শোনা যায়, পৌষ মাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে শ্রীচৈতন্যদেব কুলিয়া গ্রামের বৈষ্ণব-নিন্দুক পণ্ডিত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত দেবানন্দের অপরাধ ভঞ্জন করেন । তাই একে অপরাধ-ভঞ্জনের পাটও বলে । আবার অনেকে “দেবানন্দের পাটও” বলে থাকেন । যার জন্য শ্রীচৈতন্যদেব ও শ্রীনিত্যানন্দের স্মৃতি বিজড়িত কুলিয়ার পাট বৈষ্ণবদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান ।
মন্দিরে গৌর-নিতাই বিগ্রহের নিত্য পুজা হয় । সামনেই নাট মন্দির । মন্দিরের পাশে কুলিয়া বিলের ঘাটটি ভীষণ সুন্দর ! নির্জন ও ছায়া-শীতল । বর্তমানে সমগ্র মন্দির দেখ-ভালের দায়িত্বে কলকাতার পিঞ্জরাপোল সোসাইটি ।
উল্লেখ থাকে যে, কুলিয়া পাটের এই মন্দিরটি কল্যাণী মেন স্টেশন থেকে ২.৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত । সেখানে পৌঁছানোর হরেকরকম যানবাহন । তার মধ্যে টোটো সার্ভিস উল্লেখযোগ্য ।
এবার আসছি, কুলিয়ার পাট মেলা সম্পর্কে । কুলিয়ার পাট সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত । দেবানন্দ ছিলেন কুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা । কিন্তু ভক্তিহীন মোক্ষাভিলাষী । শ্রীমদ্ভাগবতের অধ্যাপনা করতেন । একদিন চৈতন্যদেবের ভক্ত বলা চলে পার্শ্বচর শ্রীবাস পণ্ডিত ভাগবতের ব্যাখা শুনতে তাঁর বাড়িতে আসেন । ভাগবতের পাঠ শুনতে শুনতে পণ্ডিত শ্রীবাস প্রেমাবিষ্ঠ হলেন । প্রেমাবিষ্ঠ হয়ে উচ্চৈস্বরে কাঁদতে লাগলেন । এটাকে পণ্ডিত দেবানন্দ পাগলের পাগলামি ভাবলেন । পাগলের পাগলামি ভেবে পণ্ডিত দেবানন্দ ও তাঁর ছাত্ররা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীবাসকে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে বের করে দেন । এই অপরাধে পণ্ডিত দেবানন্দ কুষ্ঠাগ্রস্থ হন । পরবর্তীতে পণ্ডিত শ্রীবাসের উপর দুর্ব্যবহারের জন্য পণ্ডিত দেবানন্দের প্রচণ্ড অনুশোচনা হয় । তদানীন্তনকালে অর্থাৎ প্রায় পাঁচ শত বছর বা তার বেশী সময়কালে এই কুলিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনা নদী বয়ে যেত । সেই সময় মহাপ্রভু কুলিয়া গ্রাম হয়ে কুমারহট্ট যাওয়ার সময় এখানে এলে পণ্ডিত দেবানন্দের চরণে তাঁর দুখের কথা নিবেদন করেন এবং একটা কুলোয় করে মুলো, পালং শাক, চাল, ইত্যাদি দিয়ে সিধা দেন । তারপর দয়ালু মহাপ্রভু পণ্ডিত দেবানন্দকে যমুনায় স্নান করে আসতে বলেন । পণ্ডিত দেবানন্দ যমুনায় ডুব দেওয়া মাত্র তাঁর দেহ থেকে কুষ্ঠব্যাধি নির্মূল হয় । তারপর ঐ সিধা রান্না করে মহাপ্রভু একাদশীর উপবাস ভঙ্গ করেন । এরপর যমুনার ধারে সারা রাত ধরে হরিনাম সংকীর্তন করেন ।
আরও শোনা যায়, কয়েক বছর পরে ঠিক পৌষ মাসের কৃষ্ণা একাদশীর তিথিতে পণ্ডিত দেবানন্দ দেহ ত্যাগ করেন । পৌষ মাসের কৃষ্ণা একাদশীর দিন পণ্ডিত দেবানন্দের অপরাধ ভঞ্জন হয়েছিল বলে সেই থেকে ঐ তিথিতে পণ্ডিত দেবানন্দের সমাধির পাশে অপরাধ-ভঞ্জনের মেলা বসে । কথিত আছে, এই তিথিতে এসে গৌর-নিতাই মূর্তি দর্শন করে কুলিয়ার পাটে স্নান, পুজার্চ্চনা করলে সব পাপ ও অপরাধ ভঞ্জন হয় ।
কুলিয়ার পাটের মেলা, অপরাধ ভঞ্জনের মেলা নামেও পরিচিত । মেলায় সকাল থেকেই পুণ্যার্থীদের সমাগম ঘটে । পুণ্যার্থীরা কুলো ও মুলো সহযোগে গৌর-নিতাই মূর্তিতে পুজো দেন । এই বছর মেলা সবে শুরু । এই মেলা প্রায় সপ্তাহব্যাপী চলবে । শোনা যায়, বাংলাদেশ থেকেও অনেক পুণ্যার্থী মেলায় আসেন । রাজ্যের তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা বাস, ট্যাক্সি, টাটা-সোমো, ইত্যাদির মাধ্যমে মেলায় হাজির হন । সুতরাং ভক্তির নিরিখে অসংখ্য মানুষের বিশ্বাস আজও অমলিন । যার জন্য মেলায় জমজমাট ভিড় ।
স্বল্প কথায় কুলিয়া পাটের মেলার ইতিহাস এইটুকু । যদিও আজও স্মৃতি বিজড়িত কুলিয়ার পাট বৈষ্ণবদের একটি অন্যতম তীর্থক্ষেত্র । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।
Categories
বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র কুলিয়া পাটের মেলা : দিলীপ রায়।
