একদিন মহাপ্রভু গেছেন শ্রীজগন্নাথ দর্শন করতে, সিংহদ্বারে দ্বারপাল তাঁকে দেখেই এগিয়ে এসে চরণবন্দনা করলেন । অমনই মহাপ্রভু , “কোথায় আমার কৃষ্ণ ? আমার প্রাণনাথ কোথায় গো? তুমি আমার সখা ; আমায় দেখাও সখা ,আমার প্রাণনাথকে ।”—-বলে অনুনয় করার মত দ্বারপালের হাতখানা জড়িয়ে ধরলেন। দ্বারপাল বললেন, “আমি দর্শন করাচ্ছি আপনাকে , চলুন ।” শ্রীমন্ মহাপ্রভুর হাত ধরে মন্দিরের জগমোহনে নিয়ে গেলেন দ্বারপাল। আর তারপর , শ্রীপুরুষোত্তমকে দেখিয়ে বললেন, “ঐ যে তিনি ! আপনার প্রাণনাথ।”
গরুর স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করতেন মহাপ্রভু । তিনি কখনোই গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথ দর্শন করতেন না । প্রতিদিনের মত আজও দ্বারপাল নিয়ে তাঁকে গরুর স্তম্ভের পিছনে বাঁ দিকটায়(গরুড়ের বাম দিক) দাঁড় করালেন এবং সেখান থেকেই মহাপ্রভু দু’নয়ন মেলে জগন্নাথকে দর্শন করলেন । জগন্নাথ আজ এখন মুরলীবদন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ধরা দিলেন মহাপ্রভুর নেত্রে । —-এই লীলার কথা রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাঁর ‘শ্রীচৈতন্যস্তবকল্পবৃক্ষ’ গ্রন্থের সপ্তম শ্লোকে প্রকাশ করেছেন।
“ক্ক মে কান্তঃ কৃষ্ণস্ত্বরিতমিহ তং লোকয়
সখে ! ত্বমবেতি দ্বারাধিপমভিবদন্নুন্মদ ইব।।
দ্রুতং গচ্ছ দ্রস্টুং প্রিয়মিতি তদুক্তেন
ধৃততদ্ভুতজান্তর্গৌরাঙ্গো হৃদয় উদয়ন্মাং মদয়তি ।।”
এমন সময় গোপালবল্লভ ভোগ লাগলো জগন্নাথের । ভোগের পর শঙ্খ , ঘন্টা আদি সহ আরতি হল । ভোগ সরলে জগন্নাথের সেবকগণ প্রসাদ নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে এলেন। তাঁকে প্রসাদী মালা পরিয়ে প্রসাদ হাতে দিলেন। সেই প্রসাদের আঘ্রাণ নিলেন মহাপ্রভু আর বললেন, “বহুমূল্য প্রসাদ ! এ যে সর্বোত্তম বস্তু !” এর অল্প নিয়ে তিনি জিহ্বায় দিলেন আর বাকিটা সেবক গোবিন্দ দাস আঁচলে বেঁধে নিলেন। সেই কণিকা মাত্র প্রসাদের অমৃতাস্বাদ করে প্রভুর মনে যেন চমৎকার হলো, সর্বাঙ্গে পুলক তাঁর । আর নেত্র থেকে অশ্রুধারা বইতে থাকলো। তিনি আপন মনে বিস্মিত হয়ে বললেন , “এই দ্রব্যে এত স্বাদ কোথা থেকে এলো ! ওহ্, এতে তো কৃষ্ণের অধরামৃত সঞ্চারিত হয়েছে ! তাই বুঝি এই বস্তু এত মধুময় হয়েছে স্বাদে !”—- এ কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মধ্যে প্রেমাবেশ হলো । কিন্তু পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সম্বরণ করে নিলেন জগন্নাথের সেবকরা তাঁর সামনে আসায় ।
মহাপ্রভু বারবার ‘সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত’ বলতে থাকলেন। জগন্নাথের সেবক মহাপ্রভুর মুখে এই শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রভু , সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে কি? অর্থ কি এর ?” তখন মহাপ্রভু বললেন , “এই যে তুমি আমায় কৃষ্ণের অধরামৃত দিলে ,এই বস্তু ব্রহ্মা আদি দেবতাদেরও দুর্লভ এবং অমৃতের স্বাদকেও নিন্দনীয় হতে হয় এর কাছে। শ্রীকৃষ্ণের ভুক্তাবশেষের নামই হল ফেলা । তিনি ভাগ্যবান যিনি ফেলামৃত লব মাত্র পান । সামান্য ভাগ্য যার সে এই বস্তু প্রাপ্ত হতে পারে না। যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ কৃপা তিনি তা পান। আর, তিনিই সুকৃতীবান যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের কৃপা থাকে । অর্থাৎ সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে হল যাঁর সুকৃতি লাভ হয় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ হয় তিনিই ফেলা রূপ অমৃত লাভ করতে পারেন ; শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত আস্বাদনের অধিকারী হন।”— এই বলে মহাপ্রভু সকলকে বিদায় দিলেন । তারপর জগন্নাথের উপলভোগ দর্শন করে গম্ভীরায় ফিরে এলেন।
মধ্যাহ্নকালে ভিক্ষা নির্বাহণ করলেন মহাপ্রভু । কিন্তু অন্তরে কৃষ্ণ-অধরামৃতের স্বাদ সর্বদা স্মরণ হচ্ছে তাঁর। বাইরে কর্ম করছেন অথচ অন্তরে প্রেমে গরগর মন হয়ে আছে। সেই সঘন আবেশ অত্যন্ত কষ্ট করে সম্বরণ করছেন তিনি। সন্ধ্যা বেলায় যখন পুনরায় নিজের পার্ষদগণের সাথে বসে কৃষ্ণকথা রঙ্গে নিভৃতে কাল কাটাচ্ছেন , তখন সেবক গোবিন্দ দাসকে ইঙ্গিত দিলেন দুপুরের সেই আঁচলে বেঁধে রাখা প্রসাদ এখন আনার জন্য । পুরী-ভারতী তথা তাঁর গণের সন্ন্যাসীদের জন্য কিছুটা পাঠিয়ে দেওয়া হলো , আর সেখানে উপস্থিত রামানন্দ রায় , সার্বভৌম ভট্টাচার্য , স্বরূপ দামোদর ও অন্যান্যদের সেই প্রসাদ বিতরণ করা হলো। প্রসাদের সৌরভ-মাধুর্য আস্বাদন করেই সকলে বিস্মিত হলেন । যে প্রসাদ এমন দিব্য সৌরভ সম্পন্ন , সেই প্রসাদের স্বাদ না জানি কেমন অলৌকিক হবে ! তখন মহাপ্রভু বললেন , “দ্যাখো, প্রসাদে যা যা আছে যেমন ধরো আখের গুড় , কর্পূর, মরিচ, এলাচ , লবঙ্গ,কাবাবচিনি, দারুচিনি এইগুলো সব প্রাকৃত দ্রব্য। তোমরা সকলেই এই সব প্রাকৃত দ্রব্যগুলোর স্বাদ, সুগন্ধ কেমন জানো । কিন্তু এই প্রসাদে তাহলে এত আমোদ কোথা থেকে এলো? প্রসাদের এই সৌরভ —এতো লোকাতীত ! এর আস্বাদন তাহলে কত না দিব্য ! আস্বাদ করে দেখ সকলের মনে প্রতীত হবে তাহলে। আস্বাদন তো অনেক পরের কথা , কেবল গন্ধেই মন মাতিয়ে দেয়। তাই না ! প্রসাদের এমন মাধুর্য যে আস্বাদন সময়ে আস্বাদন ব্যতীত অন্য সকল কিছু বিস্মৃত করিয়ে দেয় । কেন? কারণ , শ্রীকৃষ্ণের অধর স্পর্শ করেছে এই প্রসাদ। তাঁর অধর রসের গুণ সব সঞ্চারিত হয়েছে প্রসাদে, তাইতো অলৌকিক সুগন্ধ মাধুর্য হয়েছে এমন ! মহাভক্তি করে সকলে প্রসাদ আস্বাদ করো।”
সকলে হরিধ্বনি দিয়ে প্রসাদ আস্বাদন করলেন এবং আস্বাদন মাত্রই সকলের মন প্রেমে মত্ত হল। মহাপ্রভুর মধ্যে প্রেমাবেশ সে সময় । তিনি আজ্ঞা দিলেন রামানন্দ রায় কে শ্লোক পাঠ করতে। রামানন্দ রায় শ্রীমদ্ ভাগবতের শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।
“সুরতবর্দ্ধনং শোক নাশনং , স্বরিতবেণুনা সুষ্ঠচুম্বিতম্ ।
ইতররাগবিস্মারণং নৃণাং, বিতর বীর নস্তেহধরামৃতম্ ।।”
(শ্রীমদ্ ভাগবত, ১০, ৩১, ১৪ শ্লোক)
—– শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসমন্ডল থেকে অকস্মাৎ অন্তর্ধান হয়ে যান, শোকাকুলা গোপীরা বিলাপ করে বলছেন তখন— হে বীর ! তোমার সেই সুরতবর্ধনকারী (সম্ভোগেচ্ছা ক্রমশঃ বর্ধনকারী) অধরের সুধা যা তোমার বিরহ জনিত শোক রাশিকে নাশ করে তা আমাদেরকে বিতরণ কর । তোমার অধরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বেণু পঞ্চম সুরে নাদিত হয়ে মানবের সকল আসক্তি ভুলিয়ে দেয় ; সেই অধরের অমৃত আমাদের দাও।
সেই শ্লোক শ্রবণ করে রসরাজ-মহাভাবের মিলিত স্বরূপ মহাপ্রভু তখন ভাবাবিষ্ট হয়ে রাধার উৎকণ্ঠা জনিত একটি শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।
“ব্রজাতুলকুলাঙ্গনেতর রসালি তৃষ্ণাহরঃ ,
প্রদীব্যদধরামৃতঃ সুকৃতিলভ্য ফেললাবঃ।
সুধাজিদহিবল্লিকাসুদলবীটিকাচর্বিতঃ,
স মে মদনমোহনঃ সখি তনোতি জিহ্বাস্পৃহাম্।।”
(গোবিন্দলীলামৃত, ৮, ৮শ্লোক)
—- শ্রীমতী রাধিকা তাঁর সখী বিশাখাকে বলছেন, হে সখি ! অনন্যা ব্রজকুলবতী ললনাদের যিনি অধরামৃত দ্বারা আনন্দ দান করে তাঁদের অন্য সকল রস-তৃষ্ণাকে হরণ করেন , যাঁর চর্বিত তাম্বুলে অমৃতাপেক্ষা অধিক স্বাদ—-সেই শ্রীমদনমোহন আমার জিহ্বার স্পৃহাকে বিস্তৃতি দান করেছেন।
তারপর মহাপ্রভু নিজেই দুই শ্লোকের অর্থ প্রলাপের মত উচ্চারণ করে গেলেন । সকলে শ্রবণ করে ভাবের ভিয়ানে বিহ্বল হলেন। গ্রন্থ– মহাপ্রভুর মধুময় কথা , লেখিকা —- রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক, প্রকাশক–তথাগত।