Categories
প্রবন্ধ

মানুষের ব্যবহার –একটি বিশেষ পর্যালোচনা : দিলীপ  রায়।

 

কথিত আছে “মানুষের ব্যবহারই মানুষের পরিচয়” ।
রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে, অলিতে-গলিতে, বাজার-হাটে, কান পাতলে শোনা যায় মানুষের ব্যবহারের দৈনন্দিন কড়চা । মুখরোচক বাহার । মানুষের হিতার্থে কিছু মানুষের নিঃস্বার্থ প্রয়াসের কাহিনীও দৈনন্দিন কড়চার প্রাসঙ্গিক অঙ্গ, যদিও সেটা সীমিত । সুতরাং মানুষের ব্যবহারের ব্যাখার ব্যাপ্তি, ব্যাপক । দৈনন্দিন জীবনে মানুষের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বয়সের একটা প্রেক্ষাপট কাজ করে । বাচ্চা-হাল্কা-মধ্য  বয়স্ক মানুষদের ব্যবহারের বিন্যাসের পরিবর্তন  অহরহ । জনশ্রুতি, “হাল্কা বয়সের মানুষের কথা বলার মধ্যে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে রাগান্বিত সুরের প্রাদুর্ভাব ঘটার সম্ভাবনা উজ্জ্বল । আবার বয়স্ক মানুষদের মধ্যে কথোপকথনে বা কথা বলার আদান-প্রদানে অনেক মার্জিত স্বভাবের পরিচয়, পরিলক্ষিত ।“ তাই  মানুষের ব্যবহারের প্রকাশ স্থান-কাল-পাত্র একটা অপরিহার্য প্রেক্ষিত । তাই বলা চলে, মানুষের ব্যবহারের প্রেক্ষাপট আলোচনার ক্ষেত্রে “নানা মুনির নানা মত” কথাটি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক ।
ব্যবহারিক জীবনের সেকাল ও একালের দিকে তাকালে আগের দিনের মানুষের ব্যবহারের অনেক পরিবর্তন সহজেই অনুমেয় । যোগাযোগের প্রেক্ষাপটে আগের   মানুষের নিকট পোষ্ট অফিসের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম । পোষ্ট কার্ডে চিঠি লেখার ভিতর দিয়ে মানুষের ব্যবহারের অবয়ব ফুটে উঠতো । তদানীন্তনকালের চিঠি লেখাটা ছিলো শিল্পকলার অপরিহার্য অঙ্গ । বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে চিঠি লেখার সুঅভ্যাস প্রকৃত অর্থে নিস্প্রভ । কালের  নিয়মে এসে গেছে ডিজিটাল যুগ । টেক-সেভির সুবিধার বিভিন্ন স্তর । ইন্টারনেটের  ব্যবহারের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা । যার ফলে হোয়াটস্‌ অ্যাপের মাধ্যমে মানুষ দূরের মানুষের সঙ্গে এমনকি সুদূর আমেরিকা, লন্ডন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ইত্যাদি দেশের মানুষের সঙ্গে নিমেষের মধ্যে যোগাযোগ   । সুতরাং আজকের কম্পিউটারাইজেশনের যুগে মানুষের ব্যবহারিক জীবনও খানিকটা নয় অনেকটাই বদলে গেছে । একটা ঘটনার উল্লেখ এখানে প্রনিধানযোগ্য । রাস্তায় হাঁটা চলমান মানুষটিকে অন্য আর একজন বিশিষ্ট চলমান মানুষ তাঁর প্রয়োজনে জিজ্ঞাসা করলেন, “দাদা রেলওয়ে স্টেশনটি কোন্‌দিকে ?” কিন্তু রাস্তায় হাঁটা ঐ বিশিষ্টজন যাকে জিজ্ঞাসা করলেন সেই পথিকবর  শুনতেই পেলেন না ! কারণ তাঁর দুটি কানে হেড্‌ ফোনের তার গোঁজা । ঐ পথযাত্রী কানে হেড্‌ ফোন লাগিয়ে তাঁর প্রিয় গান শুনতেই তখন ব্যস্ত । এতেই স্পষ্ট, মানুষের ব্যবহারিক জীবনে টেক-সেভির প্রভাব অবর্ণনীয়  ।  অন্যদিকে  কম্পিউটারের ব্যবহারের দিকে তাকালে দেখা যায় আগে কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা বড় টেবিলের প্রয়োজনীয়তা ছিলো অনস্বীকার্য । কিন্তু বর্তমানে টেবিল কম্পিউটারের জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে ল্যাপটপ । যেটা সহজেই অল্প জায়গায় ব্যবহারযোগ্য । এতেই স্পষ্ট, ব্যবহারিক জীবনে মানুষ ডিজিটাল যুগের দিকে ধাবিত ।
( ২ )
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব । সমাজবদ্ধভাবে একত্রে বসবাস করাটা মানুষের পরম্পরা । সুতরাং সমাজের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা অনস্বীকার্য । দায়বদ্ধতার নিরিখে মানুষের ভূমিকা অগ্রগণ্য । এজন্য মানুষের মধ্যে প্রচলিত “বাবহারই মানুষের নিজস্ব অবয়ব” । সমাজের গণ্যমান্য মানুষজন যেমন শ্রদ্ধার পাত্র, তেমনি সাধারণ মানুষের আচরণও শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে সমভাবে উল্লেখযোগ্য । আবার অন্যদিকে ব্যবহারিক আচরণও ক্রমপরিবর্তনশীল । যেমন আগে গুরুজন বা মাস্টারমহাশয় দেখলেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গড় হয়ে প্রণাম করার রেওয়াজ সর্বজনবিদিত । নিদেনপক্ষে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাটা ছিলো অবধারিত । আজকের যুগে গুরুজনদের শ্রদ্ধা জানানোর আগের ব্যবহারিক রীতির দৃশ্য স্পষ্টতই দুর্ল্ভ । সুতরাং সমাজের গণ্যমান্য  মানুষের প্রতি ব্যবহারের ধরণ আগের চেয়ে বর্তমানে অনেক পরিবর্তন । সমাজের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, ব্যবহারের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । তাই সঠিক ব্যবহার সমাজ উন্নয়নে আবশ্যক  ।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বেশভূষা ব্যবহারিক শ্রেণিবিন্যাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকার দাবি রাখে । আমরা জানি পোষাক পরিচ্ছদ শরীর আবরণের বিশেষ মাধ্যম । কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপটে বেশভুষারও পরিবর্তন লক্ষণীয় । সর্বকালেই ভাল পোষাকের গুণ সমাদৃত । পোষাক পরিধানেও মানুষের ব্যবহারিক রুচির বার্তা বহনের ধারক । আগে মানুষের মধ্যে ধুতি ও শাড়ি পরবার রেওয়াজ ছিলো সামাজিক রীতিনীতির অঙ্গ । এমনকি সামাজিকতার দিক থেকেও সর্বজনগ্রাহ্য ।  যার জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে এমনকি স্কুল-কলেজে, কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের ধুতির ব্যবহার ছিলো সাবলীল । অন্যদিকে মহিলাদের শাড়ি ছিলো অঙ্গের ভূষণ, সৌন্দর্য্যে উৎকৃষ্টের পরম্পরা । সুতরাং বলা চলে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে রুচিশীল পোষাকের ব্যবহার শালীনতাবোধের ধারক ও বাহক। ইদানীং পোষাকের পরিবর্তন ভীষণভাবে চোখে লাগে  । স্বল্প পোষাক পরিচ্ছদে মানুষ অভ্যস্ত । কলেজের-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এমনকি যুব সমাজের মধ্যে স্বল্প পোষাকের ব্যবহার অহরহ । বয়স্ক মানুষও হাফ্‌-প্যান্ট-গেঞ্জি গায়ে ইদানীং বাজারে বাজার করতে স্বচ্ছন্দ । সপিং মলগুলিতে ঢুকলে বোঝা যায়, যুব সমাজ কতোটা স্বল্প পোষাকমুখি । সন্তানের মায়েরা পর্যন্ত ফ্রকে অভ্যস্ত । সুতরাং ব্যবহারিক জীবনে আজকের দিনের মানুষ হাল্কা ও স্বল্প পোষাকের দিকে বেশীমাত্রায় ঝুঁকছে  ।
( ৩ )
চলমান জীবনে নেশার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । অথচ নেশার প্রকারভেদ দিন-দিন  পাল্টাচ্ছে । আগে নেশা বলতে ঐ বই পড়া । বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার অভ্যাস মানুষের মধ্যে দেখা যেতো । ছেলেরা বিশেষ করে  ছাত্ররা ফুটবলের নেশায় মাঠে ছুটতো । চলমান জীবনে তখন ফুটবল খেলাটা ছিলো ভীষণ জনপ্রিয় । মেয়েদের মধ্যে অ্যাথলেটিক্স ছিলো অগ্রগ্ণ্য । তা ছাড়া খেলাধূলার সু্যোগ মেয়েদের ক্ষেত্রে খুব কম ছিলো । তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে ঐ রান-কিৎ কিৎ-ইত্যাদি খেলার নেশা উল্লেখের দাবী রাখে । আগে  রেডিও’র  গান শোনার কদর ছিলো চোখে পড়ার মতো । রেডিও ছিলো তদানীন্তনকালের আ্মোদপ্রমোদের উল্লেখযোগ্য  মাধ্যম । বিড়ি ও সিগারেট খাওয়ার নেশা মানুষের ব্যবহারিক জীবনে আগাগোড়াই কম । একালে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি পড়ার ধৈর্য  হতাশাজনক । বরং কম্পিউটারের মাউস ঘুরিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বজয়ের আকাঙ্খা প্রবল । রেডিও’র পরিবর্তে টি ভি’র ব্যবহার ঘরে ঘরে । সিনেমা দেখার জন্য সিনেমা হলে গিয়ে  সিনেমা দেখার প্রবণতা এখন কম । সুতরাং বলা চলে,  মানুষের ব্যবহারিক জীবনে নেশার পরিবর্তন ব্যপকভাবে পরিলক্ষিত ।
আজকের দিনে মোবাইলের ব্যবহার ষোলোআনা । অথচ আগে কোনো একটা পরিবারের বিশেষ করে মৃত্যুর খবর দেওয়ার জন্য পোষ্ট অফিসে ছুটতে হতো টেলিগ্রাম করার জন্য । আজকের দিনে প্রায় মানুষের হাতে মোবাইল । মোবাইলে নেটের ব্যবহার সর্বত্র ।  আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব ধরনের মানুষের মধ্যে রাস্তাঘাটে মোবাইলে নেট ব্যবহার করার দৃশ্য অনবরত । সুতরাং ব্যবহারিক জীবনে মোবাইলের কদর ছাত্র-ছাত্রী, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, বাবা-মা, সকলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান । এটা বাস্তব যে, মোবাইলের সঠিক ব্যবহার সমাজ জীবন উন্নয়নে অগ্রগণ্য  ।
( ৪ )
চুরি করার ধরণও পরিবর্তনশীল । ব্যবহারিক জীবনে মানুষ চোরের উপদ্রব বলতে আগে যেটা বুঝতেন, চোর-ডাকাত রাত্রিবেলায় গৃহস্তের বাড়ি ঢুকে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দেওয়ার রেওয়াজ । আজকের দিনে চোর বা ডাকাত বিভিন্ন আধুনিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ঘরে ঢুকে মূল্যমান সোনা-গয়নার অলংকার নিয়ে পালাতে অভ্যস্ত । চোর-ডাকাতদের  আর খাট্‌, রেফ্রিজারেটার, টি ভি, ইত্যাদিতে নজর নেই ।  সুতরাং চুরি-ডাকাতির ব্যবহারিক ধরণও ক্রমপরিবর্তনশীল । চুরি করার প্রক্রিয়াও আধুনিক ও  উন্নতমানের  ।
ব্যবহারিক ধরণ বা ব্যবহারের প্রয়োগের কাহিনী অনেক লম্বা । উপরের আলোচনার প্রেক্ষাপটে এটা সুস্পষ্ট যে,  কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যবহারের পরিবর্তন ক্রমবর্ধমান । তবে গঠনমূলক ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবহার সমাজজীবনে উন্নয়নের হাতিয়ার । বাস্তবসম্মত ও রুচিসম্মত ব্যবহার অবশ্যই কাম্য । প্রকৃত ব্যবহার শিক্ষার যেমন অঙ্গ তেমনি মানুষের মধ্যে চেতনা বিকাশের নিশানা । সুতরাং সমাজ উন্নয়নে  সঠিক ব্যবহারের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।
—–০——-

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *