Categories
রিভিউ

সে তুমি কবি হও বা নাও হও, আমি জানি কবিতার ঈশ্বর তুমি, কবিতা ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আমি ঈশ্বরের নামমাত্র প্রশংসা করব না,
বরং ঈশ্বরের উচিত আমার স্তুতি করা,আমার হৃদয়ের
সামনে মাথা নত করে ক্রন্দন করা,আমার অশ্রু অথবা
অফুরন্ত আবেগের জন্য আবার একটি জন্ম উপহার দেওয়া,যাতে আমি জ্বলন্ত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত

নারীকে,হৃদয়বতীকে এমনভাবে রক্তমাংসমদির ভালোবাসি,মুগ্ধতার পদাবলি রচনা করি এবং একটু স্পর্শের জন্য প্রাণ তুচ্ছ করতে পারি!

যা ঈশ্বরের করা অসম্ভব,অকল্পনীয় এবং অরতিময়!

কে কার সৃষ্টি জানি না!প্রেমের ফুল হাতে নিলেই
ভেতরে যে ধ্বনিত হচ্ছে শ্বাসবায়ুরচিত কবিতা,তা
গালিবের লেখা,লেখা নয়, তাই গালিব

সে তুমি কবি হও বা না হও!”( গালিবের কবিতা।শুভঙ্কর দাস)

প্রায় দু’শতাব্দী আগে এক প্রেমিক-কবির জন্ম হয় ১৭৯৭ সালে আগ্রায়,তিনি সৈনিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও,কখনো অস্ত্র ধরেননি,বরং নিজের হৃদয়কে ফুল করলেন,প্রতিটি শানিত অস্ত্র যাতে ফুল এবং অস্ত্র ভান্ডার ফুলের বাগানে পরিণত হয়।
তিনি উর্দুতে কবিতা লিখতেন। শেষ পর্যন্ত এই ভাষার প্রতি তাঁর পরম নিষ্ঠা ও বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।তাঁর সারাজীবন ছিল সৌন্দর্য সন্ধানের আকর।তিনি লক্ষ্য করলেন,ঈশ্বরের সৃষ্ট এই জগতে সত্যিকারের সুন্দরতম বলে কিছু থেকে থাকে,তা হল নারী।
সেই নারীর হৃদয় জয় করা তাঁর কাছে শত সাম্রাজ্য জয় করার সমান মনে হত।
ডেই নারীর হৃদয়ে স্থান পাওয়াকে তিনি মনে করতেন বেহস্তে যাওয়ার সমান।
তপ্ত হৃদয়ের ভেতর ছায়া আনতে এবং মরুসদৃশ ওষ্ঠতৃষ্ষা মেটাতে পারে একমাত্র নারী।তাই সেই কবির কাছে প্রেম,নারীর প্রেম জীবন ও মরণ,ত্যাগ ও ভোগের একাত্ম সাধনরূপ হয়ে উঠল।
তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে বুলবুল,গোলাপ,বসন্ত,চাঁদ, ফুল,ময়ূর,কেশদাম,সুরা, লায়লা-মজনু এবং যে শব্দটি অযুতবার এসেছে, তা হল চুম্বন।
অর্থাৎ তিনি নারীর প্রেমকে ও তার প্রাপ্তিকে জীবনের সবশ্রেষ্ঠ গজল মনে করতেন।
প্রায় ১৭৯৬ টি কবিতা রচনা করেছেন।
তিনি ইংরেজি জানতেন না!
তিনি বাংলা যে জানতেন না,তা বলা বাহুল্য!
তিনি ফার্সি জানতেন কিন্তু পদ রচনায় তিনি উর্দুকেই বাহন করেছিলেন।
তার সত্ত্বেও তাঁর হৃদয়আর্তিকে আটকে রাখা যায়নি!
অনুবাদের মাধ্যমে আলোকিত কবি-প্রেমিক সম্রাট হয়ে আছেন সারা ভুবনে।

তিনি মির্জা আসাদুল্লাহ্ খান।
গোটা জগৎ তাঁকে মির্জা গালিব নামে চেনে।

কাব্য-বিশেষজ্ঞের মতামত এই “গালিব শুধুমাত্র বড় কবি নন,তিনি অত্যন্ত দুরূহ কবি।তাঁর কবিতা ও গজল দু’শতাব্দী অতিক্রম করেও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক। গালিবকে তাঁর জীবনী ও কবিতায় আমরা পাই সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, মেধা ও মননের সমৃদ্ধ সমকালীন ভারতীয় সংস্কৃতির পটভূমিকায় একজন অমিত শক্তিধর স্রষ্টা হিসেবে। সমগ্র উর্দু ও ফারসি কাব্যে একমাত্র ইকবাল ব্যতীত আর কোনো কবি একরকম কালোত্তীর্ণ প্রতিভা নিয়ে উপস্থিত হননি”

আর মহাকবি গালিব নিজে স্বয়ং কী বলেন, তাও শোনা দরকার–
“শোনো,দুটি পৃথিবী আছে,একটি আত্মার, অন্যটি মাটি ও জলের পৃথিবীর। সাধারণ নিয়ম এই যে মাটিজলের পৃথিবীতে যারা অপরাধী তারা আত্মার পৃথিবীতে শাস্তি পাবে,আবার যারা আত্মার জগতে অপরাধী তারা মাটিজলের পৃথিবীতে শাস্তি পাবে”

তাঁর আত্মা কবিতার জন্য নিবেদিত ছিল।তাই তিনি মাটিজলের পৃথিবীতে নানা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে প্রেমকে প্রজ্বলিত করেছেন তিলে তিলে…
তিনি তাই বলেন—
“আমাদের প্রেমের ব্যাকুলতা তোমার মহত্ত্বকে প্রকাশ করে
তোমার পৃথিবী তোমার মুখের তুলনায় অতি সামান্য
একটি আয়না মাত্র! ”
সেই আয়না যদি উর্দু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকত,তাহলে সসাগরা বসুন্ধরা এই অতুলনীয় প্রেমের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকত,তাই আমরা যারা অসহায় অথচ গালিব পড়তে আগ্রহী এবং বহুভাষাজ্ঞানহীন অথচ বহুমাত্রিক প্রেমসন্ধানী, তাদের জন্য অনুবাদ একান্ত প্রয়োজন।
এগিয়ে এলেন কবি তপনকুমার মাইতি।
কবি তপনকুমার মাইতি অখন্ড মেদিনীপুরের প্রেমের কবিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনাকার।তিনি নিজে অসংখ্য এবং সার্থক প্রেমের কবিতা সৃষ্টি করেছেন।এবং যা আবৃত্তিশিল্পীদের স্বর্ণকলস হতে পারে! যেমন একটি শোনাই—

“ভালোবাসলে সব মানুষের মুখ সুন্দর দেখায়
তখন শত্রুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলা যায়,বুকে এসো
তখন ঝরা ফুল হাতে নিয়ে বলা যায়,বৃন্তে ফিরে যাও
তখন ছোট ছোট লোভ ও ঘৃণাগুলো নক্ষত্র হয়ে যায়
তখন অচেনা মানুষের দুঃখের ভেতর দাঁড়ানো যায়

ভালোবাসলে পাখি নেমে আসে গাছ থেকে
মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে আসে

ভালোবাসার মত স্বচ্ছ আয়না আর একটিও নেই। ”

সেই মানুষটি প্রেমের হৃদয় দিয়ে গালিব ভাষান্তর করেছেন। মূল উর্দু কবিতার পাশাপাশি বাংলায় অনুবাদ।কয়েকটি প্রেমপ্রদীপ জ্বালানো যেতেই পারে—

“ঘুম তো তারই,গর্বও তারই,রাত্রিও তার
তোমার অবিন্যস্ত কেশদাম যার বাহুর উপর বিছিয়ে আছে”

“দেওয়াল ও দরজাবিহীন একটি ঘরে বানাতে চাই
সেখানে কোনো পাহারাদার থাকবে না,থাকবে না কোনো পড়শি”

“তুমি বলছ কুড়িয়ে পাওয়া হৃদয়টা ফিরিয়ে দেবে না
হৃদয় কোথায় যে লুকিয়ে রাখবে? আমি পেলাম আকাঙ্ক্ষিত করুণা”

এইরকম কবি তপনকুমার মাইতি একশো দুটি অনুবাদ করেছেন গালিবের কবিতার।মূল উর্দুর সঙ্গে পড়তে এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যায়,তবে হয়তো যে শব্দ বা বাক্য উর্দুতে প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে,তার বাংলা সেই আবেদন নিয়ে কোথাও কোথাও হাজির হয়নি,অনুবাদ সদর্থক এবং সাবলীল, কিন্তু ভাষান্তরে সেই ধ্বনিময় অনুভবজারিত রস পাওয়া অসম্ভব।
তা সত্ত্বেও কবি তপনকুমার মাইতি আমাদের জন্য যে স্বর্ণখনি নির্মাণ করেছেন,তাতে মুগ্ধ হতেই হয় এবং অবশ্যই পাঠ করতে হয়।

গালিব বাংলা ভাষায় কবিতাচর্চা করতেন না,এমন কি তিনি বাংলার কবিতাসম্ভার জানতেন কি না,জানা যায় না,কিন্তু ১৮২৬ সালে কলকাতায় এসেছিলেন।দিল্লির শেষ বাদশা বাহাদুর শাহের সভাকবি ছিলেন তখন।সেইসময় কলকাতায় তাঁকে ঘিরে একটি উর্দু কবিমন্ডল তৈরি হয়। যে সময় কলকাতায় রাজা রামমোহন রায় একের পর এক সমাজসংস্কারমূলক বাংলা বই রচনা করে চলেছেন এবং রামমোহন নিজে খুব ভালো ফার্সি ও উর্দুভাষা জানতেন।সেদিক থেকে গালিবের সঙ্গে রাজা রামমোহনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না,জানা যায় না! রামমোহন গালিবের চেয়ে ২৩ বছরের বড় ছিলেন।এবং গালিব যখন কলকাতায় সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বীরসিংহের টোলে পড়াশুনা করছেন এবং তাঁর বয়স মাত্র ছয়।
এবং সেই সময় বাংলার প্রধান কবি ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত।
তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রে গালিবের কোনো সংবাদ প্রকাশিত অথবা গালিবের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন বা প্রকাশ করেছিলেন কি না,জানা যায় না!
এইসব ইতিহাসের উর্ধ্বে যা থাকে,তা হল গালিবের কবিতা।তাই আমরা হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি, কবি তপনকুমার মাইতির আয়োজনে,এটাই বড় প্রাপ্তি।এই আলোচনায় অনেকের মনে হতে পারে,শব্দার্থ বা উপমা প্রয়োগ অথবা ভাষান্তরে ভাবের বিস্তার বা সংকোচ হল কি না,তা তো আলোচিত হল না!
না,আমি সেসব করতে বসিনি,সে যোগ্যতাও আমার নেই।আমি শুধু এক কবি হৃদয়ের আর্তি অপর কবিহৃদয় কীভাবে সঞ্জাত করে গালিবপ্রিয় পাঠকের মনে সঞ্চারিত করল,তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরলাম।মহাকবি মধুসূদন তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্যের একটি জায়গায় বলেছেন—

” যে যাহারে ভালোবাসে/সে যাইবে তার পাশে
মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিবে কেমনে?
যদি অবহেলা করি/রুষিবে শম্বর-অরি
কে সমস্বরে স্মরশরে এ তিন ভুবনে?”

এই সত্যিটুকু মির্জা গালিবের কবিতায় আছে,কবি তপনকুমার মাইতির কবিতায় আছে এবং পাঠান্তর তাই আমার মতো তুচ্ছ নগন্য পাঠকের মনেও সোনালি রেখায় স্পন্দিত হয়েছে,এরপর আর কি চাই??
শেষ করব গালিবের কবিতা দিয়ে,যা তপনকুমার অনন্য হৃদয়ময়তায় ফুটিয়ে তুলেছেন—

“অনুযোগে আমিও পূর্ণ, বাদ্যযন্ত্র যেমন রাগিনীতে
একটু বিচ্ছেদ দাও,দেখ কেমন বেজে উঠি”

————————//——————–

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *