শ্রীনিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবাদেবী প্রথম বার যখন বৃন্দাবন গমন করেন সেটা ছিল সম্ভবতঃ ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দের (১৪৮২ শকাব্দ) মাঘ মাস। সহযাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থরচনাকার নিত্যানন্দ দাস, উদ্ধারণ দত্ত প্রমুখ। আর দ্বিতীয়বার ব্রজে পদার্পণ করেন ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৫০৪ শকাব্দ) খেতু্রীর উৎসবের পরে। সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পদকর্তা গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস, ভাস্কর নয়ন মিশ্র, পরমেশ্বর দাস প্রমুখ। দ্বিতীয়বার যাত্রাপথে জাহ্নবা মাতা অনেক অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেন। পথের মধ্যে রাত্রিযাপন কালে এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন যখন, সেসময় স্থানীয় কিছু নিন্দুক গ্রামবাসী লক্ষ্য করেন যে, সঙ্গীরা সকলে এক রমণীর (জাহ্নবাদেবীর) চরণে প্রণত হচ্ছেন। এ ঘটনায় তাঁরা অত্যন্ত আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হলেন। কারণ চন্ডীদেবীর পরিবর্তে কোন মানুষীর চরণে শরণাগত হয়েছিল সঙ্গীরা সকলে। তাই তাঁরা গ্রাম মধ্যস্থ চন্ডীমন্ডপে চন্ডীমাতার কাছে নালিশ করলেন যে, যারা দেবীর পরিবর্তে মানুষের চরণে পতিত হয় তাদের যেন তিনি সংহার করেন অবিলম্বে। শাস্তি বিধান অত্যন্ত প্রয়োজন। এমন বলে যখন তাঁরা নিদ্রায় গেলেন তখন ক্রোধিত দেবী চণ্ডী তাঁদেরকে স্বপ্নাদেশ দিলেন –“জাহ্নবাকে নারীজ্ঞানে অবহেলা করছো তো, তোমাদের মুণ্ডছেদন করবো আমি ! মহিমা না জেনে ধিক্কার করছো তাঁর! মানুষী জ্ঞান করছো! কিন্তু তিনি আমারও প্রণম্য। কাল প্রভাতেই অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইবে তাঁর কাছে। না হলে, আমি তোমাদের সংহার করবো।” নিন্দুকেরা সকলে পরদিবস প্রভাতেই মাতার চরণে পড়লেন। দোষ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন। ঈশ্বরী জাহ্নবা সন্তান জ্ঞানে সকলকে কাছে টেনে নিয়ে কৃপা করলেন। প্রত্যক্ষদর্শী নিত্যানন্দ দাসের বিবরণ অনুযায়ী এমন আরও এক অলৌকিক লীলা করেন জাহ্নবা ঠাকুরাণী পথে।
কুতুবুদ্দিন নামক এক দস্যুদলপতি নিজের সঙ্গীদের নিয়ে রাতে ডাকাতি করতে আসেন যে গৃহে জাহ্নবা মাতা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই গৃহেই। কিন্তু, ডাকাতদল সারারাত ধরে ঘুরেও পথ খুঁজে পেলেন না গৃহে প্রবেশের। গৃহের চারিদিকে বিশালাকার ভয়ংকর সব সর্প ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গৃহের দিকে এগোতেই ছুটে আসছিল সর্পরা দংশন করতে। রাত্রি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু প্রতীক্ষা ব্যর্থ হল। কিছুই করতে পারলেন না তাঁরা। শেষরাত্রে দৈববাণী হল—-“ঠাকুরাণীই তোমাদের জব্দ করলেন।” কুতুবুদ্দীন তাঁর সঙ্গীসাথীসমেত মাতার চরণে শরণ নিয়ে ক্ষমা চাইলেন। জাহ্নবাদেবী নামপ্রেম দিয়ে তাঁদের অযাচিত কৃপা করলেন।
এভাবে, পথে নানা পতিত উদ্ধার লীলা করতে করতে জাহ্নবা মাতা গণসমেত শুভাগমন করলেন মথুরায়। সেখান থেকে ব্রজে। শ্রীজীব গোস্বামী জাহ্নবাদেবী ও তাঁর সঙ্গীদের বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। ঈশ্বরীর আগমনে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দ যারপরনাই আনন্দিত হলেন। গোপাল ভট্ট, ভূগর্ভ গোস্বামী, লোকনাথ গোস্বামী, মধু পন্ডিত, কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী প্রমুখ মহাজনরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করলেন। জাহ্নবা মাতা যে কতখানি সম্ভ্রম-সম্মান নিজ গুণে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দের থেকে অর্জন করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুটি উদাহরণ দেওয়া যায় –(১) ঈশ্বরীর দ্বিতীয়বার বৃন্দাবন আগমনের পূর্বে যখন শ্রীনিবাস আচার্য বৃন্দাবন থেকে গৌড়ে গমন করবেন, তখন শ্রীগোপাল ভট্ট তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তিনি যেন গৌড়ে ফিরে জাহ্নবা মাতাকে বৃদ্ধ গোপাল ভট্টের খেদোক্তির কথা জানান –“ঈশ্বরীর পদযুগ না দেখিনু আর।” (প্রেমবিলাস , ৬ বিলাস)। আসলে অসুস্থ গোপাল ভট্টের বয়স হয়েছিল। তাই তাঁর শঙ্কা ছিল যে জাহ্নবা মাতার চরণ দর্শনের সৌভাগ্য বোধহয় আর এ জীবনে হবে না তাঁর। তাই তিনি অমন বিলাপ করেছিলেন।
(২) যখন প্রথমবার জাহ্নবা মাতা ব্রজে যান তখন রাধাকুণ্ড নিবাসী রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পর্ব ঘটেনি। তাই তিনি দ্বিতীয়বার ব্রজে আসছেন শুনে চলচ্ছক্তিরহিত বৃদ্ধ দাস গোস্বামীজী নিজে প্রেরণ করেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ও অন্যান্য বৈষ্ণববৃন্দকে , যাতে তাঁরা ব্রজ থেকে সসম্মানে জাহ্নবা মাতাকে রাধাকুণ্ডে নিয়ে আসেন। জাহ্নবাদেবী কৃপাদর্শন দান করে ধন্য করবেন দাস গোস্বামীজীকে তাহলে।
রন্ধন পটিয়সী দেবী জাহ্নবা বৃন্দাবনে আপন হস্তে ভোগ রন্ধন করে শ্রীগোবিন্দ, গোপীনাথ, মদনমোহন,রাধাদামোদর ও রাধারমণ –এই ছয় বিগ্রহকেই ভোগ নিবেদন করতেন। তারপর সেই প্রসাদামৃত ব্রজবাসীদের বিতরণ করে দিতেন। সকলেই সে সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করে ধন্য হতেন, তৃপ্ত হতেন।
ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবার রাতুল চরণে অধমা রাধাবিনোদিনীর ভক্তিপূর্ণ প্রাণের প্রণতি নিবেদিত হল ।
সমাপ্ত