১২৫৬ সালের ১৫ জানুয়ারী, চেঙ্গিস খানের নাতি এবং ইলখানাত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হালাকু খান বর্তমান ইরানের নিজারি ইসমাইলি রাজ্যের দুর্গ আলামুত দখল ও ধ্বংস করেন। এই ঘটনাটি মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং ইসলামী বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়কে চিহ্নিত করে।
পটভূমি
আলামুত, যা ঈগলের বাসা নামেও পরিচিত, উত্তর ইরানের আলবোর্জ পর্বতমালায় অবস্থিত একটি দুর্গ শহর ছিল। এটি ৯ম শতাব্দীতে জাস্টানিদ রাজবংশ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পরে একাদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত শিয়া ইসলামী সম্প্রদায় নিজারি ইসমাইলি রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠে। নিজারিরা তাদের সামরিক দক্ষতা, কৌশলগত জোট এবং গুপ্তচর ও ঘাতকদের অত্যাধুনিক নেটওয়ার্কের জন্য পরিচিত ছিল।
১০৯০ সালে আলামুত দখলকারী ক্যারিশম্যাটিক নেতা হাসান-ই সাব্বাহ নিজারি ইসমাইলি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নেতৃত্বে নিজারিরা তাদের অঞ্চল সম্প্রসারণ করেন, একটি জটিল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ঐতিহ্য গড়ে তোলেন। তারা তাদের সহনশীলতা, শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থান করার ক্ষমতার জন্য পরিচিত ছিল।
মঙ্গোল আক্রমণ
ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জয় শুরু করে। মঙ্গোলরা ছিল মঙ্গোলিয়ার একটি যাযাবর জাতি যারা একক নেতার অধীনে একত্রিত ছিল এবং একটি শক্তিশালী সামরিক যন্ত্রের অধিকারী ছিল। তারা তাদের বর্বরতা, সামরিক কৌশল এবং প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য পরিচিত ছিল।
১২৫৩ সালে, চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানকে তার ভাই মংকে খান নিজারি ইসমাইলি রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করেন। হালাকু খানের সেনাবাহিনী ছিল মঙ্গোল যোদ্ধা, তুর্কি সৈন্য এবং স্থানীয় মিত্রদের সমন্বয়ে গঠিত। তারা নিজারি প্রতিরক্ষা দুর্বল করার জন্য সামরিক শক্তি, কূটনীতি এবং গুপ্তচরবৃত্তির সংমিশ্রণ ব্যবহার করে আলামুতের দিকে অগ্রসর হয়।
আলামুতের দখল এবং ধ্বংস
১২৫৬ সালের ১৫ জানুয়ারী, হালাকু খানের সেনাবাহিনী দীর্ঘ অবরোধের পর আলামুত দখল করে। ইমাম রুকনউদ্দিন খুরশাহর নেতৃত্বে নিজারি রক্ষকরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল অগণিত এবং তারা গুলিবিদ্ধ ছিলেন। মঙ্গোলরা দুর্গের দেয়াল ভেঙে ফেলার জন্য ক্যাটাপল্ট, তীরন্দাজ এবং অন্যান্য অবরোধ যন্ত্র ব্যবহার করে।
আলামুত দখলের পর, হালাকু খান দুর্গ ধ্বংস এবং এর বাসিন্দাদের গণহত্যার নির্দেশ দেন। বিরল পাণ্ডুলিপি এবং বইয়ের সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত নিজারি গ্রন্থাগার ধ্বংস করা হয় এবং এর অনেক পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী নিহত বা বন্দী হন।
পরবর্তী ঘটনা
আলামুতের দখল এবং ধ্বংস নিজারি ইসমাইলি রাজ্যের সমাপ্তি এবং পারস্যে মঙ্গোল শাসনের সূচনা করে। হালাকু খান ইলখানাত রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন, যা আধুনিক তুরস্ক থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল ভূখণ্ডে শাসন করত।
আলামুতের ধ্বংসের ফলে ইসলামী বিশ্বের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের এক যুগের সমাপ্তি এবং মঙ্গোল আধিপত্যের এক যুগের সূচনা করে। অনেক মুসলিম পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী পালিয়ে যেতে বা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন এবং ইসলামী বিশ্ব অন্ধকার ও অস্থিরতার এক যুগে নিমজ্জিত হয়।
উপসংহার
১২৫৬ সালের ১৫ জানুয়ারী হালাকু খান কর্তৃক আলামুতের দখল ও ধ্বংস ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। এটি নিজারি ইসমাইলি রাজ্যের সমাপ্তি এবং পারস্যে মঙ্গোল শাসনের সূচনাকে চিহ্নিত করে। আলামুতের ধ্বংস ইসলামী বিশ্বের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে, যার ফলে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক অবক্ষয়ের এক যুগ শুরু হয়। আজ, আলামুতের উত্তরাধিকার বিশ্বজুড়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত এবং মুগ্ধ করে চলেছে, যা ইসলামী বিশ্বের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে কাজ করে।