Categories
প্রবন্ধ

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস শুধুমাত্র একজন কবি বা ঋষি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগস্রষ্টা।

ভূমিকা

ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে যে কয়েকজন মহামুনি তাঁদের অনন্য অবদানের জন্য যুগে যুগে শ্রদ্ধার আসনে বিরাজমান, তাঁদের মধ্যে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সর্বাগ্রে। তিনি শুধু এক মহাকাব্যকার নন, তিনি ছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার স্থপতি। তাঁর রচিত মহাভারত বিশ্বের দীর্ঘতম মহাকাব্য, যার মধ্যে মানবজীবনের প্রায় সমস্ত দিক – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ – এর শিক্ষা বিদ্যমান। তিনি বেদের বিভাজন করেছিলেন, পুরাণ রচনা করেছিলেন এবং হিন্দুধর্মকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তুলেছিলেন। তাই তাঁকে “ব্যাসদেব”, “বেদব্যাস” এবং “হিন্দু সংস্কৃতির মহাগুরু” বলা হয়।

জন্ম ও বাল্যজীবন

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়নের জন্ম ছিল অলৌকিক। তাঁর পিতা মহর্ষি পরাশর, যিনি একজন মহান ঋষি ও যোগী ছিলেন, গঙ্গার তীরে সত্যবতী নামে এক যুবতীর সঙ্গে মিলিত হন। সত্যবতী ছিলেন একজন মৎস্যজীবীর কন্যা, যিনি গঙ্গায় নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরাশর সত্যবতীর গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন যে তাঁর গর্ভে এক মহাজ্ঞানী ঋষির জন্ম হবে।

কথিত আছে যে, সত্যবতী তখন এক ছোট দ্বীপে ছিলেন এবং সেখানেই বেদব্যাসের জন্ম হয়। তাঁর জন্মের সময়ই তিনি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছিলেন, তাই তাঁর নাম হয় “কৃষ্ণ”। জন্মস্থান দ্বীপ হওয়ায় নাম হয় “দ্বৈপায়ন”। তিনি জন্মের পরেই বড় হয়ে গিয়ে মাকে আশীর্বাদ করে বনবাসে চলে যান। শাস্ত্র মতে তিনি জন্মগত মহাজ্ঞানী ছিলেন।

বেদের বিভাজন

বেদব্যাসের সবচেয়ে বড় অবদান হল বেদ বিভাজন। প্রাচীন যুগে একটিমাত্র “বেদ” ছিল, যা আকারে বিশাল এবং জটিল ছিল। সাধারণ মানুষ সেটি আয়ত্ত করতে পারছিল না। তাই বেদব্যাস এটিকে চারটি ভাগে ভাগ করেন –

1. ঋগ্বেদ – স্তোত্র ও দেবতাদের প্রশস্তি।

2. যজুর্বেদ – যজ্ঞের মন্ত্র ও আচারের বিধি।

3. সামবেদ – সুরেলা সঙ্গীত ও স্তোত্র।

4. অথর্ববেদ – চিকিৎসা, তন্ত্র, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার জ্ঞান।

 

এই চারভাগ করার ফলে বেদের জ্ঞান সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়। এই বিশাল কাজের জন্যই তিনি “বেদব্যাস” নামে পরিচিত হন।

মহাভারতের রচনা

মহাভারত বেদব্যাসের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এটি ১,০০,০০০ শ্লোকের এক মহাকাব্য। এতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, পাণ্ডব ও কৌরবদের কাহিনি, নীতিশিক্ষা, ধর্মসংকট, মানবজীবনের দার্শনিক ব্যাখ্যা সবই আছে।

ভাগবদ্গীতা – মহাভারতের অন্তর্গত একটি অংশ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধর্ম ও কর্মের জ্ঞান দেন। এই গীতা আজও ভারতীয় দর্শনের মূল ভিত্তি।

নীতিশিক্ষা – মহাভারত শুধুমাত্র যুদ্ধের কাহিনি নয়, এটি এক জীবন্ত ধর্মশাস্ত্র। এতে রাজনীতি, ন্যায়নীতি, সমাজনীতি, মানবধর্ম সবই শিক্ষা দেয়।

 

পুরাণ রচনা

বেদব্যাসকে ১৮টি মহাপুরাণের রচয়িতা বলা হয়। এগুলি হল –
বিষ্ণু পুরাণ, শিব পুরাণ, ভাগবত পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ ইত্যাদি। এই পুরাণগুলিতে দেবদেবীর কাহিনি, ধর্মনীতি, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান বর্ণিত আছে।

পরিবার ও বংশ

বেদব্যাস নিজে মহাভারতের চরিত্র। তাঁর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল নিয়োগ প্রথা। সত্যবতীর দুই পুত্র বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদ অকালমৃত্যুবরণ করলে, কুরু বংশ নির্বংশ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তখন সত্যবতীর অনুরোধে বেদব্যাস নিয়োগ প্রথা অনুযায়ী দুই রাণীকে গর্ভবতী করেন। এর ফলে জন্ম নেন –

ধৃতরাষ্ট্র – কৌরবদের পিতা।

পাণ্ডু – পাণ্ডবদের পিতা।

বিদুর – মহাভারতের এক নীতিবাগীশ চরিত্র।

 

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি

বেদব্যাসের দর্শন ছিল মানবজীবনের চারটি পুরুষার্থ – ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ – এর মধ্যে সুষমা স্থাপন করা। তিনি শিখিয়েছিলেন –

ধর্ম ছাড়া অর্থ ও কাম অর্থহীন।

সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকাই মুক্তির একমাত্র উপায়।

মানুষের কর্তব্য কর্ম করতে হবে, ফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে।

 

গুরুপূর্ণিমা ও বেদব্যাস পূজা

প্রতিবছর আষাঢ় পূর্ণিমার দিনে গুরুপূর্ণিমা পালিত হয়। এই দিনটি ব্যাস পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। সমস্ত শাস্ত্রাচার অনুযায়ী এই দিন গুরুকে সম্মান জানানোর দিন, কারণ বেদব্যাসকে সমগ্র মানবজাতির প্রথম গুরু হিসেবে ধরা হয়।

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

বেদব্যাস হিন্দু ধর্মের সংহতিসাধক। তাঁর কারণে ভারতীয় সংস্কৃতি এক সুসংহত আকার পেয়েছে। তাঁর রচনাই পরবর্তী যুগে দর্শন, সাহিত্য, সমাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা – সব কিছুর ভিত্তি হয়েছে।

উপসংহার

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস শুধুমাত্র একজন কবি বা ঋষি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগস্রষ্টা। তাঁর সৃষ্টি মহাভারত, তাঁর বেদের বিভাজন, তাঁর পুরাণ রচনা – সব মিলিয়ে তিনি ভারতীয় চেতনার শাশ্বত প্রতীক। আজও যখন ভারতীয় সমাজ ধর্ম, নীতি, আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিন্তা করে, তখন বেদব্যাসের নির্দেশনা ও শিক্ষা আলো দেখায়। তাই তাঁকে “অষ্টচিরঞ্জীবী”দের একজন হিসেবে মান্য করা হয় – যিনি যুগে যুগে বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *