Categories
গল্প

অন্ধকারে লুকানো সত্য (রহস্য গল্প)।

(একটি পূর্ণাঙ্গ রহস্য গল্প)

১. প্রথম সতর্কবার্তা

পার্থ মুখার্জি কলকাতার এক পুরোনো বাড়িতে একা থাকে। বাড়িটা তার ঠাকুরদার সময়ের, প্রায় একশো বছরের পুরোনো। সেদিন সকালে ডাকবাক্স খুলতেই সে দেখতে পেল একটি হলুদ খামের চিঠি। খামের উপর কাঁপা হাতের লেখা —
“আজ রাত বারোটার আগে বাড়ির ঘড়ি থামিয়ে দিও। না হলে বিপদ আসবে।”

চিঠি পড়ে পার্থর শরীরে কাঁটা দিল। কে লিখল এই চিঠি? কেন লিখল? সে জানে তার বাড়ির দোতলায় ঝোলানো ঘড়িটা অনেক বছর ধরে বন্ধ।

দিনভর তার মাথায় এই রহস্য ঘুরপাক খেতে লাগল। সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির ভিতর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। পার্থ বারবার সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ছে।

২. অদ্ভুত শব্দ

রাত বাড়তে থাকল। ঠিক ১১টা নাগাদ হঠাৎ দোতলার দিক থেকে টিক-টিক শব্দ শোনা গেল।
পার্থ থমকে দাঁড়াল।
— “অসম্ভব! ওই ঘড়ি তো নষ্ট…”

টর্চ হাতে নিয়ে দোতলায় উঠতেই তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করেছে।

ঘড়ির কাচের ভেতরে তার নিজের মুখ দেখল, কিন্তু মনে হল আরেকটি ছায়া দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। টর্চের আলো ফেলতেই ছায়া মিলিয়ে গেল।

৩. দেয়ালের পেছনের ঘর

ঠিক তখনই দেয়ালের পেছন থেকে ফাঁপা শব্দ এল। পার্থ টর্চ দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে দেয়ালের একটা অংশ ঠুকল। হঠাৎ একটা গোপন দরজা খুলে গেল। ভেতরে ছোট্ট একটা ঘর, ধুলো জমে আছে, কিন্তু সেখানে রাখা একটি টেবিলের উপর পুরোনো ডায়েরি আর কিছু দলিল।

ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা —
“আমি এই বাড়ির আগের মালিক অমরেশ মুখার্জি। আমাকে আমার আপন ভাই খুন করেছে এই বাড়ির সম্পত্তির জন্য। আমার দেহ এই ঘরের মেঝের তলায় লুকানো আছে। আমার আত্মা মুক্তি চাই।”

পার্থর গলা শুকিয়ে গেল। সে সাথে সাথে পুলিশের খবর দিল।

৪. তদন্ত শুরু

পরের দিন সকালেই ইন্সপেক্টর সুদীপ সরকার এলেন। অভিজ্ঞ অফিসার, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
— “আপনি বলছেন ঘড়ি নিজে থেকে চলতে শুরু করেছে?”
পার্থ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ স্যার, আর এই ডায়েরিটা পেয়েছি।”

দলিল আর ডায়েরি দেখে সুদীপ গম্ভীর হলেন।
— “আমরা ঘরের মেঝে খুঁড়ব। যদি হাড়গোড় পাওয়া যায় তবে এটা খুনের মামলা।”

মেঝে খুঁড়তেই সত্যিই একটি কঙ্কাল পাওয়া গেল। বাড়ি হইচই পড়ে গেল। খবর ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায়।

৫. অতিপ্রাকৃত ইঙ্গিত

সেই রাতে পার্থ আবার সেই ছায়া দেখল। এবার ছায়াটি তাকে হাতের ইশারায় অন্য ঘরের দিকে ডাকল। পার্থ ভয় পেলেও সাহস করে গেল। সেখানে একটি ছোট কাঠের বাক্স পেল। বাক্সের ভিতরে পুরোনো নথি আর একটি রুপোর চেইন।

পরদিন ইন্সপেক্টরকে বাক্সটি দেখানো হল। নথির মধ্যে ছিল বাড়ির পুরোনো দলিল, যেখানে দেখা গেল অমরেশ মুখার্জির মৃত্যুর পর সম্পত্তি বেআইনি ভাবে তার ভাই অর্জুন মুখার্জির নামে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সুদীপ বললেন,
— “এখন স্পষ্ট, অর্জুন খুন করেছে। কিন্তু সে তো বহু বছর আগে মারা গেছে। খুনের পেছনে আর কেউ ছিল কি?”

৬. নতুন সন্দেহভাজন

তদন্তে জানা গেল অর্জুনের নাতি রাজীব মুখার্জি সম্প্রতি বাড়ির দখল নিতে চেয়েছিল। পার্থর কাছে চিঠি লিখে বাড়ি ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিল।

পার্থ মনে পড়ল— সেই চিঠির হাতের লেখা! চিঠি আর রাজীবের পুরোনো স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখতেই বোঝা গেল দুটোই এক।

সুদীপ পুলিশ টিম নিয়ে রাজীবকে গ্রেপ্তার করল। রাজীব স্বীকার করল যে সে জানত তার দাদু অমরেশকে খুন করেছে। সে এই সত্যিটা চিরতরে গোপন রাখতে চেয়েছিল, তাই পার্থকে ভয় দেখাতে চিঠি লিখেছিল।

৭. চূড়ান্ত মুখোমুখি

রাজীবকে নিয়ে বাড়িতে পুনর্নির্মাণ চলছিল। ঠিক তখনই ঘড়ি আবার বাজতে শুরু করল। হঠাৎ জানলা বন্ধ হয়ে গেল, ঘর অন্ধকার। সবাই দেখল এক ফ্যাকাশে ছায়ামূর্তি রাজীবের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজীব চিৎকার করে উঠল,
— “আমার দোষ নেই! আমি খুন করিনি!”

ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটায় থেমে গেল। যেন আত্মা শান্তি পেল।

৮. ন্যায়বিচার

রাজীবকে আদালতে তোলা হল। ডায়েরি, দলিল আর পার্থর সাক্ষ্য মিলে মামলায় প্রমাণ হল অমরেশকে খুন করেছিল অর্জুন। আদালত পার্থর নামে বাড়ির সম্পত্তির অধিকার ফিরিয়ে দিল।

ইন্সপেক্টর সুদীপ পার্থকে বললেন,
— “আপনি কেবল বাড়ির মালিক নন, আপনি ইতিহাসের সাক্ষী। আপনি যদি সাহস না করতেন, অমরেশ মুখার্জির আত্মা আজও শান্তি পেত না।”

৯. সমাপ্তি

রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝলমল করছে। পার্থ দোতলায় দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ি থেমে আছে, কিন্তু বাড়ি আর অদ্ভুত নয়। যেন শান্তি ফিরে এসেছে।

পার্থ ভাবল,
— “এই বাড়ি শুধু আমার নয়। এখানে এক ইতিহাস আছে, এক রক্তাক্ত অতীত আছে। এখন আমি সেই অতীতের রক্ষক।”

সে টেবিলে ডায়েরিটা রাখল, যেন ভবিষ্যতের জন্য প্রমাণ হয়ে থাকে। বাইরে হাওয়ায় যেন একটুখানি ধন্যবাদসূচক ফিসফিসানি শুনল।

 

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *