Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

পুষ্পলতা দাশ: অসমের সাহসী কন্যা ও ভারতের নারী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত।

✦ ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অবদান যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ততখানি প্রেরণাদায়কও বটে। অসংখ্য নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন পূরণের জন্য। এই মহান নারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন পুষ্পলতা দাশ। অসমের এই সাহসিনী শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামেই অংশ নেননি, বরং সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বেও ছিলেন অনন্য। তিনি আজও অসমবাসীর কাছে এক প্রেরণার প্রতীক।
এই প্রবন্ধে আমরা পুষ্পলতা দাশের জন্ম, শৈশব, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা, কারাবাস, সামাজিক অবদান এবং তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

✦ জন্ম ও শৈশবকাল

পুষ্পলতা দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ সালের ২৭ মার্চ, আসামের উত্তর লখিমপুর জেলায়। তাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী এবং মাতা ছিলেন একজন গৃহিণী, যিনি পরিবারে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা লালন করতেন। শৈশব থেকেই পুষ্পলতা রাজনৈতিক আলোচনা ও জাতীয় আন্দোলনের গল্প শুনে বড় হয়েছিলেন।
তাঁর পরিবারে দেশপ্রেমের যে পরিবেশ ছিল, তা তাঁর চিন্তা ও জীবনদর্শন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি দৃঢ়চেতা, স্পষ্টভাষী এবং অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।

✦ শিক্ষাজীবন

পুষ্পলতা দাশের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় আসামের স্থানীয় স্কুলে। পরে তিনি গৌহাটি এবং শিলংয়ে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় যান এবং ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং ‘স্বদেশী’ ও ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের প্রভাব তাঁর মনে গভীরভাবে পড়ে।
ছাত্রাবস্থায়ই তিনি লালন করতেন নারী জাগরণ ও শিক্ষার স্বপ্ন। পরে এই স্বপ্নই তাঁকে নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ করে তোলে।

✦ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান

পুষ্পলতা দাশের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে ১৯৩০ সালের দিকে, যখন মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশজুড়ে সিভিল অবিডিয়েন্স মুভমেন্ট শুরু হয়। অল্প বয়সেই তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন।
১৯৩১ সালে, অখিল অসম ছাত্রী সম্মেলন-এর সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি নারী শিক্ষার প্রসার, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এবং স্বাধীনতার বার্তা প্রচার করতে থাকেন।

✦ সল্ট সত্যাগ্রহ ও কারাবাস

গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে পুষ্পলতা দাশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অসমে মহিলাদের লবণ উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা, বিদেশি পণ্যের বয়কট, ব্রিটিশবিরোধী মিছিল—এসব কর্মকাণ্ডে তাঁর নেতৃত্ব ছিল দৃশ্যমান।
১৯৩২ সালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং কয়েক মাসের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারে থাকাকালীন তিনি অন্য মহিলা বন্দিদের স্বশিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যান।

✦ ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন

১৯৪২ সালে কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিলে পুষ্পলতা দাশ অসমে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি অসমের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানান।
পুলিশ একাধিকবার তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করেন, কিন্তু তাঁর মনোবল ভাঙেনি। বরং কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।

✦ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজ

স্বাধীনতার পরে পুষ্পলতা দাশ নিজেকে কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের জন্য বহু উদ্যোগ নেন। অসম মহিলা সমিতি-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি নারীদের স্বাস্থ্য, স্বনির্ভরতা এবং অধিকার নিয়ে কাজ করেন।
তাছাড়া, তিনি আসামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং প্রচারে বড় ভূমিকা রাখেন। সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত এবং লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল।

✦ রাজনৈতিক জীবন

পুষ্পলতা দাশ স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। তিনি অসম বিধানসভায় নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী অধিকার এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন।

✦ ব্যক্তিগত জীবন

পুষ্পলতা দাশ বিয়ে করেছিলেন ওমিও কুমার দাস-কে, যিনি ছিলেন অসমের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মী। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল দেশ ও সমাজসেবার কাজে নিবেদিত। দুজন মিলে শিক্ষার প্রসারে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

✦ সম্মান ও স্বীকৃতি

পুষ্পলতা দাশ তাঁর আজীবন সংগ্রাম ও অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে।

✦ শেষ জীবন

পুষ্পলতা দাশ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু অসম ও সমগ্র দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল।

✦ উত্তরাধিকার

পুষ্পলতা দাশ শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন; তিনি নারী মুক্তি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের এক প্রতীক। তাঁর জীবন আজও তরুণ প্রজন্মকে শেখায়—সাহস, দৃঢ়তা, ত্যাগ ও নিষ্ঠা থাকলে কোনো লক্ষ্যই অসম্ভব নয়।

✦ উপসংহার

অসমের এক ছোট্ট শহরে জন্ম নেওয়া এই নারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সমাজ সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়ে এবং রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে প্রমাণ করেছিলেন যে নারীর ক্ষমতা অসীম। পুষ্পলতা দাশের জীবন কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং আজও নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয়তাবাদের এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *