কোচবিহার মদনমোহন মন্দিরের অন্যতম কর্মকর্তা সুরেশবাবুর কাছে পুলিশি অভিযান ও শহরের যত্রতত্র পাচারকারীদের ঘোরাঘুরির খবর পেয়ে কুহেলি যারপরনাই চিন্তিত হয়ে উঠলো । মন্দিরে থাকাটা তাদের কাছে আর নিরাপদ হবে না ভেবে কুহেলি প্রমাদ গুণতে লাগলো, অতঃপর কী করা যায় ? আর এখানে থাকা খুব ঝুঁকিবহুল । সুতরাং অন্যত্র চলে যাওয়াই শ্রেয় !
পুবালী এই ফাঁকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলো কুহেলিকে । কুহেলি বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিপক্ষে । কেননা তার মতে, নারী পাচার চক্র এখনও ধরা পড়েনি । তারা বহাল তবিয়তে উত্তরবঙ্গ সহ নানান জায়গায় অবাধে ঘোরাফেরা করছে । এখনও তাদের শকুনের দৃষ্টি । মেয়েদের ফুসলিয়ে বা যেভাবে হোক কব্জায় এনে ভিন্ন জায়গায় পাচার করা । পাচারের গ্যাং ধরা পড়লে তাদের বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ হতো । যেহেতু তারা পাচার চক্রের হাত থেকে পালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেহেতু তারা এখন পাচার চক্রের চক্ষুশূল । যেকোনো মুহূর্তে তারা পাচারকারীদের হাতে ধরা পড়তে পারে । তাই কুহেলি ঠিক করলো, মন্দির থেকে পালাতে । কিন্তু বাড়িতে নয় ! কোথায় যাবে সেই চিন্তায় কুহেলি ও পুবালী অস্থির ?
ইতিমধ্যে কোচবিহার শহরে শুরু হয়েছে শক্তপোক্ত পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা । জোর কদমে চলছে পুলিশি টহল । তা ছাড়া থানা থেকে এলাকার বিশেষ বিশেষ মানুষকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছে, শহরে নারী পাচাকারী চক্র ঘোরাফেরা করছে । যেকোনো মুহূর্তে তারা অঘটন ঘটাতে পারে । তাই নাগরিকদের সচেতনার নিরিখে থানার বড়বাবুর পরামর্শ, শহরে কোনো মেয়ে যেনো একা একা ঘোরাফেরা না করে বা অবাঞ্ছিত কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশকে সত্বর জানায় ।
কোচবিহার শহরে সন্ধ্যাবেলায় থমথমে পরিবেশ । কুহেলিরা খুব সাবধান মতো মন্দিরের ভিতরে কাজকর্ম সারছে । সুরেশবাবু পুনরায় কুহেলি ও পুবালীকে ডাকলেন এবং জানতে চাইলেন, তাদের পরবর্তী কী চিন্তাভাবনা ? কুহেলি আমতা আমতা করে সুরেশবাবুকে বোঝালো, “আমাদের কয়েকটা দিন সময় দিন । আমরা মন্দির ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবো । এই মুহূর্তে চারদিকে পাচারকারীদের আনাগোনা । সুতরাং এইরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে বের হলে আমরা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে যাবো । তাতে আখেরে আমাদের বিপদ !“
সুরেশবাবু তাদের অভয় দিয়ে বললেন, “এখানে থাকায় আমার আপত্তি নেই । মন্দিরে অনেক ভক্তের আগমন । বিভিন্ন জায়গার ভক্তদের আনাগোনা । সবাইকে আমরা চিনিও না বা জানিনা । কখন কে কী মতলব নিয়ে মন্দিরে আসে এবং বেরিয়ে যায় আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন ! মন্দিরে প্রবেশ অবাধ । সুতরাং মন্দিরের দরজা বন্ধ রাখতে পারবো না । মন্দির যতক্ষণ খোলা থাকবে মানুষের আনাগোনা থাকবেই । এর মধ্যে পাচারকারী-দুর্বৃত্তরা মন্দিরে ঢুকে তোমাদের উপর নজর রাখলে, সেই ক্ষেত্রে বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ! তাতে তোমাদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না । তাই তোমাদের হিতার্থে আমি একটা পরামর্শ দিচ্ছি ।
পুবালী নড়েচড়ে বসে বেশ আগ্রহ দেখিয়ে সুরেশবাবুকে বলল, “আপনি বলুন । আপনার পরামর্শ কী ?”
“এই জেলার মাথাভাঙায় আমার পরিচিত খুব সুন্দর একটি আশ্রম আছে । তোমরা কিছুদিনের জন্য সেখানে গিয়ে গা-ঢাকা দিতে পারো । থাকার ব্যবস্থা খুব ভাল । আর তা ছাড়া তাদের আটোসাটো নিরাপত্তা ব্যবস্থা । তোমরা থাকতে চাইলে আমি সেই আশ্রমের মহারাজকে বলে দিচ্ছি । সুতরাং তোমাদের থাকার কোনো অসুবিধা হবে না । যে কদিন থাকতে চাও, থাকতে পারবে । সেখানে আশ্রমে প্রবেশ অবাধ নয়, অনুমতি সাপেক্ষে আশ্রমে ঢোকা যায় । অনেক টাইট নিরাপত্তা ব্যবস্থা । এইবার তোমরা ভেবে দ্যাখো, কী করবে । এখানে থাকাটা তোমাদের ক্ষেত্রে টেনশনের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ! সুতরাং আমার পরামর্শ ভেবে দেখতে পারো ।“ সুরেশবাবু সবিস্তারে জানালেন ।
কিন্তু মাথাভাঙা যাওয়ার সময় আমরা অতি সহজে দুর্বৃত্তদের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি ।
সেই ব্যবস্থা আমি করছি । যাতে তোমারা নিরাপদে মাথাভাঙার আশ্রমে পৌঁছাতে পারো, সুরেশবাবু আশ্বস্ত করলেন ।
কুহেলি ভেবে দেখলো মাথাভাঙা যাওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায়ও নেই, যার উপর ভিত্তি করে কোচবিহার শহরে থেকে যাবে । তাই সুরেশবাবুর প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত ভেবে কুহেলি সুরেশবাবুকে বলল, “আপনি আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করুন । আমরা মাথাভাঙার আশ্রমে পরের কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে চাই ।“
পুবালীর মুখটা ব্যাজার ! তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা । বাড়ির কারও সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই । বাবা-মা ছাড়া আত্মীয় স্বজন কারও সঙ্গে দেখা হচ্ছে না । বন্ধু-বান্ধবীরা নিশ্চয় খোঁজ খবর নিচ্ছে । পুবালীর বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ছে । ছোট ভাইয়ের দুষ্টুমীর ভাগিদার হতে পারছে না । বাবার আহ্লাদ ও মায়ের বকুনি থেকে সে বঞ্চিত । এইসব ভেবে পুবালীর মনটা দুঃখে ভরপুর । কোনোকিছুতেই তার মন নেই । মাথাভাঙার আশ্রমে যেতে তার ভীষণ আপত্তি । কুহেলি তাকে বোঝাচ্ছে, এই মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেওয়া সেটা হবে বোকামী । তাদের কাছে ‘নদীর তীরে এসে নৌকা ডোবার’ ন্যায় । কেননা পাচারকারীদের শ্যেনদৃষ্টি চতুর্দিকে । পুনরায় তাদের গোচরে পড়লে বিপদের শেষ থাকবে না । নির্ঘাত ভিনদেশে চালান হতে হবে । ফলে বাকী জীবন অন্ধকার জগতে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় থাকবে না । সেই অন্ধকার জগতে ঢোকার চেয়ে আর কয়েকটা দিন মাথাভাঙার আশ্রমে কাটিয়ে দেওয়াটা তাদের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ । কুহেলি পুনরায় পুবালীর দিকে তাকিয়ে জোর দিয়ে বলল, এবার পুলিশের জালে পাচারকারীরা পড়তে বাধ্য । একবার এই দলটা ধরা পড়লে তাদের মুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে । তখন লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফেরায় এতটুকু টেনশন থাকবে না । সুতরাং আর কটাদিন এদিক-ওদিক কাটিয়ে দিতে পারলে স্থায়ীভাবে এবং নির্ভয়ে এলাকায় বাস করতে কোনো বাধা থাকবে না ।
এক চিলতে হাসি দিয়ে পুবালী বলল, “ঠিক আছে ।“
পরেরদিন খুব ভোরে কাঁচ লাগানো এসি গাড়িতে পুবালী ও কুহেলি গিয়ে উঠলো মাথাভাঙার আশ্রমে । সেখানে পৌঁছে দেখে আশ্রমবাসীর তখনও ঘুম ভাঙ্গেনি । তখনও আশ্রমের সকলে ঘুমাচ্ছে । সূর্য পূর্ব আকাশে উদয়ের পথে । চারিদিকে পাখির কলরব । দূরে মুরগীর ডাক । কৃষি প্রধান এলাকা । চারিদিকে চাষের জমি । মাথাভাঙা একটি ছোট্ট শহর । কিন্তু আশ্রমটি মাথাভাঙা শহর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে । জায়গাটা খুব নিরিবিলি । আশেপাশে চাষের জমি ছাড়া যদিও কিছু বসত বাড়ি রয়েছে । সেখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল নয়, বাড়িঘর ও লোকজনের হাঁটাচলাতে সেটা পরিষ্কার । চারিদকটা দেখার মাঝখানে একজন বয়স্ক মহিলা চোখ রগড়াতে রগড়াতে কুহেলির কাছে এসে বললেন, “তোমরা কী কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির থেকে এসেছো বাছা ?”
“হ্যাঁ ।“ পুবালী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো ।
ঘরে এসে বসো মা । আশ্রমের মহারাজ প্রাতঃকালীন ভ্রমণে বেরিয়েছেন । তিনি একটু পরে এসে পৌঁছাবেন । ততক্ষণে আমি চা করে আনছি । তোমরা চা খেয়ে একটু জিড়িয়ে নাও ।
কুহেলি লক্ষ করলো, ভদ্রমহিলা বয়স্ক হলেও যথেষ্ট মার্জিত । তাঁর ব্যবহারও অমায়িক । তাঁর কথাবার্তায়, কোথায় যেনো মায়া জড়ানো । বয়স্ক মহিলাকে দেখার পর কুহেলির বারংবার মনে হচ্ছে, “তিনি অনেকদিনের পরিচিত আপনজন ।“ কুহেলি আর দেরী না করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো ।
বয়স্ক মহিলা আর কেউ নন, তিনি শ্রাবন্তী মাসি । আশ্রমে সকলের মায়ের মতো । কুহেলিকে প্রণাম করা দেখে শ্রাবন্তী মাসি বললেন, “থাক্ মা । প্রণাম করতে হবে না । তোমরা একটু বসো । আমি চা করে আনছি । ততক্ষণে আশ্রমের মহারাজ এসে যাবেন ।“
বসার ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । অনেকটা বড় । চারিদিকে মহাপুরুষদের ছবিতে ভরা । টেবিল চেয়ারের পেছনে বইয়ের আলমারী । খোলা আলমারী । বইগুলি পরিপাটিভাবে সাজানো । বইয়ের ভাণ্ডার দেখে বোঝা যাচ্ছে, মহারাজ পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । কুহেলি বইয়ের আলমারীর পাশে গিয়ে দেখলো, তাতে সব ধরনের বই সাজানো । পাঠ্য বই ছাড়া বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস, ধর্মের বই, বেদ এমনকি উপনিষদ, ভ্রমণের বই, প্রবন্ধের বই, ইত্যাদি । বইয়ের ভাণ্ডার দেখে মহারাজের রুচিবোধের একটা ধারণা কুহেলির মধ্যে জন্মালো ।
শ্রাবন্তী মাসি চা নিয়ে হাজির । সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট । চা খাওয়ার সময় কুহেলি শ্রাবন্তী মাসির সাথে দু-চারটে কথা বলার সুযোগ পেলো ।
কুহেলি প্রথমেই প্রশ্ন করলো, “মাসি, আশ্রম চলে কী করে ? অর্থাৎ আশ্রম চালাতে খরচ কোথা থেকে আসে ?”
আমি তো সব জানি না বাপু । তবে আশ্রমের নামে কয়েক বিঘা জমি আছে । সেই জমিতে ধান চাষ হয় । সেই ধানের চালে আশ্রমের লোকেদের সারা বছরের খাবার জোটে । আশ্রমে কিছু দুস্থ ছেলে-মেয়ে থাকে । তারা পড়াশুনা করে । আগে যারা পাশ করে বেরিয়ে গেছে, তারা মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠায় । সেই টাকায় নুন-তেল-হলুদের মতো দৈনন্দিন খরচা উঠে আসে । এছাড়া ভক্তরা তাঁদের সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা করে । সেই আর্থিক সহায়তায় অন্যান্য খরচ মিটে যায় । এইটুকু মোটামুটি আমি জানি ।
আচ্ছা মাসি, আশ্রমের উদ্দেশ্য কী ? অন্যভাবে বলতে গেলে আশ্রমের ভাবনা কী ? কী প্রয়োজনে আশ্রমের প্রতিষ্ঠা ?
উত্তরে শ্রাবন্তী মাসি বললেন, “আমাদের মহারাজ বলেন, মানুষের সেবা করা আমাদের ব্রত । মানুষের হিতার্থে আশ্রমের কাজকর্ম ।“
এইসব অগোছালো কথাবার্তার মাঝে আশ্রমের মহারাজ এসে উপস্থিত । তিনি সোজা স্নানে ঢুকলেন । দূর থেকে বোঝা গেলো, লম্বা-চওড়া একজন সুপুরুষ ! তবে বয়সটা মনে হলো, হাল্কা বয়স । মহারাজ আসার সাথে সাথে মাসি উঠে চলে গেলেন । তিনি বললেন, “ছেলেটা এসেছে । তার কিছু দরকার হলে আমাকে ডাকবে । তোমরা বরং একটু বসো । আমি মহারাজের সঙ্গে দেখা করে আসি ।“
কুহেলি ও পুবালী বসে রইলো । উত্তরবঙ্গের খবরের কাগজ আশ্রমে পৌঁছে গেলো । খবরের কাগজের হেড লাইনের খবরগুলিতে চোখ গেলো কুহেলির । “গভীর রাত্রিতে পাচারকারীদের সাথে পুলিশির খণ্ডযুদ্ধ । কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ না থাকায় পুলিশি অভিযান ভেস্তে গেলো ।“ ভিতরে আরও লেখা, পুলিশ নাকি পাচারকারীদের ডেরা ধরতে পেরেছে । খুব শীঘ্র পাচারকারীর দল পুলিশের জালে ধরা পড়তে বাধ্য । পাচারকারীদের ডেরার চারিপাশে পুলিশি তল্লাশি অব্যাহত । প্রয়োজনে আধা সামরিক বাহিনী নামার সম্ভাবনা ।
শ্রাবন্তী মাসি কুহেলি ও পুবালীকে ডাকলো, “চায়ের টেবিলে আশ্রমের আবাসিকরা আসছে । তাদের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মহারাজ বললেন । সুতরাং তোমরা আমার সঙ্গে এসো । আগে সকলের সঙ্গে আলাপ হোক । তারপর হাত মুখ ধুয়ে সকালের জলখবার খাওয়া ।“
চায়ের টেবিলে বারোজন ছাত্র এবং চারজন ছাত্রী । পাঁচজন আবাসিক সর্বক্ষণ মাঠের জমি দেখাশোনা করে । দুজন মহিলা । আশ্রমের অন্যান্য কাজকর্মে তারা নিয়োজিত । আশ্রমে বলদ গরু নেই, কিন্তু দুগ্ধবতী গরু চারটি । বাছুর আপাতত তিনটি । অর্থাৎ তিনটি গরু এখন দুধ দিচ্ছে । একটি গাই-গরু সম্ভবত বাচ্চা দেবে । মহারাজকে সহযোগিতা করার জন্য সর্বক্ষণের কুমারদা । তার কাজ হচ্ছে আশ্রমের ভালমন্দ দেখাশোনা করা । ছেলে-মেয়েদের স্কুলের/কলেজের সাথে যোগাযোগ রাখা । তাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়া । ছাত্রদের কোনো গৃহশিক্ষক নেই । কুমারদা তাদের গৃহশিক্ষক । সকলের সাথে আলাপ করে কুহেলি উৎফুল্ল । সে অন্তত এখানে একটা ঘরোয়া পরিবেশ পেলো । তার ভিতর থেকে ভয়টা ক্রমশ বিদায়ের পথে । সকলে যথেষ্ট আন্তরিক । একে অপরের সুবিধা-অসুবিধায় প্রত্যেকে সজাগ । তাই কুহেলির মনে হচ্ছে, সে এখন ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে । আর দমবন্ধ জীবন নেই । দমবন্ধ জীবন থেকে সাময়িক মুক্তি । আশ্রমের আবাসিকরা সকলেই হাসিখুশী ও কর্মঠ ।
জলখাবার রেডি । দুটো করে আটার রুটি, সবজির তরকারি । ঝাল ঝাল করে ধনে পাতা দিয়ে আলু ও কুমড়োর তরকারি । খাবার ঘরে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার রেওয়াজ । কারও কলেজ/স্কুল থাকলে আলাদা কথা । মাঠের জমিতে যারা কাজে যান, তাদের জলখাবার কেউ না কেউ জমিতে পৌঁছে দিয়ে আসে । শ্রাবন্তী মাসি মহারাজকে ডাকলেন । তার কথাবার্তায় কুহেলি বুঝতে পারলো, মহারাজ শ্রাবন্তী মাসিকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন ।
পুবালী বাইরের কলে হাত ধুতে গেলো । এমন সময় মহারাজ সকালের জলখাবার টেবিলে হাজির । সোজা কুহেলি চোখে চোখ পড়তেই কুহেলির মনে হলো, ভদ্রলোকটি তার অনেকদিনের চেনা ।
কুহেলি হাত জোড় করে মহারাজকে নমস্কার জানালো
মহারাজ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোন্ ভোরে বের হয়েছেন । টিফিন খেয়ে আপনারা একটু বিশ্রাম নিন ।“
তার দরকার হবে না স্যার । এখানে সকল আবাসিকের সাথে আলাপ হয়ে মনে হচ্ছে, নিজের বাড়িতে আছি । সুতরাং আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে আপনি অযথা উতলা হবেন না । আমরা খুব ভাল জায়গায় এসেছি এবং নিরাপদ বোধ করছি ।
সুরেশবাবুর কাছে আপনাদের সম্বন্ধে কিছুটা শুনেছি । বাকীটা আপনাদের মুখ থেকে শুনবো । নিশ্চিন্তে ও সাবধানে থাকুন । আশা করি আপনাদের আর কোনো বিপদ হবে না । তবে সাবধানে থাকাটা যুক্তিযুক্ত ।
কুহেলির হঠাৎ প্রশ্ন, “স্যার, আপনার মতো শিক্ষিত ও গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি । কিন্তু আমার মনে একটা খটকা, “আপনি গার্হস্থ্য জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে কেন আশ্রমবাসী হলেন, এটা খুব জানতে ইচ্ছা করছে ?“
আপনার প্রশ্নটা অমূলক নয় ! এই প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ আগেও বহুবার হয়েছি । আপনি বলতে পারেন, আমি মানুষের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছি । এটা আমার জীবনের ব্রত ।
কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকায় মাথাভাঙার মতো জায়গায় আশ্রম খুঁজে পেলেন কী করে ?
সেটাও একটা ইতিহাস । ঘটনাচক্রে আমার জীবনে একটা দূঃসময় আসে । সেই সময় আমি এলোপাথারি ঘোরাঘুরি করি । “সংসার জীবনে ঢুকবো না” স্থির সিদ্ধান্ত নিই । তখন আমার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী এই আশ্রমের হদিস দিলো । তাঁর বন্ধু মাথাভাঙা হাইস্কুলে চাকরি করার সুবাদে তিনি এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন । হাইস্কুলের মাস্টার মশাই আবার এই আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা । তিনি আমাকে পেয়ে আশ্রমের দায়িত্বে বসিয়ে দিলেন । আগের মহারাজ বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন । বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার তাঁর তাগাদা ছিল । মাস্টার মশাই আমাকে পেয়ে আগের মহারাজকে বাকী জীবনের জন্য ছুটি দিয়ে দিলেন । তিনি এখন বাংলাদেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন । আর আমি এখন আশ্রম সামলাচ্ছি । আশ্রমে যারা রয়েছেন, প্রত্যেকে খুব ভাল মানুষ । শ্রাবন্তি মাসি সকলের কাছে মায়ের মতো । ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রাবন্তী মাসিকে খুব ভালবাসে । যার জন্য তাদের যতো আবদার, সবটাই শ্রাবন্তি মাসির কাছে ।
তারপর মহারাজ কুহেলির দিকে তাকালো, “আপনার আর কী প্রশ্ন ?”
প্রশ্ন অনেক । তবে একসঙ্গে নয় । পরে অবসর সময়ে আশ্রম নিয়ে কথা বলা যাবে । ঠিক সেই মুহূর্তে পুবালী হাত ধুইয়ে খাওয়ার টেবিলে হাজির । শ্রাবন্তি মাসি দুখানা রুটি ও আলু-কুমড়োর তরকারি এগিয়ে দিলেন । রুটি দেখে পুবালীর মাথা গরম । মুখে বলতে পারছে না, অথচ খেতেও চাইছে না ।
মহারাজের ঠিক উল্টোদিকে পুবালী বসলো । যার জন্য মহারাজের মুখ পুবালী দেখতে পেলো না । তাই পুবালী জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা কুহেলি !”
“কী ?” কুহেলি জানতে চাইলো ।
আশ্রমের মহারাজকে দেখতে পেলাম না ?
এবার মহারাজ পুবালীর উদ্দেশে বলল, “মহারাজ তো আপনার পাশেই !”
মহারাজ পুবালীর দিকে তাকাতেই, পুবালী চমকে গেলো ! সে কাকে দেখছে ?
( চলবে )
Categories
দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস ,ষোড়শ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)
