Categories
প্রবন্ধ

ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের অব্যর্থ পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে ব্রজোকিশোর চক্রবর্তী প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন। ব্রজোকিশোর চক্রবর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে।

 

ব্রজোকিশোর চক্রবর্তী (১৯১৩ – ২৫ অক্টোবর ১৯৩৪) ছিলেন একজন ভারতীয় বিপ্লবী এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য যারা ভারতের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার প্রয়াসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলেন।  ম্যাজিস্ট্রেট বার্গকে হত্যার অভিযোগে ১৯৩৪ সালের ২৫ অক্টোবর রামকৃষ্ণ রায়ের সাথে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

 

পরিবার—-

 

ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ১৯১৩ সালে বল্লভপুরে (পশ্চিম মেদিনীপুর) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল উপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।  তিনি ব্রিটিশ ভারতের একটি বিপ্লবী সংগঠন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে যোগ দেন। ব্রজকিশোর ছাত্রাবস্থায় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন।

 

বিপ্লবী কার্যক্রম—

 

ম্যাজিস্ট্রেট প্যাডি ও রবার্ট ডগলাস হত্যার পর কোনো ব্রিটিশ অফিসার মেদিনীপুর জেলার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।  মিঃ বার্নার্ড ই জে বার্গ, একজন নির্মম জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে মেদিনীপুর জেলায় পোস্ট করা হয়েছিল।  বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সদস্যরা হলেন রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, প্রভাংশু শেখর পাল, কামাখ্যা চরণ ঘোষ, সোনাতন রায়, নন্দ দুলাল সিং, সুকুমার সেন গুপ্ত, বিজয় কৃষ্ণ ঘোষ, পূর্ণানন্দ সান্যাল, মণীন্দ্র নাথ চৌধুরী, সানজান রঞ্জন চৌধুরী, রঞ্জন দাস।  সেন, শৈলেশ চন্দ্র ঘোষ, অনাথ বন্ধু পাঞ্জা ও মৃগেন্দ্র দত্ত প্রমুখ তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।  রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, নির্মল জীবন ঘোষ এবং মৃগেন্দ্র দত্ত মিডনাপুরের পুলিশ গ্রাউন্ডে ফ্রান্সিস ব্র্যাডলি ব্র্যাডলি-বার্ট এর নামে একটি ফুটবল ম্যাচ (ব্র্যাডলি-বার্ট ফুটবল টুর্নামেন্ট) খেলার সময় তাকে গুলি করে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন।  বার্গ একজন অত্যন্ত চতুর এবং সতর্ক অফিসার কখনই তার বাড়ি থেকে বের হন না, তার বাংলোর চারপাশে উচ্চ নিরাপত্তার বেড়া দেন।  এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই এবং আগস্টের মধ্যে মাস কেটে যায় বার্নার্ড ফুটবল খেলার প্রতি অনুরাগী, তার স্ব-আরোপিত কারাদণ্ড শিথিল করে
২রা সেপ্টেম্বর বার্গ পুলিশের মাঠে ফুটবল ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নেয়, এইবার মৃগান দত্ত ও অনাথ বন্ধু পাঞ্জা বার্গের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন।

 

১৯৩৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ সাহেব মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মোহামেডান স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে মেদিনীপুর ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতে নামেন। খেলা প্রাকটিসের ছল করে বল নিয়ে মাঠে নামেন অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। মাঠেই দুই বন্ধু বার্জ সাহেবকে আক্রমণ করলে তিনি মারা যান। জোন্স নামে একজন আহত হন। পুলিস প্রহরী দুজনের উপর পাল্টা গুলি চালায়। এতে তারা দুজন নিহত হন এবং অপর সঙ্গীরা পলায়ন করতে সক্ষম হন।

এই ঘটনার পর ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, নন্দদুলাল সিং, কামাখ্যা ঘোষ, সুকুমার সেন, সনাতন রায়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলা হয়। বিচারে  ব্রজ ও রামকৃষ্ণকে বার্নাডের মৃত্যুদণ্ডের অভিযোগে বন্দী করা হয়, ১৯৩৪ সালের ২৫শে অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং পরের দিন ২৬ অক্টোবর নির্মল জীবন ঘোষকে ।নন্দদুলাল সিং, কামাখ্যা ঘোষ, সুকুমার সেন এবং সনাতন রায়-এর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খুনের অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন অনাথ বন্ধু পাঞ্জা ও মৃগেন্দ্র দত্ত।মেদিনীপুরের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট ছিল না।

মৃত্যু–

ম্যাজিস্ট্রেট বার্গকে হত্যার অভিযোগে ১৯৩৪ সালের ২৫ অক্টোবর রামকৃষ্ণ রায়ের সাথে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে তিনি ফাঁসিতে শহীদ হন।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

কিশোর কুমার ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক এবং নায়ক, জন্ম দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি l

কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমার কে চেনেননা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বে তিনি এক অতি পরিচিত নাম। সঙ্গীতের আকাশে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । কিশোর কুমার ছিলেন ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক। সাধারণত তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে বিবেচিত হন।

 

কুমার ছিলেন একজন বাঙালি পেশাজীবী পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান।কিশোর কুমার ১৯২৯ সালের ৪ ই আগস্ট ৪ টের সময় মধ‍্যপ্রধেশের খান্ডোয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের নাম আভাস কুমার গঙ্গোপাধ‍্যায়। তাঁর ডাক নাম ছিল কিশোর। তাঁর পিতার কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী। তিনি ছিলেন উকিল। তাঁর মাতার নাম গৌরি দেবী, তিনি ছিলেন একজন গৃহকর্তী।

কুঞ্জলাল গাঙ্গুলীর পৈতৃক বাড়ি ও জন্মস্থান হলো ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে (বর্তমান নাম মুন্সীগঞ্জ)। কুঞ্জলাল জীবিকার তাগিদে মধ্য প্রদেশে চলে যান। কিশোর কুমারের জন্মনাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সবথেকে বড় ছিলেন অশোক কুমার তারপর সীতা দেবী। তারপর অনুপ কুমার আর অনুপ কুমারের থেকে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন কিশোর কুমার। যখন তিনি একজন কিশোর ছিলেন, তিনি বোম্বে টকিজ ফিল্ম স্টুডিওতে মাঝে মাঝে কোরাস গায়ক হিসাবে বোম্বেতে (এখন মুম্বাই) চাকরি পেয়েছিলেন, যেখানে তার বড় ভাই অশোক কুমার ছিলেন বর্তমান তারকা।  যদিও তাঁর হৃদয় ছিল গান গাওয়ার মধ্যে, ছোট কুমার ১৯৪৬ সালে ননডেস্ক্রিপ্ট ফিল্ম শিকারীতে অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ করেন।  এটি ছিল ১৯৫১ সালের আন্দোলনের রিলিজ, যা তাকে গায়ক-অভিনেতা হিসাবে স্টারডমে প্ররোচিত করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে তার ভাই অশোকের ছায়া থেকে মুক্ত করেছিল।

 

চার স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারের- রুমা গুহ ঠাকুরতা, মধুবালা, যোগিতাবালি এবং লীনা চান্দাভাকর। কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী এবং বাঙালি গায়িকা-অভিনেত্রী রুমার ছেলে অমিত কুমার। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত বিবাহবন্ধবে আবদ্ধ ছিলেন তাঁরা। রুমা গুহঠাকুরতা (১৯৫০-১৯৫৮), মধুবালা (১৯৬০-১৯৬৯), যোগিতা বালী (১৯৭৫-১৯৭৮) এবং লীনা চন্দাভারকর (১৯৮০-১৯৮৭)। কিশোরের প্রথম পুত্র (রুমা গুহ ঠাকুরতার সাথে) অমিত কুমার একজন বিখ্যাত গায়ক। কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী রুমা গুহ ঠাকুরতা এবং কিশোর কুমারের সুযোগ্য সন্তান অমিত কুমার তার বাবার মত সাফল্য না পেলেও বেশ কিছু কালজয়ী হিন্দি ও বাংলা সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন। কিশোরের ছোট ছেলে সুমিত কুমার। সুমিত কুমার ছিলেন লীনা চন্দ্রভারকারের সন্তান।

 

খাদ্যাভাসে তাঁর ছিল খাঁটি বাঙালিয়ানা। তিনি পছন্দ করতেন বাঙালী খাবার । লুচি মাংস, আলুরদম, বেগুন ভাজা ইত‍্যাদি।  তিনি এতটাই মাছের প্রতি দূর্বল ছিলেন যে তাঁর সাথে যদি কেউ  দেখা করতে আসেন তাহলে তাঁর জন‍্য সেই অতিথি মাছ নিয়ে আসতেন। এমনকি তাঁকে গান রেকর্ডিং এ রাজি করানোর জন‍্য মাছ ঘুষ দিতেন। ঈলিশ মাছ ছিল তাঁর প্রিয়।তিনি মদ‍্যপান করতেন না।

 

কিশোর কুমার বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালয়ালম, ওড়িয়া, এবং উর্দু। এছাড়াও তিনি তার ব্যক্তিগত গান সংকলনেও বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন, বিশেষত তার বাংলায় গাওয়া গানগুলি সর্বকালের ধ্রুপদী গান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তিনি ৮ বার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়কের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন এবং একই বিভাগে সর্বাধিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার বিজয়ের রেকর্ড করেছেন। তাকে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং তার নামে হিন্দি চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য কিশোর কুমার পুরস্কার প্রদান চালু করে।কিশোর কুমারের গান বাংলা সঙ্গীতজগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালির সংষ্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতাবে জড়িয়ে রয়েছেন কিশোর কুমার। তার উদাত্ত কণ্ঠ মাধুর্য্য বাঙালিকে এখনও মুগ্ধ করে রেখেছে।

শধু গায়ক হিসাবে নন, তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের একজন নামি অভিনেতাও ছিলেন। তবে তিনি তাঁর প্রথম জীবনে গায়ক হিসেবে ততটা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি যতটা তাঁর পাওয়া উচিত ছিল। তবুও তিনি অভিনেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তার অভিনীত বিখ্যাত কয়েকটি হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে বাপ রে বাপ (১৯৫৫), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), হাফ টিকিট (১৯৬২), পড়োশন (১৯৬৮), হাঙ্গামা (১৯৭১), পেয়ার দিবানা (১৯৭৩), বাড়তি কা নাম দাড়ি (১৯৭৪)। এছাড়া অন্যান্য চলচ্চিত্রের ভিতর রয়েছে নোকরি, বন্দী, দূর গগন কি ছাঁও মে, দূর কা রাহি প্রভৃতি।  তিনি সুদক্ষ অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও অভিনয় বস্তুটি অতটাও পছন্দ করতেন না। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল সঙ্গীত।

 

ভারতের প্লেব্যাক গায়কদের শীর্ষে কুমারের উত্থান একটি অসাধারণ কীর্তি ছিল।  পেশায় তার সহকর্মীদের থেকে ভিন্ন, যাদের বেশিরভাগই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন, কুমারের কোনো আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত প্রশিক্ষণ ছিল না।  তবুও, তিনি একজন দক্ষ অনুকরণকারী, দোভাষী এবং উদ্ভাবক ছিলেন।  তিনি রঙিন টিমব্রাল ইফেক্ট ব্যবহার করেছেন—যেমন ইয়োডেলিং—তার কণ্ঠে, বৈদ্যুতিক অঙ্গ এবং অন্যান্য অ্যাটিপিকাল যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং উচ্ছ্বসিত ছন্দে তার অভিনয়কে প্রাণবন্ত করেছেন।  এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি শেষ পর্যন্ত কুমারের সামগ্রিক শব্দে আধুনিকতার একটি আকর্ষণীয় অনুভূতি প্রদান করেছে।

 

কিশোর কুমার সর্বমোট ২,৭০৩টি গান গেয়েছেন, যার মধ্যে ১১৮৮টি হিন্দি চলচ্চিত্রে, ১৫৬টি বাংলা এবং ৮টি তেলুগু ভাষায়।

 

প্লেব্যাক করা বাংলা ছবি—-

 

 

কবিতা, গুরুদক্ষিণা, জীবন মরণ, জ্যোতি, তুমি কত সুন্দর, অমরকন্টক, আশ্রিতা, অনিন্দিতা, অমর সঙ্গী, দোলন চাঁপা, পাপ পুণ্য, অমানুষ, বান্ধবী, মিলন তিথি, অন্তরালে, বৌমা, মোহনার দিকে, সঙ্কল্প, আনন্দ আশ্রম, রাজকুমারী, অন্যায় অবিচার, লুকোচুরি, অনুসন্ধান, সুরের আকাশে, দেবিবরণ, জীবন মরণ ইত্যাদি।

 

জনপ্রিয় বাংলা গান—

 

তোমায় পড়েছে মনে, নীল নীল আকাশে, সেদিনও আকাশে ছিল কত তারা, আমার মনের এই ময়ূর মহলে, আমার পূজার ফুল, এক পলকের একটু দেখা, এ আমার গুরুদক্ষিণা, একদিন পাখী উড়ে যাবে যে আকাশে, এই যে নদী, চিতাতেই সব শেষ, হাওয়া মেঘ সরায়ে, কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, কি উপহার সাজিয়ে দেব, কত মধুর এ জীবন, এই যে নদী, চেয়েছি যারে আমি, নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে, সেই রাতে রাত ছিলো পূর্ণিমা, চোখের জলের হয় না কোনো রং, কেন রে তুই চরলি ওরে, কথা দিলাম, প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে, শুনো শুনো গো সবে।

 

অভিনয় এবং গানের পাশাপাশি কুমার ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত রচনা করেছিলেন।  তিনি দূর গগন কি ছাওঁ মে (১৯৬৪) এবং দূর কা রাহি (১৯৭১) সহ বেশ কয়েকটি প্রযোজনাও পরিচালনা করেছিলেন।  হালকা হৃদয়ের চলচ্চিত্রগুলির বিপরীতে যেখানে তিনি সাধারণত একজন অভিনেতা, গায়ক বা সুরকার হিসাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কুমার যে চলচ্চিত্রগুলি পরিচালনা করেছিলেন সেগুলি প্রায়শই ট্র্যাজেডি ছিল।

 

তিনি বেশ কয়েকটি গানের জন‍্য পরপর আটবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এখনো পর্যন্ত পরপর এতবার কেউ পায়নি। যে গান গুলির জন‍্য পেয়েছেন সেগুলি হল-  রুপ তেরা মস্তানা (১৯৭০), দিল অ্যাইসা কিসি নে মেরা (১৯৭৬), খাইকে পান বানারাস ওয়ালা (১৯৭৯), হাজার রেহেন মুডকে দেখেন (১৯৮১), পাগ ঘুঙরু বাধ( ১৯৮৩), আগার তুম না হতে (১৯৮৪), মাঞ্জিলে আপনি জাগা হ‍্যান ( ১৯৮৫), সাগর কিনারে (১৯৮৬)। ১৯৭৫ সালে কোরা কাগজ সিনেমায় গানের জন‍্য  “সেরা নেপথ্য গায়ক” হিসাবে পুরষ্কার পান। এছাড়া আরো সিনেমায় পুরষ্কার পান। সেগুলি হল,  আনন্দ (১৯৭১), আন্দাজ (১৯৭২), হরে রাম হরে কৃষ্ণ (১৯৭৫)।

 

আজ কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারের মৃত্যুবার্ষিকী। শেষ জীবনটা বড্ড একাকীত্বে কাটছে। ১৯৮৭ সালের ১৩ ই অক্টোবর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটার্কে তাঁর মৃত‍্যু হয়। মৃত‍্যুর আগের দিনেও অর্থাৎ ১২ অক্টোবর তিনি স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং করেন।আইকনিক গায়ক এবং অভিনেতা তাঁর গাওয়া বেশ কয়েকটি হিট গান এবং অনেক স্মরণীয় ছবিতে অভিনয়ের জন্য সকলের মনে এখনও জায়গা করে আছেন ও থাকবেন চিরদিন।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

 

 

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

সপ্তাহের কয়েকটা দিন একদম নির্জনে কাটাতে চাইলে ঘুরে আসুন অহলদারা।

ঘুরতে কে না ভালোবাসে। বিশেষ করে বাঙালিরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেশায়। কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র আবার কেউ প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান ভালোবাসে ভ্রমণ করতে। প্রকৃতি কত কিছুই না আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। কতটুকুই বা আমরা দেখেছি। এ বিশাল পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই দেখিনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আজ গোটা পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়় এলেও প্রকৃতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা এ এক আলাদা রোমাঞ্চ, আলাদা অনুভূতি যার রেষ হৃদয়ের মনিকোঠায় থেকে যায় চিরকাল।। তাইতো আজও মানুষ বেরিয়ে পড়়ে প্রকৃতির কে গায়ে মেখে  রোমাঞ্চিত হওয়ার নেশায়। কেউ চায় বিদেশে ভ্রমণে, আবার কেউ চায় দেশের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণে।

 

আপনি কি কখনো পাহাড়ের চূড়ায় থেকেছেন?  একদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য সহ একটি পাহাড়ের চূড়া এবং অন্যদিকে তিস্তা নদী দ্বারা বিভক্ত চা বাগান!  আপনি যদি এখনও পরিদর্শন না করে থাকেন তবে একবার চেষ্টা করে দেখুন।  এটা আপনার ইন্দ্রিয় আপ অনুভব করা যাচ্ছে। মানুষের তৈরি কোনো বস্তু দ্বারা আপনার দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে না।  তোমার কান শুনবে বাঁশির হাওয়া, মিস হয়ে গেছে এত বছর ধরে।  আপনি শ্বাস নেবেন যা আপনার পুরো শরীরকে শক্তি দেবে।  শেলপু পাহাড়ের একটি মনোরম পাহাড়ের চূড়া অহলদারা NJP থেকে মাত্র  ২ ঘন্টার দূরত্বে।  এটি কেবল কাঞ্চনজঙ্ঘা র উপর সূর্যোদয়ের চমৎকার দৃশ্য, তাজা অক্সিজেন এবং জৈব খাবারের জন্য উপযুক্ত নয় বরং এটি একটি দুর্দান্ত এবং অবিস্মরণীয় সপ্তাহান্তও তৈরি করে।

এমনি এক ভ্রমণ এর জায়গা হলো অহলদারা।

 

অহালদারার মূল আকর্ষণ হল এখানকার পাহারেরে ৩৬০ ডিগ্রী  ভিউ ও এখান থেকে দেখতে পাওয়া বরফ আশ্রিত কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ দৃশ্য এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সাথে ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া । আকাশ পরিস্কার থাকলে এই অহলদারা থেকে  কার্শিয়ং, দার্জিলিং, কালিম্পং , চিমনি , প্রভিতি অঞ্চলের পাহাড় ও সমতলে বয়ে চলা তিস্তা নদি ও তরাই দুয়ারস ও অঞ্চল ও দেখতে পারবেন।

 

শিলিগুড়ি থেকে অনতিদুরে সেল্পু হীলে অবস্থিত একটি পাহাড়ি চুড়া হল Ahalara View Point ।এই পাহাড়ি চুড়াটির একদিকে পাইনের গাছ ও অপর দিকে দিগন্ত বিস্ত্রিত ঢেউ খেলান পাহাড় ও সমতলে বয়ে চলা তীস্তা নদীর  অপরুপ দৃশ্য।

 

এই অহলদারার মূল আকর্ষণ হল এখানকার ৩৬০ডিগ্রি পাহারের ভিউ তার সাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং আকাশ পরিস্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য যা আপনার মনকে প্রফুল্লিত করে তুলবে। পাহাড়ের চুড়াতে অবস্থিত হওয়াতে ও  আশেপাশে কোন কোলাহল না হওয়ার কারনে এখানে বসে প্রকৃতির রুপ উপভোগ করতে করতে ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে  অনায়াসে দিন কাটিয়ে ফেলতে পারবেন গোটা দিন।

 

অহালদারাতে আপনারা বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি ও পাখি ও দেখতে পারবেন, এছাড়া এখানে সিঙ্কনা গাছের চাষ ও হই।
এছাড়াও অহালদারার আশেপাশে দেখতে পারেন…

লাতপাঞ্চার(Latpanchar)–  অহালদারা থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই লাতপাঞ্চার , এই লাতপাঞ্চার হল পাখি প্রেমি দের জন্য সর্গরাজ্য, এটি Mahananda Wildlife Sanctuary এর একটি পার্ট । এখানে আপনারা দেখতে পাবেন ২৪০ ধরনের বিরল প্রজাতির পাখি যেমন Sultan Tit, Red-Headed Trogan, Orient Hornbill, Rufous Hornbill, প্রভিতি। এছাড়াও এখানে দেখতে পাবেন Cinchona Plantation   এর কারখানা যেখানে Quinine তইরি করা হয়।

ণাম্থিং পোখরি(Namthing Pokhri) – সেল্পু হীল এ অবস্থিত একটি প্রাচিন জলাশয় , এটি বছরের ৬ মাস শুকন থাকে বর্ষা কাল বাদে। এই নাম্থিং পোখরিতে এক ধরনের বিরল প্রজাতির Himalayan Salamander দেখতে পাওয়া যাই । এছাড়াও এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতি দেখতে পাবেন। অহালদারা থেকে এই স্থানটি খুব একটা দুরে নই হাটা পথে এখানে পৌঁছে যেতে পারেন।

সিটং(Sittong) – অহালদারা থেকে প্রায় ৩২ কিমি দূরে অবস্থিত এই গ্রাম টি কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত , সিটং কে কমলালেবুর গ্রামও বলা হয় , আপানারা এই সিটং থেকেউ ঘুরে আসতে পারেন।

টেগোর হীল – অহালদারা থেকে অনতি দূরে অবস্থিত এই পাহাড়টিকে স্থানিওরা টেগোর হীল নামেউ ডেকে থাকে । এই পাহাড়ের আকর্ষণ হল এই পাহাড়টির আকৃতি  কবিগুরু  রবিন্দ্রনাথ এর মুখের মত , দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন কবিগুরু শায়িত অবস্থাই আছেন।

 

 

আহলদারায় বহিরঙ্গন কার্যক্রম–

 

সূর্যোদয় পয়েন্ট–

আহলদরা কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়ার উপর সূর্যোদয়ের আশ্চর্যজনক দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত।  একটি উজ্জ্বল এবং রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, গ্যাংটক, কালিম্পং, আলগারা, বাগোরা, তিনচুলি পাহাড়গুলি এই বিন্দু থেকে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়৷

 

শিটং কমলার বাগানগুলি

 

আহলদরা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে শিটং গ্রাম৷  গ্রামে প্রচুর কমলার বাগান রয়েছে।  অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে কমলালেবুর গাছে ফল দিয়ে ভরা হয়।

 

পাখি পালন

 

লাটপানচার একজন আগ্রহী পাখি পর্যবেক্ষক এবং একজন ফটোগ্রাফার জায়গাটিকে তাদের স্বর্গ বলে মনে করবেন।  সাধারণ পাখিরা দেখেছে সুলতান টিট, রেড হেডেড ট্রোগান, ওরিয়েন্ট হর্নবিল, রুফাস হর্নবিল, লং-লেজ হর্নবিল, কমন গ্রিন ম্যাগপাই, দার্জিলিং উডপেকার, ওরিয়েন্টাল কোকিল, চেস্টনাট-হেডেড টেসিয়া, কালো গলা সানবার্ড।

 

বেঙ্গল সাফারি—

 

বেঙ্গল সাফারি পার্কের মধ্যে অবস্থিত।  মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের বনাঞ্চল হল উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের প্রথম প্রাণী সাফারি পার্ক।  আপনি এখানে চিতাবাঘ, বাঘ এবং বিড়ালের মতো প্রাণী দেখতে পাবেন।

 

Ahaldara কাছাকাছি আকর্ষণ—

 

শেলপু পাহাড়—

শেলপু পাহাড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মোহনীয় আয়না।  অন্ধকার, গভীর জঙ্গল এবং চিনচোনা উদ্ভিদ স্থানটির প্রকৃত উষ্ণতাকে চিত্রিত করে।  সমস্ত ঋতুতে ফুলের অপ্রতিরোধ্য সুগন্ধে বাতাস ভারী থাকে৷

 

করোনেশন ব্রিজ —

 

একটি একক খিলান দ্বারা সমর্থিত, সেতুটি তিস্তা নদী পেরিয়ে জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং জেলাগুলির সাথে সংযোগ স্থাপন করে একটি বিস্ময়কর এবং অবশ্যই দর্শনীয় পর্যটন স্পট৷

 

মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য—

 

অন্যতম এই অভয়ারণ্যের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ যা  ১৫৮ বর্গকিলোমিটারের বেশি বন এলাকা জুড়ে রয়েছে।  ১৯৫৮ সালে, এটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং ভারতীয় বাইসনকে রক্ষা করার জন্য অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।  এই প্রাণীগুলি ব্যতীত, অন্যান্য উপলব্ধ প্রাণী হরিণ, বার্কিং ডিয়ার, ভাল্লুক, প্যাঙ্গোলিন, হিমালয় কালো ভাল্লুক এবং চিতাবাঘ।

নমথিং পোখরি —-

 

শিল্প পাহাড়ের কাছে অবস্থিত হ্রদটি বছরের ছয় মাস শুকিয়ে যায় এবং হিমালয়ান সালামান্ডারের জন্মভূমি হিসাবে বিখ্যাত।  , একটি অস্বাভাবিক এবং বিপন্ন প্রজাতি।

 

পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক —-

 

চিড়িয়াখানাটি ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রধানত স্নো চিতাবাঘ, বেঙ্গল টাইগার এবং অনেক বিদেশী প্রাণীর জন্য বিখ্যাত।  পার্কটি ৬৭.৫৬ একর জমি জুড়ে রয়েছে।

 

ঘূম মনাস্ট্রি —-

পর্যটকদের মধ্যে এই জনপ্রিয় গন্তব্যটি ইগা চোয়েলিং মনাস্ট্রি নামেও পরিচিত।  বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রাচীন গৌরবে আঁকা মৈত্রেয় বুদ্ধের ১৫ ফুট উঁচু মূর্তিটি এই অঞ্চলের প্রাচীনতম মঠগুলির মধ্যে একটি।

 

 

কিভাবে আহলদারা পৌঁছাবেন

বায়ু–

বাগডোগরা বিমানবন্দরটি আহলদারার নিকটতম।  বিমানবন্দর থেকে, রিসোর্টে পৌঁছাতে সড়কপথে ১.৫ ঘন্টা (প্রায়) সময় লাগবে।

রেলওয়ে—

আপনি যদি ট্রেন পেতে চান, হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে যে কোনও মুর্সিদাবাদগামী ট্রেনে চড়েন, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে যান, বিশ্রাম তাদের দ্বারা নেওয়া হবে।

রাস্তা—-

জাতীয় এবং রাজ্য সড়ক দিয়ে ১৪ ঘন্টা (প্রায়) গাড়ি চালানো আপনাকে আপনার গন্তব্যে নিয়ে যাবে।  NJP থেকে জায়গাটি মাত্র ২ ঘন্টার পথ।

আহলদারা দেখার সেরা সময়—

গ্রীষ্মে মনোরম আবহাওয়া অতিথিদের আহলদারায় আমন্ত্রণ জানায়।  ভূমিধসের কারণে বর্ষা এড়ানো যায় তবে আহলদরা এড়ানোর মতো উচ্চতা নয়।  যেখানে বর্ষা জীবনে আসা ছোট জলপ্রপাতের একটি চমৎকার দৃশ্য দেয়।  পরাক্রমশালী তিস্তাও এই সময়ে তার পূর্ণ গৌরব পায়।  নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে পাহাড়গুলি দেখার জন্য সবচেয়ে পরিষ্কার এবং মেঘহীন আকাশ দেয়।  কমলার বাগান দেখার জন্যও এই মাসগুলো সেরা সময়।  পাহাড়ে বসন্ত রঙিন হয়ে ওঠে অসংখ্য রঙিন ফুলে।

 

।। তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

সুনীল ছেত্রী, প্রথম ভারতীয় খেলোয়াড় যিনি তিনটি ভিন্ন মহাদেশে খেলেছেন।

সুনীল ছেত্রী (জন্ম ৩আগস্ট ১৯৮৪) একজন ভারতীয় পেশাদার ফুটবলার যিনি একজন ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলেন এবং ইন্ডিয়ান সুপার লিগ ক্লাব বেঙ্গালুরু এবং ভারত জাতীয় দল উভয়েরই অধিনায়ক । তিনি তার লিঙ্ক-আপ খেলা, গোল করার ক্ষমতা এবং নেতৃত্বের জন্য পরিচিত। সক্রিয় খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি তৃতীয়-সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলদাতা , শুধুমাত্র ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং লিওনেল মেসির পরে , সামগ্রিকভাবে চতুর্থ, এবং এছাড়াও তিনি সর্বাধিক ক্যাপড খেলোয়াড় এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা।ভারতের জাতীয় দলের। দেশের জন্য তাঁর অবদানের জন্য তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় ফুটবলারদের একজন হিসাবে বিবেচিত।

 

 

সুনীল ছেত্রী ৩ আগস্ট ১৯৮৪-এ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স কর্পস অফ ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের অফিসার কেবি ছেত্রী এবং ভারতের সেকেন্দ্রাবাদে সুশীলা ছেত্রীর কাছে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ভারতীয় সেনা ফুটবল দলের হয়ে ফুটবল খেলতেন , তার মা এবং তার যমজ বোন নেপাল মহিলা জাতীয় দলের হয়ে খেলেন । ছেত্রী ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন। ৪ ডিসেম্বর ২০১৭-এ, ছেত্রী তার দীর্ঘদিনের বান্ধবী সোনম ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেন যিনি প্রাক্তন ভারতীয় আন্তর্জাতিক এবং মোহনবাগান খেলোয়াড় সুব্রত ভট্টাচার্যের কন্যা ।

 

 

ছেত্রী ২০০২ সালে মোহনবাগানে তার পেশাদার কর্মজীবন শুরু করেন , JCT- এ চলে যান যেখানে তিনি ৪৮টি খেলায় ২১ গোল করেন। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সন্তোষ ট্রফির ৫৯ তম আসরে সুনীল দিল্লি দলের অংশ ছিলেন । গুজরাটের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক সহ সেই টুর্নামেন্টে তিনি ছয় গোল করেছিলেন । দিল্লি কোয়ার্টার ফাইনালে কেরালার কাছে হেরেছিল এবং সে ম্যাচেও গোল করেছিল। তিনি মেজর লিগ সকার দল কানসাস সিটি উইজার্ডসের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন২০১০ সালে, উপমহাদেশের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিদেশ গমন করেন।  তিনি ভারতের আই-লিগে ফিরে আসেন যেখানে তিনি বিদেশে ফিরে যাওয়ার আগে চিরাগ ইউনাইটেড এবং মোহনবাগানের হয়ে খেলেন, প্রাইমিরা লিগার স্পোর্টিং সিপি- তে , যেখানে তিনি ক্লাবের রিজার্ভ সাইডের হয়ে খেলেন ।
ছেত্রী ভারতকে ২০০৭ , ২০০৯ , এবং ২০১২ নেহেরু কাপের পাশাপাশি ২০১১ , ২০১৫ , ২০২১ এবং ২০২৩ SAFF চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে সাহায্য করেছিলেন । এছাড়াও তিনি ২০০৮ এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে ভারতকে জয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন , যা তাদের ২৭ বছরে তাদের প্রথম এএফসি এশিয়ান কাপে যোগ্যতা অর্জন করেছিল,  ২০১১ সালের ফাইনাল টুর্নামেন্টে দুবার গোল করে । ছেত্রী ২০০৭, ২০১১, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৭, ২০১৮-১৯ এবং ২০২১-২২ সালে রেকর্ড সাতবার AIFF বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন ।

 

 

রেকর্ড—-

 

(ক) প্রথম ভারতীয় খেলোয়াড় যিনি তিনটি ভিন্ন মহাদেশে খেলেছেন।

(খ) ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি খেলা (১৪২)

(গ) ভারতীয়দের দ্বারা সর্বাধিক আন্তর্জাতিক গোল (৯২)

(ঘ) ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিক (৮)

(ঙ) AFC প্রতিযোগিতায় ভারতের হয়ে সর্বাধিক গোল (১৯)

(চ) সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা (২৩)

(ছ) এএফসি কাপে ভারতীয়দের দ্বারা সর্বাধিক সংখ্যক ম্যাচ খেলা (৪০)

(জ) এএফসি কাপে ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশি গোল (১৯)

(ঝ) প্রথম স্তরের ভারতীয় ফুটবল লিগে ভারতীয়দের দ্বারা সর্বাধিক গোল (১৪৩)

(ঞ) ইন্ডিয়ান সুপার লিগে হ্যাটট্রিক করা প্রথম ভারতীয় খেলোয়াড়।

(ট) ইন্ডিয়ান সুপার লিগে ভারতীয়দের দ্বারা সর্বাধিক হ্যাটট্রিক (২)

(ঠ) ইন্ডিয়ান সুপার লিগে সর্বোচ্চ ভারতীয় গোলদাতা (৫৬)

(ড) আই লিগে সর্বোচ্চ ভারতীয় গোলদাতা (৯৪)

(ঢ) সুপার কাপে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৯)

(ণ) বেঙ্গালুরুর হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন (২৫৯)

(ত) বেঙ্গালুরুর পক্ষে সর্বাধিক সংখ্যক গোল (১১৫)

(থ) খেলরত্ন পুরস্কার পাওয়া প্রথম ফুটবলার।

(দ) রেকর্ড সাতবার এআইএফএফ বর্ষসেরা খেলোয়াড়।

 

 

স্বতন্ত্র সম্মাননা—-

AIFF বর্ষসেরা খেলোয়াড় (৭): ২০০৭, ২০১১, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৭, ২০১৮-২০১৯, ২০২১–২০২২

FPAI ইন্ডিয়ান প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার (৩): ২০০৯, ২০১৮, ২০১৯

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট (৪): ২০১১ , ২০১৫ , ২০২১ , ২০২৩

SAFF চ্যাম্পিয়নশিপের শীর্ষ স্কোরার (৩): ২০১১ , ২০২১ , ২০২৩

ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের হিরো : ২০১৮

আই লিগের হিরো : ২০১৬-২০১৭

আই-লিগ গোল্ডেন বুট : ২০১৩-২০১৪

ইন্ডিয়ান সুপার লিগের হিরো : ২০১৭-২০১৮

২ইন্ডিয়ান০১৮ সুপার কাপ : গোল্ডেন বুট

ভারতীয় ক্রীড়া সম্মান : স্পোর্টসম্যান অফ দ্য ইয়ার ২০১৯ (টিম স্পোর্টস)

ফুটবল দিল্লি কর্তৃক ফুটবল রত্ন পুরস্কার (প্রথম প্রাপক) : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

টাইমস অফ ইন্ডিয়া TOISA সেরা ফুটবলার: ২০২১

অন্যান্য—

২০২২- বিশ্বকাপের আগে , FIFA সক্রিয় খেলোয়াড়দের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয়-সর্বোচ্চ পুরুষ আন্তর্জাতিক গোল স্কোরার হওয়ার জন্য ছেত্রীকে তার জীবন এবং কেরিয়ার সম্পর্কে তিনটি তথ্যচিত্রের পর্ব প্রকাশ করে এই অনুষ্ঠানে সম্মানিত করেছে।

AFC এশিয়ান আইকন: ৩ আগস্ট ২০১৮

২০১৯ এএফসি এশিয়ান কাপ : প্রিয় খেলোয়াড় (ভক্তদের ভোট)

এএফসি কাপ সর্বকালের একাদশ (দ্য স্ট্রাইকার্স): ইনডাক্টি (২০২১)

 

 

ছেত্রী তার অসামান্য ক্রীড়া কৃতিত্বের জন্য ২০১১ সালে অর্জুন পুরস্কার পান , ২০১৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার, ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ২০২১ সালে, তিনি খেলা রত্ন পুরস্কার পান , ভারতের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সম্মান এবং এই পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম ফুটবলার হন।

 

ভারতীয় ফুটবলে তিনিই কিংবদন্তি। সেই সুনীল ছেত্রী  ৩৯ বছর সম্পূর্ণ করলেন বৃহস্পতিবার। ১৯৮৪ সালে আজকের দিনেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশে। জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা আর সবচেয়ে বেশি গোল করার নজির রয়েছে সুনীলের সাফল্যের ঝুলিতে। ভারতীয় ফুটবলের আইকন সুনীল ছেত্রী’র জন্মদিনে তাঁকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।

 

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম আচার্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জন্ম দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ব্রিটিশ আমলে ভারতের একজন বিশিষ্ট হিন্দু সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী চৈতন্য মহাপ্রভুর ব্যক্তিগত শিক্ষক এবং সহযোগী অদ্বৈত আচার্যের ১০ তম প্রজন্মের বংশধর হিসাবে “অদ্বৈত পরিবার ” (পরিবার) এর অন্তর্গত । ভারতের ইতিহাসে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম আচার্য। শিক্ষার প্রসার ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

 

জন্ম ও শিক্ষা—

 

প্রভুপাদ শ্রী বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী (গোসাইজি) ১৮৪১ সালের ২ আগস্ট শিকারপুর ( নদিয়া ), আনন্দ কিশোর গোস্বামী এবং স্বর্ণময়ী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন । সন্তানের আকাঙ্ক্ষায়, আনন্দ কিশোর গোস্বামী প্রভু শান্তিপুর থেকে জগন্নাথ মন্দির, পুরিতে যান , সারা পথ ধরে দন্ডবত প্রণাম করেন। এই যাত্রাপথে তাঁর পুরী পৌঁছতে দেড় বছর লেগেছিল । যে রাতে তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পৌঁছেছিলেন , মনে করা হয় যে তিনি জগন্নাথ স্বামীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, যিনি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি তার পুত্র হিসাবে জন্ম নেবেন। এইভাবে আনন্দ কিশোর গোস্বামী আশ্বস্ত হয়ে শান্তিপুরে ফিরে আসেন. ঘরের সীমানার বাইরে জন্ম নেওয়া সাধুদের জন্য এটি একটি সাধারণ প্যাটার্ন। ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মেছিলেন নিম গাছের নীচে, ভগবান যীশু খ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল একটি খাঁচায়, এবং গৌতম বুদ্ধের জন্ম লুম্বিনী বাগানে একইভাবে গোসাঁইজিও শিকারপুরে (নদিয়া) একটি কলকাসিয়া ঝোপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  তিনি অদ্বৈতাচার্যের বংশধর ছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ শান্তিপুরে গোবিন্দ গোস্বামীর টোলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করেন। তারপর কিছুদিন তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়ন করেছিলেন।

 

ব্রাহ্মসমাজে যোগদান ও প্রচার–

 

১৮৬৪ সালের মধ্যে গোসাঁইজি আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন আচার্য ছিলেন । ব্রাহ্ম আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করার সাথে সাথে আচার্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে প্রবীণ রক্ষণশীল আদি ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের এবং কেশুব চন্দ্রের নেতৃত্বে সমাজের নতুন সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেন _ ফলস্বরূপ, গোসাঁইজি আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং কেশব চন্দ্র সেনের নতুন সমাজে যোগ দেন যাকে বলা হয় ভারতের ব্রাহ্মসমাজ । নতুন ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে গোসাঁইজি নারীদের শিক্ষা এবং বাল্যবিবাহ রোধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কাজ করেনবাল্যবিবাহের নিষেধাজ্ঞা অর্জনের জন্য। ভারতের মহিলাদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে, তিনি উমেশ চন্দ্র দত্ত সম্পাদিত বামাবোধিনী, তত্ত্ববোধিনী, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বাংলা পত্রিকায় অবদান রাখতে শুরু করেন। বামাবোধিনী পত্রিকায় “আশাবতী” ছদ্মনামে তাঁর লেখা ব্যাপক মনোযোগ ও শ্রদ্ধা পায়; এই লেখাগুলো পরে “আসহাবাতির উপখান” নামে একটি গ্রন্থে সংকলিত হয়।
১৮৭৪ সালে গোসাইজির প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ প্রাঙ্গনে সংকীর্তন আন্দোলনের উত্থান ঘটে। গোসাঁইজি এই সময়কালে অসংখ্য ব্রাহ্ম গান রচনা করেন। এই সময়কালে গোসাইজি সারা ভারতে ব্রাহ্ম উপাসনার প্রচার শুরু করেন, তিনি বিহার , উত্তর প্রদেশ , আসাম এবং পাঞ্জাবের অভ্যন্তরীণ অংশে ব্রাহ্মধর্মের উপদেশ দিয়ে যান। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গেও তিনি কাজ করেন। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রহ্মসমাজের আচার্য হন। তার উদ্যোগে শান্তিপুর, ময়মনসিংহ, গয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

নব্যবৈষ্ণব আন্দোলন—

 

১৮৭৪ থেকে ১৮৭৮ সালের মধ্যে গোসাইজির জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। একজন প্রচারক হিসাবে, তিনি ভারতের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের মধ্য দিয়ে হেঁটেছেন, কখনও কখনও শুধুমাত্র জল পান করে এবং নদীর তীরের কাদা খেয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী গয়াতে সাধুদের সংস্পর্শে এসে বৈষ্ণবধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে তার সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের মতবিরোধ হয় এবং তিনি ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণব সাধনায় মগ্ন হন। তিনি যে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন তা নব্যবৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন নব্যবৈষ্ণব আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব। নারীর উন্নতি ও স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি। অশ্বিনীকুমার দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ‍্যায় প্রমুখ ব‍্যক্তি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।সন্ন‍্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় অচ‍্যুতানন্দ সরস্বতী।

 

দক্ষিণেশ্বরে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাথে সাক্ষাৎ–

 

গুরুর সন্ধানে গোসাঁইজি হিন্দু আধ্যাত্মবাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি বাউল , কাপালিক , কর্তাভজা প্রভৃতি বৈচিত্র্যের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর এই সময়কালে দক্ষিণেশ্বরে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। গোসাঁইজিকে দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্তব্য করলেন, “আত্মা যখন আকাশে উড়ে যায়, তখন শরীরকে খাঁচায় রাখবে কেন?” – ইঙ্গিত ছিল যে গোসাঁইজির ব্রাহ্মসমাজের একজন পুরোহিতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ার এবং একজন সন্ন্যাসীর মুক্ত জীবনযাপন করার সময় এসেছে। তিনি যোগীরাজ গম্ভীর নাথ, সিদ্ধ সহ সেই সময়ের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সাধুদের সাথেও দেখা করেছিলেননবদ্বীপের চৈতন্য দাস বাবাজি , কালনার সিদ্ধ ভগবান দাস বাবাজি এবং মহাত্মা ত্রৈলঙ্গ স্বামী ।

 

শিষ্য—

 

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য শিষ্যরা কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী, কিরণ চাঁদ দরবেশ, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

 

মৃত্যু—

বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বিএস ( গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৪ জুন ১৮৯৯ ) পুরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ঘুরে আসুন হুগলির চন্দননগর শহরের ২ টি দর্শনীয় স্থান –সেক্রেড হার্ট চার্চ ও নন্দদুলাল মন্দির।

ঘুরতে কে না ভালোবাসে। বিশেষ করে বাঙালিরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেশায়। কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র আবার কেউ প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান ভালোবাসে ভ্রমণ করতে। প্রকৃতি কত কিছুই না আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। কতটুকুই বা আমরা দেখেছি। এ বিশাল পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই দেখিনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আজ গোটা পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়় এলেও প্রকৃতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা এ এক আলাদা রোমাঞ্চ, আলাদা অনুভূতি যার রেষ হৃদয়ের মনিকোঠায় থেকে যায় চিরকাল।। তাইতো আজও মানুষ বেরিয়ে পড়়ে প্রকৃতির কে গায়ে মেখে  রোমাঞ্চিত হওয়ার নেশায়। কেউ চায় বিদেশে ভ্রমণে, আবার কেউ চায় দেশের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণে। এমনি এক ভ্রমণ এর জায়গা হলো  হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত চন্দননগর। এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ রাখতে বাধ্য।চন্দননগর , এটির পূর্ব নাম চন্দেরনাগর এবং ফরাসি নাম চন্দ্রনাগর দ্বারাও পরিচিতভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার একটি শহর। এটি চন্দননগর মহকুমার সদর দফতর এবং এটি কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ) দ্বারা আচ্ছাদিত এলাকার একটি অংশ।  হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই শহরটি ফরাসি ভারতের পাঁচটি জনবসতির মধ্যে একটি ছিল । ঔপনিবেশিক বাংলোগুলিতে ইন্দো-ফরাসি স্থাপত্য দেখা যায়, যার বেশিরভাগই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।।

এই নিবন্ধে আপনি চন্দননগরের নিম্নলিখিত ২টি জনপ্রিয় ভ্রমণ স্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন—

 

(ক) সেক্রেড হার্ট চার্চ

(খ) চন্দননগর মিউজিয়াম।নন্দদুলাল মন্দির

 

 

(ক) সেক্রেড হার্ট চার্চ—-

 

সেক্রেড হার্ট চার্চ, চন্দননগর  হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার চন্দননগরে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী চার্চ।  এই গীর্জার একটি অসাধারণ চমৎকার সাদা পাথরের সম্মুখভাগ এবং চিত্তাকর্ষক অভ্যন্তর রয়েছে। বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি Jacques Duchatz এই গীর্জাটি প্রতিষ্ঠা করেন।
সূর্যাস্তের সময় চার্চটিকে আরও সুন্দর দেখায়। বর্তমানে গির্জাটি পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।  এটির গঠনটি ভারতে ফরাসি স্থাপত্যশৈলীর একটি খাঁটি অভিব্যক্তি।  সেক্রেড হার্ট চার্চটি ২৭ জানুয়ারী ১৮৮৪-এ কলকাতার আর্চবিশপ পল গোথালস দ্বারা উদ্বোধন করা হয়েছিল।  চন্দননগরে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ১৮৭৫ সালে নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৮৮৪ সালে রেভারেন্ড এম. বার্থেটের অনুরোধে তার ভাই জোয়াকিমের সহায়তায় এটি সম্পন্ন হয়।  এটি ফরাসি স্থপতি জ্যাক ডুচাটজ দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছে।

২০০ বছরের পুরানো ফ্রেঞ্চ-স্টাইলের সেক্রেড হার্ট ক্যাথলিক চার্চটি একটি শ্বাসরুদ্ধকর উপাসনার স্থান।।

 

 

(খ) নন্দদুলাল মন্দির—

চন্দননগর একটি ঐতিহ্যবাহী শহর যার আনাচে কানাচে এমন অনেক মন্দির আছে যা বহু প্রাচীন। এই চন্দননগরেই অবস্থিত শ্রীশ্রী নন্দদুলাল জিউর মন্দির। ঐতিহ্য এবং প্রাচীনত্বের সংমিশ্রণ এই মন্দির। প্রতিবছর বহু দর্শনার্থীরা পূর্ণ লাভের আশায় এখানে আসে। চন্দননগরের  লালবাগান  অঞ্চলে  শ্রীদুর্গা  ছবিঘরের  কাছে  নন্দদুলাল  মন্দির  বিখ্যাত।  মন্দিরটি  ১১৪৬  বঙ্গাব্দে ( ১৭৩৯  খ্রীষ্টাব্দে )  চন্দননগরের  তদানীন্তন  ফরাসি  সরকারের  দেওয়ান  ইন্দ্রনারায়ণ  চৌধুরী  প্রতিষ্ঠা  করেন।নন্দদুলাল মন্দির চন্দননগরের মনোমুগ্ধকর শহরে অবস্থিত।শ্রীশ্রী নন্দদুলাল জিউর মন্দিরের আকার এবং কারুকার্য খুবই অনন্য। এটি সম্পূর্ণ পোড়া মাটির তৈরি। মাঝারি উচ্চতার ভিত্তি বেদির উপর স্থাপিত সমতল যা ছাদবিশিষ্ট ও দক্ষিণমুখী দালান। এর দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং প্রস্থ প্রায় ১১ ফুট। একবাংলার বা দোচালা সংলগ্ন দালান থাকায় মন্দিরের স্থায়িত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একবাংলাটির উচ্চতা মূল মন্দিরের চেয়ে বেশী। মন্দিরটির সামনে ও পশ্চিমদিকের দেওয়ালে পোড়ামাটির কয়েকটি ছোট ছোট ফুলের কাজ আছে। মন্দিরে শ্রীশ্রী নন্দদুলাল জিউর বিগ্রহ নিত্য পূজিত হয়। পরবর্তীকালে এই মন্দিরটি সংস্করণও করা হয়। মন্দির সংস্কারের পরেও বহুদিন মন্দিরে কোনো বিগ্রহ ছিল না। মন্দিরে পুরানো বিগ্রহের ছবিকেই পুজো করা হত। তবে ২০০৫ সালে বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পুরানো বিগ্রহের ছবিটি বর্তমান বিগ্রহের পাশে রাখা আছে। মন্দিরটি প্রাচীন ভারতীয় নিদর্শনগুলির একটি চমৎকার উদাহরণ। এখানে যেতে হলে হাওড়া থেকে ব্যান্ডেলগামী ট্রেনে উঠতে হবে। নামতে হবে চন্দননগর রেলওয়ে স্টেশনে।  এরপর টোটো বা রিক্সায় করে পৌঁছে যেতে পারবেন এই মন্দিরে ।
এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি অনন্য মন্দির রয়েছে যা দেবী কালী, মহাদেব এবং অন্যান্য দেবতাদের প্রতি পূজনীয় যা চমৎকার কারুকাজ এবং শৈল্পিক অনুভূতি প্রদর্শন করে।এই অঞ্চলের কয়েকটি মন্দিরের সাথে মন্দিরের ডিভাইডারগুলি খোদাই করা আছে এবং ধর্মীয় আইকন দিয়ে সুসজ্জিতও করা আছে।

 

।। তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

গোয়ার ৪ টি দর্শনীয় সমুদ্র সৈকত।

ঘুরতে কে না ভালোবাসে। বিশেষ করে বাঙালিরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেশায়। কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র আবার কেউ প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান ভালোবাসে ভ্রমণ করতে। প্রকৃতি কত কিছুই না আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। কতটুকুই বা আমরা দেখেছি। এ বিশাল পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই দেখিনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আজ গোটা পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়় এলেও প্রকৃতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা এ এক আলাদা রোমাঞ্চ, আলাদা অনুভূতি যার রেষ হৃদয়ের মনিকোঠায় থেকে যায় চিরকাল।। তাইতো আজও মানুষ বেরিয়ে পড়়ে প্রকৃতির কে গায়ে মেখে  রোমাঞ্চিত হওয়ার নেশায়। কেউ চায় বিদেশে ভ্রমণে, আবার কেউ চায় দেশের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণে। এমনি এক ভ্রমণ এর জায়গা হলো  আমাদের আর এক রাজ্য গোয়া । এখন আমরা জানব গোয়ার চারটি সমুদ্র সৈকত সম্পর্কে।

 

সিঙ্কেরিম সৈকত

 

 সমুদ্র সৈকত আপনাকে তার মনোরম বালুকাময় সৈকত বরাবর হাঁটার আমন্ত্রণ জানায়। আপনি সাঁতার সহ বিভিন্ন ধরণের জল-ভিত্তিক খেলাধুলা এবং উত্তেজনাপূর্ণ ক্রিয়াকলাপগুলিতে অংশ নিতে পারেন, তবে আপনি কেবল সাঁতার কাটতে পারেন। এই সৈকতের রাতের জীবন বেশিরভাগ সময় সঙ্গীত উত্সব দ্বারা প্রভাবিত হয়। এখানে প্রচুর সংখ্যক হোটেল এবং অন্যান্য ধরণের রিসর্ট রয়েছে। এছাড়াও, আশেপাশের এলাকায় অনেক চমৎকার রেস্তোরাঁ রয়েছে যা তাদের সুস্বাদু খাবার এবং পানীয়ের জন্য পরিচিত। প্রচুর ট্যাক্সি, মোটরসাইকেল এবং বাস পাওয়া যায় বলে সিঙ্কেরিমে যাওয়া সহজ।

অশ্বেম সৈকত

 

অশ্বেম সমুদ্র সৈকত হল একটি দীর্ঘ এবং পরিষ্কার দৈর্ঘ্যের বালি যা জনসাধারণের কাছ থেকে দূরে অবস্থিত, এটি ভ্রমণকারীদের জন্য একটি দুর্দান্ত অবস্থান তৈরি করে যারা শান্তিপূর্ণ ছুটি চান যেখানে তারা যেতে পারেন সূর্য, বালি এবং তরঙ্গে ভিজিয়ে রাখুন। অশ্বেম সৈকতের আশেপাশের জল সাঁতারের জন্য আদর্শ, এবং এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীটি শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ প্রদান করে যারা এখনও সমুদ্রের ঢেউ পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট বয়সী নয়। আপনি স্থানীয় রিসর্টগুলির একটিতে স্পা দিনে নিজেকে চিকিত্সা করে বা আয়ুর্বেদিক ম্যাসেজ করতে গিয়ে আরও আরাম করতে পারেন, উভয়ই তাদের শান্ত প্রভাবের জন্য পরিচিত। এই অঞ্চলে অনুশীলন করা আয়ুর্বেদিক ম্যাসেজগুলি অত্যন্ত উচ্চ মানের এবং দক্ষতার স্তরের।

মিরামার সৈকত

 

গোয়ানদের জন্য, মিরামার বিচ মুম্বাইয়ের চৌপাট্টির সাথে তুলনীয়। এর প্রধান দর্শনার্থীরা গোয়ানরা, যারা সকালে বা সন্ধ্যায় অবসরে হাঁটার জন্য তাদের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে আসে। ফলস্বরূপ, এটি সম্ভবত গোয়ার যেকোনো স্থানের তুলনায় সবচেয়ে কম পর্যটন পরিবেশ রয়েছে। একটি শক্তিশালী আন্ডারকারেন্টের উপস্থিতির কারণে, এই সৈকত সাঁতারের জন্য উপযুক্ত নয়। ভিউ নেওয়ার পাশাপাশি এখানে কিছু কেনাকাটা করাও সম্ভব। এটি প্রায়শই গোয়ার সৈকতগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয় যা পরিবারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস ভারতে এই অবস্থানে ভ্রমণের জন্য আদর্শ।

মর্জিম সৈকত

 

যারা নিজেদের মধ্যে রাখতে চান তারা মরজিম বিচকে পছন্দ করবেন। এই সৈকত, যা চাপোরা নদীর উত্তরে পাওয়া যায়, এটি একটি বালুকাময় সমুদ্র সৈকতের একটি অত্যাশ্চর্য উদাহরণ এবং এটি গোয়ার সমুদ্র সৈকতগুলির মধ্যে একটি যা প্রতিদিন খুব কম দর্শক দেখে। অলিভ রিডলি কচ্ছপ হল এই সৈকতে শোয়ের তারকা কারণ এটি তাদের জন্য বাসা বাঁধার আবাসস্থল। মর্জিম সৈকত এক ধরণের বাস্তুশাস্ত্র রয়েছে যা এই ধরণের কচ্ছপের বিকাশ এবং ডিম থেকে বাচ্চা বের করার প্রচার করে, এটি তাদের বসবাসের জন্য একটি আদর্শ জায়গা করে তোলে। এর ফলস্বরূপ মরজিম বিচকে একটি নতুন ডাকনাম দেওয়া হয়েছে: টার্টল বিচ। অত্যাশ্চর্য সূর্যাস্তের দৃশ্যের প্রশংসা করার সময় 3-কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত দীর্ঘ হাঁটার জন্য উপযুক্ত।

 

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় সম্বন্ধে দুটি কথা : দিলীপ রায়।

আমাদের দেশের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ  বন্দোপাদ্যায়কে শৈশব থেকেই মুগ্ধ করত  । যার জন্য তিনি নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন গ্রাম বাংলার এখানে সেখানে লুকিয়ে থাকা ঝোঁপ-জঙ্গল, লতা-পাতা, বিভিন্ন ধরনের ফুল, নানান প্রজাতির পশু-পাখি, পথ-ঘাট, নদী-নালা, ইত্যাদি । পরবর্তী কালে  প্রকৃতির প্রতি  তাঁর অগাধ ভালবাসার  অভিজ্ঞতা নানাভাবে তাঁর রচনাকে প্রভাবিত ও  সমৃদ্ধ করেছে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়  । তাঁর অনুভবী এবং সংবেদনশীল মন দিয়ে প্রকৃতির অসামান্য রূপ বর্ণনা করে সাহিত্য সম্ভারকে অন্যতর ভূমিকায় উদ্ভাসিত করেছেন । সেই কারণে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি,   তাঁর সৃজনশীল সাহিত্য প্রতিভা, অবর্ণনীয় !
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশের চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ার সন্নিকট ঘোষপুর-মুড়াতিপুর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন  ।  তিনি ছিলেন প্রখ্যাত মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃণালিনী দেবীর পাঁচটি সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান, অর্থাৎ বিভূতিভূষণ দুই ভাই এবং  তিন বোনের মধ্যে ছিলেন সবার বড় । তাঁর বাবা  ছিলেন  তদানীন্তনকালের একজন প্রখ্যাত সংস্কৃত বিষয়ক পণ্ডিত  । মহানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের পাণ্ডিত্য  ও  কথকতার জন্য শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন । উল্লেখ থাকে যে, তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলার ( বর্তমান চব্বিশ পরগনা জেলার ) অন্তর্ভুক্ত বনগ্রাম মহকুমায় অবস্থিত ইছামতী নদীর তীরে ব্যারাকপুর গ্রামে । শোনা যায়  বাবা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় কথকতা ও পৌরাহিত্য করতেন বলে,  তাঁর  বাল্য ও কৈশোর জীবন কাটে দারিদ্র্য , অভাব  ও  অনটনের মধ্যে । বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে গৌরী দেবী  ও পরে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে রমা দেবীর সাথে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হন ।
এবার আসছি তাঁর শিক্ষা জীবন সম্পর্কে  ।  বাবা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের শিক্ষার হাতেখড়ি  । লেখাপড়ার পাঠ শুরু  । ছোট থেকেই মেধাবী হওয়ার কারণে নিজ গ্রামের  পাঠশালায় পড়াশোনার পর বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসাবে ভর্তি হন  । ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ (অর্থাৎ বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আই-এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে রিপন কলেজ থেকেই বি.এ পরীক্ষায় ডিস্টিংশন সহ উত্তীর্ণ হন । উচ্চতর পড়াশোনার জন্য এম.এ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হন । কিন্তু পরিবারের চাপে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
এবার আসছি তাঁর কর্ম জীবন সম্পর্কে ।   হুগলী জেলার জাঙ্গিপাড়া গ্রামের বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ । এরপরে সোনারপুর হরিনাভী স্কুলেও শিক্ষাকতা করেন  । ঐ সময়ে গৌরী দেবীর মৃত্যু হলে মনের কষ্টে  সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । সেখান থেকে ফিরে এসে খেলৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহ শিক্ষক ও সেক্রেটারি হিসাবে কাজ  করা শুরু করেন । পরবর্তীকালে  খেলৎচন্দ্রের  সুপারিশ ক্রমে ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন  । ভাগলপুরে প্রবাসী হিসাবে বসবাস করতে থাকেন, এখানেই তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “পথের পাঁচালী” রচিত হয় । এভাবে কিছুদিন কাটানোর পর ধর্মতলায় খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন । পরে বনগাঁর নিকট গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশনে আমৃত্যু জীবন পর্যন্ত  শিক্ষাকতা করতে থাকেন ।
সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় “উপেক্ষিতা”  নামক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে  তাঁর সাহিত্য জীবনে সূত্রপাত  ।  ভাগলপুরের বাঙালিটোলায়  জমিদারির সেরেস্তায় নায়েবের কাজ নিয়ে চলে আসার পর “পথের পাঁচালী” উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে ভাগলপুরে তাঁর লেখকজীবনের সূত্রপাত  ।  উল্লেখ থাকে যে,  ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুরে বসবাস কালীন  সময়ে  “পথের পাঁচালী”  রচনা শুরু   এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সেই লেখার শেষ  ।  এই ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় লেখক বিভূতিভূষণকে আবিষ্কার করেন যিনি, তাঁর নাম উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় । এখানে একটা কথা ভীষণ প্রাসঙ্গিক,  উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন দুজন বিখ্যাত সাহিত্যিককে আবিষ্কার করার কারণে । তাঁদের মধ্যে প্রথমজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর দ্বিতীয়জন হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । উপেন্দ্রনাথ একদিকে সাহিত্যপাগল, অন্যদিকে মজলিসি । তাঁর বাড়ির কাছারিঘরে নিত্যদিন জমজমাট সাহিত্য আড্ডা বসতো । সেই আড্ডায়  অপরিচিত যুবক বিভূতিভূষণের ছিল নিত্য যাতায়াত । বৈঠকখানার সেই আড্ডায়  বিভিন্নরকম  সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ও  মন্তব্যে সকলে মেতে উঠতেন । কিন্তু এই যুবকটি কোনো আলোচনায়  অংশগ্রহণ করতেন  না । একদিন বৈশাখ মাসের  বিকেলের আড্ডায় কেউ উপস্থিত হলেন না ।  উপেন্দ্রনাথ কাছারিঘর থেকে নেমে উঁকি দিয়ে দেখলেন বাইরে রাস্তার উপরে একটি লণ্ঠনের  আলো,  সঙ্গে একটা ছায়ামূর্তি । সেই  ছায়ামূর্তি এসে হাজির হলো তাঁর বৈঠকখানায় । আড্ডারঘরে  একেবারে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বিভূতিভূষণ বসলেন । উপেন্দ্রনাথ বললেন, “একি ! আপনি পেছনে বসলেন কেন ?” প্রত্যুত্তরে বিভূতিভূষণ বললেন, “আরো অনেকে আসবেন, আমি কীভাবে সামনের বেঞ্চটিতে বসি ।“   উপেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “আজকে মনে হচ্ছে আর কেউ আসবেন  না । আসুন, আপনি সামনের চেয়ারটাতে বসুন ।“  নানাবিধ গালগল্পের মধ্যে উপেন্দ্রনাথ হঠাৎ বিভূতিভূষণকে জিজ্ঞেস করলেন, তা আপনার কবিতা কিংবা গল্প-উপন্যাস লেখার বাতিকটাতিক আছে নাকি ? বিভূতিভূষণ উত্তরে বললেন,  “না, তেমন কিছু নয়,  একটা উপন্যাস লিখেছি ।“  কিন্তু লেখাটি আদৌ মানসম্পন্ন হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না ! উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিভূতিভূষণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,  “তাহলে উপন্যাসের খাতাটি একবার নিয়ে আসুন । দেখি কেমন উপন্যাস লিখেছেন আপনি ?”  এই কথোপকথনের  কয়েক দিনের মধ্যে  বিভূতিভূষণ তাঁর  “পথের পাঁচালী”  উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে গেলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে । তারপর কিছুদিন বাদে একদিন মজলিস শেষে সবাই যখন উঠে  যাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে বললেন,  “আপনি এখনই যাবেন না । আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে ।“
সাহিত্য আসর থেকে সবাই বিদায় নেওয়ার পর উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে বললেন,  “ভাই, আপনার হবে । হবে বলছি কেন ?  আপনার লেখা ভাল হয়েছে । কী এক অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন আপনি ! লেখাটা পড়েই মন-প্রাণ দুটিই জুড়িয়ে গেছে আমার । যাই হোক, এবার আসল কথা বলি, আমি ভাগলপুরে আর থাকছি না । কলকাতায় চলে যাচ্ছি । তবে আমার কলকাতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেখান থেকে একটি পত্রিকা বের করব ‘বিচিত্রা’ নামে । সেখানেই  আমি ছাপতে চাই  আপনার এই  উপন্যাসটি । আপনার এই উপন্যাস দিয়েই যাত্রা শুরু করবে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকাটি । এর  কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল বিচিত্রা এবং বিভূতিভূষণের উপন্যাসও কিস্তিতে কিস্তিতে ।  উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যরসিক পাঠকমহলে গুঞ্জন শুরু হলো—কে এই লেখক ? যে সমাজ ও দেশ-গ্রামের তুচ্ছ জিনিসগুলো এত মনোমুগ্ধ করে তাঁর লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন  । হঠাৎ একদিন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এসে উপস্থিত । নব্বই  টাকা দিয়ে বললেন—”বিভূতিবাবু, আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে “পথের পাঁচালী”  উপন্যাসটি বই আকারে ছাপব ।“  এভাবেই শুরু বিভূতিভূষণের পথচলা ।
এই উপন্যাসটি ছিল বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের  প্রথম ও সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকৃতী যা পরবর্তি কালে চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় “পথের পাঁচালী” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বিখ্যাত হয়ে ওঠে । এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস  ‘অপরাজিত’ রচনা করেন, যা ছিল পথের পাঁচালী উপন্যাসের পরবর্তী অংশ । এই দুই উপন্যাসের কাহিনীই ছিল তাঁর জীবনকেন্দ্রিক । চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসের কাহিনীর মাধ্যমে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা ভীষণ ভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে । ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কিশোর পাঠ্য ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাস ভারতবর্ষের তরুণদের কাছে অতি  জনপ্রিয় ও রোমাঞ্চকর  উপন্যাস। ২০১৩ সালে চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জির পরিচালনায় ‘চাঁদের পাহাড়’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে যথেষ্ঠ খ্যাতি অর্জন করে ।
পুরস্কার হিসাবে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতী উপন্যাসের জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার পান । এছাড়াও তাঁর জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁ মহকুমার পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম লেখকের সম্মানার্থে  “বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য”  রাখা হয়েছে ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ জীবনের কয়েকটি বৎসর তাঁর ভালোবাসার শেষ চিহ্ন গৌরীকুঞ্জতে কাটিয়েছেন । তিনি তার বাড়িটির নাম স্ত্রীর নামে ‘গৌরীকুঞ্জ’ রেখেছিলেন ।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় (অধুনা ঝাড়খণ্ডের) ৫৬ বৎসর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সৃষ্টির গুনে ইতিহাসে চিরস্মরণীয়  হয়ে থাকবেন আজীবন । তাঁকে আমার শতকোটি প্রণাম ।  (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।
——–০———

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বাংলা গানের কণ্ঠশিল্পী জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বৃটিশ ভারতের কলকাতার টালিগঞ্জে তার মাতুলালয়ে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ডিসেম্বর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামে। সেখানকার চট্টোপাধ্যায় পরিবার বরাবরই সঙ্গীতে অনুরক্ত ছিল। পিতা মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় চাকুরিসূত্রে সপরিবারে কলকাতার ভবানীপুরে থাকতেন। তিনি গজল,ঠুমরি দাদরায় ছিলেন দক্ষ। প্রতিমা এক বৎসর বয়সেই পিতৃহারা হলে মাতা কমলাদেবীর প্রবল ইচ্ছায় সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। আর্থিক অভাবের মধ্যেও পয়সা জমিয়ে হারমোনিয়াম কিনে ছিলেন এবং প্রথম প্রথম গান শিখতে লাগলেন মায়ের কাছেই।পরে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্য বিশিষ্ট সংগীত শিক্ষক প্রকাশকালী ঘোষালের কাছে।

 

শৈশবে সাত-আট বছর বয়সে ছুটিতে এক বার ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। সেই শৈশবে ছুটিতে এক বার ঢাকায় আত্মীয়বাড়ি গিয়েছেন, আশপাশের লোকজন তাঁর গান শুনে তাজ্জব। এক গুণগ্রাহী ঢাকা রেডিয়োয় যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। সেখানে শিশুবিভাগে গাইবার পরপরই ডাক এল কলকাতা বেতার থেকে। মাত্র এগারো বছর বয়সে ১৯৪৫-এ সেনোলা থেকে প্রথম রেকর্ড বেরিয়ে গেল ‘কুমারী প্রতিমা চ্যাটার্জী’ নামে। সুকৃতি সেনের কথা ও সুরে বেসিক গানের রেকর্ড। ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’, ‘মালাখানি দিয়ে আমারে ভোলাতে চাও’ গানগুলি বেশ জনপ্রিয় হল। জলসায় গান শুনেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন সঙ্গীতপ্রেমিক অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুদর্শন যুবক। কমলাদেবীকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, গানের জগতে প্রতিমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যথাসাধ্য করবেন। তেরো পেরোতে না পেরোতেই স্বামীঘর করতে নবপরিণীতা প্রতিমা চলে এলেন টালিগঞ্জের সাহানগরে। সেখানেই তাঁর সন্তানদের জন্ম। এক মেয়ে, তার পরে ছেলে।

 

দক্ষিণ কলকাতার ‘মিলনচক্র’ ক্লাবে প্রতিমার গান শুনে যশস্বী শিল্পী-সুরকার সুধীরলাল চক্রবর্তী চমৎকৃত হন। তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তার ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছায়াছবিতে প্রতিমাকে দিয়ে ‘উছল তটিনী আমি সুদূরের চাঁদ’ গানটি গাওয়ান। আর সেই সাথে নেপথ্যগায়িকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ। তারপর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে’যদুভট্ট’ছায়াছবিতে কুন্দন লাল সায়গলের গাওয়া ‘বাবুল মোরা নইহার ছুট হি যায়ে’ বিখ্যাত গানটি তিনি গেয়েছিলেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের “ঢুলি” চলচ্চিত্রে ( বৃন্দাবনী সারং রাগে) রাগাশ্রিত ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে’ গানটি প্রতিমাকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও অভিভূত হয়েছিলেন। তাই এক সাংবাদিক যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, গায়িকাদের মধ্যে কার গলাটি তাঁর সবচেয়ে সুরেলা লাগে, তিনি এক ঝটকায় বলে দিলেন, ‘‘প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

পরে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে হেমন্তর সুরে ‘শাপমোচন’ছায়াছবিতে চিন্ময় লাহিড়ীর সঙ্গে ‘পটদীপ’ রাগে দ্বৈতকণ্ঠে গাইলেন ‘ ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’। স্বকীয় গায়কির গুণে কঠিন গানেরও সূক্ষ্ম কারুকাজে অনায়াসে বিচরণ করতে থাকলেন তিনি। বলা যায় কয়েক দশক জুড়ে ‘যদুভট্ট, ‘ঢুলি’, ‘শাপমোচন’, ‘ছুটি’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘পরিণীতা’, ‘দাদাঠাকুর’ ইত্যাদি অজস্র ছায়াছবি ভরে আছে প্রতিমার গানে। অন্যদিকে আধুনিক গানের মধ্যেও তার গাওয়া ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’,’একটা গান লিখো আমার জন্য’ ইত্যাদি অজস্র অবিস্মরণীয় গান তার কণ্ঠে কালজয়ী আখ্যা পেয়েছে। ছায়াছবি, আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, ভজন, ভক্তিগীতি, কীর্তন, কাব্যগীতি, অতুলপ্রসাদের গানেও প্রতিমা সমান উজ্জ্বল ছিলেন। কলকাতার আকাশবাণীতে রম্যগীতিও গেয়েছেন।

 

অসংখ্য গানের মধ্যে তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় কিছু গান : ‘আজি মুরলী বাজে প্রেম বৃন্দাবনে’,  ‘আন্ধার আমার ভালো লাগে’,  ‘আবীরে রাঙ্গালো কে আমায়’, ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে'(১৯৬০), ‘আমার বকুল ফুল কই’, ‘একা মোর গানের তরী’, ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’, ‘কই গো কই গো কই’,  ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’, ‘ছলকে পড়ে কল্কে ফুলে’,  ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’,  ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর’, ‘সাতরঙ্গা এক পাখি’ প্রভৃতি।

তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসাবে ‘ছুটি’ ‘চৌরঙ্গী’ ও ‘পরিণীতা’ ছায়াছবিতে গানের জন্য পরপর তিন বৎসর বি.এফ.জে.এ. পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই  কলকাতায় তিনি প্রয়াত হন।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঊনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার, প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি : দিলীপ  রায়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার । তাঁর পসম্পর্কে বলা যেতে পারে, তিনি লেখক, দার্শনিক, পণ্ডিত, অনুবাদক, প্রকাশক ও মানবহিতৈষী । সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন । সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও অপরবোধ্য করে তোলেন । বাংলা গদ্যের সার্থক রূপকার তিনিই ।
বিদ্যাসাগরের যখন জন্ম (১৮২০), তখন শিক্ষা সংস্কারে ও বাংলা ভাষার আধুনিকরণের একটা ডামাডোল পরিস্থিতি । বিশৃঙ্খলার বাতাবরণ । শিক্ষার লক্ষ্য, পদ্ধতি ও পাঠক্রম নিয়ে চলছিল নানান বিতর্ক । অথচ বাঙালী সমাজ জানে, আধুনিক শিক্ষা ও সমাজ  সংস্কারে বিদ্যাসাগরের গৌরবময় অবদানের কথা ।

তাঁর নির্মিত বাংলা ভাষার ভিত্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম অধ্যায় । বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে বোধগম্য এবং সবরকমের ভাব ও চিন্তা প্রকাশের যোগ্য করে তুলেছিলেন । তাই আজও বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয় ।
আটপৌরে বাঙালি পোশাকে বিদ্যাসাগর ছিলেন সর্বত্রগামী । প্রবল জেদ ও আত্নসম্মানবোধ নিয়ে সরকারি চাকরি করেছেন, দ্বিরুক্তি না করে ইস্তফা দিয়েছেন । পাঠ্যবই লিখে ছেপে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেছেন, দানের জন্য ধারও করেছেন ।  উনিশ শতকে সমাজ বদলের সব আন্দোলনেই তিনি ছিলেন পুরোভাগে । এমন ব্যক্তিত্ব সবসময়ে  ব্যতিক্রম ।
বিদ্যাসাগরের একটা আপ্ত বাক্য আজও সমাজজীবনে উজ্জীবিত, “কোনো বিষয়ে প্রস্তাব করা সহজ, কিন্তু নির্বাহ করে ওঠা কঠিন” । অথচ তিনি এককভাবে ধুতিচাদর পরে একটার পর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা বাস্তবায়িত করে গেছেন, যেমন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ শিক্ষার সংস্কার ও বিধবা বিবাহ প্রচলন । এটা সর্বজনবিদিত, বিদ্যাসাগরের লড়াইটা ছিল একার লড়াই । বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বিশ্বকবি  রবীন্দ্রনাথের  মন্তব্য পরিষ্কার, তিনি গতানুগতিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন  স্বতন্ত্র, সচেতন ও পারমার্থিক ।
এটা অনস্বীকার্য যে,  বাঙালী সমাজে আজও বিদ্যাসাগরের প্রদীপ্ত উপস্থিতি ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়ে । প্রাথমিক শিক্ষায় ‘বর্ণপরিচয়’ এর  মাহাত্ম্য সকলের জানা । মুর্শিদাবাদ  জেলার শক্তিপুর হাই স্কুলের বাংলা ক্লাসের  দিদিমণি আমার রচনা লেখার গঠন অবলোকন করে হঠাৎ তাঁর সম্মুখে তিনি আদর করে ডেকে আমাকে বললেন, “তুই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থের নাম শুনেছিস” ? মাথা নেড়ে আমি  বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় গ্রন্থটির নাম শুনেছি জানালাম ।  তারপর চুপি চুপি বাংলা বিষয়ের শ্রদ্ধেয়া দিদিমণি বললেন, রোজ রাতে শোওয়ার আগে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’  বইখানা পড়বি । রচনা লেখার সময়ে তোর বানানের জড়তা কেটে যাবে ।“  সুতরাং শৈশব থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় আজও অমলিন । সেই বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ অতিক্রান্ত  । তাই দুশো বছর ধরে শিক্ষা জীবনের বাস্তবতায় ও শিক্ষা বিকাশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক ।
বিদ্যাসাগর যখন জন্মগ্রহন করেছিলেন সেই  সময়টা ছিল রামমোহনের যুগ, যিনি একজন শিক্ষিত ও অগ্রণী পুরুষ ছিলেন এবং সমাজ সংস্কারের অন্যতম কারিগর ।  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর  মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত ও বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা পুরুষ। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরিতে খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতেন । পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের অতীত ছিল। সেই কারণে বালক ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী’র  সঙ্গে বাস করতেন।
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির ছ’মাসের মধ্যেই পাঁচ টাকা বৃত্তি পান ।  তাঁর প্রতিভার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে শিক্ষকেরা সকলে স্তম্ভিত । তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্মজীবন শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম (১৮৪১) কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসাবে । ঐসময়েই  তাঁর ইংরেজি শিক্ষার যথাযথ শিক্ষালাভ । কেননা বিদ্যাসাগরকে সকলে জানতেন সংস্কৃতের পণ্ডিত হিসাবে । ইংরেজি হাতের লেখাও ছিল নজরকাড়া । ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে অর্থাৎ ১৮৫১ সালের ২২শে জানুয়ারী ঐ  কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন।  ঐ সময়েই ১৮৫১ সালে বিদ্যালয় দেখলেন, সংস্কৃত কলেজে গোড়া থেকেই  শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানদের পড়বার অধিকার ছিল । কিন্তু বৈদ্যদের আবার ধর্মশিক্ষায় ছিল আপত্তি । স্বভাবতই প্রশ্ন উঠল কায়স্থ ও অন্যান্য হিন্দু বর্ণদের কথা । তখনকার পণ্ডিত সমাজের তোয়াক্কা না করে, বিদ্যাসাগর তদানীন্তন কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিলেন ব্রাম্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্যান্য বর্ণের বিশেষ করে শূদ্রদের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশে তাঁর আপত্তি নেই । যদিও সেই সময় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকরা বিদ্যাসাগরের মতে গররাজী ছিলেন, তথাপি বিদ্যাসাগরের মতটাকেই মান্যতা দিয়েছিলেন তদানীন্তনকালের কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সেক্রেটারি । এবং পর পরই ১৮৫৪ সালের শেষে বিদ্যাসাগর হিন্দুদের সব শ্রেনীর জন্য সংস্কৃত কলেজের দরজা খুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন এবং সেই প্রস্তাব যথাসময়ে অনুমোদিত হয়েছিল ।
সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া,  শিক্ষা প্রসারে তাঁর আরও অবদান সর্বজনবিদিত ।  ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন । ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে  বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ  প্রকাশ করে তিনি বাঙালীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন। ১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন,  তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।  ১৮৫৯ সালে তিনি “ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল” স্থাপনে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। ১৮৬৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় “হিন্দু মেট্রেপলিটন ইসস্টিটিউট”। ইংরাজ অধ্যাপকের সাহায্য ছাড়া এবং কোনোরকম সরকারি সাহায্য ছাড়া, বিদ্যাসাগর স্কুলটিকে ১৮৭২ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত করেছিলেন । বর্তমানে এর নাম “বিদ্যাসাগর কলেজ”। এটি দেশের প্রথম কলেজ যার প্রতিষ্ঠাতা – পরিচালক – শিক্ষক স্কলেই ভারতীয় ।  এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।
ব্রাম্মণ হয়েও বিদ্যাসাগর ত্রিসন্ধ্যা জপ করেননি । কোনো  মন্দিরে যাননি এবং ঈশ্বর  বিষয়ক কোনো লেখা তিনি লেখেননি । বিদ্যাসাগর ছিলেন নাস্তিক । ধর্ম সম্বন্ধে  তিনি শুধু মনে করতেন জগতের কল্যাণসাধন ও বিদ্যাচর্চা । এপ্রসঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষের উক্তিটি প্রনিধাযোগ্য, ধর্মের কোন বহিরঙ্গ মানতেন না । তিনি, আচরণও করতেন না । এখন যেমন অনেকে বলেন, ধর্মটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, অনেকটা সেইরকম ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ, বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন । সেদিনের সমাজে প্রচলিত প্রথার নির্মম পরিণতির জন্য নারীদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন আপামর জনতা অবলোকন করেছিলেন । শোনা যায়, একসময় রাজা  রাজবল্লভ নিজের বালবিধবা কন্যাকে পুনর্বিবাহ দেওয়ার অনুমতি সমাজের পণ্ডিতদের কাছ থেকে পেয়েও সেই বিবাহ কারও কারও বাধায় দিতে পারেননি ।  বিদ্যাসাগরের “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা” বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ ও সমাজ চমকে উঠেছিল । শেষ পর্য্যন্ত ১৮৫৫ সালের ১৬ই  জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়  । তারপর ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন স্রকারিভাবে আইন হিসাবে মঞ্জর হয় ।   বিদ্যাসাগরের দরদী হৃদয় কেঁদেছিল সেকালের সমগ্র হিন্দু নারী সমাজের দুর্গতি দুর্দশায় । বিধবা বিবাহ আইন নামে পরিচিত ১৮৫৬ সালের আইনটি কেবলমাত্র বিধবা নারীর দ্বিতীয় বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি, আইনটি যেমন বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে তেমনই মৃত স্বামীর এবং দ্বিতীয় বিবাহের এবং পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তিতে অধিকার সুনিদ্দিষ্ট করে ।  বিভিন্নভাবে জানা যায়, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত মোট ৬০টি বিধবা বিবাহ সংঘটিত   হয়  ।  আরও      জানা   যায়,   বিদ্যাসাগর     ও  তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচণ্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তা ছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। এতে একটা জিনিস পরিস্কার,  বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগরের দৃঢ় সংকল্প শতভাগ সফল ।
তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন, যাকে পরবর্তীতে বেথুন কলেজ নামকরণ করা হয়। নারীদের শিক্ষার দিকে আনার জন্য তিনি একটি অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন, যা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখান থেকে মেয়েদের শিক্ষার জন্য যাবতীয় অর্থের ব্যবস্থা করা হতো। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিত । দরিদ্রদের দানে তিনি সর্বদাই মুক্তহস্ত ছিলেন ।  তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন । এখানে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র উক্তি প্রনিধানযোগ্য,
“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু ! উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম কান্তি অম্লান কিরণে” ।
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের। তাঁর বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে । পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের,  যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ।
তিনি তাঁর একক ও সহযোগীর উদ্যোগে রেখে গেলেন আধুনিক ব্যবহারযোগ্য একটি (উচ্চারণ অনুযায়ী ও মুদ্রণযোগ্য) বাংলা ভাষা, প্রাথমিক ও নীতিশিক্ষার বহু জনপ্রিয় গ্রন্থ, বাংলা মাধ্যম স্কুলব্যবস্থা ও নারীশিক্ষার পাকা বুনিয়াদ । মাতৃ/বাংলা ভাষার শিক্ষার আর একটি প্রাক শর্ত হল ভাল পাঠ্যপুস্তকের সুলভতা । বিদ্যাসাগরের সময় তার যথেষ্ট অভাব ছিল । বিদ্যাসাগরকেও অবতীর্ণ হতে দেখা যায় এক দিকে, বাংলায় ব্যকরণসিদ্ধ মুদ্রণযোগ্য অক্ষর ও বানান সংস্কার করে, নানা পাঠ্যপুস্তক রচনা, ছাপা ও বিপণনের আয়োজন । পাঠ্যপুস্তক রচনার পাশাপাশি ছাপা  বইয়ের সম্পাদনা ও সম্মার্জনার প্রতি তাঁর অখণ্ড মনোযোগ চিরদিন বজায় ছিল । একবার  তিনি হতদরিদ্র সাঁওতালদের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন তিনি, সেই সময় (১৮৭৮) চর্যাপদের আবিস্কর্তা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও তাঁর এক সঙ্গী লখনউ যাওয়ার পথে এক রাত বিদ্যাসাগরের আতিথ্যগ্রহণ করেন । রাত্রে বিশ্রামের পর সকালে উঠে শাস্ত্রী মশাই দেখলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয় বারান্দায় পাইচারি করিতেছেন এবং মাঝে মাঝে টেবিলে বসিয়া কথামালা কি বোধোদয়ের প্রূফ দেখিতেছেন । প্রূফে  বিস্তর কাটকুটি  করিতেছেন । যেভাবে প্রূফগুলি পড়িয়া আছে, বোধ হইল, তিনি রাত্রেও প্রূফ দেখিয়াছেন । আমি বলিলাম, কথামালার প্রূফ আপনি দেখেন কেন ? তিনি বলিলেন, ভাষাটা এমন জিনিস, কিছুতেই মন  স্পষ্ট হয় না ; যেন আর একটা শব্দ পাইলে ভাল হইত ; — তাই সর্বদা কাটকুটি করি । ভাবিলাম — বাপ রে, এই বুড়ো বয়সেও ইহার বাংলার ইডিয়ামের ওপর এত নজর ।“ (সূত্রঃ অ-বা-প,পৃঃ৪/ ২৭-৯-১৯) ।
এই অনন্য ও  বিরাট ব্যক্তিত্বের মানুষটি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ধর্মের কোনও বহিরঙ্গ মানতেন না এমনকি, আচরণও করতেন না ।   অথচ চালচলনে তিনি ছিলেন নিতান্তই সাদাসিধে ।  খুব বিনয়ী  এবং জীবনে  দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে ছিলেন  তিনি দৃঢ় মনোভাবাপন্ন । তিনি ছিলেন  একাধারে মহান সমাজ সংস্কারক  অন্যদিকে এক জন শিক্ষাবিদ  এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন অবিরাম । ভারতে শিক্ষার প্রতি তার অবদান এবং নারীর অবস্থার পরিবর্তন জন্য তিনি চিরস্বরণীয়। তাঁর অবর্ণনীয় মাতৃ ভক্তি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও চর্চিত ।
হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরোধী, বিধবা বিবাহের প্রচলনকারী, নারী শিক্ষার প্রবর্তক, উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, সমাজ সংস্কারক, বর্ণপরিচয় ও বহু গ্রন্থের রচয়িতা, মহান শিক্ষাবিদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনের প্রাক্কালে তাঁর মহান স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য ।
————————-০——————————

Share This