Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস: ইতিহাস, তাৎপর্য ও জনসচেতনতায় এর গুরুত্ব।

 

🔶 ভূমিকা

প্রতিবছর ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত এক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য বিষয়ক দিবস, যা জনসাধারণকে হেপাটাইটিস রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে পালন করা হয়। হেপাটাইটিস এমন একটি নীরব ঘাতক রোগ যা প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, অথচ সচেতনতা ও সঠিক প্রতিরোধে এটি প্রতিরোধযোগ্য ও অনেক ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য।

এই প্রবন্ধে আমরা জানব—

  • হেপাটাইটিস কি এবং এর প্রকারভেদ
  • এই দিবস পালনের ইতিহাস
  • প্রতি বছরের থিম
  • হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও প্রতিকার
  • দিবসটির গুরুত্ব ও সমাজে এর প্রভাব

🔶 হেপাটাইটিস: এক সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

“হেপাটাইটিস” শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে, যার “হেপার” অর্থ যকৃত এবং “ইটিস” অর্থ প্রদাহ। অর্থাৎ, হেপাটাইটিস হল যকৃতের প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশন।

হেপাটাইটিস সাধারণত পাঁচটি প্রধান ভাইরাসের মাধ্যমে হয়:

  1. হেপাটাইটিস এ (HAV)
  2. হেপাটাইটিস বি (HBV)
  3. হেপাটাইটিস সি (HCV)
  4. হেপাটাইটিস ডি (HDV)
  5. হেপাটাইটিস ই (HEV)

এই ভাইরাসগুলি যকৃতের উপর বিভিন্ন মাত্রায় আক্রমণ করে এবং দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার জন্ম দিতে পারে, যেমন— সিরোসিস, লিভার ফেইলিওর বা লিভার ক্যান্সার।


🔶 হেপাটাইটিস-এর প্রকারভেদ

✅ হেপাটাইটিস A (HAV):

  • প্রধানত দূষিত খাদ্য ও পানি থেকে ছড়ায়
  • স্বল্পমেয়াদি কিন্তু সংক্রামক
  • বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব

✅ হেপাটাইটিস B (HBV):

  • রক্ত, শুক্রাণু, মাতৃদুগ্ধ ও শরীরবিজড়িত তরলের মাধ্যমে ছড়ায়
  • যৌন সম্পর্ক, অসুরক্ষিত সূচ বা রক্তদান থেকে সংক্রমণ ঘটে
  • নবজাতকেরা মায়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে
  • দীর্ঘমেয়াদী এবং লিভারের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে
  • প্রতিরোধের জন্য টিকা রয়েছে

✅ হেপাটাইটিস C (HCV):

  • মূলত সংক্রামিত রক্তের সংস্পর্শে এসে সংক্রমণ ঘটে
  • যৌন সম্পর্ক বা রক্ত সংক্রমণে ছড়ায়
  • বহু বছর ধরে নীরবে যকৃতে ক্ষতি করে
  • প্রতিকারযোগ্য হলেও টিকা নেই

✅ হেপাটাইটিস D (HDV):

  • শুধুমাত্র হেপাটাইটিস বি-র সংক্রামিত রোগীদের মধ্যেই এই ভাইরাস কাজ করে
  • সংক্রমণ বেশি মারাত্মক
  • টিকা সরাসরি না থাকলেও HBV-এর টিকা প্রতিরোধে সহায়ক

✅ হেপাটাইটিস E (HEV):

  • দূষিত পানি থেকে সংক্রমিত
  • গর্ভবতী নারীদের মধ্যে মারাত্মক হতে পারে
  • উন্নয়নশীল দেশে সাধারণ

🔶 বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস: ইতিহাস

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০১০ সাল থেকে ২৮ জুলাই তারিখটিকে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এটি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কর্তা ও নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক ডঃ বারুচ সামুয়েল ব্লুমবার্গ-এর জন্মদিন।

WHO-এর লক্ষ্য ছিল:

  • বিশ্বের সামনে হেপাটাইটিস জনিত বিপদের পরিমাণ তুলে ধরা
  • রোগ প্রতিরোধ, টিকাদান ও চিকিৎসার বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা

এর আগে এই দিবসটি ১ অক্টোবর পালন করা হতো, কিন্তু পরে ব্লুমবার্গের সম্মানে এটি ২৮ জুলাই নির্ধারিত হয়।


🔶 বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ২০২৫: থিম

প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি নির্দিষ্ট থিমের মাধ্যমে এই দিবস উদযাপন করে।

👉 ২০২৫ সালের থিম এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি (আপডেট হলে যুক্ত করা যাবে)। তবে পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ছিল:

  • ২০২4: “We’re not waiting” — প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি দেশ যেন সময় নষ্ট না করে হেপাটাইটিস নির্মূলে একসঙ্গে কাজ করে
  • ২০২3: “One life, One liver”
  • ২০২2: “Bringing hepatitis care closer to you”

🔶 হেপাটাইটিস প্রতিরোধের উপায়

✅ প্রতিরোধমূলক টিকা:

  • হেপাটাইটিস A ও B-এর জন্য কার্যকর টিকা রয়েছে
  • শিশুদের জন্মের পরপরই HBV টিকা দেওয়া শুরু হয়
  • HAV টিকাও বর্তমানে অনেক দেশে দেওয়া হয়

✅ ব্যক্তিগত সচেতনতা:

  • বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ
  • যৌন সম্পর্কের সময় সুরক্ষা ব্যবহার
  • অপ্রয়োজনীয় রক্ত গ্রহণ এড়িয়ে চলা
  • ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করার সময় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার

✅ সঠিক চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণ:

  • হেপাটাইটিস C এর কার্যকর ওষুধ রয়েছে (DAA: Direct Acting Antiviral)
  • সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে লিভারের ক্ষয়রোগ ঠেকানো সম্ভব

🔶 বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের গুরুত্ব

১. বিশ্বজুড়ে সচেতনতা সৃষ্টি:
এই দিনটি রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে তথ্য ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।

  1. নতুন টিকা ও ওষুধ প্রসঙ্গে তথ্য প্রদান:
    চিকিৎসা ক্ষেত্রে অগ্রগতির খবর প্রচারে সহায়তা করে।
  2. ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা:
    মাতৃগর্ভ থেকে নবজাতকের সংক্রমণ প্রতিরোধে উদ্যোগ জোরদার করা হয়।
  3. সরকারি পদক্ষেপ:
    স্বাস্থ্য নীতিতে হেপাটাইটিস সংক্রান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চাপ বাড়ে।
  4. UN Sustainable Development Goals (SDG):
    ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকারকে জোরালো করা হয়।

🔶 ভারতের প্রেক্ষিতে হেপাটাইটিস

ভারত হেপাটাইটিসে আক্রান্ত দেশের তালিকায় অন্যতম। বিশেষ করে গ্রামীণ ও দরিদ্র অঞ্চলে এখনও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, অজ্ঞতা, চিকিৎসার অপ্রতুলতা হেপাটাইটিস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হন। হেপাটাইটিস সি-র ক্ষেত্রেও সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য। সরকার ‘ন্যাশনাল ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম’-এর মাধ্যমে শিশুদের জন্য হেপাটাইটিস বি টিকাকরণ চালু করেছে।


🔶 পালন পদ্ধতি ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি

প্রতিবছর এই দিনটিতে বিভিন্ন সংগঠন ও সরকার:

  • রক্তপরীক্ষার শিবির
  • টিকাদান ক্যাম্প
  • সচেতনতামূলক র‍্যালি
  • পোস্টার, লিফলেট, টিভি বিজ্ঞাপন প্রচার করে
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ কর্মসূচি চালু করে

🔶 আমরা কী করতে পারি?

  1. নিজের ও পরিবারের সদস্যদের টিকা দেওয়া
  2. সুরক্ষিত জীবনযাপন
  3. যে কোনও অসুস্থতার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
  4. আশেপাশের মানুষকে সচেতন করা
  5. ভুল ধারণা দূর করে সামাজিকভাবে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা

🔶 উপসংহার

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস শুধুমাত্র একটি দিন নয়, এটি একটি বার্তা— সচেতন হোন, নিজের ও সমাজের জীবন রক্ষা করুন। সময় থাকতে ব্যবস্থা নিন। “এক জীবন, এক যকৃত”— যকৃতকে ভালো রাখলেই জীবন সুস্থ থাকবে।

এই দিনে আমরা যেন প্রতিজ্ঞা করি—

  • আমরা হেপাটাইটিস সম্পর্কে জানব
  • সময়মতো চিকিৎসা নেব
  • হেপাটাইটিসমুক্ত পৃথিবী গড়ব

📚 তথ্যসূত্র:

  • World Health Organization (WHO)
  • CDC – Hepatitis Overview
  • Indian Journal of Medical Research
  • Ministry of Health and Family Welfare, Govt. of India
Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *