Categories
গল্প

দাবানো : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

রোহিমা খাতুন ও মহিমা খাতুন, দুই বোন । রোহিমা বড় । তার বিয়ে হয়ে গেছে । মহিমা এখন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত । গাঁয়ে মহিমার সমবয়সী মেয়েরা প্রায় সকলে বিবাহিত । ঐ ফরাসডাঙ্গা গ্রামে দীর্ঘদিন থেকে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ । যার জন্য বেশীর ভাগ মেয়েদের অষ্টম/নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় বিয়ে । মেয়েদের বিয়ের বয়স বেশী হলে, পাত্র পাওয়া কঠিন ! গাঁয়ে কয়েক ঘর ছাড়া আর সকলেই হতদরিদ্র । ‘দিন আনে দিন খায়’ অবস্থা । পরের জমিতে চাষ-আবাদে দিন-মজুর খাটে । কিছু মানুষের রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে-মিস্ত্রি হিসাবে দূরের শহরে কাজ করে তাদের জীবিকানির্বাহ । গাঁয়ের মানুষের আর্থিক অবস্থা তথৈবচ । হাতে গোনা কয়েকজন সবজি বিক্রি করে তাদের সংসার । এইরকম একটা টানাটানির পরিস্থিতিতে ফরাসডাঙ্গা গ্রামের মানুষের দিনাতিপাত ।
রোহিমা খাতুনের বিয়ে হয়েছে ঠিক চৌদ্দ বছরের মাথায় । এখন তার বিশ বছর বয়স । দুটো সন্তানের জননী । সন্তান হওয়া ও সন্তান পালনের জন্য রোহিমার চেহারা শুকিয়ে কাঠ । এখন তার রোগা-পটকা চেহারা । চেহারার জৌলুস বয়স্ক মহিলাদের ন্যায় । এইসব দেখেশুনে মহিমা বিয়ের ব্যাপারে বেঁকে বসেছে । তার একটাই বক্তব্য, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ে । জেদি মনোভাবের জন্য মহিমাকে নানান গঞ্ছনা সইতে হচ্ছে । বিশেষ করে পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে । আর আছে গাঁয়ের মোড়ল অর্থাৎ মৌলবীদের উৎপাত । অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে গাঁয়ের মৌলবীদের শ্যেনদৃষ্টি । বিয়ের উপযুক্ত বয়স হওয়া সত্ত্বেও লিয়াকত কেন মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে না, এইটাই তাঁদের গাত্রদাহ ? জুম্মাবারে মসজিদে নামাজ পড়া শেষ হলে মৌলবীরা লিয়াকতকে মনে করিয়ে দিলেন, “বয়স হওয়া সত্ত্বেও মেয়েকে কেন বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না ?” মেয়েদের কাজ, ঘর-সংসার করা । “বিয়ে না দিয়ে মেয়েকে দূরের কলেজে পড়ানো” তাঁরা ভালভাবে নিচ্ছেন না ?
গাঁয়ের মৌলবীদের নির্দেশ মানতে নারাজ মহিমা । জীবনটা তার । জীবনের ভাল-মন্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র তার নিজের । তাই মহিমার জেদ, “নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ে ।“ লিয়াকত নিজেও মনেপ্রাণে চায়, তার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক । ফরাসডাঙ্গা গ্রাম থেকে অন্তত একটি মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হোক এবং চাকরি করুক ।
( ২ )
সকালে ঘুম থেকে উঠে লিয়াকত জমিতে ছুটলো । তার সর্বসাকুল্যে দুই বিঘে জমি । জমিতে পাট চাষ । পাট কাটার পর আমন ধান রোয়ার পালা । গিন্নিকে বলে গেলো জমিতে দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতে । মাথার উপর থেকে কেবল সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । এমন সময় মহিমা গামছায় খাবারের থালা বেঁধে মাঠে উপস্থিত । মহিমা খবর দিলো, তার রেজাল্ট বের হয়েছে । পাশ করেছে এবং সে এখন গ্রাজুয়েট । লিয়াকতের তখন কী আনন্দ ! মেয়ের বি.এ. পাশের খবরে খুশীতে উচ্ছ্বসিত । আবেগে বলেই ফেললো, “তুই এবার মস্ত বড় চাকরি পাবি ।“
মহিমা উল্টে বললো, চাকরি পাওয়া অতো সহজ নয় বাবা । বাস্তব বড় কঠিন ।
মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে লিয়াকত বললো, “তুই আদাজল খেয়ে পড়াশোনায় মন দে । আমার বিশ্বাস, তুই চাকরি পাবি ।“
পড়াশুনার জন্য মহিমার দরকার একটা ল্যাপটপ । মহিমা আদৌ ল্যাপটপ কিনতে পারবে কিনা, সেই ব্যাপারে পুরোটাই ধন্দে ? কিন্তু লিয়াকত মেয়েকে আশ্বস্ত করলো, পাট বিক্রি করে সেই টাকায় মহিমার ল্যাপটপ কিনে দেবে ।
ডিজিটাল যুগ । তাই মহিমা নেটের মাধ্যমে নিজেকে তৈরী করতে শুরু করলো । মহিমার বাস্তব উপলব্ধি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় দাঁড়াতে গেলে যথোপযুক্ত প্রস্তুতি দরকার !
অন্যদিকে গাঁয়ের মৌলবীরা নিজেরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলেন, লিয়াকতকে আর সময় দেওয়া যাবে না ।
জুম্মাবারে মসজিদে নামাজের পরে ফরাসডাঙ্গা গ্রামের সকল মানুষের সামনে ও অন্যান্য মৌলবীদের অনুমতিক্রমে মসজিদের মূল মৌলবী ( মসজিদের পুরোহিত অর্থাৎ ‘ইমাম’) লিয়াকতকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়ে বললেন, “তার মেয়েকে সত্ত্বর বিয়ে দিতে । অন্যথায় গাঁয়ে সকলের সাথে বাস করা যাবে না । তাকে একঘরে থাকতে হবে ।“
খবর পেয়ে ছুটে আসে মহিমা । তার আবার ভয় ডর কম । মৌলবীদের মুখের উপর সে জানিয়ে দিলো, “আমি এখন বিয়ে করবো না । আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই । তাই আমাকে সুযোগ এওয়া হোক ।“
মসজিদের মূল মৌলবী লিয়াকতের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “তোমার মত জানাও ।“
গাঁয়ের মানুষের সামনে লিয়াকত মাথা নীচু করে আমতা আমতা করে বললো, “হ্যাঁ, মেয়ে যেটা বললো সেটাই আমার মত ।“
উপস্থিত সকলেই তখন চুপ । মূল মৌলবী তখন ষোষণা করলেন, “লিয়াকতকে গ্রামে ‘এক ঘরে’ করে রাখা হলো ।“
মহিমার কাছে সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার, গাঁয়ের একটি মানুষও কোনো প্রতিবাদ করলো না । মহিমার আপশোশ, মানুষ এখনও মান্ধাতার আমলে বিরাজ করছেন । বর্তমান ডিজিটাল যুগে নারীরা কতো এগিয়ে, সেখানে তাদের গাঁয়ের মানুষ অনেক পিছিয়ে । এটা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যাথা নেই । এইসব দেখে রাগে-দুঃখে মহিমা তার বাবাকে জোর করে সেখান থেকে বিদায় নিলো ।
তারপর …………?
(৩)
তারপর চাকরির চেষ্টা । অনেক চেষ্টার পর চাকরির পরীক্ষায় পাশ করলো এবং চাকরি পাওয়ার তালিকায় নামও উঠলো । “তালিকায় নাম উঠেছে” এই মর্মে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে মহিমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েও দিলো । কিন্তু অবশেষে জানতে পারলো, কোনো এক প্রভাবশালী নেতার মেয়েকে চাকরিটা পাইয়ে দিতে গিয়ে ‘চাকরি পাওয়ার তালিকা’ থেকে তার নাম কাটা গেছে ।
মহিমা নাছোড়বান্দা । জেদি মেয়ে । ছাড়বার পাত্রী নয় । মনে মনে ভাবছে, তাকে দাবানো যাবে না । মহামান্য উচ্চ আদালতে বিষয়টি তুললো । সেখানেও অনেক বাধা । হাইকোর্ট থেকে কেস তুলে নেওয়ার জন্য তাকে রীতিমতো শাসানি । এমনকি রাস্তাঘাটে তাকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা । কিন্তু মহিমার সাহসের কাছে তাদের সব প্রচেষ্টাই বিফল ।
ডিপার্ট্মেন্টের চিঠিটাই একমাত্র মহিমার ভরসা । কোর্টে লড়াই করার মোক্ষম অস্ত্র !
রাত্রিবেলা শুয়ে রয়েছে । পরেরদিন হাইকোর্টে মামলার শুনানি । একদল গুণ্ডা বাড়িতে এসে হুজ্জুতি । মহিমাকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা । মহিমার মা রান্নাঘর থেকে সবজি কাটার বটি এনে গর্জে উঠলো, “তোরা পালাবি, নতুবা তিনটেকেই আমি একসঙ্গে কচুকাটা কাটবো ।“
মহিমার মায়ের রণংদেহি মূর্তি দেখে মুখে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা আগন্তুকগুলো পালাতে বাধ্য হলো । যাওয়ার সময় মহিমার উদ্দেশে তাদের কী চিৎকার, আগামীকাল কোর্টে গেলে তোকেও আমরা কচুকাটা কাটবো ।
এদিকে গাঁয়ে ‘একঘরে’ থাকার জন্য চিৎকার চেচামেচি শোনা সত্ত্বেও মৌলবীদের ভয়ে কেউ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এলো না ।
মামলার শুনানি শেষ । মাননীয় বিচারক সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দিলেন, সত্বর মহিমাকে কাজে যোগ দেওয়ার নিয়োগপত্র দিয়ে দিতে ।
মহিমা কাজে যোগ দিলো ।
লিয়াকতের চোখে আনন্দাশ্রু ।
*********************************************

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *