ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের কঠোর পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়। এই অন্দোলনে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে দীনেশচন্দ্র গুপ্ত প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন। দীনেশচন্দ্র গুপ্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে।
দীনেশচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন স্বনামধন্য বাঙালি বিপ্লবী। তিনি দীনেশ গুপ্ত নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ঢাকা ও মেদিনীপুরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মেদিনীপুরে তাঁর সংগঠন পরপর তিন জন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেছিল।
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের জন্ম হয় ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর (বাংলা ১৩১৮ সালের ২০ অগ্রহায়ণ) তদনীন্তন ঢাকা জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সীগঞ্জ জেলা) যশোলঙে। তাঁর পিতার নাম সতীশচন্দ্র গুপ্ত ও মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু।চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। চাকরির সূত্রে তিনি কিছুকাল গৌরীপুরে অবস্থান করেন। গৌরীপুরের পাঠশালাতেই দীনেশের শিক্ষারম্ভ। পরে নয় বছর বয়সে ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। প্রথম দিকে দীনেশ ঢাকার গ্যান্ডারিয়া অঞ্চলে দাদুর বাড়িতে বাস করতেন, পরে উয়াড়িতে পৈত্রিক বাসভবনে চলে আসেন। বাল্যকাল থেকেই দীনেশ ছিলেন নির্ভীক, বেপরোয়া ও বাগ্মী। এই সময় থেকেই তাঁর মনে স্বদেশ চেতনা ও ব্রিটিশ বিরোধিতার আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছিল।
এলাকায় তিনি ‘নসু’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। দীনেশচন্দ্র ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেন।
সাহসিকতাপূর্ণ কর্মতৎপরতার জন্য দীনেশচন্দ্র বিপ্লবী সংগঠন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বিভি) বাহিনীর সাধারণ সদস্য থেকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ঢাকা জেলায় এবং পরে মেদিনীপুরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। এ সংগঠনের প্রভাবেই বিপ্লবী দল মেদিনীপুরে একে একে তিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমর্থ হয়।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর, বিনয় বোসের নেতৃত্বে বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ চন্দ্র কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করে, কারা বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর-জেনারেল সিম্পসনকে হত্যা করে এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ ইউরোপীয় কর্মচারীকে গুরুতরভাবে আহত করে। এ ঘটনায় গ্রেফতার এড়াতে এই বিপ্লবী বিষ পান করে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বিনয় ও বাদল মারা যায় এবং দীনেশ গুরুতর আহত হয় এবং তাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টার পর হাসপাতালে আনা হয়। কিন্তু দীনেশের দেশপ্রেম এতটাই গভীর ছিল যে অনেক চেষ্টা করেও সরকার তার কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি।
সরকার বিরোধী কার্যকলাপ ও হত্যার অভিযোগে অবশেষে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায়, নির্ভীক দীনেশ জেলে বসে কিছু মূল্যবান চিঠি লিখেছিলেন, যাতে বিপ্লবীদের বীরত্বগাথা, আত্মত্যাগের গৌরব এবং গভীর দেশপ্রেম প্রকাশ করা হয়েছিল। চিঠিগুলো সমাজে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত।
১৯৩১ সালের ৭ জুলাই মাত্র ১৯ বছর বয়সে আলিপুর জেলে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অংশে বিনয়, বাদল এবং দিনেশকে শহীদ হিসেবে সম্মান করা হয়। পরবর্তীকালে কলকাতার প্রসিদ্ধ লালদীঘি ময়দান বিনয়-বাদল-দীনেশ এ তিন নবীন বীরের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়, যা সংক্ষেপে ‘বিবাদী বাগ’ নামে পরিচিত।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।