ॐ সর্বমঙ্গল- মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ -সাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে।।
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ পাওয়া যায় সমাধি নামক এক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে মেধা ঋষির আশ্রমে প্রথমবার বাসন্তী পুজো করেছিলেন রাজা সুরথ। দূর্গা সপ্তশতী, দেবী মাহাত্ম্য ও মার্কণ্ডেয় পুরাণে রাজা সুরথকে চিত্রগুপ্তের বংশধর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী রাজা সুরথ ছিলেন সুশাসক ও অপরাজেয় যোদ্ধা। কিন্তু একদা প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন সুরথ। এই সুযোগে তাঁর সভাসদরাও লুটপাট চালায়। নিজের ঘনিষ্ঠদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে তিনি স্তম্ভিত হন। হতাশ হয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। সুরথ রাজার রাজধানী ছিল বীরভূম জেলার বোলপুরের সুপুর। রাজা সুরথ সুশাসক ও যোদ্ধা হিসাবে বেশ সুখ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশের। জীবনে কোনো যুদ্ধে তিনি পরাজিত হননি। কিন্তু সুরথ রাজার প্রতিবেশীরাজ্য (যবন রাজ্য) তার প্রতি হিংসাত্মক মনোভাবসম্পন্ন ছিল। যবন রাজ্য একদিন সুরথ রাজার রাজ্যকে আক্রমণ করে এবং তাদের কাছে সুরথ রাজের পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তার (সুরথ) রাজসভার মন্ত্রী, ও অন্য সদস্যরা সব ধনসম্পত্তি লুঠ করে। কাছের লোকেদের এমন আচরণ দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। অবশেষে সর্বহারা হয়ে বনে আশ্রয় নেন।
এমনই একদিন ঘুরতে ঘুরতে মেধা ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা ঋষি তাঁকে সেখানে থাকার আবেদন জানান। রাজা সেখানে বাস করলেও তাঁর মনে শান্তি ছিল না। নিজের রাজ্য ও প্রজার ভালো-মন্দের কথা তাঁকে ঘুমাতে দিত না। এরই মধ্যে একদা সমাধি নামক এক বণিকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সমাধি বণিকের স্ত্রী-পুত্রও তাঁর সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবারের ভালোর জন্য চিন্তিত থাকতেন তিনি। রাজার মনে প্রশ্ন জাগল যে, তাঁরা দুজনেই আপনজনদের প্রতারণার শিকার হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁদের ভালোর কথা চিন্তাভাবনা করছেন? কেন তাঁদের প্রতি মনের মধ্যে কোনও ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে না? তাঁরা ঋষিকে একথা জিগ্যেস করেন যে, তাঁদের আপনজনেরা তাঁদের সঙ্গে এত খারাপ করা সত্ত্বেও কেন তাঁরা এখনও তাঁদের কল্যানের কথা ভাবছেন? এর উত্তরে মেধা ঋষি বলেন যে, সবই মহামায়ার ইচ্ছা। এর পর ঋষি মহামায়ার কাহিনি শোনান। তার পর তাঁদের কঠিন তপস্যা করার পরামর্শ দেন। মহামায়া দেবী দুর্গার আশীর্বাদ পেতে রাজা সুরথ ও বণিক সমাধি বসন্ত কালের শুক্ল পক্ষে দুর্গার আরাধনা করেন। বসন্ত কালে এই পুজো করা হয়েছিল বলে এটি বাসন্তী দুর্গা পুজো নামে পরিচিত। পরবর্তী কালে এই পুজোয় খুশি হয়ে দেবী তাঁদের রাজ্য, ধন-সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী তার পর থেকেই বসন্ত কালে দুর্গার আরাধনা শুরু হয়। শ্রীরামচন্দ্রের দ্বারা শরৎ কালে দুর্গা পুজোর আগে পর্যন্ত বসন্ত কালেই দেবীর আরাধনা করা হত। বর্তমানে মুষ্টিমেয় কিছু স্থানে ও বাড়িতে বাসন্তী দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হয়।
শ্রীশ্রী চণ্ডী এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে মেধস মুনির আশ্রমেই পৃথিবীর প্রথম দুর্গাপুজো আয়োজিত হয়েছিল। সেটাকেই বাসন্তি পূজা বলা হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর মহকুমার কাঁকসার গড় জঙ্গলে অবস্থিত। দুর্গাপুর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে গড়জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে ২-৩ কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে মেধসাশ্রম। পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের নিকটবর্তী গড় জঙ্গলে মেধসাশ্রমে ভূভারতের প্রথম দুর্গাপূজা হয়। এখানেই রাজা সুরথ বাংলা তথা মর্তে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন। কাঁকসার গড় জঙ্গলের গভীর অরণ্যের মেধাশ্রম বা গড়চণ্ডী ধামে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য পুজো শুরু করেন। বসন্তকালে পুজোর সূচনা হয়, তাই, বসন্তের নবরাত্রির পূজা বাসন্তিক বা বসন্ত কালীন দুর্গাপূজা নামে পরিচিত হয়। তারপর থেকেই বাংলা তথা ভূভারতে দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়। আগামী ৩০ মার্চ থেকে শুরু হবে চৈত্র নবরাত্রি। এই নবরাত্রির ষষ্ঠী থেকে দশমীর মধ্যে পালিত হবে বাসন্তী পুজো। চৈত্র নবরাত্রিতে হয় বাসন্তী পুজো। বাসন্তী পুজোকেই বাঙালির আসল দুর্গা পুজো বলে মনে করা হয়।
মহর্ষি মেধস মুনি বলিলেন, মহামায়া পরমা জননী অর্থাৎ আদিমাতা৷ যখন এই জগৎ ছিল না, তখন তিনি ছিলেন। যখন সূর্য্য ছিল না, চন্দ্র ছিল না, তারা নক্ষত্র এই পৃথিবী কিছুই ছিল না, তখন তিনি ছিলেন। তাঁহা হইতেই এই জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে৷ তিনি এই জগৎকে মোহিত করিয়া রাখিয়াছেন বলিয়া তাঁহার নাম মহামায়া। জগৎকে তিনি সৃষ্টি করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জগৎকে ধরিয়া আছেন, এই জন্য তাঁহার আর এক নাম জগদ্ধাত্রী। তিনি ধারণ করিয়া না থাকিলে উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই এ জগতের লয় হইয়া যাইত। শক্তিরূপা সনাতনী আপনার বিশ্ব বিমোহিনী মায়া দ্বারা আপনাকে আচ্ছাদিত করিয়া নানারূপে আমাদের মধ্যে লীলা করিতে আসেন। কখনও তিনি পিতা মাতার কাছে নন্দিনী, ভ্রাতার কাছে ভগিনী, পতির কাছে জায়া, পুত্র কন্যার কাছে জননী। কখনও তিনি দীনের কাছে দয়া, তৃষিতের কাছে জল, রোগীর কাছে সেবা, ক্ষুধিতের কাছে ফল। কখন কত মূর্তিতে যে মা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হন তাহা আর কি বলিব ? তাঁহার গুণ বর্ণনা করিয়া শেষ করিতে পারে, এমন শক্তি এ জগতে কার আছে ? তিনি আসিলেই জীবের সকল দুর্গতির অবসান হয়। এইজন্য তাঁহার আর এক নাম দুর্গা। দুর্গতিনাশিনী শ্রীদুর্গাই ভুবনমোহিনী ত্রিজগৎ প্রসবিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া।
চৈত্র অমাবস্যার পরের দিন, অর্থাৎ চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ থেকে শুরু হয় চৈত্র নবরাত্রি। এই বছর নবরাত্রি শুরু হবে আগামী ৩০ মার্চ থেকে। সেই দিনই করা হবে ঘট স্থাপন। দেবী মাতার নয়টি রূপ নবরাত্রি পূজা করা হয়। এই বছর ৩০ মার্চ প্রতিপদ শৈলপুত্রী, দ্বিতীয়া ৩১শে মার্চ ব্রহ্মচারিণী, তৃতীয়া ০১ এপ্রিল-চন্দ্রঘণ্টা, চতুর্থী ০২ এপ্রিল-কুষ্মাণ্ডা, পঞ্চমী ০৩ এপ্রিল-স্কন্দমাতা, ষষ্ঠী ০৪ এপ্রিল-কাত্যায়নী, সপ্তমী ০৫ এপ্রিল-কালরাত্রি, অষ্টমী ও নবমী ০৬ এপ্রিল-মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী। চৈত্র নবরাত্রির নবমীতেই পালিত হয় রাম নবমী। মনে করা হয়, এই দিনেই জন্ম হয়েছিল রামচন্দ্রের। চৈত্র নবরাত্রি পুজোর প্রচলন উত্তর ও পশ্চিম ভারতে, শাস্ত্রে যে চারটি নবরাত্রিগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে আমরা চৈত্র, আষাঢ়, আশ্বিন এবং মাঘ মাসের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত চারটি নবরাত্রি দেখতে পাই। আষাঢ় ও মাঘ মাসের নবরাত্রিকে বলা হয় গুপ্ত নবরাত্রি। আশ্বিন মাসের নবরাত্রিকে শারদীয়া নবরাত্রি এবং চৈত্র মাসের নবরাত্রিকে বাসন্তী নবরাত্রি বলা হয়।
প্রাচীন কাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, ওড়িশা, অরুণাচল প্রদেশ, বিহারে চৈত্র মাসে দুর্গা পুজোর প্রচলন ছিল। এখনও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বাসন্তী দুর্গাপুজো করা হয়ে থাকে। বাঙালির সার্বজনীন পূজা ছাড়াও বর্তমানে রাজবাড়ী, জমিদার বাড়ি, কিছু প্রাচীন বনেদী বাড়ি এবং কিছু মঠ মন্দিরে এছাড়াও বিভিন্ন আশ্রম, মঠ ও মিশনে সন্ন্যাসীরা বাসন্তী দুর্গা পূজার আয়োজন করেন। এই বছর শ্রী শ্রী বাসন্তী দেবী দুর্গাপুজোর আমন্ত্রণ অধিবাস, ষষ্ঠী তিথি- ৩ এপ্রিল ২০২৫, সপ্তমীর পুজো, নবপত্রিকা স্নান- ৪ এপ্রিল ২০২৫, দুর্গাঅষ্টমী ও সন্ধি পুজো- ৫ এপ্রিল ২০২৫, নবমী পুজো- ৬ এপ্রিল ২০২৫, শ্রী বাসন্তী দেবী দুর্গা পুজো দশমী পুজো ও বিসর্জন- ৭ এপ্রিল ২০২৫।
জয় মা দুর্গা-জয় মা দূর্গা-জয় মা দূর্গা দূর্গতিনাশিনী… জগৎ জননী মাদূর্গা তোমার আশির্বাদ সকলের মস্তকে বর্ষিত হোক। জগৎ গুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক, পিতা-মাতার আশির্বাদ সকলের শিরে বর্ষিত হোক, এই প্রার্থনা করি.!
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ *পরিব্রাজক*