আমরা জানি, প্রাত্যহিক জীবনের চালিকা শক্তি হচ্ছে জ্ঞান ও শিক্ষা । এখন দেখা যাক জ্ঞান ও শিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি ? শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তনির্হিত শক্তি ও সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হয় এবং জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত হয় । এই জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ তার সমাজকেও সমৃদ্ধ করে । শিক্ষা ব্যক্তি ও সমষ্টির জ্ঞান, সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা, চরিত্র ও মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটায় । আবার অনেকের মতে, বিদ্যা হলো একটা পুস্তকে আবদ্ধ, একটি জ্ঞানের শিখা মাত্র । আর জ্ঞান হলো সেই শিখা থেকে অসংখ্য শিখা হয়ে আলোকিত হওয়ার উপায় । শিখার আলোয় চারিদিকে আলোকিত হয় । জ্ঞান বলতে কোনো বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা থাকাকে বোঝায় । দর্শন শাস্ত্রের জ্ঞান নিয়ে যে অংশটি আলোচনা করে তাকে আবার জ্ঞানতত্ত্ব বলে ।
সম্ভবত আমার মতো অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক, “প্রযুক্তিঃ আশীর্বাদ না অভিশাপ ?” প্রচণ্ড গতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে । প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নয়ন বলতে গেলে সব কিছুকে সম্ভব করে হাতের নাগালে এনে দিয়েছে । আগে প্রযুক্তির ব্যবহার কম ছিল । প্রযুক্তির লভ্যতা ও ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মধ্যে । একটা ফোন করতে মানুষ ছুটতেন পিসিও বুথে । আরও কিছুদিন আগে দুই শব্দে মৃত্যু খবর জানাতে ছুটতে হতো দূরের পোস্ট অফিসে, টেলিগ্রাম করার জন্য । মানি অর্ডারের মাধ্যমে গ্রামে গঞ্জে টাকা পাঠানোর রেওয়াজ সেদিনও ছিল । ট্রেনের টিকিট, ব্যাঙ্ক, সিনেমা, বিল মেটানো, সবক্ষেত্রেই লম্বা লাইন । এমনও দেখা গেছে কলকাতার জিপিও’র পাশে কয়লা ঘাটের রেলের সংরক্ষিত কাউন্টারে ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য রাত থেকে লাইন দিতে হতো । বর্তমানে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে । প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনযাত্রার ছবিটার আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে । এইজন্য জেগে উঠেছে “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” যার প্রভাব ভৌগলিক সীমানাকেও ছাপিয়ে গেছে । জানা যায়, ভারতের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সারা বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে এই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কর্মসূচি ।
( ২ )
এখানে উল্লেখ থাকে যে, ডিজিটাইজেশনের দিকে ভারতের দ্রুতগতির যাত্রা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পরিকাঠামোর সম্প্রসারণ এবং গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সামগ্রী ও ডেটা সহজে নাগালের মধ্যে আসায় শিক্ষা ক্ষেত্রে EdTech এর দ্রুত উত্থান ও গ্রহণযোগ্যতার পথ সুগম হয়েছে । ভারতের EdTech ক্ষেত্র, বিশ্বের বৃহত্তম শিক্ষাপ্রযুক্তি ক্ষেত্রগুলির অন্যতম । আমরা জানি, EdTech হলো শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের উন্নয়ন ঘটাতে প্রযুক্তি, অর্থাৎ সফটওয়্যার এবং/অথবা হার্ডওয়্যারের ব্যবহার । EdTech অ্যাপ ডাউনলোড করা স্মার্টফোন এখন শিক্ষার সমার্থক হয়ে উঠেছে । শ্রেণীকক্ষ এখন ইট-সিমেন্টের চৌহদ্দী ছাড়িয়ে ক্লিক এবং পোর্টালে স্থানান্তরিত । দূর-দূরান্তে থাকা, আধুনিক সুবিধাবঞ্চিত পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে EdTech গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং এই ভূমিকার জন্য আগামীদিনে EdTech ক্ষেত্রের বিকাশ অব্যাহত থাকবে ।
শুধুমাত্র পড়ুয়ারাই নয়, শিক্ষকরাও আকর্ষণীয় শিক্ষণগত অনুশীলনের মাধ্যমে EdTech থেকে উপকৃত হচ্ছেন, তাঁদের শিক্ষাদান পদ্ধতি আরও উন্নত হচ্ছে । ইন্টারঅ্যাকটিভ হোয়াইটবোর্ড, শিক্ষামূলক ভিডিও, এবং অন্যান্য ডিজিটাল সম্পদের সুবাদে পড়ুয়াদের শিক্ষাগ্রহণ আরও মনোগ্রাহী হয়ে উঠছে ।
ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা মানুষ ছোটবেলা থেকে ইন্টারনেট এবং কম্পিউটারে সড়গড় । প্রযুক্তির সাথে তাদের হরিহর আত্মা । এরা বড় হয়ে উঠছে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, ইত্যাদিকে ঘিরে । এখানে বলা বাহুল্য, ডিজিটাল প্রযুক্তি তাদের জীবনের একটা স্বাভাবিক অঙ্গ । তারা সহজ-সাবলীল্ভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগায় । তাই এসব তরুন-তরুনীদের মাথা থেকে বের হয় অনেক ধরনের উদ্ভাবন । তবে এটা ঘটনা, ফোনাফুনি, ইমেল, টেক্সটিং ও টুইটের হাত ধরে এরা বুঁদ হয়ে আছে । বর্তমান প্রজন্মের মানুষেরা সহজেই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে । পুরানো ধ্যান ধারণার বাবা-মায়ের মতো নয়, তারা তাদের কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে বেশী আগ্রহী ।
ভারতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তির প্রভাব এখন অনেক সুগভীর । শোনা যায়, এই বছরের জানুয়ারীতে সংখ্যায় প্রায় আট বিলিয়ন লেনদেন হয়েছে ডিজিটাল প্রথায় । প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে দ্রুত কীভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে ভারত তার নজিরবিহীন উদাহরণ রেখেছে এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে । ভারত চায় সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার উপর আধারিত এই কর্মপন্থা অন্য দেশেও অনুসৃত হোক । কারণ এই পন্থা উদ্ভাবনমূলক কর্মসূচীসমূহের আঁতুরঘর হয়ে ওঠার এবং দরিদ্র দেশগুলির উত্থানের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে ।
( ৩ )
এবার আবার আসছি বিদ্যা, শিক্ষা ও জ্ঞান প্রসঙ্গে । ব্যক্তিগত ও জাতীয় নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান ভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপন সৃষ্টি করা । সুতরাং মূল্যবোধ তৈরী করা এই মুহূর্তে সময়োচিত ও আশুকর্তব্য । জ্ঞানের উৎস নিয়ে দার্শনিকদের ভিন্ন ভিন্ন মত । উল্লেখযোগ্য চারটি মত —– বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, বিচারবাদ ও স্বজ্ঞাবাদ । বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধিই যথার্থ জ্ঞান লাভের মাধ্যম বা উৎস । ডেকার্ট, লিবনিজ, প্রমুখ দার্শনিক বুদ্ধিবাদের সমর্থক । অভিজ্ঞতাবাদ অনুসারে, ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা জ্ঞানলাভের উৎস । লক, বার্কলি, হিউম প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক । বিচারবাদ অর্থ — বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়েই জ্ঞানের উৎপত্তি । কান্ট এই মতবাদের সমর্থক । স্বজ্ঞা বা সাক্ষাৎ প্রতীতিই যথার্থ জ্ঞান লাভের উৎস । দার্শনিক বার্গসোঁ স্বজ্ঞাবাদের প্রবক্তা । অন্যদিকে বিদ্যা প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান, শিক্ষা, দর্শন, বা কোনো বাস্তব জ্ঞানের ক্ষেত্রে “সঠিক জ্ঞান” বোঝায় যা বিতর্কিত বা খণ্ডন করা অসম্ভব ! যার অর্থ হলো বিবেচনা করা, সন্ধান করা, জানা, অর্জন করা বা বোঝা । অনেকের মতে বিদ্যা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য — মানুষ হওয়া । আবার অনেকে বিদ্যা অর্জন অন্য অর্থে বুঝে থাকেন । আমরা বুঝি বিদ্যা অর্থ শিক্ষা । দুটি দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষার উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে । একটি ব্যক্তিক, অপরটি সমষ্টিক বা রাষ্ট্রীক দৃষ্টি ভঙ্গি । ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি একটি পুরাতন প্রবাদ বাক্য- “লেখা পড়া করে যেই / গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই”- দিয়েই সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কেননা ঐ প্রবাদ বাক্যের মর্মার্থ আমাদের দেশের মানুষের মানসভূমে গভীর ভাবে শিকড় বিস্তৃত করে আছে । মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকের চিন্তা আরও সংকীর্ণ ও আত্মকেন্দ্রিক । অধিকাংশ বাবা-মা তাদের মেয়েকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান একটাই উদ্দেশে, যাতে শিক্ষিত ও ভাল অর্থ উপার্জকারী পাত্র শিকার করা যায় । তবে অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে । পারিবারিক সংস্কৃতির উপর এটি নির্ভর করে । তা ছাড়া বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে, নারী শিক্ষার কলেবর ঊর্ধ্বগতি ! কিন্তু ধনী-গরীব নির্বিশেষে এই সংকীর্ণ চিন্তা পরিহার করার সময় এসেছে । নারীরা এখন “মহলের” অলঙ্কার ‘মহিলা’ নয়; নারীরা এখন অনেক উন্নত-মনস্ক মানুষ । দেশের উন্নয়নের নিরিখে তারাও পুরুষদের সম-মর্যাদার । “Education is the method of civilization” “শিক্ষাই সভ্যতার বাহন ।” সভ্যতার অগ্রসরতা মানেই মানব সমাজের বিকাশ । আধুনিক যুগে প্রতি রাষ্ট্রের একটি শিক্ষানীতি থাকে এবং সেই অনুসারে শিক্ষা পদ্ধতিকে সাজানো হয় । আমাদের দেশেও একাধিক শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে । আমাদের জাতীয় শিক্ষা নীতির (NEP, 2020) উদ্দেশ্য হচ্ছে , বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু হ্রাস করে প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং অভিজ্ঞতা শিক্ষার উপর বৃহত্তর ফোকাস ।
সর্বশেষে এটাই বলা যায়, শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলো জ্ঞানার্জন । জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই মানুষের বিভিন্ন দিকে দক্ষতা বাড়ে । মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশলাভ তখনই ঘটে যখন জ্ঞানার্জন সম্ভব । জ্ঞান অর্জন করলে যেমন ব্যক্তির মানসিক উন্নতিসাধন হয় তেমনই ব্যবহারিক দিকেও প্রভূত উন্নতিসাধন ঘটে । সুতরাং প্রযুক্তির ব্যবহার যতই বাড়ুক, শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রবহমান অটুট থাকবে নিজস্ব মহিমায় ।
(তথ্যসূত্র ও ছবি: সংগৃহীত ও যোজনা ০২ & ০৫/২৩)