আমরা ভারতীয়, আমাদের কর্মময় জীবন, এবং ধর্মময় মনপ্রাণ। কিন্তু, আমাদের সমাজে আজ পাল্টে গেছে মানুষের চিন্তাধারা। কিছু বছর আগেও মানুষে মানুষে প্রেম ও গভীর ভালোবাসা ছিল। বিশুদ্ধ বিশ্বাস ছিল, নির্ভরতা ছিল। একে অপরের প্রতি প্রচন্ড বিশ্বাস ছিল। প্রকাশ ছিল কম অনুভব ছিল বেশী। এখন প্রকাশ বেশী অনুভব কম। মনের ব্যাকুলতা, অফূরন্ত বিশ্বাস, ধৈর্য্য, ভালোবাসা আর কিছু অবশিষ্ট নাই। আজ আমরা মোবাইল আর টাকার গোলাম হয়ে পড়েছি। আজ মোবাইলের কারণে পরিবারের মধ্যে একে অপরের সাথে ভালো সুসম্পর্ক নেই। সর্বদা মোবাইলে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কুশল বিনিময় হয় না, কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলার সময় নেই। ফলে সবার উপর থেকে সম্মান, স্নেহ,আদর্শ, ভালবাসা, গুরুত্ব সবই কমে যাচ্ছে। সবাই আজ মেশিন। আর তারপর আসে আমাদের সমাজে টাকার কথা। শিক্ষা,স্বাস্থ্য, আজ ব্যবসায় পরিণত। সর্ব ত্যাগী সন্ন্যাসীগনও টাকার গোলাম আজ, যেন তেন প্রকারেন টাকা চাই। সর্ব ত্যাগী সন্ন্যাসীগন ও টাকা টাকা করে ন্যায় অন্যায় এর পার্থক্য ভুল ভাবে করছে। এখন টাকা সবার স্ট্যাটাস সিম্বলে পরিণত। সমাজে আমরা আজ আরও টাকা চাই, আরও টাকা চাই, মানুষ আজ টাকার দাস। সবাই আজ মোবাইল আর টাকার পাগল।
একটি গল্পের মাধ্যমে চরম বাস্তবটা অনুভব করার চেষ্টা করি। আমার এক সুপরিচিত বিশাল শিল্পপতি। ১২ টার উপর ফ্যাক্টরি, শত কোটি টাকার উপর ব্যাংক ব্যালেন্স। এক মুহূর্তের জন্য শান্তি নেই। সারাদিন ব্যাস্ত টাকার দুনিয়ার পেছনে। একদিন তাঁর অফিসে বসে গল্প করছিলাম, এমন সময় তাঁর এক কর্মচারী আসল। তার কোন কারণে কিছু টাকার দরকার। সে বলল, সে অত্যন্ত অভাবী ব্যক্তি, তাঁকে কিছু সাহায্য করার জন্য। শিল্পপতি হেসে বলল যদি অভাবের কথাই বলতে হয়, এই পুরো অফিসে আমার চেয়ে অভাবি আর কেউ নেই। আমরা একটু থতমত হয়ে গেলাম। বললাম আমাদের সবার মিলিয়ে যত সম্পদ আছে আপনার একারই তার অনেক বেশি সম্পদ আছে।
সে বলল আপনাদের একটা গল্প বলি। তাহলেই আমার অভাবের রহস্য বুঝবেন। এক বিশাল ব্যবসায়ি, তাঁর সবই আছে খালি শান্তি নেই। খালি হাহাকার আর টেনশান। চিন্তায় মাথার চুল নেই। সে একদিন দেখল তাঁর অফিসের এক অফিস কর্মী টেবিল মুছছে আর গুনগুন করে গান গাচ্ছে। সে কর্মীকে ডেকে বলল এই যে তুমি মনে মনে গান গাও, তোমার কি অনেক সুখ, তোমার মনে কি কোন দুঃখ নেই, কোন হতাশা নেই? কর্মী বলে না, হতাশা কেন থাকবে স্যার, আপনি যা বেতন দেন তা দিয়ে আমার ভালই চলে যায়। ভগবানের ইছায় আমার কোন অভাব নেই।
ব্যবসায়ী তো আরো টেনশানে পড়ে গেলেন। ওনার ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, আমার সব আছে কিন্তু শান্তি নেই, আর ওই লোককে আমি সামান্য কয়টা টাকা বেতন দিই, সে আছে মহা সুখে, এর রহ্স্যটা কি? ম্যানেজার বলল, রহস্য বললে বুঝবেন না। সত্যই যদি বুঝতে চান তাহলে, ওই কর্মীকে প্রমোশান দিয়ে একটা বড় পোস্টে দিন। আর তাঁকে ১০/১২ লক্ষ টাকা দিয়ে দিন। এরপর দেখুন। ব্যবসায়ি তাই করল। এতোগুলো টাকা, আর এতবড় চাকরি পেয়ে কর্মী আনন্দে আত্মহারা। বাড়িতে ও সবাই খুশি। যেহেতু এখন অফিসার হয়ে গেছে, এখন তো আর টিনের ঘরে থাকা যায় না। সহকর্মীরা কি মনে করবে।
প্রথমেই বাসস্থান পরিবর্তন করে আরেকটু অভিজাত এলাকায় এপার্টমেন্টে উঠলো। দেখল, বিল্ডিং এর সবাই সন্তানকে বড় স্কুলে পাঠায়, তাই বাচ্চার স্কুলও পরিবর্তন করতে হল। কিছুদিন পড় বউ ঘ্যনঘ্যন শুরু করলো সবার বাড়িতে কত দামি আসবাব, ফ্রিজ, টিভি, আর আমাদের বাড়িতে কিচ্ছু নেই। ও গুলোও কিনতে হোল। এরপর শুরু হোল বাচ্চার প্রাইভেট টিউশান, নানা রকম দাবি দাবা। আগে পূজায় একজোড়া জুতা পেয়েই সবাই কত খুশি হত, আর এখন প্রতি মাসে একজোড়া দিলেও তৃপ্তি নেই। যেহেতু সে এখন বড় চাকরি করে , পরিবারের সবার তাঁর কাছে প্রত্যশাও অনেক। সাধ্যমত চেষ্টা করে, তাও সবার চাহিদা মেটাতে পারেনা। আত্মীয় স্বজন বন্ধুগন তাকে অহংকারি ভেবে দুরে সরে গেলো।
এদিকে অফিসের সবাই ফ্ল্যাট বুকিং দিচ্ছে। বৌ সারাদিন বাড়িতে খোটা দেয় , তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সে চাকরির ফাকে অন্য আয় কিছু শুরু করলো। তাতেও কিছু হয় না। নানাবিধ টেনশান আর দুশ্চিন্তায় তারো মাথার চুল কমতে লাগলো। ব্যবসায়ি লক্ষ করলেন ব্যপারটা। উনি বললেন কি ব্যপার , তোমাকে এতো বড় প্রমোশান দিলাম, এতো টাকা দিলাম, আর এখন দেখি তুমি আগের মত আর প্রাণবন্ত নেই। ঘটনা কি?
সে বলল স্যার , কিছু সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সাথে যে এতো চাহিদা আর অভাব আসবে তাতো আর বুঝিনি। আগে আমার কিছুই ছিলনা, অভাবও ছিলনা। আর এখন যেদিকেই তাকাই , খালি নাই আর নাই। আগে আমার অভাব পড়লেও সেটা ছিল এক দুই হাজারের ব্যপার। কোন ভাবে মেটান যেত। আর এখন আমার অভাব লক্ষ কোটি টাকার। এটা কিভাবে মেটাবো সে চিন্তায় আমার এখন আর রাতে ঘুম আসেনা স্যার। ব্যবসায়ি বলল, এতদিনে বুঝলাম, আমার মুল অসুখ। টাকার আর সম্পদের সাথে অভাব আসে। যতই টাকার দুনিয়ার পিছনে ছুটি, এই অভাব আর অন্য কিছু দিয়েই পূর্ণ হবেনা।
সন্ন্যাসী মানুষগনও শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা মাথায় তুলতে পারলে ভুলে যায়, তার আশেপাশের মানুষেরাই তাকে শ্রেষ্ঠ করে তুলেছিল। অহংকারের চূরায় অধিষ্ঠিত হয়ে নিজেকে চরম উচ্চস্থানে তুলে এই আমিত্ব। এখানেই মানুষের নৈতিক পরাজয় ঘটে। জাগতিক প্রাপ্তির অহংকারে গা না ভাসাতে শিখতে হয়। বোধটুকু কাজে লাগাতেই হয়। তবেই না মান+হুশ = মানুষ হওয়া যায়। তবে মানুষকে ভালোবাসতে শিখতে হয়, ভাল-তে বাস করতে শিখতে হয়। প্রেম বুঝতে হয়, প্রেম শিখতে হয়। সব সময় আরও টাকা চাই, আরও টাকা চাই নয়।
আমাদের সমাজে আজ আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ ডাক্তার কোথায়? শিক্ষা,স্বাস্থ্য, আজ ব্যবসায় পরিণত। আজ নেট দুনিয়া আমাদের সমাজকে পরিচালনা করছে।আজ আমাদের সমাজে সাধু মহারাজ, সর্ব ত্যাগী সন্ন্যাসীগনও টাকা টাকা করে পাগল, কথাগুলি অপ্রিয় হলেও সত্যি। আজ সরকারি কাঠামো ভেঙে পড়ছে, কোথায় আজ বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, সুভাষ এর আদর্শ? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল আজ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত। তাই আসুন আমরা সবাই সচেতন হই, মোবাইল আর টাকার পিছনে ছোটাছুটি কম করি। আমাদের সমাজে সুসম্পর্ক চিন্তা, ভাবনা, কল্পনা, আনন্দ, অনুভূতি, মনের ব্যাকুলতা, অফূরন্ত বিশ্বাস, আর ভালোবাসা প্রয়োজন।
তাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন:-“মানুষ কি চায় — উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে।” আসুন পরিবর্তন করার চেষ্টা করি। বাস্তববাদী হওয়ার চেষ্টা করি।***
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ….!
স্বামী আত্মভোলানন্দ l