Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

গার্গী দেবী: বাংলার সাহসী কন্যা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত।

ভূমিকা:-  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারীর নাম রয়েছে, যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের মুক্তির জন্য। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছেন, আবার অনেকের নাম কিছুটা হলেও মানুষের মনে রয়ে গেছে। গার্গী দেবী সেইসব সাহসী নারীদের একজন, যিনি জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
তাঁর সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যই ছিল না, বরং নারীশিক্ষা, নারীর স্বাবলম্বন ও সামাজিক সমতার জন্যও তিনি কাজ করে গেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা গার্গী দেবীর জীবন ও কর্মযাত্রার বিস্তারিত আলোচনায় যাব।

শৈশব ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট

গার্গী দেবীর জন্ম ১৯১২ সালে অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে, এক শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে সমৃদ্ধ পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং মা ছিলেন গৃহবধূ, যিনি ধর্মীয় হলেও প্রগতিশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাস করতেন। ছোটবেলা থেকেই গার্গী দেবী সাহিত্য, সংগীত ও দেশপ্রেমমূলক আলোচনায় বড় হয়েছেন।
বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার বই ছিল সর্বদা। এগুলোর প্রভাবেই তাঁর মনে দেশপ্রেম ও মানবতার বীজ অঙ্কুরিত হয়।

শিক্ষাজীবন

গার্গী দেবী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন কৃষ্ণনগর গার্লস স্কুলে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। বেথুন কলেজ সে সময় নারীদের উচ্চশিক্ষার একমাত্র বড় কেন্দ্র ছিল এবং এখানেই তিনি রাজনৈতিক সচেতনতার প্রথম পাঠ পান।
কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ব্রিটিশবিরোধী বক্তৃতা, সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় সমসাময়িক নারী সংগ্রামী যেমন প্রীতি লতা ও বিনোদিনী দাসের সঙ্গে।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা

গার্গী দেবীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলনের মাধ্যমে। বেথুন কলেজের ছাত্রীরা তখন বিক্ষোভ মিছিল ও সভা সংগঠিত করেছিল, এবং গার্গী দেবী তার অন্যতম মুখ্য সংগঠক ছিলেন।
১৯৩০ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি গান্ধীবাদী কর্মসূচিতে অংশ নেন, পাশাপাশি গোপনে বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর ও বঙ্গীয় যুব সংঘ-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন।

বিপ্লবী কর্মকাণ্ড

গার্গী দেবী চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি নারীর পোশাকের আড়ালে বিপ্লবীদের কাছে গোপন বার্তা পৌঁছে দিতেন, অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন, এমনকি আহত বিপ্লবীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন।
১৯৩২ সালে কলকাতায় এক ব্রিটিশ পুলিশের গোপন নথি চুরি করার অভিযানে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এই নথি বিপ্লবীদের হাতে পৌঁছালে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।

গ্রেফতার ও কারাবাস

১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ না থাকলেও, তাঁকে ১৮ মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে গার্গী দেবী নারীবন্দীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন।
তিনি কারাগারে গান্ধীজীর “হিন্দ স্বরাজ” পড়াতেন, বিপ্লবীদের গান গাইতেন এবং কারা কর্তৃপক্ষের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এই সময় তিনি অনশনও করেন, যা ব্যাপক আলোড়ন তোলে।

স্বাধীনতার পর সমাজসেবা

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর গার্গী দেবী রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকে সামাজিক কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি নারীদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প চালু করেন। কলকাতার কালীঘাটে তিনি একটি মেয়েদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে অবহেলিত পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হত।
তিনি একাধিক নারী সংগঠনের সভাপতি ছিলেন এবং নারী অধিকার রক্ষায় আইনি লড়াই চালিয়েছেন।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ

গার্গী দেবী ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সৎ ও সাহসী। তিনি বিশ্বাস করতেন—

“স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকও হতে হবে।”

তিনি সর্বদা সরল জীবনযাপন করতেন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতেন।

সমসাময়িকদের স্মৃতিচারণ

বিপ্লবী অনন্ত সিং একবার বলেছিলেন—

“গার্গী শুধু একজন নারী সংগ্রামী ছিলেন না, তিনি ছিলেন পুরুষদের সাহস জোগানো এক অদম্য প্রেরণা।”

উত্তরাধিকার

গার্গী দেবীর নাম আজ মূলধারার ইতিহাসে খুব বেশি উচ্চারিত হয় না, কিন্তু তাঁর অবদান অমূল্য। তিনি প্রমাণ করেছেন যে নারীর সাহস, বুদ্ধি ও দৃঢ়তা জাতির মুক্তি সংগ্রামে অপরিহার্য।
তাঁর জীবনী আজকের তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারে—বিশেষ করে সেইসব মেয়েদের, যারা বড় স্বপ্ন দেখে এবং দেশের জন্য কিছু করতে চায়।

উপসংহার

গার্গী দেবীর জীবন কাহিনী কেবল স্বাধীনতার আন্দোলনের অংশ নয়, বরং নারীর মুক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর সংগ্রাম, ত্যাগ ও কর্মযজ্ঞ আমাদের শেখায় যে—সত্যিকারের দেশপ্রেম কেবল কথায় নয়, কাজে প্রকাশ পায়।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *