Categories
প্রবন্ধ

বর্তমান যুব সম্প্রদায়ের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব।

ভূমিকা

একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া মানবজীবনের অন্যতম প্রধান অংশে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টিকটক, এক্স (টুইটার) এবং নানা রকম প্ল্যাটফর্ম এখন আর শুধু বিনোদনের জায়গা নয়, বরং আমাদের চিন্তা, যোগাযোগ, তথ্য গ্রহণ, এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শ গঠনের ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে যুব সমাজ, অর্থাৎ ১৫ থেকে ৩০ বছরের মানুষরা, সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় ব্যবহারকারী।

কিন্তু এই ব্যবহার কতটা সুফল দিচ্ছে, আর কতটা কুফল বয়ে আনছে? এই প্রশ্ন আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।


১. সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান ও যুব সমাজ

গত এক দশকে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকে তীব্রভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

  • ভারতে ২০২৫ সালের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান।
  • ভারতের মোট ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৬৫% এর বয়স ৩০-এর নিচে।

যুব সমাজ তথ্য, বিনোদন, শিক্ষা, সম্পর্ক, ক্যারিয়ার — সব কিছুই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগ্রহ করছে। ফলে তাদের জীবনযাপন, মূল্যবোধ ও মানসিকতা আগের প্রজন্মের তুলনায় ভিন্ন।


২. ইতিবাচক প্রভাব

২.১ যোগাযোগ ও সংযোগ

  • পরিবার, বন্ধু, সহপাঠী ও বিদেশে থাকা পরিচিতদের সাথে সহজ যোগাযোগ।
  • দূরত্ব ও সময়ের সীমাবদ্ধতা অনেকটাই কমে গেছে।

২.২ তথ্যপ্রাপ্তি ও শিক্ষা

  • ইউটিউব ও এডুকেশনাল ব্লগ/পেজ থেকে নানা রকম শিক্ষামূলক কন্টেন্ট পাওয়া যায়।
  • প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, অনলাইন কোর্স, নতুন দক্ষতা শেখা – সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সহজ হয়েছে।

২.৩ ক্যারিয়ার ও ব্যবসায়িক সুযোগ

  • অনেক যুবক/যুবতী সোশ্যাল মিডিয়াকে পেশা বানিয়েছে – যেমন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইনফ্লুয়েন্সার, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার।
  • ছোট ব্যবসা ও স্টার্টআপের জন্য ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম এখন গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম।

২.৪ সামাজিক সচেতনতা

  • যুব সমাজ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সোচ্চার।
  • জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, পরিবেশ রক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা – এসব বিষয়ে অনলাইন ক্যাম্পেইন শক্তিশালী আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।

৩. নেতিবাচক প্রভাব

৩.১ আসক্তি

  • প্রতিদিন গড়ে ৩-৪ ঘণ্টা সময় কাটে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
  • অতিরিক্ত ব্যবহার ডোপামিন আসক্তি তৈরি করে, যা মস্তিষ্ককে তাত্ক্ষণিক আনন্দের উপর নির্ভরশীল করে তোলে।

৩.২ মনোযোগে ব্যাঘাত

  • ক্রমাগত নোটিফিকেশন, স্ক্রল করার অভ্যাস মনোযোগ ভেঙে দেয়।
  • পড়াশোনা ও প্রোডাক্টিভিটির ক্ষতি হয়।

৩.৩ মানসিক স্বাস্থ্য

  • FOMO (Fear of Missing Out) – অন্যদের জীবনের ঝলমলে ছবি দেখে নিজেকে পিছিয়ে পড়া মনে হয়।
  • হতাশা, উদ্বেগ, একাকিত্ব বেড়ে যায়।
  • সাইবার বুলিং ও অনলাইন হ্যারাসমেন্টের শিকার হয় অনেক তরুণ।

৩.৪ ভুয়ো খবর ও বিভ্রান্তি

  • সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ভুয়ো খবর ছড়ায়।
  • যুব সমাজ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

৩.৫ বাস্তব সম্পর্কের ক্ষয়

  • মুখোমুখি কথোপকথন কমে যাচ্ছে।
  • পরিবারে সময় দেওয়া কমছে।

৪. যুব সমাজের আচরণে পরিবর্তন

সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে যুবকদের জীবনে নিম্নলিখিত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে —

  • ভাষা ও যোগাযোগ: ইমোজি, শর্টকাট, মিম – নতুন এক ভাষা তৈরি হয়েছে।
  • সেলফ ইমেজ: লাইক ও ফলোয়ার সংখ্যা আত্মসম্মানকে প্রভাবিত করছে।
  • তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টির অভ্যাস: দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বদলে দ্রুত ফলাফলের দিকে ঝোঁক বাড়ছে।

৫. মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মপরিচয়

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার —

  • ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটি বাড়ায়।
  • ঘুমের সমস্যা তৈরি করে।
  • আত্মপরিচয় সংকট (Identity Crisis) তৈরি করে — কারণ অনেকে ভার্চুয়াল দুনিয়ার আদর্শ জীবনকে বাস্তব মনে করে।

৬. সমাধান ও করণীয়

৬.১ ডিজিটাল ডিটক্স

  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার।
  • “নোটিফিকেশন অফ” করে রাখা।

৬.২ সচেতন ব্যবহার

  • কোন তথ্য শেয়ার বা বিশ্বাস করার আগে যাচাই করা।
  • ইতিবাচক ও শিক্ষামূলক কন্টেন্টে সময় ব্যয় করা।

৬.৩ বাস্তব সম্পর্কের গুরুত্ব

  • পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো।
  • অফলাইন হবি বা খেলাধুলায় অংশগ্রহণ।

৬.৪ নীতিনির্ধারক ও শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা

  • স্কুলে ডিজিটাল লিটারেসি শিক্ষা।
  • সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর উপর কঠোর নিয়ম, যাতে ভুয়ো খবর ও হেট স্পিচ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৭. ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ

সোশ্যাল মিডিয়া পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বরং এর সঠিক ব্যবহার শিখতে হবে।

  • ভবিষ্যতে AI ভিত্তিক কন্টেন্ট ফিল্টার ব্যবহার বাড়বে।
  • মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে আরও প্রচার হবে।
  • যুব সমাজ যদি সোশ্যাল মিডিয়াকে কেবল বিনোদনের জন্য নয়, শিক্ষার ও উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তবে এটি আশীর্বাদ হতে পারে।

উপসংহার

সোশ্যাল মিডিয়া আজকের যুব সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি একদিকে যেমন তথ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সংযোগ এনে দিচ্ছে, অন্যদিকে আসক্তি, মানসিক চাপ, বিভ্রান্তি ও একাকিত্বও বাড়াচ্ছে।

তাই প্রয়োজন সচেতনতা ও ভারসাম্য

  • যুব সমাজকে ডিজিটাল মিডিয়ার সুফল গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য ও বাস্তব সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
  • পরিবার, শিক্ষক ও সরকারকে একসাথে কাজ করতে হবে যাতে সোশ্যাল মিডিয়া এক শক্তিশালী উন্নয়নমূলক মাধ্যম হয়ে ওঠে, ধ্বংসাত্মক নয়।
Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *