Categories
গল্প প্রবন্ধ

শান্তিপুরের শ্রীশ্যামসুন্দরের অলৌকিক লীলামাধুরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

আহা ! শান্তিপুরের আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির শ্রীশ্যামসুন্দরের যেমন চিত্তাকর্ষক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য তেমনই তাঁর অপূর্ব সব লীলা । পুত্র যেমন পিতার কাছে আবদার করে, বায়না করে তেমনভাবেই শ্যামসুন্দর নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ রূপে করেছেন এটা-সেটার দাবি। কখনো শ্রীআনন্দকিশোর গোস্বামীর কাছে কখনও বা শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের কাছে। প্রসঙ্গতঃ জানাই , আনন্দকিশোর গোস্বামী ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের পিতাপ্রভু ।

অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র শ্রীদেবকীনন্দন ছিলেন আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরজীউ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হন স্বয়ং অদ্বৈত, তাঁর পুত্র বলরাম এবং পৌত্র দেবকীনন্দন— তিনজনের দ্বারা মিলিত ভাবে। দেবকীনন্দন নির্দেশিত নিয়ম মেনেই এখনও সেবাপূজা চলে। বিশ্ববিশ্রুত সিদ্ধ মহাপুরুষ ,প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই বংশেই জন্মগ্রহণ করেন‌ বলে এই বাটীকে ‘বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাটী’-ও বলা হয়।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখনও ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করেননি। মনে-প্রাণে তিনি ভীষণ ভাবে ব্রাহ্মধর্মে বুঁদ হয়ে আছেন । কলকাতাতে থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার চালাচ্ছেন জোরকদমে । মাঝে মধ্যে শান্তিপুরে যান । আর যখনই শান্তিপুরে যান তখনই শ্যামসুন্দর তাঁর সম্মুখে প্রকট হন। প্রেমচাহিদার যেন শেষ নেই বিজয়কৃষ্ণের কাছে শ্যামসুন্দরের । ওদিকে ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণ নীতিগতভাবে মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী থাকলেও , কোন অজ্ঞাত কারণে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ , টান অনুভব করেন শ্যামসুন্দরের প্রতি। আর , তাই শ্যামসুন্দরের আবদারও মিটিয়ে চলেন একের পর এক।

একবার নটখট্ শ্যামসুন্দর বললেন , “শোন বিজয় ! আমার দেখ না বাঁশি নেই ! একটা বাঁশী বানিয়ে দে না !” এমন ভাবে শ্যামসুন্দর বললেন, যে বুকে গিয়ে বাজলো বিজয়কৃষ্ণের সে কথা । তিনি বাংলাদেশের ঢাকাতে অর্ডার দিয়ে খুব সুন্দর একটি বাঁশি প্রস্তুত করিয়ে দিলেন। বাঁশি পেয়ে বড় আনন্দ পেলেন বিগ্রহ শ্যাম।

আবার একবার শ্যামসুন্দর বললেন , “বাঁশী তো দিলি , এবার চূড়াটাও গড়িয়ে দে। বাঁশি-চূড়া না থাকলে কী সাজ সম্পূর্ণ হয়, বল !” শ্যামসুন্দরের বলার ঢঙে হেসে ফেললেন বিজয়কৃষ্ণ । মনটা কোমল হয়ে গেল যেন । স্নেহব্যথা পেলেন চিনচিনে এক । তিনি পরদিনই ঢাকায় সংবাদ পাঠিয়ে চূড়ার অর্ডার দিলেন । বেশকিছুদিন পর ঢাকা থেকে এল চূড়া । বাঁশি আর চূড়ার সাজে শ্যামসুন্দরের সুন্দর সাজ এমন সুন্দর হল যে নয়ন ফেরানো যায় না । কিন্তু, না , শ্যামসুন্দরের মনের ইচ্ছা অন্য । তিনি বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ নিয়ে হাজির । অনুযোগের সুরে বললেন , “চূড়া তো দিলি , ভালো হয়েছে। কিন্তু , আমার মনোমতো হয়নি।” বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “কেন , কি রকম হলে তোমার মনোমতো হবে শুনি !” শ্যামসুন্দর বায়নার মত করে বললেন , “আমার সোনার চূড়া চাই। রূপার চূড়া নেব না ।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন অবাক হয়ে, “সে কী কথা ! আমি সোনার চূড়া কোথায় পাবো ! অত টাকা আছে নাকি আমার !কোথায় পাব টাকা !” শ্যামসুন্দর বললেন, “রাঙ্গা ঠাকুরাণীর অনেক টাকা আছে, জানিস তো ! তুই আমার নাম করে বল , দেখবি টাকা দেবে ।”

রাঙ্গা ঠাকুরাণী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাকিমা ছিলেন । তাঁকে বিজয়কৃষ্ণ সব জানালেন । তিনি শুনেই আনন্দে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না । শ্যামসুন্দরের মুখে তাঁর নাম ! শ্যামসুন্দর নিজে যেচে তাঁর থেকে সেবা নিতে চেয়েছেন । এমন সৌভাগ্যও তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো, আহা ! পুলকিত , রোমাঞ্চিত হলেন তিনি । অতি শীঘ্র টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বিজয়কৃষ্ণকে । সে টাকা থেকে রূপোর চূড়ায় সোনার পাত বসিয়ে সোনার চূড়া বানানো হল। অপূর্ব দর্শন রূপোর বাঁশি আর সোনার চূড়ায় সেজে শ্যামসুন্দরের যে মনোহারী, মনাকর্ষক , মুগ্ধকর সাজ হল তা ভাষায় বর্ণনার অতীত । তিনি নিজেও অনুধাবন করলেন যে , এরূপ দেখলে বিজয়কৃষ্ণও তাঁর প্রেমে পরে যাবেন । তাইতো বিজয়কৃষ্ণের কাছে এবার বললেন, “হ্যাঁ রে, দিলি তো চূড়া-বাঁশী । এবার একটু দেখবি না আমায় এসব পরে কেমন লাগছে ! যা, মন্দিরে যা, দেখ আমায়।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “বা-রে ! আমি না ব্রাহ্ম! মন্দির-টন্দিরে আমায় যেতে নেই জানো না ! ওসব দেখতে নেই।”

শ্যামসুন্দর—”তাতে কী ! ব্রাহ্ম না হয় হলিই। দেখতে দোষ কী । আর ব্রাহ্ম তো তুই আমার ইচ্ছেতেই হয়েছিস । আমিই বানিয়েছি ব্রাহ্ম তোকে।”

শ্যামসুন্দরের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ চুপ করে রইলেন । পরে একসময় মন্দিরে গিয়ে দর্শন করে এলেন শ্যামসুন্দরকে। সত্যিই শ্যামসুন্দরের সৌন্দর্য দর্শনে মন যেন কেমন করে উঠল তাঁর।বোধহয় ইচ্ছে হল একবারটি নিজের কোলে করার, বক্ষে ধরে নেওয়ার ; শ্যামসুন্দরের ওই রাতুল চরণে মস্তক স্পর্শ করাতে ইচ্ছে হল আত্মনিবেদনের ভাব নিয়ে।

ঠিক এমনই ঘটনা আবারও একদিন হল। বিজয়কৃষ্ণের মনে হল যেন কেউ নূপুর পরে হাঁটছে। তিনি বেরিয়ে এলেন । নূপুরের ধ্বনি যেদিকে, সেদিকে এগিয়ে গেলেন। মনে তাঁর দোলা দিয়েছে, এ ধ্বনি শ্যামসুন্দরের চরণের নূপুরের না তো ! কারণ, মাঝেমধ্যেই তিনি শ্যামসুন্দরের নিক্কণের ধ্বনি পান। তাঁর পিতা-মাতা বা পরিবারের অনেকেই পান । শ্যামসুন্দর নিজের উপস্থিতি জানান দেন এভাবে। তাই আজ বিজয়কৃষ্ণ নূপুরের ধ্বনি শুনেই কোন যেন অমোঘ টানে চলে গেলেন শ্যামসুন্দরকে দেখবেন বলে বা ধরবেন বলেই হয়তো বা ।

হ্যাঁ , শ্যামসুন্দরও আজ যেন বিজয়কৃষ্ণের জন্যই রূপের ফাঁদ পেতেছেন । বিজয়কৃষ্ণ দেখলেন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে শ্যামসুন্দর । দুষ্টুমির ঝলক তাঁর আখির প্রান্তে । তাঁর রূপ দেখে বিজয়কৃষ্ণ ক্ষণিকের জন্য বিহবল হয়ে গেলেন। আর অন্তর্যামীর দেরী হল না অন্তর পড়তে বিজয়কৃষ্ণের । বিদ্যুতের ঝলকের থেকেও তাঁর অনুধাবন ক্ষমতা অতি তীব্র, অতি দ্রুত যে। তখন শ্যামসুন্দরের মনের ভাবখানা এমন যে কেমন ফাঁদ পেতেছি আমি, দেখলি তো ! কেমন ধরা পড়লি সে ফাঁদে, বল ! আর সেকারণেই ছিল দুষ্টুমির ঝলক নট্‌খট্‌ নওলকিশোর শ্যামসুন্দরের নয়নের কোনায়। কন্ঠে তিনি দুষ্টুমির সুর করে বললেন, “ বল তো , এবার আমায় কেমন দেখছিস ?” স্বগোতক্তির ন্যায় বিজয়কৃষ্ণের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “অতি সুন্দর তুমি।” পরক্ষণেই বিজয়কৃষ্ণের একটা কথা মনে এল, তিনি বলে ফেললেন তা আপনমনে —-”আচ্ছা, একটা কথা বলো তো ! আমায় দর্শন দিয়ে এত কৃপা করার ইচ্ছে যখন তোমার , তাহলে কেন এমন করে ব্রাহ্ম করলে আমায়?”

শ্যামসুন্দর আকর্ণ-বিস্তৃত মধুময় হাসি হেসে বললেন, “জানিস, অলংকার ভেঙ্গে আবার গড়ালে আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয় তা।” বিজয়কৃষ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন এ উত্তর পেয়ে । শ্যামসুন্দরও অন্তর্ধান করলেন সেই মুহূর্তেই , আসল কাজ করা হয়ে গেছে এই মন নিয়ে।

শ্যামসুন্দর নিজের প্রিয় পাত্র বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগও করতেন । একবার পূজারী ভোগের সময় জল দিতে ভুলে গেলেন। শ্যামসুন্দর বাচ্চা ছেলেদের মতো এসে বিজয়কৃষ্ণকে বললেন, “দেখ বিজয়, তোদের পূজারী কেমন ! মধ্যাহ্নভোগে পারস করেছে আর জল দিতে ভুলে গেছে । বলতো খেতে বসে জল না দিলে হয় !” তখন বিজয়কৃষ্ণ পূজারীকে খানিকটা তিরস্কার করেই ঘটনা জানালেন সব। আর যেন এমন ভুল না হয় সাবধান করলেন।

আবার অন্য একটা দিনের কথাও জানাই । মন্দিরে চুরি করল এক চোর । শ্রীরাধারাণীর মুকুটটি বড় ভালো লাগায় হয়তো বা লোভ সামলাতে না পেরে সেটি নিয়ে গেল। তবে পরে নিজের ভুল বুঝে অনুতাপানলে জ্বলে ফেরত দিতে চাইলো । কিন্তু, আর তো উপায় নেই গর্ভমন্দিরে ঢুকে রাধারাণীর মস্তকে মুকুট পরিয়ে দেবার । ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে । তাই করলো কী , মুকুটটি মন্দির চত্বরেই একটু আড়াল করা স্থানে ফেলে গেল। মুকুটের খোঁজ চলছে এদিকে । পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই । তখন শ্যামসুন্দরের শ্রীরাধিকা বিজয়কৃষ্ণের কাছে প্রকাশিত হলেন । সে সময় আসনে বসে ধ্যান করছেন বিজয়কৃষ্ণ। শ্রীরাধিকা মুকুটের অবস্থান বলে দিলেন । বিজয়কৃষ্ণ তা সকলকে জানালেন। সত্যিই সে স্থানে পাওয়া গেল মুকুট।

ভক্তিপূর্ণ প্রণাম পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করি এহেনো সুন্দরের সুন্দর শ্যামসুন্দর বিগ্রহকে ও যাঁর সঙ্গে তিনি এমন মধুময় লীলা করেছেন সেই শ্রদ্ধেয় প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *