নবনীতা দেবসেন একজন বাঙ্গালি কবি, লেখক এবং শিক্ষাবিদ। নবনীতা দেবসেন দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে তার বাবা- মা’র ‘ভালবাসা’ গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা নরেন্দ্র দেব ও মাতা রাধারাণী দেবী সেযুগের বিশিষ্ট কবি দম্পতি। নবনীতা দেবসেনের বাবা নরেন্দ্র দেব, মা রাধারানী দেবী ছিলেন কলকাতার এলিট ঘরানার মানুষ। গত শতকের ত্রিশের দশক বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ বলে কথিত। ওই যুগের কবি তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। রাধারানী দেবী একসময় ‘অপরাজিতা দেবী’ নামে লিখতেন। ওই নামে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ হয়, যা বাংলা সাহিত্যে বহুল আলোচিত। তাঁদের কন্যা নবনীতা অধিকতর আধুনিকতায় দীপ্ত হবেন, খুব স্বাভাবিক।
একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যকে বিচার-বিশ্লেষণ করার রসদ নবনীতা পেয়েছিলেন মায়ের জীবন এবং সাহিত্যচর্চা থেকে।
শৈশব থেকে এক বিশেষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া উনি হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাগুলি পড়তে পারেন। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস, লেডি ব্রেবোর্ণ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর , হার্ভার্ড, ইণ্ডিয়ানা (ব্লুমিংটন) ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। ১৯৭৫- ২০০২ তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তাকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট অথরিটি মানা হয়। যাদবপুরে তিনি কবি বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য ছাত্রী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সাহিত্য একদেমি পুরস্কার পান তার আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনা ‘নটী নবনীতা’ গ্রন্থের জন্যে। এছাড়াও তিনি মহাদেবী বর্মা ও ভারতীয় ভাষা পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।
নবনীতার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে জীবনের একাধিক ক্ষেত্রে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গবেষণা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, অনুবাদসাহিত্য, শিশুসাহিত্যে এক উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল তাঁর। ১৯৫৯ এ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম প্রত্যয়’ প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকায় অমিয় বাগচী ও প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের আগ্রহে। প্রথম উপন্যাস ‘আমি অনুপম’ ১৯৭৬-এ। কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস মিলে তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩৮।নবনীতা ছিলেন ভার্সেটাইল লেখক। বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে নবনীতা দেবসেন একজনই। তিনি উচ্ছল, সহাস্য, সুদূরপিয়াসী, কখনো তির্যক, কখনো ক্রুদ্ধ, প্রয়োজনে কঠোর। ছেলেভোলানো রূপকথা থেকে অচঞ্চল কবিতা, সরস ট্রাভেলগ থেকে প্রশ্নাত্মক অ্যাকাডেমিক রচনা – সবকিছুতেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। তিনি ঠিক যতটাই ধ্রুপদি, ততটাই আধুনিক বা সমকালীন।
কলকাতার একটি পত্রিকার রোববারের ম্যাগাজিনে ‘ভালো-বাসার বারান্দা’ নামে তাঁর ধারাবাহিক রচনা অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যেটি পরে বই হিসেবেও প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই : কবিতা – প্রথম প্রত্যয়, স্বাগত দেবদূত, তুমি মনস্থির করো; উপন্যাস – আমি অনুপম, প্রবাসে দৈবের বশে, অন্য দ্বীপ; গল্প – মঁসিয়ে হুলোর হলিডে, গল্পগুজব, খগেন বাবুর পৃথিবী, নাটক – অভিজ্ঞান দুষ্মন্তম; শিশু-কিশোর – পলাশপুরে পিকনিক, চাকুম চুকুম, স্বপ্নকেনার সওদাগর; গবেষণা – ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, সীতা থেকে শুরু।
ভ্রমণ আর ভ্রমণ রচনায় সিদ্ধপা, সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে তাঁর একটি অসাধারণ ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ।
ভ্রমণ-সাহিত্যে যেমন ছিলেন অনন্য, তেমনি ছিল তাঁর অসাধারণ রসবোধ। রসজ্ঞান ছিল রুচিসম্মত। ‘সেন্স অব হিউমার’ শব্দটার বোধহয় একটাই সংজ্ঞা, নবনীতা দেবসেন। নিজেকে নিয়েও রসিকতা করতেন।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। ১৯৭৬ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। তবে আমৃত্যু তাঁরা ভালো বন্ধু ছিলেন। তাদের দুই কন্যা। অন্তরা দেবসেন এবং নন্দনা সেন।জ্যেষ্ঠা অন্তরা সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং কনিষ্ঠা নন্দনা অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী।
বর্ণময় জীবন নবনীতার। নবনীতাই একমাত্র বাঙালি লেখক, যিনি ভারতীয় নানা সাহিত্য পুরস্কার কমিটির বিচারক-সদস্য ছিলেন। যেমন জ্ঞানপীঠ, সাহিত্য অ্যাকাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয় (কেন্দ্রীয়) গ্রান্টস কমিশন। বাংলা একাডেমির সঙ্গেও তিনি আমরণ যুক্ত ছিলেন। অসংখ্য গল্প, কবিতা, রম্যরচনা ও উপন্যাসের স্রষ্টা নবনীতা দেবসেন পদ্মশ্রী(২০০০ সাল) , সাহিত্য অ্যাকাডেমি, কমলকুমারী জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন।
প্রথাগত ‘‘নারীবাদী লেখক“ তকমার বিরোধী হলেও মেয়েদের কথা বারবার উঠে এসেছে নবনীতার লেখনীতে।
নবনীতা মনে করতেন মেয়েদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেই অধিকারকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে তাঁদের প্রয়োজনীয় সাহায্য জোগানোটাই ফেমিনিজ়মের নির্যাস। সারা জীবন অসংখ্য বিষয়ে কলম ধরেছেন, তার মধ্যে সামাজিক সমস্যা, দেশভাগের যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমনই আছে সমকাম, এইডস বা বার্ধক্যের মতো বিষয়। তাঁর একাধিক রূপকথার গল্পের কেন্দ্রেও রাজপুত্র নয়, থেকে গেছেন রাজকন্যারাই!
অসুস্থতা নিত্যসঙ্গী ছিল তাঁর, কিন্তু কোনও অসুস্থতাকে কখনও নিজের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি অত্যন্ত ঋজু মনের মানুষটি। ক্যান্সারের মতো মারণরোগকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন নিজের কলামে, মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে হেসে উঠেছেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পরও রসিকতা করতেন নিজেকে নিয়ে। লিখেছিলেন, ‘এই যে এত লম্বা জীবনটা কাটালুম, এর একটা যথাযথ সমাপন তো দরকার। পাঁজি-পুঁথি দেখে শুভদিন, শুভলগ্ন স্থির করে, স্বজন-বান্ধব খাইয়ে তবেই তো শুভযাত্রা।’ নিজের মৃত্যু নিয়ে এমন রসিকতা অল্প মানুষই করতে পারে। তাঁর প্রাণ ভরপুর ছিল রসের স্ফূর্তিতে, সঙ্গে ছিল বুদ্ধির দীপ্তি। আর কী আশ্চর্য, চলেও গেলেন পাঁজি-পুঁথি দেখে ক্যানসার সচেতনতা দিবসে। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর ৮১ বছর বয়সে কলকাতায় তার নিজের বাড়িতে প্রয়াত হন তিনি।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।