এই সময়ের সাহিত্যের আকাশটা বড় থেকে
ছোটো হয়ে আসছে
তার প্রধান তিন কারণ
এক
এই সময়ের সাহিত্যচর্চায় সত্যিকারের সন্ধানীহাতের বড় অভাব।অর্থাৎ খুঁজে খুঁজে নবীন প্রতিভা বের করে প্রতিষ্ঠা দান।তার মারাত্মক অভাব।অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেই খুঁজে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিস্ময়কর আভিধানিক আবিষ্কার করেছিলেন।বুদ্ধদেব বসুর উদারতায় ও আহ্বানে জীবনানন্দের মতো বিরল প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছিল, আজকের জয় গোস্বামী, শ্রীজাত,বিনায়ক, মন্দাক্রান্তা, এমন কি মায়ে সুবোধ সরকার পর্যন্ত সকলেই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আনন্দময় সান্নিধ্যের পক্ষপাতপুষ্ট প্রতিভা।এই সূত্রে প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষের নাম স্মরণীয়। তাঁর গৃহের রবিবারের আড্ডা তো অসংখ্য সৃজনশীল হাওয়ার বাতাস হয়ে ওঠার সিঁড়ি ছিল।
এখানে উচ্চারিত নামগুলো শুধু উদাহরণ, কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য উল্লিখিত নয়, এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান এবং সাহিত্যে সৎ।
এই সময় প্রিয় ‘কবিসম্মেলন’ পত্রিকার দুই মহারথী কবি শ্যামলকান্তি দাশ ও শংকর চক্রবর্তী নীরবে ও নির্দ্বিধায় শস্যরোপনের কাজটি করে চলেছেন।এঁরা ব্যতিত নবীন প্রতিভার দাঁড়ানোর স্থান এতখানি অকুলান, তাতে যাকে অনুপ্রেরণা বলে,তা সত্যিকারের অণু হয়ে থেকে গেছে।
তাহলে
বল মা দাঁড়াই কোথা?
দুই
আপনার পাশের সাহিত্যরচনাকারীটি আপনার লেখা পড়েন না!
অর্থাৎ মহানগর তো দূরের নক্ষত্র, মফস্বলি কোনো সৃজনকর্মের পাঠক মফস্বলের পাওয়া দুষ্কর। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় কতজন সম্পাদক, সাহিত্যিক এবং সংগঠক আছেন,যাঁরা হাতে প্রাপ্ত কবিতা-গল্প-উপন্যাস যাই পান,তার এক পাতাও উলটে দেখেন কি না সন্দেহ!
ফলে তাঁর মুখে এই আফসোস প্রতিফলিত, আজকাল ভালো লেখার বড় অভাব! আসলে তিনিই যে সবচেয়ে অভাবী,দরিদ্র, একথা কাকে বোঝানো যাবে?
ঠিক একই কথা বাচিকশিল্পীদের ক্ষেত্রে খাটে,তাঁরা এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছেন,তিনি এখনও গলার শিরা ফুলিয়ে এবং হস্তসঞ্চালনপূর্বক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম এবং সুকান্তে আওড়ে চলেছেন।তাঁরা অবশ্য অনেক খুঁজে খুঁজে সুনীলের নির্বাসন,শক্তির অবনী বাড়ি আছো? জয় গোস্বামীর মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয় আর সুবোধের শাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছেন,তারপর? তারপর? তারপর সবই অঙ্কে যত শূন্য পেলে!
না, না, মোটেই আমরা বলছি না,যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত-সুকুমার পড়বেন না,আবৃত্তি করবেন না,বরং এঁদের সৃষ্টি না পড়লে,যেকোনো সাহিত্যের লাজ অসম্পূর্ণ, তা তো সত্য। কিন্তু তার পাশে নতুন জমিও সন্ধানের চোখ,কণ্ঠ এবং হস্তসঞ্চালন রাখুন,তাহলে আকাশটা বড় হবে,আপনিও…
কিন্তু তা হচ্ছে না!
ফলে নবীন প্রতিভা শেষ পর্যন্ত সেই এলেবেলে আস্তাকুঁড়ে ভবিষ্যতের বীজধান হয়ে শুয়ে থাকে!
তিন
এরপর প্রকাশক!
এঁরা এক আশ্চর্য আকাশ! বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান ধারার ধারক ও বাহক!
যাঁরা পড়েন কম, প্রকাশ করেন বেশি!তার থেকেও ব্যবসায় আবেগ খাটান আরও আরও বেশি!
আমি বই ব্যবসায়ে নেমেছি,ব্যবসাকেই প্রধান করে দেখব,একদম সঠিক।তাই তাঁদের বই প্রকাশ করে চলেন,যাঁদের বাজার তৈরি আছে।
এবং যাঁরা বাজার তৈরি করে দিতে পারবেন!
এবং তাঁদের, যাদের হাতে নিজস্ব বাজার আছে!
ফলে প্রকাশকগণ নিজে খেটে, নিজে হেঁটে প্রতিভার সন্ধান বন্ধ করে রেখেছেন!
কিন্তু এতে একদিন দেখা যাবে সাহিত্যের মৃত রথী-মহারথী ছাড়া কোনো জীবিত প্রতিভার বই প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যাবে না!
চলুক,এইভাবে চলুক…
কিন্তু তাঁরা এটা কি বোঝেন,যদি সত্যিকারের সন্ধানী চোখ দিয়ে নবীন নবীন প্রতিভা তুলে ধরে বাজারে রাখার চেষ্টা করি,তাদের মধ্যে কেউ না কেউ পাঠকসমাজ পাবেন,ফলে আবার নতুন করে বাজার তৈরি হবে!
কিন্তু সেই ঝুঁকি নিতে এঁরা আগ্রহী নয়! ফলে সাহিত্যের আকাশ,শুধু লেখার নয়, প্রকাশেরও ছোট হতে হতে সমুদ্র থেকে গর্ত হয়ে যাবে!
এবং একদিন কলেজ স্ট্রিট না গিয়েও বলে দেওয়া যাবে,ওখানে কী বই বিকোয় এবং কী বই শুকোয়!
এই সবের ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
কিন্তু তা এতো যৎসামান্য যে,আকাশটাকে কিছুতেই বড় করতে পারছে না! বরং সেই সব ব্যতিক্রমীদের এমনভাবে বাধা-বিপত্তির বেড়াজালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের নাভিশ্বাস আকাশ পর্যন্ত ওঠে না!
সুপ্রিয় সচেতন পাঠক,
এই কথাগুলো চোখ চারিয়ে,হৃদয় মিশিয়ে এবং বোধ পিষিয়ে রচিত।এ-র সঙ্গে আপনি একমত হতে পারেন আবার নাও হতেন পারেন!
আপনি কমেন্ট করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন!
সেটা সম্পূর্ণ আপনার মনন এলাকা।
কিন্তু এই আলোচনা পাঠের পর কথককে অকারণে ও অযৌক্তিক নেতিবাচক এবং সূচীশিল্পে বিদ্ধ না করিয়া কীভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নস্যাত করা যায়,তাই লিখুন…
আপনার মতামতের জন্য তো ফেসবুকে পোস্ট করা…
ওহ্ হ্যাঁ,ফেসবুক।
জয় ফেসবুকস্বতী।
যার কেউ নেই, তার ফেসবুক আছে।
এবং তাই বোধহয় হলদিয়া টু হাওড়া,কলকাতা টু কাঠমান্ডু,ঢাকা টু কাশ্মীর,নিউইয়র্ক টু নদের গঞ্জ পর্যন্ত আকাশটা বেঁচেবর্তে আছে!