Categories
কবিতা

গর্ভবতী নদী ::: রাণু সরকার।।

গর্ভবতী নদীর বুকে
অনুদ্ধত নিরীহ ক্ষুদ্র তরঙ্গরাশি
হর্ষধ্বনিতে নেচে যায়-
তাতে প্রতিফলিত হয় সংখ্যাহীন চন্দ্ররশ্মি।
তখন যে তার বিরামকাল!
সোহাগের দোলাচলে অস্থিরচিত্ত!
তাই সে তরঙ্গহীন-
সম্পূর্ণ হৃদয় জুড়ে
আলোর বিচ্ছুরণ,
মন্থর গতিতে জাগায় শিহরণ!
রূপের দীপ্তিতে বিবশ হয় তার চেতনা!

Share This
Categories
কবিতা

কেউ আসে না :: রাণু সরকার।।

আজকাল তেমন একটা কেউ আসে না,
আসলে তাদের আসার অপেক্ষাতে তো আজ আর নেই,
কী আর থাকবো- ঝুড়িঝুড়ি প্রশ্ন নিয়ে আসে আমার কাছে।

আসলে এতো প্রশ্নের উত্তর রাখার মতো টুকরি নেই আমার-
আমি আবার এতো ভার বহন করতে পারিনা, কষ্ট হয় ভীষণ।

প্রাপ্তবয়স্ক হলে কি হবে- বহন করার ক্ষমতা আছে বেশ,এতোটুকুও ক্লান্তি নেই ওদের-
সেবার এসে অনেক প্রশ্ন রেখে গেলো, ভালোবেসে না রাগ করে জানিনা বাপু।

আলগোছে রেখেছি তুলে নাড়াচাড়া দেইনি-
আমি একটু আটপৌরে জীবন যাপন করে থাকি, জগৎ সম্পর্কে তেমন কোন কৌতুহল দেখাই না- যখন যা হবার হবে।
জীবন কী বুঝতে ঋতু লাগেনা।

Share This
Categories
কবিতা

সাজো ঘটনা :: রাণু সরকার।।

এক নারী, রোজ সকাল হলে চলে আসে একই জায়গায়, বসে কী যেন ভাবে অস্পষ্ট ও মৃদুস্বরে
কথা বলে।

একদিন স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তার কথা,
সে- উচ্চস্বরে বললো কত গুলো বছর ধরে ভেবেই যাচ্ছি
কোথায় যে রেখেছি পাচ্ছি না খুঁজে-আমার বাড়ি কোথায়?

ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে মরে যাবি তবুও খুঁজে পাবি না তোর বাড়ি,
হা হা হা, হায়রে- নারীর আবার আছে নাকি বাড়ি?

যখন সুস্থ ছিলি একবারও ভেবে দেখার সময়
পাসনি,
মেয়েবেলা আর কৈশোর কাটে বাবার বাড়িতে,
এটাও জানিস না-
যৌবনকাল কাটে স্বামীর বাড়িতে,
যতদিন স্বামী আছে যৌবন আছে রান্না ঘরে কাটাতে হবে,
যে চাকুরি করে তার টাকা আছে তো সব আছে তার ব্যপার আলাদা। সব নারী যদি চাকুরি করতো হতো না আর তোর মতো।
তারপর তোর ছেলের ঘর- যদি ছেলে ও ছেলের বৌ ভালো হয় তবে থাকতে পারবি ও বলবি আমাদের বাড়ি, তোর বলা যাবে না।
ছেলে-বৌ না দেখলে তবে তোকে থাকতে হবে পথে-ঘাটে ,তুই তো চাকুরি করিস না, তোর টাকাও নেই-
পথে-ঘাটেও এখন আর থাকা যায় না রে নারী, দুরবস্থা, বৃদ্ধ হলেও ছাড় নেই।

এবার বল- তোর বাড়ি কোথায়?
বাড়ি খুঁজে খুঁজে শেষে তুই পাগোল হলি।
এই বয়সে স্বামীকে হারালি তারপর গর্ভের
প্রিয়জনের থেকে পেলি না আদরযত্ন শ্রদ্ধা-
নেই তোর প্রতি মনোযোগ তাই তো মানসিক
ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিস-
এখন সবাই তোকে বলে পাগোল—-

Share This
Categories
কবিতা

ভাবনা : রাণু সরকার।

একদিন সে- ডেকেছিলো-
করেছি অবজ্ঞা!
তার সোহাগ কে দেইনি সময়–
ভাবার অবসর পাইনি
তার অন্তরে এতো ব্যথা-
অন্যমনস্ক ছিলাম হয়তো!

বর্তমানে- তাকানোর স্মৃতি মনকে
পঙ্গু করে!
ঈষৎ ঝাঁকুনি দেয় শরীরে ও প্রশমিত করে পত্রশিরা!
বর্তমানে তার তাকানো কে প্রশ্রয় দেওয়া অলীক দুরাশা!

Share This
Categories
কবিতা

প্রতিবিম্ব : রাণু সরকার।

সবসময় আমাকে আগলে রাখে,
আমার সাথে নীরবে কথা হয়-
সুখ দুঃখের-
আমাকে ও খুব ভালোবাসে!

আমার চলার পথ ও নিজেই ঠিক
করে দেয়-
অন্ধকারে যদি ভয় পাই-
তাই তো বুকে জড়িয়ে রেখে কত
স্নেহ কোরে!

আমি আনন্দে দিশাহারা
চোখ বন্ধ করে ওর বুকে
মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি–

ও আমার প্রতিবিম্ব!

Share This
Categories
কবিতা

ব্যথা : রাণু সরকার।

ব্যথা বলছে, আমারও তো ব্যথা আছে- কেউ কি তা বোঝে?

হ্যাঁ, বোঝে তো–
কেনো স্পর্শেন্দ্রিয় তো বোঝে।

তবে ভাগিদার কে ?
যে ভাগ বা অংশ পায় সে-
সে কে?
সে হচ্ছে অনুভূতি,
তোমার দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে
রক্ষা করছে ব্যথা।
ব্যথার উৎস থেকে ব্যথা দূরে সরে যাবার সময় আরো যে ব্যথারা আছে তাদেরকে সাথে করে নিয়ে যায়,
ব্যথা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে না, সে ভীষণই ব্যস্ত
তাই তো তার এতো কষ্ট।

ব্যথার সৃষ্টি কেমন তুমি কি কখনো বুঝেছো?
ব্যথা আসে ধীরে ধীরে- তারপর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তখন সে আহত ক্ষুধিত হিংস্রের মতো হয়ে যায়।

Share This
Categories
কবিতা

আত্মম্ভরি : রাণু সরকার।

দৃষ্টিকোণের বোবা জলটা পীড়নকর,
উপলব্ধি করলে বৃহৎ এক কাব্য,
ঠোঁট জুড়ে অকথিত ভাষা,
অথচ নাচ ঘরে শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী,
কিন্তু শরীর জুড়ে অঙ্কিত দাম্ভিকতা
সোহাগে বাড়ে আত্মম্ভরি!

Share This
Categories
কবিতা

ত্রিস্রোতা জীবন : রাণু সরকার।

জীবন কবিতার রচনানুবন্ধ
ত্রিস্রোতা- তাল ছন্দে নৃত্যপটিয়ান,

যখন ছন্দকানা হয় তখন পড়ে ধন্দে
অশান্ত বর্ণরাগে আচমকা ঝুড়বৃষ্টি
গল্প উপন্যাসের সাথে হরদম চলে
সহবাস!

পরিবর্তনপ্রবণ অঙ্গভঙ্গি দ্বারা নেয়
নাট্যরূপ-
উত্তেজনাপূর্ণ কিছু বাণী লক্ষ্যহীন
ঘরে করে ভ্রমণ–

একটি শব্দ সজোরে নিক্ষেপ করে
জানালার কাঁচে,
হয় হাজার খণ্ড রক্তাক্ত হয় আবালবৃদ্ধ-
কোন ভ্রুক্ষেপ নেই-
জ্যোৎস্না রাতে আসে গালভরা হাসি নিয়ে!

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল : দ্যা লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্প।

আজ আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ বা ধাত্রী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আজ ভারতেও পালন করা হচ্ছে দিবসটি। নার্সিং এমন একটি পেশা যা সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। এ পেশার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে কোন রোগী বা ব্যক্তির স্বাস্থ্য পুণরুদ্ধার এবং জীবনযাত্রার গুরুত্বতা তুলে ধরা হয়। এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত, দক্ষ কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি নার্স বা সেবিকা নামে পরিচিত। প্রধানতঃ নারীরাই নার্সিং পেশার সাথে জড়িত থাকেন। তবে এখন অনেক পুুুরুষেও এই পেশার সাথে যুুুুক্ত হচ্ছেন। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জন্মদিন কে স্মরণীয় করে রাখতে আজকের দিনটি অর্থাৎ আন্তৰ্জাতিক ধাত্রী দিবস সমগ্র বিশ্বে প্ৰতিবছর ১২ মে তারিখে পালন করা হয়। ১৮২০ সালের এই তারিখে আধুনিক নার্সিং পরিষেবার মাৰ্গদৰ্শক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্ম হয়েছিল। এই দিবস পালনের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয় সেই নারীকে যিনি তার কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন – নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের প্ৰতি শ্ৰদ্ধা জানাবার সাথে বিশ্বের ধাত্রীদের রোগীদের প্ৰতি দেওয়া স্বাস্থ্যসেবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্ৰকাশ করা হয়।

ইতিহাস—

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর জন্মদিন কে আন্তৰ্জাতিক ধাত্রী দিবস হিসেবে পালিত হয়। তিনি ছিলেন আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত, একজন লেখিকা এবং পরিসংখ্যানবিদ। যিনি দ্যা লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্প নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮২০ সালের ১২ মে মাসে ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
ছোটবেলা থেকে তার স্বপ্ন ছিল নার্স হওয়া। কিন্তু তখনকার সময়ে নার্সিংকে সম্মানের চোখে দেখা হতো না। এছাড়া তার পিতা-মাতা চাননি ফ্লোরেন্স নার্স হোক। তাই ফ্লোরেন্সকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়। কেননা তার নিজ বাড়িতে তার স্বপ্নটি পূরণ করা সম্ভব ছিলনা।
১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য কাজ শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবদান রাখে।লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং । ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় নার্সিংয়ের উপর বইও লিখেছেন। ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। যার মধ্যেমে সম্মান জানানো হয় এক নারীকে যিনি তার কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন- নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

 

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নার্সিং ইতিহাসে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটেছিল। এতে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল পেশাদারী পর্যায়ে নার্সিংয়ের পরিধি এবং নীতিমালা প্রণয়ন ও বিশ্লেষণপূর্বক তার প্রণীত নোটস অন নার্সিং গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
পেশাদারী পর্যায়ে এ পেশার মানোন্নয়নে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নার্স ব্যক্তিত্বরূপে ম্যারি সীকোল, এগনেস এলিজাবেথ জোন্স এবং লিন্ডা রিচার্ড ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন। ম্যারি সীকোল ক্রিমিয়ায় কাজ করেছেন; এগনেস এলিজাবেথ জোন্স ও লিন্ডা রিচার্ডস গুণগত মানসম্পন্ন নার্সিং বিদ্যালয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে প্রতিষ্ঠা করেন। তন্মধ্যে – লিন্ডা রিচার্ডস আমেরিকার প্রথম পেশাদার ও প্রশিক্ষিত নার্সরূপে ১৮৭৩ সালে বোস্টনের নিউ ইংল্যান্ড হসপিটাল ফর উইম্যান এন্ড চিল্ড্রেন থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন।
বিশ্বের ১ম দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডে জাতীয় পর্যায়ে নার্সদেরকে নিবন্ধিত করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯০১ সালে নার্সেস রেজিস্ট্রেশন এ্যাক্ট প্রণীত হয়। এলেন ডাফার্টি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের প্রথম নিবন্ধিত নার্স। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অঙ্গরাজ্যরূপে নর্থ ক্যারোলাইনায় নার্সিং লাইসেন্স ল ১৯০৩ সালে গৃহীত হয়। ১৯৯০-এর দশকে নার্সদেরকে ঔষধ দেয়া, ডায়াগনোস্টিক, প্যাথলজি পরীক্ষাসহ রোগীদেরকে প্রয়োজনে অন্য পেশাদারী স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের কাছে স্থানান্তরের অনুমতি দেয়া হয়।

 

আন্তর্জাতিক ধাত্রী পরিষদ বা ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ নার্সেস (আইসিএন) ১৯৬৫ সাল থেকে এই দিনটি উদযাপন করে আসছে। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কল্যাণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা ডরোথি সাদারল্যান্ড প্রস্তাব করেন যে প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার “ধাত্রী দিবস” ঘোষণা করবেন; তবে তিনি তা অনুমোদন করেননি।
১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে, ১২ মে দিনটি উদযাপনের জন্য নির্বাচিত হয় কারণ এটি আধুনিক নার্সিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মবার্ষিকী। প্রতি বছর, আইসিএন আন্তর্জাতিক নার্স দিবসের কিট প্রস্তুত এবং বিতরণ করে। কিটে সর্বত্র নার্সদের ব্যবহারের জন্য শিক্ষাগত এবং উন্মুক্ত তথ্য উপকরণ রয়েছে।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

আমার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ :: অরূপ কুমার ভট্টাচার্য্য।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির শৈল্পিক অহঙ্কারের সৌধে অনিবার্যভাবে বিরাজমান। বাংলার সামাজিক উত্থান-পতনের এক যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁর জন্ম। ঐতিহ্যবাহী কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সন্তান হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে জ্ঞানচর্চার এক নির্মল পরিবেশের মধ্যে। মহর্ষি পিতার উপনিষদ চর্চা বালক বয়সেই রবীন্দ্রমানস-গঠনে প্রতিফলন ঘটে এবং সেই শিক্ষাকে তাঁর সমস্ত সত্তায় আত্মস্থ করে নেন। বাল্যকালের সেই উপনিষদিক শিক্ষার আলো সারাজীবন তাঁকে পথ দেখিয়েছে। উপনিষদে যে সত্যের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন সেই সত্যেরই উজ্জ্বল প্রভা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য সাধনা, মেধা ও শ্রমে নিজেই ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন যা তাঁকে বহুমাত্রিক শিল্পস্রষ্টার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। নিজের বিরাট সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তাঁকে এক যুগোত্তীর্ণ মহাপুরুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। বাংলা সাহিত্যে হাতে গোনা যে ক’জন বড় মাপের খ্যাতিসম্পন্ন লেখক আছেন তার মধ্যে একজন অন্যতম পুরোধা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবিভক্ত বাংলায় নবজাগরণের মধ্যাহ্নে রবি কিরণের উন্মেষ ঘটেছিল। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সত্য ও সুন্দরের ফলগুধারার মতো বহমান এবং সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে এবং বাংলা সাহিত্যজগতে হিমাদ্রির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন এক অলৌকিক ঐশ্বর্য নিয়ে। বাঙালির সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতির বহুলাংশ জুড়েই আছেন ধীমান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাঙালি তাই তার প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি সংশয়ে আশ্রয় নেয় সেই রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার পরিধি দিয়ে বিস্তৃত করেছেন গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিসর। আমরা তাঁকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় অভিষিক্ত করেছি। রবীন্দ্রনাথের সাফল্যের এই ক্রম-উত্তরণ কিন্তু একদিনে ঘটেনি। এক লহমায় তিনি ‘বিশ্বকবি’ বা ‘কবিগুরু’ অভিধায় ভূষিত হননি। সমগ্র রবীন্দ্র জীবন ও সৃষ্টির পিছনে রয়েছে তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘ অবিশ্রান্ত পথ চলা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন বর্তমানের দৃষ্টির সীমানায়। যে দৃষ্টি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে। তাই তিনি সব সময়ই আজকের রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। জীবনের প্রভাত থেকে অন্তিমলগ্ন তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা; সব্যসাচী লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সুর স্রষ্টা, গায়ক, সমালোচক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ হিসেবে অনন্য। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে, বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে বদলে দিয়েছেন বাঙালির মানসজগত এবং বাংলাকে দিয়েছেন বিশ্ব পরিচিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান। একে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, জীবন- চেতনায় রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অপরিহার্য। আমাদের জীবনের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে, মননের সঙ্গে, আন্দোলনে, ভাষার মাধুর্যে, দেশপ্রেমে সৃষ্টিশীল কর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আমাদের প্রাণের টানে, জীবনের টানে, চেতনার টানে, শিল্প ও সাহিত্যের টানে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে শিল্পের আরাধনায়। তাঁর কবিতার ছন্দ, বাণী ও সুর আমাদের হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় শান্তির শুভ্র পরশ। অনন্ত অসীমের সেই অসামান্য রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা প্রার্থনায় নতজানু হই, সমর্পিত হই, পরম বিশ্বাসে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, জীবনের কবি, প্রকৃতির কবি, গানের কবি সর্বোপরি মানুষের ভালোবাসার কবি হয়ে চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে অপার্থিব আনন্দলোকে আনন্দের বিস্তৃৃতি ঘটিয়েছেন। তিনি বাঙালি হয়েও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তাঁর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ছড়া, কবিতা কিংবা বড়দের জন্য লেখা কবিতা, গান, গল্প-উপন্যাসে আমরা বাঙালির সহজ সরল জীবনকে তুলে ধরতে দেখি। তাঁর নানা কাব্যগীতিতে আমরা প্রেম সৌন্দর্য, রোমান্টিক ভাবনা, আধ্যাত্মিক কল্পনার চিন্তাধারা পরিলক্ষিত হতে দেখি। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ গল্প উপন্যাস এখনো আমাদের সৃজনশীল মনকে আন্দোলিত করে। আমরা রাবীন্দ্রিক চরিত্রগুলোকে চলচ্চিত্র ও মঞ্চে রাজা ও রানী, বিসর্জন, রক্তকরবী, চিত্রাঙ্গদা, চিরকুমার সভা, বাল্মিকী প্রতিভা, তাসের দেশ, ডাকঘর, রাজা, মুক্তধারা, অচলায়তন, শাপমোচন, শেষের কবিতা, সফল সঞ্চায়ন দেখি; তখন আমরা নিজেরা কিছুটা রাবীন্দ্রিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ আছেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে তাঁর সৃষ্টির উৎসারণে কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, মঞ্চনাটক, টিভি নাটক, নৃত্যনাট্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত এবং বাংলার সমগ্র সংস্কৃতিতে। তিনি তাঁর মানবীয় উচ্চ ভাবনা-চেতনা আর মানুষের চিরায়ত অনুভূতি ভাষার সৌকর্য সাধন আর নিপুণ শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে কাব্য-সঙ্গীত-প্রবন্ধ-গল্পে আর চিত্রকলায় রূপায়িত করে মানুষের চেতনাকে শানিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ব্যাপকতা বিশ্বজুড়ে শিখরস্পর্শী প্রতিভায় উদ্ভাসিত যা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তায় ছড়িয়েছে রবির আলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনকে শিল্পবোধ থেকেই অনুভব করেছেন। আর সেজন্য তাঁর শিল্প-সৃষ্টি প্রায়শই জীবনসংলগ্ন। তিনি কাব্য, গল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটককে জীবনের প্রতিভাষে সিঞ্চিত করেছেন। যা রূপালঙ্কার, প্রতীক ও বিমূর্ততার দ্যোতনায় হয়েছে উজ্জ্বল। সব মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। দেড়শ বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে তাই চিরজাগরুক হয়ে আছেন।

সমগ্র বাঙালির মানস জগতে রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন আবেগ, প্রেরণায় জাগ্রত থাকবেন এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আলোর দিশারি হয়ে আলো ছড়াবেন যুগ থেকে যুগান্তরে। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর স্বপ্ন আর জীবন দর্শন আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে সত্য ও সুন্দরের।

——————————————————————————-

Share This