Categories
নারী কথা

কবিতা পরমেশ্বরী : শুভ্রাশ্রী মাইতি।

দুপুরের ঘুঘুডাকা নির্জনতা। পাতা পড়লেও বোধহয় শব্দ শোনা যাবে পুকুরে–টুপ্। মামার বাড়ির লাইব্রেরির চৌদ্দো হাজার বইয়ের আলমারির পাশে বইপাঠে নিমগ্ন একাকী বালিকা।
অক্ষর, অক্ষর পেরিয়ে শব্দ, ছন্দ, উপমা, যতি, ব্যঞ্জনা, অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি আর বোধির এক আশ্চর্য আলোকিত রূপকথা জগত। পা ফেলে মেয়েটি, সন্তপর্ণে। মাকে দেখেছে তো সে ছোট থেকে, এই অজানা জগতটি থেকে ঘুরেফিরে বেরোতে। জাবদা খাতায় মুক্তোর মতন অক্ষর সাজিয়ে লিখে ফেলতে মনের কথা। কেমন যেন আলো আলো হয়ে ওঠে মায়ের মুখটা তখন। মাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, একে বলে কবিতা। অবাক হয়েছে খুব। কি আশ্চর্য, একেবারে তারই নামটি কেটে বসানো যে। লেখাগুলোকে বড় আপন মনে হয় তার। মায়ের পেটের বোনটি যেন।
সে ও লিখতে শুরু করে খাতায়। ছোট মনের ছোট, ছোট কথা। দুঃখ-ব্যথা। বয়স মোটে ছয় কি সাত। এতটুকু মেয়ে হলে হবে কি, হৃদয় আর বোধ যেন তার কত বড়। শুধু ফুল, পাখি, গাছ, নদী নয়, তাকে টানত জীবন। মানুষের জীবন। চারপাশ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া ছোট, বড় অভিজ্ঞতা। কৃত্রিম বা বানানো কোন কিছুতে তার বিশ্বাস নেই মোটে। জীবনে যা নেই, তাকে কলমে এনে কি এমন রাজ্যোদ্ধার হবে—এমনই ছিল ভাবখানি তার।
কৈশোরে কবিতার জগতে নতুন ভুবনের দরজা খুলে দিল তার কাছে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকা এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতাবলী। মেয়েটি বুঝল, তার অনেক কিছু বলার আছে। আর এই বলার একটা মাধ্যম হল তার লেখালিখি। লেখা হয়ে উঠল তার নিয়তি।
যৌবনে পা দিয়ে সে দেখল মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সামাজিক বঞ্চনা, নারী-পুরুষের বৈষম্য, ক্ষমতার রাজনীতি, পুরুষের আধিপত্যবাদী অনুশাসন। অথচ কত শান্ত, নিশ্চুপ সকলে। সমস্ত অসমতার বিরূদ্ধে গর্জে উঠল তার প্রতিবাদী কলম, সহজ, প্রত্যয়ী উচ্চারণে—
‘ না, আমি হবো না মোম
আমাকে জ্বালিয়ে ঘরে তুমি লিখবে না।

কবিতা লেখার পর বুকে শুয়ে ঘুমোতে দেব না।’

লোনাজলের ঝাপসা হয়ে যাওয়া নারীর ভেতর এই যে আরেক নারী, তার ক্ষোভ, ক্রোধ, অভিমান নিয়ে যে ‘বাসন্তী অসুখ’ তাকে তিনি চোখের ঝিনুকে নয়, ধরলেন কলমের শাণিত তরবারিতে, জলের অক্ষরে—
‘ কি নেবে দেহের থেকে? মাংস মেদ বসা?
প্রাগৈতিহাসিক অগ্নি? পোড়া মাংসের ঘ্রাণ, রক্ত-পানীয়
নখ দাঁত চুল কিংবা অন্নপাত্র দিব্য করোটি?
অথবা কি নিষ্কাশন করে নেবে প্রতিভা ও মেশিনের মিশ্র কুশলতা?

দেহের থেকে চাড় দিয়ে ক্রমাগত খুলে নেবে শিশু।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মিত আশ্রয় দাত্রী, রহস্যময়ী, পেলব নারীর সাজানো মিথকে ভেঙে বিশ শতকের আধুনিক নারীসত্তার দৃপ্ত উচ্চারণে নারীকে প্রথম প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি কলমের জোরে।
‘কবিতা পরমেশ্বরী’, কবি, সেই কবিতা সিংহকে আজ এই নারীদিবসে জানাই অন্তরের অক্ষরফুলে সশ্রদ্ধ প্রণাম। তাঁর ‘সহজসুন্দরী’- হয়ে যেন বলে উঠতে পারি আমরা একদিন—-
‘ আমি
মৃত্যুর মতন নগ্ন, অশ্বারোহিণী এক
নিজ অশ্বে একা
অহংকার ছুঁড়ে দেওয়া আরো বড় অহংকারে ধনী।'( ‘অহংকার’)

‘আমিই প্রথম বিদ্রোহিণী ‘। ( ঈশ্বরকে ইভ)

Share This
Categories
কবিতা

নাচুনে বসন্ত :: রাণু সরকার।।।

বসন্তে শুধু কোকিল নয়
অন্যান্য পাখিরাও সুমধুর সুরে গান করে আর এডালে-ওডালে নেচে বেড়ায়,
তবে কোকিল বেশি ডাকে।

গভীর প্রণয় জাগে এই বসন্তে,
কামোচ্ছ্বাসে সঙ্গী খুঁজে
বেড়ায় পুরুষ কোকিল- তাই সুরেলা স্বরে ডাকতে থাকে-
সঙ্গীকে পাবার তীব্র
আকাঙ্ক্ষা যখন অতন্দ্র হয়
তখন আসে তার সঙ্গী সঙ্গম করতে।
এই সুরেলা ধ্বনি জীবাধারে ছড়িয়ে পড়ে,
অব্যক্ত থাকে জীবাধারের হৃদয়ে ঘনিষ্ঠ ভাব!

অভিলাষ অতন্দ্র হয় নানান নাচুনে-
পদ্য-গদ্য-গীতিকাব্যতে।

বসন্তের এই বাতাসের গন্ধ শুঁকে টের পাই
অতীতের স্মৃতি-
চঞ্চল হয় কবির মন, কত কি জাগে মনে।

বসন্ত তুমি কত সুন্দর সোহাগ মাখাও হৃদয়ে।

Share This
Categories
কবিতা

পোয়াতি ::: রাণু সরকার।।।

এসে দেখি তুমি অবহেলায় ঘুমিয়ে আছো-
কেনো তোমার শরীর খারাপ বুঝি?
এতো খোঁজ নিচ্ছো যে-
তুমি কি ভালোবাসো?

না, বাসি না-
ভালো না বাসলেও বিচ্ছেদের ব্যথাটা ভালো বুঝতে পারি।

ভালো না বেসে কিকরে বোঝো?

বুঝি গো বুঝি, শোন তবে-
আমার ভালোবাসা পোয়াতি হয়েছিলো-
ভরা মাস তীরটা এসে জঠরে বিঁধলো,
জীবনমরণ কঠিন সমস্যা আমি বেঁচে গেলাম
কিন্তু গর্ভেই মৃত্যু ঘটলো আমার ভালোবাসা জন্ম নেবার সুযোগ পেলোনা!

Share This
Categories
কবিতা

শেষ সফর :: রাণু সরকার।।

শেষকালে যখন সফর হবে শকটে
দূরের রাস্তা দিয়ে মন্থর গতিতে চলবে পা,
মুখে ধ্বনিত হবে নাম!
সদর দ্বারে দেখবে দাঁড়িয়ে, দু’গাল বেয়ে পড়বে ঝরে শুক্তি,
একটু দাঁড়াতে বোলো, অকুন্ঠচিত্তে দু’একটি দিও আমার গালে ছড়িয়ে!

তোমার দাম্ভিকতা হয়তো বা যাবে চলে,
তখন গর্বে আপন কুলায় হবো বিলীন!
তখন পারবে কি সোহাগের চিহ্নে সজ্জীকরণ করতে
শৈলপ্রান্তে?

বৃথা গেলো যে জনম
শৈলপ্রান্তে না হয় একটু অধরের স্পর্শ দিলে!
তখন ছিলো হতচেতন মন,
আসবো আবার ফিরে তখন তুমি থেকো পাশে পাশে!
ভুলভ্রান্তি গুলো সব শুধরে রেখো আগে থেকে-
জুঁইয়ের মালা রেখো কিন্তু দুটো!
মুখোমুখি বসবো হাতে হাত রেখে!

Share This
Categories
কবিতা

নারী হওয়া কি পাপ : রাণু সরকার।

নারী কেনো সইছিস এতো তাপ?
বলতে পারো—
কেনো?
নারী হয়ে জন্মনিলে মানুষের চোখে পাপ-

রাস্তায় চলতে গেলে হতে হয়-ইভটিজিংয়ের শিকার
রুখে তোকে দাঁড়াতে হবে মানুষ গুলোর
মানসিক বিকার-

“পণ” না দিলে নির্যাতন-করতে হবে মোকাবিলা-
পরাধীনতার শিকল পরে সহ্য করিস জ্বালা,
পায়ের শিকল ছুড়ে ফেলে-পরনা জয়ের মালা-

দূর্গা রূপ ধারণ করে করবি-দৈত্য-দানব বিনাশ-
তোর পিছনে অনেক নারী ভয় কেনো তুই পাশ-
তোল না প্রবল ঝড়-
সেই ঝড়েতে শত্রু-অনেক হবে নাশ-

বীরাঙ্গনা হয়ে-
এগিয়ে গেলে-সব গ্লানি ভুলে যাবি-
রুখে যদি দাঁড়াতে পারিস
সুন্দর এক দিন আসবে জানবি।

Share This
Categories
কবিতা নারী কথা

নারীর তপ্ত আঙিনা : রাণু সরকার।

ভালোবাসার ছোঁয়া পেলে নারী পৌঁছে যায় তার শৈশবে।
যৌবনের প্রারম্ভে নারী খোঁজে পুরুষের অঙ্গের ঘ্রাণ,
খুঁজে ফেরে যথার্থ পুরুষের সঙ্গ,
কে হবে তার জীবনের প্রকৃত বন্ধু-
জীবনপ্রবাহে ভাসিয়ে দেবে স্বেচ্ছায়,
এগিয়ে চলার পথে প্রতি মুহূর্তে রাখবে তার হাতে হাত।

প্রেম সদা অমলিন-
শুভ্র বেলি-রজনীগন্ধায় অর্ঘ্য ক’রে দেহ-মন অর্পণ,
নারী করে সমর্পন সুখে দিন যাপনের আশায়।

পুরুষ প্রেমিক স্বপ্নময়….
হৃদয়ে অনুরণন, কাব্যময়তায় মায়াজালে বদ্ধ
নারী,
প্রেমের আলিঙ্গন পেলে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়।

বিবাহ হয় দু’টি শরীরের নিবিড়তায়-
ভূমিষ্ঠ হয় দেহ-মন দোঁহে,
মিলনের আনন্দে পরম মোহে স্রোতে ভাসে!

ক্রমে প্রেমিক পতিত হয় পতির আসনে-
আস্তে আস্তে আসে সংম্পর্কে চরম সংঘাত,
জীবনটা তিতিক্ষায় কেমন যেন কেটে যায়।

সৌভাগ্যবতী নারীর জীবনেও দেখা মেলে কৃষ্ণগহ্বর!
অনেক কিছু পেয়েও যেন না পাওয়ার যন্ত্রণা-
কার যেন অভিশাপে ভরে থাকে নারীর জীবন।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

ফাগুরঙ্গে মাতল নাগর-নাগরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীশ্যামনাগর আজ নাগরিমণি শ্রীরাধাকে নিয়ে হোরীরঙ্গে মেতেছেন। ব্রজগোপিনীরা সে রঙ্গলীলায় অনুঘটক । রাধারমণ রমণীমনচোরা রাসবিহারী নওলকিশোর কানু, ফাগুয়া অঙ্গে মেখে ও মাখাতে মহানায়ক হয়েছেন । ব্রজসুন্দরীগণ তাঁকে মন্ডলী-মন্ডলী করে চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছেন আর মধ্যখানে মনমোহনিয়া মুরলীমনোহর আজ সেই ব্রজরামাদের মনোভাব বুঝে ভরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের ঘনপরিরম্ভনে,চুম্বনে, সোহাগের পরশে-হরষে।

নটন বিভঙ্গে ফাগুরঙ্গে মাতল
নাগর অভিনব নাগরি সঙ্গ।
ঋতুপতি রীত চীত উমতায়ল
হেরি নবীন বৃন্দাবন রঙ্গ ৷৷
ফাগুয়া খেলত নওল কিশোর।
রাধারমণ রমণীমনচোর ।। ধ্রু॥
সুন্দরিবৃন্দ- করে কর মণ্ডিত
মণ্ডলি মণ্ডলি মাঝহি মাঝ ৷
নাচত নারিগণ ঘনপরিরম্ভণ
চুম্বন লুবধল নটবর রাজ॥
কানুপরশ রসে অবশ রমণিগণ
অঙ্গে অঙ্গে মিলি ঝাঁপি রহু।
পূরল সবহুঁ মনোরথ মনোভব
মোহন গোবিন্দদাসিয়া পহু।।

ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হোরীলীলা বা হোলিখেলা আদপে প্রেম প্রদানের উৎসব। প্রেমের বৈচিত্র্যময় ভাবের মূর্তিমন্ত রূপই হল যেন নানান রঙের আবীর আর ফাগ। মুঠো মুঠো ফাগ ছুঁড়ে ,রঙ মাখিয়ে যেন সেই প্রেমকেই নতুন করে নিবেদন করা মনের মানুষটিকে,কাছের জনকে । প্রাণ ভরে সারাদিন অক্লান্ত হোরি খেলে খানিক জিরিয়ে নিতে দোলনায় বসে দোল খান শ্রীরাধাকৃষ্ণ। তাই ,এ উৎসবের আর এক নাম দোলযাত্রা ,একথা মনে হলেও ,আদপে সেটি নয় । দোলযাত্রার ইতিহাস আরও হাজার হাজার বৎসর পূর্বে—সেই ঋকবেদের সময়কালের, অর্থাৎ সাত-আট হাজার বৎসর পূর্বের।

উত্তরায়ণের আগমনে নতুন বছরের সূচনা রূপে আর্য ঋষিরা এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বিষ্ণুর পূজা করতেন। পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চারকারী সূর্যকে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুরই প্রতিভূ মেনে তাঁরা সে পূজায় নারায়ণ শিলাকে উত্তর দক্ষিণে তিনবার ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোল দিতেন,যাতে আগামী বৎসরেও সূর্যের যাত্রা নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নকে মাধ্যম করে। আর তাই নাম দোলযাত্রা।

সাত-আট হাজার পূর্বের দোলোৎসব পূজাই পরবর্তীতে হয় হোলি বা হোরীলীলা । দোলযাত্রা হল বছরে একটি নয় দুটি— একটি দোল পূর্ণিমায় অপরটি শ্রাবণী পূর্ণিমায় হিন্দোলযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। দোল অর্থাৎ দোলন আর যাত্রা অর্থে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গমন । অতএব, দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা। যেমন রথযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। একটা কথা মনে দোলা দিতে পারে যে দেবী দুর্গাও তো যাত্রা করেন পতিগৃহ থেকে পিতারগৃহে কিছুদিনের জন্য । তবে কেন আমরা দুর্গাযাত্রা বলি না। আসলে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালির উৎসব এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে তা দুর্গোৎসব নামেই যথার্থতা পায়। আর, তাছাড়া যাত্রা শব্দটি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর গমনের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে। ফিরে আসি দোলযাত্রার কথায়,ব্রজের হোলিতে।

এই প্রেমের উৎসবের আগমণী সুর কিন্তু ফুলেরা দুজের দিনই ধ্বনিত হয়ে যায় বৃন্দাবন আর মথুরায় । ‘ফুলেরা দুজ’ হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা-মঞ্চের তথা দোলনা প্রস্তুতির সূচনা দিবস ;যা ফাল্গুনের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে পালিত হয়। এদিন ফুলের নয়নাভিরাম সাজে সজ্জিত হন বিগ্রহগণ। মন্দিরচত্বর থেকে শুরু করে সর্বত্র ফুলের সজ্জা।মন্দিরে-মন্দিরে ,গৃহে-গৃহে হোলির গীত,নৃত্য ,নাটকের অপূর্ব উপস্থাপনা শুরু হয়ে যায় এদিন থেকেই। এরপর চতুর্থীর দিন পালিত হয় লাড্ডু হোলি‌।

মথুরার রাভেলের ভূস্বামী তথা রাধারাণীর পিতা ‘বৃষভানু’ কংসের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের মাথায় সুউচ্চ স্থানে প্রাসাদ গড়লেন । নতুন জনপদ ‘বৃষভানুপুর’(এরই অপভ্রংশ বর্ষাণা)-এর পত্তন হল।সেসময় কংসের নানান অত্যাচারে একইভাবে অতিষ্ঠ নন্দগ্রামবাসীরাও।রাজা বৃষভানু আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বন্ধু নন্দরাজা তথা শ্রীকৃষ্ণের পিতাকে; বললেন, নন্দগ্রামবাসীসমেত বৃষভানুপুরে এসে বাস করতে ।এই বসন্ত চতুর্থীর দিনেই নাকি গোপীগণের চিত্তহারী-চপল-চটুল- নওলকিশোর নন্দকুমার কৃষ্ণ তাঁর গ্রাম নন্দগাঁও থেকে রাধারাণীর গ্রাম বর্ষাণায় এসেছিলেন ।তখন তাঁদের আতিথেয়তা করা হয়েছিল লাড্ডু খাইয়ে।আর তাই,সেদিনের সেই আনন্দ দিবসের স্মরণে আজও বর্ষাণায় লাড্ডু তো খাওয়া হয়ই,তার সাথে চলতে থাকে একে অপরকে লক্ষ্য করে লাড্ডু ছোঁড়াছুঁড়ির পালা;যা লাড্ডু হোলিতে পর্যবসিত হয়। সত্যি,এহেন মিষ্টিমধুর আনন্দময় উৎসব ভারতভূমিতেই বুঝিবা সম্ভব।

ঠিক পরদিন, বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে বর্ষাণায় পালিত হয় লাঠমার হোলি , অর্থাৎ লাঠি দিয়ে মারের হোলি। পড়তে অদ্ভুত লাগছে তাই না! যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে পুরুষরা কোন বিশেষ কার্যে গ্রামে নেই, আর হঠাৎ,কংসের অত্যাচারী দুষ্টু পেয়াদারা এল বর্ষাণায়। তখন মহিলারা আত্মরক্ষা করবেন কীভাবে(!) –তার মহড়া শুরু হল সেখানে। গোপিনীরা লাঠি দিয়ে মেরে শক্তি প্রদর্শন করলেন ,আর মার খেলেন মাথায় বালির বস্তা ,হাতে ঢাল নিয়ে গোপেরা dummy সেজে। মহিলাদের সেই লাঠিখেলা আজও অব্যাহত হয়ে পালিত হয় এই লাঠমার হোলির দিন।তবে তাতে লেগেছে উৎসবের আবেশ,আমেজ আর আনন্দ। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সখারা জোর করে রঙ মাখিয়েছিলেন শ্রীরাধাসহ তাঁর সখীদের। ছদ্ম প্রণয়কোপ প্রকাশ করতে প্রফুল্লিত গোপিনীরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন লাঠি। সেই স্মৃতিতেই তো আজও নন্দগ্রাম থেকে পুরুষরা রঙ মাখাতে আসেন বর্ষাণার মহিলাদের। আর মহিলারা লাঠমার দেন মাথায় ছোট বস্তা বাঁধা,মাটির ঢাল হাতে সজ্জিত পুরুষদের। লাঠির ঘায়ে একজনের ঢাল ভেঙ্গে গেলে,অপরেরটা কেড়ে আত্মরক্ষা করে সে। এভাবে চরম হাসাহাসি,আনন্দ,উৎফুল্লতার মধ্য দিয়ে এই হোলি পালিত হয়।

তারপর ,মূল হোলির উৎসব আগত হয় ; বসন্ত পূর্ণিমার শেষলগ্নের দিন তা পালিত হয়। তবে তার আগের দিন পালিত হয় হোলিকাদহনোৎসব । দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র বালক প্রহ্লাদ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। অনেক প্রকার চেষ্টা করেও , অনেক শিক্ষা দিয়েও যখন প্রহ্লাদের মতিগতির পরিবর্তন করা গেল না , তখন ক্ষুব্ধ হিরণ্যকশিপু স্থির করলেন দুষ্ট গোরুর থেকে শূণ্য গোয়াল ভালো— অর্থাৎ, প্রহ্লাদকে প্রাণে নিধন করবেন। কিন্তু প্রাণে মারার নানান রকম প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল । হতাশ হিরণ্যকশিপুকে দেখে শেষে ভগ্নী হোলিকা বলে বসলেন তিনি এবার হাল ধরবেন‌ । হোলিকা বরপ্রাপ্তা ছিলেন যে তাঁর অঙ্গকে অগ্নি স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি তাই প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে অগ্নিসংযোগ করিয়ে দিতে বললেন তাঁকে চতুর্দিক থেকে। জ্বলন্ত অগ্নির দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠা গ্রাসে ফল হল বিপরীত। দুষ্ট অভিসন্ধি নিয়ে স্বেচ্ছায় অঙ্গে অগ্নিসংযোগ করায় , প্রাপ্ত বর কাজে লাগলো না । হোলিকা জ্বলেপুড়ে ভস্মীভূত হল আর বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কোন ক্ষতি হল না। কথায় আছে রাখে হরি মারে কে ! আসুরী শক্তির , অশুভ উল্লাসের পরাজয় যে সর্বদা হয়— তা স্মরণ করতে ও করাতে এবং আর্য ঋষিদের দ্বারা কৃত উত্তরায়ণের নব বৎসরের দোলযাত্রা উৎসবের আগের দিন পুরাতন আবর্জনা পুড়িয়ে পরিবেশ পরিষ্কার করার ও আগত নব বৎসরের আনন্দের দ্যোতক রূপে পালিত হয় এই হোলিকাদহন উৎসব । প্রচলিত নাম চাঁচর । চাঁচর শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার চর্চরী শব্দ থেকে। অর্থ— উৎসবের হর্ষধ্বনি। খড়, বাঁশ, শরপাতা, পুরানো গাছের ডাল, তালপাতা , নারকেল পাতা—- এসব দিয়ে তৈরী করা হয় ঘরের মত করে স্তূপ। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সেই স্তূপে অগ্নিসংযোগ করে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে হোলিকাদহনোৎসব পালন । এর অপর একটি প্রচলিত নামও আছে —-মেড়াপোড়া । আসুরী শক্তির প্রতীকী রূপে পিটুলি দিয়ে তৈরি একটি ভেড়াকে (যার নাম মেন্ডাসুর) ওই খড়ের ঘরের মধ্যে রেখে দেওয়া হতো। এই অসুর মেন্ডাকে পোড়ানো থেকেই হয় মেড়াপোড়া, যা আরও অপভ্রংশ হয়ে হয় নেড়াপোড়া। মনে পড়ছে , নেড়াপোড়ার সময় আমাদের বাংলায় প্রচলিত এক ছড়া—-আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল , পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল। উল্লেখ্য যে, সম্ভবতঃ হোলিকার নাম থেকেই হোলি উৎসব হয়েছে।

কথিত আছে, নব-নীরদ-বরণ শ্রীকৃষ্ণকে সান্ত্বনা দিতে মা যশোদা তাঁর হাতে রঙ দিয়ে বলেছিলেন, গৌরবর্ণা রাধার গাত্রে লেপন করে তাঁকে নিজের মত এক বর্ণের করে নিতে। সবান্ধব শ্রীকৃষ্ণ লুকিয়ে ছুঁড়লেন রঙ রাধা ও তাঁর সখীদের লক্ষ্য করে। গোপিনীরাই বা দমবেন কেন! তাঁরাও কলসে কাদামাটি গুলে তৎক্ষণাৎ দিলেন ঢেলে কানু আর তার গোপসখাদের মাথায়। ব্যস,মাখামাখি ,হাতাহাতি আনলো হাস্য-পরিহাস আনন্দের বন্যা। সেই থেকে রঙ দেওয়া-নেওয়া খেলার শুরু হয়ে গেল।
ফাগু খেলিতে ফাগু উঠিল গগনে।
বৃন্দাবনের তরুলতা রাতুল বরণে ।।
আবীর ,রঙ,ফাগের স্নানে সমগ্র বৃন্দাবন রেঙে ওঠে । রঙ তো নয় ,যেন হাতভর্তি মুঠো মুঠো ভালোবাসা অর্পিত হয় একে অপরের প্রতি। বর্ণবিদ্বেষকে যেন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেবার দ্যোতক এই দোল উৎসব। মানবের মহামিলনের ,মহানন্দের হাট বসে যেন। আবার ,এই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতেই তো শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ তথা মধ্যযুগের বাঙলার নবজাগরণের নায়ক শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মহাবির্ভাব মর্ত্য মাঝে। সে দিন ছিল ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ,শনিবার সন্ধ্যাবেলা।

কৈছন মধুরিমা, কৈছন রাধাপ্রেম, কৈছন প্রেমে তিঁহ ভোর——অর্থাৎ, রাধার প্রেমের মাধুর্য কেমন, রাধার প্রেমই বা কেমন আর সেই প্রেম আস্বাদন করে রাধা কী জাতীয় সুখ আস্বাদন করেন— এই তিন বাসনা পূরণ করতে তথা জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে শ্রীরাধার ‘ভাব’ কে নিজের হৃদয়ে ধরে , শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি অঙ্গে মেখে শ্রীশ্যামসুন্দর আবির্ভূত হলেন অবনী মাঝে শ্রীগৌরাঙ্গ হয়ে। দোল পূর্ণিমা এবার নবনামে আরো বেশী উজ্জ্বল ও ভাস্বর হল । আরও মহিমাময় হল। গৌরচন্দ্রের গৌরববোজ্জ্বল উদয় হয়েছে যে এই তিথিতে ! তাইতো ‘গৌরপূর্ণিমা’ হল। আহা , কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে -চারিপার্শ্বে ! বসন্ত রাগে শ্রীল নরহরি চক্রবর্তীপাদ গেয়ে উঠলেন তাঁর শ্রীভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে—-
জয় জয় জয় মঙ্গলরব ফাল্গুন পূর্ণিমা ফাল্গুন নিশি নবশোভিত
শচী-গর্ভে প্রকট গৌর বরজ (ব্রজ) রঞ্জনা
ঝলকতবর কনক তনু, কুঙ্কুম থির দামিনী ভানু,
চমকত মুখচন্দ মধুর ধৈরজভর ভঞ্জনা…
গায়ত কিন্নর সুধঙ্গ, বায়ত মৃদুতর মৃদঙ্গ
ধা ধি ধি ধিকিতা ধিক্ ধিক্ ধিক্কট তক ধিন্নানা।

তাই, সব মিলিয়ে ফাল্গুনী পূর্ণিমা এক বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ মধুময় তিথি ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই ঋক্ বেদের সময়কাল থেকে।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

কল্যাণীর সতীমার দোল মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

যতদূর জানা যায়, আনুমানিক দুশো বছর আগে আউলিয়া সম্প্রদায়ের সতীমা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী এই মেলার প্রবর্তন করেন । এপার বাংলা- ওপার বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষপাড়ার সতীমার দোল মেলা । খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষদয়ের নিয়ে গড়ে ওঠে আউলচাঁদ সমাজ । এই সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিলেন আউলচাঁদ । তাঁর মৃত্যুর পর আউল সমাজের কর্তাপদ লাভ করেন রামশরণ পাল । তাঁরই স্ত্রী ছিলেন সরস্বতী দেবী যিনি পরবর্তীকালে সতী মা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন ।
বাউল, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লীগীতির সুরে মেলা জমে ওঠে । আখড়ায় আখড়ায় সারা রাত ধরে বসে গানের আসর । শ্রোতারা অধিকাংশই গ্রাম ও মফঃস্বলের । বিভিন্ন জায়গায় তৈরী হয় লালন মঞ্চ । গানের পাশাপাশি বিশাল উনুন জ্বালিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হয় ঐ আখড়াগুলিতে । দূরদূরান্তের যাত্রীদের আশ্র্যস্থল এই আখড়াগুলি ।


এবার আসছি কর্তাভজা সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদ থেকে বিকশিত একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় । এই সম্প্রদায়ের মূল গুরু আউল চাঁদ ।
প্রথমেই বলি, আউল চাঁদ হলেন একজন বাঙালি ধর্ম প্রচারক ও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু । কিংবদন্তি বা লোকবিশ্বাস যে, গোরাচাঁদ অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যদেব আউল চাঁদ রূপে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন । গৃহী মানুষকে বৈরাগ্য ধর্ম শেখাতে শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হন আউল চাঁদ ফকির হয়ে । এখানে তাই কোনো জাতিভেদ নেই ।
আউল চাঁদের জন্ম খ্রিষ্টাব্দ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে । শোনা যায়, তিনি হিন্দু না মুসলমান সেটা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি । তবে প্রচলিত লোক কাহিনী অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার উলা গ্রামের ( অনেকের মতে, নদীয়া জেলার প্রাচীন জনপদ উলা বীরনগর ) পান ক্ষেত থেকে একটি নবজাতক শিশু পাওয়া যায় । ক্ষেতের মালিক মহাদের বারুই ভগবানের আশীর্বাদ ভেবে তাঁকে লালন-পালন শুরু করেন । বড় হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন । আউল চাঁদের পুরানো নাম পূর্ণচন্দ্র । সংস্কৃত ভাষা শেখানোর জন্য তাঁকে পাঠানো হয় সে সময়কার বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য হরিহরের কাছে । বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং নানাভাবে শিক্ষালাভ করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধিলাভ করেন । তাঁর নতুন নাম হয় ফকিরচাঁদ বা আউল চাঁদ । বহু দেশ ঘোরার পর নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় রামশরণ পাল নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি তাঁকে আশ্রয় দেন । আউল চাঁদের ২২জন শিষ্যের মধ্যে অন্যতম শিষ্য রামশরণ পাল । ২২জনের মধ্যে রামশরণ পাল আউল চাঁদের মৃত্যর পর গুরুপদ প্রাপ্ত হন । যারজন্য তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্তাভজা ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান, যা পরবর্তী সময়ে সতী মায়ের মন্দির নামে সবার কাছে পরিচিত । রামশরণ পালের স্ত্রীর নাম সরস্বতী, যার নামেই এই মন্দির—-সতী মায়ের মন্দির । কথিত আছে, সরস্বতীর প্রথম অক্ষর “স” আর শেষ অক্ষর “তী” অনুসারে সতী । আউল চাঁদের শিষ্য রামশরণ পাল গুরুর ভাবাদর্শকে ভিত্তি করে কর্তাভজা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন । এইজন্য ভক্তের নিকট তিনি “কর্তা” এবং তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী “কর্তামা” নামে অভিহিত । রামশরণ পালের পর সরস্বতী দেবী এই সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেন । রামশরণ পালের স্ত্রী কর্তাভজা সম্প্রদায়কে দিশা দেখান । রামশরণের স্ত্রী সরস্বতী দেবী ছিলেন অতীব ধর্মপরায়ণা । শোনা যায়, আউল চাঁদ হিম সাগরের জল ও ডালিম গাছের তলার মাটির সাহয্যে সরস্বতী দেবীকে অলৌকিক উপায়ে মৃত্যের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন । আরও শোনা যায়, আউল চাঁদই রামশরণ পাল ও সরস্বতী দেবীর সন্তান হয়ে পরবর্তীতে জন্ম নেন দুলাল চাঁদ নামে । দুলাল চাঁদ (১৭৭৬-১৮৩৩) কর্তাভজা সম্প্রদায়কে সাংগঠনিক রূপ দেন । তিনি বহু পদ রচনা করে কর্তাভজা ধর্মমতকে একটা তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত করেন । পদগুলি ভাব-গীত-রূপে ভক্তদের নিকট সমাদৃত । কর্তাভজারা কোনো জাতিভেদ মানেন না । তাঁরা লোভ-মোহ-কাম-ক্রোধকে নৈতিক পাপ বলে মনে করেন । সৎ পথে থেকে এবং মিথ্যা কথা পরিহার করে নৈতিকভাবে ধর্মকর্ম করা তাঁদের প্রধান লক্ষ্য । তাঁর সময়ে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত গড়ায় । মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় । এরপর তাঁর মা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী কর্তা মা বা সতীমা নামে খ্যাতিলাভ করেন ।
নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ার রামশরণ পালের আদি ভিটেটুকু ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র । ভিটের পাশেই ডালিম গাছ । এই গাছের নীচেই যেহেতু সতীমা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেই হেতু ভক্তরা ডালিম গাছের ডালে ঢিল বেঁধে মানত করেন । বাতাসা, কদমা, চিড়ে, মুড়কি দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তদের সতীমাকে পুজো দেওয়ার রীতি ।


জনশ্রুতি, শেষ বয়সে সরস্বতী দেবী সন্তানহারা হলে দোলপূর্ণিমার দিন গুরু পুজার আয়োজন করেন । সেই থেকে দোল পূর্ণিমার সূচনা । হাজার হাজার মানুষের সঙ্গেও বাউলেরা আসেন । তাই সতী মায়ের মেলাটা আউল-বাউলের মেলা বা আখড়া নামে পরিচিত ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় মূর্তিপুজা এবং সকল প্রকার আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী । কর্তাভজা প্রচারক দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান, সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান ।“ উক্ত ভাবের গীত থেকে বোঝা যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজনে মানব সেবার প্রসঙ্গটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । এই প্রসঙ্গে ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “মানুষ ভজ, মানুষ চিন্ত, মানুষ কর সার, সকলি মানুষের খেলা মানুষ বই নাই আর” ।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য । এই সম্প্রদায়ে নারী পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না । এই কারণে গুরুদেবের ভূমিকায় নারী পুরুষ উভয়কেই দেখা যায় । একই ভাবে তাঁরা বাউল সম্প্রদায়ের মতো জাতিভেদ প্রথা মানেন না । দুলাল চাঁদের ভাবের গীতে তাই বলা হচ্ছে—- “ভেদ নাই মানুষে মানুষে, খেদ কেন ভাই এদেশে ।”
সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ে । এ বিষয়ে কবি নবীন চন্দ্র সেনের বক্তব্য অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য । তাঁর মতে, “কর্তাভজা সম্প্রদায়ে কোন জাতিভেদ নেই । সকলেই এক রন্ধনশালার পাক গ্রহণ করে । ছোঁয়াছুয়ির দোষ এদের কাছে মুখ্য নয় । মানুষ সেবা তাঁদের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় ।“
কর্তাভজাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গুরুদেবের পুত্র অযোগ্য হলে তাঁরা তাকে গুরু নির্বাচন করতে চান না । তাঁদের নিয়মাবলী নামক ভাবের গীতে এই প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করে বলা হয়েছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিই গুরুদেব হবার অধিকারী । এই জায়গায় কর্তাভজা সম্প্রদায় বর্ণবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন ।
আজও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীমায়ের কৃপা পাওয়ার নিরিখে যথেষ্ট উন্মাদনা । তাঁদের মধ্যে সরল বিশ্বাস ও ভক্তি আজও উজ্জীবিত । যার জন্য দোল পূর্ণিমার দিন সতী মায়ের মেলায় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে । এদেশ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকেও মেলাপ্রাঙ্গনে অনেক মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো । বাউলদের সমারোহ আলাদা মাধুর্যে ভরপুর থাকে ঘোষপাড়ার এই মেলা । (তথ্যঃ সংগৃহীত) ।
—————-০———–
লেখক কথা সাহিত্যিক (ভারত) / +৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া ‘সরোজিনী নায়ডু’।

ভূমিকা—-

“মহাত্মা গান্ধীর “মিকি মাউস” সরোজিনি নাইডুর মৃত্যুদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।”

সরোজিনী নায়ডু (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯ – ২ মার্চ ১৯৪৯) ছিলেন স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি। তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে সরোজিনী নাইডু অনেকবার কারাবরণ করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পিছু হটেননি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি যোগ দেন ডান্ডি পদযাত্রায়। গান্ধী, আব্বাস তয়েব ও কস্তুরবা গান্ধী গ্রেফতার হলে তিনি ধারাসন সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাগ্মী এবং ইংরেজি ভাষার যশস্বী কবি।  তিনি ভারতীয় কোকিল (দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া) নামে পরিচিত। সরোজিনী নায়ডু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম (ভারতীয়) মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীন ভারতে তিনি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজ্যপালও হয়েছিলেন।

 

 

জন্ম ও পরিবার—

 

১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সরোজিনী চট্রোপাধ্যায় ভারতের হায়দরাবাদ শহরের একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি বরদাসুন্দরী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা।  অঘোরনাথ ছিলেন নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি ও তার বন্ধু মোল্লা আব্দুল কায়ুম ছিলেন হায়দরাবাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সদস্য। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে পদচ্যুত করে হয়। সরোজিনীর ভাই বীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী।

 

 

শিক্ষা—-

 

সরোজিনী নাইডু ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। ১২ বছর বয়সে, তিনি ১২ তম পরীক্ষায় ভাল নম্বর নিয়ে পাস করেছিলেন। তিনি ১৩ বছর বয়সে ‘লেডি অফ দ্য লেক’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যা তাকে বিখ্যাত করেছে। স্কুলে বসে অঙ্কের ১৩০০ লাইনে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এতে হায়দ্রাবাদের নিজাম এত খুশি হয়েছিলেন যে তাকে বিদেশে পড়ার জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজে এবং পরে কেমব্রিজের গ্রিটন কলেজে পড়াশোনা করতে যান। বারো বছর বয়সে সরোজিনী মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সমগ্র মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৯১ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা বন্ধ রেখে তিনি নানা বিষয় অধ্যয়ন করেন। ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজ ও পরে কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফার্সি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। তার প্রিয় কবি ছিলেন পি. বি. শেলি।

 

স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ—–

 

সরোজিনী নাইডু গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং গান্ধীজির চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সত্যাগ্রহ ও সংগঠনে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবেও তাঁর প্রতিভা দেখিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং জেলে যান।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরোজিনী যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, অ্যানি বেসান্ত, সি. পি. রামস্বামী আইয়ার, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন।
১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ভারতের নানা স্থানে যুবকল্যাণ, শ্রমের গৌরব, নারীমুক্তি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বক্তৃতাদান করেন। ১৯১৬ সালে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি চম্পারণে নীলচাষীদের হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৫ সালে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।

 

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন জারি করে সকল প্রকার রাজদ্রোহমূলক রচনা নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করলে সরোজিনী সর্বপ্রথমেই আন্দোলনে যোগ দেন। পরে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনের উপর ব্যাপক দমননীতি প্রয়োগ করে।
১৯১৯ সালের জুলাই মাসে সরোজিনী ইংল্যান্ডে হোমরুল লিগের দূত মনোনীত হন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসের তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পর ১ অগস্ট গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসের দুই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিনিধির অন্যতম রূপে নির্বাচিত হন।
১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি নিউ ইয়র্ক সফর করেন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকান ও আমেরিইন্ডিয়ানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা করেন তিনি। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

 

১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৫ মে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর অনতিকাল পরেই গ্রেফতার হন সরোজিনী। এই সময় কয়েক মাস তিনি কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি, গান্ধীজির সঙ্গে সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়। সেই বছরেই পরে আবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। স্বাস্থ্যহানির কারণে অল্পদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যান সরোজিনী। গান্ধীজি মুক্তি পান ১৯৩৩ সালে। ১৯৩১ সালে গান্ধীজি ও পণ্ডিত মালব্যের সঙ্গে তিনিও গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই সময় গান্ধীজির সঙ্গে ২১ মাস কারারুদ্ধ ছিলেন সরোজিনী।

মহাত্মা গান্ধী যখন স্বাধীনতা নিয়ে দেশে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল তা শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় সরোজিনী নাইডু তাকে ‘শান্তি দূত’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং সহিংসতা বন্ধ করার আবেদন করেছিলেন।

 

 

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সরোজিনী নায়ডুর সম্পর্ক এতটাই অন্তরঙ্গ ছিল গান্ধীজি তাঁকে ‘ভারত নাইটিঙ্গেল’ উপাধি দেন। কিন্তু চিঠিতে তিনি কখনো কখনো ‘প্রিয় বুলবুল’, ‘প্রিয় মীরাবাই’ এমনকি ‘আম্মাজান’, ‘মা’ও মজা করে লিখতেন। সরোজিনীও তাকে ‘তাঁতি’, ‘লিটল ম্যান’ এবং কখনো কখনো ‘মিকি মাউস’ বলে সম্বোধন করতেন।

 

ব্যক্তিগত জীবন—-

 

১৭ বছর বয়সে সরোজিনী ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নায়ডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। উল্লেখ্য, সেই যুগে অসবর্ণ বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। সরোজিনী ব্রাহ্মণ হলেও গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে ১৮৭২ সালের আইন অনুযায়ী তাদের বিবাহ হয়। তাদের চারটি সন্তান হয়েছিল: জয়সূর্য, পদ্মজা, রণধীর ও লীলামণি। কন্যা পদ্মজা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন।

 

কর্ম জীবন—-

 

১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এশীয় সম্পর্ক সম্মেলনের স্টিয়ারিং কমিটির পৌরোহিত্য করেন সরোজিনী নায়ডু।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার পর সরোজিনী নায়ডু যুক্তপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যপাল নিযুক্ত হন।

 

 

তাঁর রচনাবলি—-

 

লেখাপড়ার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। গোল্ডেন থ্রেশহোল্ড ছিল তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাব্য সংকলন ‘সময়ের পাখি’ এবং ‘ব্রোকেন উইং’ তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়কে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা কবিদের মধ্যে অন্যতম মনে করা হয়। বিশ্বনন্দিত অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সাহিত্যিক তার সাহিত্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। পোয়েট্রি সুপ নামের একটি ওয়েবসাইট তাকে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ১০০ জন কবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেখানে তার অবস্থান ছিল ১৯তম। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফারসি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। সরোজিনী নাইডু ইংরেজি ভাষায় কবিতাও লিখতেন।

উল্লেখযোগ্য  রচনাবলি—

The Golden Threshold (১৯০৫);  The Bird of Time: Songs of Life, Death & the Spring (১৯১২); The Broken Wing: Songs of Love, Death and the Spring (১৯১৭);
The Sceptred Flute: Songs of India (১৯৪৩); The Feather of the Dawn (১৯৬১);  The Gift of India;

 

মৃত্যু—-

 

স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি বিক্রমপুর কন্যা ভারতীয় কোকিলা সরোজিনি নাইডু ১৯৪৯ সালের আজকের দিনে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।  তার মৃত্যুর পর যুগ যুগ ধরে এই অতি অসামান্য বিদুষী নারী সমগ্র মহিলাজাতির পথপ্রদর্শিকা হিসেবে সম্মানিত হযে আসছেন।

 

।।ছবি ও তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
নারী কথা রিভিউ

প্রাণে প্রাণে যে প্রদীপ জ্বলে : জয়তী ধর পাল।

একই বৃন্তে যেমন দুটি কুসুম ফুটে ওঠে , তেমনি একটি মহীরূহকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে দুটি সাহিত্যকুসুম। মহীরূহটি অবিভক্ত মেদিনীপুরের জনপ্রিয় গান্ধিবাদী নেতা শ্রী কুমারচন্দ্র জানা , আর সাহিত্যকুসুম দুটির একটি উপন্যাস ‘মাটিমাখা মহাপ্রাণ’ , অপরটি নাটক ‘সুতাহাটার গান্ধি’।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন , নাটকে লোকশিক্ষে হয়। এই লোকশিক্ষে যথার্থ না হলে , স্বাধীন দেশেও আমরা পরাধীন থাকব। আর তাই স্বাধীনতার স্বপ্ন আমাদের যারা দেখিয়েছিলেন তাদের অন্যতম পুরোধা দেশমিত্র কুমারচন্দ্র জানাকে আশ্রয় করে কবি শুভ্রাশ্রী মাইতি লিখেছেন নাটক ‘সুতাহাটার গান্ধি’ , যে নাটক আমাদের স্বাধীনতার যথার্থ চালচিত্রের সাথে পরিচিত করায় আলোর কলমে।
কুমারচন্দ্র জানার ব্যক্তিগত জীবন আর স্বাধীনতার সংগ্রামের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটকে নাট্যকার খুব অল্প পরিসরে এই পাঁচ অঙ্কের নাটকে জীবন্ত করে তুলেছেন এক অসাধারণ দক্ষতায়। সময়ের প্রতীক হিসাবে গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো চরিত্রগুলির ভাষ্য কোরিওগ্রাফির মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান সময়কে বহতা নদীর মতোই উপস্থাপন করেছেন । কোরিওগ্রাফি কোথাও কোথাও মঞ্চে জন্ম দেয় কবিতার…
(অন্ধকার মঞ্চ জুড়ে জোনাকির ছোট ছোট বৃত্ত আলোর নকশা তৈরি করবে তখন। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে সেই দিকে …। আবহ – ও জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ…)।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের মঞ্চ উপস্থাপনা দর্শক মনে জন্ম দেয় শিহরনের…
(ঝুঁকে থাকার সময়রূপী সামনের জন সামনের প্লেটে রাখা লাল আবির ছিটিয়ে দেবে চারপাশে। গুলির শব্দ । পেছনের পর্দায় আলোর ঝলকানি, লাল আলো। চিৎকার। আর্তনাদ। সময়রূপী পাঁচজন লাল কাপড়ের বাঁধনে নিজেদের জড়াতে জড়াতে প্রকাশ করবে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে ধীরে ধীরে।)
ছোট্ট কুমার বিদ্যাসাগরের মতো মহাপুরুষদের গল্প হলেও সত্যি কথা পড়তে পড়তে বড় হয়ে ওঠে , অন্যকে শ্রদ্ধা তার ভেতরে এক আলোর জন্ম দেয় , আর সেই আলো হাজার কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়ার সময় বের করার অঙ্গীকারবদ্ধ করে তাঁকে। কুমার তার জীবনের মূলমন্ত্রে ‘ ঠকিলেও , ঠকাইব না ‘ ( যা বইটির প্রচ্ছদে ধ্রুবপদের মতো ব্যবহৃত হয়েছে ) দীক্ষিত করেন তার ছাত্রদের , যারা এই দেশের ভবিষ্যৎ। নাটকে পাই ,
কুমার : তা পারে। তবে একটা কথা মনে রেখো সবসময়- ‘ঠকিলেও ঠকাইব না’। এই দরিদ্র মাস্টারের আর কিছু না হোক , এই কথাটিকে জীবনের ধ্রুবতারা করে তোলো তোমরা।
সকলে : ঠকিলেও ঠকাইব না। ঠকিলেও ঠকাইব না।
তিনি প্রকৃতই একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে মানুষ গড়ার কারিগরের ভূমিকা নেন তাই বালিগঞ্জ জগবন্ধু ইনস্টিটিউশন এর সভাপতি আশুতোষ চৌধুরী। বলেন,
আশুতোষ : এ একেবারে খাঁটি কথা মুরলীবাবু । কুমারবাবু শুধু পুঁথিপড়া বিদ্যাদিগ্গজ ছাত্র নয় , দেশের জন্য খাঁটি সোনার মানুষ গড়ার কাজে হাত লাগিয়েছেন জোরকদমে। উনি আমাদের স্কুলের সম্পদ।
কুমার অনুভব করেন ‘দেশ মানে শুধু বাহিরমহল নয় , দেশ মানে অন্দরমহলও , আমাদের অন্তরমহলও’। এই উপলব্ধি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত করে …
কুমার : মানে শুধু আমাদের , মানে পুরুষজাতির উন্নতি হলেই হবে না , আমাদের অন্তর ছুঁয়ে আছেন যাঁরা , অন্তর তৈরি করছেন যাঁরা , তাঁদেরও তুলে আনতে হবে ঘরের অন্ধকার কোন থেকে। সামিল করতে হবে এই দেশ গঠনের মহাযজ্ঞে।
তাই স্ত্রী চারুশিলার সাথে বিবাহবন্ধনকে নাট্যকার চিহ্নিত করেছেন ‘শ্রী যোগ হল শক্তির সাথে’ বলে।
হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালবাসা ফিরে ফিরে এসেছে নাটকটিতে। মুহুরি ভূদেব চক্কোত্তির হুমকির উত্তরে কুমার দৃঢ় স্বরে বলেন,
কুমার : আমাকে ভাঙবেন আপনি কি করে ? আমাকে ভাঙতে গেলে যে এই আশ্রম ভাঙতে হবে। এই দেশ ভাঙতে হবে , ভাঙতে হবে হিন্দু-মুসলমানের ভাই-ভাই সম্পর্ক। তা কি আর আমি হতে দেবো কখনো? তোমরা কি দেবে বলো?
কুমার যখন এ কথা বলেন তখন কুমারের মধ্যে যেন অখন্ড গোটা ভারতকে দেখতে পাই তাই। কুমারনারায়ন তথা কুমারচন্দ্র হয়ে ওঠেন মহম্মদ কুমারচন্দ্র ,
মৌলভী : ( ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেন কুমারকে ) আপনি সাধারণ মানুষ নন কুমারবাবু , আজ আপনি চোখ খুলে দিলেন সবার। আপনাকে প্রণাম। আজ থেকে আপনার আরেক নাম হল মহম্মদ কুমারচন্দ্র ।
সকলে : জয় কুমারচন্দ্রের জয় , মহম্মদ কুমারচন্দ্রের জয়।
নাট্যকার প্রতিটি চরিত্রের মুখে যথাযথ সংলাপ প্রয়োগ করে তাদের করে তুলেছেন জীবন্ত রক্ত মাংসের মানুষ। তারই কয়েকটি নিদর্শন ,
১. মিস্টার স্মিথ : শাট্ আপ , রাস্কেল ! কে চায় টুমাদের সাহায্য ? ব্ল্যাক নিগার কোথাকার । টুমি যে হাসছিলে হামার ড্রেসের কাদা ডেকিয়া… সেটা কি অপমান নয় যথেষ্ট ?
২. গোমস্তা : খালি বিগ্ টক , বিগ বিগ টক্ , তাই না ! বুঝবে একদিন মজা… একটা ছোট জাতকে মাথায় তুলে নাচা…
৩. ফতেমা : (ছুটে এসে কুমারের পায়ে পড়ে কাঁদতে থাকে) দাঠাউর মুই কুন অন্যায় কাম করি নাই গো। প্যাটের জ্বালা নিভাতে , মেয়া লাতির মুখে দুটা অন্ন তুলি দিবার জন্য কাম করিতে চাইছিলি শুধু । এ গেরামে মোর খসমের ভিটাবাড়ি। মুই কখনো এর অমঙ্গল চাইতি পারি?
৪. কুমার : জানি না সূর্য । বুকের মধ্যে কে যেন ডাক দিয়ে যায় বারবার । গাঁয়ের ফকিরবাবার সুর ভেসে আসে কানে । গান্ধিজির গলার স্বর গমগম করে ওঠে, সুরেনবাবুর বক্তৃতায় শিরা-উপশিরায় আগুন ছোটে যেন… আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল হয় খুব। কান্না দলা পাকিয়ে উঠে গলায়। আমার মা আমার দেশ – সব যেন একাকার হয়ে যায় আমার কাছে।
বেশিরভাগ দৃশ্য শেষ হচ্ছে গানের মধ্যে দিয়ে যা ঘটনা রেশকে দর্শকমনে অনুরণিত করে।
পরানচক স্কুলের মাস্টারমশাই মানসবাবু বলেন,
মানসবাবু : কুমার , তোমার মধ্যে আমি খাঁটি সোনা দেখেছি। আমি চাই তোমার মত ছেলেরা নিজেকে প্রস্তুত করে তুলুক । নিজেকে চিনুক। দেবদূত হয়ে ফিরে আসুক এ পোড়া দেশ গাঁয়ে। মানুষের সামনে আয়না ধরুক , নিজেকে চেনার নিজেকে জানার… আঁধার কেটে যাক সব নতুন দিনের আলোয় …ওই শোনো ফকির বাবা গান ধরেছেন কেমন…
নাটকটিও যেন দর্শকদের সামনে তুলে ধরে এক আয়না, যার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয় আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন।
নাটকের শেষে সময়ের হাত ধরে তৈরি হয়, এক অপূর্ব কবিতা …অপূর্ব আলো… অপূর্ব বন্দনা …অনন্ত …অফুরন্ত…
(সকলে একটি সুন্দর কোরিওগ্রাফিতে মাটিতে হাঁটু ঠেকিয়ে বসবে। প্রদীপজ্বলা হাত বাড়িয়ে থাকবে সামনে… নতুন দিনের আলো একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়বে নাটকের মঞ্চেও। )
আবহে বাজবে –
ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
তোমারি হউক জয়…

‘মাটিমাখা মহাপ্রাণ’ এক আলোমাখা উপন্যাস , এ আলো ভোরের সূর্যোদয়ের মতোই আশাবাদী , দুপুরের তেজদীপ্ত গগনের মতোই অগ্নিময় , সন্ধ্যের গোধূলির মতোই স্নিগ্ধ শান্তি বর্ষণকারী।
একজন মহামানবের জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে লেখক শুভঙ্কর দাস যে চালচিত্র রচনা করেছেন …যে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এঁকেছেন… তাতে সমকালীন দেশ কালকে নিপুন বুনোটে সাজিয়েছেন। লেখনীর অমোঘ আকর্ষণে সময়দেবীর সুতোতে টান পড়েছে , সেই টানে যেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বিদ্যাসাগর , গান্ধীজি , বীরেন্দ্র শাসমল , আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র , মদনলাল ধিংড়ার মতো অসামান্য চরিত্ররা , তেমনি বিধবা হররমা পতি বা রমানাথের মত আড়ালে থেকে যাওয়া নিঃস্বার্থ মানুষেরা তাদের আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। আর আছেন রবীন্দ্রনাথ , প্রতিটি অধ্যায়ের পথ চলার শুরুতে তাঁর আলোকোজ্জ্বল উদ্ধৃতি নিয়ে পথপ্রদর্শক হয়ে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে লেখকের মনের মাধুরী মিশিয়ে কিছু কাল্পনিক চরিত্র , যারা উপন্যাসটিকে মাটির রূপকথা করে তুলেছে এক আশ্চর্য রূপটানে। যেমন আব্দুল ফকিরের চরিত্রটি বারবার ফিরে ফিরে এসেছে , যে গানে গানে প্রকৃত মানুষ হবার শিক্ষা দেয় , যে বলে ,
‘মনকে বলো , জগতে সবই সুন্দর , কালো এলে আলো করব , আর কান্না এলে পান্না দেখব , এইভাবেতে বাঁচতে চাই…।’
রবীন্দ্রনাথের কথায় , ‘ ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূলরস হবে মানবরস ‘। এই উপন্যাসের প্রতিটি অক্ষরে সেই মানবরসের ধারা নদীর মতই বহমান। দেশের জন্য আত্মোৎসর্গের দৃঢ় পণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সন্তানস্নেহ , ভ্রাতৃপ্রেম ,সহধর্মিণীর আত্মত্যাগ , বন্ধুবাৎসল্য , গুরুজনকে শ্রদ্ধার দৃঢ় ভিত্তি প্রস্তরের উপর। কুমারের বাবা গরিব চাষী ঠাকুরদাস একটা ছেঁড়া বইয়ের পাতা নিয়ে ঘোরেন বইটি সংগ্রহের চেষ্টায় , যার জন্য তিনি নিজের সারা বছরের অন্নসংস্থানে চাল বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত। এই উত্তরাধিকারই বহন করেন কুমার। শিশু কুমার ঝড় জলের সারারাত কেঁদে কেঁদে খোঁজে বর্ণপরিচয় , উঠোনকে স্লেট করে লিখে চলে অ আ। কুমারের মা লক্ষ্মীদেবী পানাভর্তি পুকুর পরিষ্কার করে , পুকুরপাড়ে ডাঁই হয়ে ওঠা কচুরিপানা দেখিয়ে বলেন ,
‘এই হচ্ছে দুঃখ কষ্ট আর আঘাত , পুকুর হলো জীবন , এইভাবে এগুলো সরিয়ে আলো আনতে হবে , এগিয়ে যেতে হবে , বুঝলি…’
এমন শিক্ষা যে মায়ের , তাঁর সন্তানই তো হয়ে ওঠেন অন্ধকারে নিমজ্জিত পরাধীন জাতির আলোর দিশারী। স্ত্রী চারুশীলাদেবী স্বামীর জন্য ভাত সাজিয়ে বসে থাকেন , মৃদু হেসে বলেন ,
‘যে অপেক্ষা করতে জানে, সে যার জন্য অপেক্ষা করছে , তার পদধ্বনি শুনতে পায়।’
এরকম সহধর্মিনীকে যিনি পাশে পান , তিনিই তো পারেন… একদিন ঘর ও বাহির মিলে এই দেশকে সোনার দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে…। মাস্টারমশাই ক্ষীরোদচন্দ্র কুমারের হাতে ‘আনন্দমঠ’ তুলে দিয়ে বলেন,
‘ মানুষের মতো মানুষ হও , তুমি যেন নিজেই একটা পথ হয়ে উঠতে পারো।’
এইরকম মাস্টারমশায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়েই কুমারচন্দ্র বন্ধু গঙ্গাধরকে বলে ,
‘ ভাই , আমি ধুলোর মতো হতে চাই , মাড়িয়ে যাক , থুতু ফেলুক , কিন্তু আমি তো জানি , সেই ধুলোতে জল ঢেলে কখনো মূর্তি , কখনো শস্য ফলানো যায় ! এই বিশ্বাস আমার কোনদিন হারাবে না ! ‘
এই মাটিমাখা মহাপ্রাণের ছোঁয়ায় তাই মাটি জাগে , সেইসঙ্গে জাগে মাটিমাখা মানুষগুলো , যাদের কেউ কোনদিন সম্মান করেনি , মানুষ ভাবেনি !
উপন্যাসিক শুভঙ্করের প্রথম পরিচয় তিনি একজন কবি , তাই কবির কলমে উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনা কোথাও কোথাও কবিতার ব্যঞ্জনায় হয়ে উঠেছে এক এক টুকরো উজ্জ্বল হীরকখন্ড ! উপন্যাসটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতির পর কবিতার ব্যঞ্জনায়…
‘চার্চের সুউচ্চ ঘন্টা-তোরণের পেছনে অস্তমিত সূর্য । দেখলে মনে হয় , সুদীর্ঘ ও সুতীব্র অন্ধকার দূর করতে করতে নিজেই তীরবিদ্ধ যোদ্ধার মতো ক্লান্ত , রক্তাক্ত এবং একাকী । সেই চার্চে এখনই ঈশ্বর-বন্দনা শুরু হবে। তার জন্য ঘন্টাধ্বনি হচ্ছে।’
অথবা , বালক কুমারের অধ্যয়নমগ্নতার বর্ণনা…
‘দূর থেকে দেখলে মনে হতো এ যেন সেই তপোবনের একটি খণ্ড দৃশ্য । সেখানে ছিল অপরূপ সবুজ গাছগাছালির সৌন্দর্য , এখানে মাঠের পর মাঠে রোদ মেঘের লুকোচুরি খেলা।
তার মধ্যে একজন একলব্যের মতো সেই রোদ-মেঘকে গুরু কল্পনা করে পড়াশুনা করে চলেছে।’
এইভাবে হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি চলে কবিতা আর উপন্যাস …তৈরি করে এক খন্ড মানব ইতিহাস !

আজকের এই দিশেহারা সমাজে নিজেকে দীপ করে জ্বালতে হবে , সেই আলোয় পথ দেখে চলতে হবে … নব প্রাণের আলোয় সমাজকে করতে হবে কলুষমুক্ত। আর সেই জীবনদীপে সলতে পাকানোর কাজটি করে দেয় , কুমারচন্দ্র জানার মত সৎ কর্মযোগী দেশপ্রেমিক সাধক মহামানবদের জীবনীপাঠ। দেশকে ভালো না বাসলে দেশের মানুষকে ভালো না বাসলে কখনোই প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা যায় না , তাইতো মানবজমিন পতিত রয়ে যায়। এইরকম নাটক , উপন্যাস , কবিতা, গল্প , প্রবন্ধ গ্রন্থ লেখা ও পাঠের মধ্যে দিয়ে সেই মানবজমিনে সোনা ফলানোর আশায় অপেক্ষায় থাকে সময় …

সুতাহাটার গান্ধি
শুভ্রাশ্রী মাইতি
লিপি প্রকাশন

মাটিমাখা মহাপ্রাণ
শুভঙ্কর দাস
লিপি প্রকাশন

Share This