Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

মাতঙ্গিনী হাজরা: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমর নারী যোদ্ধা

প্রস্তাবনা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অসংখ্য পুরুষ বিপ্লবীর নাম আমরা জানি, কিন্তু নারীদের অবদানও ততটাই অনন্য ও অনুপ্রেরণামূলক। মাতঙ্গিনী হাজরা সেইসব নারীদের একজন, যিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। তিনি শুধুমাত্র বীরাঙ্গনা নন, বরং তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে দেশপ্রেম বয়সের সীমা মানে না। ব্রিটিশ শাসকের গুলি বুকে নিয়েও তিনি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত “বন্দে মাতরম” ধ্বনি তুলেছিলেন।


শৈশব ও পারিবারিক জীবন

মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম ১৯ শতকের শেষভাগে, ১৯ শতকের ৬০-এর দশকে (আনুমানিক ১৮৬৯ সালে) তামলুক মহকুমার এক ছোট গ্রামে। গ্রামের সাধারণ এক কৃষক পরিবারে জন্মানো মাতঙ্গিনী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শান্ত, কিন্তু দৃঢ়চেতা। আর্থিক কষ্টের কারণে তিনি বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি, তাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর হয়নি। তবে গ্রামীণ পরিবেশ, লোকসংস্কৃতি এবং চারপাশের মানুষের জীবনযুদ্ধ তাঁকে জীবনের প্রথম পাঠ শিখিয়েছে— অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ও অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা।

মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় তমলুকেরই এক মধ্যবয়সী ব্যক্তির সঙ্গে। কিন্তু বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। স্বামী মারা যাওয়ার পর মাতঙ্গিনী তরুণ বয়সেই বিধবা হয়ে পড়েন। সমাজ তখন বিধবাদের জন্য কঠোর নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল, কিন্তু মাতঙ্গিনী সেই শৃঙ্খলকে নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ভাঙতে শুরু করেন।


স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের প্রেরণা

তৎকালীন তমলুক মহকুমা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উর্বর ক্ষেত্র। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন, স্বদেশী ভাবধারা ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছিল। মাতঙ্গিনী ক্রমশ এই আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি বুঝতে পারেন, ব্রিটিশ শাসনের শোষণ থেকে মুক্ত না হলে দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচবে না।

১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি প্রথমবার সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি মিছিল, সভা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে যোগ দেন। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল করার জন্য তাঁকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়।


কারাবরণ ও সংগ্রামী জীবন

মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনে কারাবাস ছিল একাধিকবারের ঘটনা। প্রথমবার গ্রেপ্তারের সময় তাঁর বয়স প্রায় ৬৩ বছর। তমলুক শহরে ব্রিটিশ বিরোধী মিছিলে যোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে আনা হয়। কিন্তু বয়স ও স্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে সতর্কবার্তা তাঁর মনোবল ভাঙাতে পারেনি। তিনি গান্ধীজির ‘সত্যাগ্রহ’ নীতিকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। খদ্দরের পোশাক পরা, চুল সাদা, মুখে শান্ত হাসি— এমন চেহারার এক বৃদ্ধা হলেও তাঁর অন্তরে ছিল অদম্য সাহস।


১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৪২ সালের “ভারত ছাড়ো আন্দোলন” (Quit India Movement) ছিল এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। মাতঙ্গিনী হাজরা তখন প্রায় ৭৩ বছরের বৃদ্ধা, কিন্তু তাঁর উদ্যম ও দেশপ্রেম তখনও অটুট।

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ সালে তমলুক মহকুমার কটালীপাড়ায় কংগ্রেসের আহ্বানে একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল— তমলুক থানা দখল করে জাতীয় সরকারের পতাকা ওড়ানো। মাতঙ্গিনী সেই মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে।


শেষ লড়াই ও শহিদি বরণ

ব্রিটিশ পুলিশ মিছিলে বাধা দেয় এবং ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি চালায়। কিন্তু মাতঙ্গিনী পিছু হটেননি। তিনি সামনে এগিয়ে গিয়ে পুলিশদের উদ্দেশে বলেছিলেন—
“আপনারা গুলি চালান, আমি এগোবই।”

গুলি তাঁর শরীর ভেদ করলেও তিনি পতাকা উঁচিয়ে “বন্দে মাতরম” ধ্বনি তুলতে থাকেন। একে একে তিনটি গুলি তাঁর শরীরে লাগে— একটি হাতে, একটি বুকে, একটি কপালে। তবুও পতাকা মাটিতে ফেলেননি। পতাকা হাতে নিয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


মৃত্যুর পর প্রতিক্রিয়া ও সম্মাননা

মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মবলিদান সমগ্র তমলুক তথা বাংলায় গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ মানুষের মনে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তমলুক জাতীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর আত্মত্যাগ বিশেষ প্রেরণা হয়ে ওঠে।

স্বাধীনতার পরে মাতঙ্গিনী হাজরাকে নানা ভাবে স্মরণ করা হয়—

  • কলকাতার রেড রোডে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, যা আজও শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে পরিচিত।
  • তমলুক ও তার আশপাশে বহু রাস্তা, বিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
  • পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতি বছর তাঁর শহিদ দিবস পালন করে।

ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ

মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনদর্শনের মূল ভিত্তি ছিল—

  1. ত্যাগ — ব্যক্তিগত কষ্ট ও সামাজিক অপমানকে উপেক্ষা করে দেশের জন্য আত্মদান।
  2. অহিংসা — গান্ধীজির নীতি অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন করা।
  3. অদম্য সাহস — বারবার পুলিশের গুলি ও গ্রেপ্তারি সত্ত্বেও পিছিয়ে না যাওয়া।

উত্তরাধিকার

আজকের প্রজন্মের কাছে মাতঙ্গিনী হাজরা কেবল ইতিহাসের একটি নাম নন, বরং সাহস ও দেশপ্রেমের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর জীবন শেখায়—

  • স্বাধীনতা কখনো বিনা মূল্যে আসে না।
  • বয়স বা শারীরিক সীমাবদ্ধতা দেশসেবার পথে বাধা নয়।
  • সত্য ও ন্যায়ের পথে চললে মৃত্যু পর্যন্তও ভয় পাওয়া উচিত নয়।

উপসংহার

মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অদম্য সৈনিক, যিনি বৃদ্ধ বয়সেও নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন মাতৃভূমির জন্য। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়— স্বাধীনতা রক্ষার জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আছে।

আজ আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি, কিন্তু এই স্বাধীনতার পিছনে থাকা শহিদদের কথা স্মরণ রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মাতঙ্গিনী হাজরার জীবন আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়— যে কোনো যুগে, যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই প্রকৃত দেশপ্রেম।

 

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *