Categories
প্রবন্ধ

আমার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ :: অরূপ কুমার ভট্টাচার্য্য।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির শৈল্পিক অহঙ্কারের সৌধে অনিবার্যভাবে বিরাজমান। বাংলার সামাজিক উত্থান-পতনের এক যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁর জন্ম। ঐতিহ্যবাহী কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সন্তান হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে জ্ঞানচর্চার এক নির্মল পরিবেশের মধ্যে। মহর্ষি পিতার উপনিষদ চর্চা বালক বয়সেই রবীন্দ্রমানস-গঠনে প্রতিফলন ঘটে এবং সেই শিক্ষাকে তাঁর সমস্ত সত্তায় আত্মস্থ করে নেন। বাল্যকালের সেই উপনিষদিক শিক্ষার আলো সারাজীবন তাঁকে পথ দেখিয়েছে। উপনিষদে যে সত্যের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন সেই সত্যেরই উজ্জ্বল প্রভা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য সাধনা, মেধা ও শ্রমে নিজেই ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন যা তাঁকে বহুমাত্রিক শিল্পস্রষ্টার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। নিজের বিরাট সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তাঁকে এক যুগোত্তীর্ণ মহাপুরুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। বাংলা সাহিত্যে হাতে গোনা যে ক’জন বড় মাপের খ্যাতিসম্পন্ন লেখক আছেন তার মধ্যে একজন অন্যতম পুরোধা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবিভক্ত বাংলায় নবজাগরণের মধ্যাহ্নে রবি কিরণের উন্মেষ ঘটেছিল। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সত্য ও সুন্দরের ফলগুধারার মতো বহমান এবং সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে এবং বাংলা সাহিত্যজগতে হিমাদ্রির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন এক অলৌকিক ঐশ্বর্য নিয়ে। বাঙালির সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতির বহুলাংশ জুড়েই আছেন ধীমান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাঙালি তাই তার প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি সংশয়ে আশ্রয় নেয় সেই রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার পরিধি দিয়ে বিস্তৃত করেছেন গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিসর। আমরা তাঁকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় অভিষিক্ত করেছি। রবীন্দ্রনাথের সাফল্যের এই ক্রম-উত্তরণ কিন্তু একদিনে ঘটেনি। এক লহমায় তিনি ‘বিশ্বকবি’ বা ‘কবিগুরু’ অভিধায় ভূষিত হননি। সমগ্র রবীন্দ্র জীবন ও সৃষ্টির পিছনে রয়েছে তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘ অবিশ্রান্ত পথ চলা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন বর্তমানের দৃষ্টির সীমানায়। যে দৃষ্টি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে। তাই তিনি সব সময়ই আজকের রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। জীবনের প্রভাত থেকে অন্তিমলগ্ন তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা; সব্যসাচী লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সুর স্রষ্টা, গায়ক, সমালোচক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ হিসেবে অনন্য। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে, বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে বদলে দিয়েছেন বাঙালির মানসজগত এবং বাংলাকে দিয়েছেন বিশ্ব পরিচিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান। একে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, জীবন- চেতনায় রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অপরিহার্য। আমাদের জীবনের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে, মননের সঙ্গে, আন্দোলনে, ভাষার মাধুর্যে, দেশপ্রেমে সৃষ্টিশীল কর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আমাদের প্রাণের টানে, জীবনের টানে, চেতনার টানে, শিল্প ও সাহিত্যের টানে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে শিল্পের আরাধনায়। তাঁর কবিতার ছন্দ, বাণী ও সুর আমাদের হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় শান্তির শুভ্র পরশ। অনন্ত অসীমের সেই অসামান্য রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা প্রার্থনায় নতজানু হই, সমর্পিত হই, পরম বিশ্বাসে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, জীবনের কবি, প্রকৃতির কবি, গানের কবি সর্বোপরি মানুষের ভালোবাসার কবি হয়ে চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে অপার্থিব আনন্দলোকে আনন্দের বিস্তৃৃতি ঘটিয়েছেন। তিনি বাঙালি হয়েও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তাঁর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ছড়া, কবিতা কিংবা বড়দের জন্য লেখা কবিতা, গান, গল্প-উপন্যাসে আমরা বাঙালির সহজ সরল জীবনকে তুলে ধরতে দেখি। তাঁর নানা কাব্যগীতিতে আমরা প্রেম সৌন্দর্য, রোমান্টিক ভাবনা, আধ্যাত্মিক কল্পনার চিন্তাধারা পরিলক্ষিত হতে দেখি। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ গল্প উপন্যাস এখনো আমাদের সৃজনশীল মনকে আন্দোলিত করে। আমরা রাবীন্দ্রিক চরিত্রগুলোকে চলচ্চিত্র ও মঞ্চে রাজা ও রানী, বিসর্জন, রক্তকরবী, চিত্রাঙ্গদা, চিরকুমার সভা, বাল্মিকী প্রতিভা, তাসের দেশ, ডাকঘর, রাজা, মুক্তধারা, অচলায়তন, শাপমোচন, শেষের কবিতা, সফল সঞ্চায়ন দেখি; তখন আমরা নিজেরা কিছুটা রাবীন্দ্রিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ আছেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে তাঁর সৃষ্টির উৎসারণে কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, মঞ্চনাটক, টিভি নাটক, নৃত্যনাট্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত এবং বাংলার সমগ্র সংস্কৃতিতে। তিনি তাঁর মানবীয় উচ্চ ভাবনা-চেতনা আর মানুষের চিরায়ত অনুভূতি ভাষার সৌকর্য সাধন আর নিপুণ শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে কাব্য-সঙ্গীত-প্রবন্ধ-গল্পে আর চিত্রকলায় রূপায়িত করে মানুষের চেতনাকে শানিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ব্যাপকতা বিশ্বজুড়ে শিখরস্পর্শী প্রতিভায় উদ্ভাসিত যা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তায় ছড়িয়েছে রবির আলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনকে শিল্পবোধ থেকেই অনুভব করেছেন। আর সেজন্য তাঁর শিল্প-সৃষ্টি প্রায়শই জীবনসংলগ্ন। তিনি কাব্য, গল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটককে জীবনের প্রতিভাষে সিঞ্চিত করেছেন। যা রূপালঙ্কার, প্রতীক ও বিমূর্ততার দ্যোতনায় হয়েছে উজ্জ্বল। সব মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। দেড়শ বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে তাই চিরজাগরুক হয়ে আছেন।

সমগ্র বাঙালির মানস জগতে রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন আবেগ, প্রেরণায় জাগ্রত থাকবেন এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আলোর দিশারি হয়ে আলো ছড়াবেন যুগ থেকে যুগান্তরে। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর স্বপ্ন আর জীবন দর্শন আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে সত্য ও সুন্দরের।

——————————————————————————-

Share This
Categories
কবিতা

সুখ দুঃখের মাঝে আলো নিভে গেছে : লাজু চৌধুরী।

মিথ্যের যে এতো রং থাকে
আমার জানা ছিলো না।
হঠাৎ নিদ্রা ভেঙে দেখি তোমার শরীর জুড়ে অন্য এক
নারীর শাড়ির আঁচল।
আমার চোখে জল –
পৃথিবীর আলো কমতে শুরু করছিলো
হঠাৎ বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম –
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে,
সোডিয়ামের আলো মাথা নুইয়ে আছে।

যাকে আমি স্বর্বস দিয়েছি
সে অন্যের শাড়ির আঁচলে হামাগড়ি দিচ্ছে।
সুখ দুঃখের মাঝে আলো গেছে নিভে –
প্রশস্ত রাস্তা হাহাকার করছে
হারিয়ে যেতে মন চাইছে–
কতগুলো বছরকে নির্বাসনে নিয়ে পত্রপাঠ বিদায় নিলাম ।

আমি কেউ নই –
আমার কোন তুমি নেই –
যাওয়া আসার মাঝ খানে যে টুকু সময় ছিলো
সেটা ছিলো কাল্পনিক কাব্য রচনা ।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

বৃন্দাবনের পথে শ্রীজাহ্নবার অদ্ভুত লীলা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীনিত‍্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবাদেবী প্রথম বার যখন বৃন্দাবন গমন করেন সেটা ছিল সম্ভবতঃ ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দের (১৪৮২ শকাব্দ) মাঘ মাস। সহযাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থরচনাকার নিত্যানন্দ দাস, উদ্ধারণ দত্ত প্রমুখ। আর দ্বিতীয়বার ব্রজে পদার্পণ করেন ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৫০৪ শকাব্দ) খেতু্রীর উৎসবের পরে। সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পদকর্তা গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস, ভাস্কর নয়ন মিশ্র, পরমেশ্বর দাস প্রমুখ। দ্বিতীয়বার যাত্রাপথে জাহ্নবা মাতা অনেক অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেন। পথের মধ্যে রাত্রিযাপন কালে এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন যখন, সেসময় স্থানীয় কিছু নিন্দুক গ্রামবাসী লক্ষ্য করেন যে, সঙ্গীরা সকলে এক রমণীর (জাহ্নবাদেবীর) চরণে প্রণত হচ্ছেন। এ ঘটনায় তাঁরা অত্যন্ত আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হলেন। কারণ চন্ডীদেবীর পরিবর্তে কোন মানুষীর চরণে শরণাগত হয়েছিল সঙ্গীরা সকলে। তাই তাঁরা গ্রাম মধ‍্যস্থ চন্ডীমন্ডপে চন্ডীমাতার কাছে নালিশ করলেন যে, যারা দেবীর পরিবর্তে মানুষের চরণে পতিত হয় তাদের যেন তিনি সংহার করেন অবিলম্বে। শাস্তি বিধান অত্যন্ত প্রয়োজন। এমন বলে যখন তাঁরা নিদ্রায় গেলেন তখন ক্রোধিত দেবী চণ্ডী তাঁদেরকে স্বপ্নাদেশ দিলেন –“জাহ্নবাকে নারীজ্ঞানে অবহেলা করছো তো, তোমাদের মুণ্ডছেদন করবো আমি ! মহিমা না জেনে ধিক্কার করছো তাঁর! মানুষী জ্ঞান করছো! কিন্তু তিনি আমারও প্রণম‍্য। কাল প্রভাতেই অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইবে তাঁর কাছে। না হলে, আমি তোমাদের সংহার করবো।” নিন্দুকেরা সকলে পরদিবস প্রভাতেই মাতার চরণে পড়লেন। দোষ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন। ঈশ্বরী জাহ্নবা সন্তান জ্ঞানে সকলকে কাছে টেনে নিয়ে কৃপা করলেন। প্রত‍্যক্ষদর্শী নিত্যানন্দ দাসের বিবরণ অনুযায়ী এমন আরও এক অলৌকিক লীলা করেন জাহ্নবা ঠাকুরাণী পথে।

কুতুবুদ্দিন নামক এক দস‍্যুদলপতি নিজের সঙ্গীদের নিয়ে রাতে ডাকাতি করতে আসেন যে গৃহে জাহ্নবা মাতা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই গৃহেই। কিন্তু, ডাকাতদল সারারাত ধরে ঘুরেও পথ খুঁজে পেলেন না গৃহে প্রবেশের। গৃহের চারিদিকে বিশালাকার ভয়ংকর সব সর্প ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গৃহের দিকে এগোতেই ছুটে আসছিল সর্পরা দংশন করতে। রাত্রি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু প্রতীক্ষা ব্যর্থ হল। কিছুই করতে পারলেন না তাঁরা। শেষরাত্রে দৈববাণী হল—-“ঠাকুরাণীই তোমাদের জব্দ করলেন।” কুতুবুদ্দীন তাঁর সঙ্গীসাথীসমেত মাতার চরণে শরণ নিয়ে ক্ষমা চাইলেন। জাহ্নবাদেবী নামপ্রেম দিয়ে তাঁদের অযাচিত কৃপা করলেন।
এভাবে, পথে নানা পতিত উদ্ধার লীলা করতে করতে জাহ্নবা মাতা গণসমেত শুভাগমন করলেন মথুরায়। সেখান থেকে ব্রজে। শ্রীজীব গোস্বামী জাহ্নবাদেবী ও তাঁর সঙ্গীদের বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। ঈশ্বরীর আগমনে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দ যারপরনাই আনন্দিত হলেন। গোপাল ভট্ট, ভূগর্ভ গোস্বামী, লোকনাথ গোস্বামী, মধু পন্ডিত, কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী প্রমুখ মহাজনরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করলেন। জাহ্নবা মাতা যে কতখানি সম্ভ্রম-সম্মান নিজ গুণে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দের থেকে অর্জন করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুটি উদাহরণ দেওয়া যায় –(১) ঈশ্বরীর দ্বিতীয়বার বৃন্দাবন আগমনের পূর্বে যখন শ্রীনিবাস আচার্য বৃন্দাবন থেকে গৌড়ে গমন করবেন, তখন শ্রীগোপাল ভট্ট তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তিনি যেন গৌড়ে ফিরে জাহ্নবা মাতাকে বৃদ্ধ গোপাল ভট্টের খেদোক্তির কথা জানান –“ঈশ্বরীর পদযুগ না দেখিনু আর।” (প্রেমবিলাস , ৬ বিলাস)। আসলে অসুস্থ গোপাল ভট্টের বয়স হয়েছিল। তাই তাঁর শঙ্কা ছিল যে জাহ্নবা মাতার চরণ দর্শনের সৌভাগ্য বোধহয় আর এ জীবনে হবে না তাঁর। তাই তিনি অমন বিলাপ করেছিলেন।
(২) যখন প্রথমবার জাহ্নবা মাতা ব্রজে যান তখন রাধাকুণ্ড নিবাসী রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পর্ব ঘটেনি। তাই তিনি দ্বিতীয়বার ব্রজে আসছেন শুনে চলচ্ছক্তিরহিত বৃদ্ধ দাস গোস্বামীজী নিজে প্রেরণ করেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ও অন্যান্য বৈষ্ণববৃন্দকে , যাতে তাঁরা ব্রজ থেকে সসম্মানে জাহ্নবা মাতাকে রাধাকুণ্ডে নিয়ে আসেন। জাহ্নবাদেবী কৃপাদর্শন দান করে ধন্য করবেন দাস গোস্বামীজীকে তাহলে।
রন্ধন পটিয়সী দেবী জাহ্নবা বৃন্দাবনে আপন হস্তে ভোগ রন্ধন করে শ্রীগোবিন্দ, গোপীনাথ, মদনমোহন,রাধাদামোদর ও রাধারমণ –এই ছয় বিগ্রহকেই ভোগ নিবেদন করতেন। তারপর সেই প্রসাদামৃত ব্রজবাসীদের বিতরণ করে দিতেন। সকলেই সে সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করে ধন্য হতেন, তৃপ্ত হতেন।

ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবার রাতুল চরণে অধমা রাধাবিনোদিনীর ভক্তিপূর্ণ প্রাণের প্রণতি নিবেদিত হল ।

সমাপ্ত

Share This
Categories
প্রবন্ধ

অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য : ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী, মৃত্যু দিবস স্মরণে।

ভূমিকা—

 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘাট্লে দেখা যাবে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন আমাদের দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য। কিন্তু এখনো অনেকেই জানে না অনেকের নাম। কত শহীদ এর আত্মত্যাগের ঘটনা রয়ে গেছে অন্তরালে।  এখন আমরা জানব  ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য  সম্পর্কে কিছু কথা।

 

বিপ্লবী জীবন—-

 

এবার আমরা জানব অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য’র বিপ্লব জীবনের কর্মকান্ড নিয়ে কিথা। আমরা সকলেই জানি  আলিপুর বোমা মামলার সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা।

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

 

আলিপুর বোমা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিগণ—

৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর, বিহারে রাত সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যা করেন ক্ষুদিরাম বসু। সেই ঘটনার পর আলিপুর বোমা মামলা শুরু হয়। ১৯০৯ সালের ৬ মে আলিপুর বোমা মামলার রায় দেয়া হয়। রায়ে বিচারক বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বিভূতিভূষণ সরকার, বীরেন্দ্র সেন, সুধীর ঘোষ, ইন্দ্রনাথ নন্দী, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়ের, দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। পরেশ মৌলিক, শিশির ঘোষ, নিরাপদ রায় ১০ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড, অশোক নন্দী, বালকৃষ্ণ হরিকোণে, শিশির কুমার সেন ৭ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড এবংকৃষ্ণ জীবন সান্যাল ১ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন। আপিলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয় এবং তার বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান এবং অনেকের সাজা হ্রাস করা হয়।

 

স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ—–

 

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।

 

রচিত গ্রন্থ—-

 

এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

 

মৃত্যু—-

 

১০ মে, ১৯৬২ সালে মহান এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রয়াণ ঘটে।

 

।।তথ্য ঋণ: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

ব্রতচারী নিয়ে দুটি কথা : দিলীপ রায়।

আজ ১০ই মে, ব্রতচারী দিবস ৷ ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্তের জন্মদিনকে স্মরণে-সম্মানে আজকের দিনটি ব্রতচারী দিবস হিসাবে পালিত হয় বা হচ্ছে । ব্রত শব্দের অর্থ তপস্যা ও সংযমের সংকল্প । বিশেষ ব্রত নিয়ে যারা চলে , তারাই ব্রতচারী । তাই ব্রতচারীদের ব্রত পালন করার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে — সত্যনিষ্ঠা, সংযম, অধ্যবসায় ও আত্মনির্ভরতা । মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্রতচারীদেরকে – জ্ঞান , শ্রম , সত্য , ঐক্য ও আনন্দের সাথে জীবনযাপন । বাঙালির দৈহিক-মানসিক গঠন এবং নৈতিক বোধ উন্নয়নের ভাবনা থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত প্রাসঙ্গিক নৃত্য-গীত অবলম্বন করে গুরুসদয় দত্ত ১৯৩২ সালে ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন । ব্রতচারী আন্দোলন হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উন্নয়নের আন্দোলন । আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয়চেতনা ও নাগরিকত্ববোধ । গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারণের শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হবার শিক্ষা ।
এবার আমরা গুরুসদয় দত্ত সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করি । ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত ১৮৮২ সালের ১০ মে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । গুরুসদয় দত্ত সাত বছরে পিতৃহারা, চোদ্দ বছরে মাতৃহারা হয়ে জেঠুর কাছে মানুষ হন । বালক বয়স থেকে গুরুসদয় দত্ত ছিলেন দুরন্ত , নির্ভীক আর একই সঙ্গে হৃদয়বান । ছোট বেলা থেকেই তিনি সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । প্রয়োজনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বন্যাত্রাণে, অগ্নি নির্বাপনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন । গ্রামের মাইনর স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু । তারপর সিলেট শহরের ইংরাজি মাধ্যম স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং মেধানুসারে তিনি অসম প্রদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেন । কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করে তিনি বিলেত যান । ১৯০৪ সালে তিনি আই.সি.এস. পাশ করেন এবং মেধা তালিকার সপ্তম স্থান অধিকার করেন । তিনি ছিলেন সরকারি কর্মচারি । জেলাশাসক, কালেক্টর, কৃষি ও শিল্প বিভাগের সচিব হিসাবে কাজ করেছেন । সরোজ নলিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় । ১৯৪০ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন ।
১৯৩২ সালে তিনি ব্রতচারী প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৩৪ সালে ব্রতচারী সমিতি এবং ১৯৪১ সালে কলকাতার জোকায় ব্রতচারী গ্রাম স্থাপন করেন । ব্রতচারী আন্দোলনে কেউ সামিল হতে চাইলে তিনটি উক্তি স্বীকার করে নিতে হতঃ-
১। আমি বাংলাকে ভালবাসি
২। আমি বাংলার সেবা করব
৩। আমি বাংলার ব্রতচারী
গুরুসদয় দত্ত সারাজীবন লোকশিল্প আর সংস্কৃতির সন্ধানে প্রবৃত্ত ছিলেন । তিনি রায়বেঁশে (রায়বেঁশে হচ্ছে পুরুষদের দ্বারা লোকযুদ্ধ নৃত্যের একটি ঘরানা), কাঠি, ধামাল, ঝুমুর, ব্রত, ঢালিনৃত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । ব্রতচারীদের মধ্যে তিনি “প্রবর্তক জী” নামে খ্যাত ছিলেন । ব্রতচারীদের অভিবাদন-ভঙ্গি, মাতৃভাষা প্রীতি, স্বাস্থ্যজ্ঞান, সত্যনিষ্ঠা, সংযম, প্রফুল্লভাব, অধ্যবসায়, আত্মনির্ভরতা খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে । রবীন্দ্রনাথ সহ তৎকালীন সময়ের বহু বিখ্যাত ব্যক্তি গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন । তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যেগুলো বর্তমানে দুর্লভ । গ্রাম পুনর্গঠন , সমবায় প্রথায় চাষ, লোকশিল্প সংগ্রহ, ম্যাগাজিন প্রকাশ সহ তিনি নানান কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন । লোকসাহিত্য গবেষক, লেখক, স্বদেশপ্রেমী গুরুসদয় দত্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪১ সালের ২৫ জুন পরলোক গমন করেন । এখনও তাঁর লোক ঐতিহ্যের সন্ধান বাঙালি জাতিকে আত্ম-আবিষ্কারের পথে চালিত করে । তাঁর জন্মদিনে শতকোটি প্রণাম । (তথ্যসূত্র: সংগৃহীত)
——০——–

Share This
Categories
প্রবন্ধ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩-তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

বাংলা সাহিত্য জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি আমাদের সকলের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য, “ভাবগভীরতা, চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক, সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা ।“ তাঁর লেখা অসাধারণ সব কবিতা ও গান, আজও প্রত্যেকটা বাঙালীর মন কাঁড়ে । তিনি শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ কবি বা গল্পকারই ছিলেন না, সেইসাথে ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিকও । রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক । ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল । কথা সাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন । সমাজ কল্যাণের উপায় হিসাবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন এবং পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরূদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় মনুষ্য সেবার কথাই বলা হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ ঈশ্বরের পুজার কথা বলেছিলেন । সঙ্গীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন । রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি । তিনি দুই হাজারের উপর গান রচনা করেছেন । তাঁর রচিত “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে” — ভারতে এবং “আমার সোনার বাংলা” — বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গীত ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ই মে ১৮৬১ সালে ( ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ ) পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে অবস্থিত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে | তাঁর বাবার নাম ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি কিনা ছিলেন তদানীন্তনকালের ব্রাহ্মসমাজের একজন ধর্মগুরু এবং তাঁর মায়ের নাম সারদাসুন্দরী দেবী । অনেকেই জেনে অবাক হবেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাবা মায়ের ১৪তম সন্তান । বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা গ্রহণ করেননি । গৃহ শিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । মাত্র আট বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু । ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তাঁর “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশ পায় । এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ।

১৮৭৮ সালে মাত্র সতের বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান । ১৮৮৩ সালে ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় বেণীমাধব রায়চৌধুরী নামে ঠাকুরবাড়ির এক অধস্তন কর্মচারীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে । বিয়ের সময় ভবতারিণীর পুণরায় নামকরণ করা হয় এবং তাঁর নাম পাল্টে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী । ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন । ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মাচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন । সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন । ১৯০২ সালে তাঁর পত্নী বিয়োগ হয় । ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে “নাইট” উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৯১৫ সালে জালিনওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন । ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় । দীর্ঘজীবন তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন ।

অবশেষে দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট , জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর ।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী ও কেলে কুকুরের আশ্চর্য কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শান্তিপুরের গোঁসাইজী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর গৃহমন্দিরে এক পোষ্য  সারমেয় (কুকুর) থাকত। নাম তার কেলে। কেলে ছিল অন্যান্য কুকুরদের থেকে একদম আলাদা। কোনদিনও সে আমিষ আহার গ্রহণ করেনি। বা , কারোর উচ্ছিষ্টেও (এঁটো খাবার) মুখ দেয়নি। সে সবসময় প্রসাদ গ্রহণ করতো। আর প্রতিদিন শান্তিপুরের শ্যামসুন্দর মন্দিরকে প্রদক্ষিণ করতো। মন্দিরে কীর্তন চলাকালীন এক মনে দূর থেকে বসে তা শুনতো । সেসময় মাঝেমধ্যেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। কাউকে কামড়ানো-হাঁচড়ানো, বলাবাহুল্য তা তো জীবনে করেনি সে। বিজয়কৃষ্ণ তাই বলতেন প্রায়ই ,”ওরে কেলেকে তোরা আর পাঁচটা কুকুরের মত ভাবিস না। ও কোন সাধারণ কুকুর নয় । ও বিশেষ কার্যসাধন করতে পৃথিবীতে এসেছে।” তাঁর কথা শুনে অনেকে ভাবতো—-কি এমন কাজ করবে কেলে ?  কবে আসবে সেদিন, যেদিন চোখের সামনে এমন কিছু দেখতে পাবো ?

১২৯৫ বঙ্গাব্দের অর্থাৎ ১৮৮৮ সালের ২৬শে ফাল্গুন শুক্রবার, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী তাঁর পুত্র এবং কন্যা উভয়ের বিবাহ দিলেন একসাথে। ঢাকার গেন্ডারিয়ার আশ্রমে বেশ সমারোহের সাথেই পুত্র যোগজীবনের নামে সাথে পাত্রী বসন্তকুমারীর আর জগদ্বন্ধু মৈত্রের সাথে কন্যা শান্তিসুধার শুভ পরিণয়   সুসম্পন্ন হল । এই বিবাহপ্রদানের কিছুদিন পরই গোস্বামীজি শান্তিপুরে  চলে আসেন আর বেশ কিছুকাল বাস করেন এখানে ।সেসময় একদিন স্থির করলেন নগর সংকীর্তন করতে করতে সকলে মিলে বাবলায় যাবেন।

বাবলা অর্থাৎ সেই স্থান যেখানে গৌর-আনা ঠাকুর সীতাপতি শ্রীঅদ্বৈত সাধনা করতেন।  এই বাবলাতেই তিনি গঙ্গাজল তুলসীপত্র হাতে নিয়ে অশ্রুসজল নয়নে সুরধনীর আবক্ষ বারিতে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের আরাধনা করে তাঁকে মর্ত্যে অবতীর্ণ হতে প্রার্থনা জানাতেন। দীর্ঘ ১২ বছর এমন আকুতি ভরা অনুনয় করার পর অবশেষে নবদ্বীপে শ্রীজগন্নাথ মিশ্রের পত্নী শ্রীশচীদেবীর  গর্ভসিন্ধুতে শ্রীহরিরূপ চন্দ্র  উদিত হয়েছিলেন শ্রীগৌরাঙ্গ রূপে। এখন অবশ্য আর গঙ্গা দেখা যায় না। শুধু খাতটাই রয়ে গেছে। কিন্তু সেসময় পতিতপাবনী  গঙ্গা শান্তিপুরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিতা ছিল। তখন গঙ্গার স্রোত সুরধনী নাম নিয়ে  এই বাবলা পুণ্যভূমির  ধার ঘেষে বহমানা ছিল। বর্তমানে সেই সুরধনী প্রায় মৃতপ্রায় দশায় । উল্লেখ্য, বৈষ্ণব ইতিহাস তথা শান্তিপুরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত এই ১৪কি.মি. দীর্ঘ সুরধনী নদীকে বাঁচাতে , তাকে স্বাভাবিক স্রোতস্বিনী ছন্দে ফিরিয়ে আনতে উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সংস্কারের দাবিতে শান্তিপুরের পরিবেশ ভাবনা মঞ্চ দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে সম্প্রতি।

শান্তিপুর শহরের ৩.২ কিলোমিটার উত্তরে বাবলার অবস্থান । এখন এই স্থান আদি শান্তিপুর নামে পরিচিত হলেও অদ্বৈত প্রভুর আমলে শান্তিপুরেরই অন্তর্গত ছিল । এই স্থান অতীতে বাবলা বৃক্ষে পরিপূর্ণ থাকায় নাম হয়েছে বাবলা। বাবলার উত্তরে পঞ্চবটী । পঞ্চবটীর কাছে ছিল দোলমঞ্চ । যেখানে অদ্বৈত প্রভুর দোল হতো। এখন দোল উৎসব শ্রীমন্দিরেই হয় , যা সপ্তম দোল নামে পরিচিত।  সপ্তম দোলকে উপলক্ষ্য  করে বহু ভক্ত সমাগম হয় প্রতি বৎসর । মহোৎসবও হয় সেদিন।

এই বাবলাতেই অদ্বৈতের দীক্ষালাভ হয়েছিল শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদের কাছে। আবার এখানেই অদ্বৈত দীক্ষা প্রদান করেছিলেন নামাচার্য শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে।   এখানেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাসের পূর্বে শ্রীনিত্যানন্দের সাথে আসতেন অদ্বৈত গৃহে। মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর বৃন্দাবন যাবেন বলে তিনদিন ধরে রাঢ়দেশে ঘোরার পর যখন তাঁকে  নিত্যানন্দ ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন শান্তিপুরে  , তখন এই বাবলাতেই এনেছিলেন।  এখানেই শচীমাতা সহ নবদ্বীপবাসীরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় গোরাচাঁদকে দেখতে হাজির হয়েছিলেন। তখন তো গৌরাঙ্গ নবীন সন্ন্যাসী,  নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী। এখানে অদ্বৈত প্রভুর গৃহে সেসময় দশদিন মহাপ্রভু ছিলেন। পরবর্তীতে ১৫১৪-১৫ সালে অবশ্য আবারও বেশ কিছুদিন ছিলেন তিনি । এখানেই  লীলা সাঙ্গ করেন আচার্য অদ্বৈত । বাবলা তাই শ্রীঅদ্বৈতের শ্রীপাট। একে অদ্বৈতপাটও বলা হয়।

শ্রীপাটের মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজিত রয়েছেন  আচার্যের দারুময় বিগ্রহ । স্বয়ং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী বলেছিলেন—–এই বিগ্রহের শ্রীবদনপানে চেয়ে নয়নে নয়ন স্থির রেখে একমনে নিজের দীক্ষামন্ত্র জপ করলে বিগ্রহে অদ্বৈতের উপস্থিতির অনুভূতি লাভ করবে , দর্শনও পাবে। অনেক ভক্তসুজন সেই সৌভাগ্য লাভ করেছেনও।

ফিরে আসি সেদিনের সংকীর্তনের কথায় । সালটা ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ । চৌদ্দ মাদল নিয়ে মহানন্দে মনপাগল, প্রাণহরণ করা কীর্তন করতে করতে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী ভক্তগণ সমেত এসে উপস্থিত হলেন বাবলায় । গৃহপালিত সারমেয় কেলেও  সংকীর্তন দলের অনুগামী হল । সেও যে ভক্ত । ভক্ত না হলে এমন ভক্তের ন্যায় আচরণ করবেই বা কেন ! যাহোক,  যখন গঙ্গার খাত পেরোনোর সময় হল তখন সহযাত্রীদের অনেকের নজরে পড়ল একটা কুকুরও তাদের সাথে খাত পার হবার চেষ্টা করছে। তারা তাকে তাড়াবার চেষ্টা করতে থাকলো।কেলে ‘কুঁই কুঁই’ করতে করতে গোস্বামী প্রভুর চরণে পরলো। ভাবখানা এমন যে, আমাকেও তুমি ভবনদী পার করাও । যেতে অনুমতি দাও তোমাদের সাথে । আমিও যে উদ্ধার হতে চাই ।

গোস্বামীজী সকলকে উদ্দেশ করে বললেন, “তোমরা ওকে তাড়িও না গো। ওকে যেতে দাও । চলুক আমাদের সঙ্গেই ।”

প্রভুর আজ্ঞা পেয়ে সকলে  বললেন, “চল ,চল তোকে গোঁসাইজী কৃপা করেছেন । তুইও আমাদের সাথে তবে চল।আর কেউ কিছু বলবে না তোকে।” ভক্তেরা হাসলেন আনন্দে কুকুরের এমন কান্ড দেখে।  হরিনাম যে মানব ,জীবজন্তু ,বৃক্ষ-লতা, গুল্ম সকলকে মত্ত করে দেয়—-এ ঘটনা যেন তারই প্রমাণ।

সংকীর্তন দল অচিরেই শ্রীঅদ্বৈত শ্রীপাটে প্রবেশ করলো।  কেলে দাঁড়িয়ে রইলো অদূরে এক কোণে । মন্দিরে কীর্তনের তালে তালে ভক্তেরা আনন্দে ভাবাবেশে নৃত্য করছেন । এমন সময় একটা দিব্য ঘটনা ঘটলো। অপর কোন কীর্তনের দল বুঝিবা মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসছে। সে কীর্তনের সুরের অদ্ভুত সুরেলা প্রাণছোঁয়া আবেশ।  তাই অনেক ভক্তই মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে পথে অপেক্ষা করতে লাগলেন সেই কীর্তন দলের জন্য। কেউ কেউ আবার আরও একটু এগিয়ে গেলেন কীর্তন দলের আগমনের আশায়। তাঁরাও তাতে যোগ দিতে চান। তাই প্রবল উৎসাহী। অথচ সকলেই অবাক হলেন এই ঘটনায় যে, সুরের ঝংকার , মৃদঙ্গ-করতালের ঝনঝনি শ্রবণ করা গেলেও কেউ কোথাও নেই।  এক সময় তাঁরা মন্দিরে আবার ফেরত এলেন হতাশ হয়ে ।বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি। তিনি মন্দিরেই বসেছিলেন। ভক্তদের ফিরে আসা দেখে হাসলেন আর বললেন, “ওগো , এ কীর্তন যে মহাপ্রভু , নিত্যানন্দ, আচার্যপ্রভু আর তাঁদের পার্ষদদের    করা কীর্তন। মহাপ্রভুর নিত্যলীলার অংশ এ ।” বাবলা শ্রীপাটে পাঁচ শতাধিক পূর্বে ঘটা মহাপ্রভুর লীলা যে নিত্য ! কোন কোন ভাগ্যবান তা দর্শন করতে পারেন । সেই নিত্যলীলার কীর্তনের সুরই সেদিন অনুরণিত হয়েছিল বাবলা শ্রীপাটের নির্জন , ছায়াঘেরা, সুশীতল , মনোরম পরিবেশে।

ওদিকে কেলে সারমেয় সবটাই নিরীক্ষণ করছে মনোযোগ  দিয়ে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এক একটা দৃশ্যের সে প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বিজয়কৃষ্ণ তাকে আদর করে নাম দিয়েছিলেন ‘ভক্তরাজ’। ভক্তরাজ এসব মন দিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎই উঠে চলে গেল মন্দিরের কিছু দূরের পঞ্চবটীর কাছে একটি স্থানে।
আর সেখানে তার পা দিয়ে জোরে জোরে মাটি হাঁচরাতে লাগলো। তারপরই ছুটে গিয়ে গোস্বামী প্রভুর বহির্বাস দাঁতে ধরে টানতে থাকলো। সকলে , “হাই হাই” করে উঠলো।  গোস্বামী প্রভু ভ্রূ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলেন হঠাৎ ভক্তরাজ কেলে এমন আচরণ করছে কেন !  তিনি বললেন, “কি হয়েছে , কি হয়েছে ?” কাপড় আর ছাড়ে না ভক্তরাজ ।  টানছে সমানে।  যেন বোঝাতে চাইছে তার সাথে যেতে। ‌   গোস্বামী প্রভু বলে উঠলেন, “আচ্ছা চল , চল ! কি হয়েছে ?কোথায় নিয়ে যাবি ? নিয়ে চল।  কেলে তখন কাপড় ছেড়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলতে থাকল , চোখের ভাষায় ডাকতে থাকলো মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোস্বামী প্রভুকে । তার পশ্চাতে পশ্চাতে গোস্বামীজী গেলেন।  ভক্তরাও অনুসরণ করলেন তাঁদের প্রিয় গোঁসাইজীকে।

পঞ্চবটীর কাছে পূর্বের স্থানে এলো ভক্তরাজ। এসেই মাটি হাঁচড়ে-হাঁচড়ে কিছু বোঝাতে চাইলো । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ভাবলেন তাহলে কী মাটির তলায় কিছু আছে , যা ভক্তরাজ দেখাতে চাইছে।  তিনি আদেশের সুরে বললেন, “এই এখানে মাটি খুঁড়ে দেখতো, কিছু আছে কিনা ! এমনটা কেন করছে ভক্তরাজ!  বোঝা যাচ্ছে না , নাহলে ।” এক-দু’জন মাটি খুঁড়লেন । কিন্তু কই, কিছুই তো নেই সেখানে। বৃথাই কুকুরটা কাওতালি করল কতক্ষণ ধরে ! — সকলে ভাবলেন। প্রভুজী কেলেকে উদ্দেশ করে বললেন, “কী রে?  কই রে? কী দেখলি তুই ?  কিছুই তো নেই এখানে।” গোস্বামীজী কেলের দিকে চাইতেই কেলে সতৃষ্ণ ব্যাকুল নয়নে কিছু যেন বোঝাতে চাইল। ছটফট করতে করতে আবার সেই স্থানে গিয়ে মাটি হাঁচড়াতে থাকল। বিজয়কৃষ্ণ চিন্তা করলেন, “এমন তো করে না কখনো শান্তশিষ্ট কুকুরখানা ! আজ এমন চঞ্চল হয়ে উঠল কেন?”

তিনি বলে উঠলেন , “এই আবার আর একবার মাটি তোলো তো তোমরা । আরো গভীর করে মাটি ওঠাও।” অগত্যা আবার মাটি খোঁড়া হতে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোদাল যেন কোন ধাতব পদার্থের গায়ে লাগলো। “হ্যাঁ প্রভু। কিছু একটা আছে মাটির তলায়।” মাটি খোঁড়া হতে থাকলো । অচিরেই একটা পিতলের হাড়ি প্রকাশ হলো।  পিতলের হাড়িটি বার করা হলো মৃত্তিকার তলদেশ থেকে ।
কী আছে তাতে? যা ছিল তা বড় দুর্লভ সম্পদ  । শুধু দুর্লভ নয় , সুদুর্লভ —– শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর নামাঙ্কিত একজোড়া কাষ্ঠ পাদুকা , একটা কমন্ডুল আর হস্তলিখিত পুঁথি শ্রীঅদ্বৈতের , যা একটা বাক্সের মধ্যে ভরা ছিল।  সকলের চোখ কপালে উঠলো এহেন ঘটনায়। ভাষাহীন প্রত্যেকে।  তখন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী পাদুকাটি নিজের মাথায় বসিয়ে নৃত্য শুরু করলেন। ভক্তেরা আনন্দে মাতোয়ারা আজকের এই শুভ দিবসে এমন দিব্যবস্তু লাভ করার জন্য।

ভাবের ঘোরে প্রভু বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী সংজ্ঞা হারালেন । ভক্তদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জ্ঞান ফিরে আসলো তাঁর । দেখা গেল কেলেও অচৈতন্য দশায় মাটিতে পড়ে আছে। গোস্বামীজী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নাম শোনাতে থাকলেন। এ সময় জ্ঞান ফেরত আসলো কেলের । গোস্বামীজী তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন ।খানিক আদর করার পর বললেন, “ভক্তরাজ ! এবার তোমার কার্য শেষ হয়েছে।  যে জন্য তুমি এসেছিলে তা সাঙ্গ হল । এবার তুমি গঙ্গালাভ  করতে পারো।”

অনেক রাত পর্যন্ত সংকীর্তন চললো। বাবলা ছেড়ে ভক্তেরা ফেরৎ গেলেন তারপর একসময়।

পরদিন অতি অদ্ভুত ভাবে দেখা গেল গঙ্গায় হাঁটুজলের মধ্যে কেলের মৃতদেহ পড়ে আছে। যেখানে কিনা সাঁতার জানতে পারে বলে কুকুরদের সুনাম, সেখানে গঙ্গার এই সামান্য জলে কেলে যে কী ভাবে মারা পড়লো, তা এক প্রশ্ন ! কী অদ্ভুত! গোস্বামীজী নিজের হাতে গঙ্গাতীরে পলি খনন করে সমাধিস্ত করলেন ভক্তরাজ কেলেকে। সে তার দায়িত্ব পূরণ করে চলে গেল স্বেচ্ছায়।

নিশ্চয় মনে প্রশ্ন জাগছে , যে বস্তুগুলো পাওয়া গেল সেগুলোর কি হলো?  সেসবের অধিকার নিয়ে গোস্বামী পরিবারের লোকেদের মধ্যে কলহ শুরু হলো। আর তাই  শেষমেশ গোস্বামীপ্রভু  বাবলায় অদ্বৈত বিগ্রহের তলায় সমাধিস্ত করে দিলেন সেসব। তবে থেকে সেই ঐতিহ্যপূর্ণ দ্রব্যগুলি লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেল।

সমাপ্ত

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস; চতুর্থ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

কুহেলির ধারণা, “যত দিন যাচ্ছে পান্তা মাসি বাবার সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধন শক্ত করতে ততো মরিয়া হয়ে উঠছে ।“ পান্তা মাসি এটাও বুঝতে পারছে, তার পথের কাঁটা হচ্ছে কুহেলি । পান্তা মাসি ইদানীং কুহেলিকে সহ্য করতে পারছে না । তাই প্রমাদ গুনছে, কীভাবে কুহেলিকে টাইট দেওয়া যায় এবং কীভাবে কুহেলির অগোচরে সানাইকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায় !
সপ্তাহ খানেক আগে রাত্রিবেলায় পান্তা মাসির সাথে সানাইয়ের প্রচণ্ড ঝগড়া ! ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দু কুহেলি । তুমুল বাগ্‌বিতণ্ডা । ঝগড়ার কথাগুলি শুনে কুহেলি তাজ্জব ! পান্তা মাসির বক্তব্য, “আশা দিয়ে কেন তাকে ঝোলাচ্ছ ?” কুহেলি বুঝতে পারলো না, পান্তা মাসি কীসের আশার কথা বলছে ? পান্তা মাসি খুব নিম্ন মানের অরুচিকর কথার মাধ্যমে কুহেলির বাবাকে ফাঁসাতে চাইছে । দুইজনের কথাতে কুহেলি নিশ্চিত, তার বাবা পান্তা মাসির কাছে ফেঁসে গেছে ।
বাবাকে পরেরদিন কুহেলি বলেছিল, “আমি বড় হয়েছি । বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না আমি করতে পারি । তাহলে পান্তা মাসিকে আর কী দরকার ?”
কথাটা শুনে সানাই কিচ্ছুক্ষণ কুহেলির দিকে করুণ দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল । কোনো কথা বলেনি । কিন্তু বাবার করুণ চোখের তাকানোর মাহাত্ম্য কিছুটা হলেও কুহেলি আন্দাজ করতে পেরেছিল । কুহেলির বদ্ধ ধারণা, তার বাবা পান্তা মাসির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে ।
কুহেলি ভরতপুর হাই স্কুলে এগারো ক্লাসে ভর্তি হলো ।
প্রথম কয়েকদিন সানাই মেয়েকে ভরতপুর পর্যন্ত পৌঁছে দিতো । কিন্ত কুহেলিকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার পর সানাই বাড়ি ফিরতে অনেক দেরী করত । কুহেলি এটা জানতে পারে কাকীমার কাছে । যখন বাড়ি ফিরত, তখন সঙ্গে পান্তা মাসি । কোথায় যেতো কুহেলি সেটা উদ্ধার করতে পারেনি । এমনকি সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেও সঙ্কোচ বোধ করত । তাই তাকে পৌঁছে দিয়ে বাবা কোথায় যায়, আজও কুহেলির অজানা !
ভরতপুর হাই স্কুলের কলেবর তুলনামূলকভাবে অনেক বড় । ক্লাসের বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়ে ঐ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ । কুহেলিরা কয়েকজন বাইরের স্কুল থেকে আগত এবং নবাগত । ফলে ক্লাসে ঐ স্কুলের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগলো । ভরতপুর স্কুলে পড়াশুনায় কুহেলির তেমন কোনো সমস্যা নেই । কিন্তু ফেরার সময় কিছু উটকো ছেলের পাল্লায় পড়তে হচ্ছে কুহেলিকে । সম্ভবত তাদের বাড়িতে কাজকর্ম বলে কিছু নেই । যার জন্য রাস্তার পাশে গাছ তলায় বসে আড্ডা । তারা ইচ্ছা করেই বিকেলবেলাটা বেছে নিয়েছে । স্কুল ছুটি হলে ছেলে-মেয়েগুলি ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরবে । যারা আমলাই, খয়রা, ইত্যাদি গ্রামের ছেলে-মেয়ে, তারা সকলেই ঐ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফেরে । আড্ডাবাজ ছেলেগুলির টার্গেট, উঁচু ক্লাসের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ।
আজ বুধবার । স্কুলে যাওয়ার জন্য মন বসছিল না কুহেলির । বাড়িতে বসে ঘুমানোর ইচ্ছা । সকাল থেকে শরীরটা আলস্যে ভরা । কোনোকিছুতেই মন বসছে না । বাবার কথা ভেবেই কুহেলির মনটা আনচান ! বাপ-বেটির মাঝখানে ঢুকে পান্তা মাসি কুহেলির জীবনে বিপদ ডেকে আনছে কিনা সেটা ভেবেই কুহেলি আকুল । পান্তা মাসির জন্য ভবিষ্যতে তার কপালে কী বিপদ লুকিয়ে আছে, সেটা ভেবেই কুহেলি অস্থির ! ভাবনাটা ইদানীং বেশী বাড়ছে । তাই বাবাকে কুহেলি বলল, “আজ স্কুলে যেতে মন বসছে না । আর তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্লাসও নেই । যার জন্য আজ আমার স্কুলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক ।“
“না, মা । বাড়িতে বসে থাকলে বরং উল্টোটা হবে । শরীর আরও খারাপ হতে পারে ।“ বাবা কুহেলিকে বোঝালো ।
কুহেলির গলার আওয়াজ পেয়ে পান্তা মাসি কোথা থেকে ছুটে এসে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “স্কুলে না গিয়ে নিশ্চয় শীতলের সঙ্গে দুনিয়া ঘোরার মতলব ?” কুহেলিকে বলেই সানাইয়ের দিকে তাকিয়ে পান্তা মাসি একরকম চিল্লিয়ে বলল, “তোমাকে আগেও বলেছি এই মেয়েটা কেলেঙ্কারি বাধিয়ে তবেই ছাড়বে । কিছুতেই শীতলকে ভুলতে পারছে না । মনে হচ্ছে শীতল তাকে বিয়ে করবে ! আমার কাছে শুনে নাও, শীতল জিন্দেগিতে এই মেয়েকে বিয়ে করবে না । নতুন নতুন মেয়েদের সাথে ওদের ফষ্টিনষ্টি করা স্বভাব !”
শীতলের নামে পান্তা মাসির মুখে কটুকথা শুনে কুহেলি চিৎকার করে পান্তা মাসিকে বলল, “ভদ্রভাবে কথা বলো । এরপরে শীতলের নামে একটি কথা বললে তোমাকে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবো । আমাদের বাড়িতে থাকছ, আমাদের অন্ন ধ্বংস করছ আর আমাদেরকে নিয়ে তোমার জ্বালা !“ তারপর রাগে গজরাতে গজরাতে সানাইকে বলল, “বাবা, খুব তাড়াতাড়ি পান্তা মাসিকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলো । নতুবা আমি থানার সাহায্য নিয়ে পান্তা মাসিকে বাড়ি থেকে তাড়াবো ।“
“মা, ঐভাবে বলতে নেই । পান্তা মাসি তোমার গুরুজন ।“ সানাই বোঝালো ।
বাবার কথা শুনে কুহেলি ছুটে ঘরের ভিতর ঢুকলো ।
“দেখেছো, তোমার আদরের মেয়ের আস্পর্ধা দেখেছো ? পুলিশ দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াবে ? সাহস থাকে তো তাড়িয়ে দেখাক !” চোখ বড় বড় করে সানাইকে পান্তা মাসি শাসালো । আবার বলতে শুরু করলো, “ওকে আজ স্কুলে পাঠাও নতুবা আমি ঘাড় ধরে স্কুলে পাঠিয়ে ছাড়ব ।“
“খবরদার ! তুমি আমার মেয়েকে কিচ্ছু বলবে না । যা বলার আমি বলবো ।“ সানাই রেগে গিয়ে পান্তা মাসিকে বলল ।
আমি তোমার চমকানোতে ডরাই না । আজ আমাদের সম্পর্কের একটা বিহীত চাই ? নতুবা অনন্তকাল আমি ধৈর্য ধরতে পারব না ।
তুমি কী করবে জানি না । আমি আগেও বলেছি আজও বলছি, মেয়ের বিয়ে না দিয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারব না । তোমার জন্য মেয়েটাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে পারব না ।
“তোমার অতিরিক্ত আহ্লাদের জন্য ঐ গুণধর মেয়ে একদিন আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে, এটা তোমাকে বলে রাখলাম !” জোর দিয়ে পান্তা মাসি সানাইকে বলল ।
তোমার কথামতো চাষের সব জমি বিক্রি করে দিলাম । আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে মেয়েটা বাঁচবে কীভাবে ? মেয়েটাকে অগাধ জলে ভাসিয়ে দিয়ে আমি সুখ আহ্লাদে বাঁচতে চাই না । এটা তুমি কেন বুঝতে পারছো না ?
“নিজে বাঁচলে বাপের নাম ! এটা বোঝো তো ?” পান্তা মাসি বলল ।
“তুমিই বোঝো । আমি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারব না ।“ তারপর বাইরে থেকে মেয়েকে ডাকতে শুরু করলো, “মা, রাগ করে থাকিস না । বাইরে বেরিয়ে এসে রেডি হয়ে স্কুলে যা মা ।“ মেয়ের কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো সানাই ।
এবার সানাই পান্তা মাসির কথা ভাবছে, সে আচ্ছা জ্বালায় পড়লো । পান্তা মাসি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে নতুন ঘর বাঁধার । ঘর বাঁধার ক্ষেত্রে কাঞ্চন নগরে থাকতে রাজি না । দূরে গিয়ে ঘর বাঁধতে চায় । সানাই বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছে, পান্তা মাসি কুহেলিকে সহ্য করতে পারছে না । অথচ পান্তা মাসি জানে, সানাইয়ের একমাত্র অবলম্বন কুহেলি । সেই কুহেলিকে নিয়ে তার যত হিংসা, বিদ্বেষ ! এটা কিছুতেই সানাই মেনে নিতে পারছে না । কুহেলি পান্তা মাসির পেটের মেয়ে নয়, কিন্তু তার পেটের মেয়ের মতো । সেটা সানাই বারবার বলা সত্ত্বেও পান্তা মাসি কুহেলিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না । অন্যদিকে পান্তা মাসিকে নিয়ে সানাই ঘর বাঁধার স্বপ্নও দেখছে, সেটা ঠিক । তবে সানাই চাইছে, মেয়েটাকে সঠিক জায়গায় পাত্রস্থ করে পান্তা মাসির সাথে ঘর বাঁধতে । কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, পান্তা মাসিকে থামানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।
কুহেলি বেজার মুখে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাবাকে বলল, “আমি স্কুলের জন্য তৈরী হচ্ছি । তুমি আমাকে ভরতপুর পৌঁছে দিয়ে আসবে ।“
সানাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ।
স্কুলে যাওয়ার পথে আইসক্রিমের বাক্স সমেত আইসক্রিমওয়ালাকে দেখতে পেয়ে কুহেলির কী আনন্দ ! তাই কুহেলির বায়না, “বাবা ! আইসক্রিম খাবো ।“
সানাই মেয়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলো, আইসক্রিম দেখে কুহেলির আনন্দ ঠিক ছোটবেলার আনন্দের মতো । ছোটবেলায় আইসক্রিমের বাক্সের শব্দ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে বাবার কাছে কুহেলির বায়না, “বাবা, আইসক্রিম !” আজ সেই রকম বায়না দেখে সানাইয়ের চোখে জল চলে আসছিল । নিজেকে সামলে নিয়ে আইসক্রিমওয়ালাকে বলল, “দাদা, বাটির আইসক্রিম দিন তো ?”
“বাটির আইসক্রিম নেই । তবে ভাল মানের আইসক্রিম আছে ।“ বলেই বাক্স থেকে নতুন মডেলের আইসক্রিম বের করে সানাইয়ের সামনে তুলে ধরলো ।
আইসক্রিম দেখে সানাই বলল, “একটু দাঁড়ান দাদা ! আমি মেয়ের কাছে জেনে আসি, সে এই আইসক্রিম খাবে কিনা ?”
দূর থেকে আইসক্রিম দেখতে পেয়ে বাবাকে হাতের ইশারায় কিনতে বলল ।
আইসক্রিম খেয়ে আবার স্কুলের উদ্দেশে রওনা । কুহেলি বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে, বাবা খুব খোশ মেজাজে রয়েছে । তাই কুহেলি আস্তে করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা ! একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ?”
হ্যাঁ মা । কী বলবে, বলো ।
তুমি এতদিন আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কোথায় যেতে ?
তোকে এই ব্যাপারটা পরে জানাবো । তুই আমার মা । তুই আমার প্রাণ । তোকে সব জানাবো মা । তোকে জানাতে আরও কয়েকটা দিন সময় লাগবে ।
“ঠিক আছে বাবা । পরে জানালেই হবে ।“ এই কথা বলার পরে বাবার দিকে তাকিয়ে কুহেলি লক্ষ করলো বাবার চোখ ছলছল । কুহেলি আন্দাজ করতে পারলো, জিজ্ঞাসা করায় বাবা একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেছে ।
বাবাকে স্বাভাবিক করতে কুহেলি আবার বলল, “অনেকদিন তুমি আর আমি কোথাও বেড়াতে যাই না । পরের মাসে চলো দীঘা বেড়িয়ে আসি ।“
“ভাল প্রস্তাব দিয়েছিস মা ।“ সানাই চোখের জল মুছে কুহেলির বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলো ।
ভরতপুর স্কুলে পৌঁছানো মাত্র কুহেলি স্কুলের কম্পাউন্ডে ঢুকে গেলো ।
সানাই এখন একা । কুহেলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তার বাড়ি ফেরার পালা । সানাইয়ের বারবার মনে হচ্ছে কুহেলি ছাড়া তার জীবন শূন্যতায় ভরা । কুহেলিকে কোলে-পিঠে মানুষ করতে তাকে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে । তবুও সানাই ছিল নাছোড়বান্দা । কেননা তার ভিতরে জেদ ছিল, তার একমাত্র মেয়েকে অনেক শিক্ষিত করবে । এইজন্য কুহেলির পড়াশুনার প্রতি সানাইয়ের সবসময় খেয়াল । মেয়ে অনেক বড় হয়েছে । নিজে বুঝতে শিখেছে । তবুও মেয়ের আবদার মেটাবার জন্য সানাই সর্বক্ষণ তটস্থ । মেয়ের কষ্ট হোক, এমন কাজ সানাই কখনও করে না । সমস্যা বাধলো পান্তা মাসিকে নিয়ে । প্রথম দিকে পান্তা মাসি অতটা ঝঞ্ঝাটে যেতো না । চোখ বুজে বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করত । কুহেলিকে ঘুম থেকে তোলা, তাকে স্কুলের সাজে সজ্জিত করে স্কুলে পাঠানো, ইত্যাদি । এইসব সংসারের টুকিটাকি কাজ সেরে সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে গাঁয়ে-গঞ্জে ছুটত বিক্রি করতে । বিক্রি শেষে নিজের বাড়ির কাজে মন দিতো । সেই পান্তা মাসি এখন আলাদা সংসার চাইছে, যেখানে কুহেলি থাকলে বলবে না । কুহেলি কীভাবে বাঁচবে সেটা তার ধর্তব্য নয় । ইতিমধ্যে পান্তা মাসি কোচবিহার গিয়েছিল । সেখানে তার নিজের বোন জুলি থাকে । কোচবিহারের মাথাভাঙায় জুলির বাড়ি । জুলির দুই মেয়ে । অল্প বয়সেই তারা বিবাহিত । পান্তা মাসি জুলির সাহায্য নিয়ে মাথাভাঙায় একটি পুরানো বাড়ির হদিস পেয়েছে । সেটা কেনার জন্য মরিয়া । বাড়িটা বাজারের মধ্যে । বাড়ির সামনের দিকটায় দোকান ঘর । তবে মেরামত দরকার ! মাথাভাঙার বাড়িটা কেনার জন্য একরকম পান্তা মাসির চাপে মাঠের জমি বিক্রি করা । বাড়িটা কেনার জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়েছে । বাড়ি কেনার ব্যাপারে ঝুট-ঝামেলা সামলাচ্ছে জুলি । এখন বাড়ির মালিক তাগাদা দিচ্ছেন অতি সত্বর বাড়িটা রেজিষ্ট্রি করে নিতে । সেই কারণে পান্তা মাসির ছটফটানি । যেনতেনভাবে বাড়িটা কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করা । কাঞ্চন নগরে থাকলে মানুষ নানানভাবে তাদের অতিষ্ঠ করে তুলবে । নানা অছিলায় বিরক্তিকর কথা শোনাবে । তাই পান্তা মাসির পরিকল্পনা, অনেক দূরে সকলের অগোচরে বসবাস করা ।
ভাবতে ভাবতে সাইকেল নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো সানাই । বাড়ি পৌঁছে সানাই অবাক ! তার বাড়ির সামনে একটা মারুতি ভ্যান গাড়ি দাঁড় করানো । ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না । সানাই আরও কয়েকটা দিন সময় নিয়েছিল । সানাই মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত । প্রথমদিকে গোঁ ধরেছিল মেয়েটা বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পান্তা মাসির সাথে ঘর বাঁধবে । কিন্তু পান্তা মাসির পীড়াপীড়িতে বলতে বাধ্য হয়েছে মেয়েটা অন্তত একটা চাকরি পাক্‌ । কিন্তু পান্তা মাসির সবুর সইলো না । সানাই নির্ঘাত বুঝতে পারছে, তাকে কাঞ্চন নগরের বাড়ি ঘর ছেড়ে পান্তা মাসির হাত ধরে এখনি কোচবিহার ছুটতে হবে ।
“শিগ্‌গির রেডি হও । বাজারসৌ স্টেশন থেকে ট্রেন । আমি সব ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি । খাবার রেডি । খাবার খেয়ে রওনা দিতে হবে । বেশী দেরী করা যাবে না ।“ পান্তা মাসি তাগাদা দিলো ।
অগত্যা চোখের জল ফেলে পান্তা মাসির হাত ধরে কোচবিহারের উদ্দেশে পাড়ি দিলো সানাই । কাক-পক্ষীও টের পেলো না সানাই গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে কোচবিহারে চলে গেলো । এমনকি তার ভাই কানাইও জানলো না, তার দাদা কাঞ্চন নগরের মায়া ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে কোচবিহারে বাস করার জন্য পালিয়ে গেলো ।
*************************
শেষ ক্লাস শেষ হতে বিকাল গড়িয়ে গেলো । বাজারে মুদিখানার দোকানে তার কিছু কাজ ছিল । মুদিখানার দোকানে গিয়ে সেগুলি কিনতে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেলো । ভরতপুর থেকে যখন সাইকেল নিয়ে কুহেলি স্টার্ট দিলো, তখন চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে । পিঠে বইয়ের ব্যাগ । সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো বাজারের ব্যাগ । সাইকেল চালিয়ে সিসগ্রাম পার হয়ে যখন ফাঁকা রাস্তাটা ধরলো, তখন সন্ধ্যার কালো অন্ধকার নেমে এসেছে । তার সাথে স্কুলের কোনো ছাত্র বা ছাত্রী ছিল না । সকলে অনেক আগেই বাড়ি ফিরে গেছে । কুহেলি একা বাড়ি ফিরছে । রাস্তা দিয়ে মানুষজন চলাফেরা করছে ঠিকই, কিন্তু তাঁরা নিজের নিজের কাজে ব্যতিব্যস্ত । সেই কারণে তাঁরা নিজ গন্তব্যস্থানে আপন মনে হেঁটে চলছেন ।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামার জন্য কুহেলির মনের ভিতর একটা আতঙ্ক ! শীতলটা বাড়িতে নেই । বাবা-মায়ের সঙ্গে মামা বাড়ি গেছে । ফিরতে আরও দুদিন ! বাবাকে কুহেলি আর ডাকতে চাইছে না । সকাল বেলায় তার আবদার মেনে বাবা তাকে স্কুলে ছাড়তে এসেছিল । তাই কুহেলি বাবাকে সন্ধ্যাবেলায় বিব্রত করতে চাইছে না । মাথায় সাতপাঁচ চিন্তা । সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ।
আড্ডা দেওয়া ছেলেদের কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ দিগন্ত নামে একটি অল্প বয়স্ক ছোকড়া কুহেলির হাত টেনে ধরে বলল, “তুই আমাকে বিয়ে করবি । আমি তোকে সুখে রাখব ।“
কথা শুনেই কুহেলি দিগন্তের গালে টেনে এক থাপ্পড় ! তারপর শাসিয়ে দিগন্তকে বলল, “আবার আমার দিকে তাকালে তোর চোখ দুটি আমি উপড়ে ফেলে দেবো । কথাটা মনে রাখিস্‌ ।“
ইত্যবসরে কাঞ্চন নগরের শ্যামল কাকু মোটর বাইকে বাড়ি ফিরছিলেন । বাইকের হেড লাইটে কুহেলিকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কুহেলি, কী ব্যাপার ? তুমি ভর সন্ধ্যাবেলায় রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে কেন ? কোনো সমস্যা ?”
“না কাকু ! এরা আমার পরিচিত । আমার সঙ্গে কথা বলছিল । চলুন, আমিও রওনা দিচ্ছি ।“ কুহেলি শ্যামল কাকুর সঙ্গে রওনা দিলো । শ্যামল কাকু বাইক নিয়ে আগে চলে গেলো, আর কুহেলি পেছন পেছন সাইকেলে চললো ।
দূরের অন্ধকার থেকে একটা পরিচিত গলার আওয়াজ ভেসে এলো, “বাড়ি যা ! বাড়িতে গেলে আর রক্ষে নেই । তোকে এবার শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে !”
কথাটা শুনে কুহেলির অন্তরটা ছ্যাঁত করে উঠলো ?
খুব দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরলো কুহেলি । এ-ঘর, সে-ঘর ঘুরেও বাবাকে দেখতে পেলো না । আতঙ্কের শিহরণ তার সারা শরীরে ! তারপর অন্ধকারে চিৎকার করে ডাকলো, “বাবা ! বাবা !” নিস্তব্ধ নীরব বাড়িতে এখন শুধু কান্নার রোল ! কুহেলির বুক চাপড়ানো আর্তনাদ, “ফিরে এসো বাবা ।“
( চলবে )

Share This
Categories
কবিতা

সাজো ঘটনা : রাণু সরকার।

এক নারী, রোজ সকাল হলে চলে আসে একই জায়গায়, বসে কী যেন ভাবে অস্পষ্ট ও মৃদুস্বরে
কথা বলে।

একদিন স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তার কথা,
সে- উচ্চস্বরে বললো কত গুলো বছর ধরে ভেবেই যাচ্ছি
কোথায় যে রেখেছি পাচ্ছি না খুঁজে-আমার বাড়ি কোথায়?

ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে মরে যাবি তবুও খুঁজে পাবি না তোর বাড়ি,
হা হা হা, হায়রে- নারীর আবার আছে নাকি বাড়ি?

যখন সুস্থ ছিলি একবারও ভেবে দেখার সময়
পাসনি,
মেয়েবেলা আর কৈশোর কাটে বাবার বাড়িতে,
এটাও জানিস না-
যৌবনকাল কাটে স্বামীর বাড়িতে,
যতদিন স্বামী আছে যৌবন আছে রান্না ঘরে কাটাতে হবে,
যে চাকুরি করে তার টাকা আছে তো সব আছে তার ব্যপার আলাদা। সব নারী যদি চাকুরি করতো হতো না আর তোর মতো।
তারপর তোর ছেলের ঘর- যদি ছেলে ও ছেলের বৌ ভালো হয় তবে থাকতে পারবি ও বলবি আমাদের বাড়ি, তোর বলা যাবে না।
ছেলে-বৌ না দেখলে তবে তোকে থাকতে হবে পথে-ঘাটে ,তুই তো চাকুরি করিস না, তোর টাকাও নেই-
পথে-ঘাটেও এখন আর থাকা যায় না রে নারী, দুরবস্থা, বৃদ্ধ হলেও ছাড় নেই।

এবার বল- তোর বাড়ি কোথায়?
বাড়ি খুঁজে খুঁজে শেষে তুই পাগোল হলি।
এই বয়সে স্বামীকে হারালি তারপর গর্ভের
প্রিয়জনের থেকে পেলি না আদরযত্ন শ্রদ্ধা-
নেই তোর প্রতি মনোযোগ তাই তো মানসিক
ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিস-
এখন সবাই তোকে বলে পাগোল—-

Share This
Categories
কবিতা

কেউ আসে না : রাণু সরকার।

আজকাল তেমন একটা কেউ আসে না,
আসলে তাদের আসার অপেক্ষাতে তো আজ আর নেই,
কী আর থাকবো- ঝুড়িঝুড়ি প্রশ্ন নিয়ে আসে আমার কাছে।

আসলে এতো প্রশ্নের উত্তর রাখার মতো টুকরি নেই আমার-
আমি আবার এতো ভার বহন করতে পারিনা, কষ্ট হয় ভীষণ।

প্রাপ্তবয়স্ক হলে কি হবে- বহন করার ক্ষমতা আছে বেশ,এতোটুকুও ক্লান্তি নেই ওদের-
সেবার এসে অনেক প্রশ্ন রেখে গেলো, ভালোবেসে না রাগ করে জানিনা বাপু।

আলগোছে রেখেছি তুলে নাড়াচাড়া দেইনি-
আমি একটু আটপৌরে জীবন যাপন করে থাকি, জগৎ সম্পর্কে তেমন কোন কৌতুহল দেখাই না- যখন যা হবার হবে।
জীবন কী বুঝতে ঋতু লাগেনা।

Share This