ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের কঠোর পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়। এই অন্দোলনে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে বিনয় কৃষ্ণ বসু প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন। বিনয় কৃষ্ণ বসু ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে।
বিনয় কৃষ্ণ বোস বা বিনয় বোস বা বিনয় বসু ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একজন ভারতীয় বিপ্লবী, যিনি সেক্রেটারিয়েট ভবনে আক্রমণ শুরু করেছিলেন; বাদল গুপ্ত ও দীনেশ চন্দ্র গুপ্তের সাথে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে রাইটার্স বিল্ডিং।
বোস ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রেবতীমোহন বসু ছিলেন একজন প্রকৌশলী। মা ক্ষীরদাবাসিনী দেবী।
বিনয় খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। শৈশব থেকেই বিনয় খুব জেদী এবং আক্রমণাত্মক ছিলেন। তার বড় সাহস ছিল এবং কোন কিছুতেই তার ভয় ছিল না। তিনি মধ্যরাতে একাই বেরিয়ে যেতেন বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের গোপন আস্তানায় এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে দেখা করতেন। স্কুল শেষ. বিনয় পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিল। কিছুক্ষণ পড়ার সুযোগ পেতেন। কিন্তু তিনি যা পড়েছেন, মন দিয়ে পড়েছেন। ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে সশস্ত্র বিপ্লব, স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালীন তিনি হেমচন্দ্র ঘোষের কাছ থেকে বিপ্লবের দীক্ষা নেন।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯২৮ সালে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স গঠন করেন। বিশ বছর বয়সী বিনয় বসু বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ঢাকা শাখায় যোগদান করেন এবং নেতৃত্ব দেন। ঢাকার কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা লোম্যান একের পর এক অন্যায় করে যাচ্ছেন। অনেককে বিনা বিচারে আটক করা হয়েছে। এমনকি বাড়ির মহিলাদের শ্লীলতাহানিও করে। বিপ্লবী দলটি একটি গোপন বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় যে লোমানকে যেকোনো উপায়ে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। বিপ্লবীরা বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অকথ্য বর্বরতার প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করেছিল। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাকে ন্যস্ত করা যায়? বিনয় বোসকে অনেক ভেবেচিন্তে নির্বাচিত করা হয়। ২৯ আগস্ট, ১৯৩০ সালে, পুলিশের মহাপরিদর্শক লোম্যান মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ব্রিটিশ অফিসারকে দেখতে যান। বিনয় দিবালোকে লোম্যানকে গুলি করে হত্যা করে। বিনয় বোসের গুলিতে গুরুতর আহত হন লোম্যান এবং তার সঙ্গী পুলিশ সুপার হডসন। একটি মেডিকেল টিম কলকাতা থেকে বিমানযোগে এসেছিল কিন্তু কুঁচকি এলাকায় গুলিবিদ্ধ লোম্যানকে বাঁচাতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে গুলি মাথার খুলিতেও লেগেছে। পুলিশ এলাকা ঘিরে ফেলে। কে খুন করেছিল? খুনি কোথায়? পুলিশ একে একে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। হাসপাতালের মেঝে ঝাড়ু দেওয়া ঝাড়ুদারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু ঝাড়ুদার বনে যাওয়া বিনয়কে মুহূর্তের মধ্যে চিনতে পারেনি পুলিশ। বিনয় বোস মুহুর্তে হাসপাতাল ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হন।
লোম্যানের হত্যাকারী আততায়ীকে পুলিশ ধরতে সক্ষম না হলেও আততায়ী যুবক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিল। বিনয়ের সন্ধানদাতার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষনা করল পুলিস। ওই সময় ভারতীয়দের উপর ইংরেজদের অত্যাচার-নির্যাতন শতগুণে বেড়ে যায় । শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটক রেখে চলে নির্যাতন । এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বক্সীর মতো নেতৃত্বকেও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখে । একের পর এক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল না । জেলের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক অসহনীয় অবস্থা। চলে নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার । সুভাষ বসু, যতীন্দ্রমোহন এবং সত্য বক্সীরাও বাদ গেলেন না এই অত্যাচার থেকে । এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভিতরে । জানা গেল এই অত্যাচারের পিছনে রয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসন । বিপ্লবীদের টার্গেট হলো কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল লে. কর্নেল সিম্পসন । তাই বিপ্লবীদের পরবর্তী অভিযান ছিল কোলকাতার ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ । তাকে হত্যার দায়িত্ব পড়ে বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশচন্দ্র গুপ্ত-এর ওপর । ৯৩০ সালের ৮ ই ডিসেম্বর দীনেশ তার দুই সঙ্গী বিনয় বসু এবং বাদল গুপ্তসহ ইউরোপীয় পোশাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেন এবং সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন । ব্রিটিশ পুলিশও তদের ওপর গুলি চালানো শুরু করেন । ফলে এই তিন তরুণ বিপ্লবীর সাথে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয় । টোয়াইনাম , প্রেন্টিস ও নেলসন সহ আরো বেশ কিছু অফিসার তাদের গুলিতে আহত হয় । পুলিশ দ্রুতই তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে ফেলে । কিন্তু এই তিনজন কোনোভাবেই ইংরেজদের হাতে ধরা দেবেন না প্রতিজ্ঞা করলেন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন আত্মহত্যা করবেন । বাদল গুপ্ত সাথে সাথেই পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিয়েছিলেন, অন্যদিকে বিনয় এবং দিনেশ নিজেদের রিভলবার দিয়ে নিজেদেরকেই গুলি করেছিলেন । বিনয়কে আর দীনেশকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে বিনয়ের চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে সবে যখন মাথার ক্ষত শুকাতে শুরু করেছে ডাক্তারির ছাত্রটি ব্যান্ডেজ খুলে নিজেই ওর মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলেন। ১৩ ই ডিসেম্বর সবার অজান্তে মহান এই বিপ্লবী পাড়ি দিলেন মহাপ্রস্থানের পথে মৃত্যুবরণ করলেন।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।