Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

মহালয়া মানেই আবেগ, স্মৃতি ও বাঙালির চিরন্তন উৎসবের ডাক।

ভূমিকা:-  ভোর রাত পেরিয়ে অন্ধকার যখন ফিকে হতে থাকে, আকাশে তখনও একফোঁটা চাঁদের আলো। ঠিক তখনই বাজতে শুরু করে সেই চেনা কণ্ঠস্বর—
“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা…”

এ এক এমন মুহূর্ত যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙালির হৃদয়ে আবেগের জোয়ার বইয়ে দেয়। এ হলো মহালয়ার সকাল, এ হলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী। বাঙালি জীবনে মহালয়া মানে শুধু পিতৃপক্ষের অবসান নয়, এটি দুর্গাপুজোর সূচনা এবং এক অনন্য সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার নাম। আর এই অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দু হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

মহালয়া: এক ঐতিহ্যের নাম

হিন্দু শাস্ত্রমতে, মহালয়া হল ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা থেকে শুরু হওয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন। এই দিনে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করলে তাঁদের আত্মা শান্তি পায় বলে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু বাংলার মানুষের কাছে মহালয়ার আরও এক তাৎপর্য রয়েছে — দেবীপক্ষের সূচনা। এই দিন থেকেই শুরু হয় দুর্গাপুজোর কাউন্টডাউন।

মহিষাসুরমর্দিনীর জন্মকথা

১৯৩১ সালে আকাশবাণী কলকাতা প্রথম সম্প্রচার করে মহিষাসুরমর্দিনী নামের এক অনন্য সঙ্গীতনাট্য। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন বাণী কুমার (বাণীশরণ চট্টোপাধ্যায়) এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।
এটি মূলত চণ্ডীপাঠ, শাস্ত্রোক্ত স্তোত্র, গান ও সংগীতের মিশ্রণে তৈরি একটি আধুনিক শ্রবণনাট্য, যা ভোরবেলা আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারিত হয়।

প্রথম দিন থেকেই এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং বাঙালির দুর্গোৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র: কণ্ঠযাদুকরের আবির্ভাব

মহিষাসুরমর্দিনীর প্রাণ হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

জন্ম: ১৯০৫ সালে কলকাতায়।

শিক্ষা: সংস্কৃত ভাষা ও শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন।

আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি মহিষাসুরমর্দিনীর আবৃত্তিকার হিসেবে নির্বাচিত হন।

তাঁর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠের যে গভীরতা ও ভক্তিভাব প্রতিফলিত হয়েছে, তা আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর উচ্চারণে ছিল প্রাঞ্জলতা, ছন্দে ছিল অনন্য গাম্ভীর্য, আর স্বরে ছিল এমন এক শক্তি যা শুনলেই শ্রোতা দেবীর রূপ কল্পনা করতে পারেন।

“যা দেবী সর্বভূতেষু”: এক চিরন্তন ধ্বনি

মহিষাসুরমর্দিনীর প্রথম শব্দ থেকেই যে ভক্তিময় পরিবেশ তৈরি হয়, তা অনন্য।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আবৃত্তি শুরু হয়—
“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা…”

এই মন্ত্রোচ্চারণ যেন পুরো মহালয়ার আবহকে ভরিয়ে তোলে এক আধ্যাত্মিক শক্তিতে। সেই সঙ্গে গান—

“শুনো শুনো শুনো শোভন…”

“জাগো দুর্গা…”

“বাজলো তোমার আলোর বেণু…”

সব মিলিয়ে ভোরবেলার কলকাতার আকাশে এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয়।

বাঙালির আবেগ ও স্মৃতি

মহালয়া শুনতে মানুষ ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠে, রেডিও বা এখন টিভি/মোবাইলে অনুষ্ঠান শোনে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী বাঙালির কাছে এক স্মৃতি, আবেগ ও নস্টালজিয়ার উৎস।

বহু মানুষ বলেন, মহিষাসুরমর্দিনী শুনলেই দুর্গাপুজোর গন্ধ পাওয়া যায়।

পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে শোনেন, ছোটদের বোঝানো হয় দেবীর আগমনের কাহিনি।

এমনকি বিদেশে থাকা বাঙালিরাও অনলাইনে মহালয়ার দিন এই অনুষ্ঠান শোনেন।

 

বিরাট বিতর্ক: কণ্ঠ বদলের চেষ্টা

১৯৭৬ সালে আকাশবাণী প্রথমবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ বাদ দিয়ে নতুন সংস্করণ সম্প্রচার করেছিল, যেখানে আবৃত্তি করেছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু শ্রোতারা এই পরিবর্তন মেনে নেননি। প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে পরের বছরই আকাশবাণী আবার পুরনো সংস্করণ ফিরিয়ে আনে।
এটি প্রমাণ করে যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ শুধু আবৃত্তি নয়, এটি বাঙালির আবেগের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

মহালয়া আজকের দিনে

আজ মহালয়া শুধু রেডিওতে সীমাবদ্ধ নয়, টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান, লাইভ শো, এবং অনলাইনে স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে মানুষ মহিষাসুরমর্দিনী শোনেন। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের রেকর্ডিং এখনও সবচেয়ে বেশি শোনা হয়।

এটি প্রমাণ করে—

প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু আবেগ একই রয়ে গেছে।

প্রজন্ম পাল্টেছে, কিন্তু মহালয়ার সকাল এখনও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ ছাড়া অসম্পূর্ণ।

 

উপসংহার

মহালয়া ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র একে অপরের সমার্থক। মহালয়ার আসল আবহ তৈরি হয় তাঁর কণ্ঠেই। তিনি শুধু একটি অনুষ্ঠানকে জনপ্রিয় করেননি, বাঙালির আবেগকে এক অমর রূপ দিয়েছেন। যতদিন বাঙালি থাকবে, দুর্গাপুজো থাকবে, ততদিন মহালয়ার সকাল শুরু হবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী দিয়ে।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *