ভূমিকা
১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও বিস্ময়কর দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসন তখন ভারতের মানুষের ওপর ক্রমশ দমননীতি চালাচ্ছিল। মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃত্ব তখন বুঝতে পেরেছিলেন—আর বিলম্ব নয়, স্বাধীনতার ডাক দিতে হবে। সেই ডাকে জন্ম নিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন (Quit India Movement)—যা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রামে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল, এবং এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান বাংলাদেশেও।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশ শাসনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভারতে তখন প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ শাসন চলছে। প্রশাসন, অর্থনীতি ও কৃষি ব্যবস্থা উপনিবেশিক শোষণের শিকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের জনগণকে কোনো অনুমতি বা আলোচনার বাইরে রেখেই যুদ্ধে জড়িয়ে দেয়। ভারতীয়রা বুঝতে পারে—এ লড়াই মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য নয়।
কংগ্রেসের অবস্থান
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রথমে ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা ছাড় আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে, মহাত্মা গান্ধী বলেন—
“এখন বা কখনোই নয়” (Do or Die)।
এ ছিল এক নিঃশর্ত স্বাধীনতার ডাক।
৯ আগস্ট ১৯৪২: আন্দোলনের সূচনা
বোম্বে কংগ্রেস অধিবেশন
৮ আগস্ট ১৯৪২ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) কংগ্রেসের সর্বভারতীয় কমিটি এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব পাস করে—ভারতের অবিলম্বে স্বাধীনতা দাবি এবং ব্রিটিশ শাসন অবসানের আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবটি ইতিহাসে পরিচিত হয় ‘ভারত ছাড়ো প্রস্তাব’ নামে।
নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার
৯ আগস্ট ভোরেই ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লভভাই পটেলসহ প্রায় সব শীর্ষ কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করে। এর ফলে নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় আন্দোলন এক নতুন রূপ নেয়—জনতার হাতে আন্দোলনের দায়িত্ব চলে যায়।
আন্দোলনের বিস্তার
জনতার বিদ্রোহ
নেতারা কারাগারে বন্দি থাকলেও সারাদেশে হরতাল, বিক্ষোভ, ট্রেনলাইন উপড়ে ফেলা, ডাকঘর ও থানা আক্রমণ—এসব চলতে থাকে। যুব সমাজ, ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিকরা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল।
গ্রামীণ আন্দোলন
শহরের পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামীণ জনগণ ব্রিটিশ প্রশাসন বর্জন করে বিকল্প শাসন কাঠামো গড়ে তোলে।
বর্তমান বাংলাদেশের ভূমিকায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন
তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায়ও আন্দোলনের প্রভাব প্রবল ছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে কংগ্রেস, যুবলীগ ও ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে মিছিল-মিটিং হয়। ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনারা দমননীতি চালালেও আন্দোলন থামানো যায়নি।
ব্রিটিশ দমননীতি ও সহিংসতা
ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমনে গুলি, গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ ও দমনমূলক আইন প্রয়োগ করে। সরকারি হিসাবে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়, আর লাখেরও বেশি গ্রেপ্তার হয়। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়।
আন্দোলনের তাৎপর্য
- নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার দাবি – আলোচনার মাধ্যমে নয়, সরাসরি স্বাধীনতার ডাক
- জনতার অংশগ্রহণ – নেতৃত্ব ছাড়াই সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে আন্দোলন চলা
- অহিংসা ও সহিংসতার মিশ্রণ – গান্ধীবাদী অহিংস প্রতিবাদের পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্ত সহিংস প্রতিরোধ
- ব্রিটিশদের দুর্বলতা প্রকাশ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলায় ব্রিটিশদের পক্ষে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি
স্বাধীনতার পথে প্রভাব
ভারত ছাড়ো আন্দোলন সরাসরি ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার কারণ না হলেও, এটি ব্রিটিশ সরকারকে বুঝিয়ে দেয়—ভারতকে দমন করে চিরকাল শাসন করা সম্ভব নয়। যুদ্ধশেষে ব্রিটিশরা রাজনৈতিক সমাধানের পথে যেতে বাধ্য হয়।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা
- নেতৃত্ব গ্রেপ্তারের কারণে পরিকল্পিত আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়
- সহিংস কর্মকাণ্ডে কিছু জায়গায় সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়
- দেশীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উদ্ভব ঘটে
আজকের দিনে প্রাসঙ্গিকতা
৯ আগস্টের ডাক আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াই অপরিহার্য। শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যও একই ধরনের সাহসী পদক্ষেপ দরকার।
উপসংহার
৯ আগস্ট ১৯৪২ শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি দিন নয়—এটি ছিল এক জাতির অদম্য সাহস, আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার অমোঘ আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। মহাত্মা গান্ধীর “করো বা মরো” আহ্বান শুধু ব্রিটিশদের চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং গোটা উপমহাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছিল। আজকের প্রজন্মের কাছে এই দিনটি কেবল ইতিহাস নয়—এটি অনুপ্রেরণার চিরন্তন উৎস।