Categories
গল্প প্রবন্ধ

সমুদ্র মন্থনের বিষ ও নীলকণ্ঠ মহাদেব : শ্রাবণের পুরাণকথা ও তাৎপর্য।

প্রস্তাবনা

ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চায় প্রতিটি ঋতু, মাস, দিন, এমনকি মুহূর্তেরও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সেই পরম্পরায় শ্রাবণ মাস (জুলাই-আগস্ট) হল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ এক মাস। এটি চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী হিন্দু বর্ষপঞ্জির পঞ্চম মাস, এবং বর্ষার পূর্ণ মৌসুমি রূপে আবির্ভাব ঘটে এই সময়। শ্রাবণ শব্দটি এসেছে ‘শ্রবণ’ নক্ষত্র থেকে, যা এই মাসের পূর্ণিমার দিনটিকে নির্দেশ করে। এই মাস মূলত ভক্তি, তপস্যা ও আত্মশুদ্ধির মাস। এই সময়টা দেবাদিদেব মহাদেবের পূজা-অর্চনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।

শ্রাবণ মাস ও দেবাদিদেব মহাদেবের সম্পর্ক

শ্রাবণ মাস প্রধানত শিব ভক্তদের জন্য এক বিশেষ পূণ্যকাল। পুরাণ অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় যখন হলাহল বিষ উৎপন্ন হয়, তখন সমস্ত দেবতাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। সেইসময় ভগবান শিব তা নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন যাতে সৃষ্টির কোনো ক্ষতি না হয়। এই ঘটনার পর থেকেই শিবকে নীলকণ্ঠ বলা হয়।
বিশ্বাস করা হয়, সেই সময় ছিল শ্রাবণ মাস। ভগবান শিবের গলায় ধারণ করা বিষের তাপ প্রশমনের জন্য দেবতারা তাঁকে গঙ্গাজল, বেলপাতা ও দুধ নিবেদন করেন। সেই থেকেই শুরু হয় শ্রাবণ মাসে শিবের আরাধনা এবং শিবলিঙ্গে জল ও দুধ নিবেদন করার প্রথা।

শ্রাবণ মাসে উপবাস ও ব্রত

শ্রাবণ মাসে উপবাস রাখার প্রচলন অত্যন্ত প্রাচীন। এই মাসে প্রতি সোমবার ‘শ্রাবণ সোমব্রত’ পালন করা হয়। সাধারণত অবিবাহিতা কন্যারা উপযুক্ত বর প্রাপ্তির আশায় এই ব্রত পালন করেন, আর বিবাহিত নারীরা স্বামীর দীর্ঘ জীবন কামনায় এই ব্রত নেন।
সোমবার ব্রত পালনের নিয়ম:

ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করা।

শিবলিঙ্গে জল, দুধ, ঘৃত, মধু, চন্দন, বেলপাতা, ধুতুরা, আকাশবেল ইত্যাদি নিবেদন।

“ওঁ নমঃ শিবায়” মন্ত্র জপ করে আরতি এবং প্রার্থনা।

সারাদিন উপবাস রাখা বা ফলাহার গ্রহণ করা।

বিশেষ ব্রত ও পূজার ধরন:

মঙ্গলা গৌরী ব্রত: মহিলারা মঙ্গল কামনায় প্রতি মঙ্গলবার পালন করেন।

নাগ পঞ্চমী: নাগদের পূজার দিন; শিবের গলায় বাস করা বাসুকি নাগকে স্মরণ করে।

রক্ষাবন্ধন ও শ্রাবণী পূর্ণিমা: ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্ক উদযাপন।

শ্রাবণ মাসে পবিত্র তীর্থযাত্রা ও কাওয়ার যাত্রা

শ্রাবণ মাসে ভারতজুড়ে লক্ষ লক্ষ শিবভক্ত “কাঁওয়ারিয়া” হন। তাঁরা গঙ্গার পবিত্র জল সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট শিবমন্দিরে তা নিবেদন করেন। বিশেষ করে উত্তর ভারতের হরিদ্বার, গোমুখ, গঙ্গোত্রী, বারাণসী, বৈদ্যনাথধাম, কেদারনাথ প্রভৃতি স্থান থেকে জল সংগ্রহ করে দীর্ঘ পথ হেঁটে ভোলেনাথকে অর্ঘ্য দেন। এটি একটি কঠোর ব্রত; কাঁওয়ারিয়ার দল নিরামিষ আহার করেন, অনেকে নিদিষ্ট দিনে উপবাস পালন করেন এবং কঠোর নিয়ম পালন করেন।

পৌরাণিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব

শ্রাবণ মাসে দেবতা, ঋষি ও অন্যান্য মহাপুরুষের অনেক ঘটনাও এই মাসের সঙ্গে যুক্ত।

সমুদ্র মন্থন ও নীলকণ্ঠ রূপ
বিষ পান করে শিব পৃথিবীকে রক্ষা করেন। শ্রাবণ মাস সেই আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে।

শিব ও পার্বতীর পুনর্মিলন
শ্রাবণ মাসেই দেবী পার্বতী দীর্ঘ ব্রতের পর মহাদেবকে লাভ করেন।

শ্রীবিষ্ণুর যোগনিদ্রা থেকে জাগরণ
দেবশয়ন একাদশীতে শ্রীবিষ্ণু যোগনিদ্রায় যান এবং শ্রাবণ মাসে উত্থান একাদশীতে জেগে ওঠেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম মাস
শ্রাবণ মাসেই কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী পালিত হয়।

আয়ুর্বেদ ও প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রাবণ মাস

আয়ুর্বেদ অনুসারে, শ্রাবণ মাসে শরীর ও মন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, কারণ বর্ষার কারণে পরিপাক শক্তি দুর্বল হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই এই সময় উপবাস ও সাদামাটা খাদ্যাভ্যাস শরীরকে বিশ্রাম দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও জলবাহিত রোগ, সর্দি-কাশি, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি এই সময়ে বেশি দেখা যায়। তাই ফলাহার, নিরামিষ ভোজন, নিয়মিত যোগাভ্যাস এবং প্রার্থনা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।

মানসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

শ্রাবণ মাস শুধু বাহ্যিক পূজা-অর্চনার জন্য নয়, এটি introspection বা আত্মসমীক্ষণের জন্যও উপযুক্ত সময়। এই মাসে তপস্যা, জপ, ধ্যান ও উপবাসের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মধ্যে শুদ্ধতা আনতে পারে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে—

“যঃ শ্রাবণমাসে শিবং ভজেত্, তস্য পাপানি নাশ্যন্তি ইহলোক পারত্র চ।”
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শ্রাবণ মাসে ভগবান শিবের উপাসনা করেন, তার সব পাপ নাশ হয় – এই লোকেও, পরলোকেও।

শ্রাবণ মাসে পালনীয় কিছু নিয়ম

ব্রহ্মচর্য পালন করা।

নিষিদ্ধ দ্রব্য যেমন পেঁয়াজ, রসুন, মাংস-মদ ইত্যাদি পরিহার করা।

প্রত্যেক সোমবার উপবাস ও শিবপূজা।

কাঁওয়ার যাত্রায় অংশগ্রহণ করা অথবা অন্ততপক্ষে গৃহস্থ পর্যায়ে গঙ্গাজল নিবেদন।

দান-ধ্যান ও গরিবদের সাহায্য করা।

আধুনিক সমাজে শ্রাবণ মাসের তাৎপর্য

আজকের ব্যস্ত জীবনে শ্রাবণ মাস আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও পরিবেশ সচেতনতার বার্তা নিয়ে আসে। শিবের আরাধনা মানে কেবল পূজা নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও জীবনের ভারসাম্য খোঁজাও। বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণ, মানসিক চাপ, মূল্যবোধের অবক্ষয় যখন মানুষের জীবনে নৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে উঠেছে, তখন শ্রাবণ মাসের ব্রত ও অনুশাসন ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পারে।

উপসংহার

শ্রাবণ মাস সনাতন ধর্মের এক অমূল্য রত্ন। এটি শুধুমাত্র এক মাস নয় – এটি আত্মবিশ্লেষণ, আত্মত্যাগ, পরোপকার, সংযম, এবং ভক্তির এক দীর্ঘ সাধনার সময়। এই মাসে শিব ভক্তরা যেমন শারীরিক ও মানসিক তপস্যা করেন, তেমনি সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগও পান।
ভক্তি, শুদ্ধতা ও ধার্মিক চেতনার এই অনন্য উৎসবমুখর মাস নতুন করে মনে করিয়ে দেয় – “শিবেই সর্বস্ব”, “শিবই অনন্ত”, আর তাঁর চরণেই লুকিয়ে আছে মোক্ষের দ্বার।
শেষ কথা: শ্রাবণ মাসে অন্তত কিছু সময় ভগবান শিবের নাম জপ, নিঃস্বার্থ সেবা, এবং আত্মিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলা – এটাই এই মাসের প্রকৃত পালন।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *