Categories
গল্প

মৃত্যঞ্জয় : ডঃ অশোকা রায়।

কফির আড্ডায় আজ সবাই আছে নেই মৃত্যুঞ্জয়।
অবসরের পর আমরা সবাই কলকাতায়, দেশ- বিদেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে।
কর্মজীবন আমাদের সাত বন্ধুর জোড়টা আলগা করেছিল। তবে চোখের দেখা না থাকলেও প্রাণের বাঁধন বজায় রেখেছিল ইন্টারনেট। সুতরাং বন্ধুত্বে ভাঁটা সেভাবে পড়ে নি। স্কাইপ বা ভিডিও কলে আমরা পরস্পরের মেদ-বাহুল্য ঘটার ঘটনা যেমন জানতে পারতাম, তা,অপরাধী বন্ধুর পক্ষ থেকে লোকানোর যতোই চেষ্টা করা হোক না কেন, আবার কারো ওজন দ্রুত কমলে সেটাও জানা থাকতো । জ্ঞান বরিষণের হাত থেকে রেহাই পেতে তার কাজের অজুহাতে ভিডিও ক্যামেরার সামনে থেকে পালানোর কথা বাকিদের কাছে অজানা থাকতো না। সকলের নাড়িনক্ষত্র আমাদের প্রত্যেকের কাছে খোলা খাতার মতোই ছিল। কথাটা যে কতটা ভুল ছিল তা’ বুঝেছি অবসরের পর। তবে সে বোঝা অলৌকিকভাবে।
অবসরের পর আমরা সবাই দেশের মাটিতে। মৃত্যঞ্জয় রয়েছে মেক্সিকোতে। ওর বিদেশিনী বৌয়ের চাকরি আর কয়েক মাস আছে। মৃত্যুঞ্জয় আর তার বৌ লিসা ঠিক করেছে ভারতে ফিরবে। আর তো কয়েক মাস। তারপর সপ্তরত্নের সভা সস্ত্রীক জমজমাট। বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভা হার মেনে যাবে। আমাদের স্ত্রীরা যমের মুখে ছাই দিয়ে বহাল তবিয়তে বর্তমান। সুতরাং দুরন্ত মৃত্যুঞ্জয় ঘরে ফিরলে আমরা সাত দু-গুণে চোদ্দো। নবরত্ন সভাকে হাসিহুল্লোড়ের রেটিং এ পিছে রাখতেই পারি।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আলিপুরের এক কফি-বারিস্তায় আমাদের নতুন আড্ডা। আগের আড্ডা কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস আমরা ছেলে-ছোকরা আর কিছু ইন্টেলেকচুয়াল লোকজন কে ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য কোনকালেই আমরা যথাযথ ইন্টেলেকচুয়াল ছিলাম না। তবে ইন্টেলেকচুয়ালের ভান করাটা প্যাশন এবং ফ্যাশন ছিল। তাই ব্রাত্য হওয়ার ভয়ে কফি হাউসের কাঠের সিঁড়ি ভাঙ্গতাম।
এখন সেই ফ্যাশনের মোহ নেই, প্যাশন উধাও। বয়স বেড়েছে। আমরা সবাই দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। এতোটা পথ উজিয়ে যাওয়ার এনথু একেবারে লেস।
তাই কফিহাউস ছেড়ে আলিপুরের কফি-বারিস্তায় আমাদের আড্ডা। রোজ নয়, সপ্তাহে দুদিন। আড্ডার অত সময় আমাদের মধ্যে তিনজনের নেই। আমার ছেলের চাকরি খোদ কলকাতার বুকে। একে নিজের বৌয়ের ফরমায়েশ, তার ওপর বৌমার চিকণ গলায় আবদারের সুরে বলা তার নিজস্ব জিনিসের ফর্দ। কায়দা করে জুড়ে দেয় প্রশংসা, ” বাবা তোমার বাজার করার ফরম্যাট টা সুন্দর। তোমার ছেলে কে কেন শেখাও নি? কিছু আনতে বললে আগেভাগে ফরমান জারি করে, ওসব কোথায় পাওয়া যায় জানি না। বাবা কে বলো। ” অগত্যা বাজারে দরকারী অ- দরকারী কাজে আমার কাটে পাক্কা দু ঘন্টা। তারপর কিছু অবসর। চারটে বাজতে না
বাজতেই দুটো ক্ষুদে দস্যির আগমন। পার্ক আর ইনডোর গেমস। কিন্তু সেটা আমার রিলাক্সেশন। আসলের চেয়ে সুদ বেশি। বাদবাকি দুজনের ঐ একই অবস্থা। একটু ঊনিশ-বিশ।
হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। সেদিন আড্ডা তুঙ্গে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পাওয়া নিয়ে। চলে এসেছে অমর্ত্য সেনের প্রসঙ্গ। কফির পেয়ালায় আলোচনার তুফান। হঠাৎ আমাদের টেবিলের সামনে মৃত্যুঞ্জয়। সেই দীর্ঘ দেহ। ঠোঁটে মুচকি হাসি। আমরা ছ’ জন হতবাক। সায়ক বলে, “তোর তো ফিরতে কয়েক মাস বাকি! ” মৃত্যুঞ্জয় বলে,” আগে ফিরতে মন চাইছিল বড়ো। কেন তোরা খুশি হসনি? ” নবারুণ, উদয়, অমিত, কৌশিক সমস্বরে বলে, ” তুই ভাবলি কি করে এ কথা। আমরা বলে অপেক্ষা করে আছি, কবে আসবি তুই “? মৃত্যঞ্জয় এবার আমার দিকে চায়, ” কি করে প্রদীপ, এমন করে চেয়ে আছিস যে। এক কাপ কফি তো বল। আর কাজুবাদামও অর্ডার কর। ” আমরা ভালো করে জানি মৃত্যঞ্জয়ের পছন্দ। আগে বলতো, কফির সাথে কাজু হোয়াটস এ্যা ফ্যান্টাস্টিক কম্বিনেশন”! একটু পজ দিয়ে বলতো, “খেতে খেতে আমি ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় চলে যাই। “
আমি কফি- কাজুর অর্ডার দিই।
ওগুলো আসার আগে মৃত্যুঞ্জয় বন্ধুদের সাথে মেক্সিকোর গল্পে মেতেছে। আমার মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। সকালের ফোনটা কি ফেক ফোন? ঐরকম বদমাইশি কেউ কারও সাথে করে! ভেবছিলাম, বন্ধু দের একটু পরে জানাব, কেউ একজন মেক্সিকো থেকে জানিয়েছে, “মৃত্যঞ্জয় ভৌমিক ইজ নো মোর। ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক”। আর এখন মৃত্যুঞ্জয় আমার সামনে বসে কলকাতার কফি-বারিস্তায় কাজু খাচ্ছে! ভাগ্যিস খবরটা বন্ধু দের আগে দিই নি। লেগপুলিং কে আমার বড়োই ভয়। ভেবেছিলাম বাড়ি ফেরার আগে দেব। আজ দুপুরে ভাত খাইনি ফোন রিসিভ করে মন খারাপ।
ভাবনার মধ্যে আমার ফোন টা বাজছে। ফোন বার করে দেখি, কলার লিসা। “হ্যালো”. ” প্রদীপ, মৃত্যুঞ্জয় চলে গেছে। ফিউরানাল শেষ হলো। ইন্ডিয়ায় ফেরার জন্য ফিউরিয়াস হয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝিনি। বোঝাতাম আর তো কয়েক মাস। মুখে কিছু বলত না। কিন্তু রেস্টলেস হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।
আমার ইল- লাক। আমি চাকরি ছাড়ছি। সময়ের টি
কাজ সময়ে করা উচিত,এ শিক্ষা আমার ইগনোর করা উচিত ছিল। বড়োই লেটে বুঝলাম। মৃত্যঞ্জয়ের ইচ্ছামত বাদবাকি জীবন ইন্ডিয়ায় কাটাব। বাট মৃত্যুঞ্জয় থাকবে না, সাথে। তুমি আমার একটা এ্যাকোমোডেশন এ্যারেঞ্জ করে দিও প্লিজ। ” লিসা জানে, আমি মৃত্যঞ্জয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এটুকু সাহায্য সে চাইতেই পারে। আশ্চর্যজনক কিছু নয় সেটা। আমি ফোন টা ইদানীং কানে কম শুনি বলে সবসময় স্পিকারে দিই। বন্ধু রা আমার ফোনে লিসার প্রায় এক তরফা কথা শুনেছে। মৃত্যঞ্জয়ের চেয়ারের দিকে তাকিয়েছে। চেয়ার খালি। কফির কাপ শেষ।
কাজুবাদামের প্লেট খালি।
জীবন থেকে চলে গিয়েও মৃত্যুঞ্জয়ের ইচ্ছা হয়েছিল বন্ধুদের সাথে অন্ততঃ একবার আড্ডা মারার। মৃত্যু কে জয় করে মৃত্যুঞ্জয় তার ইচ্ছাপূরণ করেছে।
সর্বস্বত্ব লেখিকা কর্তৃক।সংরক্ষিত।
19/10/2019

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জাতিস্মর : ডঃ অশোকা রায়।

কি নিয়ে লিখব ভাবছিলাম বেশ কিছু ক্ষণ ধরে। কিছুই মাথায় আসছিল না।
মাথাটা একেবারে ব্ল্যাংক। হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। আমার ঘরের ঠিক জানলার নীচে একটা ঝোপ আছে, অনেক ক্ষণ ধরে সেখান থেকে ব্যাঙের ঘ্যানঘ্যানানি ডাক ভেসে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম বৃষ্টি আসবে। অপেক্ষায় থাকলাম বৃষ্টির। বৃষ্টি আমার আশা পূরণ করলো। ঝমঝমানি শব্দ করে নামলো বৃষ্টি। প্রথমে জানলা বন্ধ করিনি, যদি বৃষ্টি দেখে মাথায় গল্পের প্লট আসে, তবে সুমনের পোর্টালে আজ একটা আবার গল্প দিতে পারবো, এই ধান্দা নিয়ে। জগতটাই তো ধান্ধাবাজিতে চলছে, তবে আমিই বা এব্যাপারে পেছিয়ে থাকি কেন? লোকে তো তখন আমার কপালে “ব্যাক ডেটেড” শব্দটা দেগে দেবে। কি একটা হিন্দি সিনেমায় দেখেছিলাম নায়কের হাতে উল্কি কেটে ” আমার বাবা চোর” লিখে দেয়া হয়েছিল। সে নিয়ে তো সিনেমাটা একেবারে ক্লাইমেক্সে পৌঁছে গিয়েছিল। বক্স অফিসও হিট। সিনেমার নামটা ভালোই মনে আছে। কিন্তু বলে তর্ক সৃষ্টি করতে চাই না। এত চিন্তামগ্ন ছিলাম যে, বৃষ্টির ছাঁট আমার পাঞ্জাবিটা ভিজিয়ে দিয়েছে কখন বুঝতেই পারিনি। সুতরাং জানলা বন্ধ করে দিতে যাই। আর তখনি আকাশের গায়ে জোর বিদ্যুৎ ঝলকানি। তা’ দেখে আমার মাথায় গল্পের প্লট এসে যায়। জানলা বন্ধ করে আমি টেবিলের সামনে চেয়ারে বসি। কলম তুলে নিই, লেখনী এগিয়ে চলে পাতার পর পাতা। কল্পনার গরু ‌আমার একবারে মগডালে।
সমীরণ খুব ভালো বন্ধু আমার সেই স্কুল জীবন থেকে। ওদের বাড়িতে আমি যেতাম প্রায়ই। খুব ছোট যখন লুডো বা ক্যারাম খেলতে। শৈশবে সমীরণ খুব বেশি না হলেও আমাদের বাড়িতে আসত‌। কিন্তু সে ইনডোর গেমেই ইন্টারেস্ট দ‌েখাতো, আউটডোর গেমে নয়। আমি সমীরণ দুজনেই বড়ো হয়েছি। সমীরণ ঘরের কোণে বই মুখে দিয়ে বসে থেকেছে। আমি গেলে বেশ বড়ো অবস্থাতেও আমার সাথে সাপলুডো খেলেছে। আমি ব্যঙ্গ করে বলেছি চল্ আমরা সাপলুডোই খেলি। বড়োদের বিজ্ঞাপন কিন্তু আমি যে এঁচ‌োড়ে পাকা। সরল সমীরণ আক্ষরিক অর্থেই কথাটা নিয়েছে। ইনার মিনিংটা বোঝে নি, বা বোঝার ক্ষমতা তার ছিল না। এই সময় আমাদের বয়েস চোদ্দ বছর। সমীরণকে কতবার মাঠে খেলার কথা বলেছি। মোটা চশমার কাঁচের আড়ালে ঢাকা সমীরণের চোখ দুটো এক লহমার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পরক্ষণেই ম্রিয়মাণ গলায় জবাব দিয়েছে “না রে, মা বাবা বকবে” রহস্যটা উদ্ধারের ইচ্ছে থাকলেও তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। আমি ফুটবল, ক্রিকেট সব খেলাতেই বেশ দড় ছিলাম। ফুটবলে সেন্টার ফরোয়ার্ড প্লেয়ার হিসেবে আমার তখন পাড়া, পাশাপাশি বেপাড়ায় বেশ সুনাম। তার থেকেও বড়ো কথা আমি তখন অনুর্দ্ধ ঊন্নিশ-এ সি. এ. বির টুর্নামেন্ট খেলছি। নামযশ কিছু কিছু ছড়িয়েছে। কাগজে আমার ক্যালিবারের প্রশংসা করে রিভিউ বেরোচ্ছে। তবু তার মধ্যেও সমীরণের বাড়ি যাই। দুজনের চরিত্রগত প্রকৃতির বিশাল ডিফারেন্স। তবুও সমীরণের আকর্ষণ আমার কাছে অপ্রতিরোধ্য। কারণটা তখন বুঝতে পারি নি। বুঝেছি অনেক পরে।
ইতি মধ্যে আরো কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমি বেঙ্গল ক্রিকেট দলের অপরিহার্য সদস্য। টেস্ট দলে আমার অন্তর্ভুক্তি আলোচনার স্তরে আছে। আমার এ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন হায়ার সেকেন্ডারির স্তর পেরিয়ে থমকে গেছে। দরকার কি? এ. জি বেঙ্গলে ঢুকে গেছি। সমীরণের সংগে সম্পর্ক ত্যাগ করিনি। আমার চাকরি পাওয়া উপলক্ষ্যে “রেড চিলি” তে তাকে ডিনার খাইয়েছি। সমীরণ তখন এম. এ তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বি. এড পড়ছে আর চাকরি পাওয়ার জন্য জুতোর শুকতলা ক্ষয়িয়ে ফেলছে। আমি ভেবেছি ওর চাকরির জন্যে কোন মুরুব্বিকে ধরব‌ো। এখন আমার পরিচিতির সার্কেল হাইফাই। দরকার হয়নি , আমি তখন টেস্ট খেলছি ব্যাঙ্গালোরে। রাত আটটায় আমার মোবাইলে ফোন “অর্ক আমি একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি। ভাগ্যিস বি. এড টা কমপ্লিট করেছিলাম।” আমি শ্রী অর্ক রায় সমীরণকে অভিনন্দন জানিয়েছি। রাতে ঘুম আসার আগে রবি ঠাকুরের গানটা মনে পড়েছে, “প্রান ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে ম‌োরে আরো আরো আরো দাও প্রান। তব ভুবনে, তব ভবনে মোরে আরো আরো আরো দাও স্হান। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নয় অর্ক সমীরণকে এই গানটা ডেডিকেট করে। এ এক আশ্চর্য টান!
দুবছর বাদে সমীরণের সংগে আমার চাক্ষুষ সাক্ষাৎ। চুপিচুপি এসেছি ওর বাড়ি। তখন ক্রিকেটে আমার নাম দেশ-বিদেশের ক্রীড়ামোদীদের কাছে খুব আদরনীয় এক নাম। সিকিউরিটি নিইনি, ড্রাইভারও নয়। আজ এসেছি আমি সমীরণ‌ের মা-বাবার একসাথে মৃত্যুর খবর পেয়ে। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাঙালির কাছে পুরী রথ দেখা কলা বেচার মতো… জগন্নাথ ও সমুদ্র দর্শন একত্রে। ফিরতি পথে বাস উল্টেছে। জখম অল্প বেশি সকলে। শুধু সমীরণ‌ের মা-বাবার নাম নিহতের তালিকায়। সমীরণ কে ফোন করে বডি আইডেন্টিফিকেশন করতে বলা হয়েছে কটক থানা থেকে। কটকেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। সমীরণ থানায় গেছে। নিজে শিওর হয়েছে ও পুলিশ কে জানিয়েছে বডি তার মা-বাবার। কটকের শ্মশানে পাশাপাশি দুটো চুল্লিতে সমীরণের জীবনের দুই প্রিয় মানুষের নশ্বর দ‌েহ ভস্মীভূত হয়েছে সমীরণকে খুব একলা করে দিয়ে। সমীরণ বিয়ে করেনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। তার থেকে বলা ভালো মা-বাবার সংগে বৌয়ের অবনিবনা হবার ভয়ে। বিয়ে আমিও করিনি। বহু সেলিব্রিটি নায়িকা, ফ্যাশন জগতের মেয়েদের সংগে বা বড়ো বিজনেস ম্যানদের মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি করেছি একটা সীমারেখা বজায় রেখে। তবু এ নিয়ে ইয়েলো জার্নালিজম হয়েছে। ক্রেডিটে আমার অনেক স্ক্যান্ডাল জমা পড়েছে। কেয়ার করিনি। সেলিব্রিটিদের কাছে এগুলো মুকুটে গোঁজা কৃতিত্বের অনুষঙ্গের এক, একটা পালক বিশেষ। সুতরাং বিয়েতে আমারও অনীহা।
বর্ষার বৃষ্টি অঝোরে পড়ছে সারাদিন ধরে। থামা-কমার নামগন্ধ নেই। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আমি আজ এসেছি সমীরণের বাড়িতে। মব এ্যারেস্টেড্ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সমীরণের অঙ্গে কাছা। খাপছাড়া ভাবে সে আমায় আজ কিছু কথা বলে, যা জুড়ে আমি সমীরণের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু আভাস পাই । নিজের মতো সাজিয়ে নিয়ে সমীরণের বলতে চাওয়া কথা গুলো আমি আপনাদের বলছি। মা-বাবা দুজনকেই একসাথে হারানো সমীরণকে আপনারা দোষ দেবেন না। ওর মানসিক স্হিতি এ‌খন খুব নড়বড়ে। আমি সমীরণের বকলমে যা বলবো, তাতে অসংগতি বা অগোছালো ভাব থাকবে না। কারণ আমি সমীরণের বন্ধু মাত্র। তার মা-বাবা যাওয়াতে দুঃখ পেয়েছি খুবই কিন্তু সমীরণের মতো ভেঙ্গে পড়িনি। সমীরণের মা-বাবা আমার পাড়ার কাকু-কাকীমা, মা-বাবা তো নয়।
সমীরণ ফিরে গিয়েছিল আমাদের সেই ছেলেবেলায়। বলেছে, আমার মনে আছে কিনা, যে সে খেলতে যেত না মাঠে আমার হাজার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও। খুব মনে আছে আমার। ভীষণ রাগ লাগতো আমার মানে শ্রীমান অর্ক রায়ের, সে কথাটাও ভুলিনি। তা’ সত্ত্বেও সমীরণের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণের কথা ভুলিনি। যেচে যেচে ওদের বাড়ি যেতাম। মনে পড়ে আমি গেলে সমীরণের মা কেমন ভাবে স্নেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন আমার দিকে। থালা ভর্তি খাবার এনে এক থালা থেকে খাইয়ে দিতেন আমাদের দুজনকে। আমাদের তখন নিজের হাতে খাওয়ার সুযোগ কই? ততক্ষণে হয়তো সমীরণের পুট পড়লে আমার পাকা ঘুঁটি কেঁচে যাবে। নয়তো সমীরণের ছক্কা আর দুই পড়লে শেষ ঘুঁটি ঘরে উঠে যাবে। সমীরণ জিতে যাবে। দারুণ টেনশনের মুহূর্ত। আর তাছাড়া সমীরণের মায়ের হাতে খেতে আমার ভালো লাগতো। সমীরণ আর আমি গল্প করছি, নিজের হাতে খেতে কোন বাধা নেই। তবুও কাকীমার কাছে আবদার করেছি, খাইয়ে দেয়ার জন্যে। কাকীমার চোখে জল। মানে বুঝতে পারি নি কেন? কারণও জিজ্ঞেস করা হয় নি। ভেবেছি আনন্দাশ্রু। কাকীমা খুব নরম-সরম। আমার মায়ের মতো স্ট্রিক্ট ছিলেন না। সমীরণের বাবা সবসময় বাড়ি থাকতেন না। আমি যখন সমীরণদের বাড়ি যেতাম অফিস থেকে ফেরার সময় তখনও কাকুর হতো না। কিন্তু ছুটির দিন আমাদের দুজনকে পাশে বসিয়ে দেশ-বিদেশের নানা গল্প বলতেন। কি আকর্ষণীয় বলার ভঙ্গি! আমরা দুই বন্ধু গালে হাত দিয়ে শুনতাম। আমার বাবা মস্ত অফিসার। অফিসের পর মিটিং, ক্লাব – পার্টি। রবিবারও তিনি ব্যস্ত। নিজের ছেলেকে দেবার মতো সময় তার রবিবারের সিডিউলেও থাকতে নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সমীরণের বাড়ির আকর্ষণ আমার কাছে অপ্রতিরোধ্য। আজ সমীরণের কাছে জানতে পারলাম, সে জাতিস্মর। পূর্ব জন্মের কথা তার জ্ঞান হওয়া অবধি মনে আছে। আর এই কথা লোকজানাজানি যাতে নাহয়, তার জন্যেই কাকু-কাকীমা সমীরণকে বেরোতে দিতেন না। বিস্ময়কর বটে সমীরণের কথাটা। বিশ্বাস – অবিশ্বাসের দোলায় দুলি আমি। সমীরণ বুঝতে পারে আমি ওর গল্পটা ঠিক মতো হজম করতে পারছি না। জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারে, ” বৃষ্টির তোড়টা একটু কমেছে। রাত অনেক। রাস্তাও শুনশান। তোকে ঘিরে ধরার লোকজন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে। যাবি নাকি আমার সংগে একটা জায়গায়?” সমীরণ ভুল বলেনি রাজি হয়ে যাই। সমীরণ ড্রয়ারে রাখা চাবির গোছা তুলে হাতে নেয়। কাছাধারীর পকেট কোথায়? আমি পকেট হাতড়িয়ে গাড়ির চাবি বার করে নিই।
নিশুতি রাত চিরে গাড়ি এগিয়ে চলে। চালক আমি, পথ নির্দেশক সমীরণ। পথটা মনে হয় আমাদের ডায়মন্ড হারবারের দিকে নিয়ে চলেছে। আবার বৃষ্টি় তোড়ে এসেছে। ওয়াইপার চলছে। তবু দৃশ্যমানতায় অসুবিধা হচ্ছে। আমরা চুপচাপ। তবুও আমি দু-একটা কথা বলতে গিয়েছিলাম। অদ্ভুত গলায় সমীরণ বলেছে চুপচাপ সাবধানে গাড়ি চালা, এ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। আমি সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, মুখের রেখা গুলো কেমন অচেনা। তবুও বলি, “ডেস্টিনেশনটা কিন্তু এখনো জানাস নি।” ছোট্ট উত্তর এসেছে, ” ডায়মন্ড হারবারের দেউলা স্টেশন। গ্রামের নাম দিশাগড়।” দিশেহারা আমি বলি, ” রাস্তা চিনি না।” সমীরণ বলে, “ডিরেকশন দেয়ার দায়িত্ব আমার।” আমি আর কিছু বলি না। চুপচাপ স্টিয়ারিং এর নিয়ন্ত্রণ করি।
সমীরণের নির্দেশক্রমে দেউলা স্টেশনে পৌঁছে গ্রামের পথ ধরেছি। রাস্তা একদম ভালো নয়. বৃষ্টি থেমেছে। তবে সারা রাস্তা কাদায়-কাদা। বৃষ্টি থামা আকাশে কাস্তে চাঁদের উঁকি ঝুঁকি। নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ। অন্ধকারে জোনাকের আলোর মিটিমিটি ফোকাস , ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক.. আমার নেশা ধরায়। অথচ সমীরণের বাড়ি আসবো বলে দামী মদে অভ্যস্ত আমার পেটে আজ একফোঁটা এ্যালকোহল নেই। আমার নেশা চটকে দেয় সমীরণ… ” অর্ক গাড়ি থামা। এসে গেছি আমরা আমাদের বাড়িতে। যন্ত্র – গাড়ি যান্ত্রিক আওয়াজ করে থেমে যায়। গাড়ি থেকে নেমে দেখি জীর্ণ বাড়ি। রঙ-পলেস্তারা অনেকদিন পড়ে নি। তবুও একেবারে বসবাসের অযোগ্য নয়। সমীরণ কখন যে একটা চার ব্যাটারির টর্চ সংগে নিয়েছিল, খেয়াল করিনি। টর্চের জোরালো আলোয় অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা বাড়ির সদর-দরজার সামনে। আগে হয়ত এই পথের ধারে কেয়ারী করা বাগান ছিল, হয়তো ছিল না। নিছক আমার কল্পনা। তবে এখন যে এই জায়গায় আগাছা থরে থরে গজিয়ে রয়েছে, সেটা বাস্তব। সমীরণকে কিছু জিজ্ঞেস করবে, ইচ্ছে করছে না। সে যেন এখন একটা ভূতগ্রস্ত জীব। সমীরণ চাবির গোছা থেকে সঠিক চাবি বেছে নিয়ে ঢোকায় তালার গর্তে। তালা খুলে যায়। ওরা ভেতরে ঢোকে। বাড়ির মেঝে মার্বেলের ঝাঁট-মোছ না পড়ার দরুন ধূলিকণায় মলিন। নীচের সব ঘর বন্ধ. সমীরণ সেদিকে যায় না। বিশাল মার্বেলের সিঁড়ির ধাপ গুলো পেরোতে থাকে সে। পেছনে নিশি পাওয়া মানুষের মতো আমি তাকে অনুসরণ করি.
দোতলার ঘরের তালা খোলা হয়। আমি আর সমীরণ ঘরের মধ্যে। আমি দেখি জমিদার বা ভীষণ অবস্থাপন্ন দের বিশাল শয়ন- কক্ষ। মেহগিনী কাঠের পালঙ্ক। বার্মা টিকের নানা ফার্নিচার, বেলজিয়াম কাঁচের আয়না বসানো আলমারি। ঘরের মাঝে একটা গোল শ্বেত-শুভ্র টেবিল। চারপাশে লালটুকটুকে ভেলভেটের চেয়ার। একপাশের দেওয়াল আলমারিতে কাঁচের পুতুল, আরেকটা দিকের দেয়াল- আলমারিতে দেশ বিদেশের নানা বই। আমি যেন সাপুড়ের বীণ শোনা মন্ত্রমুগ্ধ এক সাপ। নিজের অজান্তেই মন আমার হেলছে দুলছে. দেয়ালে টাঙানো বিদেশী ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার চোখ আটকায় একটা সাদা-কালো ছবিতে. একি, এ তো সমীরণের মা-বাবার ছবি। এতো বড়ো ছবি, তা’ও চোখে পড়েনি। ফোটোগ্রাফ থেকে গোড়ের ঝুঁইের মালা ঝুলছে। এই ঘরে ঢুকে আমি পুরোনো ভ্যাপসা ঘরের গন্ধ পাই নি। উল্টে একটা ভালো গন্ধ পাচ্ছিলাম। মনে মনে তখন আমি ধরে নিয়েছি, এটা সমীরণদের বাড়ি। সংগে সংগে প্রশ্ন জেগেছে মনে,যাদের এতো ভালো অবস্থা,.. কলকাতায় তারা কেন অতো সাধারণ ভাবে থাকতো? এখন আমরা বড়ো হয়ে গেছি। একথা ছোট বেলার জিগরি – দোস্তকেও জিজ্ঞেস করা যায় না। কিছু ভাবতে পারে। ছোটবেলায় অনেক কিছু বলা যায়, অনেক কিছু করা যায়। পরিনত বয়েসে সম্পর্কের সমীকরণ সরলপথে হাঁটে না। তাই শুধু জিজ্ঞেস করি সমীরণকে , ” কাকু-কাকীমার ফোটোগ্রাফে মালাটা কোথা থেকে এলো রে? ” সমীরণের উদাস উত্তর, “জানি না”। অবাক হই, সমীরণ কোন মালা যে আনেনি আমি শিওর। সমীরণ নিয়ে যায় পরবর্তী ঘরে। ঘরের ফার্নিচার গুলো বলে, এটা কোন বাচ্চার ঘর। সুন্দর খাটের বিছানায় দুজনের পাশাপাশি শোওয়ার সরন্জাম বলে, একজন নয়, দুজন বাচ্চার ঘর। বইপত্র, খেলনার সংগে ঘরের এককোণে দাঁড়ানো ক্রিকেট ব্যাট রয়েছে। একটা ফুটবল খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আমার পায়ে ধাক্কা মারে। সমীরণ আমাকে দেখে যাচ্ছে। আমি ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি পড়ার টেবিলে রাখা আরো একটা ফটোগ্রাফ….. সমীরণ আর আমার। সমবয়সী দুটো ছেলের ছবি। জিজ্ঞাসু আমার চোখে এমন কিছু ছিল, যার উত্তর দিতে সমীরণ বাধ্য হয়েছিল।

সমীরণ জানিয়ে ছিল সমীরণ, কাকু, কাকীমা তিনজনেই পূর্ব স্মৃতি নিয়ে জন্মেছিল। বাদ ছিলাম খালি আমি। অথচ একই পাড়ায় আমার জন্ম। পূর্বজন্মের দুই যমজ ভাই এই জন্মে সমবয়সী দুই বন্ধু। আমি সমীরণের কথা বিশ্বাস করেছি। আমার মনে পড়েছে কাকীমার মাতৃ-স্নেহ, কাকুর পিতৃসুলভ আচরণ। ছেলের বন্ধু কে অনেকেই ছেলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু কাকু-কাকীমার ভালোবাসায় অরিজিনাল কিছু ছিল, ছিল রক্তের টান। আর সমীরণের সংগে তো শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, আত্মার সম্পর্ক একই বৃন্তে ফোটা দুটি কুসুমের মতো। সমীরণকে বলি,” চল, এবার আমরা এগোই.”
আবার আমি চালক। পথ চিনে গেছি, সব কিছু জেনে গেছি। সমীরণের নির্দেশক বা কথকের ভূমিকা শেষ। সমীরণ চুপচাপ। আমার মনে দিশের গড়,… আমার পূর্ব জীবন, পূর্ব জীবনের বাড়ি তোলপাড় তুলেছে। আমি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। গাড়ি উল্টেছে নয়ানজুলিতে। আশেপাশের লোকজন আমায় কষ্ট করে বার করেছে গাড়ি থেকে। আমার কিচ্ছু হয়নি। একটুও কাটেনি-ছড়েনি পর্যন্ত। আশ্চর্যের বিষয়, সমীরণ নেই। জমায়েত জনতা বলেছে আর কেউ ছিল না গাড়িতে। তাদের চোখের সামনেই তো ঘটনাটা ঘটেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করি সমীরণ নয়ানজুলির ধারে দাঁড়িয়ে বলছে, ” অর্ক, আমিও আর বেঁচে নেই রে। দেড় বছর আগে ডেঙ্গি আমায় নিয়ে গেছে। শুধু তোকে প্রকৃত ঘটনা জানাব বলে প্রতীক্ষা করছিলাম তোর দেশে ফেরার। ফিরে যা অর্ক, তোর নিজস্ব জগতে। অতীতের মাঝে বাসের কষ্ট আমরা তিনজন জানি। তবে তোর আমাদের প্রতি আকর্ষনের কারণটা তোর জানা দরকার ছিল। চলি রে। সমীরণ মিলিয়ে যায়। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অন্য কেউ সমীরণকে দেখে নি, আমাদের কথোপকথন শোনে নি। গাড়ি স্টার্ট করি। সেদিন নিরাপদে পৌঁছে যাই আমার এ জন্মের আস্তানায়।
আমি কাছাধারণ করেছি আমার এ জন্মের মা-বাবা জীবিত থাকা সত্ত্বেও। প্রশ্নের বাণ ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এসেছে। আমার এ জন্মের মা কেঁদেছে। বাবা মুখ গম্ভীর করে ঘুরেছে। সমীরণের কাছ থেকে আমার পূর্বজন্মের পরিচয় পাওয়ার ঠিক দশদিনের মাথায় ঘটাপটা করে আমার পূর্বজন্মের তিন আত্মজনের শ্রাদ্ধাদি কার্য করেছি। নিমন্ত্রিতদের কৌতুহল সেদিন নিবারণ করেছি,… “আমার পূর্বজন্মের শেষ ঋণ চোকাচ্ছি।”
সমীরণ তোর শেষ কথা রাখতে পারিনি। ডুপ্লিকেট চাবি করিয়ে যখনই দেশে থাকি দিশেরগড়ের বাড়িতে যাই অতীতের সংগে কথা কই। জানি না তোরা শুনতে পাস কিনা, নাকি তোদের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে?

Share This
Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ, তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ রায়।

কঙ্কাবতীর মাথায় হাত ! বৃহস্পতিবারদিন সাধারণত বিক্রিবাট্টা কম । গেরস্তের বাড়ি থেকে নগদ টাকা বের করা নাকি সংসারের অমঙ্গল । চিরাচরিত ধ্যানধারণার সংস্কার এখনও  গাঁয়ের দিকে বিদ্যমান । গাঁয়ের মানুষের কথা ভেবে কঙ্গাবতী যদিও বৃহস্পতিবার বাজার থেকে সব্জীও কম তোলে । সকাল আটটায় বেরিয়ে তিনটি গ্রাম ঘোরা হয়ে গেলো । কিন্তু বিক্রির  হালহকিকৎ দেখে কঙ্কাবতী হতাশ ! অগত্যা ভর দুপুরে বিরক্তমুখে বাড়ি ফিরলো । বাড়ি ফিরে দেখে, বড় মেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে । তার চোখ দুটি ছলছল !
তানিশাকে তানিশার নিজের ইচ্ছামতো অনেক আগেই বিয়ে দিতে হয়েছিল কঙ্কাবতীকে । তানিশা তখন সাগরের প্রেমে বিহ্বল । তাই তাকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না কঙ্কাবতীর । ফলে নিজের মতের বিরূদ্ধে গিয়ে সাগরের সাথে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ।  এই মুহুর্তে তানিশাকে দেখে কঙ্কাবতী রীতিমতো উদ্বিগ্ন।   
মাকে দেখে তানিশার কান্না  শুরু হলো । তার কী কান্না ! তানিশার কান্না থামানো দায় হয়ে দাঁড়ালো ! কঙ্কাবতী যতবার কান্না থামিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইছে, ততবার তানিশার কান্নার ঊর্ধ্বগতি বাড়ছে । 

শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে কান্না থামানোর জন্য ধমক দিলো কঙ্কাবতী ।  
শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছলো তানিশা । তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল ।  তাকে দেখেই কঙ্কাবতীর মনে হচ্ছে, তার বড় মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । মুখটা শুকনো । মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন খায়নি । মাথার চুল উসকো-খুসকো । চেহারার করুণ দশা । অবিন্যস্ত বেশভূষা । এত সুন্দর দেখতে তার মেয়েগুলি, অথচ তানিশাকে দেখলে মনে হবে সে কঙ্কাবতীর পেটের মেয়ে নয় । অনেক কষ্টে তার কান্না থেমেছে বটে, কিন্তু তখনও তানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । মুখ দিয়ে তার কথা বের হচ্ছে না । কঙ্কাবতীর চোখ গরমের জন্য তানিশা  সোজা হয়ে দাঁড়ালো । পিঠের কাপড় সরিয়ে মাকে দেখতে ইশারা করল । কঙ্কাবতী তানিশার পেছনের  পিঠ দেখে বিস্ময়ে হতবাক ! সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কাবতীর মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, “তোকে এভাবে কে পেটালো ?”
   এতক্ষণ পর তানিশার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে কথা বের হলো, “তোমার গুণধর জামাই !”    
   কঙ্কাবতী ভীষণ রেগে গিয়ে উল্টে তানিশার উপর চোটপাট ! বুদ্ধুর মতো লাঠির ঠ্যাঙানি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে  বাপের  বাড়ি ফিরে এলি । একবারও ভাবলি না, তোকে শ্বশুর বাড়ির লোক অন্যায়ভাবে মেরেছে । সুতরাং এর একটা বিহিত হওয়া দরকার । তুই স্পটে যতটা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারতিস, এখন সেটা অনেক কমে যাবে । কিছু করতে না পারলে অন্তত ফোঁস করতে পারতিস । তা না করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলি । এটা একটা মুর্খতার পরিচয়  ! তোর হারাবার কিছু ছিল না । সব হারিয়ে তুই বাড়ির দিকে পা রাখছিস, সুতরাং তোকে অন্তত তাদের বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত “তোর একটা আত্মসম্মান আছে” । সেই আত্মসম্মানে তারা আঘাত করেছে । সুতরাং  শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সহজে ছেড়ে দেবে না । আহাম্মকের মতো লাঠির প্রহার খেয়ে পালিয়ে এলি । তারা তোকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল  । দুটো লাঠির ঘা’য়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল । আমার পেটের মেয়ে হয়ে এই শিক্ষা মায়ের কাছ থেকে কী পেয়েছিস ? দেশে কী আইন-প্রশাসন নেই । থানায় গিয়ে নালিশ জানাতে তোকে কে বাধা দিয়েছিল ? সেগুলি না করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোজা পলায়ন ! এটা তোমার একদম ঠিক হয়নি । বিয়েটা করেছিলে নিজের পছন্দ মতো । বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ঐ পাষণ্ড ছেলেটার সুমিষ্ট কথা শুনে গলে গিয়িছিলি । খোঁজ খবর নিয়ে আমি এমনও বলেছিলাম, ছেলেটা  বখাটে ! কিচ্ছু কাজকর্ম করে না । তা ছাড়া ছেলেটার স্বভাব চরিত্র ভাল না । বিয়ের পরে ছেলেটাকে তার বাবা-মায়ের  উপর  নির্ভর করতে হবে ।“ তুই আমার কথা শুনলি না । উল্টে মাকে সন্দেহ করলি, “আমি নাকি তোদের সম্পর্কটাকে সন্দেহ করছি ?”
 তখন তোর বিয়ের জন্য তর সইছিল না । আমি ঢিলা দিয়ে তোর বাবাকে ফাগুনডাঙায় পাঠিয়েছিলাম, সাগরদের বাড়ির খোঁজখবর নিতে । তোর বাবা ফাগুনডাঙা গাঁয়ের আশেপাশের মানুষের সঙ্গে খোঁজখবর নিয়ে বলেছিল, “সাগর ছেলেটার সাথে  বিয়ে হলে মেয়েটা সুখী হতে পারবে না ।“  সাগরের নৈতিক চরিত্র নাকি খুব খারাপ । তা ছাড়া উপার্জনের জায়গাটা নেই । কাজকর্ম কিচ্ছু করে না । সাগরদের পরিবারের ব্যাপারে  তোর বাবার উষ্মার কথা তোকে জানাতে পারিনি,  পাছে তুই অসন্তুষ্ট হস্‌ ।  বিয়ের সময় দাবী-দাওয়ার লম্বা লিষ্ট, যেটা  কোনোরকমে ম্যানেজ করেছিলাম । বিয়ের পরেও সাগরের দাবীমতো পঞ্চাশ হাজার টাকা গোপনে পৌঁছে দিয়েছিলাম তোর সুখের কথা ভেবে । 
   প্রিয় ভালবাসার মানুষটি লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো । অথচ তার বিরূদ্ধে একটা কথাও বললি না । সুতরাং এই অবস্থায় আমার বাড়িতে বসে অসহায়ের মতো কাঁদলে হবে না । এক্ষুণি আমার সাথে তোকে যেতে হবে !
 কোথায় যাবো ? আমি কিন্তু ঐ লম্পটদের বাড়ি আর যেতে চাই না ।
  সেকথা বললে হবে না মা । সমস্যা সৃষ্টির মূলে তুমি । সুতরাং  সমস্যা মোকাবিলা তোমাকেই করতে হবে । আমি কিন্তু সাগরকে অত সহজে  ছেড়ে দেবো না । আমার মেয়েকে যে বা যারা তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের আমি যতক্ষণ উচিত শিক্ষা দিতে না পারছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই । আমার নাম কঙ্কাবতী । কঙ্কাবতী কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না । অন্যায়ের সঙ্গে আপোশ করা আমার ধাতে নেই । আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সুতরাং তাদের সারাজীবন মেয়েকে  ভরণপোষন দিতে হবে । নতুবা আমি আইনের দ্বারস্থ হব । দেশ থেকে এখনও আইন শৃঙ্খলা উঠে যায়নি । প্রয়োজন হলে আমি আইনি সাহায্য নেবো ।  
  সাগরদের বাড়ি পড়েছে  বলরামপুর থানার অধীনে । থানায় ছুটলো কঙ্কাবতী ।  সঙ্গে অনিন্দ । বড়বাবু  থানায় উপস্থিত ছিলেন । কঙ্কাবতী বড়বাবুর চেম্বারে সোজা ঢুকে গেলো  ।
 “স্যার, আমার মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে ।“  কঙ্কাবতী কথাগুলি বলেই মেয়ের পিঠের কাপড় সরিয়ে এবং ব্লাউজের হুক খুলে বড়বাবুকে মারের  আঘাতের চিহ্নগুলো দেখালো । আঘাতের চিহ্নগুলি দেখিয়ে চোখ লাল করে বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, এটা কী সুস্থ মানবিকতার লক্ষণ ?”
  বড়বাবু ঐ দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না । তাই অস্বস্তিবোধ করছিলেন । তিনি  মৃদু স্বরে কঙ্কাবতীকে আপত্তি করে বললেন, “প্লীজ আপনারা বসুন । আমাদের মহিলা পুলিশ আধিকারিক চেম্বারে ঢুকলে তাঁর সামনে ক্ষত চিহ্নগুলি দেখাবেন ।“ বড়বাবু উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে মহিলা পুলিশ চেম্বারে ঢুকলেন । তাঁকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ম্যাডামের ঘটনাটা নোট করুন ।“
  “উঁহু স্যার ! ঘটনাটা নোট করলে হবে না । এফ-আই-আর নিতে হবে ।“ কঙ্কাবতী বড়বাবুকে অনুরোধ করলো ।
  “আপনি কাদের বিরুদ্ধে এফ-আই-আর করতে চান ?”  মহিলা পুলিশ আধিকারিক জানতে চাইলেন ।
   “মেয়ের স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ।“ 
    গৃহবধূ নিগ্রহের ঘটনাটা শুনে বড়বাবু দৃশ্যত ক্ষুব্ধ । যার জন্য তিনি মহিলা পুলিশ আধিকারিককে নির্দেশ দিলেন, “এফ-আই-আর হয়ে গেলে আপনি ও মেজবাবু আমার সঙ্গে মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি চলুন । এই জাতীয় ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা সত্বর করা আশুকর্তব্য । অমানবিক কী ভয়ঙ্কর নিগ্রহ, দেখলেন ম্যাডাম ! অল্প বয়সের বৌকে কীভাবে মেরেছে । পিঠের দাগগুলি দেখে মনে হচ্ছে বাঁশ দিয়ে বলদ গরুকে ঠাঙাবার মতো ।“ মহিলা পুলিশ আধিকারিক মাথা নেড়ে বড়বাবুর কথার সম্মতি জানালেন ।
  “সাগরবাবু, বাড়ি আছেন ?” বড়বাবু কঙ্কাবতীর জামাইকে ডাকলেন । 
  বাড়িতে পুলিশ দেখে সাগর ভয় পেয়ে গেলো । বিপদ আসন্ন ভেবে  পুলিশ দেখা মাত্র সাগর বাড়ির পেছন দিয়ে উধাও । শ্বশুর মশাই পুলিশের হ্যাপার খপ্পড় থেকে দূরে থাকতে তিনিও বাড়ি থেকে উধাও । শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বড়বাবু নিশ্চিত, শ্বশুর বাড়ির লোকজন তানিশাকে অমানুষিকভাবে মেরে তাড়িয়েছে  । সাগর ও তানিশার শ্বশুরকে সত্বর থানায় দেখা করতে শাশুড়িকে নির্দেশ দিয়ে  বড়বাবু থানায় ফিরে গেলেন । 
  কঙ্কাবতী মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ।  
  বড়বাবু রাতে হঠাৎ হানা দিয়ে সাগরকে না পেয়ে তার বাবাকে বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করলেন । তারপর সোজা থানার লক আপে । থানার বড়বাবুর ধারণা, বাবাকে ধরলেই ছেলে ধরা দিতে বাধ্য । পালিয়ে বেশীদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে না । পুলিশের বক্তব্য, “কান টানলে মাথা আসবেই ।“ 
 অ্যারেস্ট করার আগে সাগরের বাবা থানার বড়বাবুকে চেপে ধরলেন, “আমাকে অ্যারেস্ট করার অপরাধ ?”
  “ছেলের বৌকে নিগ্রহ এবং তাকে ‘অ্যাটেম্প টু মার্ডার’ করার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল ।“     
    এর প্রমাণ কী ?
   অভিযোগকারী আপনার বৌমা, তানিশা । সাক্ষী দিয়েছেন কঙ্কাবতী ও আপনাদের গাঁয়ের মাতবর সুফল তরফদার । 
   মায়ের কাছে সমস্ত ঘটনা  শোনার পর ঘোতন রেগে আগুন ! তার বড় বোন তানিশাকে মেরে পিঠে রক্ত বের করে দিয়ে কিনা প্রমাণ চাইছে ? নিজের মনে স্বগতোক্তি করে ক্রদ্ধ স্বরে বলল, “এবার সাগরকে গণধোলাই না দিতে পারলে তার শান্তি নেই ।“ ঘোতন সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে সাগরের ঠিক হদিস পেলো  । তাকে খুঁজে বার করলো । কলার চেপে ঘর থেকে বের করে রাতের অন্ধকারে বেদম প্রহার । রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ঘোতন বলল, “তানিশাকে মেরেছিস, এবার তোকে কে বাঁচাবে  ?” তারপর ভ্যানে চাপিয়ে তার হাত পা বেঁধে থানায় পৌঁছে বড়বাবুর চেম্বারের সামনে রেখে ঘোতন উধাও । সাগরকে কে মেরেছে তার কোনো প্রমাণ রইল না ।  ঘোতন এইভাবে বড় বোনের মার খাওয়ার বদলা নিলো ।   
 জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাগর অল্প বয়সের একটি মেয়েকে আবার বিয়ে করলো । 
   বড় মেয়েটা বাড়িতে থাকার কারণে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, সব জায়গায় কঙ্কাবতী উত্তর দেয় তার চারটি মেয়ে । চারটি মেয়েই বড়, ডাগর-ডোগর ।     
  অন্যদিকে তানিশার কঙ্কাবতীর বাড়িতে স্বাভাবিক জীবন যাপন । কঙ্কাবতীর নির্দেশমতো  টেলারিং শিখতে লাগল তানিশা । এইজন্য সপ্তাহে তিনদিন বহরমপুরে যেতে হচ্ছে তানিশাকে । এক বছরের কোর্স ।  তবে একবছরের মধ্যে কোনো বড় টেলারিং দোকানে তাকে হাতে কলমে এক মাস শিখতে হবে । টেলারিং কাজটা তানিশার খুব মনে ধরেছে । কাজটা তার ভাল লাগে । তাই খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটা শিখছে তানিশা ।  কঙ্কাবতীর বক্তব্য, কাজটা শিখলে তানিশা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে । বাবা-মা  সারাজীবন বাঁচবে না । সুতরাং জীবনে চলার পথে অসুবিধা ঘটলে উপার্জনের জন্য চিন্তা থাকবে না । এক মুঠো ভাতের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে । 
  মিঁয়া হল্ট স্টেশন বাজারে একটা ঘরের সন্ধান পেলো কঙ্কাবতী । ছোট্ট একফালি জায়গার উপরে ছোট্ট একটি ঘর । যার পান-বিড়ির দোকান ছিল, তিনি তার একমাত্র  মেয়ের কাছে জলপাইগুড়ি চলে গেছে ।  স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন  । যার জন্য জায়গাটা খুব অল্প দামে পাওয়া গেলো ।     গুমটি কুঠুরি বটে, কিন্তু বাজারের মাঝখানে । যারজন্য তানিশার টেলারিং সকলের নজরে পড়বে এবং তার টেলারিং ব্যবসা ভাল চলবে । কঙ্কাবতীর দূরদর্শিতা ভীষণ গঠনমূলক । যার জন্য  মেয়েদের স্বাবলম্বী করার দিকে কঙ্কাবতীর ঝোঁক  । 
   তানিশার  বহরমপুরের টেলারিং কোর্স শেষ । সেই কারণে তানিশার টেলারিং ব্যবসা খোলার উদ্যোগ নিলো কঙ্কাবতী । সত্বর দোকানটা খোলার একটাই কারণ, সামনে দুর্গা পুজা । দুর্গা পুজার মার্কেট ধরতে মরিয়া কঙ্কাবতী । ধার-দেনা করে একটা সেলাই মেশিন কিনলো । শুভ জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার দিন দোকান উদ্বোধন করার মনস্থির করলো । সেই মতো গুমটি ঘরটি সাজালো । উদ্বোধনের দিন নিয়ামতপুর ব্লকের বি-ডি-ও ম্যাডামকে উপস্থিত থাকতে নিমন্ত্রণ জানালো কঙ্কাবতী । ম্যাডাম কথা দিলেন, রথের দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন । 
    কঙ্কাবতীর বিপদ পদে পদে । রথের আগের রাত্রিতে দোকান ঘর সাজানো শেষ । তানিশা ও কঙ্কাবতী দোকানের সাটার বন্ধ করে বাইরেটা ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজালো । বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা দোকান ঘর সাজানোর তারিফ করলেন । তারপর তারা বাড়ি ফিরে খেতে বসেছে, এমন সময় তাদের দোকানের উল্টোদিকে মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের  ভম্বলের টেলিফোন, “তোমাদের দোকানের বাইরের সাজানো ফুল ছিঁড়ে ফেলছে । শিগ্‌গির না এলে সাটার ভাঙতে পারে ।“ 
  “কারা ফুল ছিঁড়ছে, তাদের চিনতে পারলি ?” জানতে চাইল কঙ্কাবতী । 
  “না । গামছা দিয়ে তাদের মুখ ঢাকা ।“ মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারী ভম্বল জানালো । 
   ঘোতন শুনতে পেয়ে খাওয়া ফেলে ছুটলো দুর্বৃত্তদের ধরতে । ঘোতন পৌঁছানোর আগে তারা পালিয়েছে । কিন্তু ঘোতন হাল ছাড়বার পাত্র নয় । ভম্বলের কাছে জানতে পারলো তারা সংখ্যায় তিনজন এবং সাইকেলে তারা পূর্ব দিক দিয়ে পালিয়েছে । ঘোতনের অনুমান তারা বেশীদূরে পালাতে পারেনি । যেদিক দিয়ে পালিয়েছে সেইদিকে মনু ময়রার মোটর বাইক নিয়ে ছুটলো ঘোতন । বাবলা নদীর কিনারের রাস্তা দিয়ে তারা তখন প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল ছোটাচ্ছে ! ঘোতন মোটর বাইক নিয়ে তিনজনের সামনে দাঁড়ালো । দুর্বৃত্তরা তখন মারমুখী । প্রচণ্ড আক্রোশে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন তেজী জওয়ান । নিমেষের মধ্যে তিনজনকে ঘায়েল করে ফেললো । তিনটিই তখন রাস্তার উপর গড়াগড়ি ।  তারপর দুর্বৃত্তদের কাছে  ঘোতনের প্রশ্ন, “দোকান ঘর কেন ভাঙলি ?” কিন্তু কিছুতেই উত্তর দিতে চাইছে না । তাদের মুখে কুলুপ আঁটা ।  ঘোতন জানে, কীভাবে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে হয় । একজন দুর্বৃত্তের বুকের পা রেখে বলল, এবার না বললে একে একে তিনটিকেই জাহান্নামে পাঠাবো । ততক্ষণে ভম্বল ও তানিশার মেজ বোন মনীষা স্পটে হাজির । অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল, “তাদের পাঠিয়েছিল সাগর !”  ঘোতনের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার । রাগ মেটাতে তানিশার টেলারিং  দোকান খোলা বানচাল করার ধান্দা  !  
  ঘোতন এবার দুর্বৃত্তদের কড়া ভাষায় বলল,”ভাল চাস্‌ তো দোকান ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনি করে সাজিয়ে আয় । নতুবা তোদের সাগরের মৃত্যু আমার হাতে !”
  পরেরদিন সকাল দশটায় ব্লক আধিকারিকের উপস্থিতিতে তানিশার টেলারিংয়ের দোকান উদ্বোধন হয়ে গেলো ।  মিঁয়াগ্রাম বাজারে এই প্রথম মেয়েদের টেলারিং দোকান । যার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো  । কঙ্কাবতী খুশী, কেননা বড় মেয়ের অন্তত নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা হিল্লে হল । 
                 ************************ 
    গাঁয়ের কাকু ষষ্টীকমলকে নিয়ে কঙ্কাবতী পড়েছে মহা ফাঁপরে । মনীষা জানিয়েছিল, বিপাশা নাকি রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় ষষ্টীকমলকাকুর বাসায় যায় এবং সেখানে কিছু সময় দাদুর সাথে কাটায় ।  বিপাশার দাদু অর্থাৎ ষষ্টীকমল বিপাশাকে খুব ভালবাসে । গেলেই লজেন্স, চকলেট এবং আরও ভাল ভাল লোভনীয় খাবার খাওয়ায় । দশ মিনিট মতো দাদুর সঙ্গে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে । এটা নাকি এখন বিপাশার নিত্য রুটিন । কঙ্কাবতীর এতে কোনো আপত্তি ছিল না । ষষ্টীকমলকে  কঙ্কাবতী অনেক আগে থেকেই কাকু সম্বোধনে ডাকে । তেমনি কাকু কঙ্কাবতীর  পারিবারের এবং  ব্যবসার খোঁজখবর নেয় । গাঁয়ের একজন বয়স্ক মানুষ তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছে,  এতে কঙ্কাবতী খুশী । কেননা গাঁয়ে অনেক মানুষের বসবাস, অথচ  ঘুণাক্ষরেও তাঁরা কঙ্কাবতীদের দিকে ফিরেও তাকায় না । সেই নিরিখে ষষ্টীকমলকাকা তাদের পরিবারের একজন হিতাকাক্ষী মানুষ । তাই তাঁকে কঙ্কাবতী শ্রদ্ধা করে । তা ছাড়া তাঁর একমাত্র ছেলে ও বৌ দুইজনেই খুব শিক্ষিত । ছেলেটা সরকারি উচ্চপদে চাকুরিরত  এবং বৌমা রেলওয়েতে কর্মরত । দুইজনেরই শহরে পোস্টিং । খুব সকালে তারা অফিসে বেরিয়ে যায়, আর ফেরে রাত্রিতে । ষষ্টীকমলকাকুর একটাই মেয়ে । তার বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ে জামাই থাকে বেনারসে । ষষ্টীকমলকাকুর গিন্নি আবার বছরের বেশীর ভাগ সময় মেয়ের কাছে থাকে । কারণ মেয়ের সন্তানকে  দেখাশোনা করতে হয় । জামাই বড় মাপের ডাক্তার । মেয়ে সরকারি দপ্তরে আধিকারিক । দায়িত্বপূর্ণ কাজ । ফলে সেখানে কাকীমাকে বাচ্চা আগলাবার জন্য থাকতে হচ্ছে । তাই ছোট মেয়ের কাকুর বাড়ি যাওয়া-আসায় কঙ্কাবতীর  আপত্তি নেই  । 

 কিন্তু মনীষা খবর দিলো, বিপাশা আজকাল ষষ্টীকমলকাকুর বাড়ি বেশী সময় কাটাচ্ছে । এটা চোখে লাগছে । দাদুর সাথে এমন কী কথা,  যার জন্য বিপাশাকে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট কাটাতে হচ্ছে । এটা মনীষার ভাল লাগছে না । তাই মনীষা মাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছে ছোট বোনটার দাদু-প্রীতি কমাতে ।
 ষষ্টীকমলকাকু ভাল সরকারি চাকরি করতেন । শোনা গেছে তিনি প্রচণ্ড ঘুষ খেতেন । সেটা দপ্তরের কয়েকজনের চোখে ভাল লাগে না । তাঁরা ফঁন্দি পেতে ঘুষের টাকা নেওয়াটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে দেন । এমনকি কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা সংস্থা ষষ্টীকমলকাকুকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেন । তারপর যা হওয়ার সেটাই হয়েছে । প্রথমে বিভাগীয় তদন্ত । তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত ! সেই কারণে অবসরের ষাট বছর হওয়ার আগে চাকরি জীবন থেকে তাঁর ছুটি  । এখন তাঁর অবসরকালী জীবন । কিন্তু তিনি যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ । যার জন্য চেহারা ধরে রেখেছেন । কেউ তাঁকে দেখলে বলবে না, তিনি রিটায়ার্ড । 
   স্কুল ছুটি হলে বিপাশা পা টিপে টিপে চুপি চুপি দাদুর ঘরে ঢোকে । দাদু আগেভাগেই বাড়ির সদর দরজা খোলা রাখেন  । বিপাশার স্কুল শুরু হয় সকাল  সাতটায় এবং শেষ হয় বেলা সাড়ে-এগারোটায় । স্কুল থেকে হাঁটা পথে দাদুর বাড়ি পনের মিনিট । তাই বিপাশা সাধারণত দুপুর বারোটা নাগাদ দাদুর বাড়িতে ঢোকে । দাদু তখন সেজেগুজে ফিটফাট । নাতনীর জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন । বিপাশার জন্য নিত্যদিন চকলেট বাধা । এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল রেডি রাখে । ঠিক ঐ সময় দাদুর বাড়ি ফাঁকা । ছেলে-বৌমা তখন অফিসে । সকাল দশটার মধ্যে কাজের মাসি কাজ সেরে চলে যায় । কাকীমা দীর্ঘদিন মেয়ের বাড়ি বেনারসে ।  বাড়িতে তখন দাদু ছাড়া কেউ থাকে না । ফাঁকা বাড়ি পেয়ে বিপাশা মহা আনন্দে সারা বাড়ি ধেইধেই ঘুরে বেড়ায় । 
    ষষ্টীকমলকাকু তখন বিপাশার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন । বিপাশা সদ্য মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে পাঠরত । হাপালো মেয়ে । ডাগর-ডোগর । বিপাশাকে দেখলে মনে হবে সে কলেজে ফাইনাল ইয়ার । সুতরাং বিপাশা যখন এঘর-সেঘর দৌড়-ঝাঁপ করে, তখন তার পুরো শরীরটা নড়াচড়া করে । সেটা দেখতে ষষ্টীকমলকাকুর খুব ভাল লাগে । বিপাশা দাদুর ঐরকম তাকানোতে খুব মজা পায় । এইজন্য অনেক সময় দাদুর ঠিক সামনে স্কিপিং করার মতো লাফায়, আর হাসে । তখন দাদুরও চোখে-মুখে  প্রশান্তির হাসি । 
    বেলা বারোটা পার হয়ে গেলে ষষ্টীকমলবাবু উতলা হয়ে উঠেন । যতক্ষণ বিপাশা ঘরে না ঢুকছে ততক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন । ষষ্টীকমলবাবু নিজেও জানেন না, বিপাশার জন্য  তাঁর মন কেন আনচান করে ?
      মায়ের নীরবতা লক্ষ্য করে মানষী ভাবলো, সে একদিন সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে বিপাশা দাদুর বাড়িতে ঢুকে ঠিক  কী কিরে ? তার এত সময় কাটানোর কারণ কী ? মানষীর ধন্দে কিছুতেই কাটছে না,  দাদুর বাড়িতে যাওয়ার বিপাশার এত উৎসাহ  কেন ? মানষী  সুযোগ বুঝে ষষ্টীকমলদাদুর বাড়ি হানা দেওয়ার অপেক্ষায় রইল । 
                        ******************** 
    এদিকে কঙ্কাবতীর তৃতীয় মেয়ে অনীশা ও অনিন্দ ঠিক করলো, মিঁয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে তারা চায়ের দোকান খুলবে । অনীশা খুব পরিশ্রমী । পড়াশুনায় বেশীদূর এগোতে পারেনি, কিন্তু পরিশ্রম করার ক্ষেত্রে তার কোনো অলসতা নেই । অনিন্দ অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তারা বাপ-বেটী চায়ের দোকান খুলবে । মিঁয়াগ্রামের নাসিরুদ্দিনের দু-কাঠার জমির উপর একটা ভাঙাচোরা ঘর স্টেশনে যাওয়ার রাস্তার উপরেই পড়ে রয়েছে, খানিকটা পরিত্যক্তভাবে ।  নাসিরুদ্দিন সাম্প্রতিককালে তার একমাত্র ছেলের কাছে নিমতিতাতে (মুর্শিদাবাদ জেলা) বাস করছে । ছেলে নিমতিতার একটি নামজাদা হাই স্কুলের শিক্ষক ।  ছেলে একরকম জোর করে নাসিরুদ্দিনকে নিমতিতায় তাদের কাছে নিয়ে  রেখেছে । ফলে ঐ জায়গাটায় তাঁর প্রস্তাবিত দোকান ঘর আর খোলা হয়নি । নাসিরুদ্দিনের ইচ্ছা ছিল ঐ জায়াগায় খাওয়ার রেঁস্তরা খোলার । তবে এই মুহূর্তে জমি সমেত  ভাঙা বাড়িটা নাসিরুদ্দিনের বেচার ইচ্ছা ছিল না । কঙ্কাবতী তাঁকে চেপে ধরায় নাসিরুদ্দিন অমত করতে পারেনি । একরকম জলের দামে জায়গাটা কঙ্কাবতী কিনেছে । এটা কেনার ক্ষেত্রে অনিন্দ মধ্যস্থতা করলে জায়গাটা হাত ছাড়া হয়ে যেতো । জমিটা কেনার প্রতি দৃষ্টি  মিঁয়ার অনেক ব্যবসায়ীর ছিল । তাই অতি সন্তর্পণে সুযোগ বুঝে কঙ্কাবতী সোজা নিমতিতায় হাজির । ট্রেনে পৌঁছে গিয়েছিল কঙ্কাবতী এবং সে একা গিয়েছিল । পাছে জানাজানি হয়ে যায়, এইজন্য বাড়ির কাউকে সঙ্গে নেয়নি । নিমতিতা স্টেশনের কাছাকাছি ভাগীরথী গঙ্গা । সবাই জানে, ভাগীরথী গঙ্গা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে এসেছে । আরও একটা মজার ব্যাপার, নিমতিতার উল্টোদিকে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা । ভাগীরথী গঙ্গা রাজশাহী জেলা দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশে পদ্মা নামে খ্যাত । সেই হিসাবে পদ্মা নদী ভাগীরথীর প্রধান শাখা নদী । সেই নিমতিতায় নাসিরুদ্দিনের ছেলের বাড়িতে বসে জায়াগাটা কেনাবেচা এবং চুক্তিপত্রের কাগজপত্রের কাজকর্ম সম্পন্ন হয় । নাসিরুদ্দিনের সেই জায়গার উপর অনিন্দ ও অনীশা চায়ের দোকান খোলার মনস্থির করলো ।   
                                                              ( ক্রমশ )
Share This
Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ রায়।

       কঙ্কাবতীর মাথায় হাত ! বৃহস্পতিবারদিন সাধারণত বিক্রিবাট্টা কম । গেরস্তের বাড়ি থেকে নগদ টাকা বের করা নাকি সংসারের অমঙ্গল । চিরাচরিত ধ্যানধারণার সংস্কার এখনও  গাঁয়ের দিকে বিদ্যমান । গাঁয়ের মানুষের কথা ভেবে কঙ্গাবতী যদিও বৃহস্পতিবার বাজার থেকে সব্জীও কম তোলে । সকাল আটটায় বেরিয়ে তিনটি গ্রাম ঘোরা হয়ে গেলো । কিন্তু বিক্রির  হালহকিকৎ দেখে কঙ্কাবতী হতাশ ! অগত্যা ভর দুপুরে বিরক্তমুখে বাড়ি ফিরলো । বাড়ি ফিরে দেখে, বড় মেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে । তার চোখ দুটি ছলছল !
     তানিশাকে তানিশার নিজের ইচ্ছামতো অনেক আগেই বিয়ে দিতে হয়েছিল কঙ্কাবতীকে । তানিশা তখন সাগরের প্রেমে বিহ্বল । তাই তাকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না কঙ্কাবতীর । ফলে নিজের মতের বিরূদ্ধে গিয়ে সাগরের সাথে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ।  এই মুহুর্তে তানিশাকে দেখে কঙ্কাবতী রীতিমতো উদ্বিগ্ন ।   
      মাকে দেখে তানিশার কান্না  শুরু হলো । তার কী কান্না ! তানিশার কান্না থামানো দায় হয়ে দাঁড়ালো ! কঙ্কাবতী যতবার কান্না থামিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইছে, ততবার তানিশার কান্নার ঊর্ধ্বগতি বাড়ছে । 
   শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে কান্না থামানোর জন্য ধমক দিলো কঙ্কাবতী ।  
   শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছলো তানিশা । তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল ।  তাকে দেখেই কঙ্কাবতীর মনে হচ্ছে, তার বড় মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । মুখটা শুকনো । মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন খায়নি । মাথার চুল উসকো-খুসকো । চেহারার করুণ দশা । অবিন্যস্ত বেশভূষা । এত সুন্দর দেখতে তার মেয়েগুলি, অথচ তানিশাকে দেখলে মনে হবে সে কঙ্কাবতীর পেটের মেয়ে নয় । অনেক কষ্টে তার কান্না থেমেছে বটে, কিন্তু তখনও তানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । মুখ দিয়ে তার কথা বের হচ্ছে না । কঙ্কাবতীর চোখ গরমের জন্য তানিশা  সোজা হয়ে দাঁড়ালো । পিঠের কাপড় সরিয়ে মাকে দেখতে ইশারা করল । কঙ্কাবতী তানিশার পেছনের  পিঠ দেখে বিস্ময়ে হতবাক ! সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কাবতীর মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, “তোকে এভাবে কে পেটালো ?”
   এতক্ষণ পর তানিশার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে কথা বের হলো, “তোমার গুণধর জামাই !”    
   কঙ্কাবতী ভীষণ রেগে গিয়ে উল্টে তানিশার উপর চোটপাট ! বুদ্ধুর মতো লাঠির ঠ্যাঙানি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে  বাপের  বাড়ি ফিরে এলি । একবারও ভাবলি না, তোকে শ্বশুর বাড়ির লোক অন্যায়ভাবে মেরেছে । সুতরাং এর একটা বিহিত হওয়া দরকার । তুই স্পটে যতটা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারতিস, এখন সেটা অনেক কমে যাবে । কিছু করতে না পারলে অন্তত ফোঁস করতে পারতিস । তা না করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলি । এটা একটা মুর্খতার পরিচয়  ! তোর হারাবার কিছু ছিল না । সব হারিয়ে তুই বাড়ির দিকে পা রাখছিস, সুতরাং তোকে অন্তত তাদের বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত “তোর একটা আত্মসম্মান আছে” । সেই আত্মসম্মানে তারা আঘাত করেছে । সুতরাং  শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সহজে ছেড়ে দেবে না । আহাম্মকের মতো লাঠির প্রহার খেয়ে পালিয়ে এলি । তারা তোকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল  । দুটো লাঠির ঘা’য়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল । আমার পেটের মেয়ে হয়ে এই শিক্ষা মায়ের কাছ থেকে কী পেয়েছিস ? দেশে কী আইন-প্রশাসন নেই । থানায় গিয়ে নালিশ জানাতে তোকে কে বাধা দিয়েছিল ? সেগুলি না করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোজা পলায়ন ! এটা তোমার একদম ঠিক হয়নি । বিয়েটা করেছিলে নিজের পছন্দ মতো । বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ঐ পাষণ্ড ছেলেটার সুমিষ্ট কথা শুনে গলে গিয়িছিলি । খোঁজ খবর নিয়ে আমি এমনও বলেছিলাম, ছেলেটা  বখাটে ! কিচ্ছু কাজকর্ম করে না । তা ছাড়া ছেলেটার স্বভাব চরিত্র ভাল না । বিয়ের পরে ছেলেটাকে তার বাবা-মায়ের  উপর  নির্ভর করতে হবে ।“ তুই আমার কথা শুনলি না । উল্টে মাকে সন্দেহ করলি, “আমি নাকি তোদের সম্পর্কটাকে সন্দেহ করছি ?”
 তখন তোর বিয়ের জন্য তর সইছিল না । আমি ঢিলা দিয়ে তোর বাবাকে ফাগুনডাঙায় পাঠিয়েছিলাম, সাগরদের বাড়ির খোঁজখবর নিতে । তোর বাবা ফাগুনডাঙা গাঁয়ের আশেপাশের মানুষের সঙ্গে খোঁজখবর নিয়ে বলেছিল, “সাগর ছেলেটার সাথে  বিয়ে হলে মেয়েটা সুখী হতে পারবে না ।“  সাগরের নৈতিক চরিত্র নাকি খুব খারাপ । তা ছাড়া উপার্জনের জায়গাটা নেই । কাজকর্ম কিচ্ছু করে না । সাগরদের পরিবারের ব্যাপারে  তোর বাবার উষ্মার কথা তোকে জানাতে পারিনি,  পাছে তুই অসন্তুষ্ট হস্‌ ।  বিয়ের সময় দাবী-দাওয়ার লম্বা লিষ্ট, যেটা  কোনোরকমে ম্যানেজ করেছিলাম । বিয়ের পরেও সাগরের দাবীমতো পঞ্চাশ হাজার টাকা গোপনে পৌঁছে দিয়েছিলাম তোর সুখের কথা ভেবে । 
   প্রিয় ভালবাসার মানুষটি লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো । অথচ তার বিরূদ্ধে একটা কথাও বললি না । সুতরাং এই অবস্থায় আমার বাড়িতে বসে অসহায়ের মতো কাঁদলে হবে না । এক্ষুণি আমার সাথে তোকে যেতে হবে !
 কোথায় যাবো ? আমি কিন্তু ঐ লম্পটদের বাড়ি আর যেতে চাই না ।
  সেকথা বললে হবে না মা । সমস্যা সৃষ্টির মূলে তুমি । সুতরাং  সমস্যা মোকাবিলা তোমাকেই করতে হবে । আমি কিন্তু সাগরকে অত সহজে  ছেড়ে দেবো না । আমার মেয়েকে যে বা যারা তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের আমি যতক্ষণ উচিত শিক্ষা দিতে না পারছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই । আমার নাম কঙ্কাবতী । কঙ্কাবতী কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না । অন্যায়ের সঙ্গে আপোশ করা আমার ধাতে নেই । আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সুতরাং তাদের সারাজীবন মেয়েকে  ভরণপোষন দিতে হবে । নতুবা আমি আইনের দ্বারস্থ হব । দেশ থেকে এখনও আইন শৃঙ্খলা উঠে যায়নি । প্রয়োজন হলে আমি আইনি সাহায্য নেবো ।  
  সাগরদের বাড়ি পড়েছে  বলরামপুর থানার অধীনে । থানায় ছুটলো কঙ্কাবতী ।  সঙ্গে অনিন্দ । বড়বাবু  থানায় উপস্থিত ছিলেন । কঙ্কাবতী বড়বাবুর চেম্বারে সোজা ঢুকে গেলো  ।
 “স্যার, আমার মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে ।“  কঙ্কাবতী কথাগুলি বলেই মেয়ের পিঠের কাপড় সরিয়ে এবং ব্লাউজের হুক খুলে বড়বাবুকে মারের  আঘাতের চিহ্নগুলো দেখালো । আঘাতের চিহ্নগুলি দেখিয়ে চোখ লাল করে বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, এটা কী সুস্থ মানবিকতার লক্ষণ ?”
  বড়বাবু ঐ দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না । তাই অস্বস্তিবোধ করছিলেন । তিনি  মৃদু স্বরে কঙ্কাবতীকে আপত্তি করে বললেন, “প্লীজ আপনারা বসুন । আমাদের মহিলা পুলিশ আধিকারিক চেম্বারে ঢুকলে তাঁর সামনে ক্ষত চিহ্নগুলি দেখাবেন ।“ বড়বাবু উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে মহিলা পুলিশ চেম্বারে ঢুকলেন । তাঁকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ম্যাডামের ঘটনাটা নোট করুন ।“
  “উঁহু স্যার ! ঘটনাটা নোট করলে হবে না । এফ-আই-আর নিতে হবে ।“ কঙ্কাবতী বড়বাবুকে অনুরোধ করলো ।
  “আপনি কাদের বিরুদ্ধে এফ-আই-আর করতে চান ?”  মহিলা পুলিশ আধিকারিক জানতে চাইলেন ।
   “মেয়ের স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ।“ 
    গৃহবধূ নিগ্রহের ঘটনাটা শুনে বড়বাবু দৃশ্যত ক্ষুব্ধ । যার জন্য তিনি মহিলা পুলিশ আধিকারিককে নির্দেশ দিলেন, “এফ-আই-আর হয়ে গেলে আপনি ও মেজবাবু আমার সঙ্গে মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি চলুন । এই জাতীয় ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা সত্বর করা আশুকর্তব্য । অমানবিক কী ভয়ঙ্কর নিগ্রহ, দেখলেন ম্যাডাম ! অল্প বয়সের বৌকে কীভাবে মেরেছে । পিঠের দাগগুলি দেখে মনে হচ্ছে বাঁশ দিয়ে বলদ গরুকে ঠাঙাবার মতো ।“ মহিলা পুলিশ আধিকারিক মাথা নেড়ে বড়বাবুর কথার সম্মতি জানালেন ।
  “সাগরবাবু, বাড়ি আছেন ?” বড়বাবু কঙ্কাবতীর জামাইকে ডাকলেন । 
  বাড়িতে পুলিশ দেখে সাগর ভয় পেয়ে গেলো । বিপদ আসন্ন ভেবে  পুলিশ দেখা মাত্র সাগর বাড়ির পেছন দিয়ে উধাও । শ্বশুর মশাই পুলিশের হ্যাপার খপ্পড় থেকে দূরে থাকতে তিনিও বাড়ি থেকে উধাও । শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বড়বাবু নিশ্চিত, শ্বশুর বাড়ির লোকজন তানিশাকে অমানুষিকভাবে মেরে তাড়িয়েছে  । সাগর ও তানিশার শ্বশুরকে সত্বর থানায় দেখা করতে শাশুড়িকে নির্দেশ দিয়ে  বড়বাবু থানায় ফিরে গেলেন । 
  কঙ্কাবতী মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ।  
  বড়বাবু রাতে হঠাৎ হানা দিয়ে সাগরকে না পেয়ে তার বাবাকে বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করলেন । তারপর সোজা থানার লক আপে । থানার বড়বাবুর ধারণা, বাবাকে ধরলেই ছেলে ধরা দিতে বাধ্য । পালিয়ে বেশীদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে না । পুলিশের বক্তব্য, “কান টানলে মাথা আসবেই ।“ 
 অ্যারেস্ট করার আগে সাগরের বাবা থানার বড়বাবুকে চেপে ধরলেন, “আমাকে অ্যারেস্ট করার অপরাধ ?”
  “ছেলের বৌকে নিগ্রহ এবং তাকে ‘অ্যাটেম্প টু মার্ডার’ করার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল ।“     
    এর প্রমাণ কী ?
   অভিযোগকারী আপনার বৌমা, তানিশা । সাক্ষী দিয়েছেন কঙ্কাবতী ও আপনাদের গাঁয়ের মাতবর সুফল তরফদার । 
   মায়ের কাছে সমস্ত ঘটনা  শোনার পর ঘোতন রেগে আগুন ! তার বড় বোন তানিশাকে মেরে পিঠে রক্ত বের করে দিয়ে কিনা প্রমাণ চাইছে ? নিজের মনে স্বগতোক্তি করে ক্রদ্ধ স্বরে বলল, “এবার সাগরকে গণধোলাই না দিতে পারলে তার শান্তি নেই ।“ ঘোতন সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে সাগরের ঠিক হদিস পেলো  । তাকে খুঁজে বার করলো । কলার চেপে ঘর থেকে বের করে রাতের অন্ধকারে বেদম প্রহার । রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ঘোতন বলল, “তানিশাকে মেরেছিস, এবার তোকে কে বাঁচাবে  ?” তারপর ভ্যানে চাপিয়ে তার হাত পা বেঁধে থানায় পৌঁছে বড়বাবুর চেম্বারের সামনে রেখে ঘোতন উধাও । সাগরকে কে মেরেছে তার কোনো প্রমাণ রইল না ।  ঘোতন এইভাবে বড় বোনের মার খাওয়ার বদলা নিলো ।   
 জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাগর অল্প বয়সের একটি মেয়েকে আবার বিয়ে করলো । 
   বড় মেয়েটা বাড়িতে থাকার কারণে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, সব জায়গায় কঙ্কাবতী উত্তর দেয় তার চারটি মেয়ে । চারটি মেয়েই বড়, ডাগর-ডোগর ।     
  অন্যদিকে তানিশার কঙ্কাবতীর বাড়িতে স্বাভাবিক জীবন যাপন । কঙ্কাবতীর নির্দেশমতো  টেলারিং শিখতে লাগল তানিশা । এইজন্য সপ্তাহে তিনদিন বহরমপুরে যেতে হচ্ছে তানিশাকে । এক বছরের কোর্স ।  তবে একবছরের মধ্যে কোনো বড় টেলারিং দোকানে তাকে হাতে কলমে এক মাস শিখতে হবে । টেলারিং কাজটা তানিশার খুব মনে ধরেছে । কাজটা তার ভাল লাগে । তাই খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটা শিখছে তানিশা ।  কঙ্কাবতীর বক্তব্য, কাজটা শিখলে তানিশা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে । বাবা-মা  সারাজীবন বাঁচবে না । সুতরাং জীবনে চলার পথে অসুবিধা ঘটলে উপার্জনের জন্য চিন্তা থাকবে না । এক মুঠো ভাতের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে । 
  মিঁয়া হল্ট স্টেশন বাজারে একটা ঘরের সন্ধান পেলো কঙ্কাবতী । ছোট্ট একফালি জায়গার উপরে ছোট্ট একটি ঘর । যার পান-বিড়ির দোকান ছিল, তিনি তার একমাত্র  মেয়ের কাছে জলপাইগুড়ি চলে গেছে ।  স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন  । যার জন্য জায়গাটা খুব অল্প দামে পাওয়া গেলো ।     গুমটি কুঠুরি বটে, কিন্তু বাজারের মাঝখানে । যারজন্য তানিশার টেলারিং সকলের নজরে পড়বে এবং তার টেলারিং ব্যবসা ভাল চলবে । কঙ্কাবতীর দূরদর্শিতা ভীষণ গঠনমূলক । যার জন্য  মেয়েদের স্বাবলম্বী করার দিকে কঙ্কাবতীর ঝোঁক  । 
   তানিশার  বহরমপুরের টেলারিং কোর্স শেষ । সেই কারণে তানিশার টেলারিং ব্যবসা খোলার উদ্যোগ নিলো কঙ্কাবতী । সত্বর দোকানটা খোলার একটাই কারণ, সামনে দুর্গা পুজা । দুর্গা পুজার মার্কেট ধরতে মরিয়া কঙ্কাবতী । ধার-দেনা করে একটা সেলাই মেশিন কিনলো । শুভ জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার দিন দোকান উদ্বোধন করার মনস্থির করলো । সেই মতো গুমটি ঘরটি সাজালো । উদ্বোধনের দিন নিয়ামতপুর ব্লকের বি-ডি-ও ম্যাডামকে উপস্থিত থাকতে নিমন্ত্রণ জানালো কঙ্কাবতী । ম্যাডাম কথা দিলেন, রথের দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন । 
    কঙ্কাবতীর বিপদ পদে পদে । রথের আগের রাত্রিতে দোকান ঘর সাজানো শেষ । তানিশা ও কঙ্কাবতী দোকানের সাটার বন্ধ করে বাইরেটা ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজালো । বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা দোকান ঘর সাজানোর তারিফ করলেন । তারপর তারা বাড়ি ফিরে খেতে বসেছে, এমন সময় তাদের দোকানের উল্টোদিকে মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের  ভম্বলের টেলিফোন, “তোমাদের দোকানের বাইরের সাজানো ফুল ছিঁড়ে ফেলছে । শিগ্‌গির না এলে সাটার ভাঙতে পারে ।“ 
  “কারা ফুল ছিঁড়ছে, তাদের চিনতে পারলি ?” জানতে চাইল কঙ্কাবতী । 
  “না । গামছা দিয়ে তাদের মুখ ঢাকা ।“ মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারী ভম্বল জানালো । 
   ঘোতন শুনতে পেয়ে খাওয়া ফেলে ছুটলো দুর্বৃত্তদের ধরতে । ঘোতন পৌঁছানোর আগে তারা পালিয়েছে । কিন্তু ঘোতন হাল ছাড়বার পাত্র নয় । ভম্বলের কাছে জানতে পারলো তারা সংখ্যায় তিনজন এবং সাইকেলে তারা পূর্ব দিক দিয়ে পালিয়েছে । ঘোতনের অনুমান তারা বেশীদূরে পালাতে পারেনি । যেদিক দিয়ে পালিয়েছে সেইদিকে মনু ময়রার মোটর বাইক নিয়ে ছুটলো ঘোতন । বাবলা নদীর কিনারের রাস্তা দিয়ে তারা তখন প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল ছোটাচ্ছে ! ঘোতন মোটর বাইক নিয়ে তিনজনের সামনে দাঁড়ালো । দুর্বৃত্তরা তখন মারমুখী । প্রচণ্ড আক্রোশে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন তেজী জওয়ান । নিমেষের মধ্যে তিনজনকে ঘায়েল করে ফেললো । তিনটিই তখন রাস্তার উপর গড়াগড়ি ।  তারপর দুর্বৃত্তদের কাছে  ঘোতনের প্রশ্ন, “দোকান ঘর কেন ভাঙলি ?” কিন্তু কিছুতেই উত্তর দিতে চাইছে না । তাদের মুখে কুলুপ আঁটা ।  ঘোতন জানে, কীভাবে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে হয় । একজন দুর্বৃত্তের বুকের পা রেখে বলল, এবার না বললে একে একে তিনটিকেই জাহান্নামে পাঠাবো । ততক্ষণে ভম্বল ও তানিশার মেজ বোন মনীষা স্পটে হাজির । অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল, “তাদের পাঠিয়েছিল সাগর !”  ঘোতনের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার । রাগ মেটাতে তানিশার টেলারিং  দোকান খোলা বানচাল করার ধান্দা  !  
  ঘোতন এবার দুর্বৃত্তদের কড়া ভাষায় বলল,”ভাল চাস্‌ তো দোকান ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনি করে সাজিয়ে আয় । নতুবা তোদের সাগরের মৃত্যু আমার হাতে !”
  পরেরদিন সকাল দশটায় ব্লক আধিকারিকের উপস্থিতিতে তানিশার টেলারিংয়ের দোকান উদ্বোধন হয়ে গেলো ।  মিঁয়াগ্রাম বাজারে এই প্রথম মেয়েদের টেলারিং দোকান । যার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো  । কঙ্কাবতী খুশী, কেননা বড় মেয়ের অন্তত নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা হিল্লে হল । 
                 ************************ 
    গাঁয়ের কাকু ষষ্টীকমলকে নিয়ে কঙ্কাবতী পড়েছে মহা ফাঁপরে । মনীষা জানিয়েছিল, বিপাশা নাকি রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় ষষ্টীকমলকাকুর বাসায় যায় এবং সেখানে কিছু সময় দাদুর সাথে কাটায় ।  বিপাশার দাদু অর্থাৎ ষষ্টীকমল বিপাশাকে খুব ভালবাসে । গেলেই লজেন্স, চকলেট এবং আরও ভাল ভাল লোভনীয় খাবার খাওয়ায় । দশ মিনিট মতো দাদুর সঙ্গে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে । এটা নাকি এখন বিপাশার নিত্য রুটিন । কঙ্কাবতীর এতে কোনো আপত্তি ছিল না । ষষ্টীকমলকে  কঙ্কাবতী অনেক আগে থেকেই কাকু সম্বোধনে ডাকে । তেমনি কাকু কঙ্কাবতীর  পারিবারের এবং  ব্যবসার খোঁজখবর নেয় । গাঁয়ের একজন বয়স্ক মানুষ তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছে,  এতে কঙ্কাবতী খুশী । কেননা গাঁয়ে অনেক মানুষের বসবাস, অথচ  ঘুণাক্ষরেও তাঁরা কঙ্কাবতীদের দিকে ফিরেও তাকায় না । সেই নিরিখে ষষ্টীকমলকাকা তাদের পরিবারের একজন হিতাকাক্ষী মানুষ । তাই তাঁকে কঙ্কাবতী শ্রদ্ধা করে । তা ছাড়া তাঁর একমাত্র ছেলে ও বৌ দুইজনেই খুব শিক্ষিত । ছেলেটা সরকারি উচ্চপদে চাকুরিরত  এবং বৌমা রেলওয়েতে কর্মরত । দুইজনেরই শহরে পোস্টিং । খুব সকালে তারা অফিসে বেরিয়ে যায়, আর ফেরে রাত্রিতে । ষষ্টীকমলকাকুর একটাই মেয়ে । তার বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ে জামাই থাকে বেনারসে । ষষ্টীকমলকাকুর গিন্নি আবার বছরের বেশীর ভাগ সময় মেয়ের কাছে থাকে । কারণ মেয়ের সন্তানকে  দেখাশোনা করতে হয় । জামাই বড় মাপের ডাক্তার । মেয়ে সরকারি দপ্তরে আধিকারিক । দায়িত্বপূর্ণ কাজ । ফলে সেখানে কাকীমাকে বাচ্চা আগলাবার জন্য থাকতে হচ্ছে । তাই ছোট মেয়ের কাকুর বাড়ি যাওয়া-আসায় কঙ্কাবতীর  আপত্তি নেই  । 

 কিন্তু মনীষা খবর দিলো, বিপাশা আজকাল ষষ্টীকমলকাকুর বাড়ি বেশী সময় কাটাচ্ছে । এটা চোখে লাগছে । দাদুর সাথে এমন কী কথা,  যার জন্য বিপাশাকে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট কাটাতে হচ্ছে । এটা মনীষার ভাল লাগছে না । তাই মনীষা মাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছে ছোট বোনটার দাদু-প্রীতি কমাতে ।
 ষষ্টীকমলকাকু ভাল সরকারি চাকরি করতেন । শোনা গেছে তিনি প্রচণ্ড ঘুষ খেতেন । সেটা দপ্তরের কয়েকজনের চোখে ভাল লাগে না । তাঁরা ফঁন্দি পেতে ঘুষের টাকা নেওয়াটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে দেন । এমনকি কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা সংস্থা ষষ্টীকমলকাকুকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেন । তারপর যা হওয়ার সেটাই হয়েছে । প্রথমে বিভাগীয় তদন্ত । তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত ! সেই কারণে অবসরের ষাট বছর হওয়ার আগে চাকরি জীবন থেকে তাঁর ছুটি  । এখন তাঁর অবসরকালী জীবন । কিন্তু তিনি যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ । যার জন্য চেহারা ধরে রেখেছেন । কেউ তাঁকে দেখলে বলবে না, তিনি রিটায়ার্ড । 
   স্কুল ছুটি হলে বিপাশা পা টিপে টিপে চুপি চুপি দাদুর ঘরে ঢোকে । দাদু আগেভাগেই বাড়ির সদর দরজা খোলা রাখেন  । বিপাশার স্কুল শুরু হয় সকাল  সাতটায় এবং শেষ হয় বেলা সাড়ে-এগারোটায় । স্কুল থেকে হাঁটা পথে দাদুর বাড়ি পনের মিনিট । তাই বিপাশা সাধারণত দুপুর বারোটা নাগাদ দাদুর বাড়িতে ঢোকে । দাদু তখন সেজেগুজে ফিটফাট । নাতনীর জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন । বিপাশার জন্য নিত্যদিন চকলেট বাধা । এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল রেডি রাখে । ঠিক ঐ সময় দাদুর বাড়ি ফাঁকা । ছেলে-বৌমা তখন অফিসে । সকাল দশটার মধ্যে কাজের মাসি কাজ সেরে চলে যায় । কাকীমা দীর্ঘদিন মেয়ের বাড়ি বেনারসে ।  বাড়িতে তখন দাদু ছাড়া কেউ থাকে না । ফাঁকা বাড়ি পেয়ে বিপাশা মহা আনন্দে সারা বাড়ি ধেইধেই ঘুরে বেড়ায় । 
    ষষ্টীকমলকাকু তখন বিপাশার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন । বিপাশা সদ্য মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে পাঠরত । হাপালো মেয়ে । ডাগর-ডোগর । বিপাশাকে দেখলে মনে হবে সে কলেজে ফাইনাল ইয়ার । সুতরাং বিপাশা যখন এঘর-সেঘর দৌড়-ঝাঁপ করে, তখন তার পুরো শরীরটা নড়াচড়া করে । সেটা দেখতে ষষ্টীকমলকাকুর খুব ভাল লাগে । বিপাশা দাদুর ঐরকম তাকানোতে খুব মজা পায় । এইজন্য অনেক সময় দাদুর ঠিক সামনে স্কিপিং করার মতো লাফায়, আর হাসে । তখন দাদুরও চোখে-মুখে  প্রশান্তির হাসি । 
    বেলা বারোটা পার হয়ে গেলে ষষ্টীকমলবাবু উতলা হয়ে উঠেন । যতক্ষণ বিপাশা ঘরে না ঢুকছে ততক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন । ষষ্টীকমলবাবু নিজেও জানেন না, বিপাশার জন্য  তাঁর মন কেন আনচান করে ?
      মায়ের নীরবতা লক্ষ্য করে মানষী ভাবলো, সে একদিন সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে বিপাশা দাদুর বাড়িতে ঢুকে ঠিক  কী কিরে ? তার এত সময় কাটানোর কারণ কী ? মানষীর ধন্দে কিছুতেই কাটছে না,  দাদুর বাড়িতে যাওয়ার বিপাশার এত উৎসাহ  কেন ? মানষী  সুযোগ বুঝে ষষ্টীকমলদাদুর বাড়ি হানা দেওয়ার অপেক্ষায় রইল । 
                        ******************** 
    এদিকে কঙ্কাবতীর তৃতীয় মেয়ে অনীশা ও অনিন্দ ঠিক করলো, মিঁয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে তারা চায়ের দোকান খুলবে । অনীশা খুব পরিশ্রমী । পড়াশুনায় বেশীদূর এগোতে পারেনি, কিন্তু পরিশ্রম করার ক্ষেত্রে তার কোনো অলসতা নেই । অনিন্দ অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তারা বাপ-বেটী চায়ের দোকান খুলবে । মিঁয়াগ্রামের নাসিরুদ্দিনের দু-কাঠার জমির উপর একটা ভাঙাচোরা ঘর স্টেশনে যাওয়ার রাস্তার উপরেই পড়ে রয়েছে, খানিকটা পরিত্যক্তভাবে ।  নাসিরুদ্দিন সাম্প্রতিককালে তার একমাত্র ছেলের কাছে নিমতিতাতে (মুর্শিদাবাদ জেলা) বাস করছে । ছেলে নিমতিতার একটি নামজাদা হাই স্কুলের শিক্ষক ।  ছেলে একরকম জোর করে নাসিরুদ্দিনকে নিমতিতায় তাদের কাছে নিয়ে  রেখেছে । ফলে ঐ জায়গাটায় তাঁর প্রস্তাবিত দোকান ঘর আর খোলা হয়নি । নাসিরুদ্দিনের ইচ্ছা ছিল ঐ জায়াগায় খাওয়ার রেঁস্তরা খোলার । তবে এই মুহূর্তে জমি সমেত  ভাঙা বাড়িটা নাসিরুদ্দিনের বেচার ইচ্ছা ছিল না । কঙ্কাবতী তাঁকে চেপে ধরায় নাসিরুদ্দিন অমত করতে পারেনি । একরকম জলের দামে জায়গাটা কঙ্কাবতী কিনেছে । এটা কেনার ক্ষেত্রে অনিন্দ মধ্যস্থতা করলে জায়গাটা হাত ছাড়া হয়ে যেতো । জমিটা কেনার প্রতি দৃষ্টি  মিঁয়ার অনেক ব্যবসায়ীর ছিল । তাই অতি সন্তর্পণে সুযোগ বুঝে কঙ্কাবতী সোজা নিমতিতায় হাজির । ট্রেনে পৌঁছে গিয়েছিল কঙ্কাবতী এবং সে একা গিয়েছিল । পাছে জানাজানি হয়ে যায়, এইজন্য বাড়ির কাউকে সঙ্গে নেয়নি । নিমতিতা স্টেশনের কাছাকাছি ভাগীরথী গঙ্গা । সবাই জানে, ভাগীরথী গঙ্গা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে এসেছে । আরও একটা মজার ব্যাপার, নিমতিতার উল্টোদিকে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা । ভাগীরথী গঙ্গা রাজশাহী জেলা দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশে পদ্মা নামে খ্যাত । সেই হিসাবে পদ্মা নদী ভাগীরথীর প্রধান শাখা নদী । সেই নিমতিতায় নাসিরুদ্দিনের ছেলের বাড়িতে বসে জায়াগাটা কেনাবেচা এবং চুক্তিপত্রের কাগজপত্রের কাজকর্ম সম্পন্ন হয় । নাসিরুদ্দিনের সেই জায়গার উপর অনিন্দ ও অনীশা চায়ের দোকান খোলার মনস্থির করলো ।   
                                                              ( ক্রমশ )
Share This
Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ; দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ রায়।

 রাত হচ্ছে । অথচ কঙ্কাবতী বাড়ি ফিরছে না । চঞ্চল হয়ে উঠলো অনিন্দ । কঙ্কাবতী সাধারণত বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার আগে ঘরে ঢোকে । আজ সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে চলল, অথচ তার বাড়ি ফেরার নাম নেই । অনিন্দ বিচলিত হয়ে পড়ল । ঝড়-বৃষ্টি প্রচণ্ড হয়েছে । যদিও বৃষ্টি এখন কমতির দিকে । অথচ কঙ্কাবতীর বাড়ি ফেরার হদিস নেই । উদ্বিগ্ন অনিন্দ ছোট ছেলে ঘোতনকে ডাকলো । 
 ঘোতন বাবার কাছে চটজলদি পৌঁছেই  জিজ্ঞাসা করল, “ডাকছিলে বাবা ?” 
  “মা ফেরেনি । সম্ভবত বৃষ্টিতে আটকে গেছে  । তুই শিগ্‌গির খোঁজ নিয়ে আয় । হরিবল্লভপুরের দিকের রাস্তাটাতে আগে খোঁজ নিবি । কেননা তোর মা সাধারণত সব্জি বিক্রি না হলে হরিবল্লভপুর গাঁয়ে ঢোকে । শিগ্‌গির যা বাবা ।“  বিচলিত অনিন্দ ছোট ছেলেকে মায়ের খোঁজ নিতে বলল ।  
  ঘোতন এদিক-সেদিক না গিয়ে সোজা হরিবল্লভপুরে যাওয়ার রাস্তার  দিকে রওনা দিলো । কেননা বাবার কথাই সঠিক, কাছাকাছি গ্রামে থাকলে বৃষ্টিতে ভিজে মা নিশ্চয় বাড়ি ফিরতো । দ্রত পা চালালো ঘোতন । বেশী রাত্রি হলে ভাঙাচোরা রাস্তায়  হাঁটাচলায় বিপত্তি । একরকম ছুটে এগিয়ে যাচ্ছে ঘোতন । হাঁটতে হাঁটতে  ঘোতন গভীরভাবে নিজের জীবনের বেদনার দিনগুলির কথা  ভাবতে লাগলো । ঘোতন ভাবছে, মা তাকে খুব একটা পছন্দ করে না । তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে । কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আতিয়ার প্রেমে জড়িয়ে পড়ল । আতিয়া শহরের প্রভাবশালী ধনী পরিবারের মেয়ে ।  প্রথটায় ঘোতন বুঝতে পারেনি । আতিয়ার বেশভূষা, চালচলন ছিল অতি সাধারণ ! ঘূণাক্ষরেও ঘোতন টের পায়নি আতিয়া ধনী পরিবারের আদরের একমাত্র কন্যা, যদিও তার দাদা রয়েছে  । আতিয়াও তেমনি, ঘোতনের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার মাঝে কখনও নিজেকে প্রকাশ করেনি । কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় আতিয়ার আসল রূপ প্রকাশ্যে এলো । ততদিনে ঘোতন আতিয়ার ভালবাসায় মোহিত । আতিয়ার প্রেমে হাবুডুবু । 
     অনেকদিন থেকেই ঘোতনের আতিয়ার সাথে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা ! তাই   আতিয়াকে নিয়ে একান্তে ঘুরতে যাওয়ার আবদার ধরলো ঘোতন । গ্রামের দিকে ঘোতনের বাড়ি । কিন্তু কলেজ অনেকটা দূরের শহরে, সালার । ট্রেনে যাতায়াত । কিন্তু আতিয়ার বাড়ি সালারে । তাই ঘোতন চেয়েছিল সালার থেকে বাসে অজয় নদীর তীরে ঘুরতে যেতে । কিন্তু আতিয়া কিছুতেই রাজী হল না । আতিয়ার বক্তব্য, ঘোতনের সাথে ঘুরতে গেলে তার বাড়ির লোকজন তাদের   ভাব-ভালবাসার কথা জেনে ফেলবে । তাতে হিতে বিপরীত হবে । তার চেয়ে বরং যেভাবে তাদের মেলামেশা চলছে চলুক । সময়মতো আতিয়া বাড়িতে ঘোতনের সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসার কথা জানিয়ে দেবে । তখন দুজনে  ঘুরতে যেতে কোনো বাধা থাকবে না ।
 কিছুদিন চুপচাপ । তারপর ঘোতন মনে মনে ভাবছে, ঘুরতে যেতে আতিয়ার আপত্তি উঠলো কেন ? দুজন-দুজনকে ভালবাসে । সুতরাং তারা শুধু নদীর পারে ঘুরতে যাবে । এতে আতিয়ার আপত্তি কেন ? সেই কারণে আতিয়ার আপত্তি অবলোকন করে ঘোতনের মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটলো । ঘোতনের মনে বারংবার একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, আতিয়া কী তাকে সত্যিই ভালবাসে ? তাদের  ভালবাসাটা দুই-একদিনের নয় । পুরো  কলেজ লাইফ তাদের সালার শহরে একসঙ্গে ঘোরাফেরা  । তাদের ঘোরাফেরায় সন্দিহান প্রকাশ করে কলেজের কিছু বন্ধু-বান্ধব ঘোতনকে আতিয়ার থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু সেসব কথার তোয়াক্কা না করে আতিয়ার সঙ্গে ঘোতন প্রেম-ভালবাসা চালিয়ে যাচ্ছে । আতিয়ার প্রতি তার ভালবাসা নির্ভেজাল । তাহলে ঘোতনের সাথে কলেজ কামাই করে ঘুরতে যাওয়াতে আতিয়ার কেন  আপত্তি ? 
  ভাবনা তার অমূলক নয় ! সেটা টের পেলো পরীক্ষার কিছুদিন আগে । কলেজ শেষে খুব খিদে পেয়েছিল ঘোতনের । সকালবেলায় সেরকম কিছু বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে পারেনি । বৌদি তাকে টিফিন বানিয়ে দিতে চেয়েছিল । কিন্তু ঘোতনের টিফিন নিয়ে কলেজে আসতে ঘোরতর আপত্তি । তাই সারাদিন পর কলেজ শেষে তার খুব খিদে !  সালারে তেমন কোনো বড় রেস্টুরেন্ট নেই । তবুও সালামুদ্দিনের রেস্টুরেন্ট তুলনামূলকভাবে ভাল । ভাল না বলে, বলা চলে চলনসই । সেখানে বিকেলবেলায় হরেকরকম খাবার মেলে । সালামুদ্দিনের হাল্কা বয়স । রেস্টুরেন্টে পৌঁছে সালামুদ্দিনকে বলল ডিম দিয়ে চাউমিন বানিয়ে দিতে । ঘোতনের মতে, ডিম চাউমিন সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য । কাঁটা-চামচে করে কিছুটা খেয়েছে, তারপর হঠাৎ রেস্টুরেন্টে আতিয়াকে দেখে অবাক ! আতিয়ার সাথে হাত ধরে ঢুকছে তার বয়ফ্রেণ্ড । পরে নাম জানতে পারলো, পল্লব । 
 ঘোতন এমন ভাব করলো,যেনো আতিয়াকে সে দেখতে পায়নি । 
 ঘোতন মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে এবং আতিয়ার দিকে তাকাচ্ছে । ঘোতন বোঝার চেষ্টা করছে, পল্লবের সাথে আতিয়ার কীরকম সম্পর্ক !  রেস্টুরেন্টে ঢুকে তাদের কী ধরনের খাবার অর্ডার ! কিন্তু ঘোতন কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো, তাকে ইঙ্গিত করে আতিয়া পল্লবকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে । ঘোতন অতশত না ভেবে, চাউমিন খাওয়ায় মন দিলো । ঘোতন আরও ভাবছে, হয় তো আতিয়া তাকে ইঙ্গিত করে তাদের প্রেম-ভালবাসার কথা শোনাচ্ছে । 
 খাওয়া শেষ ! 
 পল্লব ধীরে ধীরে ঘোতনের খুব কাছে এসে বলল, “তুই কী ঘোতন ?”
  “হ্যাঁ, আমি ঘোতন । কী হয়েছে বলুন ?” উত্তর দিলো বটে, কিন্তু পল্লবের কথা বলার ধরন বা শারীরিক ভাষা ঘোতনের কাছে মোটেই সুবিধার লাগলো না । 
  শোনামাত্র পল্লব ঘোতনের জামার কলার চেপে ধরে বিশ্রি আওয়াজ করে বলল, “বড় লোকের মেয়ের সাথে পীড়িত করার শখ, তোকে আমি ঘোচাচ্ছি !  এবার তোকে কে বাঁচায়, দেখবো  ?”
  কিছু বোঝার আগেই পল্লব ঘোতনকে মারতে শুরু করল  । বেধড়ক মার ! 
 প্রথমটায় ঘোতন শুধুই মার খেলো । কিচ্ছু বলল না । তারপর আতিয়ার দিকে তাকিয়ে  লক্ষ করল, ঘোতনকে পল্লবের হাতে মার খাওয়া দেখে দূরে দাঁড়িয়ে আতিয়া মুচকী মুচকী হাসছে । মজা লুটছে ! পল্লবকে ছাড়াবার কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না । বরং মারের দৃশ্য দেখে সে উৎফুল্ল ! আতিয়ার আনন্দোচ্ছ্বাস দেখে ঘোতন অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারলো তাকে হেনস্থা করার আতিয়ার একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত । নিজেকে শক্ত করলো ঘোতন । এতক্ষণ আতিয়ার কথা ভেবে পল্লবকে কিচ্ছু বলেনি । নীরবে মার খেয়েছে, অথচ প্রতিবাদে পল্লবকে কয়েক ঘা দেওয়া তো দূরের কথা তাকে গালি পর্যন্ত দেয়নি । একটাই কারণ, পাছে আতিয়া অসন্তুষ্ট হয় । ঘোতন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না । জোয়ান মর্দ গাঁয়ের খাটিয়া ছেলে । এইসব ছা-পোষা শহরের ছেলেদের কীভাবে টাইট দিতে হয়  ঘোতনের ভালভাবে জানা । ডান হাতের মুঠি দিয়ে কয়েক ঘা মারতেই শুয়ে পড়ল পল্লব । তারপর ডান পায়ের লাথি মেরে তাকে একেবারে আতিয়ার কাছে । এবার ঘর্মাক্ত শরীরে আতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এত নেমক হারাম আগে এতটুকু টের পাইনি । এখন তোমার ছায়া মারাতে ঘৃণা হচ্ছে । ছি  আতিয়া ! শেষে কিনা একটা পঙ্গু ছেলেকে দিয়ে আমাকে মার খাওয়ালে, যার কিনা তোমার হাত ধরার গুণ নেই ?”
“এই পঙ্গু ছেলেটাই আমার আসল বয়-ফ্রেণ্ড ! তুমি কাজটা ভাল করলে না । এর মাশুল তোমাকে গুণতে হবে ।“ আতিয়া শাসালো ঘোতনকে ।
 ঘোতনও তেমনি স্পষ্ট জবাবে বলল, “তোমাদের মতো সুবিধাবাদী কুচক্রী অসভ্য মেয়েদের আমার চেনা আছে । যাদের এতটুকু শারীরিক ক্ষমতা নেই, সেইসব মস্তান দিয়ে আমাকে মারার হুমকি । আমিও ভবিষ্যতে দেখতে চাই, কার এত হিম্মৎ আমার গায়ে হাত তোলে ? এটা আমার চ্যালেঞ্জ !” 
   পরেরদিন সালার স্টেশনে নামতেই আতিয়া ঘোতনকে ডাকলো । 
    কিন্তু আতিয়ার ডাকে সাড়া না দিয়ে ঘোতন আপন মনে স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো ।
  আবার আতিয়া  ডাকলো, “ঘোতন, আমি তোমাকে ডাকছি ?”
  এবার মুখ খুললো ঘোতন । আমাকে ডাকা মানে, তোমার নিত্য নতুন নাগর দিয়ে আমাকে পেটানো । তোমার আসল চরিত্র আমার কাছে পরিষ্কার ! তুমি পরষ্কার করে বলো, “তোমার কতগুলি নাগর  ?” 
   ক্ষেপে গেলো আতিয়া । কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো । তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ঘোতনের কাছে এসে মিষ্টি কন্ঠে বলল, “সেদিনের ঘটনার জন্য আমি খুব দুঃখিত । আমি তোমাকেই ভালবাসি ।“ এই কথা বলার পর আতিয়া ঘোতনের হাত তার বুকের কাছে নিয়ে কী যেনো বলতে চাইছিল, ঠিক সেই সময় আতিয়ার দাদা ফিরিকি এসে হাজির । চিল্লিয়ে ঘোতনকে বলল, “আমার প্রিয় বোনের সঙ্গে বেলেল্লাপনা ।  প্রকাশ্য রাস্তায় বোনের হাত ধরে টানাটানি ।“
      কাঁদো কাঁদো স্বরে ফিরিকির দিকে তাকিয়ে আতিয়া বলল, “দ্যাখ্‌ দাদা । এই বকাটে ছেলেটা কারণে-অকারণে রাস্তার উপরে  আমাকে উত্ত্যক্ত করে । ছেলেটার চরম শাস্তি হওয়া উচিত !”
    আতিয়ার কথা শুনে ফিরিকি তার গুণ্ডাবাহিনীকে অর্ডার দিলো মুহুর্তের মধ্যে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে । 
   ততক্ষণে স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে তারা  রিক্সা স্ট্যাণ্ডে । 
  ইত্যবসরে ফিরিকির গুণ্ডাবাহিনী ঘোতনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন সর্বশক্তি দিতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালালো । অনেক গুলি মস্তান গুণ্ডাবাহিনী  । তাদের ঐক্যবদ্ধ  শক্তির সাথে  এঁটে ওঠতে পারছিল না ঘোতন । হয়রান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ঘোতন । সেই সময় থানা থেকে বিরাট পুলিশ বাহিনী  স্পটে হাজির । পথ চলতি কোনো মানুষ মারামারির ঘটনাটা থানায় রিপোর্ট করে দেওয়ার জন্য বিরাট পুলিশ বাহিনীর আগমন । পুলিশ দেখে ঐ গুণ্ডাবাহিনী ততক্ষণে স্পট থেকে উধাও । 
      কিন্তু পুলিশের কাছে আতিয়া মরা কান্না শুরু করলো । ইনিয়ে-বিনিয়ে পুলিশকে বোঝালো, ইচ্ছার বিরূদ্ধে ঘোতন তার শ্লীলতাহানি করেছে । তারপর  আতিয়া ও ফিরিকির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ঘোতনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে  থানার লক আপে ঢুকিয়ে দিলো । 
      থানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঘোতন আর কলেজ মুখো হয়নি । পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন গুম হয়েছিল ঘোতন । তারপর হঠাৎ একদিন ঘোতনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না । চারিদিকে খোঁজখবর নিয়ে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তার বন্ধু নিতাই এসে খবর দিলো ঘোতন বাড়ির বাইরে গেছে । দুদিন পরে ফিরবে । কীজন্য বাড়ির বাইরে থাকবে, কোথায় থাকবে, নিতাইকে কিচ্ছু জানায়নি  । 
     পরেরদিন সালার থানা ও নিয়ামতপুর থানার পুলিশ, একসঙ্গে বাড়িতে এসে হাজির । বাড়িতে পুলিশ দেখে কঙ্কাবতী ঘাবড়ে গেলো । সরাসরি পুলিশকে জিজ্ঞাসা  কঙ্কাবতীর, “বাড়িতে আপনারা ! তাদের অপরাধ !” 
      “আতিয়া নামে সালারের বড় ব্যবসায়ীর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । মেয়ের দাদার দাবী, আতিয়াকে ঘোতন গায়েব করেছে । এখন বলুন, ঘোতনকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ? আমরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাই ?”
     “ঘোতন এখন বাড়ি নেই । আর শুনুন, আমার ছেলে ঐ রকম জঘন্য কাজ কখনই করতে পারে না ।“ জোর গলায় কঙ্কাবতী পুলিশকে জানিয়ে দিলো । 
    পুলিশ সম্ভবত নিয়ামতপুর থানায় ফিরে গেলো । নিয়ামতপুর থানা থেকে সালার থানা কাছে । তাই দুই থানার পুলিশ একযোগে আতিয়ার তল্লাশি চালাচ্ছে ।
  অন্যদিকে ঘোতন আচমকা এবং অনেক কসরত করে  আতিয়াকে তুলে নিয়ে সোজা সুন্দরবনের একটা অপরিচিত রিসোর্টে উঠলো । রাস্তায় আতিয়াকে এমনভাবে ধমকালো, কোনোরকম পালাবার ট্যাঁ-ফোঁ করলে তার বিপদ অনিবার্য । এমনকি আতিয়াকে বশে আনতে তার পিঠে দুই এক ঘা চড়-থাপ্পড় মারতে হয়েছিল । তারা দুইজন একঘরে দুটো রাত কাটাবার পর ঘোতন আতিয়াকে বুঝিয়ে দিলো, চালাকিতে গ্রামের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও  ঘোতন কোনো অংশে কম নয় । আতিয়াকে বড্ড বেশী ভালবাসে, তাই ঘোতন দয়াবশত আতিয়ায়াকে নিষ্কলুষ অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছে । সুযোগ পেয়েও ভালবাসার মানুষকে সে কখনও কলঙ্কিত করতে চায় না । এখানেই তাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ঘোতনের জীবন আলাদা । 
  আতিয়া ঘোতনের চরিত্র সম্বন্ধে ষোলআনা ওয়াকিবহাল । তাই কাঁদতে কাঁদতে ঘোতনকে আতিয়া বলতে বাধ্য হল, “সে পল্লবের ফাঁদে পড়ে গেছে । সেখান থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই ! তাই ঘোতনকে তার জীবন থেকে সরাতে নাটক করতে বাধ্য হয়েছিল ।“ 
  তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, ঘোতন আতিয়ার খোঁজ নেয়নি । বাড়িতেই চুপচাপ দিন কাটছে  । তবে ইদানীং ঘোতনের কথাবার্তার অনেক পরিবর্তন । কেউ কিছু কটু কথা বললে, চাঁছাছোলা ভাষায় উত্তর দিয়ে দেয় । হাটে-বাজারে তার সাথে নিত্য গণ্ডগোল । একদিন মুদিখানার দোকানদার হাসিচ্ছলে বলেছিল, তুমি নাকি নারী ঘটিত কারণে পুলিশ হেপাজতে জেল খেটেছো ?”
  ঘোতন মুদিখানার দোকানদারকে সোজা থাপ্পড় । জামার কলার ধরে বলেছিল, আর যদি এইরকম কথা ফের শুনি তোমার টুঁটি টেনে ছিঁড়ে দেবো । আজ থেকে জেনে রাখবি, “আমি ঘোতন । বেশী ট্যাঁ-ফোঁ করেছিস, তো মরেছিস ।“ 
  ঘোতনের রক্তচক্ষুর খবর চারিদিকে রটে যাওয়ার পর, এলাকার মানুষ ঘোতনকে সমীহ করে চলতে লাগলো । মারপিটে ওস্তাদ । ঘোতনের মারকুটে স্বভাব অবলোকন করে গাঁয়ের বয়স্ক মানুষেরা হতাশ । তাঁদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন, ভাল ছেলেটার এরকম কেন অবনতি ? বাড়িতে অনিন্দ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, তার ছোট ছেলেটার দ্বারা কাজকর্ম কিচ্ছু হচ্ছে না । উপার্জনের পথ না খুঁজলে ভবিষ্যতে খাবে কী ?  যার জন্য কঙ্কাবতীও চিন্তিত । কাজকর্ম না করার জন্য ঘোতন মায়ের কাছে অহরহ বকা খাচ্ছে । তবুও কাজকর্ম করার ব্যাপারে ঘোতনের  হেলদোল নেই । কঙ্কাবতী এমন কথা পর্যন্ত তার ছেলেকে বলল, কিছু করতে না পারলে ভ্যান রিক্সায় মাল টানলে সারাদিনের শেষে যা মজুরী জুটবে তাতে সংসারের সুরাহা হবে ।  
                          *************************** 
   ঘোতন  খুব দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে । লম্বা চওড়া তাগড়াই চেহারার অল্প বয়সী যুবক, ঘোতন । তাই তার হাঁটার গতি সাংঘাতিক । রাতের অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে । ঘোতন চিন্তা করল, বেশী রাত হলে মায়ের বাড়ি ফিরতে কষ্ট হবে । তা ছাড়া ভ্যান রিক্সা তার টানা ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে । সেই সকালে দুটো খেয়ে কাজে বের হয়েছে । সারাদিন নিশ্চয় খাওয়া হয়নি । এদিকে মা বাড়ি না থাকলে বড় বৌদি সবাইকে আদর যত্ন করে খাওয়ায় । বলা চলে বড় বৌদি মায়ের ভূমিকা নেয় । কিন্তু মায়ের তো সারাদিন খাওয়া হয়নি । সংসারের সচ্ছলতার কথা ভেবে মায়ের রাত দিন খাটা । আবার ঘোতন উল্টে আবার  নিজের কথাও  ভাবছে, সে একজন জোয়ান মরদ ছেলে । অথচ উপার্জনের এক ফোঁটা তার নিজের মুরদ নেই । এইসব কথা ভাবতে ভাবতে, বিদ্যুতের চমকানো আলোতে ঘোতন দেখতে পেলো তার মায়ের ভ্যান রিক্সাটি রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে । অথচ মাকে দেখতে পাচ্ছে না । ঘোতনের মনটা অজানা আশঙ্কায় চমকে উঠল । তাহলে মায়ের কী কোনো বিপদ ! 
   রাস্তার আশপাশে তাকাচ্ছে ঘোতন । মাকে দেখতে না পেয়ে ঘোতনের চিৎকার, “মা তুমি কোথায় ?” রাস্তা সুনসান । আকাশে মেঘের আনাগোনা । কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেছে । ঝড়ো হাওয়া নেই । তবে চারিদিক অন্ধকার । ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার । তারপর বিদ্যুত চমকানোর সাথে সাথে ঘোতন দেখতে পেলো, রাস্তার একটু নীচে জঙ্গলা গাছের ডালে একটা শাড়ি ঝুলছে । এবার ঘোতনের কাছে পরিষ্কার, নিশ্চয় মা পড়ে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছে । তাড়াতাড়ি ছুটলো সেখানে । 
    সেখানে গিয়ে ঘোতনের চক্ষু চড়কগাছ ! মায়ের মুখ বাঁধা । রক্ষিতবাবু মাকে জাপটে ধরে রয়েছে । অন্যদিকে রক্ষিতবাবুর কব্জা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কঙ্কাবতীর মরিয়া প্রয়াস । কিন্তু শয়তান রক্ষিতবাবুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না । ঐ দৃশ্য দেখে ঘোতনের মাথায় রক্ত উঠে গেলো । কালবিলম্ব না করে এক ঝটকায় ভ্যান রিক্সার হ্যাণ্ডেল খুলে নিয়ে সোজা রক্ষিতবাবুর মাথায় আঘাত ! পিঠে আঘাত ! পায়ে আঘাত ! রক্ষিতবাবু যন্ত্রণায় চিল্লাচ্ছে ! ছটফট করছে । কঙ্কাবতী ঘোতনকে বাধা দিলো । লোকটা মরে গেলে আরও বিপদ  । রক্ষিতবাবুকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে মা-বেটা ছুটলো বাড়ির দিকে । অন্যদিকে কঙ্কাবতীকে খোঁজার জন্য অনিন্দ টর্চ নিয়ে হরিবল্লভপুর রাস্তার দিকেই হাঁটছিল । তারপর বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোতন বাড়ি ঢুকলো ।   
      শুয়ে রয়েছে কঙ্কাবতী । সারাদিনের ধকলের জন্য কঙ্কাবতী গভীর ঘুমে বিভোর । অন্যদিকে ঘোতনের ঘুম আসছে না । মায়ের দুঃসহ অবস্থা দেখে ঘোতন চিন্তান্বিত । মায়ের মতো মানুষের যদি ঐরকম অসহায়তার মধ্যে পড়তে হয় তাহলে তার অল্প বয়সী বোনদের অবস্থা কী দাঁড়াবে । মা এমনিতেই খুব সাহসী । তার ভয়ডর  কম । তবুও তার অসহায়তার চরম পর্যায় দেখে ঘোতন ঘোর চিন্তান্বিত । এইসব ওলট-পালট ভাবনাতে ঘোতন আছন্ন । যার জন্য তার ঘুম আসছে না । ঘড়িতে তখন রাত দুটো । 
     হঠাৎ দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ ! 
    “এত রাত্রিতে আবার কে  ?”  প্রশ্ন জাগলো ঘোতনের মনে ।
     বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছিলো ঘোতন । কিন্তু কঙ্কাবতী দরজা নাড়ার শব্দে ঘুম থেকে উঠে ঘোতনকে বলল, “তুই ঘরে ঢোক । আমি দেখছি কে এলো ?” কঙ্কাবতীর মনে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত কু-গাইছিল, “রক্ষিতবাবু নিশ্চয় বদলা নিতে দলবল নিয়ে বাড়িতে হামলা করবে ।“ তাই বারংবার ভাবছে, “নচ্ছারটা নিশ্চয় বাড়ি এসে এখন হাজির ।“
   দরজা খুলতেই পুলিশ । পুলিশ বাড়ি ঢুকেই বাড়ির সমস্ত ঘর তল্লাশি শুরু করল । ঘোতনকে হাতেনাতে ধরে হাতকড়া পড়িয়ে দিলো । থানার বড়বাবু কঙ্কাবতীকে বললেন, “আপনার ছেলে বিনা কারণে পঞ্চায়েত রক্ষিতবাবুকে বেধড়ক মেরেছে ! যার জন্য তিনি হাসপাতালে শয্যাশায়ী । মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন । পঞ্চায়েতকে অকারণে মারার জন্য আমরা আপনার ছেলেকে অ্যারেস্ট করলাম ।“
  “আমার ছেলে রক্ষিতবাবুকে মেরেছে তার প্রমাণ ?” কঙ্কাবতী পাল্টা প্রশ্ন করলো থানার বড়বাবুকে ।
  পেছন থেকে চড়ুইডাঙার মাতবর নকড়ি ও পল্লীদহ গ্রামের  সুখহরি মোড়ল এগিয়ে এসে পুলিশের  সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা চাক্ষুষ দেখেছি । আমরা তার  প্রত্যক্ষদর্শী  ।“ 
    এবার থানার বড়বাবু ধমকের সুরে বললেন, “আপনার যা কিছু বলার কোর্টে বলবেন । আমরা কাল সকালেই আপনার ছেলেকে কোর্টে চালান করে দেবো । সুতরাং আপনার যা সওয়াল করার কোর্টে গিয়ে করবেন ।“ 
  ঘোতনের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে পুলিশ তাকে প্রিজন ভ্যানে তুললো । তারপর পুলিশ  ছুটলো নিয়ামতপুর থানায় । চালাক কঙ্কাবতী খুব সহজে বুঝতে পারলো, ঐ দুজনকে টাকা দিয়ে রক্ষিতবাবু সাক্ষী বানিয়েছে । যার জন্য তাঁদের এখন ঘোতনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে সাহস ! মোড়লদের কাণ্ডকারখানা দেখে রাগে জ্বলছে  কঙ্কাবতী  । এদিকে  কঙ্কাবতীর মেয়েগুলি মার কাছে বায়না ধরলো, দাদাকে ছাড়িয়ে আনতে । দাদাকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বোনদের চোখে জল । বড় বৌমা হাঁ করে তাকিয়ে অবস্থার প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করছে । অনিন্দের দিকে তাকিয়ে কঙ্কাবতী বলল, এখন ঘুমোতে গেলে চলবে না । ঘোতনকে কীভাবে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে । নতুবা ছেলেটাকে কোর্টে চালান করে দিলে ঘোতনকে ছাড়ানো ভীষণ সমস্যা হবে ।  
    ভোর হতে দেরী নেই । ইতিমধ্যে  বিভিন্ন ধরনের পাখির ডাক শুরু হয়ে গেছে । পূর্বদিকে রক্তিম আভা । গোয়ালা দুধের ক্যান নিয়ে গাঁয়ে ছোটাছুটি করছে । খুব ভোরে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে গাঁয়ের চাষীরা মাঠে ছুটছে ।  গৃহবধূরা উঠোনে গবর দিচ্ছে । তার মধ্যে  দিয়ে কঙ্কাবতী ও অনিন্দ পায়ে হেঁটে চললো মিঁয়া হল্ট স্টেশনের নিকট মিঁয়াগ্রামে ।  সেখানে নটহরি উকিলের কাছে । নটহরি উকিলের যথেষ্ট নামডাক । সকাল ন’টার ট্রেনে কোর্টে বেরিয়ে যান ।  নটহরি উকিলকে কঙ্কাবতী ভাল চেনে । কঙ্কাবতীর কাছ থেকে উকিলবাবুর বাড়ির জন্য উকিলবাবুর গিন্নি নিয়মিত সব্জি কেনেন । তাই উকিলবাবুকে বাড়িতে ধরার জন্য তাদের তাড়াহুড়ো ।     
 বাড়ি পৌঁছে দেখে উকিলবাবু কুড়ুল দিয়ে গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ চেরাচ্ছে । কাঠের ফালি জ্বালানীর জন্য ভীষণ উপযুক্ত । কঙ্কাবতী কৌতুহলবশত উকিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি নিজে কেন কাঠ চেরাচ্ছেন  ?” 
  “কঙ্কাবতী, কুড়ুল দিয়ে গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ চেরানো একদিকে শরীর চর্চা, অন্যদিকে রান্নার  জ্বালানীর কাঠ রেডি করা । মাত্র এক ঘন্টার কাজ !” হেসে হেসে কঙ্কাবতীর কথার উত্তর দিলেন । তারপর কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এত সকালে তোমরা কী মনে করে ?”
    “দাদা আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে ।“ বলেই কঙ্কাবতী কাঁদতে লাগলো । 
   আহা ! না কেঁদে ঘটনাটা খুলে সবিস্তারে বলো ?
   “চেম্বারে চলুন বলছি ।“ কঙ্কাবতী উকিলবাবুকে ঘরের চেম্বারে যেতে বলল । 
   নটহরি উকিলবাবু হাতমুখ ধুয়ে চেম্বারে এসে বসলেন ।  
   কঙ্কাবতী তার সব্জি বিক্রি, হরিবল্লভপুর যাওয়ার সময় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়লে রক্ষিতবাবুর আগমন,  রক্ষিতবাবু তার সঙ্গে কীরকম আচরণ করেছিলেন, সমস্ত কিছু সবিস্তারে উকিলবাবুকে জানালো । উকিলবাবুকে জানানোর পরে তাঁর পায়ে ধরে বলল, “স্যার, আমার ছেলেটাকে থানা থেকে জামিনে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুন ।“ 
  “ঘাবড়াবে না কঙ্কাবতী । আমি দেখছি । তবে তোমরা ঠিক সময় মতো আমার কাছে এসেছো, নতুবা ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে চলে যেতো ।“ উকিলবাবু কঙ্কাবতীদের আশ্বস্ত করলেন । 
   জামিনে থানা থেকে ছাড়া পেলো ঘোতন । তারপর থেকে ঘোতনের ব্যবহার, চালচলন স্বাভাবিক ছন্দ থেকে একটু অন্যরকম !  চোখে মুখে অহরহ বিরক্তির ছাপ । তার হৃদয়ের ভিতরে অনেক রাগ । কঙ্কাবতীর ধারণা, আতিয়ার কাছ থেকে প্রত্যাখানের ধাক্কা এবং মায়ের সঙ্গে রক্ষিতবাবুর ঐরূপ আচরণ দেখে, ঘোতন অপ্রসন্ন । সব কিছুতেই বিরাগভাজন । তবুও কঙ্কাবতীর আশা, কিছুদিন কেটে গেলে ঘোতন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে । কিন্তু কঙ্কাবতীর আশার গুড়ে বালি । ঘোতন যে কে তাই । বরং আরও ক্রমশ ডানপিটে হয়ে উঠছে । 
                                                          (ক্রমশ)
Share This
Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস :(ধারাবাহিক উপন্যাস; প্রথম পর্ব) : দিলীপ রায়।

 গাঁয়ের নাম চড়ুইডাঙা । তারপর একটু থেমে কঙ্কাবতী বলল,পোস্ট অফিসের নাম শিলাইদহ, থানা-নিয়ামতপুর,  জেলা – মুর্শিদাবাদ । এবার আমার ভাতার টাকাটা দিন ?
   এখানে টিপসই  দিন ?
  “আমি টিপসই  দেওয়া পছন্দ করি না ।“  তারপর টেবিলের উল্টোদিকে বসা ষণ্ডা মার্কা চেহারার লোকটার হাত থেকে কলমটা একরকম  ছিনিয়ে নিয়ে খাতায় স্বাক্ষর  করে দিলো । সই করার সময় কঙ্কাবতী নিজের চোখে দেখতে পেলো, তার নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা  । রেজিস্টারে লেখা দেখে কঙ্কাবতী নিশ্চিত,  “নারী ভাতা বাবদ সে এক হাজার টাকা পাচ্ছে !” 
  ষণ্ডা মার্কা  লোকটা কঙ্কাবতীর হাতে আটশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে লাইনে দাঁড়ানো অপরজনকে ডাকল ।
  টাকা গণনা করার পর কঙ্কাবতির চোখ চড়কগাছ ! দুশো টাকা কম ! সঙ্গে সঙ্গে চোখ গরম করে কঙ্কাবতী কৈফয়িৎ চাইল, “হিতেনদা, আমি আটশ টাকা পেয়েছি ! এখনও দুশো টাকা বাকী ।“
   ঐ টাকাই তোমার প্রাপ্য ।
   “মানে, আপনি কী বলতে চাইছেন । আমি দুশো টাকা কম নিয়ে বাড়ি যাবো ? পুরো এক হাজার টাকা আমাকে বুঝিয়ে দিন । নতুবা আমি এখান থেকে নড়ছি না ।“ কঙ্কাবতী নাছোড়বান্দা !  
  আচ্ছা জ্বালাতন দেখছি ? তুমি আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছো ? আমাদের কাজে বাধা  দিলে আমরা তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবো ?
  হিম্মৎ থাকলে আমাকে টাকা বুঝিয়ে না দিয়ে এখান থেকে সরান, তবে বুঝবো আপনাদের গুণ্ডামির শক্তি ?
 তুমি কী আমাদের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছো ? 
 আমার বাকী দুশো টাকা না দিলে ঠিক তাই,  আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি ?
 হঠাৎ হিতেনের একজন সাগরেদ কঙ্কাবতীর ডান হাত হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিল্লিয়ে অসভ্য ভাষায় বলল, “পালাবি ? না পালালে তোর কী হবে জানিস ? কেউ তোকে বাঁচাতে আসবে না ?”
   হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কঙ্কাবতী চিল্লিয়ে বলল, “আমি না পালালে কী হবে তুই আগে সেই কথা শোনা, তারপর আমি কী করব সেটা শোনাচ্ছি !”  
   “তোর মেয়েদের তুলে নিয়ে জঙ্গলে ফুর্তি করবো ।“  
  শোনা মাত্র কঙ্কাবতী পায়ের চটি খুলে হিতেনের সাগরেদের গালে সজোরে কয়েক ঘা এমনভাবে মারলো, মারের আঘাতে বেচারা মাটিতে গড়াগড়ি ! 
  উপস্থিত সমস্ত মহিলারা একজোট হয়ে হিতেনের সাগরেদকে টাইট দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল । এতক্ষণ তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে কথা কাটাকাটির দৃশ্য দেখছিল আর প্রমাদ গুণছিল, কখন তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে সামিল হবে ! হিতেনের গুন্ডামি তারা মেনে নিতে পারছিল না । কিন্তু সাহস করে হিতেনের গুন্ডামির যোগ্য জবাবও দিতে পারছিল না । তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ।   সুযোগ পেয়ে অন্যান্য মহিলারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল । তারা রীতিমতো টাকা ফেরতের জন্য সোচ্চার ! 
  অবস্থা বেগতিক বুঝে হিতেন স্পটে এসে সমস্ত মহিলাদের উদ্দেশে হাত জোড় করে বলল, “যারা টাকা কম পেয়েছেন, ফেরত নিয়ে যান ।“ 
  চড়ুইডাঙার বিনোদের মা এগিয়ে এসে কঙ্কাবতীকে পরামর্শ দিলেন, “রাত্রিতে সাবধানে থেকো । হিতেন একজন অসভ্য ও  নোংরা মনের মানুষ । এলাকার মানুষের অনেক ক্ষতি  করেছে  । রাস্তা থেকে বয়স্থা মেয়েদের তুলে  তাদের ইজ্জ্বত নিয়ে মজা করা তার এক ধরনের আনন্দ । রাজনৈতিক দলের ও কিছু মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় থাকার জন্য এহেন জঘন্য কাজ করেও সে পার পেয়ে যাচ্ছে । কেউ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না । এমনকি ভুক্তভোগী মেয়েদের অভিভাবকেরাও না !  সুতরাং তোমাকে তারা সহজে ছেড়ে দেবে না !” বিনোদের মা আরও জোর দিয়ে বললেন, “বদলা হিতেন নেবেই ।“ 
  কঙ্কাবতীর দুঃসাহস  যথেষ্ট । সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মহিলা না । ইতিপূর্বে  তার নিজের মেয়েদের চলাফেরার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা কঙ্কাবতীকে শক্ত হাতে সামলাতে হয়েছে । তাই বিনোদের মাকে কঙ্কাবতী অভয় দিয়ে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না । হারামজাদাগুলোকে কীভাবে টাইট দিতে হয়, সেই কৌশল আমার জানা আছে । তা ছাড়া হারামজাদাগুলো আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না । গুণ্ডামি করে আমাদের হকের টাকা মারবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না । সেইজন্য আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না । তবে এটা ঠিক, হিতেনের সাগরেদকে গণধোলাই দেওয়ার জন্য আমরা  টাকাটা ফেরত পেলাম । নতুবা এতগুলি টাকা গায়েব করে দিতো ।“
  বাড়ি ফিরতে কঙ্কাবতীর সন্ধ্যা । 
 বাড়ি ফিরে লক্ষ করলো  তার ছোট মেয়ে বিপাশা হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিয়েছে । কঙ্কাবতীর হাতে মুরগির মাংস । ছোট মেয়ের উদ্দেশে কঙ্কাবতি বলল, “আজ রাত্রিতে মাংস ভাত হবে ।“ কঙ্কাবতীর ছোট মেয়ে সর্বদা মায়ের ন্যাওটা । মায়ের কাজে হাত লাগাতে সে সর্বদা চনমনে । 
  মাংস-ভাতের কথা শুনে কঙ্কাবতীর ছেলেমেয়েরা খুশীতে টগবগ ।
  ঘর থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল মুখে কঙ্কাবতীকে অনিন্দ বলল, “মাংস আনার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।“  
 কঙ্কাবতীর ভরা সংসার । তার নিজের বয়স অনেক । কিন্তু চেহারাখানা তার চৌকশ । যেমন এক মাথা চুল । তেমনি তার শারীরিক গঠন । তার চেহারা বা চালচলন দেখলে কেউ বলতে সাহস পাবে না, কঙ্কাবতী ছয় সন্তানের জননী । তাক লাগানো চেহারা । যে কোনো বয়সের পুরুষের চোখে পড়ার মতো তার শরীর-গতর । হৃষ্টপুষ্ট শারীরিক স্থিতি । লম্বা যেমনি, তেমনি তার তাগড়াই চেহারা । চলাফেরায় সাবলীল । কিছুটা স্বাধীনচেতা ।  ভয়ডর খুব কম । অল্প বয়সের ছেলেপুলে তাকে উত্ত্যক্ত করলে, সোজা  কান ধরে শুনিয়ে দেয়, “সে তার মায়ের বয়সী ।“  কিন্তু কঙ্কাবতী পড়াশুনায় নবডঙ্কা ! অষ্টম শ্রণী পর্যন্ত ।  অল্প বয়সে অনিন্দের সঙ্গে বিয়ে ।  তারপর প্রথম দুটি ছেলে এবং পরপর চারটি মেয়ে । দুজন ছেলে হচ্ছে – যথাক্রমে রূপন ও ঘোতন । বড় মেয়ে তানিশা, মেজ মনীষা, সেজ অনীশা ও ছোট বিপাশা । বড় ছেলে তেমন লেখাপড়া শেখেনি । যার জন্য সংসারের কাজে বড় ছেলে নিয়োজিত । ছোট ছেলে ঘোতন ।  গাঁয়ে ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় তার অবাধ ঘোরাঘুরি । ঘোতনকে এলাকায় সবাই চেনে । বিনা কারণে যেখানে-সেখানে ঘোতনের অবাধ বিচরণ, অনিন্দের  একেবারেই অপছন্দ । 
  চার মেয়েই ডাগর-ডোগর । কঙ্কাবতীর চার মেয়ের চরিত্র চার রকমের । 
  অনিন্দের উপার্জনের জায়গাটা শক্তপোক্ত নয়, নড়বড়ে । ট্রেনের হকারি । আর মাঠে আট বিঘে চাষের জমি । তা ছাড়া অনিন্দ শারীরিকভাবে দুর্বল । নানান অসুখে জর্জরিত । যার জন্য উপার্জনের কথা মাথায় রেখে কঙ্কাবতীকে বেশীর ভাগ সময় ভ্যান রিক্সায় সব্জি বিক্রি করতে গাঁয়ে বের হতে হয় । পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে তার সব্জি বিক্রি । সব খরচা বাদ দিয়ে দিনে মোটামুটি  চারশ টাকা থাকে । বিয়ের প্রথম দিকে তাকে সংসারের খরচা নিয়ে ভাবতে হত না । অনিন্দ সব দিক সামলাতো । কিন্তু পরবর্তীতে কঠিন ব্যামোতে পড়েছিল অনিন্দ, যেখানে ছিল  জীবন-মরণের প্রশ্ন । ডাক্তারের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই  সময় অনিন্দ প্রাণে বেঁচে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল । তখনই ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, অনিন্দকে দিয়ে পরিশ্রমের কাজ আর করানো যাবে না । সেই থেকে অনিন্দ ট্রেনের হকার । হকারিতে আয় খুব কম । অথচ বাড়িতে বড় বড় ছেলে মেয়ে । নিষ্কর্মার ঢেঁকি । অথচ  তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচা এখন ঊর্ধ্বগতি । 
 পড়াশুনায় কেউ আগ্রহী না । শুধুমাত্র ছোট মেয়ে বিপাশা স্কুলে যাচ্ছে । সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা ! বড় ছেলে রূপন বাবার অসুখের জন্য বেশীদূর পড়াশুনা করতে পারেনি । ঘোতন কলেজে উঠে নানান অশান্তিতে জড়িয়ে পড়ে ।  স্নাতক ডিগ্রি তার কপালে জোটেনি । রূপন বিবাহিত । রূপনকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে । রূপনের একটি ছেলে । রূপন এখন ঘোর সংসারী । মাঠে চাষবাস নিয়ে থাকে । রূপনের চেষ্টায় মাঠে এখন চাষের জমি বারো বিঘা । জমিতে শুধুমাত্র ধান চাষ । ফলে বছরের খাওয়ার চাল, চাষের জমি থেকে উঠে আসে । সংসার খরচের নগদ টাকার জন্য কঙ্কাবতীর নিরলস কসরত । 
   রূপন সাদামাটা মানুষ । মাঠের জমিতে চাষ-আবাদ ছাড়া গাঁয়ের কোনো সাতেপাঁচে থাকে না । রূপনের বৌ তেমনি । ঘর সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে  সামলায় । চারটে ননদ । কখনও সংসারের কাজে ননদদের বিরক্ত করে না । মুখ বুজে হেঁশেল সামলায় । তাই কঙ্কাবতী গাঁয়ের মানুষদের অহরহ বলে, “অনেক ভাগ্য করে আমরা বৌমা পেয়েছি যে কিনা পুরোপুরি ঘর সংসারী । ঘরের সমস্ত কাজ নিজে হাতে সামলায় ।“  বড় বৌমার প্রশংসা প্রসঙ্গে অনিন্দ আরও একটু বাড়িয়ে বলে, “তার বড় বৌমা বাড়ির লক্ষ্মী । শত খুঁজলেও দ্বিতীয়টি মেলা ভার !” 
  কঙ্কাবতীর হয়েছে জ্বালা ! নিজের তাগড়াই চেহারা । দৈহিক চাহিদা অত্যধিক বেশী । কিন্তু ঘরের হাঁদারাম মরদটা অকর্মার ঢেঁকি ! তবুও তার হা-পিত্যেশ নেই । ছোঁকছোঁক বাতিক নেই । গায়ে পড়ে কেউ ভাব জমাতে এলে, কঙ্কাবতীর হুমকি খেয়ে তারা পালিয়ে বাঁচে । কাউকে ডরায় না । রাতে অনিন্দের সাথে এক বিছানায় শুয়ে শান্তি না থাকায় খুব ভোরে কাজে বের হয়ে যায় । চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে স্টেশন অনেকটা দূর ! পায়ে হাঁটা রাস্তা । স্টেশন বলা ভুল, হল্ট । মিয়াগ্রাম হল্ট । ভোরের প্রথম ট্রেন ধরে সোজা সালার স্টেশন । সেখান থেকে পাইকারি দরে সব্জি কিনে পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরতে প্রায় সকাল আটটা । তারপর সেদ্ধ-ভাত খেয়ে ভ্যানে সব্জিগুলি সাজিয়ে গাঁয়ে বের হয় বিক্রি করার জন্যে ।  এগ্রাম-সেগ্রাম ঘুরে সব্জি বিক্রি । তাই বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায় ।  বাড়ি ফিরে বৌমার সাথে গাল-গপ্প । মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাসা ! গেরস্থালির কাজ । এসবের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । তবুও ধরাবাঁধা রুটিনের বাইরে কয়েকটা অঘটন তার জীবনে ঘটে গেছে, যেটা ভাবলে তার গা শিউরে উঠে  !  গায়ে কাঁটা দেয় ! 
  সেটা বৈশাখ মাসের সংক্রান্তি  ।
  কঙ্কাবতীর সব্জি বিক্রি প্রায় শেষ । আর কিছুটা সব্জি অবশিষ্ট রয়েছে । বিশেষ করে বেগুন, কলমি শাক, ঢেঁড়শ, পটল, একফালি কুমড়ো, টমাটো, কাঁচা লঙ্কা, ইত্যাদি ।  তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে ।  পাশের গ্রাম হরিবল্লভপুর । কঙ্কাবতী যে গাঁয়ে সব্জি বিক্রি করছিল, সেই গ্রাম থেকে হরিবল্লভপুর যেতে খানিকটা হাঁটা পথ ! তবে মাটির রাস্তা কিন্তু অনেকটা প্রশস্ত । ঐ রাস্তায় গরুর গাড়ির আনাগোনা বেশী ।  ভ্যান নিয়ে কঙ্কাবতী হরিবল্লভপুরের দিকে এগোচ্ছে । তার ধারণা, হরিবল্লভপুরে গেলে তার সমস্ত সব্জি বিক্রি হয়ে যাবে ।  এতগুলি সব্জি অবিক্রি অবস্থায় বাড়িতে ফেরত নিয়ে গেলে তার লোকসান । কেননা, সব্জিগুলি গরমে প্রায় শুকিয়ে গেছে । পরেরদিন ঐগুলি বিক্রি করা কঠিন । অবশেষে সব্জিগুলি জঙ্গলে ফেলে দেওয়া  ছাড়া উপায় থাকবে  না । তাই ছুটলো হরিবল্লভপুর গ্রামের দিকে । রাস্তা ধরে এগোচ্ছে । এমন সময় আকাশে কালো মেঘ । হঠাৎ মেঘ ।  নিমেষের মধ্যে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেলো । হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে কঙ্কাবতীর  অর্ধেক রাস্তা তখনও বাকী । ঝড়ের পূর্বাভাস ! ভ্যান নিয়ে জোরে পা চালায় কঙ্কাবতী । 
  শুরু হল বিদ্যুৎ চমকানো । আর প্রচণ্ড ঝড় । কঙ্কাবতীর মতে,  নিঃসন্দেহে ঘূর্ণিঝড় ! লাগামছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ওলট-পালট অবস্থা । আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা । কালো মেঘ, তার উপর মেঘের গর্জনের দাপট ! অচিরেই  চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো । তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, অথচ চারিদিকে অন্ধকার । ঝড়ের তীব্রতায় রাস্তা দিয়ে হাঁটা দায় ! ঝড়ের গতিবেগ এতটাই বেশী, যার জন্য ভ্যান রিক্সা ঠেলতে পারছে না কঙ্কাবতী । ঝড়ের দাপটে নিজেকে সামলানোও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে কঙ্কাবতীর পক্ষে । তার উপর ভ্যান রিক্সা  সামলানো  ! ঝড়ের সো-সো শব্দ ! ক্ষমতাশালী প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড ! রাস্তায় একটা লোক নেই । চারিদিক সুনসান  ।  এই রাস্তা দিয়ে সাধারণত মানুষের যাতায়াত খুব কম । হরিবল্লভপুরের মানুষ পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে অভ্যস্ত । এই রাস্তাটা খুব একটা কাজে লাগে না । যার জন্য রাস্তাটার কোনো সংস্কার নেই । এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা । মাঠের ফসল তোলার সময় গরুর গাড়ির যাতায়াত যথেষ্ট । যার জন্য রাস্তাটা খানাখন্দে ভর্তি । প্রলয়ংকর ঘূর্ণীঝড়ে কঙ্কাবতীর ভ্যান রিক্সার উপরের সব্জি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি । এবার সে ভ্যান রিক্সা আর ঠেলতে পারছে না । অন্যদিকে পরনের শাড়ি ঠিক রাখতে পারছে না । ঝড়ো হাওয়ায় বুকের উপর থেকে অনেকক্ষণ আগেই শাড়ি উধাও । ঝড়ের তাণ্ডবে সে নিজেকে বাঁচাতে তটস্থ ! তার উপর ভ্যান রিক্সা আগলানো । এসবের মাঝে তার পরনের শাড়ি সামলানোর পরস্থিতি নেই । 
    শুরু হল ঘূর্ণিঝড়ের সাথে ভারী বৃষ্টি ! ঝড়ের ধ্বংসলীলায় চারিদিকে গাছগাছালি ভেঙ্গে  পর্যুদস্ত । সামনে রাস্তার উপরে কাটাজাতীয় একটি বাবলা গাছ  পড়ে থাকতে দেখলো । কঙ্কাবতী কোনোরকমে গাছটা সরিয়ে এগিয়ে গেলো ।  এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই । হরিবল্লভপুর গাঁয়ে ঢুকে তবে রেহাই । কিন্তু হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে এখনও অনেকটা দূর ! ঢেলে বৃষ্টি । বৃষ্টিতে কঙ্কাবতীর শরীর   ভিজে একশা ! 
   ঝড় কিছুটা থিতিয়ে গেছে । কিন্তু বৃষ্টির বর্ষণ সমানে চলছে । কঙ্কাবতী বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে স্নান করার ন্যায় । তার শারীরিক গঠন এতটাই সুন্দর,  যার জন্য বৃষ্টিতে ভেজার পর তার শরীরের দ্যুতির বিস্ফোরণ আকর্ষণীয় ।
উল্টোদিক থেকে নিয়ামতপুর থানা থেকে বাড়ি ফিরছে পঞ্চায়েতের রক্ষিতবাবু । তাঁর বয়স কঙ্কাবতীর কাছাকাছি । রক্ষিতবাবুর বাড়ি চড়ুইডাঙার পাশের গ্রাম পল্লীদহ গাঁয়ে । তিনি সেখানকার পঞ্চায়েত । পঞ্চায়েত হলে কী হবে ? কঙ্কাবতীর রূপে তিনি মুগ্ধ । কয়েকবার একথাটা বলা হয়ে গেছে । কঙ্কাবতী ঐসব কথার গুরুত্ব কোনোদিনও দেয়নি, সুতরাং রক্ষিতবাবুর কথারও গুরুত্ব দেয়নি  । বরং দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে । এমনকি রক্ষিতবাবু কঙ্কাবতীকে পঞ্চায়েতের কাজে ঢোকানোর প্রলোভনও  দেখিয়েছিল ।  কিন্তু চালাক কঙ্কাবতী ঐসব প্রলোভনে পা দেয়নি । কঙ্কাবতী জানতো, এইসবের পেছনে রক্ষিতবাবুর অন্য ধান্দা রয়েছে । কারণ রক্ষিতবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে কঙ্কাবতী ষোলোআনা অবগত । সেই কারণে রক্ষিতবাবুর ফাঁদে পা বাড়ায়নি । কঙ্কাবতী কানাঘুষো শুনেছে, পল্লীদহের শান্তি বিধবা বৌটার সঙ্গে রক্ষিতবাবুর কেলেঙ্কারির কেচ্ছা ! সেই খতরনাক লোকটাকে দেখে আতকে উঠল কঙ্কাবতী ! কঙ্কাবতী  খুব দ্রুত  তার  পরনের  শাড়ি  গোছাতে শশব্যস্ত হয়ে উঠল ।
   রক্ষিতবাবু  প্রথমে বুঝতে পারেনি । কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো, শাড়ি পরিহিত একজন হৃষ্টপুষ্ট মহিলা ভ্যান রিক্সার আড়ালে বসে রয়েছে । আকাশে তখনও মেঘের গর্জন । বৃষ্টি অনবরত চলছে ।  বৃষ্টির জলের ফোঁটা ভীষণ ঠাণ্ডা ! সূর্য দেবতা কালো  মেঘে ঢাকা ।  কাছাকাছি  এসেই  রক্ষিতবাবু  হাঁক  ডাকলো, “কে ? কে  ওখানে ?” 
 সাড়া না পেয়ে রাস্তার পাশে কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে তার ঘোমটা খুলে দিলো ।  আচমকা কঙ্কাবতীকে দেখে রক্ষিতবাবু আনন্দে উচ্ছ্বসিত । কঙ্কাবতীর ঘোমটা খুলে তাকে দেখে আনন্দে তার মুখ থেকে বের হল, “আমার অনেকদিনের স্বপ্নের রানীকে আজ সে হাতের মুঠোতে পেয়েছে  ?” 
   কঙ্কাবতী পালাতে ব্যস্ত । এতক্ষণ ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কঙ্কাবতী কিছুটা শারীরিকভাবে কাহিল ? যার জন্য ছুটে পালাতেও হোঁচট খাচ্ছে । তবুও সে পালাতে মরিয়া । নতুবা এই নির্জন জায়গায় রক্ষিতবাবুর খপ্পরে পড়তে বাধ্য । অনেক যত্নে বাঁচিয়ে রাখা তার নারীসত্তার ধ্বংস অনিবার্য । 
                                                                                 ( ক্রমশ)
Share This
Categories
গল্প

পরিবর্তন : দিলীপ রায়।

             তপা পরীক্ষার মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরল । অভিভাবকের স্বাক্ষর করিয়ে পরের দিন অবশ্যই জমা দিতে হবে । পরেরদিন মার্কশীট জমা দেওয়ার শেষ দিন । তপা মায়ের কাছে গিয়ে মার্কশীট দেখিয়ে বলল, কীভাবে বাবার স্বাক্ষর নেওয়া যায় ?  বাবা মার্কশীট দেখলে আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে । 
      নম্বরের যা  বহর, তাতে তুই কোন্‌ মুখে  বাবার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর চাইবি !            
     তপার বাবা পশুপতি খাঁ । পূর্বস্থলি স্টেশনের কাছে সোনাঝরা গ্রামে তাঁর মুদিখানার দোকান । দোকানে অনেক ধার-বাকী । খরিদ্দারের কাছ থেকে ধারের  টাকা আদায় হচ্ছে না । চাইতে গেলে সকলের মুখে এককথা, “মাঠের ধান উঠুক, ধারের সমস্ত টাকা শোধ করে দেবো ।“  পশুপতির আবার ধার দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ । অথচ ধার না দিলে খরিদ্দার ধরে রাখা কষ্ট । সদলবলে গাজি মিয়ার মুদির দোকানে হত্যে দেবে । তাতে আখেরে তাঁর লোকসান । 
      তখন সন্ধ্যা আঁটটা ! খরিদ্দারের আনাগোনা নেই বললেই চলে । তাই ভাবল পশুপতি, এবার দোকান বন্ধ করা যাক । মন-মেজাজ তাঁর ভাল নেই । কিছুক্ষণ আগে খাতা খুলে পশুপতির মাথায় হাত ! প্রায় আঠারো হাজার টাকা  ধার  । এইটুকু দোকানে এতগুলি  টাকা ধার ! লোকে ধার খেয়ে শোধ করার নাম করছে না । অথচ অনেকগুলি টাকা । সংসারে অনেক খরচ । অভাব  অনটনের বহর বেড়েই চলেছে । তাঁর বৌটা তেমনি ! একটু রেখে ঢেকে খরচা বাঁচিয়ে সংসার চালাবে সেদিকে তাঁর নজর নেই । শুধু বায়নাক্কা । এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে । দেখা যাবে  আজ গৃহের আসবাবপত্র কেনা, কাল দেখা যাবে ঘরের থালা বাসন কেনা ! আজকাল আবার অনলাইনে কেনাকাটা শিখেছে ।  কেনার শেষ নেই । তাঁর বৌয়ের খরচার হাত ষোলোআনা ।  এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে পৌঁছালো পশুপতি খাঁ ।
       গামছা হাতে  ধরিয়ে দিয়ে তাঁর বৌ বলল, “হাত মুখ ধুয়ে এসো চা বানিয়ে দিচ্ছি । ঐদিকে খাবার রেডি । যখন বলবে তখনই রাতের খাবার দিয়ে দেবো ।“  
       পশুপতি বৌয়ের  দিকে কট্মট করে  তাকিয়ে বৌকে ঝাঁঝালো সুরে বলল, “কষ্ট করে  আর  চা বানাতে হবে না । ক্ষিদে পেয়েছে, সুতরাং একটু পরে রাতের খাবার খেতে দিলেই চলবে । যতোসব আদিখ্যেতা  !”  
       পশুপতি হাত মুখ ধুতে যাবে এমন সময় তপা কাচুমাচু হয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো । মেয়েকে দেখে মুখ ভেঙ্‌চি দিয়ে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “সাঝ-সন্ধ্যাবেলায় তোমার আবার কী  দরকার ?” 
  “বাবা,  আমার স্কুলের  মার্কশীটে তোমার স্বাক্ষর চাই”, তপা আমতা আমতা করে বাবাকে  বলল ।
     মার্কশিট নিয়ে ঐরকম হতচ্ছাড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? নিশ্চয়ই পরীক্ষায়  ডাহা ফেল ! দেখি তো মার্কশীট, বলেই  পশুপতি মেয়ের হাত থেকে টান দিয়ে মার্কশীট  নিজের হাতে  নিলো ।
      এক ঝলক মার্কশীটের নম্বর দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো পশুপতি । তারপর রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে কষে মেয়ের গালে এক চড়  । চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে তপা ঘরের মেঝেতে সটান্‌ পড়ে গেল  । যন্ত্রণায় তপা কাঁদছে । তপার মা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলতে গেলে পশুপতি এক ধ্মকে বৌকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো । আর কট্মট করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “তোমার লায় পেয়ে মেয়েটা উচ্ছন্নে গেছে”  । 
   তপা কাঁদছে ।
   পশুপতি মার্কশীট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলো ।
  “বাবা, মার্কশীট আগামীকাল স্কুলে জমা দিতে হবে”,  ভীত ও ত্রস্ত অবস্থায় তপা  বাবাকে বলল ।
   আগে নাচ বন্ধ করো তারপর স্বাক্ষর । নাচ বন্ধ না করলে আমি আর স্বাক্ষর করবো না । ধাই ধাই করে এখানে সেখানে নেচে বেড়ানো । যার জন্য ১০০ নম্বরের মধ্যে  অঙ্কে ২৫ নম্বর । ইংরেজিতে  ২২ নম্বর ।  আহারে ! নম্বরের কী ছিরি ! 
    তারপর আবার মেয়ের উপরে  রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে নাচের সরঞ্জাম দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসে মেয়েকে ধমকিয়ে বলল, “আবার কখনও নাচে তোকে দেখেছি, তাহলে তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারবো । তোর মা এসেও বাচাঁতে পারবে না । বলেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা  হয়ে গজরাতে গজরাতে খাওয়ার ঘরে ঢুকলো ।“ 
                                                  ( ২ ) 
    পরের দিন রাজ্যস্তরে নাচের প্রতিযোগিতা । কলকাতার নজরুল মঞ্চে । স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতা ছুটলো নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে । এই ঘটনা একমাত্র তপার মা জানে । কেননা একমাত্র মা তপাকে নাচে ভীষণ উৎসাহ দেয় । সত্যি কথা বলতে, তপার পড়াশুনা ভাল লাগে না । পড়তে বসলেই পড়া থেকে উঠে নাচের অনুশীলন । নাচের অনুশীলনে তার পরিশ্রম নেই, বরং ভীষণ স্বচ্ছন্দ ।  কিন্তু তার বাবা উল্টো, পড়াশুনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না । অথচ তপার নাচই জীবন । নাচটা তার রক্তে ।  মনপ্রাণ দিয়ে নাচ শেখে । লুকিয়ে লুকিয়ে  নাচের ক্লাস করে । নাচে ভীষণ দক্ষ ।  মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে  কলকাতার  নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিলো তপা । তার সঙ্গে রয়েছে সহপাঠী অনুপম । তপাকে নাচের ব্যাপারে সবরকম সহযোগিতা করে অনুপম ।
   বিশাল বড় হল । রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম । প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন অথবা দুইজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে । টান টান উত্তেজনা ।  বিচারকের আসনে স্বনামধন্য  পাঁচজন । সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হল বেলা ১১টায়  ।  বিচারকেরা নাচের নিয়মাবলী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । বিচারকদের নির্দেশমতো প্রতিযোগীদের একটা মাত্র  নৃত্য পরিবেশন ।  শুরু হল নৃত্যানুষ্ঠান । 
      তপার পালা ঠিক বেলা দুটোর সময় । তাকে কত্থকের উপর নৃত্য পরিবেশনের জন্য বিচারকমণ্ডলী নির্দেশ দিলেন । তপার নৃত্যের তাল,ছন্দ ও লয় অতীব সুন্দর ।  তালে তালে এত সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করলো তপা, যার জন্য হলের সমস্ত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূতো । প্রচণ্ড হাততালি । বিচারকগণ পুনরায় তপাকে নির্দেশ দিলেন আধুনিক লোকগীতির সঙ্গে আরও একটি নৃত্য পরিবেশন করতে । তপাও তেমনি ! নৃত্যের তাল সম্পর্কে  তপার প্রচণ্ড দখল । এটা তার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা  ।   মন খুলে মনের আনন্দে নৃত্য পরিবেশন করলো তপা । নৃত্যে তার অফুরন্ত  আনন্দ ।  অনুপম অবাক ! অনুপম লক্ষ করল, তপার নাচের পরিবেশনের সময় তার সাথে সাথে অর্ধেকের বেশি শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলেন । অনুপম আরও লক্ষ করল, মাননীয় বিচারকেরা একে অপরের প্রতি হাসিমুখে তাকালেন ।
    তারপর দুজনে ছুটলো হাওড়া স্টেশন । ট্রেন ধরতে । পূর্বস্থলি স্টেশনে যখন পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ৭টা । অনুপমের সঙ্গে তপা বাড়ি ফিরছে । তপা ভাবছে এই সময়ে বাড়িতে বাবা নেই, সুতরাং বাবার বকা বা তাঁর হাতে মার খাওয়া থেকে মুক্তি । কিন্তু গাঁয়ের ভাওয়াল মাস্টার মশাই অনুপমের সঙ্গে তপার বাড়ি ফেরা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন । সরাসরি  পশুপতির দোকানে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ ! শেষে কিনা আপনার মেয়ে একটা আদিবাসী ছেলের সাথে মিশছে ? ভর সন্ধেবেলায় আপনার মেয়ে কিনা নীচু জাতের আদিবাসী ছেলেটার হাত ধরে  রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ! স্কুলের ড্রেস পরা । পিঠে স্কুলের বইয়ের ব্যাগ । নির্ঘাত স্কুল থেকে আলো-আধারি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ।“  কথাগুলি বলে ভাওয়াল মাস্টার অন্যত্র ছুটলেন ।                                        
      পশুপতি রাগে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য । দোকান খোলা রেখেই ছুটলো বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছেই  চিৎকার, “তপা কোথায় ?” 
   স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ  ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে ।
    তপা বাথরুম থেকে বের হতেই হাতের বেতের লাঠি দিয়ে তপার পিঠে বেদম মার ! তপার মা থামাতে গেলে তাকেও ঐ বেতের লাঠি দিয়ে চপেটাঘাত । মেয়েকে শাসিয়ে  পশুপতি বলল, “নাচ বন্ধ । এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা । এর বাইরে কোথাও দেখতে পেলে তোর ঠ্যাং খোড়া করে দেবো । স্ত্রীর দিকে ক্রূদ্ধভাবে  শাসিয়ে বলল, “মেয়েকে না সামলাতে পারলে আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব  পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে  দেবো ।“  
   তারপর  হন্‌হন্‌ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে  গেলো পশুপতি । 
    মা ও মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে তপা কেদেই যাচ্ছে । কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না ! কলকাতায় ছোটাছুটিতে সারাদিনের ধকলের পর বাবার হাতের বেদম প্রহারে তপা যতো না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে বাবার হাতে  মা  নিগৃহীত  হওয়ার জন্য !   
                                   ( ৩ ) 
    তারপর, নাচের প্রতিযোগিতার ফলাফল । সেটা ঘোষণা হবে কলকাতায় শনিবারদিন । বাড়ি থেকে কীভাবে বের হবে সেই চিন্তায় তপা অস্থির । 
 মা মেয়েকে বলল, কাল অর্থাৎ শনিবার  তুই ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবি । সঙ্গে অনুপম যাবে ।
  “তুমি যাবে না মা ? তুমি আমার সঙ্গে চলো মা”, বায়না ধরলো তপা ।
  যাওয়ার ইচ্ছা আমার ষোলোআনা, কিন্তু তোর বদরাগী বাবাকে নিয়ে ভয় ? 
    তপা  মনকে শক্ত করে মাকে বলল, “আমার নাচে  কোনো পুরস্কার পেলে আমি বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবো না । বাবার জন্য তোমার  যেমনি অশান্তি তেমনি আমার ভীতি । দরকার হলে থানায় নালিশ জানাবো । বাবার অভব্যতার একটা বিহীত হওয়া  দরকার, নতুবা বাবা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে” । 
     মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা শান্তভাবে তপাকে বলল, “বাবাকে নিয়ে ওসব আজেবাজে  কথা বলতে নেই মা । তোর নাচের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো পুরস্কার পেলে তোর বাবার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর মনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য । আমার কথাটা মিলিয়ে নিস ।“ 
     পরের দিন মা ও মেয়ে দুইজনেই পশুপতি  ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে  ট্রেন ধরলো । কলকাতায় রাজ ভবনের প্রেস কর্ণার হলে ফলাফল ঘোষণা । মাননীয় রাজ্যপাল বিজেতাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন । পুরো অনুষ্ঠান টিভিতে লাইফ দেখানো হবে । তপা ও মা এবং অনুপম রাজভবনে গিয়ে আসন নিয়ে বসে পড়লো । অনুপমকে রাজভবনে ঢোকার গেটে সিকিউরিটি ধরেছিল । কিন্তু তপা অনুপমকে তার জেঠতুতো দাদা বানিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করল । যার ফলে অনুপম  ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলো । 
   এবার নাম ঘোষণার পালা । 
    তপা ভীষণ টেনশনে আনচান । কোনো  পুরস্কার না পেলে আজ তার বাবার কাছে রক্ষে নেই । বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে তাড়িয়ে দেবে । পুরস্কারের ব্যাপারে তপা যেটা বুঝেছে সেটা হচ্ছে,  প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছাড়া আরও জেলা ভিত্তিক একটি করে পুরস্কার । জেলা ভিত্তিক দশ জনের পুরস্কার ।  পুরস্কারে নগদ ৫০,০০০/- টাকা এবং মানপত্র । প্রথম পুরস্কার ৫ লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৩ লাখ এবং তৃতীয় পুরস্কার ২ লাখ টাকা এবং সঙ্গে মানপত্র ।
     নাম ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠে এলেন মাননীয় ঘোষকঃ- 
       হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ । রাজ্যের মন্ত্রী ও উচ্চ পদাধীকারি আধিকারিকগণ  ।  নাম ঘোষণা করলেন ---- প্রথম,  পূর্বস্থলির তপতি বেরা । 
       তারপর হাততালি । প্রচুর হাততালি । ঘোষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “তপতিকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি ।“ 
    মঞ্চে তপতির ওঠবার পর ঘোষক তাঁর হাতের মাইকটি তপতির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি  শ্রোতাদের  উদ্দেশে কিছু বলো ।“ 
    এদিকে ভাওয়াল মাস্টার পশুপতিকে আবার খবর দিয়ে বলল, “টিভিতে তোমার মেয়েকে দেখাচ্ছে । এখন টিভি খুললেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে ।“  
   সঙ্গে সঙ্গে পাশের দোকানে টিভির সম্মুখে এসে পশুপতি অবাক ! তাঁর মেয়ে প্রেস, মিডিয়া্‌ ও  অনেক শ্রোতামণ্ডলির সামনে নির্দ্বিধায় বলছে, “নৃত্য শিক্ষায় আমার অনুপ্রেরণা আমার মা ।  মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতে আমার নৃত্য শিক্ষার বাস্তবায়ন ।“  
    পশুপতির চোখ ছলছল । সে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলো,  ফিরে এলে মেয়েকে  আর বকবে না । মেয়ে যেটা চায় সেটাই করবে । মেয়ের ক্যারিয়ারে   কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । সে এখন পরিষ্কার বুঝেছে, “যার যেদিকে ঝোঁক তাকে সেদিকেই এগিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় ।“  রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো পশুপতি । 
                                           ( ৪ ) 
     তারপর স্কুল, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সকলে তপার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।  নাচের প্রতিযোগিতায় তপা রাজ্যে প্রথম হওয়ায় সকলেই গর্বিত । 
   পশুপতি কাচুমাচু হয়ে মেয়ের কাছে নত হয়ে  ছলছল চোখে  বলল, “মা আমাকে ক্ষমা করিস্‌ ।“  
   তপা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ।
             ---------০---------
Share This