আমরা সবাই জানি শিশুই হচ্ছে যেকোনো জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক, যার হাতে থাকবে দেশগড়ার কাজ। তাই শিশু গাছকে যেমন উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হয়, তেমনি মানবশিশুকেও উপযুক্ত ভাবে গড়ে তোলাই আমাদের অন্যতম কর্তব্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো। অত্যন্ত দুঃখ ও অনুতাপের বিষয় যে –“কাঁদে কোটি মার কোলে অন্নহীন ভগবান।“ ১৩৫ কোটি মানুষের বাস ভারতে। প্রতি মুহূর্তে ভারতে শিশু জন্মাচ্ছে। কিন্তু সব শিশু কী বাঁচবার মতো খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা পাচ্ছে?
স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৪ বছর পরেও অনেক নবজাতকের চোখের সামনে কোনো আলো নেই, আছে শুধু জমাট অন্ধকার-তাদের জীবন দুঃস্বপ্নে ঘেরা ,দুঃখবেদনায় ভরা। নবজাতকেরা অসহায় দৃষ্টি নিয়ে দেশের মানুষের কাছে একটু স্নেহ ভালোবাসা,মমতা অকাঙ্খা করে। সেই সঙ্গে তাদের একটু খানি চাওয়া –শুধু দুবেলা দু-মুঠো অন্ন, থাকবার মতো একটু বাসস্থান,আর পরিধান করার মতো বস্ত্র।
কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ,শিশু একটু বড় হতে না হতেই তাকে মায়ের কোল ছেড়ে যেতে হচ্ছে কাজের সন্ধানে। যে বয়সে শিশুদের হাতে খেলনা,বইপত্র,কাগজকলম থাকবার কথা,সেই বয়সে শিশুর হাতে থাকছে হাতুড়ি কাস্তে আর কাজের বোঝা।কারণ তারা যে শিশুশ্রমিক।শ্রম দান করেই তাদের অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হবে-এর চেয়ে কলঙ্কের জিনিস কি হতে পারে! ঐ অতি অল্প বয়সে কঠোর কাজের চাপে ভগ্নপ্রায় শরীর নিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই অনেক শিশুর জীবন দীপ নিভে যাচ্ছে। যার খবর আমরা কেউ জানতে পারি না ।
আমরা প্রতি বছর আড়ম্বর করে “শিশু শ্রমিক বিরোধী দিবস ” পালন করি 12ই জুন তারিখে। আন্তর্জাতিক হিসাবে প্রতি বছর আমরা ঐ 12ই জুন দিনটিকে পালন করে শিশুদের কল্যানের জন্য নানাপ্রকারের গালভরা বক্তৃতা দিয়ে থাকি ।সেই দিন হয়তো বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা কিছু শিশুকে ভালো ভালো পোষাক ও খাবার দিয়ে সন্তুষ্ট করে। মনে হয় আমরা যেন শিশুদের কতই না ভালোবাসি!
শোনা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (WHO) দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের কল্যাণের জন্য প্রচুর টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু সেই টাকাগুলোই বা কোথায় যায়? সেই বরাদ্দ টাকা কতটুকু শিশুদের ভাগ্যে জোটে ? উত্তর হল না । দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরুদ্ধে আইন তৈরী হয়েছে। আছে শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগ, শ্রম দফতর । কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু স্কুলে না গিয়ে চলে যাচ্ছে চায়ের দোকানে ,রেস্তোরায়,পাথর খাদানে,বাজির দোকানে ,মুদির দোকানে হোটেলে, ইটের ভাটিতে ,সিমেন্ট কারখানা, দেশলাই কারখানায় সেখানে তারা অল্প বেতনে সারাদিন কাজ করে চলেছে। নিষ্ঠুর হৃদয় মালিকেরা তাদের অল্প বেতন দিয়ে সারাদিন পরিশ্রম করাচ্ছে । এই শিশু শ্রমিক ঠিক মতো কাজ না করলে তাদের কাজ থেকে ছাটাই করছে। এদের কর্মে নিয়োগের সময় মালিকের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না। কোনো শর্ত নাই, তাই কোনো কারনে এদের মৃত্যু হলে বা হাত-পা ভাঙ্গলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো দায়বদ্ধতা নেই । এমনকি তাদের কোনো কৈফিয়েৎ দিতেও হয় না । তাই যতক্ষণ হাত-পা চলবে, ততক্ষণ কাজ না চললেই বাদ , তাড়িয়ে দাও । শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলে খুব স্বাভাবিক দৃশ্য অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গৃহস্ত বাড়িতে চাকর বা চাকরানীর কাজ করে অল্প বেতনে। অভাবের সংসারে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মাঠে কাজ করতে যেতে হয়, গরু চড়াতে হয়। আরও বেদনা দায়ক ঘটনা হচ্ছে যে,এই সব ছেলে মেয়েরা দুটো পয়সা রোজগারের আশায় আস্তাকুঁড় বা আবর্জনা ঘেঁটে বেড়ায়-দুটো প্লাস্টিক জিনিস বা বোতল,ছেঁড়া জুতো,লোহার টুকরো,ভাঙ্গা বালতি সংগ্রহ করে এবং দিন শেষে অল্প কিছু টাকা পয়সা রোজগার করে। কী সৌভাগ্য এই সমস্ত অল্পবয়স্ক ছেলে মেয়ের ! বর্তমান ভারতবর্ষে বিভিন্ন সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে ৮/১০ কোটি শিশুশ্রমিক কর্মরত। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই সরকারি হিসাবে ৮/৯ লক্ষ শিশুশ্রমিক কাজ করছে। এই সমস্ত শিশুশ্রমিক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কর্ম করে যাচ্ছে। বোমাবাজির কারখানায় কত শিশুর প্রাণ যাচ্ছে তার হিসাব নাই। কয়েক বছর আগে বাগনানে একটা বাজির কারখানায় বিস্ফোরন হয়েছিল এবং তাতে একাধিক শিশুশ্রমিকের প্রাণ যায়। এদের প্রাণের যেন কোনো মূল্য নাই।
ইতিপূর্বে ভারত সরকার ২০০০ সালের মধ্যে শিশুশ্রমিক প্রথা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আজ ২০২১ সালেও শিশুশ্রমিক প্রথা যথারীতি একই চলছে । দেশের সরকার শিশুশ্রমিক নিয়োগ করা বেআইনি বলে ঘোষণা করেছিল। সুপ্রিমকোর্টে ১৯৮৬ সালে আদেশ দিয়েছিল যে, শিশুশ্রমিক সম্পর্কিত আইন লঙ্ঘিত হলে প্রতি শিশুশ্রমিকের জন্য মালিককে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে।সেই টাকা “শিশুশ্রমিক পুনর্বাসন ও কল্যান তহবিলে “ জমা দিতে হবে। তাছাড়া এই সব অসহায় শিশুশ্রমিকের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে রাজ্য সরকারগুলিকেই । সরকার শিশুশ্রমিকদের জন্য একটা Action Plan গ্রহণ করছে । এতে শিশুশ্রমিকদের ২ ঘণ্টা লেখা পড়া শিখানোর জন্য সরকারকে অর্থ ব্যয় করতে হবে। কিন্তু এই সব আইন থাকা সত্ত্বেও মালিকপক্ষ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শিশুদের নানাপ্রকার বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ কার্যে নিযুক্ত করছে। পুলিশ-প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শোনা যায় না।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমমন্ত্রির সভাপতিত্বে ‘The Nation Authority to the alimination of Child-labour’ নামে একটা সংস্থা গড়ে তুলেছে। এই সংস্থাটি হয়তো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই গঠিত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে –কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শিশুশ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করার নীতি প্রণয়ন করা, শিশুশ্রমিকদের বৃত্তিমূলক ও অর্থকরী শিক্ষাদানের সঙ্গে উপযুক্ত আহারের সংস্থান করা ,শিশুদের দরিদ্র পিতা মাতাদের আর্থিক উপার্জনে সহায়তা দেওয়া ও নতুন করে শিশুশ্রমিক সৃষ্টির সম্ভাবনা দূর করা ইত্যাদি এই সংস্থার কাজ। এমনকি দেশের শিক্ষার অধিকার আইনে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুদের বিনামূল্যে এবং আবশ্যিক ভাবে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থাপনার কথা বলা আছে।
আবার এর সাথে নতুন আইন তৈরি হয়েছে যদি সেই সরকারি আদেশ না মানে বা অগ্রাহ্য করে তবে সেই মালিককে ১০ থেকে ২০হাজার টাকা জরিমানা এবং সেই সাথে তিন মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত কারাবাসের আইন করা হয়েছে।
এই সমস্ত সরকারি নির্দেশ ও কঠোর আইন কানুন থাকলেও মালিকশ্রেনী বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিশুশ্রমিক নিয়োগ করে চলেছে, কারন তারা জানে এই সব শ্রমিককে অল্প বেতন দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে অনেক বেশি লাভ ।সকলেই জানে যে এটা একটা অমানবিক কাজ কিন্তু এখনও শিশুশ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করা অলীক স্বপ্ন মাত্র।
আমার মনে হয় ,শিশুশ্রমিক প্রথা বন্ধ করতে হলে কয়েকটি বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে। যে সব শিশু অর্থের জন্য চায়ের দোকানে বা কারখানায় যায় তাদের পিতামাতাকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে, যাতে তারা তাদের সংসার চালাবার জন্য নিজের ছেলেমেয়েদের পরের বাড়িতে বা কারখানায় না পাঠায় ।দ্বিতীয়ত,দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা যাতে বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে আগ্রহী হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকারকের সাথে সাথে সমস্ত শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তৃতীয়তঃ শিশুশ্রমিক নিয়োগের বিরুদ্ধে যে সব আইন তৈরী হয়েছে সেগুলোকে কঠোর ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করতে হবে, মালিক শ্রেণীকে বোঝাতে হবে যে, এভাবে শিশুশ্রমিক নিয়োগ করে শিশুদের জীবন নষ্ট করবেন না। এটা একটা অমানবিক কাজ । আর ছেলে মেয়েদের পিতামাতাকে বুঝতে হবে যে, এভাবে অল্প কিছু টাকা আয় করার জন্য নিজেদের ছেলেমেয়েদের অন্য কোথাও কাজ করতে পাঠাবেন না। এই সমস্ত বিষয়ে নজর রাখলে আশা করা যায় ধীরে ধীরে শিশুশ্রম প্রথা দূর হবে এবং সমাজের একটা কলঙ্ক মোচন করা সম্ভব হবে।
একদা জাতির জনক মহাত্মাগান্ধী খুব দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন- “শিশুকে অর্থের বিনিময়ে শ্রম করানোর চেয়ে বড় আভিশাপ আর কিছুই হতে পারে না।“ চরম পরিতাপের বিষয় এটাই যে গান্ধীজীর জন্মের দেড়শত বছরে তাঁর জন্মজয়ন্তী আমরা সাড়ম্বরে গোটা দেশ জুড়ে পালন করছি, অথচ তার কথা মত কাজ করছি না।
![](https://monsaras.com/wp-content/uploads/2023/06/world-day-against-child-labour-slide1.png)