Categories
প্রবন্ধ

মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও পবিত্র রক্ষাবন্ধন (ঝুলন) : স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)।

আমাদের মূল্যবান মনুষ্য জীবনে ভারতীয় সংস্কৃতি সভ্যতায় ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সত্য সনাতন হিন্দু ধর্মে এই উৎসবটি ভাই ও বোনের শুভ রাখীবন্ধন উৎসব। ভারতবর্ষে এই উৎসব শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিন পালন করা হয়। এজন্য অনেক সময় রাখী বন্ধন উৎসব কে রাখী পূর্ণিমা ও বলা হয়। আবার ঝুলন পূর্ণিমা ও বলা হয়। ঝুলন পূর্ণিমা কিছু মন্দিরে শুধুমাত্র একদিনের জন্য ঝুলন যাত্রা উৎসব পালন করা হলেও, কিছু মন্দিরে একাদশীর দিন থেকে পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত পালন করা হয়, যা শ্রাবণ মাসে পাঁচ দিন ধরে চলে। ঝুলন যাত্রা একটি ধর্মীয় উৎসব যা ভগবান কৃষ্ণ এবং ভগবান জগন্নাথকে উৎসর্গ করা হয়। ঝুলন যাত্রা উত্তর প্রদেশের মথুরা এবং বৃন্দাবন শহরগুলির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ ধাম ও মায়াপুরে অত্যন্ত আড়ম্বর ও আনন্দের সাথে উদযাপিত হয়। সারা দেশে ভগবান কৃষ্ণ মন্দির, ভগবান জগন্নাথ মন্দির এবং অন্যন্য মন্দিরেও ঝুলন যাত্রা পালিত হয়। সারা বিশ্ব এবং সারা দেশ থেকে ভক্তরা এই মন্দিরগুলিতে উৎসব উদযাপন করতে সমবেত হন।

রক্ষাবন্ধন পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বলির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিরাজের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন উৎসব হিসেবে পালন করে।

মহাভারতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী একবার যুদ্ধে ভগবান কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এতে ভগবান কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান। দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয়া হলেও, তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন বলে ঘোষণা করেন এবং দ্রৌপদীকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বহু বছর পরে, পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এইভাবেই রাখীবন্ধনের প্রচলন হয়।

ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী ৩২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।

ঐতিহাসিক মর্যাদায় সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মেওয়ারের রাজপুত রাণী কর্ণাবতী ও সম্রাট হুমায়ুনের ইতিহাস।
১৫৩৫ সালে গুজরাটের সুলতান বাদশা চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের রানী কর্ণাবতী হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তার কাছে একটি রাখী পাঠান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করতে পারেননি কারণ তিনি চিতোর পৌঁছানোর আগেই বাহাদুর শাহ চিতোর জয় করে নিয়েছিলেন। বিধবা রানী কর্ণাবতী নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে এবং বাহাদুর শাহ এর হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৩০০০ স্ত্রীকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জহর ব্রত পালন করেন। পরে হুমায়ুন চিতোর জয় করে কর্ণাবতীর ছেলে বিক্রম সিংহ কে রাজা ঘোষণা করেন। রাণী কর্ণাবতী ও সম্রাট হুমায়ুনের সম্পর্কের বুনিয়াদ ছিল শুধুই একটি রাখি আর সাথে থাকা একটি চিঠি। ভিন্ন ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্ক কিছুই মুখ্য হয়নি ভাইকে পাঠানো বোনের রক্ষাবার্তায়। বোনকে রক্ষায় ছুটে এসেছেন ভাই। শেষ রক্ষা না হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন অপরাধীকে।

পরবর্তী কালে আমরা জানি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী বন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। আজ কাল আমরা সবাই রাখী বন্ধন উৎসবে মেতে উঠি। কিন্তু অনেক সময় তা উৎসব হয়েই থেকে যায়। অনেক সময় দামী ও রংচঙে রাখীর নিচে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পবিত্র রাখি বন্ধন উৎসব এর সেই পুরোনো মহিমাময় ঐতিহ্য ও গৌরব।

এই রাখীবন্ধন উৎসব ভাই ও বোনের মধ্যে প্রীতিবন্ধনের উৎসব। ভাই ও বোন,দাদা,দিদি এই উৎসব পালন করেন। এই দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতে পবিত্র রাখী বেঁধে দেয়। এই রাখীটি ভাই বা দাদার প্রতি দিদি বা বোনের ভালবাসা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনা এবং দিদি বা বোনকে আজীবন রক্ষা করার ভাই বা দাদার শপথের প্রতীক হিসাবে পরিগণিত হয়। এই বছর রাখি পূর্ণিমা তিথি পড়েছে পঞ্জিকা অনুযায়ী বাংলা ২রা ভাদ্র সোমবার,১৪৩১। ইংরেজি 19ই আগস্ট 2024. আপনাদের সবাইকে শুভ ঝুলন পূর্ণিমা ও রক্ষাবন্ধনের শুভেচ্ছা। আজ এই শুভ দিনে জগৎগুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ সবার শিরে বর্ষিত হোক এই প্রার্থনা করি।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ….!
স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক) l

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *