সময়টা আশির দশকে..
কলকাতার অলিগলিতে পুজো পুজো গন্ধ… শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েদের মনে তখন দারুণ রোমাঞ্চ… বাড়ির বড়দের হাত ধরে শহরের হাতে গোনা বড় পোষাক বিতানের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকেই এক স্বপ্নের জগতে…মনের মতন ঝলমলে পোশাক….ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখায়…! পাশাপাশি নিন্মবিত্তের জন্য পুরোনো কোলকাতার ফুটপাতের টিনের চালা মার্কেট…বোম্বের হালফ্যাশন ডিজাইনের রকমারি পোশাক….যেমন খুশী চাই….!
সেই সময়টাতে নতুন কিছু কেনা মানেই সাতদিন ধরে বাবার মাথার হাজার খানেক পাঁকা চুল বেছে দিয়ে তারপর রবিবার সন্ধ্যায় পাথর পাতা রেললাইন পার হতে হতে চোখে দারুণ এক সুখ নিয়ে বাড়ি ফেরা…! সব মিলিয়ে সাধ আর সাধ্যের মাঝে একটা সুন্দর অপেক্ষা….!
আজকের সময়ে এই গল্পটা গল্প ভেবে বললেও পাঁচ বছরের বুচুও চোখের চশমা উপরে টানতে টানতে বলবে “এমা এ আবার কেমনতর গল্প…গল্পে এমন হয় নাকি ?”….. কি করেই বা হবে…আজকের বুচুদের গল্পে যে যাদুর হ্যারি পটারের ম্যাজিক স্টিক…ভাবার সাথে সাথেই হাতের মুঠোয় সব ইচ্ছে….!
ইচ্ছে পুরণের এমন যুগে অপেক্ষা মানেই অহেতুক সময় নষ্ট…অপেক্ষা মানেই সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যকডেটেড… অপেক্ষা মানেই আদিকালের চাষাপোনা….!
সত্যিই তো…
আজকের পৃথিবীতে সময় রাজা মানুষকে তার সেরা মুহুর্ত উপহার দিয়েছে সভ্যতার সাথে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে…! প্রতিদিনের জীবনে ভোর থেকে মধ্যরাত….দারুণ দারুণ সব ম্যাজিক…গোটা জীবনটাই এখন আস্ত একটা যাদু….!
গৃহকোণের চাল-ডাল থেকে উচ্চ- মধ্যবিত্তের আয়েসি জীবনধারা…
মানুষের জীবনযাত্রার এই স্বপ্নময় উৎযাপন প্রযুক্তির কল্যাণে আজকের এই সময়ে খেটে খাওয়া নিন্মবিত্তেরও হাতের মুঠোয় দারুণ ফিট….! অথচ, প্রযুক্তির এই চোরা ফাঁদে সাধ আর সাধ্যের মিলন ঘটাতে গিয়ে টান পড়ছে সাধের সঞ্চয়ে…! তীব্র গতিময় আজকের সভ্যতায় নিজের দৃষ্টির সীমানায় সফল হতে গিয়ে অসাবধানে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক-বিষন্নতার জীবন পরিণত হচ্ছে এক নেশাতুর সম্মোহনে…!
হ্যাঁ, আজকের বাজারে হাতের মুঠোয় সব পেয়ে যাওয়ার অমৃত এই সুখের ইচ্ছেতেই অদৃশ্য মরণ ফাঁদ পেতে আমাদের দেশের প্রযুক্তিতে স্বল্প জ্ঞানী মানুষের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে গড়ে উঠেছে বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের দেশী-বিদেশী এই প্রতারণা বানিজ্য….! এই বানিজ্যের বিকিকিনির হাটে কেও কেও বোকা ব্রয়লার হয়ে বিক্রি হচ্ছে হাতে হাতে…! হাতের মুঠোয় পৃথিবী দেখতে দেখতে মাথায় হাত বোলানোর শেয়ালটার হাতে তুলে দিচ্ছে নিজের যত্নের সন্তান….!
কোভিড ও বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির নব সমীকরণের ধাক্কায় অধুনা সময়ে সারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও অর্থনীতিতে ভারতের মেধা দীপ্ত সফলতার সাথে বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রযুক্তি নির্ভর অর্থ ব্যবস্থাপনায় বা ই-কমার্স খাতে সাধারণ মানুষের ব্যপক বৈপ্লবিক অংশগ্রহণে দেশে যেমন অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর আধুনিকায়ন হচ্ছে, তেমনই প্রত্যাশিত এই পরিবর্তনের ভেতর লুকিয়ে থাকা সাময়িক দূর্বলতার সুযোগে বাড়ছে দেশি-বিদেশি দুষ্টচক্রের রমরমা ই-বানিজ্য…!
মূলধারার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্রমবর্ধমান এই সমস্যার মূল চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সুরক্ষাব্যবস্থা নেয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে…! নইলে যে পন্ডিত খুঁজতে গা উজাড় অবস্থা…!
উন্নয়নশীল থেকে উন্নত মার্গে পরিনত হতে যাওয়া আজকের ভারতে আধুনিক সভ্যতায় প্রযুক্তির দ্রুততম গতির সাথে ছন্দ মেলাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ…! উন্মুক্ত এই বিশ্ব জুড়ে নিজেদের জীবনে প্রযুক্তিকে অতি দ্রুত অপরিহার্য করতে গিয়ে মানুষ হোঁচট খাচ্ছে তার অপরিপক্ক প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে…! দেশের বিশাল সংখ্যার তরুণ প্রজন্ম মুঠোফোনের তথাকথিত ড্রামাটিক হিরো সাজতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছে নিজের সাধ আর সাধ্যের সীমানা…! নিজেকে প্রমাণ করার ক্রমবর্ধমান মানুষিক চাপ নিয়ে নিজেদের পাশের মানুষের চাইতে ভরসা করছে টেকনোলজির কিছু সংখ্যাকে…! বিগত দুই দশকের প্রজন্মের উপর আমরা যে পরিমাণ আশা চাপিয়ে দিয়েছি..ঠিক সেই পরিমাণই জটিল করে তুলছি আমরা আমাদের আগামী শতক…!
এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে যে অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই সময়ে মানুষ জেনে–বুঝে কেন এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছেন…? তবে কি ভার্চুয়াল প্রেমে সোফিয়ার কোলে আগামী প্রজন্মের শুভ উৎপাদন….!
আসলে পণ্য বেচাকেনার এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটিতে স্বল্প পুঁজির ব্যবসায় অতী দ্রুত লাভবান হওয়ার নেশায় মত্ত বিক্রেতাদের প্রযুক্তিগত অজ্ঞতা ও স্বচ্ছতার অভাবের সাথে দেশের প্রযুক্তি মুখি কিন্তু অপারদর্শী ক্রেতার সমন্বয়ই দেশের ই-কমার্সের এই বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রাকে ভয়ংকর ভাবে বাঁধাগ্রস্ত করছে…! কিছুটা এই গরমে পঁচা আমের আমসত্ত্ব আরকি…!
বর্তমানে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা স্বত্তেও একটি বড় সংখ্যার বিনিয়োগকারী কোন নিয়মনীতির ধার ধারছে না…!ব্যবসার অনুমতির জন্য লাইসেন্স সংগ্রহ করা, শিপিং ও ডেলিভারি পলিসি, রিফান্ড পলিসি, অনলাইন প্লাটফর্মে পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নিশ্চিতকরণ, ক্রেতাদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা প্রদান, বয়স ও লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ, কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের সীমা, মৌলিক ব্যবসায়িক নীতি মেনে চলা….একটি কোম্পানি বা প্লাটফর্মকে ই-কমার্স হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য উল্লিখিত মৌলিক সব বিষয় মেনে চলতে হয় বাস্তবে যার প্রয়োগ কিনা আশংকাজনক ভাবে কম…!
বর্তমানে দেশে অনলাইন ব্যবসা নিয়ে যে বিতর্ক, অনিশ্চয়তা আর আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে, তার পেছনে অন্যতম মূল কারণ হলো ক্রেতা বিক্রেতা উভয়েরই বুঝে কিংবা না বুঝে ই-কমার্সের মৌলিক নীতিগুলো অনুসরণ না করা…!
অভিযোগগুলোর মধ্যে নির্ধারিত সময়ে অর্ডারকৃত পণ্য শিপিং ও ডেলিভারি না করা, অনলাইনে পণ্যের শিপিং স্ট্যাটাসের সঙ্গে বাস্তবতার অমিল এবং রিফান্ড করার ক্ষেত্রে গ্রাহক হয়রানি অন্যতম…! এসব বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে প্রতিকারে এই নীতিমালার সঠিক নজরদারির অভাবে ই-কমার্সে সংশ্লিষ্ট বড় সংখ্যার ছোটো বড় মাঝারি কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়নি… ই-কমার্স প্লাটফর্মে বিক্রির জন্য পণ্যের অরিজিন ও জেনেরিক নাম, উপাদান, উৎপাদকের নাম-ঠিকানা, তারিখ, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করা ক্রেতা অধিকার…যা কিনা অপূর্ণ থেকে যায় অনলাইনের রংচঙয়ে বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ক্রেতাদের ভেসে যাওয়া আবেগের কাছে…!
সারা ভারতের ব্যস্ততম শহরগুলোর পাশাপাশি ও তার আশেপাশে কর্পোরেট অফিস পাড়ায় গজিয়ে উঠছে কল সেন্টারের রমরমা ব্যবসা…যার মাধ্যমে অনলাইনে বিনোদন ব্যাস্ত মানুষের বিশ্বাসযোগ্য স্বপ্ন দেখিয়ে লুট হচ্ছে সাধারণ মানুষের পরিশ্রমের অর্থ…!
প্রযুক্তি নির্ভর আজকের তরুণদের এই স্বেচ্ছা একাকিত্বের সময়ে যেখানে চমকদার বিজ্ঞাপন হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবনের নিয়ামক, সেখানে অবশ্য নীতিমালার কিছু নিয়ম বাড়িয়ে দিলেই যে কেল্লাফতে তা ভাবাটা চরম মূর্খতাই বটে…!
আসলে অধুনা ভারতের মাত্রাতিরিক্ত গন চাপে জনতা যেখানে তার মুল্য বুঝতে ভুলছে…সেখানে দাঁড়িয়ে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য জেনারেল পিতামাতার স্কয়ার ফুটের শহুরে জীবনে সফলতা একমাত্র পরিমাপক যেখানে শুধুই ই-এম-আই নির্ভর দৃশ্যমান প্রতিষ্ঠা…সেখানে স্বল্প সময়ে আম্বানি রাজার গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে প্রজন্মের কাছে একটা বিশাল স্বপ্নের বালুর পিরামিড তৈরির লোভনীয় দৃশ্যটিতে এখন জমজমাট ভিউয়ার…! হ্যামিলনের ইঁদুরের মতন তরুণ সমাজ ছুটছে ইঁদুর ফুলে গণেশ অবতার হবে বলে…! অতিথি হিসেবে এইসব প্রতারণার জলসায় নিয়মিত পাপেট হিরোদের লম্ফঝম্প… সুচতুর ভাবে প্রযুক্তির সুখী সময়টাকে অসুখী করে তুলছে বড় ছোট সব বানিজ্যিক দানবেরা…..!
শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ জ্ঞানের অভাবে দেশের আগামী জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশের কাছে প্রযুক্তি মানেই কেবলমাত্র সুস্থ কিংবা অসুস্থ বিনোদন…! বর্তমানে আমাদের দেশের দুটি প্রজন্ম আকস্মিক ভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ…! আধুনিক শহুরে বিলাসিতায় হঠাৎ নি:সঙ্গ হয়ে পরা প্রবীণ সমাজ ও প্রযুক্তি অজ্ঞ একটি বিরাট সংখ্যার তরুণ প্রজন্ম… অনলাইন নির্ভর পেটমোটা বনিকদের কাছে যারা খুব সহজ শিকার…!
স্বম্পর্কের গণিতে একলা চলাই যে সময়ের মানব মন্ত্র… সেই সময়ে বড্ড বেশি করে আরও একটি বার অপেক্ষার মুল্য বোঝার দিনের দরকার…! যেখানে ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়া বিলিয়নিয়ার থেকে দেশের যুবকদের কাছে সুপার হিরো এলন মাস্ক…সেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিত্য নতুন প্রযুক্তি সংযোজন মানুষকে দ্বিধাগ্রস্থ করবে এটাই স্বাভাবিক…!
আধুনিক ভারতের পরিবার ও সমাজে ফিরিয়ে আনতে হবে ঐতিহ্যগত ভারতের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ…. কেননা জীবনের সফলতা মানেই যে শুধু মানুষের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা তা নয়…এর বাইরেও জীবনের বহু ক্ষেত্রে মানুষের সফলতার মানদণ্ড আছে…! একমাত্র সঠিক মানবিক দৃষ্টিকোণই মানুষকে ঠিক-বেঠিক এর তফাৎ বোঝাতে পারে….! তবেই প্রযুক্তির প্রতি অন্ধ মায়া থেকে বেড়িয়ে আজকের নাগরিকেরা তাদের জীবনে প্রযুক্তির অপরিহার্যতার মাত্রা স্ব-ইচ্ছায় নির্ধারণ করতে পারবে… আর তাতে অধুনা ভারতের প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনৈতিক মহা মঞ্চটি থেকে নির্বাসন হতে পারে প্রতারণা নামক এই সায়ানাইড বন্ধুটি….!
বি:দ্র:- প্রবন্ধটির কপিরাইট লেখক ও ডেইলি হান্ট দ্বারা সংরক্ষিত |
সৌগত রাণা কবিয়াল—
( কবি সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক )