ভারতের আধুনিক ইতিহাসে কয়েকজন ব্যক্তি এমনভাবে আলোচিত হয়েছেন যেভাবে ফুলন দেবীর নামে পরিচয় পেয়েছিলেন—‘দস্যু রানী’। তিনি ছিলেন মানুষের নীচু বর্ণ থেকে উঠে আসা এক নারীবাদী প্রতীক। নিঃস্ব, নির্যাতিত এক কন্যা থেকে দস্যু-নেত্রী, কারাগারে বন্দী, সংসদ সদস্য, এবং শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যার শিকার—ফুলন দেবীর জীবন ছিল এক প্রেম, প্রতিশোধ, রাজনীতি ও সামাজিক পরিবর্তনের জটিল ছায়ালিপি।
1. প্রারম্ভিক জীবন ও পটভূমি
- ফুলন দেবী জন্মেছিলেন ১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের জালৌন জেলার ঘোড়া কা পুরওয়া গ্রামে, একটি ‘মাল্লা’ সম্প্রদায়ে—যা সমাজে ‘নিম্নবর্ণ’ হিসেবে গণ্য।
- তার গ্রাম ও পরিবারের অভাব-দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
2. নির্যাতন, স্বামীর অত্যাচার ও বাধ্যতামূলক বিবাহ
- মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়, এবং পরবর্তীতে তিনি শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
- শারীরে ও মানসিকভাবে ভোজ্য তিনি পরিবারের ভয় ও সামাজিক অবজ্ঞার ঝাঁঝ వరারে বন্দী হলেন।
3. নির্যাতন ও প্রতিশোধের পথ: ডাকাত দলের আত্মগঠন
- চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ডাকাত দলের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীতে দলনেতা বিক্রম মাল্লা হয়ে ওঠেন, যিনি তাকে সম্মান ও ক্ষমতা প্রদান করেন।
- ১৯৮১ সালে, বেহমাই গ্রামে গণধর্ষণ এবং তার পরবর্তী প্রতিশোধ ঘটায় নেতৃত্ব দেন—এতে ঠাকুর সম্প্রদায়ের ২২ জন পুরুষকে দাঁড়িয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
- এই ঘটনা ভারতের রাজনীতিতে উত্তালতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এবং প্রায় মুখ্যমন্ত্রী ওয়াল্টার পদত্যাগের কারণও হয়ে দাঁড়ায়।
4. আত্মসমর্পণ, কারাগার জীবন ও মুক্তি
- ১৯৮৩ সালে, নির্দিষ্ট শর্তসহ তিনি মধ্যপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করেন।
- তাঁকে কারাভোগ শেষে ১৯৯৪ সালে মুক্তি দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
5. রাজনিতিতে ফেরা এবং সংসদ সদস্য নির্বাচন
- মুক্তির পর তিনি সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে মির্জাপুর থেকে লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেন, সংসদ সদস্য হন।
- পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য হন।
- রাজনীতি ও কর্মী হিসেবে তিনি জনসাধারণের উন্নয়ন, নারী ও দলিত অধিকার নিয়ে কাজ করতে উদ্যত ছিলেন।
6. গণমাধ্যম ও আত্মজীবনী: বহুমাত্রিক বর্ণনা
- ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘Bandit Queen’ (ব্যাণ্ডিট কুইন) চলচ্চিত্র তাঁর জীবনকে রহস্যময়ভাবে তুলে ধরে, যা নিয়ে তিনি আপত্তি জানিয়ে আদালতে মামলা করেন, পরে £৪০,০০০ ক্ষতিপূরণ পান।
- তাঁর আত্মজীবনী ‘I, Phoolan Devi’ লেখেন ফরাসিতে, পরে ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়।
- এই গ্রন্থ ও ছবি তাঁকে দারিদ্র্য ও অবহেলিত নারীদের জন্য বিশেষ প্রতীকী করে তোলে।
7. হত্যাকাণ্ড এবং পরিণতি
- ২৫ জুলাই ২০০১, দিল্লির নিজের বাড়ির বাইরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং মৃত্যুবরণ করেন।
- হত্যাকারী ছিলেন শের সিং রানা, যিনি প্রতিশোধমূলকভাবে এই অপরাধ করে—বেহমাই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেই এই ঘটনা ঘটায়।
8. স্মৃতযজ্ঞ ও ধারা
- ফুলন দেবী হয়ে উঠেছেন দলিত, নিপীড়িত, নারী ও নিম্নবর্গীয় শ্রেণির মানুষদের এক প্রতীকী প্রতিভূ।
- তাঁর উপর লেখা বই, চলচ্চিত্র, অনলাইন প্রচার ও আলেপ আলোচনা তাঁকে ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য চরিত্রে পরিণত করেছে।
- কিছু রাজনীতিক তাঁর উপর ভাস্কর্য স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন—তার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা আজও সমানভাবে আলোচিত।
উপসংহার
ফুলন দেবীর জীবনের কাহিনি জাতিগত, লিঙ্গ ও শ্রেণি নির্ভর বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াই। নির্যাতনের পর প্রতিশোধের মাধ্যমে দুঃখের মানচিত্র রচনা করে, তিনি একটি প্রতিবাদের পুরুষোচিত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তার জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এক নারী কীভাবে অত্যাচার থেকে উঠে আসতে পারে—রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর হয়ে—তখনকার সমাজে অভ্যুত্থানের এক অনন্য নমুনা।
বিস্তারিত রেফারেন্স সমূহ:
- ফুলন দেবীর জীবন ও রাজনৈতিক কর্মজীবন: উইকিপিডিয়া
- বেহমাই হত্যাকাণ্ড ও প্রতিশোধের প্রতিচ্ছবি: বাংলা উইকিপিডিয়া ও গণমাধ্যম
- চলচ্চিত্র ‘Bandit Queen’ ও আত্মজীবনী: