Categories
প্রবন্ধ

শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর — একটি পর্যালোচনা ।।।।

এটা অনস্বীকার্য যে, বাঙালী সমাজে আজও বিদ্যাসাগরের প্রদীপ্ত উপস্থিতি ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়ে । প্রাথমিক শিক্ষায় ‘বর্ণপরিচয়’ এর মাহাত্ম্য সকলের জানা । মুর্শিদাবাদ জেলার শক্তিপুর হাই স্কুলের বাংলার দিদিমণি আমার রচনা লেখার গঠন অবলোকন করে হঠাৎ তাঁর সম্মুখে ডাকলেন, “তুই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ নাম শুনেছিস ? তারপর চুপি চুপি বললেন, রোজ রাতে শোওয়ার আগে বিদ্যাসাগরের বইখানা পড়বি । রচনা লেখার সময়ে তোর বানানের জড়তা কেটে যাবে” । সুতরাং শৈশব থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় আজও অমলিন । সেই বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর । তাই দুশো বছর ধরে শিক্ষা জীবনের বাস্তবতায় বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক ।
বিদ্যাসাগর যখন জন্মগ্রহন করেছিলেন সেই সময়টা ছিল রামমোহনের যুগ, যিনি একজন শিক্ষিত ও অগ্রণী পুরুষ ছিলেন এবং সমাজ সংস্কারের অন্যতম কারিগর । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত ও বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা পুরুষ। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরিতে খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতেন । পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের অতীত ছিল। সেই কারণে বালক ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী’র সঙ্গে বাস করতেন।
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির ছ’মাসের মধ্যেই পাঁচ টাকা বৃত্তি পান । তাঁর প্রতিভার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে শিক্ষকেরা সকলে স্তম্ভিত । তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্মজীবন শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম (১৮৪১) কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসাবে । ঐসময়েই তাঁর ইংরেজি শিক্ষার যথাযথ শিক্ষালাভ । কেননা বিদ্যাসাগরকে সকলে জানতেন সংস্কৃতের পন্ডিত হিসাবে । ইংরেজি হাতের লেখাও ছিল নজরকাড়া । ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন। সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষা প্রসারে তাঁর আরও অবদান সর্বজনবিদিত । এর আগে এ কলেজে পড়ার অধিকার ছিল কেবল ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য ছাত্রদের, কিন্তু তিনি সব শ্রেণির হিন্দুদের জন্যে কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেন। ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন । ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে প্রথম বর্ণপরিচয় প্রকাশ করে তিনি বাঙালীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন। ১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৮৫৯ সালে তিনি “ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল” স্থাপনে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। ১৮৬৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় “হিন্দু মেট্রেপলিটন ইসস্টিটিউট”। বিদ্যাসাগর হন এর সেক্রেটারী। ১৮৭২ সালে এটিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং ১৮৭৯ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত করা হয়। বর্তমানে এর নাম “বিদ্যাসাগর কলেজ”। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ, বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন । সেদিনের সমাজে প্রচলিত প্রথার নির্মম পরিণতির জন্য নারীদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন আপামর জনতা অবলোকন করেছিলেন । শোনা যায়, একসময় রাজা রাজবল্লভ নিজের বালবিধবা কন্যাকে পুনর্বিবাহ দেওয়ার অনুমতি সমাজের পন্ডিতদের কাছ থেকে পেয়েও সেই বিবাহ কারও কারও বাধায় দিতে পারেন নি । যাই হোক ১৮৫৫ জানুয়ারি মাসে বিদ্যাসাগরের “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা” বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ ও সমাজ চমকে উঠেছিল । শেষ পর্য্যন্ত ১৮৫৫ সালের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয় । বিদ্যাসাগরের দরদী হৃদয় কেঁদেছিল সেকালের সমগ্র হিন্দু নারী সমাজের দুর্গতি দুর্দশায় । বিধবা বিবাহ আইন নামে পরিচিত ১৮৫৬ সালের আইনটি কেবলমাত্র বিধবা নারীর দ্বিতীয় বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি, আইনটি যেমন বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে তেমনই মৃত স্বামীর এবং দ্বিতীয় বিবাহের এবং পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তিতে অধিকার সুনিদ্দিষ্ট করে । বিভিন্নভাবে জানা যায়, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ পর্য্যন্ত মোট ৬০টি বিধবা বিবাহ সংঘটিত হয় । আরও জানা যায়, বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচন্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তাছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। এতে একটা জিনিস পরিস্কার, বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগরের শতভাগ সাফল্য সর্বজনবিদিত ।
তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন, যাকে পরবর্তীতে বেথুন কলেজ নামকরণ করা হয়। নারীদের শিক্ষার দিকে আনার জন্য তিনি একটি অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন, যা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখান থেকে মেয়েদের শিক্ষার জন্য যাবতীয় অর্থের ব্যবস্থা করা হতো। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিত (তাঁকে এ বিশেষণ প্রথমে দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত) । তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের। তাঁর বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে। পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের, যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ।
বিরাট ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অথচ চালচলনে তিনি ছিলেন নিতান্তই সাদাসিধে । খুব বিনয়ী ছিলেন এবং জীবনে দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে কাটিয়ে দিলেন। তিনি একাধারে মহান সমাজ সংস্কারক অন্যদিকে এক জন শিক্ষাবিদ ছিলেন এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করে গেছেন অবিরাম । ভারতে শিক্ষার প্রতি তার অবদান এবং নারীর অবস্থার পরিবর্তন জন্য তিনি চিরস্বরণীয়। তাঁর অবর্ণনীয় মাতৃ ভক্তি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও চর্চিত ।
——————————-০———————————————–
মো – ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

Share This
Categories
কবিতা

দিব্যি দেয়নি : রাণু সরকার।

দরিদ্রের আবার দিন আছে
নাকি-
দিনরাত দলবদ্ধ হয়েছে!
এক ফাঁকে কিছু কষ্ট
গোপন রেখেছি
তোমাকে দিতে চাই-

মনের বেদনা গুলো দিবার
প্রথম প্রহরে সেতারে বাজাবে
দেখতে চাই তারা সংগীতের সুরে
কত রূপসী!

আমাকে প্রবঞ্চিত করে
বিকট আওয়াজ করে
আঙুলের ফাঁক দিয়ে পালায়–
রেওয়াজ করিনি কতদিন-
আচ্ছা আমি কি নষ্ট?
কি এমন করেছি-
ভাদ্রের জলে পা ডুবিয়েছি!

পেছন থেকে কেউ বারণ
করেনি-
দু চোখ বিভোর কি জানি কি
ভাবছে পথিক!
দ্বিপ্রহরে খরার তাপে
অনাবৃষ্টিতে এলো বৃষ্টি
পঞ্চম মাসে!

যুগল চোখের ভাষা ছিলো
অস্পষ্ট!
বেশ করেছি পা ডুবিয়ে
কেউ আমায় দিব্যি দেয়নি!

Share This
Categories
উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (পঞ্চদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

কয়েক মাস কেটে গেলো । ঘোতনের দোকান এখন অনেক চালু । দোকানের আয় থেকে পুঁজিও অনেক বেড়েছে । ঘোতন দোকানে খুব খাটছে । তার ইচ্ছা, ভাল ভাল ব্রান্ডের কাটা-কাপড় রাখা । যাতে তার টেলারিং ঢুকে একজন চাইলে, জামা-প্যান্টের কাপড় কিনে প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারবেন । সেইজন্য ঘোতনের অতিরিক্ত খাটুনি ।
অন্যদিকে কঙ্কাবতী ঘোতনকে অনবরত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে বিয়ের জন্য । হরিবল্লভপুরের বনমালী ঘটক কঙ্কাবতীর পিছনে লেগে রয়েছে । তাঁর হাতে নাকি তিনজন সুন্দরী পাত্রী রয়েছে । তাড়াতাড়ি যোগাযোগ না করলে তারাও হাত-ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা । বনমালীর তর সইছে না । তাঁর রোজ একবার করে তাগাদা দেওয়া চাই । তিনজন মেয়ের মধ্যে একজন মেয়ের বাবার নাম লাখহরি । তিনি সোমপাড়া বাজারের বড় ব্যবসায়ী । তিনি ব্যবসায়ী পাত্র খোঁজ করছেন । বনমালীর কাছে ঘোতনের খবর পেয়ে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন ঘোতনকে জামাই করার জন্যে । লাখহরির মেয়ের বয়স বেশী । গায়ের রঙ চাপা । চাপা থাকার কারণে পাত্র ঠিকমতো জুটছিলো না । যার জন্য বয়স বেশী । লাখহরিবাবু ভাবলেন, ঘোতনকে কিছু টাকা পয়সা দিলে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে ঘোতন রাজি হয়ে যাবে । তা ছাড়া খোঁজ খবর নিয়ে লাখহরিবাবু জেনেছেন, দোকানটা বাড়াতে ঘোতনের এখন অনেক টাকার দরকার ! সুতরাং এই সুযোগে ঘোতনকে টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে বোঝাতে পারলে তাঁর মেয়ে বিয়ের একটা বিহিত হবে । নতুবা মেয়ের দিকে তাকালে তাঁর ভীষণ কষ্ট ! মেয়ের সমবয়সী মেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে । একমাত্র তাঁর মেয়ের বিয়ে বাকী । সেইজন্য মেয়েটা বিষণ্ণতায় ভুগছে ।
বনমালী কঙ্কাবতীর সাথে দেখা করে লাখহরির মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলো । লাখহরিবাবুর নগদ টাকা যৌতুক দেওয়ার প্রস্তাবও, বনমালী কঙ্কাবতীকে জানালো । কিন্তু কঙ্কাবতী বনমালীকে বুঝিয়ে বলল, “বিয়ে করবে ঘোতন । পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছেলের মতামতকেই মা হিসাবে কঙ্কাবতী গুরুত্ব দেবে । তাতে লাখহরির মেয়েকে ঘোতন পছন্দ করলে কঙ্কাবতীর কোনো আপত্তি নেই । কঙ্কাবতীর নগদ টাকার উপর কোনো লোভ নেই । সে গতরে খেটে উপার্জন করার পক্ষপাতী । তার মতে, পরিশ্রম করে স্বচ্ছতার সঙ্গে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ অপরিসীম !
এদিকে ঘোতন বিয়ে করার ব্যাপারে বেঁকে বসলো । ঘোতন চাইছে, স্টেশন চত্বরে একটা বাড়ি বানাতে । হয় মিঁয়া স্টেশন কিংবা বাজারসৌ স্টেশনের আশেপাশে । কেননা তাদের চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে যাতায়াতের খুব সমস্যা । ব্যবসা চালাতে গেলে স্টেশন চত্বরে বাড়ি হলে সবদিক দিয়ে মঙ্গল । চড়ুইডাঙ্গা গাঁয়ে যেমন বড় ভাই রয়েছে, সে সেখানে জমি জায়গা চাষবাস নিয়ে থাকুক । আর একটা বাড়ি স্টেশন চত্বরে হলে ভাল হয় । সেইজন্য ঘোতন বিয়ে নিয়ে একেবারেই ব্যস্ত নয় ।
ইতিমধ্যে মিঁয়া স্টেশন লাগোয়া শক্তিপুর যাওয়ার রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠা জমি ও বাড়ির খোঁজ পেয়েছে । বাড়িতে দুখানি ঘর, রান্না ঘর, বাথ রুম ও একটি টিউবওয়েল রয়েছে । দামটা নিয়ে ঘোতনের একটু আপত্তি । তবে জায়গাটা ঘোতনের খুব মনে ধরেছে । স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট । আবার অন্যদিকে সাইকেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শক্তিপুর বাজার । জায়গাটা যার, তিনি কর্ণসুবর্ণ স্টেশনের কাছে পাকাপাকিভাবে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন । তিনি আর মিঁয়া ফিরতে চাইছেন না । তাঁর একমাত্র ছেলে সেখানকার হাইস্কুলের মাস্টার । তাই জায়গাটা বিক্রি করে দেওয়া তাঁদের উদ্দেশ্য ।
কঙ্কাবতী জায়গার দাম শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো । অতো টাকার জোগাড় কীভাবে হবে সেই চিন্তায় অস্থির । অথচ ঘোতন জায়গাটা কিনতে মরিয়া ।
বোনেরা ঘোতনের পাশে এসে দাঁড়ালো । জমি ও বাড়িটা কেনার ব্যাপারে চার বোন সর্বতোভাবে দাদাকে সহায়তা করলো । তারাও চায়, স্টেশনের কাছাকাছি একটি বাড়ি হোক । বোনেদের সহায়তায় আর সামান্য কিছু ধার-দেনা করে ঘোতন বাড়ি-সহ জমিটা কিনলো ।
জমিটা কেনার জন্য আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে মনীষা যথেষ্ট সহযোগিতা করলো । যার জন্য ঘোতনের পক্ষে জমিটা কিনতে বেশী বেগ পেতে হলো না ।
জমিটা রেজিস্ট্রি হওয়ার সাথে সাথে গবরডাঙ্গা গ্রাম থেকে ব্রজেশ্বর কামাল কঙ্কাবতীর বাড়ি এসে উপস্থিত । তাঁর ছোট মেয়ের জন্য । ব্রজেশ্বর কামালের তিন মেয়ে । ছেলে নেই । প্রথম দুই মেয়ে বিবাহিত । বড় জামাই হাসপাতালের স্টাফ । বাড়ি বেলডাঙ্গা । আর দ্বিতীয় জামাই বিডিও অফিসের ক্লার্ক । বাড়ি বর্ধমানের রসুলপুরে । ছোট মেয়ের বিয়ে বাকী । ছোট মেয়েটা সালার কলেজ থেকে স্নাতক । চাকরি-বাকরি নেই । ছোট মেয়ের নাম লতা । লতার ইচ্ছা ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার । কিন্তু তার সে আশায় বালি । মানুষের সব আশা পূরণ হয় না । তেমনি লতার চাকরি পাওয়ার আশা পূরণ হলো না । যার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে ব্রজেশ্বর কামালের বড্ড দেরী হয়ে গেলো । লতা একটু ডানপিটে ধরনের মেয়ে । গ্রামের সব ব্যাপারেই তার মাথাব্যথা । গাঁয়ে কে অসুস্থ, কে খেতে পেলো না, সব কিছুতেই তার জড়ানো চাই । আপদে-বিপদে সকলের পাশে থাকতে লতা ভীষণ সাবলীল ! ব্রজেশ্বরবাবু কাঙাল ঘোষের মুখে জানতে পেরেছেন, কঙ্কাবতী ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ করছে ! খবর জানা মাত্র ব্রজেশ্বরবাবু সোজা কঙ্কাবতীর দরবারে ।
কী আশ্চর্যের ব্যাপার, লতাকে ঘোতনের খুব পছন্দ । তাই মাকে সরাসরি জানিয়ে দিলো, “লতাকেই সে বিয়ে করতে চায় ।“
 (চলবে)

Share This
Categories
রিভিউ

সে তুমি কবি হও বা নাও হও, আমি জানি কবিতার ঈশ্বর তুমি, কবিতা ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আমি ঈশ্বরের নামমাত্র প্রশংসা করব না,
বরং ঈশ্বরের উচিত আমার স্তুতি করা,আমার হৃদয়ের
সামনে মাথা নত করে ক্রন্দন করা,আমার অশ্রু অথবা
অফুরন্ত আবেগের জন্য আবার একটি জন্ম উপহার দেওয়া,যাতে আমি জ্বলন্ত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত

নারীকে,হৃদয়বতীকে এমনভাবে রক্তমাংসমদির ভালোবাসি,মুগ্ধতার পদাবলি রচনা করি এবং একটু স্পর্শের জন্য প্রাণ তুচ্ছ করতে পারি!

যা ঈশ্বরের করা অসম্ভব,অকল্পনীয় এবং অরতিময়!

কে কার সৃষ্টি জানি না!প্রেমের ফুল হাতে নিলেই
ভেতরে যে ধ্বনিত হচ্ছে শ্বাসবায়ুরচিত কবিতা,তা
গালিবের লেখা,লেখা নয়, তাই গালিব

সে তুমি কবি হও বা না হও!”( গালিবের কবিতা।শুভঙ্কর দাস)

প্রায় দু’শতাব্দী আগে এক প্রেমিক-কবির জন্ম হয় ১৭৯৭ সালে আগ্রায়,তিনি সৈনিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও,কখনো অস্ত্র ধরেননি,বরং নিজের হৃদয়কে ফুল করলেন,প্রতিটি শানিত অস্ত্র যাতে ফুল এবং অস্ত্র ভান্ডার ফুলের বাগানে পরিণত হয়।
তিনি উর্দুতে কবিতা লিখতেন। শেষ পর্যন্ত এই ভাষার প্রতি তাঁর পরম নিষ্ঠা ও বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।তাঁর সারাজীবন ছিল সৌন্দর্য সন্ধানের আকর।তিনি লক্ষ্য করলেন,ঈশ্বরের সৃষ্ট এই জগতে সত্যিকারের সুন্দরতম বলে কিছু থেকে থাকে,তা হল নারী।
সেই নারীর হৃদয় জয় করা তাঁর কাছে শত সাম্রাজ্য জয় করার সমান মনে হত।
ডেই নারীর হৃদয়ে স্থান পাওয়াকে তিনি মনে করতেন বেহস্তে যাওয়ার সমান।
তপ্ত হৃদয়ের ভেতর ছায়া আনতে এবং মরুসদৃশ ওষ্ঠতৃষ্ষা মেটাতে পারে একমাত্র নারী।তাই সেই কবির কাছে প্রেম,নারীর প্রেম জীবন ও মরণ,ত্যাগ ও ভোগের একাত্ম সাধনরূপ হয়ে উঠল।
তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে বুলবুল,গোলাপ,বসন্ত,চাঁদ, ফুল,ময়ূর,কেশদাম,সুরা, লায়লা-মজনু এবং যে শব্দটি অযুতবার এসেছে, তা হল চুম্বন।
অর্থাৎ তিনি নারীর প্রেমকে ও তার প্রাপ্তিকে জীবনের সবশ্রেষ্ঠ গজল মনে করতেন।
প্রায় ১৭৯৬ টি কবিতা রচনা করেছেন।
তিনি ইংরেজি জানতেন না!
তিনি বাংলা যে জানতেন না,তা বলা বাহুল্য!
তিনি ফার্সি জানতেন কিন্তু পদ রচনায় তিনি উর্দুকেই বাহন করেছিলেন।
তার সত্ত্বেও তাঁর হৃদয়আর্তিকে আটকে রাখা যায়নি!
অনুবাদের মাধ্যমে আলোকিত কবি-প্রেমিক সম্রাট হয়ে আছেন সারা ভুবনে।

তিনি মির্জা আসাদুল্লাহ্ খান।
গোটা জগৎ তাঁকে মির্জা গালিব নামে চেনে।

কাব্য-বিশেষজ্ঞের মতামত এই “গালিব শুধুমাত্র বড় কবি নন,তিনি অত্যন্ত দুরূহ কবি।তাঁর কবিতা ও গজল দু’শতাব্দী অতিক্রম করেও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক। গালিবকে তাঁর জীবনী ও কবিতায় আমরা পাই সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, মেধা ও মননের সমৃদ্ধ সমকালীন ভারতীয় সংস্কৃতির পটভূমিকায় একজন অমিত শক্তিধর স্রষ্টা হিসেবে। সমগ্র উর্দু ও ফারসি কাব্যে একমাত্র ইকবাল ব্যতীত আর কোনো কবি একরকম কালোত্তীর্ণ প্রতিভা নিয়ে উপস্থিত হননি”

আর মহাকবি গালিব নিজে স্বয়ং কী বলেন, তাও শোনা দরকার–
“শোনো,দুটি পৃথিবী আছে,একটি আত্মার, অন্যটি মাটি ও জলের পৃথিবীর। সাধারণ নিয়ম এই যে মাটিজলের পৃথিবীতে যারা অপরাধী তারা আত্মার পৃথিবীতে শাস্তি পাবে,আবার যারা আত্মার জগতে অপরাধী তারা মাটিজলের পৃথিবীতে শাস্তি পাবে”

তাঁর আত্মা কবিতার জন্য নিবেদিত ছিল।তাই তিনি মাটিজলের পৃথিবীতে নানা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে প্রেমকে প্রজ্বলিত করেছেন তিলে তিলে…
তিনি তাই বলেন—
“আমাদের প্রেমের ব্যাকুলতা তোমার মহত্ত্বকে প্রকাশ করে
তোমার পৃথিবী তোমার মুখের তুলনায় অতি সামান্য
একটি আয়না মাত্র! ”
সেই আয়না যদি উর্দু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকত,তাহলে সসাগরা বসুন্ধরা এই অতুলনীয় প্রেমের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকত,তাই আমরা যারা অসহায় অথচ গালিব পড়তে আগ্রহী এবং বহুভাষাজ্ঞানহীন অথচ বহুমাত্রিক প্রেমসন্ধানী, তাদের জন্য অনুবাদ একান্ত প্রয়োজন।
এগিয়ে এলেন কবি তপনকুমার মাইতি।
কবি তপনকুমার মাইতি অখন্ড মেদিনীপুরের প্রেমের কবিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনাকার।তিনি নিজে অসংখ্য এবং সার্থক প্রেমের কবিতা সৃষ্টি করেছেন।এবং যা আবৃত্তিশিল্পীদের স্বর্ণকলস হতে পারে! যেমন একটি শোনাই—

“ভালোবাসলে সব মানুষের মুখ সুন্দর দেখায়
তখন শত্রুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলা যায়,বুকে এসো
তখন ঝরা ফুল হাতে নিয়ে বলা যায়,বৃন্তে ফিরে যাও
তখন ছোট ছোট লোভ ও ঘৃণাগুলো নক্ষত্র হয়ে যায়
তখন অচেনা মানুষের দুঃখের ভেতর দাঁড়ানো যায়

ভালোবাসলে পাখি নেমে আসে গাছ থেকে
মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে আসে

ভালোবাসার মত স্বচ্ছ আয়না আর একটিও নেই। ”

সেই মানুষটি প্রেমের হৃদয় দিয়ে গালিব ভাষান্তর করেছেন। মূল উর্দু কবিতার পাশাপাশি বাংলায় অনুবাদ।কয়েকটি প্রেমপ্রদীপ জ্বালানো যেতেই পারে—

“ঘুম তো তারই,গর্বও তারই,রাত্রিও তার
তোমার অবিন্যস্ত কেশদাম যার বাহুর উপর বিছিয়ে আছে”

“দেওয়াল ও দরজাবিহীন একটি ঘরে বানাতে চাই
সেখানে কোনো পাহারাদার থাকবে না,থাকবে না কোনো পড়শি”

“তুমি বলছ কুড়িয়ে পাওয়া হৃদয়টা ফিরিয়ে দেবে না
হৃদয় কোথায় যে লুকিয়ে রাখবে? আমি পেলাম আকাঙ্ক্ষিত করুণা”

এইরকম কবি তপনকুমার মাইতি একশো দুটি অনুবাদ করেছেন গালিবের কবিতার।মূল উর্দুর সঙ্গে পড়তে এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যায়,তবে হয়তো যে শব্দ বা বাক্য উর্দুতে প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে,তার বাংলা সেই আবেদন নিয়ে কোথাও কোথাও হাজির হয়নি,অনুবাদ সদর্থক এবং সাবলীল, কিন্তু ভাষান্তরে সেই ধ্বনিময় অনুভবজারিত রস পাওয়া অসম্ভব।
তা সত্ত্বেও কবি তপনকুমার মাইতি আমাদের জন্য যে স্বর্ণখনি নির্মাণ করেছেন,তাতে মুগ্ধ হতেই হয় এবং অবশ্যই পাঠ করতে হয়।

গালিব বাংলা ভাষায় কবিতাচর্চা করতেন না,এমন কি তিনি বাংলার কবিতাসম্ভার জানতেন কি না,জানা যায় না,কিন্তু ১৮২৬ সালে কলকাতায় এসেছিলেন।দিল্লির শেষ বাদশা বাহাদুর শাহের সভাকবি ছিলেন তখন।সেইসময় কলকাতায় তাঁকে ঘিরে একটি উর্দু কবিমন্ডল তৈরি হয়। যে সময় কলকাতায় রাজা রামমোহন রায় একের পর এক সমাজসংস্কারমূলক বাংলা বই রচনা করে চলেছেন এবং রামমোহন নিজে খুব ভালো ফার্সি ও উর্দুভাষা জানতেন।সেদিক থেকে গালিবের সঙ্গে রাজা রামমোহনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না,জানা যায় না! রামমোহন গালিবের চেয়ে ২৩ বছরের বড় ছিলেন।এবং গালিব যখন কলকাতায় সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বীরসিংহের টোলে পড়াশুনা করছেন এবং তাঁর বয়স মাত্র ছয়।
এবং সেই সময় বাংলার প্রধান কবি ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত।
তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রে গালিবের কোনো সংবাদ প্রকাশিত অথবা গালিবের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন বা প্রকাশ করেছিলেন কি না,জানা যায় না!
এইসব ইতিহাসের উর্ধ্বে যা থাকে,তা হল গালিবের কবিতা।তাই আমরা হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি, কবি তপনকুমার মাইতির আয়োজনে,এটাই বড় প্রাপ্তি।এই আলোচনায় অনেকের মনে হতে পারে,শব্দার্থ বা উপমা প্রয়োগ অথবা ভাষান্তরে ভাবের বিস্তার বা সংকোচ হল কি না,তা তো আলোচিত হল না!
না,আমি সেসব করতে বসিনি,সে যোগ্যতাও আমার নেই।আমি শুধু এক কবি হৃদয়ের আর্তি অপর কবিহৃদয় কীভাবে সঞ্জাত করে গালিবপ্রিয় পাঠকের মনে সঞ্চারিত করল,তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরলাম।মহাকবি মধুসূদন তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্যের একটি জায়গায় বলেছেন—

” যে যাহারে ভালোবাসে/সে যাইবে তার পাশে
মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিবে কেমনে?
যদি অবহেলা করি/রুষিবে শম্বর-অরি
কে সমস্বরে স্মরশরে এ তিন ভুবনে?”

এই সত্যিটুকু মির্জা গালিবের কবিতায় আছে,কবি তপনকুমার মাইতির কবিতায় আছে এবং পাঠান্তর তাই আমার মতো তুচ্ছ নগন্য পাঠকের মনেও সোনালি রেখায় স্পন্দিত হয়েছে,এরপর আর কি চাই??
শেষ করব গালিবের কবিতা দিয়ে,যা তপনকুমার অনন্য হৃদয়ময়তায় ফুটিয়ে তুলেছেন—

“অনুযোগে আমিও পূর্ণ, বাদ্যযন্ত্র যেমন রাগিনীতে
একটু বিচ্ছেদ দাও,দেখ কেমন বেজে উঠি”

————————//——————–

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

মাতৃভাষা ও সত্যিকারের মা ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে,”

আমি জানি এই দুটি চরণ পড়া মাত্র পাঠক পরের দুটি চরণ অনায়াস আনন্দে উচ্চারণ করে ফেলবেন।
এবং কবির নামও হয়তো বলতে পারবেন।
অবশ্য এই কবির পুত্রের নাম জীবনানন্দ দাশ,এক ডাকে সকলেই জানেন।কবিতা পড়েন।এখনও পর্যন্ত বাংলা কবিতার জগতে তাঁর প্রভাব রবীন্দ্রনাথের পরেই…
কীভাবে লিখতেন কবি জীবনানন্দের মা,
সংসারের কাজকর্মে ফাঁকে ফাঁকে অবলীলায় কবিতা রচনা করতে পারতেন।হয়তো খুব ব্যস্ত হয়ে কিছু করছেন,’ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এখুনি কবিতা চাই,প্রেসে পাঠাতে হবে,লোক দাঁড়িয়ে আছে।
শুনে কবি-মাতা খাতা কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একটা হাতে খুন্তি, অপর হাতে কলম নাড়ছেন,যেমন চিঠি লিখছেন।বড়ো একটা ঠেকছে না কোথাও! এবং সম্পাদক মহাশয় একটু পরে হাতে পেতেন একটি মৌলিক কবিতা।
এবং এই দৃশ্য রান্নাশালের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতেন বালক জীবনানন্দ, খুবই অবাক হতেন!
এবং জেনে রাখুন,মায়ের কবিত্ব ও বই পড়ার আগ্রহই জীবনানন্দকে কবিতার প্রতি,বইপাঠের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।মা তাঁকে বই পড়তে ও কবিতা লিখতে প্রাণিত করতেন।
এবং পড়াতেন মহাপুরুষের জীবনী,যাতে জীবনানন্দ তাঁদের জীবনের ওপর কবিতা রচনা করতে পারে,আসল অর্থ ছিল,সেই জীবনের কথা জেনে নিজের জীবনের পথ তৈরি করা।
এইভাবে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের কবিতা,দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে নিয়ে।
নাম ছিল,’দেশবন্ধু প্রয়াণে’।
কবিতাটি কেমন হয়েছে জানার জন্য মায়ের কাছে নিয়ে যায় পত্রিকাটি।
তাতে মায়ের মতামত হল,চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছো, ভালোই করেছ,কিন্তু রামমোহন ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে,মহর্ষির ওপরেও”
এইরকমভাবে পুত্র জীবনানন্দকে মাতা একটা মহাপুরুষের তালিকা করে দিয়েছিলেন।
কারণ তাতেই হবে—

” মুখে হাসি,বুকে বল,তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে,এই তার পণ”

সেই পণে ও মায়ের ঐকান্তিক আলোর পথে গিয়ে আমরা পেলাম বাংলা কবিতার এক মহা-অনুভবী কবিকে,যাঁকে পাঠ ছাড়া আধুনিক কবিতার গতি ও গর্ব নেই!
মায়ের নাম নিশ্চিত জানেন?
এটি কমেন্টে লিখুন,কারণ এই ধরণের মায়ের বড় অভাব বর্তমান সময়ে,বই পড়া তো দূরের কথা,মহাপুরুষের জীবনীপাঠ তো পরের কথা,সন্তানকে মোবাইল আসক্তি থেকে সরাতে গিয়ে নিজেই একটি অ্যাপে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন!এখনকার মিনি মাতাগণ
নিজেই বই পড়েন না!মহাপুরুষের জীবনী পড়েন না! ফলে যেমন বৃক্ষ, তেমনই ফল…
তাই এই মাতা-কবির নাম কমেন্ট-ঘরে লিখুন এবং অন্তর সঠিক পথে চালিত হোক।কারণ

“আমাদের দেশে হবে সেই মা কবে?
মোবাইল ছাড়িয়ে বই ধরিয়ে দেবে
মুখে বাংলা, বুকে বাংলা, বই-ভরা মন
পাঠক হতেই হবে এই সত্য আমরণ”

একান্ত ক্ষমাপ্রার্থী শুভঙ্কর দাস।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

সাক্ষী দগ্ধ পলাশ :::: শুভঙ্কর দাস।।।।

“এইমাত্র নদী নেমে গেল মনের
শেষ ধাপে,শুকনো পাতার মতো রৌদ্র কাঁপে
মানুষের জন্ম! এ কি কোনো দৈব অভিশাপে!
জানে না জীবন অথবা মৃত্যু!
তার মাঝে এই তো অক্ষরের সন্তান-সন্ততি
সঙ্গে আরও একটু শ্বাসের হাতটি বাড়াস…

নৌকাজন্ম যখন,একটু স্রোতের দিকটা ঘুরে যাস…

জেগে উঠে দেখি,মানুষে বুকে-চোখে ভরে আছে

শুধু মুখোশের লাশ,সাক্ষী দগ্ধ পলাশ! “( পলাশ।শুভঙ্কর দাস)

একটি মানুষ আপাদমস্তক সাহিত্যের সঙ্গী,সাহিত্যের সহযোগী এবং সাহিত্যিকের পরমবন্ধু। এবার আপনার মনে হল,তাহলে একটি দেখা করাই যেতে পারে।আপনি পূর্বেই ভেবে রেখেছেন, সাহিত্য-অন্তপ্রাণ মানে গিয়ে দেখব,রাশি রাশি বই খুলে পড়ছেন অথবা কোনো শ্বেতপাথরের টেবিলে উদাস বাউলের মতো কলমটি ধরে মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তুলছেন সাদা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়,বা ভাবলেন,গিয়েই কথা বলা শুরু করলেই তিনি সাহিত্যের অতীত গৌরব, বর্তমান দুরবস্থা এবং ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা নিয়ে সুদীর্ঘ বক্তব্য বা উপদেশ দেবেন!
না,তা কিছুই হবে না।
একটি বর্ণময় আন্তরিক সাহিত্যসভা চলছে..
সেই মানুষটি এই সভার প্রাণপুরুষ এবং সর্বময়কর্তা,তিনি কোথায়?
আপনি গিয়েই বুঝলেন,এখানে সাহিত্যের একটি যাগযজ্ঞ হচ্ছে।
নিশ্চিত মঞ্চের ওপর বসে থাকা কোনো একজন ব্যক্তি তিনি হবেন,কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করি?
অথবা যিনি মাইক্রোফোন ধরে সারা সভাকে শব্দশাসনে রেখেছেন,তিনিও হতে পারেন!
অথবা এই তো এতগুলো বইপ্রকাশ হল,এঁদের মধ্যে তিনি একজন হবেন নিশ্চিত।
এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে আপনি দেখবেন এবং বিস্মিত হয়ে উঠবেন,ও হরি!
সাহিত্যবাগানে ঢোকার মুখে একটি সাধারণ মানের জামা-প্যান্ট ও খালি পায়ে অভ্যর্থণা করছিলেন এবং আপনি পা ধোবেন বলে,যিনি পুকুর থেকে জল তুলে দিলেন,তারপর আপনার পথক্লান্তি দূর করার জন্য নিজের হাতে ডাব কেটে আপনাকে খাওয়ালেন, আবার আপনার প্রাতরাশের জন্য ঠোঙাভর্তি মুড়ি-চানাচুর-নারকেল দিলেন এবং আপনাকে হাসিমুখে সভাস্থলের চেয়ার পর্যন্ত বসিয়ে আন্তরিকভাবে বলে উঠলেন,এখানে সাহিত্য নিয়ে আনন্দ করুন এবং বাড়ি যাওয়ার কোনো চিন্তা করবেন না,এখানেই থাকুন এবং সব রকমের সাহিত্য-সেবা এখান থেকেই গ্রহণ করুন।
এবং তা শুধু কথার কথা নয়, একেবারে সত্য ও সুন্দর।

তিনি ভূতনাথ পাণিগ্রাহী।

সাহিত্য-প্রাণ সকল মানুষের জন্য প্রাণপাত করতে রাজি আছেন।
তাহলে প্রশ্ন,কী পড়েন?
—কেন মানুষ পড়ি।এর থেকে ভালো বই আজ পর্যন্ত ছাপা হয়নি
কখন লেখেন?
—ঐ যে ঘুমোনোর আগে জেগে থাকতে লিখি,এখন তো জেগে থাকাটাই আসল কাজ
এই পথে কোনো পথপ্রদর্শক আছে?
— আছেন,আসুন দেখাচ্ছি,বলেই আপনাকে নিয়ে যাবেন,তাঁর তৈরি সাহিত্যবাগান,যার নাম সংলাপ।
সেই সংলাপের আদি এবং একমাত্র সভাপতি দর্শনে।
যিনি ভূতনাথের নাথ।
গিয়ে দেখবেন, শ্বেতপাথরের মর্মরমূর্তি। সেই সদাহাস্যজ্বল আনন্দময় পাগলা ঠাকুর।যিনি বলতেন,তোমাদের চৈতন্য হোক..
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
এরপর দেখবেন,ভূতনাথ পাণিগ্রাহী কোনো ভূমিকা ছাড়াই সেই মূর্তির পাদতলে বসে, আপনাকে ইঙ্গিত করে বলবেন,ইনিই সব।
এবার আপনি বুঝে যাবেন,কেন এই সাহিত্যপুরুষ অন্যের থেকে আলাদা।
সেই অক্ষর মাটির চাষা শান্ত-সৌম্য মনে একের পর গ্রন্থ রচনা করে চলেছেন।তার সংখ্যা প্রায় কুড়িটি।
এবার যে গ্রন্থটি হাতে এলেনা,তার নাম দগ্ধ পলাশ।

এ হল ভূতনাথের আশ্চর্য স্বগোতক্তির স্বতঃস্ফূর্ত ধারা।

যে সাহিত্যিক বই নয়, মানুষ পড়েন।যিনি মঞ্চ নয়,মাটিতে বসে বক্তব্য দেন,যিনি মনে করেন,গাঁয়ের চটে-ঘেরা চা-দোকানের আলোচনায় যে দর্শন উঠে আসে,তা বড় বড় দার্শনিকের বইয়েও নেই!
সেই মানুষটি যেন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে চলেছেন,এই বইটিতে।
বইটির কোনো শুরু নেই,শেষ নেই,একেবারে আমাদের কথা বলার মতো।কোনো সূচিপাতা নেই!
এই বইতে তিনি একটি আশ্চর্য আয়না নির্মাণ করে একের পর এক ছবি অক্ষরে খোদিত করছেন।সেইসঙ্গে যিনি পড়বেন, তাঁকেও অন্তর্গত আয়না করে দিচ্ছেন।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত না দিলে ভূতনাথ-দর্পণ বোঝা যাবে না!

এক

লেখাপড়া

লেখাপড়া করা যদি খাওয়া, সঙ্গম আর শুধু বেঁচে থাকাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ওটা না করাই ভালো! কারণ বাবুর কুকুরেও তো লেখাপড়া না করে,অক্লেশে বরং আরামের বেঁচে থাকে!

কবিতা

আমি জন্ম হলাম।যন্ত্রণা শুধু শুধু দিলাম স্রষ্টাকে।স্পর্শ করলোই না কেউ! দেখলোই না কেউ মুখে তুলে!
কারণ আমি হেমু মুর্মুর মেয়ে যে,নাম? কবিতা।

আত্মমর্যাদা

অর্ধশোয়া জামরুলের পাশে দাঁড়ালাম।কাজ হয়ে যুবতী লাল ফল শয্যায়!হাত বাড়াতেই!
বলল,নির্ভরতা লজ্জার।এভাবেও বাঁচা যায়।মুখ্য বিষয় আত্মমর্যাদা।

ফুল

যে ফুল ফুটুক, ভেতরে ওগুলো ওর শিশির নয়! কান্না! পোকা থেকে দেবতা সবারই চাই! ফুলের,বলি তার আবার চাওয়া কী? রক্ত করলেও সর্বমঙ্গল্যে!
সে যে ফুল ফুটুক। ভেতরে ওগুলো ওর শিরশির নয়! কান্না।

প্রেম
হৃদয় তপ্ত দগ্ধ না হলে,প্রেমের পরশ কি সহজে মেলে?

বৃদ্ধ

বৃদ্ধ কাঁপা হাতটি দিয়ে ঝাকালো হঠাৎ
বলল,বেঁচে আছি
শব্দহীন আমার মুখ!
আকাশে দেখি দলছুট একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে, কেবল আজ একা!

এইরকম জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে মানুষের মনের অসংখ্য সিঁড়ি, সহবাস এবং সাধনাকে ভূতনাথ আপন অভিজ্ঞতা ও আলোক মিশিয়ে তুলে ধরেছেন।
এ যে সেই ঠাকুরের রসে-বশে থাকা।
ঠাকুর বার বার বলতেন,কলিযুগে নারদীয় ভক্তি।
জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা মানুষের হাতে যে সময়ের বড় অভাব।তাই শাস্ত্রে যে সকল কর্মের কথা আছে,তার সময় কই?
তাই ঠাকুরের নিদান,ঈশ্বর ও সংসার দুইহাতে ধরে এগিয়ে যেতে হবে,আর তাতে একটাই জিনিস দরকার,তা হল,মন ও মুখ এক করতে হবে।

মন ও মুখের এক করার সেই অমোঘ আয়না নির্মাণের চেষ্টা করেছেন সাহিত্যসাহসী ভূতনাথ পাণিগ্রাহী।
তাঁকে প্রণাম।
————————–//——————

Share This
Categories
রিভিউ

পুবদিকের হৃদয় এবং একজন হৃদয়সন্ধানী কবি ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আঁতুড়ঘরে এক চিলতে রোদ মায়ের আঁচলের স্পর্শের মতো ছুঁয়ে যায়,শিশুপৃথিবী…
এই সূচনা প্রথম যাত্রাপথের…
ফিরে যেতে একাই একদিন, রেখে যাবে,আরও একটু আলো,হৃদয়ের…

সেই দিক যদি পূর্ব হয়,তাহলে বুঝবে প্রতিটি জন্ম আসলে অনন্তের…

শুধু মা আর সূর্য জানে,নিজেদের মতো”

একজন কবিহৃদয় শেষ পর্যন্ত যে শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকে,তা হল অপর হৃদয়ের আলো ও উষ্ণতা। মা যেমন আঁতুড়ঘরের প্রতিটি মুহূর্ত চেতন-অবচেতনে গর্ভধারণের প্রথম সময়কাল থেকে মনে মনে এঁকে রাখেন,কবিও সেই মাতৃহৃদয়অনুভবী।
নিজের ভেতর নিজেই আশ্চর্য অনুভবে লক্ষ্য করেন,সামান্য ঘষামাজার গতানুগতিক জীবন-যাপনের গতি ও গ্রহণ কীভাবে অপর হৃদয়ের সন্ধানে পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং প্রকাশিত হয়ে চলেছে।এই ক্রমাগত আবেগ ও আবেশের মুখ একমাত্র দর্শন করতে পারে, বোধ।
বোধই হল মাতৃগর্ভের মতো জন্মচক্রের আধার।এখানে শিশুসন্তানের মতো জন্ম নেয় চিন্তা। চেতনা।উপলব্ধি।
যা কবিপ্রাণকে অস্থির করে তোলে,আবার তাই কবির একমাত্র অস্তিত্ব।
সেই ভাবনা কবি সমীররঞ্জন খাঁড়ার কবিতাও আছে—

“শুধু এক পরমান্ন আজও পাহারা দেয়
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি
মা নামক এক আগুনপ্রেম”

ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মাঝখানে যে বিচিত্র ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতার প্রপিতামহ ঝুলি ভরে ওঠে,তাই বোধকে খাদ্য ও পুষ্টি জোগায়।সেখান থেকে নির্মিত হয় একের পর এক নতুন দরজা।তাই করে চলেছেন কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া।তিনি সবিনয়ে সহৃদয়ে অপর হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন,অনুভব করছেন এবং তাকেই নিজের ভেতর জারিত করে প্রকাশ করছেন দরজা।
হা,দরজা।
এই দরজা খোলার কাজটি পাঠক করবেন,কিন্তু তার আগে দরজা নির্মাণ করা প্রয়োজন। তাই ধ্বনিত সমীরণে —

“সূর্যের আলো যেমন দিনের জন্ম দেয়
রাত্রির আঁধার আনে নক্ষত্রের দল
তেমনি মানুষও হৃদয়-আকাশ রচনা করে কাহিনি হয়ে ওঠে”

এ কাহিনির সূচনা হয়েছিল সেই অ্যামিবা থেকে…
তারপর জঙ্গল,গুহা,তপোবন,কুরুক্ষেত্র এবং সিংহাসনের পর সিংহাসন পেরিয়ে জন্ম নিল মাটির অভিমুখ। কিন্তু সেখানেও শিকলের পর শিকল,তাই কেটে তৈরি হল এক তেরঙা পতাকার দেশ,স্বদেশবাসী এবং আত্মবলিদানের ওপর আত্মপ্রকাশ। এইসব ইতিহাসের পাতার ভেতর কালো কালো অক্ষরের কারাগারে বন্দী হয়ে যখন দম আটকে গিয়ে গিয়েছিল, তখন কবিতা এসে তাকে জাগিয়ে তুলল,বোঝাল,অনুভূতি মরে গেলে হৃদয় মরে যায়…
আর হৃদয় মরে গেলে সূর্য নিভে যায়…
তাই সূর্যের আলোর দিকে যাত্রা প্রয়োজন এই অন্ধকারে, এই অসুখে…
কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া যেন সেই চিরায়ত সত্যকে তুলে ধরার জন্য কবিতার আশ্রয়ে প্রকাশিত হয়েছেন—

“অচিন দেশের কোন্ অন্ধকার গুহা থেকে করো বিদীর্ণ অতি পরিচিত হৃদয়ের ভার,অজানা সময়ে হানো দ্বারে দুর্বিষহ অকস্মাৎ! কেন, কেন তুমি জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা করো ম্লান নিষ্ঠুর কষাঘাতে? জানি আমি নই,নাও তুমি শাশ্বত এই ধরিত্রীর”

শাশ্বত ধরিত্রীর জন্য সযতনে নির্মিত সব ছেড়ে চলে যেতে হবে,তাহলে কীসের জন্য এই অনুসন্ধান? এই কবিতা? এই জীবনবোধ!
সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের একটি অসাধারণ অনুভব আছে,তার হল,আমাদের জীবিতকালেই কোনো বিরাট পরিবর্তন দেখতে পাওয়ার সম্ভবনা কম। আমাদের আসল জীবন আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। সে ভবিষ্যৎ ঠিক কতদিন পরে,তাও আমরা জানি না।দশ বছরও হতে পারে,হাজার বছরও হতে পারে।তবুও শুভচিন্তার আর যুক্তিবোধের এলাকাটা অল্প অল্প করে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে ”

দুটি চেতনা,শুভচিন্তা এবং যুক্তিবোধ।
এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সুমনন কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া প্রণীত কাব্যটি “পুবের দিকে হেঁটে চলেছি”
কবিতার বইটির নামকরণের মধ্যে সেই শুভচিন্তা ও যুক্তিবোধের মাত্রামিল লক্ষ্যনীয়।
কিন্তু কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া তা কীভাবে ব্যক্ত করেছেন,তা একটু পড়ে নিই আসুন—

এক

“অক্ষর আলোয় বদলে নিই অন্ধকার গলিপথ ”

দুই

“আমি জ্বরের চাদর দু-হাত ঠেলে/এগিয়ে চলেছি পুবের দিকে”

তিন

“অশ্রুকণায় হৃদয় আকাশ হয় ”

চার

” জন্মভিখিরিও সিংহাসন খুঁজে পায়
যদি পরমান্নের ছোঁয়া হৃদয়ে লাগে।”

পাঁচ

“জন্মের মধ্যে ক্ষয় আছে জানি
তবুও জন্মের জন্য জীবন প্রখরতর হয়।”

এই ভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয় সরিয়ে জয়, ভয় হারিয়ে ভালোবাসা, ক্ষতি সারিয়ে জ্যোতি,প্রত্যাখ্যান ফেলে প্রস্তাব এবং আগুনকে আলো করার সহৃদয় সন্ধানে কবি সমীররঞ্জন ধুলো-বালি পথ হাঁটছেন।হলদিয়া শিল্পনগরীর শিশু পরিচর্যা ও আরোগ্যলাভের বরাভয় তাঁর হাতে,তিনি সেই শিশুহৃদয়কে সযত্নে ও সতর্কতায় সুস্থ রাখতে দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। তার মধ্যেই তাঁর অনুভবী দৃষ্টি পড়ে এইভাবে যে,শিশুটি পেল নতুন ছাড়পত্র, তা কি সত্যি বেঁচে থাকার পৃথিবীর! সেই কতদিন আগে কত সহজ ভাষায় কিশোর কবি বলেছিলেন—

“চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ”

সত্যি এই অঙ্গীকার বুকে হাত রেখে ক’জন করতে পারে? যখন কবি সুকান্ত একথা লিখছিলেন,সেই অসহায় ও অবহেলিত শিশুপৃথিবীর কি কোনো উন্নতি হয়েছে? কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এখনও অসংখ্য পথশিশু ও কিশোর-কিশোরী সভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মরছে,এখনও ব্যস্ত রাজপথের ধারে হোটেলে নিয়ন বাতির নিচে বাসন মাজছে কোনো খালি-গায়ের বালক,এখনও চকলেট বা মোতির গহনার কারখানার বিভৎস অন্ধকারে ছোট ছোট হাতগুলো চিরে যাচ্ছে, শ্রমে ও লালসায়… এখনও অসংখ্য শিশু-কিশোরী চালান হয়ে যাচ্ছে পর্ণগ্রাফির জ্বলন্ত আগুনে…
তাই সুকান্তের কবিতা অমলিন,তার আবেদন চির-প্রতিবাদের…
মানুষের যেমন কষ্ট পেলে যেমন আর্তনাদ করে,এই কবিতা সেই আর্তনাদের দলিল।
কবি সমীররঞ্জন সেই আর্তচিৎকারকে আত্মবেদী করে কবিতা রচনা করছেন।
তিনি আসলে চিকিৎসা করতে করতে এটাও ভেবেছেন,এই সব অসংখ্য শিশু সুস্থ হয়ে ফিরে যাক সেই সুকান্তের কবিতার মতো সুন্দর পৃথিবীতে… ” তাইতো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি / মনে হয় শুধু তোমারই মধ্যে আমরা যে বেঁচে আছি”

এই একাত্মবোধ। তাই কবিতা হয়ে ধরা পড়েছে সমীররঞ্জনের কবিতায়।তিনিও একান্তভাবে চাইছেন—

“আমার অক্ষরগুলো চাতক পাখির মতো বর্ষা খোঁজে ”

অথবা

“এসো, তুমি বীজমন্ত্রের বিধাতা হয়ে/ শস্যগোলা তরণী পূর্ণ পৃথিবী করে”

অথবা

” অশ্রুভর্তি থালা লড়াইয়ের সিংহাসন হয়ে ওঠে”

এই চেতনা ও বোধ কবি সমীররঞ্জনের শক্তি ও সাহস।তাঁর কবিসত্তার পূর্ণ আনন্দ ও আলো এই পথেই…
এই কবিতার পরতে পরতে একজন সহৃদয় মানবতার প্রতীক হয়ে অক্ষর সাজিয়েছেন কবি।তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে এক সহানুভূতিশীলতা ও সুসমপর্ণবোধ রয়েছে। তিনি নিজে যেন সেই ধারণার বাইরে নয়, এ যেন মাটিতে নেমে মাটি দিয়েই মনের মিনার নির্মাণ করার সুপ্রচেষ্টা।ভক্ত কবীরের একটি দোঁহা আছে—

” তিনকা কবহুঁ না নিদিয়ে, জো পাঁয়ন তর হোয়
কবহুঁ উড়ি আঁখিন পরৈ, পির ঘনেরি হোয়!”
অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র জিনিস বলে অবহেলা করা উচিত নয়। তিনকা অর্থাৎ খড়কুটো বলে পায়ের তলায় চাপা দিয়ে অবহেলা করা উচিত নয়, যে কোনো মুহূর্তে চোখে এসে পড়লে, খুবই কষ্টের কারণ হতে পারে।অর্থাৎ কোনো মানুষকে ছোট বা অবহেলা করা উচিত নয়। ”
সুমনন কবি সমীররঞ্জনের কবিতায় কবীরের দোঁহার প্রভাব আছে,তিনি অতি ক্ষুদ্র জিনিস ও চোখে পড়ে না,এমন অনুভবকে অতি যত্নে তুলে এনেছেন।তাঁর অনুভব সূর্যের আলো শুধু আলো নয়, বরং

” ঘুম ভাঙতেই দেখে–চাকুরির নিয়োগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে তার অন্ধ ছেলে
এক চিলতে রোদ এসে আলো করে দেয় উঠোন”

এই আলো,যা মানুষের বুকের মধ্যে আছে,তাই তিনি সন্ধান করছেন পুবের দিকে হেঁটে হেঁটে… আসলে তিনি এইভাবে কবিতায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন নিজেই একটি দিক হয়ে উঠবেন,তাই তিনি এত সুন্দর করে আঁকেন বিশ্বাস —

“পুবের দিকে হেঁটে চলেছি
পশ্চিমি হাওয়ার বাঁকে
ঠাকুর দেবতা ঈশ্বর নয়
মানুষই সীমানা আঁকে”

প্রচ্ছদে কবি ও শিল্পী ভগীরথ সর্দার অনবদ্য ভঙ্গিতে পুবদিকের যাত্রাপথ ও যাত্রী অঙ্কন করেছে,যা এই কাব্যটির প্রাণপ্রতিমা আলোকিত। লিপি প্রকাশনা সযতনে ও সুন্দরতায় প্রকাশ করেছেন,তার জন্য বিশুদ্ধ হাততালি অবশ্যই প্রাপ্য।
এই কাব্য যে নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন পৃথিবী নির্মাণ, তাই অতি সুন্দরভাবে প্রকাশিত উৎসর্গপত্রে…
সেখানে লেখা,” প্রিয় পুত্র অর্চিস্মানকে, যে বাবার পেশাগত শত ব্যস্ততায় মনে করিয়ে দেয়,’তুমি কিন্তু অনেকদিন কবিতা লেখোনি’

এই সঞ্চারিত আলোকরেখা,এ-ই তো নতুন পৃথিবীর দরজা।শুধু খোলার জন্য অসংখ্য অগণিত অর্চিস্মানের জন্য বাসযোগ্য সুকান্ত পৃথিবী তৈরি করে যেতে হবে,সে মাটিতে হোক বা কবিতায়…

পুবের দিকে হেঁটে চলেছি
কবি সমীররঞ্জন খাঁড়া
প্রকাশকাল।নভেম্বর ২০২১
প্রচ্ছদ। ভগীরথ সর্দার
প্রকাশনা। লিপি
মূল্য। আশি টাকা।

Share This
Categories
কবিতা

চন্দনকাঠের চাঁদ, চিতা ও চমৎকার :: শু ভ ঙ্ক র দা স।।।


অনশ্বর গুহার ভেতর ছুটন্ত স্পন্দন
সময়রাক্ষসের চোখে তুচ্ছ, অতি সামান্য অথচ ব্রহ্ম-উদ্যম
তাতেই অলীক নির্মিত গোটা ভুবনের সম্রাট ও সিংহাসন!


মাঘী সংক্রান্তীর কোনো তারাখসা রাত
রক্তমাংসের পুষ্পবৃষ্টি, ঘড়ির কাঁটার উল্লম্ফনসম
ভয়ার্ত জন্ম-আঙুল,চেপে ধরে অনিদ্রিত,অগাধ সফেন স্তন!


কোনো অঙ্কে বিভাজিত নয় অঙ্ক অথচ দৃশ্য শুরু
দিগন্তে মিশে যাওয়া সাদা বলাকার পাখা,সবুজ শীষের শরীর বেয়ে নামা শিশির, ধানসিদ্ধ উনুনের লালাভমুখ
অরব আয়োজনের সাক্ষী
পথচলা গুহার চিত্রের শিকারের পর অবিরাম শান্তি।


অভিযানে অ্যামিবার আলস্যমাখা চিহ্ন বুকের মধ্যে
এনেছে বক্বল বিশুদ্ধতা, গতি তো দুর্বোধ্য, বৃক্ষের পাশে
মাথায় ময়ূরপালক বেঁধে চোখ দেখানো অসূর্যকে
রূপকথার চেয়েও অসীম,অবধারিত..


অরণ্যের সকল পোশাক ফেলে আলোর স্বভাবসত্য
স্নায়ুকিরণ চলাচল সেই মহাশূন্য থেকে পিঁপড়ের পায়ের নূপুরের ধ্বনির মাঝে, যেখানেই আর্তনাদ
প্রার্থনা শিশুহাতের,শুভ্রতার মেঠো অনুবাদ


জলজ পরিবার,শ্বাস ভরে নিয়ে সপরিবারে বাঁশি
হয়ে ওঠার নিরলস নিমগ্নতা,বসুন্ধরা বিজয়ের হাসি
কোনো জীবাস্মস্মৃতির ভেতর গোপন রেখে
এই উপলব্ধি, হৃদয়ের সুউচ্চতা ও স্থাপত্য কল্পনাতীত!


ক্ষমা শব্দের ভেতর রক্ত,শূল,কাঁটা আর বহনকারী মিথ্যের দোষারোপ, আশেপাশে সবই শব,শুধু শিরের
মাঝখানে জাগ্রত তৃতীয় নয়ন
জ্বলছে, জ্বলছে নারীত্ব,পুরুত্বের কাঠে ও কাঠামোয়..


তুষারক্ষেত্রে অযুত পায়ের চিহ্ন পাবে না,শিবরেখা
বরাবর পড়ে আছে পৃথিবীজন্মের কথা,কোথায় ছিল সেই মহাজাগতিক ছিদ্র, মাতৃযোনী,বিস্ফোরণ!
সকল প্রাণ,আসলে ধ্বংসাবশেষ…


স্বপ্নের ভেতর সারাৎসার সিঁড়ি, অথচ কতক্ষণ স্থায়ীত্ব!
হৃদয়ের সক্রিয় শব্দের মূর্তি, সে দৈব হোক বা অদৈব
অঘোষিত সিদ্ধান্ত এই,নিজের সৃষ্টিকে প্রশ্ন না করে
নিজেই উত্তরলিপি পাঠ করো নিজের আয়নায়…

১০
পর্যায়ে রেখা মাত্র দুটি, আদম ও ইভ, সত্যি কোনো
গল্পের নটেগাছ না হলেও প্রতিটি মাটির নিচে শিকড়
যাচ্ছে, কোন টানে? চেতনার অধিকৃত প্রাণে
অস্ত্রগুলি পরীক্ষিত, শুধু আহত ও পরবর্তী শুশ্রূষার
কাহিনি শিশু শুনতে থাকতে মাতৃগর্ভে

১১
অন্তহীন সন্তরণে জল পেতেও পারো আবার নাও পেতে পরো,সাঁতার অশেষ,অমোঘ এবং অপরিবর্তনীয়
নদীর কাছে নৌকা মিলনপ্রত্যাশী,অথচ স্থিরতা নেই
পিতা-মাতার চক্ষু-চমাড়া,সেই ধ্বনিত প্রকাশ

১২
খাঁচা নির্মাণই দেবত্ব,এই দিলাম চাঁদ,এই দিলাম জোছনা
এই দিলাম জোনাকি,এবার আর্ষপ্রয়োগের আবেগে
বিদ্যুৎ, বিনত প্রস্তাব, বৃষ্টি ও মুখর-মেঘে
সব কাঁচাপাকা সন্তানই জয়ের স্মারক…

১৩
আঁচলের হলুদ শস্য, আলপনা সেই স্বর্গাবোধি
অনিপুণ হাতের সোহাগ মাখানো সহবাস
লক্ষ্মীবিদ্যা শেখানোর যুগান্তর শাঁস, যেভাবে নতুন ফসলের গান,মনকণিকার অভিভাবক,অযান্ত্রিক!

১৪
জ্ঞানের কাছে থেমে আছে যা,ক্ষুধার সৈকতস্বাদ
রোদপোহানোর মতো পুঁথিপাঠ,ধর্ম-মোক্ষ-মহৎমঠ
সবই শিশুপালনের মতো আবর্তন
শুধু দীর্ঘরাত পেরিয়ে একটাই লড়াই,মৃত্যু প্রতিদ্বন্দ্বী

১৫
বনমানুষের স্বভাব ঢেলে দিয়েছে ঈশ্বরের অবয়বে
নিজেকে পোশাকের মুখোশে,কাপড়ের সৌজন্যে ঢেকে
নিজেই আবার দায়মুক্ত হয়ে নগ্ন হয় রাতে ও দিনে
কে অন্তরাল? নীলকন্ঠের রেখেছো মোহিত আড়াল!

১৬
অকস্মাৎ জানতে পারল,অনুভব ছাড়া কোনো দরজা
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই,প্রজ্ঞা, প্রেরণা, প্রদীপ এবং প্রীতি
ফুরিয়েও সঠিক সন্ধি বা সহবাস হয়নি
নিহত চোখের নিচে মুঠো মুঠো বলিরেখা

১৭
সেই মরুপথে যাত্রা, নাভিসরোবরে স্নান,স্বরূপের
সাহসসমগ্র ইতিহাসের অক্ষম পাতা,তার ওপর
মৃতচিতাবাঘের ওপর ছবি তোলার মতো কারুকার্য
অবাক পানীয়,পিপাসার কীরকম সযত্ন সঞ্চারণ!

১৮
জড় ও জমির অধিকাংশ চর্চা ও চেষ্টা, অন্বেষণ
সেইসঙ্গে নরম,তুলতুলে,পদ্মপ্রথম শরীর,খনন
বাদবাকি শুধু শ্রদ্ধাবান হাহুতাশ আর পড়ে থাকে
কিছু জরাসন্ধ ইন্দ্রিয়, যাদের নগ্ন দ্রৌপদীদহন ছাড়া
কিছু বিদ্ধ মহাভারতীয় তীর

১৯
সহসা প্রেমের সারি সারি সঙ্কল্প কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকার তলদেশ পর্যন্ত একে-অপরকে
প্রতিষ্ঠিত করতে,দৃশ্য, দৃশ্যের পালিশ,গান,গানের গভীরতা,প্রস্তাব, প্রস্তাবের সংস্কৃতি, সেই সরলতা প্রথম কদম ফুল

২০
অতি কষ্টে শ্মশান সন্ধিতে আসে,আশির কাছে
বা তারও ঢেলা-ভাঙা আগে দেখিয়ে রাখে চতুষ্পদ
বা আয়তক্ষেত্রের মাপ,স্বয়ং পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার
ছায়াছবি,তবুও সরাসরি মুহুর্ত, চুম্বন

২১
উজ্জ্বল নীলগ্রহ একাই বুকে প্রান ভরে নিয়েছে
যেভাবে ডুবসাঁতার দেওয়ার আগে ভরে নেয় দম
মেঘের আসবাব, মাঠের মাধুকরী, পুষ্পের প্রস্তাব
সব স্বয়ংচালিত ক্ষুদ্রকে করে সুবৃহৎ

২২
কেবল কি কাঠামো? যাবতীয় খড়,মাটি,অস্ত্র
যে গড়ে,তার ফুসফুস, পেট,চরিত্রসংশোধন বিন্যাস
কোনো নক্ষত্র মৃত ছাড়া মাটি ছোঁয় না
ঈশ্বরও ধাতবস্বর, আঘাত হলে আকৃতি পায়

২৩
সরলতা ন্যাংটাশিশুর মতো সকলের গৃহের সামনে ধুলোর গড়াগড়ি দেয়,হাসে,দুর্ঘটনায় কাঁদে
পুনর্বাসন সচেষ্টায় সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়,শুধু অশান্ত কিছু ছাঁচ দরজা-জানালা বন্ধ করে

২৪
শব্দহীন বেদনার বাতাসে এগিয়ে চলে মহাশূন্যকারিগর
নিজের নিঃশ্বাসের সঙ্গে কথোপকথন, নিজেকে স্পর্শ
করে প্রাণময় করে তোলে পরবর্তী পর্যায়
সেখানেও প্রবাহিত সম্পর্কের সুজনিশাক, তরতাজা

২৫
উৎসমুখে আগ্নেয়ঘর, একটি মাত্র শিল্পী বেঁচে আছে
তাঁকে করুণা করে কেউ সর্বশক্তিমান বলে বাঁচতে চেয়েছে,স্বর্গের কল্পনার চেয়ে মহৎগুণ এই
পিতৃপুরুষের শেষযাত্রায় মাথায় হাত রেখে,নিরাময়ের
নতুন গল্প শোনানো,সত্যি হলেও হতে পারে…

২৬
চাঁদের সংগীত যেকোনো শরীরকে হরিতকীমন্দির করে তুলতে পারে,জীবাণুর সকল পরিচয়, দৃষ্টি, সহবাস
অথবা পরাক্রমী উৎপাদন ভুলিয়ে রাখে নন্দনতত্ত্ব
শুধু লড়াই নেমেছে সমুদ্রের মতো,পুতুল হতে পারবে না!

২৭
শেষপাতে ঈশ্বর এসে খাবেন বলে,পা-ধোয়ার জল, তুলানরম বক্বল,পরমাসুন্দরী সম্ভাষণ সাজিয়ে রেখে
অনুসরণীয় কোনো নৃত্য-গীত এবং স্তব প্রদর্শিত
শুধু ঈশ্বর পশু-পাখি-গিরিগিটি-কেঁচো অথবা গৃহপালিত
প্রীতিময় পুরাণপাতা,সেটাই রহস্য!

২৮
নদী যেদিকে বহমান,পাহাড় যতটা আকাশভেদী
বৃক্ষের শিকড়কৌশল, সব ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শেষে
যা রক্ত-ক্লেদ-কফকে রূপময়-শ্রেয়শ্রেষ্ঠ করেছে
প্রণয়,অশ্বিনীকুমারের রথচক্র ঘষটে গেছে মাটিতে

২৯
পাথরে খোদিতরূপ, অবিশ্বাসের আলোড়নে যদি
সকল মূর্তি ভেঙে যায়,জড়ো করা প্রসাধন, প্রভাব
প্রতিশোধ আগুনে পুড়ে,ছাই
সেই ছাইয়ের ওপর অবতার ঘুমায়,ত্রিশূল শর্ত হয়ে

৩০
চাঁদের দুপিঠেই চাবুক,কুমিরের রোদ পোহানোর মতো
বিস্ময় শুয়ে আছে প্রকাশ্যে,নিজেকে এই যজ্ঞের আগুনে উৎসর্গ করেছে,অষ্টধাতুর সঙ্গে মিশিয়ে
চাঁদের চেয়েও অপরূপ অপরাধ করবে বলে…

৩১
নির্মাণ মাইলের পর মাইল হেঁটে আসে,সেখানে সৌখিন পরীক্ষায় অভিষেক, মুকুট বানানো হয়নি বুকের মাংস কেটে,ক্রিয়াধর্মের সূত্র ধরে অপেক্ষা ফিরে আসবে
যা কিছু অন্তর্গত ভালো,ভালোর মহিমা

৩২
হৃদয় সশস্ত্র ডুবোজাহাজ, নিজের শরীরে সামুদ্রিক
তা নয়, যার দর্শনে শ্বাসকার্য চলে,সেখানে যুদ্ধ, যুদ্ধবিরতি,কেন এই মহাকর্ষীয় আন্দোলন, মুখ,মুখর
কোলাহল,মধ্যমণি,সেই মুদ্রা ও মুগ্ধতা

৩৩
হৃদয়ের পান্ডুলিপি কেউ না কেউ সংবিধান ও সম্রাটের
পায়ের কাছে রেখে,মুক্তি ও মধুরিমা
এই যে অবাধ আবেগ,তার শাসিত কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস
সবই দাগ রেখে,শুধু উষ্ণতাকে তপসিলি তাম্রযুগ!

৩৪
পদাবলির পাতা ইঁদুরের মুখে,খুদের আকাল
মাঠে মাঠে সবুজের লাশ,হাঁড়ি,কলসি,বাটি,চাল,ডাল
আর বৈষ্ণবী রাত,কন্ঠিবদল করে রৌদ্রবিক্রয়
অপরাহ্নে চক্ষুস্থির, এতো পাঠ বাকি নারীর…

৩৫
একটি পরিচ্ছন্ন কাল,তাই কম্পিত হাতের ওপর রাখা
জয়ের সকল চিহ্ন দিয়ে জলেডোবা রাস্তাটুকু চলাচলের
যোগ্য করে,বিশ্বরূপদর্শন। অতীত,ভবিষ্যৎ ও বর্তমানকে
জানার এই প্রক্রিয়া, সৃষ্টির নিয়ামকের দাঁড়িপাল্লা

৩৬
আত্মা কোথা থেকে নিয়ে এসেছে আনাজ,মাছ,মাংস
স্নানের পর ত্রিপিটক খুলে সাদাবস্ত্র নামিয়েছে শির
সেই শিরে চুম্বন করছে সশরীরে নূর, পরমহংসের কাতর
কান্না মিশে আছে অস্তিত্বে,এবার পোড়ায় মায়া,গাছের ছাল

৩৭
আমলকি করতলে রেখে বলছে, মানুষ নয়,মানুষী নয়
লিঙ্গভেদে শুধু মাতা, নিত্যসিদ্ধ,শুধু উচ্চারণ, পিতা,
মুমুক্ষুবৃক্ষ,মাঝখানে সাধনবর্গ সেই যোনিপথে চক্রাকারে
চমৎকার

৩৮
অরণ্য থেকে বেরানো শ্বাস,শূদ্রের হাতে তৈরি মারণাস্ত্র
বালক চলেছে সাধু-দর্শনে,বালিকা ধরেছে,বালকের
শরীরী পটবস্ত্র, যা নিজের শরীর দিয়ে তৈরি
ক্ষত্রিয় অবাক,বৈশ্য বিগলিত,শুধু একটি জ্যোতিরেখায় ব্রাহ্মণ শূদ্রের পায়ের ধুলোয় মন্ত্র লিখছে

৩৯
বেদান্ত-আয়াত এবং বাইবেলের ধ্বনিত চমৎকার ধ্বনি
একশো শতাংশ আন্তরিক জেনে,বদ্ধজীব, আরও আরও
বদ্ধ হয়ে হাসে,সেই হাসিতে বিদ্যুৎ চিরে যায়
কৃষক শুধু গলায় হাড়ের মালা দেখিয়ে বলে
ক্ষিদের পাতা খুলে খুলে নোঙর বানাব…

৪০
সহসা শেষ কথা,শেষ কথাই,মৃত্যুর মতো সংবাদ
মৃত শোনে না,কোনোদিন, অথচ দশ সহস্র গোধন ও সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রার আশায় সন্ন্যাসী ও সংসারী
সেই সংবাদের সুষ্ঠু আশায় মৃত্যুকে ভেট দেয়…

৪১
সকল ভিক্ষুক হাত জড়ো করে নদীর ওপর,যাদের শরীরে এখনও রাজসভা লেগে,কষ্ট বেশি তাদের
আর যাদের গায়ে লেগে আছে পথের ধুলোয়
তারা স্নানমাত্র সারস

৪২
শ্বাসকার্যে ঈশ্বরের সন্ধ্যা ও সকাল।গোলাকার একটি বলীয় প্রক্রিয়া, তার ওপর মাটি-পাথর-মাংসের নামকরণ ও বুক চিতিয়ে ওঠার নমুনা,সুনিপুণ বিবরণী হিসেবের
ঐ পর্যন্ত কি আকাশ? হলুদ হ্রদের হাহাকার,শুধু সূর্যপ্রতিম সবুজ সবুজ মদের মতো ঘাস!

৪৩
অমরত্বের ভুল বোঝাবুঝি, উপাস্য তাকেই করেছে যে সবচেয়ে ক্ষুরধার অস্ত্র ধরতে পারে,সেই হত্যার সারাৎসার লীলা,এখন আহ্নিক গতির পৃষ্ঠা ছিঁড়ে
ভুবন গড়ার খেলা,খেলার অধিক অভ্যাস,এমন কি ঈশ্বরীয় বিশ্বাস!

৪৪
ঝুলন্ত মাটির বারান্দা, ধনুকহাতে বীরশ্রেষ্ঠ,স্বর্গামাধুরীর মতো মোহময়ী নারীর কোমরে হাত ক্রেডিটকার্ড ধরে থাকা কুবের,তার অনেক নিচে সিনেমার পোস্টারের নিচে খালি পেটে,না,অভুক্ত নয়, অশ্রু চেটে চেয়ে আছে
নবযুগের নায়ক

৪৫
যেকোনো বৃহৎ রাক্ষসের চেয়ে শক্তিশালী কাম,নিসর্গ, দেব-দেবী,পক্ষীরাজঘোড়া,রূপকথা,সমৃদ্ধনগরের জলপথ,আবিষ্কার, আরামপ্রিয় নিদ্রা,নত হয়ে থাকা মুনি-ঋষির শির
তার চেয়েও জন্মগ্রহণ,মানুষের, মানুষের বাচ্চার..

৪৬
মানুষের বসবাসযোগ্য ভূমি,লেখো,অশ্রু, অশ্রু, অশ্রু

৪৭
অনুতাপ চেতনার শেষ তলে ঢেউ তোলে একা
যেন নিঃসঙ্গ সৈনিক
মহাভারতের কোনো অধ্যায়কে ক্ষমা করবে না

৪৮
এখনও প্রেম সমর্থন পায়নি,জিততে কোনোদিন পারেনি!শুধু অপেক্ষার পাথুরে রেখা অথবা জীবাশ্ম হয়ে
স্থির,কোনো এক জীবন্ত হৃদয়ের

৪৯
মৃতদেহের ওপর জন্মান্তরের গাছ,সেই গাছে ধুলো…

৫০
আবার চোখের পাতায় লেখো, অপেক্ষা,অপেক্ষা, অপেক্ষা…

উৎসর্গ। কবি শম্ভু রক্ষিত
চিত্রঋণ।ফেসবুক

————————//———————-
২৫শে ডিসেম্বর, ২০২১.©Suvankar Das.Haldia.

Share This
Categories
উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (চতুর্দশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

অবশেষে প্রমোদ পাকাপাকিভাবে অনীশার দোকানে এসে উঠলো । এছাড়া উপায় নেই । বাড়ি্তে প্রমোদ ত্যাজ্যপুত্র । বাড়িতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ । তাই অনীশার সাথে ব্যবসায় হাত লাগালো প্রমোদ । দোকানটা আরও কীভাবে বড় করা যায় সেই ব্যাপারে দুজনের ধ্যান-জ্ঞান । কাজে তারা এখন অনেক বেশী চাঙা । বেঁচে থাকার পথ এখন দোকান থেকে আয়ের উপর । তা ছাড়া চায়ের দোকানের পাশাপাশি খাবারের রেস্টুরেন্টের উপর তারা জোর দিলো । ধীরে ধীরে স্টেশন চত্বরে দোকানটির কলেবর বৃদ্ধি পেলো ।
বেশ কিছুদিন পর চায়ের দোকানের পাশাপাশি খাবারের দোকান চালু হয়ে গেলো । অনেক টোটোওয়ালা, ভ্যান-ওয়ালা, অনীশার খাবারের দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার । দুপুরে ডাল, ভাত, তরকারি, মাছের ঝোল দিয়ে হোটেল চালু । পেট পুরে খাওয়া, অথচ খরচাও খুব কম । যার জন্য অনীশার খাবারের দোকানে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে । রাতে রুটি তরকারি, ডিমের ওমলেট্‌ । ট্রেনের অনেক যাত্রী যাওয়া-আসার রাস্তায় অনীশার হোটেলে ঢুকছেন । খাবার খেয়ে খরিদ্দারেরা পরিতৃপ্ত ।
স্টেশন এলাকায় একটিমাত্র খাবারের দোকান । রাস্তার পাশে হোটেল খোলার জন্য হোটেলের প্রতি খরিদ্দারদের দৃষ্টি সর্বক্ষণ । অনীশা ও প্রমোদ দুজনে আলাদাভাবে হোটেলের কাজ ভাগ করে নিলো । খাবারের দোকানের দায়িত্ব রইল প্রমোদের উপর । খরিদ্দারের চাহিদা অনুসারে বাজার করা এবং খাবারের আয়োজন করা, প্রমোদের দায়িত্ব । খরিদ্দারদের রুচি অনুযায়ী হোটেলের খাবারের প্রস্তুতি । প্রমোদ সেই কাজটা খুব যত্ন সহকারে পালন করছে । যার জন্য হোটেলের সুনাম খুব তাড়াতাড়ি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । অন্যদিকে অনীশার দায়িত্ব, চায়ের দোকান ঠিকমতো চালু রাখা । যদিও অনীশা দীর্ঘদিন ধরে চায়ের দোকান সামলাচ্ছে, সেই কারণে তার চায়ের দোকান ভীষণ ভাল চলছে । দোকানের আয় থেকে এখন তাদের হাসিমুখে সংসার ।
কঙ্কাবতী ঘোতনকে তাগাদা দিলো, অনীশাদের দো-তলায় শীঘ্র দোকান খুলতে । কিন্তু দোকান খোলা নিয়ে ঘোতনের ছিল ভীষণ আড়ষ্টতা । এতদিন তার সারা শরীরে আলস্য ভর করে ছিল । মায়ের কথা শুনে তার টনক নড়ল । ঘোতনের আন্তরিক উপলব্ধি, এবার তাকে দোকান খোলার উপর নজর দিতে হবে । তার একটাই চিন্তা, দোকান খোলার পুঁজির সংস্থান ?
ঘোতনের ইচ্ছা ছিল, রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান খোলার । কিন্তু মহাজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যেটা বুঝেছে তাতে ব্যবসা শুরুর সময় বেশ কিছু নগদ টাকার দরকার ! নতুবা নতুন দোকানের ক্ষেত্রে মহাজনেরা বাকীতে কারবার করতে রাজি নয় । প্রথমে নগদ টাকা দিয়ে মাল তুলতে হবে । তারপর কাজের হালহকিকৎ দেখে ধার-বাকীতে লেনদেন । সুতরাং দোকান খোলার প্রারম্ভে ঘোতনের মোটা টাকা দরকার । দোকান খুলতে গিয়ে ঘোতনের অভিজ্ঞতা মাকে সবিস্তারে জানালো । তাই কঙ্কাবতী নিজেও শহরে কাপড়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করলো । তাঁদের সেই এক বক্তব্য, নতুন দোকানের ক্ষেত্রে বিনা পয়সায় মাল দিতে তাঁরা গররাজি ।
মাকে হতাশ অবস্থায় দেখে ঘোতন তার মত বদলালো । পুঁজির অভাবে রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান আর খুলতে চায় না । সে টেলারিং দোকান খুলতে চায় । ইতিমধ্যে সে টেলারিংয়ের কাজ অনেকটাই শিখেছে । টেঁয়া স্টেশন বাজারে আলম ফকিরের টেলারিং দোকানে বসে কাপড় কাটা এবং সেলাইয়ের কাজ ঘোতনের অনেকটাই রপ্ত । আলম ফকির আন্তরিকতার সাথে ঘোতনকে কাজ শিখিয়েছে । এর পেছনে একটা কারণও রয়েছে । একবার কিছু উটকো মস্তানদের পাল্লায় পড়ে তার দোকান বন্ধ হওয়ার উপক্রম । জোরজুলুম করে পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জঘন্য ধান্দা ছিল ! উটকো মস্তানদের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে উপযাজক হয়ে আলম ফকিরকে বাঁচাতে ঘোতন ষড়যন্ত্রকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । যার জন্য সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল আলম ফকির । তার অনেকদিন পর যখন ঘোতন আলম ফকিরের কাছে কাজ শিখতে গেলো, তখন আলম ফকির সাদরে স্বাগত জানিয়ে ঘোতনকে কাজ শেখাবার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হলো । আলম ফকির বলেছিল, “কাজটা শিখতে কিছুদিন সময় লাগবে । কিন্তু মনোযোগ দিয়ে কাজ শিখলে ভবিষ্যতে টেলারিং দোকান খুললে স্থায়ী আয়ের একটা বন্দোবস্ত হবে ।“ তাই ঘোতন এখন ভাবছে, সেই আলম ফকিরের ভবিষ্যতবাণী ঘোতনের জীবনে ফলে গেলো । ঘোতন টেলারিং দোকান খুলতে চলেছে ।
ঘোতন ছুটলো আলম ফকিরের কাছে । কীভাবে দোকান খুলবে এবং টেলারিং দোকানে কী কী সামগ্রী লাগবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে আনলো । সেই সময় আলম ফকির ঘোতনকে আরও বলল, “প্রয়োজনে সে সবরকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ।“ আলম ফকিরের আশ্বস্থতা পেয়ে ঘোতন যারপরনাই আনন্দে উদ্বেলিত ।
ইতিমধ্যে আলম ফকির একটি পুরানো সেলাই মেশিন ঘোতনকে দিয়েছে । ঊষা কোম্পানীর মেশিন । মেশিনটির অবস্থা এখনও অনেক ভাল । চালু মেশিন । ঘোতন ঠিক করলো, ঐ পুরানো মেশিন দিয়ে তার টেলারিং দোকান চালু করবে । তারপর স্থানীয় ব্যাঙ্কের স্মরণাপন্ন হবে । লোনের জন্য । লোন না নিলে দোকানটা সাজাতে পারবে না । ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখায় দেখা করে এসেছে । লোনের ব্যাপারে শাখা প্রবন্ধক যেভাবে পরামর্শ দিয়েছেন । সেদিকেই হাঁটছে ঘোতন ।
কঙ্কাবতী চাইছে, ঘোতন শারীরিক কসরত করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ।
অনীশার রেস্টুরেন্টের উপরের তলায় দোকান ঘর সাজালো ঘোতন । খুব সাধারণভাবে দোকান ঘর সাজিয়ে তুললো । পুরানো একটি সেলাই মেশিন । তার সাথে কিছু সরঞ্জাম যেমন মাপ করার ফিতে ও স্কেল, কাপড় কাটার কাঁচি, বিভিন্ন রঙের সুতো, ইত্যাদি । স্টেশনে যাওয়ার পথে দোকান হওয়ায় সুবাদে কিছুদিনের মধ্যে ঘোতনের টেলারিং দোকান মানুষের নজরে পড়লো । দোকানে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে । ছেঁড়া ফাটা কাপড় যেমন সেলাইয়ের জন্য তেমনি নতুন শার্ট, প্যান্ট, পায়জামা, ব্লাউজ, সায়া, ইত্যাদি তৈরীর জন্য খরিদ্দারদের ভিড় বাড়ছে । তবে ডোরাকাটা চেক লুঙ্গির সেলাই প্রতিদিন থাকছে । লুঙ্গি অর্থাৎ দুই মুখ জোড়া লাগানো কাপড় যাকে বলে কাছা-কোঁচাহীন ধুতি পরনের চল এলাকায় বেশী । যার জন্য প্রতিদিন বেশ কয়েকটি লুঙ্গি সেলাইয়ের কাজ থাকে ।
কাজের প্রতি ঘোতনের খুব মনোযোগ । ব্যবসায় সে দাঁড়াতে চায় । আশেপাশের ঝুটঝামেলা থেকে সে এখন অনেক দূরে । ঝুটঝামেলার কারণে মাঝে মাঝে ডাক এলে তাদের সরাসরি “না” করে দিচ্ছে । তার একটাই বক্তব্য, তাকে তার ভবিষ্যত জীবনের কথা ভাবতে হবে । নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । সুতরাং কোনোরকম অপ্রীতিকর কাজে সে আর জড়াতে চায় না । ঘোতনের সংসার-প্রীতি অনেকের আবার অপছন্দ, যার জন্য তারা মাঝে মাঝে ঘোতনকে উত্ত্যক্ত করে । কিন্তু ঘোতন তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল । ফলে তার বিরূদ্ধে কিছু বন্ধু-বান্ধবের রোষ বাড়ছে । সেটা ঘোতন টের পেয়েও নির্বিকার । ঐসব উটকো ছেলেদের কীভাবে টাইট দিতে হয় সেই ঔষধ তার জানা । সেইজন্য উটকো ছেলেদের তড়পানিতে ডরায় না ঘোতন । তার মাথায় একটাই চিন্তা, ব্যবসা বাড়ানো !
দেখতে দেখতে ঘোতনের এক বছর কেটে গেলো । কঙ্কাবতী ঘোতনকে তাগাদা দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য । ঘোতনের এখন বিয়ের বয়স, বরং বলা চলে বিয়ের মোক্ষম সময় । তাই বিয়েতে ঘোতনকে রাজি করানো । কিন্তু ঘোতন এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাইছে না । সে দোকানটাকে আরও বাড়াতে চায় !
ব্যাঙ্ক থেকে অল্প কিছু লোন পেলো । তাতে নতুন একটা মেশিন কিনলো এবং প্যান্ট-শার্টের জন্য কাপড় কিনলো । দোকান ঘরটাও কাঠের আসবাব দিয়ে সাজালো । দোকান ঘরটা এমনভাবে সাজালো খরিদ্দারেরা দোকানে ঢুকে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ঘোতনকে বলতে বাধ্য হল, “এতদিনে মনে হচ্ছে সত্যিকারের টেলারিং দোকানে ঢুকলাম ।“ খরিদ্দারদের কথাগুলি ঘোতনকে খুব তৃপ্তি দেয় ।
প্যান্ট শার্ট কাটিং করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে সোজা টেঁয়ার আলম ফকিরের দোকানে । তার কাছ থেকে ভাল করে বুঝে তারপর প্যান্টের বা শার্টের কাপড়ের কাটিং । এইভাবে ঘোতন নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকলো । এর মধ্যে স্থানীয় এক ভদ্রলোক পর্দার কাপড় সেলাইয়ের অর্ডার দিলেন । সেই কাজ হাতছাড়া করলো না ঘোতন । রাত-দিন অতিরিক্ত খেটে সেই অর্ডার পালন করলো । এইভাবে তার টেলাইং কাজের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেলো ।
ঘোতনের টেলারিং দোকান থেকে আয়ের পরিমান ক্রমশ বাড়ছে । সংসার চালাতে মাকে নিয়মিত টাকা দিচ্ছে ঘোতন । যদিও তার সব বোনেরা কিছু না কিছু কাজ করছে, ফলে তাদের জন্য ঘোতনের চিন্তা কম । তবে বোনদের বিভিন্ন আবদার কঙ্কাবতী মেটায় । ঘোতন ও অনীশা এক বিল্ডিংয়ে সুন্দর ও লাভজনকভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে । ভাই-বোনের ব্যবসা দেখে অনেকের মুখে এখন আলোচনার বিষয়, “কঙ্কাবতীর ছেলে-মেয়েগুলি ভীষণ কর্মঠ ।“
ব্যাঙ্কের ম্যানেজারবাবু পোস্ট-স্যাঙ্ক (Post Sanction Inspection) ইন্সপেকশনে এলেন । তিনি টেলারিং দোকান দেখে ভীষণ উৎফুল্ল । ঘোতনের কাজকর্মের বর্তমান অবস্থান ও ব্যবসার গতিধারা দেখে তিনি নিশ্চিত হলেন, “যোগ্য জায়গায় লোনটা দেওয়া হয়েছে ।“ মিষ্টি খেতে পীড়াপীড়ি করলো ঘোতন । তিনি কিছুই খেলেন না । কিন্তু টেলারিং থেকে ব্যাঙ্কে ফিরে যাওয়ার আগে বললেন, “এক কাপ চা দাও বরং চা খেয়ে ওঠা যাক ।“
চা খেয়ে বিদায় নিলেন ম্যানেজারবাবু ।
 চলবে

Share This
Categories
কবিতা

একান্তে :: রাণু সরকার।।

খেলেছি কত তোমার সাথে
যখন আমার শুরু হলো প্রথম মেয়েবেলা,
তখন চিনতো কি আমাদের মন-
কে তুমি আর কে আমি!

ছিলোনা আমাদের ভয় লজ্জা অপমানের জ্বালা,
তখন সেই যে আমার প্রথম শুরু বেলা-
মনটা ছিলো বিশ্রামহীন অস্থির উড়ু উড়ু,
থাকাটাই তো স্বাভাবিক।

সকাল সন্ধ্যা রোজ আসতে না তুমি বলো ডাকতে,
যেন তুমি আমার কোন এক কালে ছিলে ভীষন আপন জন,
আমার তো কেউ ছিলো না বলো তুমি ছাড়া খেলার সাথী-
তুমিই ছিলে একজন একান্ত আপনজনা!

ছুটোছুটি করেছি কতনা হাত ধরে,
হেসে খেলে বনের এপ্রান্ত থেকে ওপান্তে।
এখন কি তোমার ওসব কথা মনে পড়ে আমার মতো?
তোমার পাঁচমিশালী টুকরো টুকরো গানের সুরে দিতাম আমি তাল,
করতো না তো একটুও লজ্জা আমার!
তখন নাচতো আমার মন, হতো চঞ্চল,
তখন আমি ছোট্ট খুকী-
সবে গায়ের গন্ধ বাতাসে ওড়ে, বুঝতামনা গানের মর্মার্থ।

আচমকা দিনের সূচনা স্তব্ধ হল সব,
প্রকৃতির এটাই বুঝি নিয়ম,
পশ্চিমেতে সূর্য রেগে ঠায় দাঁড়িয়ে,
যাচ্ছে না কেনো চলে-
বুঝেছি, এবার আমার থাকতে হবে একান্তে নিরালায় ঘরের কোণে।

Share This