ক্রিকেট খেলা কেনা ভালোবাসে। আর যারা ক্রিকেট ভালোবাসেন তাদের কাছে শেন ওয়ার্ন এক অতি পরিচিত নাম। যেমন তার ক্রিকেট জীবন তেমনই বর্ণময় তার ব্যক্তিগত জীবন।
শেন কিথ ওয়ার্ন (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ – ৪ মার্চ ২০২২) ছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার, যার ক্যারিয়ার ১৯৯২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত চলেছিল। ওয়ার্ন ভিক্টোরিয়া, হ্যাম্পশায়ার ও হ্যাম্পশায়ারের হয়ে ডানহাতি লেগ স্পিন বোলার এবং ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছিলেন। খেলাধুলার ইতিহাসের অন্যতম সেরা বোলার হিসেবে বিবেচিত, তিনি ১৪৫ টেস্টে উপস্থিত ছিলেন, ৭০৮ উইকেট নিয়েছিলেন এবং টেস্ট ক্রিকেটে যে কোনো বোলারের সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েছিলেন, এই রেকর্ডটি ২০০৭ সাল পর্যন্ত তার ছিল। ওয়ার্ন ছিলেন ১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ী অস্ট্রেলিয়ান দলের একজন সদস্য।
ওয়ার্ন ছিলেন একজন দরকারী নিম্ন-অর্ডার ব্যাটসম্যান যিনি ৩০০০-এর বেশি টেস্ট রান করেছিলেন, যার সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৯৯। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার ২০০৬-০৭ অ্যাশেজ সিরিজ জয়ের শেষে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রথম চারটি মৌসুমে, ওয়ার্ন রাজস্থান রয়্যালস-এর একজন খেলোয়াড়-প্রশিক্ষক ছিলেন এবং উদ্বোধনী মৌসুমে দলকে জয়ের জন্য অধিনায়কত্ব করেছিলেন। ওয়ার্ন তার কর্মজীবনে মাঠের বাইরে কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন; তার নিন্দার মধ্যে একটি নিষিদ্ধ পদার্থের জন্য ইতিবাচক পরীক্ষার জন্য ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা এবং যৌন অবজ্ঞার অভিযোগ এবং খেলাটিকে অসম্মানে আনার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ওয়ার্ন তার লেগ স্পিনে দক্ষতার সাথে ক্রিকেট চিন্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন, যাকে তখন একটি মৃতপ্রায় শিল্প হিসেবে গণ্য করা হয়। অবসর গ্রহণের পর, তিনি নিয়মিত ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেন এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য এবং বাণিজ্যিক পণ্য অনুমোদন করেন। তার দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড (MCG) এর বাইরে ওয়ার্ন বোলিংয়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, যেখানে তাকে একটি রাষ্ট্রীয় স্মারক পরিষেবা দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল, সেইসাথে তার সম্মানে একটি গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড নামকরণ করা হয়েছিল। ওয়ার্নকে ক্রিকেটে তার সেবার জন্য মরণোত্তর অফিসার অফ দ্য অর্ডার অফ অস্ট্রেলিয়া (AO) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।
জীবনের প্রথমার্ধ—
ওয়ার্ন ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ তারিখে মেলবোর্নের একটি শহরতলী ভিক্টোরিয়ার আপার ফার্নট্রি গালিতে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি ব্রিগেট এবং কিথ ওয়ার্নের পুত্র। তার মা ছিলেন জার্মান। মেন্টোন গ্রামারে যোগ দেওয়ার জন্য স্পোর্টস স্কলারশিপের প্রস্তাব পাওয়ার আগে তিনি হ্যাম্পটন হাই স্কুলে ৭-৯ গ্রেড থেকে পড়াশোনা করেছিলেন, যেখানে তিনি তার শেষ তিন বছর স্কুলে কাটিয়েছিলেন।
ঘরোয়া পেশা—
মেলবোর্নের জংশন ওভালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ০/৬১ এবং ১/৪১ নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১-এ ওয়ার্ন তার প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক করেন।
ওয়ার্ন ২০০০ মৌসুমে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য $৪০০,০০০ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তিনি ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মৌসুমে হ্যাম্পশায়ারে অধিনায়ক হিসেবে ফিরে আসেন। হ্যাম্পশায়ারের হয়ে তিনি তার মাত্র দুটি প্রথম-শ্রেণীর সেঞ্চুরি করেন এবং ২৫.৫৮ গড়ে ২৭৬ উইকেট নেন।
টেস্ট ক্যারিয়ার—-
ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ১৯৯২ সালের ২রা জানুয়ারি। ১৪৫ টি টেস্ট ম্যাচের ২৭৩ টি ইনিংসে তিনি ৭০৮টি উইকেট নিয়েছেন। এছাড়াও, লোয়ার অর্ডারে ১৯৯ ইনিংসে ব্যাট করে তুলেছেন ১২ টি হাফ সেঞ্চুরি। তার ইনিংস সেরা বোলিং ফিগার ছিলো ৮/৭১। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৯৯ রান করেন। ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ৩ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালে মুরালিধরন তাকে টপকাবার আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।
ওয়ানডে ক্যারিয়ার—
ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৯৩ টি উইকেট নেন তিনি। তার অসাধারণ পারফরমেন্সে অস্ট্রেলিয়া ১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে, যেখানে তিনি সেমিফাইনাল ও ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের রানার্সআপ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।
টি২০ ক্যারিয়ার—–
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পরে ওয়ার্ন আইপিএল ও বিগ ব্যাশে টি ২০ লীগ খেলতে থাকেন, তার নেতৃত্বেই রাজস্থান রয়েলস প্রথম আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়, যেখানে তার অধিনায়কত্ব প্রশংসিত হয়েছিল। বিগ ব্যাশে তিনি মেলবোর্ন স্টার্সের অধিনায়ক ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি বিগ ব্যাশ খেলে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।
ব্যক্তিগত জীবন—
ওয়ার্নের সম্পূর্ণ হেটেরোক্রোমিয়া ছিল, যার ফলস্বরূপ তার একটি চোখ নীল এবং অন্যটি সবুজ। ওয়ার্নের প্রাক্তন স্ত্রী সিমোন ক্যালাহানের সাথে তিনটি সন্তান ছিল। দম্পতি ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বিবাহিত ছিলেন। এর পরেও তিনি বহু সম্পর্কে জড়িয়ে বিতর্কে ছিলেন।
বিতর্ক—-
২০০৩ সালের বিশ্বকাপের আগে তার ক্রিকেট খেলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বিশ্বকাপের আগে তার ডোপ টেস্টে ফলাফল পজিটিভ আসে, ২০০৪ সালে তিনি ক্রিকেটে ফিরেন, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আর ওয়ানডে না খেললেও টেস্ট খেলে যান।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি—
২০০০ সালে শতাব্দীর সেরা অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড দলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড ওয়ার্ন ও মুত্তিয়া মুরালিধরনের সম্মানে অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা টেস্ট ক্রিকেট সিরিজের নাম ওয়ার্ন-মুরালিধরন ট্রফি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
মৃত্যু—
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২২-এর ৪ মার্চ থাইল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। একই দিনে মারা যান আরেক অস্ট্রে্লীয় ক্রিকেট তারকা রড মার্শ, যাকে ওয়ার্ন তার নিজের মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে একটি টুইট বার্তায় শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া।।