Categories
কবিতা

কদম : রাণু সরকার।

গত বছর আমার অজান্তেই জন্ম নেয় কদম গাছটা,
ফুল ধারণ করতে পারবে কিনা ভাবছিলাম-
তবে ফুল ফুটেছিলো গোলাপী রঙের
এই তো এই বর্ষায়!

ভাবনায় ছিলো একান্ত আপনজনকে উপহার দেবার!
অকপটে একদিন খুলেছিলো তার হৃদয়-

সে যন্ত্রণা উৎপাঠিত করেছে আমার অন্তর-
যদিও তারই দয়ায় বেঁচে থাকা।

মান্দার গাছও তো জন্ম নিতে পারতো!
সেটা তো হয়নি, জন্ম হলো কদম গাছের, তাতে আবার ফুটল গোলাপী কদম-
ফুলটা অনেকদিন ছিলো গাছে, কারর স্পর্শ পায়নি-
আকাঙ্ক্ষা যে ছিলো না- এমনটা তো বলতে পারবো না,
একদিন সে নিজের ইচ্ছেতেই ঝরে পড়ে গেল!

এখনো রাখা আছে আমার মনের আয়নায়
শুকিয়ে যাওয়া সেই কদম ফুলটি!

Share This
Categories
রিভিউ

সাহিত্যে চরিত্র হয়ে উঠে আসা সাধারণ মানুষদের নিয়ে মহালয়ার শুভদিনে চোখ সাহিত্য পত্রিকার পূজো আড্ডা ও প্রকাশনা উৎসবের জমকালো আয়োজন কলকাতার বুকে….

গল্প নয় সত্যি হ’য়ে কিছু ইচ্ছে পরিপূর্ণতা পায় তার স্বভাবসুলভ স্বকীয়তায়… ভাষার প্রকাশের ঐশ্বরিক অনুলিখন ফুটে ওঠে ছাপার অক্ষরে পাতায় পাতায়…!

তেমনই এক সুন্দরতম শুদ্ধ সাহিত্যের আয়োজনে,
গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার পূণ্যদিনে কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো চোখ সাহিত্য পরিবার আয়োজিত কবি সম্মেলন এবং মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান…!
চোখ সাহিত্য পরিবার সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে বরাবরের মতোই একই ধারায় নির্দিষ্ট ভাবনা ভিত্তিক অনুষ্ঠান করে এসেছে বিগত বছরগুলোতে, যা কিনা সাংস্কৃতিক একটি স্বকীয় উজ্জ্বতম নব ধারার সৃষ্টি করেছে এই সময়ের কলকাতার সাহিত্য অঙ্গনে..!

চোখ সাহিত্য পরিবারের কর্ণধার শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের কথা ও ভাবনায়,
” নাচের অনুষ্ঠান কিংবা পূজো প্যান্ডেল হয় একটা থিম বা ভাবনাকে কেন্দ্র করে, একটা সাহিত্যের অনুষ্ঠানও ভাবনা বা থিম নির্ভর হতে পারে এবং হওয়া উচিতও বটে.. এটাই আমরা মনে করেছি এবং সেই ভাবনা থেকেই এবারের থীম বা বিষয় ছিলো সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে উঠে আসা সফল কিছু মানুষদের নিয়ে “ওঁরা কাজ করে” শীর্ষক ভাবনার..! উল্লেখ্য যে বিগত বছরে আমাদের মঞ্চ ভাবনা ছিল, কবিপাঠকএবংকবিতারবিষয়.. এই ভাবনাকে সামনে রেখে আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছিলাম কবি এবং পাঠকদের…। কবিতার বিষয় বলতে, কবি/সাহিত্যিকরা যাদের নিয়ে মেতে ওঠে সৃষ্টির পরম আনন্দে..যেমন, বাজারের মাছওলা, সবজিওলা, রিক্সাচালক, শ্রমিক এবং ট্রান্সজেন্ডার….. আমরা সবাইকে সম্মান জানিয়েছিলাম প্রথম বর্ষে…। পরের দ্বিতীয় বছরে আমাদের ভাবনা ছিল, ‘তুমিওনারী’…। এই ভাবনায় আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছি আমাদের সমাজের মানবিক দিক থেকে অবহেলিত ট্রান্সজেন্ডার ও যৌনকর্মীদের…। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সর্বভারতীয় সভাপতি শ্রীমতী ভারতী ঘোষ মহাশয়া..। তাই এবারের মহালয়ার দিন আমাদের মঞ্চ ভাবনা– ‘ওরাকাজকরে’…। এই ভাবনাকে সার্থক করতে এবার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, বাঁকুড়া থেকে অপরাজেয় এক নারী.. সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…। যিনি ভূগোলে এম,এস সি ; বি, এড করেও বাস্তবতার নিরিখে চাকরী না পেয়ে ট্রেনে হকারি করেন..। তিনি কাজ করেন অবিরাম জীবনধারণের তাগিদে। আমার মতে, এই সমাজকে তিনি উপহার দিয়েছেন চরম এক লজ্জা। তিনি আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, আমাদের চোখে এই সমাজের বীরাঙ্গনা…। এবার মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল আবির ঘোষ। তিনি কাজ করেন দেশকে রক্ষা করার জন্য ভারতের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সীমান্তে..। আবির বাবু বিগত কার্গিল যুদ্ধের অন্যতম নায়ক ছিলেন। তাঁকে সম্মান জানাতে পেরে আমরা সম্বৃদ্ধ হয়েছি…! চেষ্টা করেছি আমাদের মঞ্চ ভাবনা ‘ওরাকাজ_করে’ অনুযায়ী এবারের অনুষ্ঠানটিকে উপস্থাপন করতে…!”

অনন্য ভাবনার চোখ সাহিত্য পরিবারের এই প্রাক পূজো মিলনমেলা ও প্রকাশ উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক শ্রী নলিনী বেরা মহাশয়, প্রধান অতিথি ছিলেন আনন্দ প্রকাশনির কর্ণধার শ্রী আনন্দ মণ্ডল মহাশয়, ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী পৃথ্বীরাজ সেন মহাশয়, আরও ছিলেন তরুণ কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শ্রী সৌগত রাণা কবিয়াল মহাশয় প্রমুখ বিজ্ঞ মানুষেরা…।

সময় শ্রদ্ধা জানায় সেই কর্মকেই, যে কর্মে মানুষের কথা লেখা থাকে…! রজত পুরোকায়স্থ মহাশয়ের ভাবনায় অসাধারণ ভাবে উজ্জীবিত এক মঞ্চ হয়ে ওঠে গত ২৫ সে সেপ্টেম্বরে কলকাতার বুকে কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের চোখ সাহিত্য মঞ্চ.. যেখানে নবীন প্রবীণ লেখকগন নিজেদের ভাবনা নিয়ে কথা বলেন, আর চোখ পরিবারের ভাবনায় তাদের মুখোমুখি ছাপায় বোনা সেই চরিত্রগুলো ভেসে ওঠে চোখ সাহিত্য পরিবারের উৎসব বারান্দায়…! অনুষ্ঠান মঞ্চের আলোয় শিশু সাহিত্যিক হিসেবে জ্বলে উঠে দশ বছর বয়সের দেভাংশ চ্যাটার্জি.. মঞ্চে দেবী দুর্গার প্রতিরুপ হয়ে ওঠেন বাঁকুড়ার ট্রেনে নিজের জীবিকার তাগিদে একজন সাধারণ মানুষ থেকে কর্ম-শিল্পী হয়ে ওঠা আমাদের সমাজের চোখের অনাহুত বিবেক গ্লানি নিয়ে ভূগোলের এম এসসি, বি এড সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…! মঞ্চে উপবিষ্ট সকল মানুষ অহংকারে তাদের দেশের এক কৃতি মানুষ কর্ণেল আবীর ঘোষকে অভিবাদন করে অবচেতন ভাবেই স্যালুট করে জানিয়ে দেয় যে যথাযোগ্য সন্মানে কখনই বাংলার সাহিত্য কর্মীরা কৃপণ নয়… নব ধারায় আগামী ভারতকে তুলে ধরতে কণ্যা স্নেহে মাতৃ দৃষ্টিতে ভালোবাসা আর আশির্বাদের ছবিতে ফুটে ওঠে ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল’…!

কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের সভাগৃহে চোখ সাহিত্য পত্রিকার এই অনুষ্ঠানে অসাধারণ সঞ্চালনা করেন প্রবীণ শিক্ষক শ্রী দেবাশিস পাল মহাশয় এবং শ্রীমতী স্বাগতাপাল মহাশয়া…।
“চোখ সাহিত্য পরিবার” এর এডমিল শ্রীমতী মৌমিতা চ্যাটার্জী মহাশয়া এবং শ্রী পঙ্কজ দত্ত মহাশয়ের আন্তরিক পরিচালনায়, পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের অসাধারণ আথিতেয়তায় মঞ্চে
সম্মান জানানো হয় এই সময়ের প্রতিভাবান একঝাঁক কবি সাহিত্যিককে..প্রদান করা হয় সম্মাননা স্বারক ও সনদ পত্র… ।
মঞ্চে সম্মান জানানো হয় ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল কে…! নাট্যকার বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ স্মৃতি সাহিত্য সম্মান প্রদান করা হয় কবি শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল মহাশয়, কবি মধুছন্দা গাঙ্গুলী মহাশয়া, কবি সজল পোদ্দার মহাশয়কে। চোখ সাহিত্য সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় কবি বৃন্দাবন দাস মহাশয়, কবি অসীমবদাস মহাশয়, কবি মহাদেব নস্কর মহাশয়কে…। সেরা পাঠক-২০২২ প্রদান করা হয় অশোক রায় মহাশয়কে…। বীরাঙ্গনা সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি মহাশয়াকে.. ।
অনুষ্ঠানে আরও যে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে, প্রাত্যহিক কবিতা পাঠের আসর এর শিল্পী কবি সুনীল বণিক মহাশয়, শ্রদ্ধেয়া মাধুরী শর্মা মাহাশয়া এবং বর্ণালী মিস্ত্রী মাহাশয়াকে..।

বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে মোড়ক উন্মোচন করা হয় কবি রজত পুরকায়স্থ সম্পাদিত চোখ সাহিত্য পত্রিকার পূজো সংখ্যা ও চোখ কাব্য সংকলনের..। এছাড়াও প্রকাশ করা হয় সাতটি একক গ্রন্থ..যথাক্রমে, কবি কৃষ্ণা গুহ’র “নির্বাচিত কবিতা”, কবি বিকাশ গুঁইয়ের “প্রেম ও প্রকৃতি”, কবি সিদ্ধার্থ সেন এবং ডাক্তার লিপিকা সেনের “রং ও তুলি”, কবি কৃষ্ণগোপাল ঘোষের “প্রথম প্রেম”, কবি ড: শিপ্রা মুখোপাধ্যায় হালদারের “পূর্বরাগের প্রণয়লিপি”, বিষ্ময় বালক দেভাংশ চ্যাটার্জির “A Tide Of Tales” এবং রজত পুরকায়স্থের “রাজার কলম হোক ক্রীতদাস”…।

মেধা মননশীলতায় বাংলা সাহিত্য সবসময় দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রধান পঙক্তির সমার্থক..সেই অর্থে আধুনিক সাহিত্যে সত্য এবং সুন্দরকে পাশাপাশি হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চোখ সাহিত্য পরিবারের মতন এমন ফেরিওয়ালা চাই যাদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য এগিয়ে যাবে তার সঠিক ভবিষ্যতের দিকে…!
জয় হোক শুদ্ধ সাহিত্যের..জয় হোক মানুষের…!

সৌগত রাণা কবিয়াল—
— কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Share This
Categories
শুভেচ্ছাবার্তা

শুভেচ্ছা বার্তা পাঠালেন কবি সৌগত রাণা কবিয়াল।

আদি থেকে শুরু করে আজকের সভ্যত্যার উত্তরণের দিনেও ‘শব্দ’ মানুষের একান্ত এমন এক প্রিয় অনুভূতি, যা তার হয়ে কথা বলে যায় ভাষায় গাঁথুনিতে ! “মন সারস” সেই বলতে চাওয়া মানুষেগুলোর মন-আরশির সুন্দরতম আমন্ত্রণ গাঁথা..! শুভ্রের প্রকাশে “মন সারস” মুখরিত মানুষের ভাবনা প্রকাশের অবারিত খোলা এক দ্বার..!সকলের অন্তরের নিভৃত সরস্বতী পুজিত হোক তার উজ্জ্বল আলোকিত প্রকাশে..!

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

বৃক্ষমাতা থিম্মাক্কা : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

বিষাদের মধ্যে জড়িয়ে থাকে ধূসর অন্ধকার। যন্ত্রণার মধ্যে লুকিয়ে থাকে গভীর কান্না। বিষাদ আর যন্ত্রণার বিষাক্ত ছোবলে ভয়ংকর শূন্যতায় হারিয়ে যায়অনেক জীবন। কিন্তু প্রতিটি জীবন আলোর স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন তখনই সফল হয় যদি যন্ত্রণা আর বিষাদের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় আলোর পথে। তার জন্য চাই আলোক-স্পর্শ, ভালোবাসার ছোঁওয়া।বাস্তবে যদি তা সম্ভব হয় তখন অন্ধকারের গর্ভে জন্ম নেয় আশ্চর্য আলো। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেদের দুঃখ যন্ত্রণাকে আলোর পথে চালিত করে ইতিহাসের পাতায় রচনা করে গেছেন সোনালী অধ্যায়। তেমনই এক আশ্চর্যময়ী নারী হলেন পরিবেশবিদ‘বৃক্ষমাতা’ থিম্মাক্কা। যিনি বিশেষভাবে পরিচিত ‘সালুমারাদা’ থিম্মাক্কা নামে।
কর্নাটকের টুমাকুরু জেলার গুব্বি তালুকে এক অতি সাধারণ দরিদ্র পরিবারে থিম্মাক্কার জন্ম। বাবা চিক্কারাঙ্গিয়া ও মা বিজয়াম্মা, দুজনেই ছিলেন শ্রমিক। অভাবের সংসারে স্কুলে যাওয়া কিংবা পড়াশোনার করার সুযোগ হয়নি থিম্মাক্কার। অভাবের সংসারে ছোটোবেলা থেকেই বাবা-মায়ের কাজে তাঁকে সাহায্য করতে হত। বাড়ির পাশের একটি খাদানে তিনি শ্রমিকের কাজ করতেন।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে থিম্মাক্কার বিয়ে হয় বিক্কালু চিক্কাইয়ার সঙ্গে। তিনি ছিলেন রামনগর জেলার মাগদি তালুকের হুলিকাল গ্রামের বাসিন্দা। বিক্কালুও শ্রমিকের কাজ করতেন। সংসারে অভাব ছিল কিন্তু বেশ সুখেই কাটছিল তাদের জীবন। সেই সুখের সংসারে একসময় নেমে আসে বিষাদের অন্ধকার।
বিয়ের পঁচিশ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের কোনো সন্তান হয় না। বন্ধ্যা রমনীদের সমাজে নানান অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হত। নানাবিধ অপবাদের শিকার হতে হত। থিম্মাক্কার জীবনেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। লোকে তাঁকে নানান কথা শোনাত। এমনকি একসময় সমাজ তাদের একপ্রকার একঘরে করে দেয়। এসব কারণে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন থিম্মাক্কা। এর থেকে মুক্তি পেতে তিনি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন। এইসময় তাঁর পাশে দাঁড়ান চিক্কাইয়া। সন্তানের দুঃখ ভোলার জন্য তিনি বিকল্প পথের সন্ধান দেন। বলেন তাঁরা দুজনে মিলে গাছ লাগাবেন আর সেই গাছকে নিজেদের সন্তানের মতো করে বড়ো করবেন। এই অভিনব ভাবনা মনে ধরে থিম্মাক্কার।
থিম্মাক্কাদের গ্রামে প্রচুর বট গাছ। তাঁরা স্থির করেন তাঁদের গ্রাম হুলিকাল থেকে পাশের গ্রাম কুদুর পর্যন্ত বিস্তৃত চার কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগাবেন। প্রথম বছর তাঁরা দশটি গাছ লাগান। পরের বছর পনেরো। তারপরের বছর কুড়ি। এইভাবে প্রত্যেক বছর গাছ লাগানোর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি গাছের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। শুধু গাছ লাগিয়ে ক্ষান্ত থাকেন না, তাদের চারিদিকে বেড়া দেন। প্রতিদিন গাছে জল দেন। এলাকায় খুব জলের সমস্যা। দীর্ঘ্য রাস্তা জল বয়ে নিয়ে যেতে হত তাঁদের। কাজটা ছিল বেশ কষ্টকর।সেই কারণে পরবর্তী সময়ে তাঁরা বর্ষাকালে গাছ লাগানো শুরু করেন।এইভাবে তাঁরা প্রায় ৩৮৫ টি বটগাছ লাগান এবং অন্যান্য গাছের সংখ্যাও প্রায় আট হাজার। সন্তানহীনা থিম্মাক্কা একটু একটু করে হয়ে ওঠেন অসংখ্য বৃক্ষের জননী।
থিম্মাক্কার কাজ মানুষের মনে ধরে। যে সমাজ তাঁকে বন্ধ্যা অপবাদ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, তারাই তাঁকে আপন করে নেয়। ভালোবেসে তাঁকে ডাকতে থাকেন ‘সালুমারাদা’থিম্মাক্কা নামে। কন্নড় ভাষায় ‘সালুমারাদা’ কথার অর্থ হল বৃক্ষের সারি। সন্তানহীনা থিম্মাক্কা হয়ে ওঠেন ‘বৃক্ষমাতা’ থিম্মাক্কা।
১৯৯১ সালে স্বামীকে হারান তিনি। এটা তাঁর জীবনের বড়ো আঘাত। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা ভাতার সমান্য টাকায় কোনোরকমে দিন চলতে থাকে তাঁর। তবে গাছ লাগানো আর তাদের পরিচর্যায় কোনো ছেদ পড়ে না। সেসব চলতে থাকে আগের মতো।একটু একটু করে তাঁর কার্যকলাপ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ নিয়ে এই কাজের জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’ পান।ক্রমশ তাঁর কার্যকলাপ রাজ্য ছাড়িয়ে দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কর্নাটক সরকার তাঁর লাগানো গাছের দায়িত্ব নেন।
২০১৯ সালে বাগেপল্লি ও হালাগুরু রাস্তা তৈরি করার সময় থিম্মাক্কার লাগানো গাছের কিছু কাটার প্রস্তাব হয়। ব্যাপারটা জানতে পেরে শিউরে ওঠেন থিম্মাক্কা। এরা তো কেবল গাছ নয়, তাঁর সন্তান। চোখের সামনে নিজের সন্তানদের হত্যা দেখবেন কী করে! থিম্মাক্কা কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন গাছগুলো না কাটার জন্য। সরকার তাঁর অনুরোধকে সম্মান জানিয়ে বিকল্প রাস্তার কথা ভাবেন।
পরিবেশের প্রতি তাঁর এই অসামান্য ও নিঃস্বার্থ অবদানের জন্য ভারত সরকার ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দেন। রাষ্ট্রপতি রমানাথ কোবিন্দ তাঁর হাতে এই সম্মান তুলে দেন। সম্মাননা প্রদানের সময় প্রোটোকল ভেঙে তিনি রাষ্ট্রপতির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। এক স্নেহময়ী মায়ের এমন মধুর স্পর্শ নাড়িয়ে দেয় রাষ্ট্রপতিকেও। যা নিয়ে তিনি বলেছেন, “সালুমারাদা থিম্মাক্কার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার মুহূর্তটি আমার কাছে খুবই হৃদয়স্পর্শী।”
১৯৯৯ সালে তাঁর জীবন নিয়ে ‘থিম্মাক্কা মাথু ২৮৪ মাক্কালু’ নামে একটি ডকুমেন্টারি হয়েছে। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তা প্রদর্শিত হয়। তাঁর নামানুসারে একটি মার্কিন পরিবেশ সংস্থা তাদের নামকরণ করেছে থিম্মাক্কা রিসোর্সেস ফর এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন। এছাড়া তিনি পেয়েছন থাম্পি বিশ্ব বিদ্যালয়ের নাদোজা পুরস্কার, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমাতা পুরস্কার, বীরচক্র প্রশস্তি পুরস্কার, কর্নাটক কল্পবল্লী পুরস্কার, সবুজ চ্যাম্পিয়ান পুরস্কার প্রভৃতি। ২০২০ সালেকর্নাটক সরকার তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দেন।
যে মহিলাকে একদিন সমাজ একপ্রকার স্থান দেয়নি, একঘরে করে রেখেছিল, সেই মহিলাকে দেশের নানা প্রান্তে আমন্ত্রণ জানানো হয়, বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে। শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণ নয়, পাশাপাশি আরও বেশকিছু পরিবেশমূলক সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তিনি জড়িয়ে রয়েছেন।
একথা অনস্বীকার্য, স্বামী পাশে না থাকলে তিনি আজ এই জায়গায় পৌঁছোতে পারতেন না। হয়তো হারিয়ে যেতেন কোনো রাক্ষুসী অন্ধকারে। স্বামী তাঁর জীবনে নতুন আলো দেখিয়েছেন। অন্ধকার থেকে তাঁকে টেনে এনেছেন জীবনের পথে। সেই স্বামীর স্মৃতিতে তিনি তাঁর গ্রামে একটি হাসপাতাল করতে চান। তাঁর জন্য একটি ট্রাস্টও গঠন করেছেন তিনি।
জীবনের চলার পথে একটি দরজা যদি বন্ধ হয়ে যায় তখন আরও একটি দরজা কোথাও না কোথাও খোলা থাকে। আমাদের শুধু সেই পথটা খুঁজে বার করতে হয় ঠিকঠাক ভাবে। যারা পারেন, তাদের জীবনের পথচলা কখনও রুদ্ধ হয় না। সেই কাজটা করে দেখিয়েছেন সালুমারাদা থিম্মাক্কা। জীবনের দুঃখ, কষ্ট, অপ্রাপ্তিগুলোকে চালিত করেছেন আলোর পথে।সংকীর্ণ গণ্ডী থেকে মুক্ত হয়ে, বৃহত্তর ও মহত্তর ভাবধারায় নিজেকে মেলে ধরেছেন উন্মুক্ত বিশ্বে। তথাকতিত পুঁথিগত শিক্ষা এবং অর্থবল না থাকলেও যে জীবনে মহৎ কাজ করতে পারা যায় তা তিনি করে দেখিয়েছেন। তার থেকে বড়ো কথা, যে প্রকৃতিকে আমরা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি, তাকে তিনি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তার চেনা রূপ। তিনি শুধু একজন পরিবেশবিদ নন, তিনি আসলে এক আলো, যে আলো আমাদের অন্ধকার পেরিয়ে এক আলোকিত জীবনপথে চালিত করে। কেবল বৃক্ষমাতা নয়, তিনি হলেন চিরন্তনী জননী।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ – দুঃখ, বিড়ম্বনা ও সহনশীলতা : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

ভারতবর্ষের গৌরবের ইতিহাসে যে সকল বিরল প্রতিভার ব্যতিক্রমী মানুষের দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ যাঁকে সময় ও কালের গণ্ডীতে বিচার করা যায় না। তিনি শাশ্বত, চির-বর্তমান। তাই জন্মের দেড়শ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জীবনে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের যে দিকটি বেশি করে আমাদের নাড়া দেয় তা হল তাঁর সহনশীলতা, যা তাকে দুঃখ, বিড়ম্বনা জয় করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, তাঁকে সাধারণ থেকে আসাধারণত্বের দিকে নিয়ে গেছে এবং মরণশীল জগতে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের জীবনের পথচলা কখনওই মসৃণ ছিল না। কৈশোর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত দুঃখ ছিল তাঁর সঙ্গী। কিন্তু দুঃখে তিনি কাতর হয়ে পড়েননি। তাঁর মধ্য দিয়ে খুঁজেছেন বেঁচে থাকার আনন্দ। আপন সৃষ্টির মধ্যেই তিনি ভুলতে চেয়েছেন জীবনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাকে। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে তাঁর সৃষ্টি, দুঃখ তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে সর্বত্র।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে যা মনে আসে তা হল তাঁর গান। জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গান লেখেননি। বর্তমানে অজস্র গান, সুর যেখানে সৃষ্টির বর্ষপূর্তির আগে হারিয়ে যায়, সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান তার ব্যতিক্রমী সুর মূর্ছনায় শাশ্বত হয়ে আছে। আজও সুখের মুহূর্তে আবেগমথিত মনে যেমন বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর, তেমনি দুঃখ ভারাক্রান্ত, বিরহক্লিষ্ট মন সান্ত্বনা পেতে ডুব দেয় রবীন্দ্রসঙ্গীতে। সারাজীবনে প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে ব্যাপক প্রসারতা তা রবীন্দ্র জীবদ্দশায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের জীবনের বহুবিধ দুঃখের মধ্যে এও ছিল এক বিষম দুঃখ। সেই দুঃখের প্রকাশ আমরা দেখি তাঁর কথায়। মৃত্যুর দু-বছর আগে ১৯৩৯ সালের ১৪ মে, রবীন্দ্রনাথ মংপুতে মৈত্রেয়ীদেবীর সামনে বলেছিলেন, “… দেখো রবিঠাকুর গান মন্দ লেখে না, একরকম চলনসই তো বলতেই হবে। …কম গান লিখেছি! হাজার হাজার গান, গানের সমুদ্র—সেদিকটা বিশেষ কেউ লক্ষ করে না গো, বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমাকে ভুলতে পার, আমার গান ভুলবে কী করে?”
সত্যিই রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাসিয়ে দিয়েছেন গানের সমুদ্রে। প্রাণ-প্রাচুর্যতাপূর্ণ তাঁর গান চির নতুন ও চিরন্তন। সেই গান তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। কিন্তু উপরোক্ত উক্তি প্রমাণ করে কতটা আক্ষেপ, যন্ত্রণা, দুঃখ মিশে রয়েছে তাঁর কথায়। আসলে জীবিতকালে তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচকের অভাব ছিল না। সেকারণে জীবদ্দশায় তিনি তাঁর গানের ব্যাপক প্রসারতা দেখে যেতে পারেননি। তাই বলে তাঁর কলম থেমে থাকেনি। দুঃখ সহ্য করে, বুকের মধ্যে অভিমান চেপে রেখে একের পর এক গান রচনা করে গেছেন তিনি।
আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের জীবনের পথচলা কখনওই মসৃণ ছিল না। সারাজীবন ধরে নানান বিড়ম্বনা তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। ঘরে-বাইরে রবীন্দ্র অনুরাগী যেমন অনেক ছিল, তেমনি রবীন্দ্র সমালোচকেরও অভাব ছিল না। বিভিন্ন সময় এরা নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন, তাঁকে কটাক্ষ করেছেন, তাঁকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কখনও এদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেননি। শান্ত, সমাহত চিত্তে তিনি সমস্ত সমালোচনা সহ্য করেছেন। হিংসা, বিদ্বেষ তাঁর মনের মধ্যে ছিল না। ছোটোবেলায় তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন ব্রাহ্মধর্মে। যে ধর্মের মূলকথা ছিল সমভাতৃত্ববোধ। আজীবন তিনি সেই ধর্ম বা ধারনা থেকে বিচ্যুত হননি। তাই দেশ কিংবা বিদেশ, যে বা যারা কটাক্ষ করুক না কেন, তিনি দুঃখকে নীরবে সহ্য করেছেন। কারুর বিরুদ্ধে অপ্রিয় কথা বলেননি।
খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে একটি কথা আছে। জীবনে যত খ্যাতি তিনি পেয়েছেন ততই বিড়ম্বনাও বেড়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের যে নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে আমাদের গর্ব, সেটাও তাঁর জীবনে ছিল এক ভয়াবহ বিড়ম্বনা ও যন্ত্রণার কারণ। তৎকালীন বহু বাঙালী পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির তীব্র কটাক্ষ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর ‘দ্য সং অফারিংস’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা বা গানগুলির ইংরাজি অনুবাদ করেছিলেন কবি নিজে। কিন্তু তৎকালীন কিছু বাঙালী পণ্ডিত বলতে থাকলেন এই অনুবাদ কবির নিজের নয়। কেননা কবির ইংরাজি জ্ঞান খুব কাঁচা। কেউ বলতে থাকলেন ওগুলো অনুবাদ করেছেন ইয়েটস। কেউ বা বলতে থাকলেন অ্যান্ড্রুজ এর কথা।
রবীন্দ্রনাথ যে ইংরাজিতে বাংলার মতো সাবলীল ছিলেন না তা তিনি নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা একটি চিঠিতে একথার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, “…আমি যে ইংরাজি লিখতে পারিনে এ কথাটা এমনি সাদা যে এ-সম্বন্ধে লজ্জা করার মতো অভিমানটুকুও আমার কোনোদিন ছিল না। যদি আমাকে কেউ চা খাবার নিমন্ত্রণ করে ইংরাজিতে চিঠি লিখত তাহলে তার জবাব দিতে আমার ভরসা হত না। তুই ভাবছিশ আজকে বুঝি আমার সে মায়া কেটে গেছে—একেবারেই তা নয়—ইংরাজিতে লিখছি, এইটেই আমার মায়া বলে মনে হয়।” তবে গীতাঞ্জলির কবিতাগুলির অনুবাদ যে তাঁর নিজস্ব সে বিষয়ে কোনো সংসয় নেই। নিজের লেখা অনুবাদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কবিতা কিংবা গানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। পাছে তাঁর কবিতার অর্থ বদলে যায় সেই ভয়ে অনুবাদের ব্যাপারে তিনি অন্য কারও ওপর ভরসা করতে পারেননি। এদিকে রোটেনস্টাইন তাঁর কবিতার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইংল্যান্ড সফরে তাঁর হাতে কিছু কবিতা তুলে দেওয়ার জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই অনুবাদের কাজে মন দেন। ইন্দিরাদেবীকে লেখা উপরিউক্ত চিঠিতে সেকথার বিবরণ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, “… গেল বারে যখন জাহাজ চড়বার দিন মাথা ঘুরে পড়লুম, বিদায় নেবার বিষম তাড়ায় যাত্রা বন্ধ হয়ে গেল, তখন শিলাইদহে বিশ্রাম করতে গেলুম। কিন্তু মস্তিস্ক ষোলো আনা সবল না থালে একেবারে বিশ্রাম করার মতো জোর পাওয়া যায় না। তাই অগত্যা মনটাকে শান্ত রাখবার জন্য একটা অনাবশ্যক কাজে হাত দেওয়া গেল। তখন চৈত্রমাসে আমের বোলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাঁক ছিল না এবং পাখির ডাকাডাকিতে দিনের বেলাকার সকল কটা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল। ছোটোছেলে যখন তাজা থাকে তখন তার মার কথা ভুলেই থাকে। যখন কাহিল হয়ে পড়ে তখনই মায়ের কোলটি জুড়ে বসতে চায়—আমার সেই দশা হল। আমি আমার সমস্ত মন দিয়ে আমার সমস্ত ছুটি দিয়ে চৈত্র মাসটিকে যেন জুড়ে বসলুম—তার আলো আর হাওয়া আর গন্ধ আর গান একটুও আমার কাছে বাদ পড়ল না। কিন্তু এমন অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না—হাড়ে যখন হাওয়া লাগে তখন বেজে উঠতে হয়। ওটা আমার চিরকালের অভ্যেস, জানিসত্। অথচ কোমর বেঁধে কিছু লেখবার মতো বল আমার ছিল না। সেই জন্যে ঐ গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে একটি একটি করে ইংরাজিতে তর্জমা করতে বসে গেলুম। যদি বলিস্ কাহিল শরীরে এমনতর দুঃসাহসের কথা মনে জন্ময় কেন—কিন্তু আমি বাহাদুরি করবার দুরাশায় একাজে লাগিনি। আর একদিন যে ভাবের হাওয়ায় মনের মধ্যে রসের উৎসব জেগে উঠেছিল সেইটিকে আর একবার আর এক ভাষার ভিতর দিয়ে মনের মধ্যে উদ্ভাসিত করে দেবার জন্য কেমন একটা তাগিদ এল। একটা ছোট্ট খাতা ভরে এল। এইটি পকেটে নিয়ে জাহাজে চড়লুম। পকেটে নেবার মানে হচ্ছে এই যে, ভাবলুম সমুদ্রের মধ্যে মনটি যখন উসখুশ করে উঠবে তখন ডেক চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার একটি দুটি করে তর্জমা করতে বসব। ঘটলও তাই। এক খাতা ছাপিয়ে আর এক খাতায় পৌঁছন গেল।” রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি প্রমাণ করে যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে সমালোচকদের কটাক্ষ কতটা মিথ্যা ছিল।
যাই হোক, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি যে তাঁর জীবনে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করতে চলেছে তা আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৩-এর নভেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর নোবেলপ্রাপ্তির টেলিগ্রাম এসে পৌঁছোয়। ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী উত্তেজিতভাবে রবীন্দ্রনাথকে সেই আনন্দ সংবাদ দেন। কিন্তু কবিগুরুর মুখে আনন্দের চেয়ে বিষণ্ণতার ছবু ফুটে ওঠে। সেই সময় তাঁর পাশে উপস্থিত এডওয়ার্ড টমসনকে কবি বলেছেন, “I shall ever have any peace again.” যে এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের লেখার উচ্চ প্রশংসা করেছেন, যে ইয়েটস্ তাঁর ইংরাজি গীতাঞ্জলির ভূমিকা লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি তাঁদের খুশি করতে পারেনি। উল্টে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন, তাঁর ইংরাজি অনুবাদ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। আবার ইয়েটস জীবনের সায়াহ্নে এসে অনুযোগ করে চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে। সব বিতর্ক ভুলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন দেশে গেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু এখানেও বিড়ম্বনা তাঁকে পিছু ছাড়েনি। জাপান, আমেরিকা, চীন প্রভৃতি দেশে তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমিরকায় দেওয়া বক্তব্যের পর কখনও তাঁকে বলা হয়েছে, তাঁর বক্তব্যের উদ্দেশ্য হিন্দু বিপ্লবী প্রচারে বাধা দেওয়া, কখনওবা বলা হয়েছে তিনি দেশের যথার্থ প্রতিনিধি নন। ১৯২৪ সালে চীনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁকে নানান অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি ২৫ মে এক বক্তৃতা দেওয়ার সময় চীনা যুবকরা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে—‘পরাধীন দেশের দাস ফিরে যাও।’ বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যখন জার্মানি যান তখন অনেকে তাঁকে দেখেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দূত হিসাবে। রবীন্দ্রনাথের জীতায়তাবোধ কিংবা দেশপ্রেম নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। তাই উপরোক্ত ঘটনাগুলি তাঁর কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু এসব অপমান কিংবা কটাক্ষ তিনি নীরবে সহ্য করেছেন।
তবে রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুঃখ বা শোক হল মৃত্যুশোক। নিজের জীবদ্দশায় পারিবারিক মৃত্যু মিছিলের স্বাক্ষী থেকেছেন তিনি। প্রায় তিরিশজন পরিজনের মৃত্যু দেখতে হয়েছে তাঁকে। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। কিন্তু মায়ের মৃত্যু তাঁর মনে সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি। প্রথমবার মৃত্যুর গভীর শোক অনুভব করেন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে। কাদম্বরী দেবী ছিলেন তাঁর শৈশবের খেলার সাথী, কৈশোর-যৌবনের বন্ধু। স্বামীর অবহেলায় নিঃসঙ্গ কাদম্বরীও রবীন্দ্রনাথকে অনেকটাই আপন করে নিয়েছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। সে বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে বলি, রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী উভয়ে উভয়কে ভালোবাসতেন। তাই কাদম্বরীর মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল। তাঁর কথায়, “কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হল তা স্থায়ী পরিচয়।” পরবর্তী সময়ে তাঁর নানা লেখায় আমরা দেখতে পাই এই হারানোর যন্ত্রণার সুশোভন প্রকাশ। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি হারান সহধর্মিনী ও কর্মসাথী মৃণালিনীদেবীকে। স্ত্রীর মৃত্যুও তাঁকে গভীরভাবে আঘাত দেয় যা প্রকাশ রয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়। এর মধ্যে ছোটোপুত্র শমীন্দ্রনাথ যাকে রবীন্দ্রনাথ আদর করে ডাকতেন ‘শমী ঠাকুর’ বলে, তার মৃত্যু কবির মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এককথায়, পরিজনদের মৃত্যু তাঁক কষ্ট দিয়েছে বারবার। কিন্তু মৃত্যুকে তিনি গ্রহন করেছেন শান্ত চিত্তে আর অন্তরের কষ্টকে তিনি মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন তাঁর লেখালিখির মধ্য দিয়ে। আসলে রবীন্দ্রনাথ জানতেন বৃহৎ কর্মের জন্যই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। তাই মৃত্যুতে কাতর হয়ে পড়া তাঁর চলবে না। শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমাদের চারিদিকেই এত দুঃখ এত অভাব এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের শোক লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষরূপে দুর্ভাগা কল্পনা করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জাবোধ হয়।” আবার ১৩২৫ সনের ১৪ শ্রাবণ শান্তিনেকতন থেকে শ্রীমতী রানু অধিকারীরে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, “… কেননা আমার উপরে যে কাজের ভার আছে; তাই আমাকে দুঃখ ভোগ করে দুঃখের উপরে উঠতে হবে। নিজের শোকের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এই মুহূর্ত কাটাইবার হুকুম নেই আমার।”
এই দুটো বক্তব্যই প্রমাণ করে রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গী। বৃহত্তর শোক আর দুর্দশার আবহে তিনি নিজের দুঃখ ও শোককে গ্রহন করেছেন। মৃত্যু তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, যন্ত্রণা দিয়েছে কিন্তু বিপর্যস্ত করে দিতে পারেনি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন প্রেমিকের মতো। তাই তিনি বলেছেন, ‘মরণরে, তুহু মম শ্যাম সমান।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা নয়। জীবনের বহু পরিবর্তনের মতো মৃত্যুও একটি পরিবর্তন। মৃত্যু মানে জীবনের শেষ নয়, শরীরের সমাপ্তি। ১৩৩৮ সনের ১৫ কার্তিক বাসন্তীদেবীকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন, “জীবন আর মরণ তো একই সত্তার দুই দিক—চৈতন্যে ঘুম আর জাগরণ যেমন।” এই মৃত্যুশোকের মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর সৃষ্টির ধারা। আর মৃত্যুকে তিনি গ্রহন করেছেন শান্ত চিত্তে, প্রকাশ করেছেন মর্যাদার সহিত। যেখানে মৃত্যু নয় তিনি বড়ো করে দেখিয়েছেন জীবনদেবতাকে। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের এই গভীর সহনশীলতা জীবনের এত বিপর্যয় এড়িয়ে তাঁকে বৃহত্তর জগতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তাঁকে অমরত্ব দান করেছে।
পরিশেষে বলি, রবীন্দ্রনাথ শুধু একজন সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, কর্মযোগী প্রভৃতি ছিলেন না। তিনি আমাদের সামনে এক প্রতীক। দুঃখকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক। গয়ায় থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ একসময় বলেছিলেন, “জীবনে দুঃখ পাওয়ার দরকার আছে।” সত্যিই তাই। তা নাহলে জীবনের প্রকৃত সুখ, বেঁচে থাকার প্রকৃত আনন্দ অনুভব করা যায় না। দুঃখ নিজেকে চিনতে শেখায়, নিজেকে ভাবতে শেখায়। শুধু তাই নয়, দুঃখই দুঃখকে ভুলতে শেখায়। জাহাজে পাড়ি দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছোনোর যে সুখ, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায় যদি সেই জাহাজ সমুদ্রে চরম ঘূর্ণিতে আটকে পড়ার পর তীব্র লড়াই করে শেষমেশ গন্তব্যে পৌঁছোতে সক্ষম হয়। আমাদের জীবনটাও তাই। জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের ভাগ বেশি। তাই দুঃখে কাতর হয়ে পড়লে জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণার, বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে দুঃসহ। সে কারণে দুঃখে কাতর হওয়া নয়, দুঃখে নিজেকে শক্ত রেখে লড়াই করতে হবে। তাহলে জীবনে প্রকৃত সুখ অর্জন করা সম্ভব। অন্য কিছু নয়, কেবল দুঃখই পারে দুঃখের নিরসন ঘটাতে। তবে তার জন্য চাই সহনশীলতা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
“দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে।
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে
ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন
জ্বলবে না আর কভু তবে।
এড়িয়ে তারে পালাস না রে
ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল
দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে যে একেবারে,
তার পরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে।”
রবীন্দ্রনাথের জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করে বারে বারে যে দিকটি আমাদের সামনে প্রকট হয় তা হল তাঁর জীবনভরা দুঃখ, বিড়ম্বনা ও তাঁর অসীম সহনশীলতা। উপরোক্ত কবিতায় দুঃখ এবং তাঁর থেকে মুক্তির পথ কী, তা সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন কবি।

Share This
Categories
গল্প নারী কথা

অন্য দুর্গা : ডঃ অশোকা রায়।

হালকা চপল ছন্দে শরত এসেছে গ্রীষ্মের প্রখরতার আতংক আর বর্ষার বিষণ্ন বিধুরতা মুছে দিয়ে. প্রসন্ন হাসি গাছের পাতার সবুজ রিবনে, মেঘ- রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলায়, কাশবনের হিন্দোলে. প্রকৃতি জুড়ে মা দুর্গার আগমনী গান… “য়া চন্ডী মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী… ” শরতের পূর্নতায় আপামর মানুষ মেতে ওঠে ঢাকের তালে উৎসবের বন্যায়. কিন্তু পুজোর আনন্দ – আয়োজন কি সবার জন্য? না, ব্যতিক্রম আছে বই কি. নানা রকম কারণে সেই ব্যতিক্রম. আমার আজকের লেখা সেই রকম একটা ব্যতিক্রম নিয়ে.
এ এক অন্য দুর্গার কথা।
কলকাতার খুব কাছেই উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজেন্দ্রপুর. এই রাজেন্দ্রপুরেরই একটা গ্রামের নাম সুন্দর গ্রাম. বিদ্যেধরী নদীর তীরে অবস্থিত এই সবুজ ঘেরা গ্রাম সার্থক নামা. এই গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার বলতে দাসপরিবার. অর্থের প্রতুলতা তো রয়েছেই, বংশ লতিকার গরিমাও কম নয়. স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে দাসপরিবারের প্রতিপত্তি বেশি. অবশ্য আজকের সুন্দর গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন নির্বাহের মান মোটামুটি ভালো. কলকাতা বা অন্যত্র কর্মের সুবাদে শুধু মাত্র ক্ষেত- খামার আর হাল-বলদের ওপর তাদের ভরণপোষণ নির্ভর করে না. শিক্ষার ছোঁয়ায় তাদের জীবনের মানে বদলে গেছে. তারা শিখেছে স্বচ্ছলভাবে স্বচ্ছন্দে বাঁচার উপায়. তাই আজ সুন্দর গ্রামের প্রকৃতি না পাল্টালেও, মানুষজনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে. বিদ্যেধরীর জলে ভেসে এসেছে শহরের ছোঁয়াচ. তাই সুন্দর গ্রামে আজকাল দু-চারটে বারোয়ারি পুজো হয়, আলোর কম্পিটিশনও চলে,.. তবুও দাসবাড়ির পুজোর আকর্ষণ অম্লান. স্হানীয় লোকজনের ধারণা, ষষ্ঠীর বোধনের সাথে সাথে মা দুর্গার জীবন্ত অধিষ্টান হয় দাসবাড়ির পুজোর দালানে. সামনের মাঠে সামিয়ানার তলায় তাই নানা বয়েসের পুরুষ – নারীর ভিড়. সারাদিন ধরে চলে পুজোর কাজকর্ম, আড্ডা গুলতানি আর রান্নার তদারকি. সারা গ্রামের মানুষের পাত পড়ে চারদিন এই দাসবাড়ির অন্দরের গোলঘরে.
আজ অষ্টমী. পুষ্পান্জলি শুরু হয় নি এখনো. যে যার নিজের রুচিতে সাজগোজ করে পুজোমন্ডপে জমিয়ে বসেছে. মেয়ে- বৌরা পুরোহিত কে পুজোর কাজে হাত লাগিয়েছে. বয়স্ক মহিলারা উপদেশ – নির্দেশ দিতে ব্যস্ত. বয়স্ক পুরুষদের ব্যস্ততা একাল- সেকাল নিয়ে আলাপ আলোচনায়. আর কম বয়সী পুরুষরা কেউ বাইরের কাজে, কেউ ভেতরের কাজের হিসাবে দৌড়াদৌড়ি করছে.
দাসবাড়ির দেউড়ির নহবতে বাজছে সানাই…. রাত পুইয়েছে এক শারদ প্রাতে. মন্ডপ আলো করে মা হাসছেন. মায়ের অঙ্গাভরণে আলোর রোশনাই. রোশনাই অল্পবয়সী মেয়েদের চোখে- মুখে. আজ বিকেলে কে কি পরবে…. তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা. কেউ বালুচরী, কেউ সিল্ক কেউ আবার চান্দেরী. সব কটা কলকাতার বিখ্যাত দোকানের. একজন বলে, “তোরা বাবা পোশাকের প্ল্যান কর, আমি বাবার সাথে যাব সন্ধ্যা- রাতে কলকাতা. মেট্রো চেপে ঠাকুর দেখব সারা রাত.
বাবা বলছে আমিনিয়ায় বিরিয়ানি খাওয়াবে.” অন্য একটি মেয়ে বলে, “কলকাতায় তো বেজায় ভিড় হবে, সামাল দিতে পারবি তো নিজেকে? ” গরবিনী বলে ঔদ্ধত্য নিয়ে , ” কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে?”
অন্যরা উত্তপ্ত আবহাওয়ায় জল ঢালে…..” কাল সকালে প্যান্ডেলে আসবি তো? ” এই একটা আন্তরিক প্রশ্নে ওঁ শান্তি. কে আর অপ্রীতিকর পরিবেশ চায় পুজোর দিনে?কিন্তু অশান্তি তো একটা ঘটলই পুজোর দিনে, তাও আবার পুজোর অষ্টমীর সকালে. আচ্ছা বয়েস, অর্থ আর পারিবারিক দম্ভ মানুষ কে কতটা নিষ্ঠুর করতে পারে?
দাসবাড়ির সামিয়ানার তলায় এককোণে এক মেয়ে, পরণে আধো ময়লা শাড়ি,হাতার কাছে বেশ খানিকটা ছেঁড়া ব্লাউজ, উস্কোখুস্কো চুলে একমনে কোঁচড়ে রাখা শিউলি ফুল তুলে মালা গেঁথে চলেছে. বয়েস? আন্দাজ ষোল – সতেরো তো হবেই. কালই তো ওর মা সদু ওর বাবা বাদল কে বলছিল রাতে, ” মেয়েডারে এট্টা শাড়ি কিনে দ্যাও না. সনাতন ব্যাপারী কাল আসবে মঞ্জু মার শাড়ি খান দিতে. দুগ্গার একখানও আস্ত শাড়ি নেই.” বাদল বলে, সাধ কি হয় না দুগ্গোর মা? কিন্তু শোলার কাজ করে মাকে ডাকের সাজ পরানো যায়, মেয়েডারে সাজানো যায় না. ” কিন্তু অতবড়ো মেয়ে, ওরকম ভাবে ঘুরে ফিরে. শেয়াল – কুকুরের তো অভাব নাই কুনখানে”
বাদল কোন জবাব দেয় না. অক্ষম বাপের জবাব দেবার কি আর থাকতে পারে? দুর্গা ঘুমোয় নি. বাপের কথা শুনে কষ্ট পায় না. মা দুর্গার ওপর তার দারুণ ভরসা. সে বিশ্বাস করে মা দুর্গার কৃপায় একদিন তাদের অবস্থা সে ফেরাবে. বাবা – মা কে সুখে রাখবে. কিন্তু কি ভাবে? তার হদিস মা দুর্গা এখনও দেয় নি. দুগ্গা গ্রামের অবৈতনিক বিদ্যালয় যায় আসে. আর স্বপ্ন দেখে মা দুর্গা তাকে অনেক লেখা পড়া শিখিয়ে বড়ো চাকরি পাইয়ে দেবে. তাদের সুদিন আসবে.
দুগ্গার মালা গাঁথা শেষ. পুরুতমশাইরে ডাক দেয়, “ও দাদু শিউলির মালাটারে মা দুগ্গার গলায় দ্যাও না দুলিয়ে গো. বড়ো যতনে গেঁথেছি. পুরুত কিছু বলার আগেই দাসগিন্নি নথ নাড়িয়ে বলে,” কি আপদ! দূর হ এখান থেকে. নোংরা বাসী কাপড়. এখনি ছোঁয়া – নেপা হয়ে যাবে. ঐ মালাটাকে দোলাব মায়ের গলায়. মা অপবিত্র হয়ে যাবে না? ” ” না গো ঠাকুমা নেয়ে- ধুয়ে ফুল কুড়িয়েছি. আমাদের উঠোনে শিউলি গাছ ভরে ফুল ফুটেছে. অনেক ফুল পড়েছিল গাছের তলায়. পরিষ্কার করে নিকোয় মা রোজ. “” তুই মিথ্যে কথা বলছিস. নেয়েছিস তো তোর চুল উস্কোখুস্কো কেন? ” দুগ্গা নীচু স্বরে বলে,” ঘরে নারকেল তেল বাড়ন্ত. চিরুনী গেছে ভেঙে. বাবা আনলি তবে চুল আঁচড়াবো মা- বেটি মিলে. ” পুরুত দাসগিন্নির দিকে তাকায় সন্মতির আশায় , ” মা দেব পরিয়ে মালাটা? ” দাসগিন্নির গম্ভীর নির্দেশ আসে,” পুরুত মশাই আপনি নিজের কাজ করুন.” তারপর হাঁক দেন, ” এই কে আছিস কাছে – পিঠে….. দুগ্গারে বার করে দে. ” দুগ্গা বলে,” আমারে কারোরি বার করতি হবে না গো ঠাকুমা. দুগ্গা এমনি চলে যাচ্ছে. তবে মা দুগ্গারে বলি যাচ্ছে সে, আমার হাত থিকি মালা তোমারে একদিন নিতি হবে, যদি তুমি হও আমারো মা. “
দুগ্গা ছুটে দাসবাড়ির চৌহদ্দি পার হয়েছে. পুজোর দালানের বাইরের চত্বরের এককোণে পড়ে আছে ওর গাঁথা শিউলির মালা. শরতের আকাশের হালকা ভাঙা মেঘ জমাট বাঁধে.অসময়ের বৃষ্টির ঝরঝর শব্দে দুগ্গার গাঁথা শিউলির মালার কান্না মিশে যায়. শরতের শুভ্রতা ম্লান হয় মানুষের মনের কালিমায়.
এ গল্পটা এখানেই শেষ হলে হতে পারতো, কিন্তু তা তো হলো না. কারণ জীবন প্রবাহ সব সময় নিয়ম মেনে চলে না. আর মা দুর্গার ইচ্ছেও নয় সেটা. মা দুর্গা চাননি সবকিছু নিয়ম মেনে স্বাভাবিক ভাবে হোক. পাঁচ বছর আগে দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন দাসবাড়িতে অপমানিত হওয়ার পর আর দুগ্গাকে দেখা যায় নি, তার মা- বাবা কেও নয়. গরীবের থাকা না থাকাতে গ্রামের বাসিন্দাদের সে ভাবে মাথা ব্যাথা হয় নি. তবুও সন্দেহ আর জল্পনা- কল্পনা শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু দানা বাঁধার আগেই থেমে গেছে. এই গতির যুগে মানুষ ছুটছে নিজের ধান্দায়. গ্রামের মানুষজনও এর বাইরে নয়. অতশত দুগ্গার ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়, যাদের দুগ্রাস ভাতের সংস্হান নেই ? প্রায়ই তো ওদের তেল নুন চাল ধার দিতে হত ফেরত পাওয়ার আশা না করে. দাসগিন্নীর ভাষায় ‘আপদ বালাই গেছে, ভালো হয়েছে.’
বছর পাঁচ বাদে আজ আবার হিমের পরশ বুলিয়ে শরত এসেছে. নিয়ম মতো মা দুর্গাও এসেছেন. দাসবাড়িতে ঢাকের কাঠি পড়েছে. শুরু হয়েছে প্রতি বছরের মতো দুর্গা পুজোর আয়োজন. সেদিনের মতো আজো অষ্টমী. সমস্ত পরিবেশ এক. কিছু লোকজনের মুখের পরিবর্তন হয়েছে. গ্রামের কোন কোন মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে, অন্য কোন মেয়ে বিয়ে হয়ে ঘর- বসত করতে এসেছে এই গ্রামে. অবশ্য পুরুত একই রয়েছে, একই রয়েছে দাসগিন্নী. তবে বয়েসের ভার কিছু ছাপ ফেলেছে তাদের চেহারায়, তাদের চলন- বলনে. নয়তো এই সব ছোটো খাটো পরিবর্তন ছাড়া দাসবাড়িতে পুজোর চিত্রপট একই. মা দুর্গাও একই ভাবে বিরাজমানা. পুরোহিত পুষ্পান্জলির মন্ত্র পড়ছেন নিষ্টাভরে..
“আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে.ধনং দেহি পুত্রান দেহি, সর্ব্ব কামাংশ্চ দেহি মে” জমায়েতের মধ্যে শুদ্ধভাবে পুনরুচ্চারণের প্রচেষ্টা. ভক্তির নেই খামতি.
পুষ্পান্জলির পর্ব শেষ. সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এক সালংকারা নারী
অলক্তরঞ্জিত খালি চরণে সে এগিয়ে আসছে গজেন্দ্রগামিনী ছন্দে. পিছনে চারদাসীর হাতে পুজোর সম্ভার. দাসবাড়ির দুর্গা প্রতিমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেই সুন্দর রমনী. সমবেত সকলের চোখে সমীহের সাথে কৌতূহল… কে এই নারী? নিশ্চয়ই কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ… নারী মহলে ফিসফিস. একবার ফিরে তাকায় সালংকারা সুন্দরী. চিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে. মুহূর্তে মেলায়. দাসীর হাত থেকে লাল ভেলভেটের বাক্স নেয় একটা. ক্লিপ খোলে . সোনার শিউলির লম্বা মালা. এগিয়ে দেয়, পুরুতের দিকে ” দাদু পরিয়ে দাও এ মালা মা দুর্গার গলায়.” পুরুত শিউরেছে, এ যে বেশ কয়েক বছর আগে এক মেয়ের আকুতি! তবে কি… মুখটা তো চেনা – চেনা, তবে অনেক পরিবর্তন. পুরুত আজও চেয়েছে, দাসগিন্নীর পানে.. ” পরাবো মা?” দাসগিন্নী বিগলিত, ” নিশ্চয়ই পরাবেন ঠাকুর মশাই. মায়ের জন্য আনা জিনিস ফেরাই কি করে? ” নারী তখন করজোড়ে চোখ বন্ধ করে মা দুর্গাকে মনে মনে বলে, ” পাঁচ বছর আগে তুমি আমার গাঁথা শিউলির মালা পরো নি, যে মালায় যৌবন ছুঁই ছুঁই এক পবিত্র মেয়ের অকৃত্রিম ভক্তি ছিল. আর আজ এই দুর্গা বারবধু. তার দেয়া সোনার শিউলির মালা তুমি কি মনে কর অপবিত্র, অশুচি? তাহলে আজো এ মালা পরো না তুমি. চোখ খুলে নারী দেখে পুরুতদাদুর পরানো মালা গলায় মা যেন হাসছেন আর বলছেন,” দুগ্গা আজ তোর দিন. তুই এদের জানিয়ে দে, আমার পুজোয় পবিত্র – অপবিত্র বলে কিছু হয় না. আমার পুজোয় সকলের সাদর অংশ গ্রহণ আমার কামনা. এই দিনের অপেক্ষায় আমি ছিলাম.
দাসগিন্নী জিজ্ঞেস করেছেন, ” তুমি কে মা?” সেদিনের দুগ্গা সদম্ভে জানিয়েছে, ” আমি বাদল শোলাকারের মেয়ে দুগ্গা.” তবে সে আমার পূর্বাশ্রমের পরিচয়. আজ আমি বিজুরী- বাঈ. বনেদী বাঈজী. মুজরো করি নিজের বাড়িতে. ডাক পেলে লক্ষ্নৌ পাটনাও যাই. ঠিকানা কলকাতার বৌ বাজারের সোনা পট্টি . এই জিনিস গুলো দিয়ে গেলাম. পুজোর কাজে লাগিও. বেশ্যা বাড়ির মাটি তো মায়ের কাঠামো তৈরির কাজে লাগে.
আর জেনো মানুষ মানুষই হয়. পবিত্রতা – অপবিত্রতা দেহে নয়, মনে জন্মায়. দৃপ্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে যায় দুগ্গা সকলের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে. এ এক অন্য দূর্গা.

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

দুর্গার দুর্গতি : ডঃ অশোকা রায়।

করোনার ক্যারিশমা সত্যি সত্যি দেখার মতো। দেবী দুর্গারও বুক বাপের বাড়িতে এসে দুরুদুরু।অথচ বাপের বাড়ির লোভ জয় করা দুরুহ। মা দুর্গা ও বোধহয় অতটা জিতেন্দ্রিয় নন। বছরান্তে একবারো বাপের বাড়ি পা দেবেন না,তা কি করে হয়? কথায় বলে মেয়েদের কাছে বাপের বাড়ির মাটিটুকু বড়ো মিষ্টি। স্বামী বুঝিয়েছেন,’ এই আশ্বিনে যেওনা বাপের বাড়ি। গতবার গিয়ে তো দেখেছ, খাতির যত্ন পাওনি। আর পাবে কোথা থেকে বলো তো দুর্গা রানী? করোনা নামে
অতি মহামারী পৃথিবী কে ছারখার করে দিয়েছে। তারপর তোমার বাপের বাড়ি,তা সে পূব বা পশ্চিম বাংলা- যাইহোক না কেনো,কেউ তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদের মতো ধনী নয়।ফলে করোনার করুণায় তোমার বাপের বাড়ির বাসিন্দাদের হাঁড়ির হাল। নন্দী তো সেদিন ঘুরে এসে বললো, তাবড় তাবড় ভালো চাকরি করা লোকেরা বাড়িতে বসে মাছি তাড়াচ্ছে আর টিপে টিপে সামান্য সঞ্চয় থেকে খরচা করছে,প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া টিউব থেকে পেস্ট বার করার মতো।না শেভ করা দাড়ি নিয়ে অনেক পুরুষ এখন ঘরের মধ্যে বিষাদের ঘরে নিজেদের বন্দী করেছে। বেল্ড বা ক্ষুর- শেভিং ক্রিমের পয়সা যতটা বাঁচে। যাদের অফিস বা রোজগার নামক বস্তু টি কোনক্রমে টিঁকে আছে, তাদেরও সদাই ভয়, এই বুঝি রিটেনশনের নোটিশ দ্বিধা থরো থরো হাতে কেউ গুঁজে দিল। মালিক পক্ষের মানবিকতা আছে, কিন্তু কি করবে তারা? করোনার কাছে নতজানু হয়েও বিশেষ সুরাহা হয়নি।নিজেদেরই পেট ভরে না, শংকরকে ডাকবে কি করে? সুতরাং অন্ততঃ ফিফটি পারসেন্ট ছাঁটাই তো বটে, ইফ নট মোর,নয়তো পুরোপুরি তালা বন্ধ। বাড়ির গিন্নীদের কাছে বিউটি পার্লার যাওয়া পূর্ব জন্মের স্মৃতির মতো। বরং দু ফোঁটা তেলে জলের ছিটে দিয়ে রাঁধতে নাজেহাল। লোকাল ট্রেন তো বিধিবদ্ধ ভাবে চলল না। স্টাফ স্পেশ্যাল নাম কা ওয়াস্তে। আপামর পাবলিকের ভিড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা ব্যবস্থা। মুখে মাস্ক কি এহেন ব্যবস্হার মুশকিল আসান হতে পারে? তার ওপর উপনির্বাচনে প্রচারের ঠ্যালা।যেও না গিন্নী, অসুবিধায় পড়বে। গিন্নী নাছোড়, ” বছরে তো একবার বাপের বাড়ি যেতে দাও। বাদবাকি সময় তো তুমি,তোমার ছেলেমেয়ে আর তোমার হাঁড়িহেঁশেল নিয়ে পড়ে থাকি। আমার কি আমোদের সুযোগ টুকুও থাকবে না? এক নম্বর মেল-শভিনিস্ট কোথাকার।”কি যে হবে মা দুর্গার কে জানে! আর জানার ইচ্ছে আছে নাকি ভদ্র মহিলার? সেই আসতেই হবে ঝড়- জল উপেক্ষা করে কোভিড এর যুগে। এতোটাই অবুঝ যে বুঝতে পারে না, দুর্গা এসেছে বলে হাজার হাজার না হোক, অন্ততঃ শখানেক লোক ছুটে আসবে আদিখ্যেতা করতে। কোভিডের সংক্রমণ হার বাড়বে। সামাল দিতে সরকারের প্রাণান্তকর অবস্হা। পুলিশ ব্যতিব্যস্ত। আর কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এলে আবার প্রাণ নিয়ে টানাটানি।ডাক্তার দের নাওয়া- খাওয়া মাথায়। কোভিডের গুঁতো তো মা দুর্গা কে সইতে হয় না। তাঁর মাথাব্যথা হবে কেন? চীন যতদূর মনে হয় তাঁর এক্তিয়ারভুক্ত নয়। শুনেছি তো চীনে ওয়াংশাং বলে এক দেবতা আছে, সে না কি সাহিত্যের দেবতা; আর ফুসি স্বর্গলোকের দেবতা, নুইও মর্ত্য লোকের দেবতা।
আর ওয়েল বিয়িং এর দেবী সকলের মঙ্গলের দিকটা দেখে। আর ইয়াং লং ড্রাগন বৃষ্টির দেবতা। তবে সব সেরা দেবতা হচ্ছে Tian. তা দুর্গার সাথে এদের কোন প্যাক্ট হয়েছে কি না জানা নেই।তবে দুর্গা আসছে কোন সাহসে? বলি মরণের ভয় ডর কি নেই?তার ওপর বায়না, দুর্গা আর তার পরিবার মাস্ক পড়ে কিছুতেই আসবেন না।সৌন্দর্য নষ্ট হবে যে! কোভিড বিধিতে পড়ে গেলে ফাইন হবে , সে চিন্তাও নেই! মর্ত্যে আসবে, অথচ মর্ত্যের আইন মানব না… এ তো বেশ গা জোয়ারী ব্যবস্থা। অথচ দুর্গার মুখে যত বোলচালই হোক না কেনো, করোনার ভয়ে তিনিও কিন্তু কাঁটা।পুজো উদ্যোক্তারা কেউ কেউ দুর্গা আর তার পরিবারের মুখে মাস্ক পরিয়ে দিলে,
” মা দুর্গা রাতের স্বপ্নে উদ্যোক্তাদের ওপরে প্রথম হম্বিতম্বি করেন,” এক্ষুনি হাটা তোদের এই মুখোশ, আমার আর ছেলেমেয়েদের প্রাণ যায় যায়। অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছে। এখানকার ডাক্তার গুলো ভীতুর ডিম এক একটা। পিপিই কিট পড়ে জবরজং সাজা ডাক্তার সব। নিজের সেফটি দেখতে ব্যস্ত। অথচ পকেটে টাকা বোঝাই করা চাই। তাই কত বুদ্ধি। হাসপাতালের ডিউটি শেষ হলো তো, শুরু হলো প্রাইভেট কনসালটেন্সি।ভিডিও কলিং এ দেদার রোজগার।বুদ্ধুরাম ডাক্তার দের পড়াশোনার বহর তো জানা আছে! আর অভিজ্ঞতা? না বলতেই হবে এবার, ধনবান হলে একরকম কসরত। আর ধনবান না হলে ভিডিও কলে বা ফোনে যা হোক নিদান দিয়ে ছেড়ে দাও।অন লাইনে পেমেন্ট এলেই হলো। টিকি পাকড়াও করে কোন পাকড়াশী? তার তো এখনও জন্মই হয়নি। চীনের উহান দোষী নিশ্চয়ই। এর একটা বিহিত করতে হবে বলে তোদের বাবা ঐ কল্কে সেবী শিব সকল দেবতা দের নিয়ে মিটিং ডাকছে। শুধু ডেট ফিক্সিং বাকি। আমি এখান থেকে ডেটা নিয়ে যাই… তখনই ডেটটা জানিয়ে দেব তোদের। কত রূপে কত অসুর আর দৈত্যদের বধ করলাম! আর তোদের বিরক্ত করে মারছে যে করোনাসুর, তাকে মারা তো আমার বাঁ হাতের খেলা রে। তবে একটা ভ্যাকসিন আর সিরিঞ্জ আমার চাই। খোঁজে আছি। পেলেই করোনাসুর কে এমন ফুটিয়ে দেব বুকে সিরিঞ্জ, জিভ বার করে অক্কা পাবে। বিভিন্ন দেশের সাথেও যোগাযোগ রাখছি, যদি কেউ মোটা সিরিঞ্জ আর ওষুধ দেয়। তাহলে মর্ত্যের খেলা মর্ত্যেই মিটিয়ে যাব। আমি এর মধ্যে না পারলে লক্ষী আর সরস্বতী তো পরপর আসবে। ওদের হাতেই না হয় করোনাসুর বধ হবে। মায়ের কাজ মেয়ে করবে, তাতে লজ্জা কি? শুধু ভয় পাচ্ছি এখন এখানে লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকের যদি কিছু হয়, কি হবে? একটা ডাক্তারও ফিজিক্যালি
চেক- আপ করবে না।ভিডিও কলিং এ কি রোগী দেখা যায় রে? নাড়ি টিপব না, জিভ দেখব না নিজের চোখে? সব কি ক্যামেরার এক্সপোজার দিলেই হয়ে যায়?ওদের বাপ আমায় মোবাইলেই তুলোধুনো করবে, ফেরারও তর সইবে না। বলবে, “পরপর দুই বছর শূন্য মন্ডপে বসে ধান ভানার কি দরকার? সরাসরি শিবের গাজন তো কৈলাশে বসেই গাওয়া যায়। আমি নিজের গাজন ভালো করে শুনতে পাই, তা’ও আবার তোমার মুখে। মনে পুলক হয়। মর্ত্যে তুমি যা কর, তা ঠিক মতো দেখতে পাই না, শুনতেও পাই না। একেবারে বেপরোয়া হয়ে বাপের বাড়ির আদর খাও। চোখ আর কান দুটো অর্গানই আজকাল বড়ো জ্বালাচ্ছে।” দুর্গা বলেন, এবার থেকে তোরা আমাকে আনার সময় ঘোড়া- মুখো অশ্বিনী কুমার দুজনকে আনার ব্যবস্থা করবি। অশ্বিনীকুমাররা যমজ দুই ভাই। কপালদোষে ঘোড়া মুখো। সূর্য আর তার বৌ সংজ্ঞার কি যে শখ জাগল, ঘোড়া রূপে মিলিত হল। জন্ম হলো ঘোড়া মুখো অশ্বিনীকুমার দের।মা হয়ে তোদের সাথে এসব আলোচনা করা উচিত নয়,বুঝি। তবুও দুশ্চিন্তায় কি মাথার ঠিক থাকে?ওদের কথা তোদের জেনে রাখা ভালো। পরের বার এ্যাপ্রোচ করতে সুবিধা হবে। তোরা তো দেখছি সকলেই ষোল ঊর্ধ্বে।সুতরাং আমার পাপ হবে না অশ্বিনী কুমার দের জন্ম রহস্য খোলসা করে তোদের বলার জন্য । ষোলো পেরোলেই ছেলে -মেয়ে মায়ের বন্ধু।জানিস,অশ্বিনীরা তো আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস। সরোর শরীরটা চিরকাল তেমন শক্তপোক্ত নয়। লক্ষীর ইদানীং দেখছি এনার্জি লেভেল কম। এনসিওর খাওয়াচ্ছি দুবেলা, কিছুতেই কিছু হবার নয়। কেমন করে কেৎরে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ না। কেতোর আবার সামনের মাসে আর্চারি কম্পিটিশন আছে। এখানে আবার আসবে তো সেই কার্তিক মাসেই, তাই ডেট এ্যাডজাস্ট করার জন্য আমাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছে। এ্যাপ্রুড হয়ে যাবে মনে হয়। কর্তৃপক্ষ তো জানে পঞ্জিকার ডেটের নট নড়ন- চড়ন।গনশার দেহটাই ওমনি ঢ্যাপসা। বলতে গেলে ও বিকলাঙ্গ মানুষ। মানুষের দেহে হাতির মাথা। তার ওপর পেটটাও অস্বাভাবিক বড়ো ।হাঁসফাঁস করছে।এখানে এতো বৃষ্টি হচ্ছে,অথচ গুমশুনি ভাব গেল না।দু- দুটো মাস্ক স্পেশাল অর্ডার দিয়ে করিয়েছিস , গনশার তো সর্দি হয়ে গেছে। বারবার ন্যাপকিন চাইছে।করোনা হলে সামলাবে কি করে?আসার জন্য এখন আমার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সোয়ামীর কথা না শুনলে এমনই হয়। তা যাক গে এসব কথা। করোনা হলে দেখা যাবে। তোরা মানুষরা কত কষ্ট পাচ্ছিস, আমার তো এখানে থাকার মেয়াদ কুল্লে পাঁচদিন। তোদের ভোলে বাবা ঠিক পার করিয়ে দেবে। জয় ভোলানাথ।

Share This
Categories
রিভিউ

চার দেয়ালের ঘেরাটোপের বাইরে উন্মুক্ত আকাশের সন্ধ্যা আলোয় বৃষ্টিস্নাত হয়ে লীনা প্রকাশনীর এক ভিন্নমাত্রার আয়োজনে সুরে-স্বরে মুখরিত হয়ে উঠলো কলকাতার মোহর কুঞ্জের সবুজবীথি।।।।

আলো এসে ভরিয়ে দিচ্ছে কাশ ভোরের সকাল..মাতৃ পক্ষের আগমনী সুরে প্রকৃতি হয়ে কথা বলছে তরুণ কিশোরের মনের ভাষা..বাংলার সাহিত্য পাড়ায়ও তার ছোঁয়া অদ্ভুত এক উজ্জ্বল সুখের কথা হয়ে ফুটে উঠছে আবীর রাঙা সব উৎসবে…!

লীনা প্রকাশনীর আয়োজনে এমনই এক অসাধারণ ভালোবাসা ও বন্ধনে সাহিত্যের মিলনমেলার প্রাণময় এক উৎসবে পরিনত হলো কলকাতার মোহর কুঞ্জ প্রাঙ্গণে গত ২৪ শে সেপ্টেম্বরের সুন্দর বিকেলের রোদ- বৃষ্টির সন্ধিক্ষণে…!

প্রকাশনীর সম্পাদক কবি বাণীব্রত সরকারের মোহরকুঞ্জে লীনা পাবলিকেশনের প্রাক শারদ আড্ডায় মিলিত হলেন এই সময়ের নবীন প্রবীণ কবি সাহিত্যিকগন.. উন্মুক্ত মঞ্চে আড্ডা কবিতায় সুর হয়ে ফুটে উঠলো বাংলার চীরচেনা শরৎ উৎসবের আলো…!

লীনা পাবলিকেশন ও কবিতা নীড় সৃজন বাংলা সাহিত্য পরিবারের যৌথ উদ্যোগের খোলা মনের এই পূজোর আড্ডায় কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শ্রী সৌগত রাণা কবিয়ালের হাত ধরে উন্মোচিত হলো কবি পলাশ দাসের ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ , প্রবীণ সাহিত্যিক কনককান্তি মজুমদারের যে’দিন আমি থাকবো না’, কবি পঞ্চু নস্করের ‘বিচ্ছুরণ’…! অনুষ্ঠানের রোদ মেঘ বৃষ্টির অসাধারণ এই সান্ধ্য আলোয় কবি সাহিত্যিকদের সন্মানিত করতে তাদের হাতে শারদ সন্মাননা তুলে দেন নীনা প্রকাশনীর কর্ণধার কবি বাণীব্রত সরকার ও বাচিক শিল্পী সেঁজুতি বসু….!

অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক ক্ষণ থেকেই আকাশের মেঘ ছায়ার খেলায় বৃষ্টি ভেজা হয়ে প্রাকৃতিক স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জমে ওঠে প্রাক শারদীয়া এই আড্ডা… চার দেয়ালের ঘেরাটোপের বাইরে ভিন্নমাত্রার এই আয়োজন সুরে-স্বরে মুখরিত হয়ে ওঠে সাহিত্যের প্রেমময় বন্ধনে…রচিত হয় এক স্মৃতি মাধুকরী ক্ষণের…! স্বতস্ফূর্তভাবে আগত সাহিত্যপ্রেমীরা মজলেন সন্ধ্যার সিক্ত সাহিত্য আড্ডায়..সকলের মন শিশুতোষ ভালোবাসাময় হয়ে উঠলো আগত তরুণ প্রবীণের দৃষ্টি দৃশ্য…!

উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ৭ই অগাস্ট লীনা প্রকাশনীর বই প্রকাশের জমকালো আয়োজনে কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল হলের সভাগৃহে এক হয়েছিলেন বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাহিত্য প্রেমী গন..!

মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় কলকাতার মোহর কুঞ্জের সবুজবীথিতে লীনা প্রকাশনীর আনন্দময় আগমনীর এই মিলনমেলায় কবিতা গানের সাথে প্রকাশ উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশ পেলো বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন সৌহার্দপূর্ণ সৃষ্টি উল্লাসের..! এভাবেই এগিয়ে যাক বাংলার সাহিত্যের বৈতরণী, সসম্বৃদ্ধ হোক আগামী প্রজন্মের জন্য মূল্যবান ইতিহাস..!

সৌগত রাণা কবিয়াল…
— কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Share This
Categories
রিভিউ

ঐশ্বরিক ভাবনাতে মানবিক প্রতিমা গড়ে কলকাতার বুকে চোখ সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলে।।।

গল্প নয় সত্যি হ’য়ে কিছু ইচ্ছে পরিপূর্ণতা পায় তার স্বভাবসুলভ স্বকীয়তায়… ভাষার প্রকাশের ঐশ্বরিক অনুলিখন ফুটে ওঠে ছাপার অক্ষরে পাতায় পাতায়…!

তেমনই এক সুন্দরতম শুদ্ধ সাহিত্যের আয়োজনে,
গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার পূণ্যদিনে কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো চোখ সাহিত্য পরিবার আয়োজিত কবি সম্মেলন এবং মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান…!
চোখ সাহিত্য পরিবার সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে বরাবরের মতোই একই ধারায় নির্দিষ্ট ভাবনা ভিত্তিক অনুষ্ঠান করে এসেছে বিগত বছরগুলোতে, যা কিনা সাংস্কৃতিক একটি স্বকীয় উজ্জ্বতম নব ধারার সৃষ্টি করেছে এই সময়ের কলকাতার সাহিত্য অঙ্গনে..!

চোখ সাহিত্য পরিবারের কর্ণধার শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের কথা ও ভাবনায়,
” নাচের অনুষ্ঠান কিংবা পূজো প্যান্ডেল হয় একটা থিম বা ভাবনাকে কেন্দ্র করে, একটা সাহিত্যের অনুষ্ঠানও ভাবনা বা থিম নির্ভর হতে পারে এবং হওয়া উচিতও বটে.. এটাই আমরা মনে করেছি এবং সেই ভাবনা থেকেই এবারের থীম বা বিষয় ছিলো সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে উঠে আসা সফল কিছু মানুষদের নিয়ে “ওঁরা কাজ করে” শীর্ষক ভাবনার..! উল্লেখ্য যে বিগত বছরে আমাদের মঞ্চ ভাবনা ছিল, কবিপাঠকএবংকবিতারবিষয়.. এই ভাবনাকে সামনে রেখে আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছিলাম কবি এবং পাঠকদের…। কবিতার বিষয় বলতে, কবি/সাহিত্যিকরা যাদের নিয়ে মেতে ওঠে সৃষ্টির পরম আনন্দে..যেমন, বাজারের মাছওলা, সবজিওলা, রিক্সাচালক, শ্রমিক এবং ট্রান্সজেন্ডার….. আমরা সবাইকে সম্মান জানিয়েছিলাম প্রথম বর্ষে…। পরের দ্বিতীয় বছরে আমাদের ভাবনা ছিল, ‘তুমিওনারী’…। এই ভাবনায় আমরা মঞ্চে সম্মান জানিয়েছি আমাদের সমাজের মানবিক দিক থেকে অবহেলিত ট্রান্সজেন্ডার ও যৌনকর্মীদের…। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সর্বভারতীয় সভাপতি শ্রীমতী ভারতী ঘোষ মহাশয়া..। তাই এবারের মহালয়ার দিন আমাদের মঞ্চ ভাবনা– ‘ওরাকাজকরে’…। এই ভাবনাকে সার্থক করতে এবার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, বাঁকুড়া থেকে অপরাজেয় এক নারী.. সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…। যিনি ভূগোলে এম,এস সি ; বি, এড করেও বাস্তবতার নিরিখে চাকরী না পেয়ে ট্রেনে হকারি করেন..। তিনি কাজ করেন অবিরাম জীবনধারণের তাগিদে। আমার মতে, এই সমাজকে তিনি উপহার দিয়েছেন চরম এক লজ্জা। তিনি আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, আমাদের চোখে এই সমাজের বীরাঙ্গনা…। এবার মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল আবির ঘোষ। তিনি কাজ করেন দেশকে রক্ষা করার জন্য ভারতের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সীমান্তে..। আবির বাবু বিগত কার্গিল যুদ্ধের অন্যতম নায়ক ছিলেন। তাঁকে সম্মান জানাতে পেরে আমরা সম্বৃদ্ধ হয়েছি…! চেষ্টা করেছি আমাদের মঞ্চ ভাবনা ‘ওরাকাজ_করে’ অনুযায়ী এবারের অনুষ্ঠানটিকে উপস্থাপন করতে…!”

অনন্য ভাবনার চোখ সাহিত্য পরিবারের এই প্রাক পূজো মিলনমেলা ও প্রকাশ উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক শ্রী নলিনী বেরা মহাশয়, প্রধান অতিথি ছিলেন আনন্দ প্রকাশনির কর্ণধার শ্রী আনন্দ মণ্ডল মহাশয়, ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী পৃথ্বীরাজ সেন মহাশয়, আরও ছিলেন তরুণ কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শ্রী সৌগত রাণা কবিয়াল মহাশয় প্রমুখ বিজ্ঞ মানুষেরা…।

সময় শ্রদ্ধা জানায় সেই কর্মকেই, যে কর্মে মানুষের কথা লেখা থাকে…! রজত পুরোকায়স্থ মহাশয়ের ভাবনায় অসাধারণ ভাবে উজ্জীবিত এক মঞ্চ হয়ে ওঠে গত ২৫ সে সেপ্টেম্বরে কলকাতার বুকে কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের চোখ সাহিত্য মঞ্চ.. যেখানে নবীন প্রবীণ লেখকগন নিজেদের ভাবনা নিয়ে কথা বলেন, আর চোখ পরিবারের ভাবনায় তাদের মুখোমুখি ছাপায় বোনা সেই চরিত্রগুলো ভেসে ওঠে চোখ সাহিত্য পরিবারের উৎসব বারান্দায়…! অনুষ্ঠান মঞ্চের আলোয় শিশু সাহিত্যিক হিসেবে জ্বলে উঠে দশ বছর বয়সের দেভাংশ চ্যাটার্জি.. মঞ্চে দেবী দুর্গার প্রতিরুপ হয়ে ওঠেন বাঁকুড়ার ট্রেনে নিজের জীবিকার তাগিদে একজন সাধারণ মানুষ থেকে কর্ম-শিল্পী হয়ে ওঠা আমাদের সমাজের চোখের অনাহুত বিবেক গ্লানি নিয়ে ভূগোলের এম এসসি, বি এড সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি…! মঞ্চে উপবিষ্ট সকল মানুষ অহংকারে তাদের দেশের এক কৃতি মানুষ কর্ণেল আবীর ঘোষকে অভিবাদন করে অবচেতন ভাবেই স্যালুট করে জানিয়ে দেয় যে যথাযোগ্য সন্মানে কখনই বাংলার সাহিত্য কর্মীরা কৃপণ নয়… নব ধারায় আগামী ভারতকে তুলে ধরতে কণ্যা স্নেহে মাতৃ দৃষ্টিতে ভালোবাসা আর আশির্বাদের ছবিতে ফুটে ওঠে ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল’…!

কলকাতার কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট হলের সভাগৃহে চোখ সাহিত্য পত্রিকার এই অনুষ্ঠানে অসাধারণ সঞ্চালনা করেন প্রবীণ শিক্ষক শ্রী দেবাশিস পাল মহাশয় এবং শ্রীমতী স্বাগতাপাল মহাশয়া…।
“চোখ সাহিত্য পরিবার” এর এডমিল শ্রীমতী মৌমিতা চ্যাটার্জী মহাশয়া এবং শ্রী পঙ্কজ দত্ত মহাশয়ের আন্তরিক পরিচালনায়, পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রজত পুরকায়স্থ মহাশয়ের অসাধারণ আথিতেয়তায় মঞ্চে
সম্মান জানানো হয় এই সময়ের প্রতিভাবান একঝাঁক কবি সাহিত্যিককে..প্রদান করা হয় সম্মাননা স্বারক ও সনদ পত্র… ।
মঞ্চে সম্মান জানানো হয় ন্যাশানাল গেমসে চারটি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত সায়ন্তনী সাহা মণ্ডল কে…! নাট্যকার বিশ্বজিৎ পুরকায়স্থ স্মৃতি সাহিত্য সম্মান প্রদান করা হয় কবি শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল মহাশয়, কবি মধুছন্দা গাঙ্গুলী মহাশয়া, কবি সজল পোদ্দার মহাশয়কে। চোখ সাহিত্য সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় কবি বৃন্দাবন দাস মহাশয়, কবি অসীমবদাস মহাশয়, কবি মহাদেব নস্কর মহাশয়কে…। সেরা পাঠক-২০২২ প্রদান করা হয় অশোক রায় মহাশয়কে…। বীরাঙ্গনা সম্মান -২০২২ প্রদান করা হয় সুপ্রিয়া পাল বৃষ্টি মহাশয়াকে.. ।
অনুষ্ঠানে আরও যে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে, প্রাত্যহিক কবিতা পাঠের আসর এর শিল্পী কবি সুনীল বণিক মহাশয়, শ্রদ্ধেয়া মাধুরী শর্মা মাহাশয়া এবং বর্ণালী মিস্ত্রী মাহাশয়াকে..।

বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে মোড়ক উন্মোচন করা হয় কবি রজত পুরকায়স্থ সম্পাদিত চোখ সাহিত্য পত্রিকার পূজো সংখ্যা ও চোখ কাব্য সংকলনের..। এছাড়াও প্রকাশ করা হয় সাতটি একক গ্রন্থ..যথাক্রমে, কবি কৃষ্ণা গুহ’র “নির্বাচিত কবিতা”, কবি বিকাশ গুঁইয়ের “প্রেম ও প্রকৃতি”, কবি সিদ্ধার্থ সেন এবং ডাক্তার লিপিকা সেনের “রং ও তুলি”, কবি কৃষ্ণগোপাল ঘোষের “প্রথম প্রেম”, কবি ড: শিপ্রা মুখোপাধ্যায় হালদারের “পূর্বরাগের প্রণয়লিপি”, বিষ্ময় বালক দেভাংশ চ্যাটার্জির “A Tide Of Tales” এবং রজত পুরকায়স্থের “রাজার কলম হোক ক্রীতদাস”…।

মেধা মননশীলতায় বাংলা সাহিত্য সবসময় দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রধান পঙক্তির সমার্থক..সেই অর্থে আধুনিক সাহিত্যে সত্য এবং সুন্দরকে পাশাপাশি হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চোখ সাহিত্য পরিবারের মতন এমন ফেরিওয়ালা চাই যাদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য এগিয়ে যাবে তার সঠিক ভবিষ্যতের দিকে…!
জয় হোক শুদ্ধ সাহিত্যের..জয় হোক মানুষের…!

সৌগত রাণা কবিয়াল—
— কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

সিঙ্গল মাদার : ডঃ অশোকা রায়।

বহুদিন বাদে তোমাকে দেখলাম. ট্যাংগুলার পার্কের মোড়ে আদি ঢাকেশ্বরীতে. মায়ের জন্যে একটা কালো পাড় গরদের শাড়ি কিনতে এসেছিলাম একবারে শেষ মুহূর্তে. আজ দুর্গা পুজোর ষষ্ঠী.
মায়ের শাড়িটা শেষ মুহূর্তে কেনার কারণ মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবহেলা নয়. মা ছিল বেলভিউতে. বেলুন সার্জারি হয়েছে হার্টের. ভালো আছে এখন. কিন্তু নিজের মা হাসপাতালে, তাই পুজোশপিং অন্যান্য দের জন্য করলেও আমার মা নার্সিংহোম থেকে ছাড়া না পাওয়া অবধি মা আর নিজের জন্যে কোন কিছু কিনবো না বলে রেজ‌োলিউশন নিয়েছিলাম. মা কে কাল বাড়ি নিয়ে এসেছি. মায়ের একমাত্র সন্তান ‌আমি. সুতরাং এসব ঝামেলা আমাকেই পোয়াতে হয়. বাবা আর শ্বশুর মারা গেছেন আমার বিয়ের আগে. ‌আর আমার স্বামী তার উজ্জ্বল
কেরিয়ার গড়তে পাড়ি দিয়েছে সাগর পাড়ে. শ্বাশুড়ির দায়িত্ব আমার ঘাড়ে নিয়েছি স্বেচ্ছায় সানন্দে. অবশ্য মায়ের মতো আমার শ্বাশুড়িকে নিয়ে ছুটতে হয় না যখন তখন ডাক্তারের চেম্বারে.তবে সপ্তাহে একদিন যেতে হয় শ্বাশুড়ির সংগে সিনেমা হলে. স্মার্ট শ্বাশুড়ি আমার. কি হিন্দি, কি বাংলা কি ইংরেজী সব সিনেমা কোথায় চলছে, টাইম কি, সব মুখস্থ. আমার দায়িত্ব অন লাইনে টিকিট বুকিং আর ওঁনাকে সংগ দেয়া, সে আমার ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক. হাজার অন্য কাজ থাকুক. ‌অদ্রিজাকে বলিনি, আমার শ্বাশুড়ির মেজাজের সংগে আমার অল্পবিস্তর পরিচয় আছে. অদ্রিজা আমার শ্বাশুড়ির ছাত্রী. আমার সংগে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে. ‌আমার শ্বাশুড়ি অমনোমত হলে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন না আমাকে. অথচ আমি যে তাঁর মেয়ে হয়ে এসেছি এই বাড়িতে.. এই প্রতিশ্রুতির খেলাপ তাঁর কোনও দিন হয়নি. আমি তাঁর মেয়ের মতো নই.. সত্যিই মেয়ে. মা- মেয়ের মধ্যে রাগারাগি তো স্বাভাবিক জিনিস সম্পর্কের সুস্বাস্হ্যের লক্ষ‌ণ. আমার শ্বাশুড়ি বলেছিলেন, বেয়ান বাড়ি ফিরলে তোমাদের সাথেই আমার শাড়ি কিনো. তবে শ্বাশুড়ির বিনীত আবদার তার ছাত্রী অদ্রিজার বুটিকের পার্টিকুলার ডিজাইনের ঢাকাই শাড়ি. আজ সকালে অদ্রিজাকে ফোন করেছিলাম, শাড়িটা রেডি
আছে কিনা. অদ্রিজা বলেছে, বাপস্ রে বাপ্ ম্যাডামের অর্ডার সবার আগে তৈরি করে রেখেছি. নাহলে কি ‌আর রক্ষে আছে. জানো বৌদি ম্যাডাম সম্পর্কে আমাদের আগের সেই সম্ভ্রম আর ভালোবাসার মিলিজুলি ‌আবেগ আজো বজায় আছে. আমাদের ব্যাচের গেট-টুগেদারে ঘুরে ফিরে ম্যাডামের প্রসঙ্গ উঠবেই উঠবে.
টেলিফোনের মধ্যে হেসে উঠি আমি, “মা তো খুব ভালো মানুষ.মাইডিয়ার বলে যাকে, তবে ভয় পেতে কেন? অদ্রিজাও হাসে,” শুধু ভয় তো বলিনি. ভালোবাসার কথাও বলেছি. ক্লাসে ডায়াসে ভয়াবহ.
পড়া না করে ক্লাসে ঢোকা, পড়াবার সময় অন্যমনস্ক হলে কঠিন কঠোর. অথচ ক্লাসের বাইরে এক সংবেদনশীল বন্ধু. এমন মানুষ কে না ভালোবেসে পারা যায়?” কি আর বলি, শুধু বললাম “মায়ের শাড়িটা রেডি করে রেখো. সন্ধ্যের দিকে একসময় কালেক্ট করে নেবো.
ঢাকেশ্বরীতে ঢোকার আগে শ্বাশুড়ি – মায়ের শাড়িটা অদ্রিজার বুটিকের থেকে কালেক্ট করেছি. তারপর ঢাকেশ্বরীতে ঢুকেছি. মা আর আমার দুটো পছন্দ সই শাড়ি কিনেছি. মায়েরটা অবশ্যই কালো পাড় গরদ. মা বৈধব্যের সব নিয়মকানুন মানেন. আঁশ খান না. একাদশী করেন. কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি – মা সেসবের ধারপাশ দিয়ে যান না. নাঃ আমার রাগ হয় না. আজকের জগতের নিয়মই তো হচ্ছে আপ রুচি খানা. আপ রুচি পড়না. তাই আমি আমার মা বা শ্বাশুড়ি- মায়ের এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যাই না. ওদের ওদের মতো থাকতে দিই. তবে দুই বেয়ানের খুব ভাব. প্রতিদিন দেখা না হলেও রোজ টেলিফোনে কথা হয়. আর কি আশ্চর্য দুজনেই ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করতে ভালোবাসে.
যাক গে এখন আমি সেদিনের ঘটনায় আসি. ‌এক্কেবারে প্রথমে এমন একজনের কথা বলেছি, যার সংগে আজ অনেকদিন বাদে আমার দেখা. সে সুজন, আমার প্রাক বিবাহিত জীবনে আমার হার্ট -থ্রব. বিয়ে নিশ্চয়ই করেছে.
শাড়ির বিলের পেমেন্ট করেছে আমি লক্ষ্য করেছি. তখন সংকোচে কথা বলতে পারি নি. কাঁচের দরজা ঠেলে যখনই বেরোচ্ছি, তখনই দুজনের চোখাচুখি. সুজন স্বাভাবিক. জিজ্ঞেস করেছে কেমন আছি আমি. মৃদু হাসি আমার,.. “ভালো.” রাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব স্মৃতির রোমন্থন, তারপর সুজনের অনুরোধে তার অডিতে চেপে ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য পাঁচতারা হোটেলে পদার্পণ… নিশির ডাকে চলেছি আমি. সুজনের নির্দেশে কি ওয়েটার আমার সফট ডিঙ্কসের গ্লাসে হার্ড ডিঙ্কস সার্ভ করেছে? আগের পীরিতির লোক, তার ওপর নিজের স্বামী স্বপনের দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি সামাজিক অনুশাসনের ব্যাকরণ ভুলেছি. সুজনের পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েক পেগ খাওয়া হয়ে গেছে. চেতনা লুপ্ত. জ্ঞান ফিরে পেয়েছি চারশো – বিশ নাম্বার স্যুটের অবিন্যস্ত বিছানায়. গায়ে চাদর টানা রয়েছে. দেহে পোশাকের অনুপস্থিতি বলে দিয়েছে আমাকে আমার বর্তমানের স্ট্যাটাস. পাশে আমার কেনা কালকের সব প্যাকেট. ওয়াশরুমে গিয়ে স্নান করে পোশাক পরে নিয়েছি. ঘড়ি তে ‌আটটা বাজতে পনেরো . রিসেপশন থেকে ফোন করে জানিয়েছে, চেক আউট টাইম ডট আটটা. পেমেন্ট করা আছে. আমি প্যাকেট গুলো নিয়ে বেরিয়ে এসেছি হোটেল থেকে. ট্যাক্সি নিয়ে বলেছি জেনেক্সভ্যালি. ড্রাইভার ট্যাক্সি ছুটিয়েছে. এখনও ঠিকমতো অফিস- টাইম আরম্ভ হয়নি. নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক আগে পৌঁছেছি বাড়িতে. শ্বাশুড়ি রেগে ‌আগুন, তেলে বেগুন. হিসহিসে স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, “রাত কাটালে কোথায়? বেয়ানের বাড়িতে যাওনি শুনলাম. ” আমি ‌আনুপূর্বিক সব ঘটনা বলে গেলাম. নিরাসক্ত মুখে শুনে গেলেন. চেয়ার থেকে উঠে ল্যান্ড ফোনের কাছে. মাকে বললেন সব. ওপ্রান্তের উত্তর শোনা গেল না. মেয়ের কুকীর্তিতে একটা মায়ের বলার কি বা থাকে! শ্বাশুড়ি ফোন কানে নিয়েই বিশাল হুঙ্কার ছাড়েন…” এই বাড়ির বাইরে যাও.” হুঙ্কারের রেশ মেলায়নি. শ্বাশুড়িমা আমার সপাটে আছড়ে পড়েছেন মাটিতে.ডাক্তারকে খবর দিয়েছি. এসে শ্বাশুড়িকে পরীক্ষা করে বলেছেন চার ঘন্টা বাদে এসে ডেথ-সার্টিফিকেট লিখবেন. ম্যাসিভ্ হার্ট এ্যাটাক্. চেম্বারে অনেক পেশেন্ট অপেক্ষা করছে. নিয়মবিধি অনুযায়ী চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া যাবে না.পুরনো কাজের লোক শ্বাশুড়ির ছেলে ও অন্যান্য দের খবর দিয়েছে. স্বামী স্বপন আসছে বলে জানিয়েছে. সময় যাতায়াতের জন্য যেটুকু লাগবে. বডি পিস-হেভেনে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি. বাড়ির মধ্যে ঢুকিনি. এমন কি টয়লেটেও যাই নি. মনে হচ্ছে শরীরের প্রাকৃতিক ক্রিয়া – কর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে. মাসী শ্বাশুড়িকে বলেছি, শ্বাশুড়ির জন্যে কেনা নতুন ঢাকাই পড়িয়ে দিতে. মনে মনে বলেছি “ওটা তো তোমার ছেলের পয়সায় কেনা. পড়তে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই. কেমন তরো সংবেদনশীল মানুষ তুমি তোমার মেয়েকে ক্ষমা করতে পারলে না! “তোমার ছাত্রীরা তোমাকে ঠিক মতো চেনে না. একটা ফোন করেছি আমি যে এন. জি. ও র সংগে যুক্ত সেখানকার প্রেসিডেন্ট জলিদি কে. থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে. মেয়েদের সেলাই শেখাই সেখানে. বস্তীর মেয়েদের পড়াশোনার উইং খুললে তার দায়িত্ব নেব. এখনকার ‌থেকে মাইনেও বেড়ে যাবে. যথাসময়ে মেয়ের জন্ম দিয়েছি আমি. নাম রেখেছি অগ্নিহোত্রী. কামনার অগ্নি থেকে ওর জন্ম. স্হির করেছি এমন দৃঢ় ও চৌখশ ভাবে গড়ে তুলবো ওকে, তখন ওকে ডাকবে সবাই আগুনে পাখি বলে, যে সমাজের সব জন্জাল সাফ করে,… হবে মহীয়সী এক নারী. স্বপন বা সুজন আসে নি আর কোন দিন. আমার নিজের মা বেঁচে আছে কোনক্রমে. কিন্তু আমার মুখ দেখে না. আমি সিঙ্গল – মাদার.


Share This