Categories
গল্প

শেষ ট্রেনের যাত্রী।

পর্ব ১: রাতের ট্রেন

সেদিন রাত সাড়ে দশটা। কুয়াশায় ঢাকা শীতের রাত। তরুণ সাংবাদিক ঋষি সরকার কলকাতা থেকে বর্ধমান ফিরছিলেন।
অফিসের কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা স্টেশন থেকে শেষ লোকাল ট্রেন ধরা ছাড়া উপায় ছিল না।
ট্রেনটা যখন আসল, প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লাল বাতির নিচে কাঁপছিল এক ছায়া। ঋষি খেয়াল করল—একজন মহিলা। খুব ধীরে ধীরে ট্রেনের দিকে এগোচ্ছেন। মুখ ঢাকা লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে। বড্ড নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছিল।
ঋষি নিজের কামরায় উঠল। সে ছাড়া পুরো কামরায় আর কেউ নেই। একটা জানলার পাশে বসে সে মোবাইলে হেডফোন গুঁজে সংবাদ সম্পাদনা শুরু করল।

পর্ব ২: ছায়ার সঙ্গী

ট্রেন ছেড়ে দিলো।
কুয়াশা গিলে ফেলছে রেললাইনের দুই দিক। ট্রেনের আলোতে মাঝে মাঝে জ্বলজ্বল করে উঠছে কোনও পুরনো সিগন্যাল পোস্ট বা গাছের ছায়া।
হঠাৎ ট্রেনের ভিতর একটা শব্দ হলো—টিক…টিক…টিক…
ঋষি প্রথমে ভাবল মোবাইলের শব্দ। কিন্তু না—এটা যেন কারও চুড়ির শব্দ। পাশের কামরায় কেউ কি উঠল?
ঋষি উঠে গিয়ে দেখতে পেল—সেই সাদা শাড়ির মহিলা। তিনি কামরার একেবারে কোণার আসনে বসে জানালার দিকে মুখ করে আছেন। আলোতে মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
ঋষি একটু অস্বস্তি বোধ করল, কিন্তু কিছু বলল না।
তখনই মহিলা মুখ ঘুরিয়ে বললেন—
“এই কামরাটা কি শুধু আপনার?”
ঋষি অবাক হয়ে বলল, “না তো! ট্রেন তো পাবলিক…”
মহিলা ধীরে ধীরে হেসে বললেন,
“তাহলে আপনি জানেন না, রাত সাড়ে দশটার পর এই ট্রেন আমার একার হয়।”
ঋষির বুকের মধ্যে শীতল কিছু জমে উঠল।

পর্ব ৩: মুখহীন গল্প

ঋষি সেই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারছিল না, মজা করা হচ্ছে না কি…?
মহিলার মুখটা এখনও স্পষ্ট নয়। যেন কুয়াশায় আবৃত।
সে আবার বলল—
“এখানে কেউ বেশিক্ষণ থাকে না। যাঁরা থাকেন, তাঁদের আর কোথাও ফিরতে হয় না।”
ঋষি হাসল, “আপনি লেখিকা নাকি অভিনেত্রী? খুব অভিনয় করছেন মনে হচ্ছে।”
মহিলা হঠাৎ একটানা বললেন—
“১৯৭৮ সালের জানুয়ারির এক রাত ছিল। এই ট্রেনেই আমি ফিরছিলাম। ঠিক এই কামরায়, এই জানালার পাশে। একদল লোক এসে আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কারণ আমি বিধবা হয়েও মঞ্চে গান গাইতাম। সমাজ মেনে নেয়নি।”
ঋষির হাসি মুখে জমে গেল। সে সামনে তাকিয়ে দেখল—মহিলার মুখে মাংস নেই। কেবল পুড়ে যাওয়া চামড়া আর একটা গলিত চোখ।
সে চিৎকার করে উঠতে গেল, কিন্তু শব্দ বের হলো না। গলা শুকিয়ে কাঠ।

পর্ব ৪: ছেঁড়া টিকিট

ঋষি জ্ঞান হারাল না, বরং হঠাৎই নিজেকে খুঁজে পেল সেই পুরনো দিনের ট্রেনে। যেন টাইম মেশিনে ঢুকে গেছে।
এখন কামরায় বেশ কিছু যাত্রী। সবাই পুরনো ধাঁচের পোশাক পরা। কেউ রেডিও শুনছে, কেউ বিড়ি টানছে।
ঋষি তাকিয়ে দেখে—সেই মহিলা মঞ্চে গান গাইছে, “আমারে ছাড়িয়া বন্ধু…”
কিন্তু তখনই হঠাৎ তিনজন লোক এসে ওর উপর চড়াও হলো। কেরোসিন ঢালা, চিৎকার…আর তার পর আগুন!
ঋষি চিৎকার করে উঠল—
“না! কেউ ওকে বাঁচাও! বাঁচাও!!”
চোখ মেলে দেখে সে ট্রেনের সিটে বসে। গলা ভিজে গেছে ঘামে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই।
শুধু তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া টিকিট—১৯৭৮ সালের বর্ধমান লোকালের।

পর্ব ৫: শেষ স্টেশন

বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন ঢুকতেই ঋষি নেমে পড়ল। রাত তখন প্রায় ১টা।
প্ল্যাটফর্মে একজন বৃদ্ধ হকার চা বিক্রি করছিল। ঋষি ছুটে গেল ওর কাছে।
“এই ট্রেনে একটা মহিলা ছিল, সাদা শাড়ি পরা, পুড়ে গেছিল নাকি… এমন কেউ কি ছিল?”
চাওয়ালা তাকিয়ে বলল,
“আপনি ওনার কামরায় ছিলেন? ভাগ্য ভালো, ফিরে এসেছেন। সবাই তো ফেরে না। উনি গান পছন্দ করতেন, কিন্তু ওর গান সমাজ মেনে নেয়নি।”
“কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
চাওয়ালা বলল,
“কারণ আমি সেই রাতে ট্রেনেই ছিলাম। তখন আমি কেরোসিন নিয়ে এসেছিলাম…”
ঋষি হতভম্ব!
বৃদ্ধ হঠাৎ হেসে বলল,
“এখন আমিও মরেছি, আপনি বেঁচে থাকুন। এটাই অনেক।”
চাওয়ালা হঠাৎ মিলিয়ে গেল কুয়াশায়।
ঋষি মাথা ধরে স্টেশনের বেঞ্চে বসে পড়ল।

শেষ ভাগ: শিরোনাম ও পুনর্জন্ম

ঋষি বাড়ি ফিরে সেই কাহিনি লিখল।
নাম দিল—“শেষ ট্রেনের যাত্রী”
কোনও সম্পাদক সাহস পেল না ছাপাতে।
এক বছর পর, সেই স্টেশনের গায়ে একটা নামহীন কবরে সে একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি রাখল। আর লিখল—
“তোমার গান আমি শুনেছি, এবার তুমি শান্তিতে ঘুমাও।”

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *