Categories
প্রবন্ধ

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল – শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন, বরং স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক একতা প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি।

ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কিছু নাম চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, ভগৎ সিং – এই নামগুলোর সঙ্গে যিনি সমান মর্যাদা পান তিনি হলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাঁকে বলা হয় ভারতের লোহপুরুষ (Iron Man of India)। কারণ তিনি শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন, বরং স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক একতা প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্ব, প্রশাসনিক দক্ষতা ও আপসহীন চরিত্রের কারণে আজকের ভারতের মানচিত্র গঠিত হয়েছে।


শৈশব ও শিক্ষাজীবন

বল্লভভাই প্যাটেলের জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৮৭৫ সালে গুজরাটের নাডিয়াদ গ্রামে। তাঁর পিতা ঝাভেরভাই একজন কৃষক ছিলেন এবং মাতা লাদবাই ছিলেন এক দৃঢ়চেতা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই বল্লভভাই ছিলেন মেধাবী, সাহসী এবং পরিশ্রমী।

শৈশবে তিনি প্রথাগত শিক্ষা নেন গুজরাটের স্থানীয় বিদ্যালয়ে। আর্থিক অভাব থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের প্রচেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। ২২ বছর বয়সে তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন – যা তখনকার সময়ে গ্রামাঞ্চলের জন্য বিরল ঘটনা।

পরে তিনি আইনজীবী হওয়ার জন্য লন্ডনে যান। লন্ডনের মিডল টেম্পল ইন থেকে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করেন। দেশে ফিরে তিনি সফল আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন এবং গুজরাটে তাঁর নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে।


পরিবার ও ব্যক্তিজীবন

বল্লভভাই প্যাটেলের বিয়ে হয়েছিল ঝাভেরবাবি প্যাটেলের সঙ্গে। তাঁদের দুটি সন্তান ছিল – কন্যা মনিবেন এবং পুত্র দাহ্যাভাই। কিন্তু স্ত্রী অল্প বয়সেই মারা যান। এরপর প্যাটেল সন্তানদের একা মানুষ করেন। তাঁর কন্যা মনিবেন পিতার ছায়াসঙ্গিনী হয়ে সারা জীবন ছিলেন এবং প্যাটেলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে থেকেছেন।


রাজনীতিতে প্রবেশ

বল্লভভাই প্রথমে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি একজন সফল আইনজীবী হিসেবে স্বচ্ছল জীবন যাপন করছিলেন। কিন্তু ১৯১৭ সালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং সেখান থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু। গান্ধীর আদর্শ – অহিংসা ও সত্যাগ্রহ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

তিনি গুজরাটে খেলাফত আন্দোলন, অহমেদাবাদের মিল শ্রমিকদের ধর্মঘট ও পরে বারদোলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮) নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনের জন্যই তাঁকে “সর্দার” উপাধি দেওয়া হয়। বারদোলি সত্যাগ্রহ ছিল কৃষকদের উপর অন্যায় কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক অহিংস সংগ্রাম।


স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান

সর্দার প্যাটেল কংগ্রেস দলের এক অনন্য সংগঠক ছিলেন। তিনি

  • নাগরিক অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০–২২)
  • দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলন ও দান্ডি অভিযান (১৯৩০)
  • ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)
    – প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি বহুবার ব্রিটিশ সরকারের হাতে কারাবন্দি হন। কিন্তু তাঁর মনোবল কখনও ভাঙেনি। তিনি গুজরাট ও পশ্চিম ভারতের জনগণকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলেন এবং গান্ধীর অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে ওঠেন।


অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রধানমন্ত্রী পদ বিতর্ক

১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করলে সর্দার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র ও তথ্য সম্প্রচার দপ্তরের দায়িত্ব পান। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৫টি প্রাদেশিক কমিটি তাঁকে মনোনীত করলেও মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছায় তিনি নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন এবং নেহেরুকে সুযোগ দেন।

ইতিহাসবিদরা বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্যাটেলের পক্ষে থাকলেও তিনি দলের ঐক্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন। যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হতেন তবে ভারতের প্রশাসনিক কাঠামো হয়তো আরও দৃঢ় হাতে পরিচালিত হতো।


স্বাধীন ভারতের লোহপুরুষ

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তিনি ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো ভারতের ভূখণ্ডগত ঐক্য রক্ষা।

তখন ব্রিটিশ ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল – ভারত ও পাকিস্তান। ব্রিটিশ শাসনের বাইরে ছিল ৫৬২টি দেশীয় রাজ্য। সর্দার প্যাটেল দক্ষতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে এসব রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করেন।

  • হায়দরাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীর – এই তিনটি রাজ্যের একীকরণ ছিল সবচেয়ে জটিল।
  • হায়দরাবাদে “অপারেশন পোলো” চালিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে একীভূত করা হয়।
  • জুনাগড় পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে প্যাটেল গণভোটের মাধ্যমে সেটিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করেন।

তাঁর এই অবদানের কারণেই তাঁকে বলা হয় “ভারতের একীকরণের স্থপতি”


অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অবদান

প্যাটেল কেবল রাজ্য একীকরণেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবা (IAS) ও ভারতীয় পুলিশ পরিষেবা (IPS) বজায় রাখেন এবং নবগঠিত রাষ্ট্রের জন্য একটি দৃঢ় আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলেন।

তাঁর বিশ্বাস ছিল – শক্তিশালী কেন্দ্র ছাড়া দেশ টিকে থাকতে পারবে না। তাই তিনি সংবিধানে কেন্দ্রকে শক্তিশালী করার পক্ষে ছিলেন।


ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ধরণ

সর্দার প্যাটেল ছিলেন দৃঢ়চেতা, বাস্তববাদী ও স্পষ্টভাষী নেতা। তিনি ত্যাগ ও শৃঙ্খলাকে জীবনের মূলমন্ত্র মনে করতেন। তাঁর সাহসী মনোভাবের জন্য তাঁকে “লোহপুরুষ” বলা হয়।

তিনি নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। গান্ধীজির মৃত্যুর পর তিনি কয়েক মাস মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, কারণ গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পথপ্রদর্শক ছিলেন।


শেষ দিনগুলি

১৯৫০ সালের শেষ দিকে তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে মুম্বাইয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুরো দেশ শোকাহত হয়।

ভারত সরকার তাঁকে মরণোত্তর ভারতরত্ন (১৯৯১ সালে) প্রদান করে।


উত্তরাধিকার ও স্মৃতিচিহ্ন

সর্দার প্যাটেলের অবদানের স্মরণে গুজরাটের নর্মদা জেলায় ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করেন “স্ট্যাচু অফ ইউনিটি” – বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মূর্তি (উচ্চতা ১৮২ মিটার)। এটি তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকার প্রতীক।


উপসংহার

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন প্রশাসক, সংগঠক, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাষ্ট্রনায়ক – সব মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ দেশনায়ক।

তাঁর জীবনের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক:

  • জাতীয় ঐক্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া
  • প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও দৃঢ় নেতৃত্ব
  • ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখা

সত্যিই, তিনি ভারতের “লোহপুরুষ” – যার দৃঢ়তা ছাড়া আজকের ভারতের মানচিত্র এ রকম হতো না।

 

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *