তিমির বরণের জন্ম অবিভক্ত বাংলার অধুনা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরের বড়বাজারের শিব ঠাকুর লেনের তন্ত্রসাধক ভট্টাচার্য পরিবারে। পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন সঙ্গীত বিশারদ। তিমির বরণরা ছিলেন তিন ভাই। জ্যেষ্ঠ ছিলেন মিহিরকিরণ এবং কনিষ্ঠ শিশিরশোভন। স্কুলের পড়াশোনা ওরিয়েন্টাল সিভিল স্কুল ও সিটি ট্রেনিং স্কুলে হলে। কিন্তু বাড়ির সাঙ্গীতিক পরিবেশ তাঁকে সঙ্গীতজগতে নিয়ে আসে। অল্প বয়সে পিতামাতাকে হারিয়ে বড়দাদা মিহিরকিরণের দায়িত্বেই বড় হন। প্রথম দিকে পিতার কাছে বহু সঙ্গীতজ্ঞের আনাগোনার সূত্রে তিমির বরণ তালিম নেন খ্যাতনামা খেয়ালশিল্পী রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কাছে। পরে ১৪ বৎসর বয়সে হ্যারিসন রোডের বাসিন্দা, ক্ল্যারিওনেট শিল্পী রাজেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানী ধ্রুপদী সঙ্গীতের শিক্ষার সাথে ক্ল্যারিওনেট বাজনা শেখেন। পরবর্তীতে আকৃষ্ট হন সরোদ বাদনে। তার সরোদের শিক্ষাগুরু ছিলেন আমির খাঁ ও আলাউদ্দিন খাঁ। কলকাতায় পাঁচ বছর আমির খাঁয়ের কাছে শিখে, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাইহারে আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সরোদবাদনে তালিম নেন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে ‘মাইহার ব্যান্ড’-এর অনুপ্রেরণায় তিনি অগ্রজ ও বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি ‘ফ্যামিলি অর্কেস্ট্রা’র দল গড়ে তোলেন। আর ওই বছরেই তিনি উদয়শঙ্কর নাট্যসম্প্রদায়ের সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে যোগ দিয়ে দলের সঙ্গে জার্মানি, জাপান, কানাডা ও ইউরোপ ভ্রমণ করেন। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপের নানা দেশে অনুষ্ঠান করলেন। বিশ্ব জুড়ে অভিনন্দিত হলেন উদয়শঙ্কর আর তিমির বরণ। কিন্তু ইউরোপ বেশি দিন ভাল লাগল না তিমির বরণের। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে উদয়শঙ্করের দল ছেড়ে ফিরলেন কলকাতায়। যোগ দিলেন বীরেন্দ্রনাথ সরকারের নিউ থিয়েটার্সে। অর্কেস্ট্রায়-এ বার ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে ব্যাঞ্জো, ভিওলা, চেল্লো-সহ বিভিন্ন ভিনদেশি যন্ত্রানুষঙ্গে সংযোজন করলেন পশ্চিমি সুরের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বেতারে যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ পরিবেশন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই যে, রবীন্দ্রনাথকে তিমির বরণ ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’ রাগে সরোদ শুনিয়েছিলেন এবং তাতে কবি মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন-
‘মাইহার থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে যোগ দিও। তোমার মতো লোক আমার দরকার।’
সঙ্গীতের সেই আসরে রবীন্দ্রনাথের সাথে গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ প্রমুখেরা উপস্থিত ছিলেন। ঐকতান সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিউ থিয়েটার্সে তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র দেবদাস-এ অর্কেস্ট্রার সার্থক ব্যবহার করেন। বেশ কিছুদিন এখানে কাজ করার পর মধু বসু ও বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী সাধনা বসুর আহ্বানে তাদের নাট্যসংস্থা ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্স যোগ দেন। সেখানে ওমরের স্বপ্নকথা’, ‘বিদ্যুৎপর্ণা’ প্রভৃতি ছবিতে সঙ্গীত ও নৃত্যের সুর সংযোজন করলেন তিনি। পরে মঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গীত পরিচালক হয়ে বোম্বাই ও পাকিস্তানে গিয়েছেন। ষাটের দশকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে যোগ দেন। তার শেষ কর্মক্ষেত্র ছিল মামুলি পেশাদার মঞ্চ স্টার থিয়েটার। তার রচিত গ্রন্থ হল – উদয়ের পথে সহযাত্রী।
সম্মাননা ও পুরস্কার————-
তিমির বরণ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশিকোত্তম উপাধি পান। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আলাউদ্দিন পুরস্কারসহ দেশ বিদেশের বহু পুরস্কারে সম্মানিত হন।
জীবনাবসান——–
তিমির বরণের জীবনের শেষদিনগুলি কলকাতার নেতাজীনগরে কেটেছে অসম্ভব শরীর খারাপের মধ্য দিয়ে। শেষে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে মার্চ ৮৬ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।