Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

মহালয়া আসলে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা।

ভূমিকা

বাংলার দুর্গোৎসবের সূচনা হয় মহালয়ার মাধ্যমে। এই দিনটিকে বাঙালি সমাজে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। মহালয়া মানেই এক অদ্ভুত আবেগ, এক আশার প্রতীক্ষা। রেডিও বা টেলিভিশনে ভোরবেলা মহিষাসুরমর্দিনী শোনা, গঙ্গার ঘাটে পিতৃতর্পণ, ঘরে ঘরে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি — সব মিলিয়ে মহালয়া এক অনন্য দিন। মহালয়া আসলে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা। অর্থাৎ এই দিন থেকেই দেবী দুর্গার আগমনের পথ প্রশস্ত হয়।


মহালয়ার আক্ষরিক অর্থ

“মহালয়া” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে — “মহা” অর্থাৎ মহান, এবং “আলয়” অর্থাৎ আবাস। এই দিনে পূর্বপুরুষদের আত্মা মহালয়ে বা পিতৃলোকে আবাস নেন বলে বিশ্বাস করা হয়। আবার এটি এমন এক দিন, যখন আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।


পিতৃপক্ষ ও তার তাৎপর্য

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা থেকে শুরু হয় পিতৃপক্ষ, যা চলে আশ্বিন মাসের অমাবস্যা পর্যন্ত। এই সময়কালে পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীতে আসে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দিনগুলিতে মানুষ শ্রাদ্ধ, পিণ্ডদান, তর্পণ ইত্যাদি করে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।

মহালয়া হল পিতৃপক্ষের শেষ দিন। এই দিন তর্পণ করলে পূর্বপুরুষরা সন্তুষ্ট হন এবং আশীর্বাদ দেন বলে বিশ্বাস রয়েছে।


দেবীপক্ষের সূচনা

মহালয়ার আরেকটি দিক হলো দেবীপক্ষের সূচনা। শাস্ত্রমতে, এই দিন থেকেই দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধযাত্রা শুরু হয়। দেবলোক থেকে তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে মর্ত্যে আগমন করেন। মহালয়ার পর থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে দেবীর পৃথিবীতে আগমনের কাহিনি কল্পনায় বাঙালি হৃদয়ে প্রতিফলিত হয়।


মহালয়া ও মহিষাসুরমর্দিনী

মহালয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে মহিষাসুরমর্দিনী নামের একটি রেডিও প্রোগ্রাম। ১৯৩১ সালে প্রথম আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হয় এই অনুষ্ঠান। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন বাণী কুমার (বাণীশরণ চট্টোপাধ্যায়) এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।

সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর। তাঁর আবৃত্তি — “যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা…” — আজও কোটি বাঙালির কানে প্রতিধ্বনিত হয়। এই আবৃত্তি, গান এবং সংগীতের সমন্বয়ে মহালয়া এক অনন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে পরিচিত।


পিতৃতর্পণ ও আচার-পদ্ধতি

মহালয়ার ভোরে বহু মানুষ গঙ্গার ঘাটে যান পিতৃতর্পণের জন্য।
আচারগুলো সাধারণত এইভাবে পালিত হয়:

  1. ভোরবেলা স্নান করে পবিত্র হওয়া।
  2. গঙ্গা বা পবিত্র জলের তীরে দাঁড়িয়ে পিণ্ডদান ও জলতর্পণ করা।
  3. পিতৃদের নাম স্মরণ করে মন্ত্রোচ্চারণ।
  4. দরিদ্র ব্রাহ্মণদের খাদ্যদান ও দক্ষিণা প্রদান।

এই সমস্ত আচার মূলত আত্মার শান্তি ও পারিবারিক সুখশান্তির জন্য করা হয়।


মহালয়ার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

মহালয়া শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ।

  • শিল্প ও সংগীত: মহিষাসুরমর্দিনীর সুর, সংগীত, আবৃত্তি আজও মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ আবেগ জাগিয়ে তোলে।
  • পুজোর প্রস্তুতি: মহালয়ার পর থেকেই শুরু হয় প্রতিমা গড়ার শেষ ধাপ — চোখ আঁকা বা চক্ষুদান। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি।
  • সামাজিক দিক: মহালয়া এমন এক সময় যখন পরিবার একত্রিত হয়, পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে, এবং নতুন প্রজন্মকে সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

মহালয়ার বৈজ্ঞানিক দিক

অনেক পণ্ডিত মহালয়ার সময়কে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করেন। আশ্বিন মাসে ঋতুচক্রে পরিবর্তন আসে, বর্ষা বিদায় নেয় এবং শরতের নির্মল আকাশে শিউলি ফুটতে শুরু করে। প্রকৃতি যেন নিজেই দুর্গাপুজোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। এই সময় কৃষিকাজেরও এক নতুন সূচনা হয়।


মহালয়া: আধুনিক প্রেক্ষাপটে

আজকের দিনে মহালয়ার গুরুত্ব কিছুটা পাল্টেছে। আকাশবাণীর বদলে এখন টেলিভিশনে মহালয়ার স্পেশাল শো হয়, যেখানে নাচ, গান, অভিনয়ের মাধ্যমে দেবীর আগমনের কাহিনি দেখানো হয়। তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের মহিষাসুরমর্দিনীর আবেদন আজও অপরিবর্তিত। বহু মানুষ আজও ভোরে উঠেই রেডিও বা মোবাইল অ্যাপে সেই অনুষ্ঠান শোনেন।


সমাজ ও প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয়

মহালয়া আমাদের শেখায় —

  • পূর্বপুরুষদের সম্মান করতে হবে।
  • পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে।
  • ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে সমাজে ঐক্য, আনন্দ এবং সাংস্কৃতিক চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে।

উপসংহার

মহালয়া শুধুমাত্র একটি দিন নয়, এটি এক আবেগ, এক সাংস্কৃতিক বন্ধন, এক আধ্যাত্মিক যাত্রা। এই দিন থেকে শুরু হয় বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব — দুর্গাপুজোর কাউন্টডাউন। মহালয়ার সকাল যেন আকাশে বাজিয়ে দেয় নতুন আশার সুর, যেখানে ভক্তির সঙ্গে মিশে থাকে নস্টালজিয়া, পারিবারিক মিলন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আবহ।

 

Share This
Categories
প্রবন্ধ

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল – শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন, বরং স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক একতা প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি।

ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কিছু নাম চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, ভগৎ সিং – এই নামগুলোর সঙ্গে যিনি সমান মর্যাদা পান তিনি হলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাঁকে বলা হয় ভারতের লোহপুরুষ (Iron Man of India)। কারণ তিনি শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন, বরং স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক একতা প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্ব, প্রশাসনিক দক্ষতা ও আপসহীন চরিত্রের কারণে আজকের ভারতের মানচিত্র গঠিত হয়েছে।


শৈশব ও শিক্ষাজীবন

বল্লভভাই প্যাটেলের জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৮৭৫ সালে গুজরাটের নাডিয়াদ গ্রামে। তাঁর পিতা ঝাভেরভাই একজন কৃষক ছিলেন এবং মাতা লাদবাই ছিলেন এক দৃঢ়চেতা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই বল্লভভাই ছিলেন মেধাবী, সাহসী এবং পরিশ্রমী।

শৈশবে তিনি প্রথাগত শিক্ষা নেন গুজরাটের স্থানীয় বিদ্যালয়ে। আর্থিক অভাব থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের প্রচেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। ২২ বছর বয়সে তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন – যা তখনকার সময়ে গ্রামাঞ্চলের জন্য বিরল ঘটনা।

পরে তিনি আইনজীবী হওয়ার জন্য লন্ডনে যান। লন্ডনের মিডল টেম্পল ইন থেকে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করেন। দেশে ফিরে তিনি সফল আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন এবং গুজরাটে তাঁর নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে।


পরিবার ও ব্যক্তিজীবন

বল্লভভাই প্যাটেলের বিয়ে হয়েছিল ঝাভেরবাবি প্যাটেলের সঙ্গে। তাঁদের দুটি সন্তান ছিল – কন্যা মনিবেন এবং পুত্র দাহ্যাভাই। কিন্তু স্ত্রী অল্প বয়সেই মারা যান। এরপর প্যাটেল সন্তানদের একা মানুষ করেন। তাঁর কন্যা মনিবেন পিতার ছায়াসঙ্গিনী হয়ে সারা জীবন ছিলেন এবং প্যাটেলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে থেকেছেন।


রাজনীতিতে প্রবেশ

বল্লভভাই প্রথমে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি একজন সফল আইনজীবী হিসেবে স্বচ্ছল জীবন যাপন করছিলেন। কিন্তু ১৯১৭ সালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং সেখান থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু। গান্ধীর আদর্শ – অহিংসা ও সত্যাগ্রহ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

তিনি গুজরাটে খেলাফত আন্দোলন, অহমেদাবাদের মিল শ্রমিকদের ধর্মঘট ও পরে বারদোলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮) নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনের জন্যই তাঁকে “সর্দার” উপাধি দেওয়া হয়। বারদোলি সত্যাগ্রহ ছিল কৃষকদের উপর অন্যায় কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক অহিংস সংগ্রাম।


স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান

সর্দার প্যাটেল কংগ্রেস দলের এক অনন্য সংগঠক ছিলেন। তিনি

  • নাগরিক অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০–২২)
  • দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলন ও দান্ডি অভিযান (১৯৩০)
  • ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)
    – প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি বহুবার ব্রিটিশ সরকারের হাতে কারাবন্দি হন। কিন্তু তাঁর মনোবল কখনও ভাঙেনি। তিনি গুজরাট ও পশ্চিম ভারতের জনগণকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলেন এবং গান্ধীর অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে ওঠেন।


অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রধানমন্ত্রী পদ বিতর্ক

১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করলে সর্দার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র ও তথ্য সম্প্রচার দপ্তরের দায়িত্ব পান। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৫টি প্রাদেশিক কমিটি তাঁকে মনোনীত করলেও মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছায় তিনি নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন এবং নেহেরুকে সুযোগ দেন।

ইতিহাসবিদরা বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্যাটেলের পক্ষে থাকলেও তিনি দলের ঐক্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন। যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হতেন তবে ভারতের প্রশাসনিক কাঠামো হয়তো আরও দৃঢ় হাতে পরিচালিত হতো।


স্বাধীন ভারতের লোহপুরুষ

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তিনি ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো ভারতের ভূখণ্ডগত ঐক্য রক্ষা।

তখন ব্রিটিশ ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল – ভারত ও পাকিস্তান। ব্রিটিশ শাসনের বাইরে ছিল ৫৬২টি দেশীয় রাজ্য। সর্দার প্যাটেল দক্ষতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে এসব রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করেন।

  • হায়দরাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীর – এই তিনটি রাজ্যের একীকরণ ছিল সবচেয়ে জটিল।
  • হায়দরাবাদে “অপারেশন পোলো” চালিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে একীভূত করা হয়।
  • জুনাগড় পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে প্যাটেল গণভোটের মাধ্যমে সেটিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করেন।

তাঁর এই অবদানের কারণেই তাঁকে বলা হয় “ভারতের একীকরণের স্থপতি”


অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অবদান

প্যাটেল কেবল রাজ্য একীকরণেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবা (IAS) ও ভারতীয় পুলিশ পরিষেবা (IPS) বজায় রাখেন এবং নবগঠিত রাষ্ট্রের জন্য একটি দৃঢ় আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলেন।

তাঁর বিশ্বাস ছিল – শক্তিশালী কেন্দ্র ছাড়া দেশ টিকে থাকতে পারবে না। তাই তিনি সংবিধানে কেন্দ্রকে শক্তিশালী করার পক্ষে ছিলেন।


ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ধরণ

সর্দার প্যাটেল ছিলেন দৃঢ়চেতা, বাস্তববাদী ও স্পষ্টভাষী নেতা। তিনি ত্যাগ ও শৃঙ্খলাকে জীবনের মূলমন্ত্র মনে করতেন। তাঁর সাহসী মনোভাবের জন্য তাঁকে “লোহপুরুষ” বলা হয়।

তিনি নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। গান্ধীজির মৃত্যুর পর তিনি কয়েক মাস মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, কারণ গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পথপ্রদর্শক ছিলেন।


শেষ দিনগুলি

১৯৫০ সালের শেষ দিকে তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে মুম্বাইয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুরো দেশ শোকাহত হয়।

ভারত সরকার তাঁকে মরণোত্তর ভারতরত্ন (১৯৯১ সালে) প্রদান করে।


উত্তরাধিকার ও স্মৃতিচিহ্ন

সর্দার প্যাটেলের অবদানের স্মরণে গুজরাটের নর্মদা জেলায় ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করেন “স্ট্যাচু অফ ইউনিটি” – বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মূর্তি (উচ্চতা ১৮২ মিটার)। এটি তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকার প্রতীক।


উপসংহার

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন প্রশাসক, সংগঠক, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাষ্ট্রনায়ক – সব মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ দেশনায়ক।

তাঁর জীবনের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক:

  • জাতীয় ঐক্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া
  • প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও দৃঢ় নেতৃত্ব
  • ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখা

সত্যিই, তিনি ভারতের “লোহপুরুষ” – যার দৃঢ়তা ছাড়া আজকের ভারতের মানচিত্র এ রকম হতো না।

 

Share This
Categories
প্রবন্ধ

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস শুধুমাত্র একজন কবি বা ঋষি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগস্রষ্টা।

ভূমিকা

ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে যে কয়েকজন মহামুনি তাঁদের অনন্য অবদানের জন্য যুগে যুগে শ্রদ্ধার আসনে বিরাজমান, তাঁদের মধ্যে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সর্বাগ্রে। তিনি শুধু এক মহাকাব্যকার নন, তিনি ছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার স্থপতি। তাঁর রচিত মহাভারত বিশ্বের দীর্ঘতম মহাকাব্য, যার মধ্যে মানবজীবনের প্রায় সমস্ত দিক – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ – এর শিক্ষা বিদ্যমান। তিনি বেদের বিভাজন করেছিলেন, পুরাণ রচনা করেছিলেন এবং হিন্দুধর্মকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তুলেছিলেন। তাই তাঁকে “ব্যাসদেব”, “বেদব্যাস” এবং “হিন্দু সংস্কৃতির মহাগুরু” বলা হয়।

জন্ম ও বাল্যজীবন

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়নের জন্ম ছিল অলৌকিক। তাঁর পিতা মহর্ষি পরাশর, যিনি একজন মহান ঋষি ও যোগী ছিলেন, গঙ্গার তীরে সত্যবতী নামে এক যুবতীর সঙ্গে মিলিত হন। সত্যবতী ছিলেন একজন মৎস্যজীবীর কন্যা, যিনি গঙ্গায় নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরাশর সত্যবতীর গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন যে তাঁর গর্ভে এক মহাজ্ঞানী ঋষির জন্ম হবে।

কথিত আছে যে, সত্যবতী তখন এক ছোট দ্বীপে ছিলেন এবং সেখানেই বেদব্যাসের জন্ম হয়। তাঁর জন্মের সময়ই তিনি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছিলেন, তাই তাঁর নাম হয় “কৃষ্ণ”। জন্মস্থান দ্বীপ হওয়ায় নাম হয় “দ্বৈপায়ন”। তিনি জন্মের পরেই বড় হয়ে গিয়ে মাকে আশীর্বাদ করে বনবাসে চলে যান। শাস্ত্র মতে তিনি জন্মগত মহাজ্ঞানী ছিলেন।

বেদের বিভাজন

বেদব্যাসের সবচেয়ে বড় অবদান হল বেদ বিভাজন। প্রাচীন যুগে একটিমাত্র “বেদ” ছিল, যা আকারে বিশাল এবং জটিল ছিল। সাধারণ মানুষ সেটি আয়ত্ত করতে পারছিল না। তাই বেদব্যাস এটিকে চারটি ভাগে ভাগ করেন –

1. ঋগ্বেদ – স্তোত্র ও দেবতাদের প্রশস্তি।

2. যজুর্বেদ – যজ্ঞের মন্ত্র ও আচারের বিধি।

3. সামবেদ – সুরেলা সঙ্গীত ও স্তোত্র।

4. অথর্ববেদ – চিকিৎসা, তন্ত্র, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার জ্ঞান।

 

এই চারভাগ করার ফলে বেদের জ্ঞান সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়। এই বিশাল কাজের জন্যই তিনি “বেদব্যাস” নামে পরিচিত হন।

মহাভারতের রচনা

মহাভারত বেদব্যাসের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এটি ১,০০,০০০ শ্লোকের এক মহাকাব্য। এতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, পাণ্ডব ও কৌরবদের কাহিনি, নীতিশিক্ষা, ধর্মসংকট, মানবজীবনের দার্শনিক ব্যাখ্যা সবই আছে।

ভাগবদ্গীতা – মহাভারতের অন্তর্গত একটি অংশ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধর্ম ও কর্মের জ্ঞান দেন। এই গীতা আজও ভারতীয় দর্শনের মূল ভিত্তি।

নীতিশিক্ষা – মহাভারত শুধুমাত্র যুদ্ধের কাহিনি নয়, এটি এক জীবন্ত ধর্মশাস্ত্র। এতে রাজনীতি, ন্যায়নীতি, সমাজনীতি, মানবধর্ম সবই শিক্ষা দেয়।

 

পুরাণ রচনা

বেদব্যাসকে ১৮টি মহাপুরাণের রচয়িতা বলা হয়। এগুলি হল –
বিষ্ণু পুরাণ, শিব পুরাণ, ভাগবত পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ ইত্যাদি। এই পুরাণগুলিতে দেবদেবীর কাহিনি, ধর্মনীতি, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান বর্ণিত আছে।

পরিবার ও বংশ

বেদব্যাস নিজে মহাভারতের চরিত্র। তাঁর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল নিয়োগ প্রথা। সত্যবতীর দুই পুত্র বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদ অকালমৃত্যুবরণ করলে, কুরু বংশ নির্বংশ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তখন সত্যবতীর অনুরোধে বেদব্যাস নিয়োগ প্রথা অনুযায়ী দুই রাণীকে গর্ভবতী করেন। এর ফলে জন্ম নেন –

ধৃতরাষ্ট্র – কৌরবদের পিতা।

পাণ্ডু – পাণ্ডবদের পিতা।

বিদুর – মহাভারতের এক নীতিবাগীশ চরিত্র।

 

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি

বেদব্যাসের দর্শন ছিল মানবজীবনের চারটি পুরুষার্থ – ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ – এর মধ্যে সুষমা স্থাপন করা। তিনি শিখিয়েছিলেন –

ধর্ম ছাড়া অর্থ ও কাম অর্থহীন।

সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকাই মুক্তির একমাত্র উপায়।

মানুষের কর্তব্য কর্ম করতে হবে, ফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে।

 

গুরুপূর্ণিমা ও বেদব্যাস পূজা

প্রতিবছর আষাঢ় পূর্ণিমার দিনে গুরুপূর্ণিমা পালিত হয়। এই দিনটি ব্যাস পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। সমস্ত শাস্ত্রাচার অনুযায়ী এই দিন গুরুকে সম্মান জানানোর দিন, কারণ বেদব্যাসকে সমগ্র মানবজাতির প্রথম গুরু হিসেবে ধরা হয়।

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

বেদব্যাস হিন্দু ধর্মের সংহতিসাধক। তাঁর কারণে ভারতীয় সংস্কৃতি এক সুসংহত আকার পেয়েছে। তাঁর রচনাই পরবর্তী যুগে দর্শন, সাহিত্য, সমাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা – সব কিছুর ভিত্তি হয়েছে।

উপসংহার

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস শুধুমাত্র একজন কবি বা ঋষি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগস্রষ্টা। তাঁর সৃষ্টি মহাভারত, তাঁর বেদের বিভাজন, তাঁর পুরাণ রচনা – সব মিলিয়ে তিনি ভারতীয় চেতনার শাশ্বত প্রতীক। আজও যখন ভারতীয় সমাজ ধর্ম, নীতি, আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিন্তা করে, তখন বেদব্যাসের নির্দেশনা ও শিক্ষা আলো দেখায়। তাই তাঁকে “অষ্টচিরঞ্জীবী”দের একজন হিসেবে মান্য করা হয় – যিনি যুগে যুগে বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে পুজোর সেরা গন্তব্য।।

পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র দর্শনের নাম এলেই সবার আগে মনে পড়ে দীঘা-র কথা। কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত এই সমুদ্রসৈকত শহর বছরের সবসময়ই জনপ্রিয়, তবে দুর্গাপুজোর ছুটিতে দীঘার আবহ থাকে একেবারে অন্যরকম।


🏖️ দীঘার সমুদ্রসৈকত – প্রকৃতির খোলা রূপ

দীঘার মূল আকর্ষণ হল তার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত।

  • ওল্ড দীঘা: এখানকার পাথরের বাঁধে বসে ঢেউয়ের শব্দ শোনা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
  • নিউ দীঘা: এখানে রয়েছে প্রশস্ত বালুকাবেলা, যা হাঁটাহাঁটির জন্য আদর্শ। সন্ধ্যায় পুরো সৈকত ভরে ওঠে আলো, দোকান ও মানুষের ভিড়ে।

🪔 পুজোর ছুটিতে দীঘা – উৎসবের বাড়তি রঙ

পুজোর সময় দীঘায় পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যায়।

  • অনেক হোটেল ও রিসর্ট বিশেষ আলোকসজ্জা করে।
  • সৈকতে প্যান্ডেলও তৈরি হয়, যেখানে ঢাকের বাজনা, ধুনুচি নাচ হয়।
  • পর্যটক ও স্থানীয় মানুষ মিলে একসাথে পুজোর আনন্দ উপভোগ করে।

🚶 কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান

পুজোর ছুটিতে শুধুই সমুদ্র নয়, দীঘার আশেপাশের কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখা যায় –

  • উদয়পুর সৈকত: নিরিবিলি পরিবেশ ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আদর্শ।
  • শঙ্করপুর: এখানে রয়েছে মৎস্যবন্দর ও নির্জন সৈকত।
  • তাজপুর ও মন্দারমণি: যারা আরও কিছুটা দূরে যেতে চান তাদের জন্য এই সৈকতগুলো দারুণ পছন্দ।
  • আমরাবতী পার্ক: শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা।
  • সায়েন্স সেন্টার: বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য ছোট কিন্তু ইন্টারেস্টিং প্রদর্শনী।

🍤 দীঘার খাবার

সমুদ্রতীরের শহরে এসে সি-ফুড না খেলে ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না।

  • কাঁকড়া, প্রন, পোমফ্রেট – সবই তাজা ও সুস্বাদু।
  • রাস্তার ধারে ভাজা মাছ, পকোড়া ও আইসক্রিমও সমান জনপ্রিয়।

🛍️ কেনাকাটা

দীঘার সৈকতের পাশে ছোট দোকানগুলোতে পাওয়া যায় –

  • ঝিনুক ও শাঁখের তৈরি জিনিস
  • বাঁশ ও কাঠের হস্তশিল্প
  • শাড়ি, গামছা ও ছোট ছোট স্মারক

🚆 কিভাবে পৌঁছবেন

  • ট্রেন: হাওড়া থেকে সরাসরি দীঘার ট্রেন চলে।
  • রাস্তায়: কলকাতা থেকে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টার ড্রাইভ (NH-116B)।
  • পুজোর সময় আগে থেকে হোটেল বুক করে রাখা জরুরি, কারণ ভিড় অনেক বেড়ে যায়।

❤️ উপসংহার

দীঘা শুধুই সমুদ্র দেখার জায়গা নয় – এটি এক আবেগ, এক স্মৃতি। দুর্গাপুজোর ছুটিতে এখানে বেড়াতে গেলে পরিবার, বন্ধু বা প্রিয়জনের সঙ্গে এক অমলিন সময় কাটানো যায়। ঢেউয়ের শব্দ, ঠান্ডা হাওয়া, বালুকাবেলার হাঁটাহাঁটি আর সুস্বাদু সি-ফুড – সব মিলিয়ে দীঘা হল পুজোর ছুটির জন্য একদম পারফেক্ট গন্তব্য।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

ইতিহাস, শিল্প আর উৎসব – বিষ্ণুপুরের পুজো এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

বাঁকুড়া জেলার ছোট্ট শহর বিষ্ণুপুর পশ্চিমবঙ্গের এক ঐতিহাসিক রত্ন। মল্লভূমের প্রাচীন রাজধানী হিসেবে বিষ্ণুপুর আজও বয়ে বেড়াচ্ছে মল্ল রাজাদের ঐতিহ্য। টেরাকোটা মন্দির, বালুচরি শাড়ি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত – সবকিছু মিলিয়ে বিষ্ণুপুর এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দুর্গাপুজোর সময় এ শহর পায় নতুন প্রাণ, মন্দিরের শহর যেন হয়ে ওঠে উৎসবের শহর।


🏺 টেরাকোটা মন্দির – শিল্প ও ইতিহাসের ধনভান্ডার

বিষ্ণুপুরে এলে সবার আগে চোখে পড়ে লাল মাটির টেরাকোটা মন্দির। দুর্গাপুজোর সময়ে মন্দিরগুলো আলোয় সাজানো হয়, পূজোর আয়োজনও হয় অনেক জায়গায়।

  • রাসমঞ্চ: বিষ্ণুপুরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। পূজোর সময় এখানে আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে, মেলার আয়োজন হয়।
  • মদনমোহন, শ্যামরায়, জোরবাংলা মন্দির: টেরাকোটা খোদাই করা দেয়ালগুলো পূজোর সময় বিশেষভাবে সাজানো হয়।

🪔 ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো

বিষ্ণুপুরের দুর্গাপুজো এখনো বহন করছে মল্লরাজাদের যুগের ঐতিহ্য।

  • অনেক বাড়ির রাজবাড়ির পুজো আজও পুরনো নিয়মে হয় – ঢাকের শব্দ, ধুনুচি নাচ, শঙ্খধ্বনিতে এক অপূর্ব আবহ তৈরি হয়।
  • গ্রামের লোকজন থেকে পর্যটক – সবাই একসাথে অংশ নেয় এই আনন্দে।

🎶 সংস্কৃতির আসর

বিষ্ণুপুরের দুর্গাপুজো মানেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

  • বিষ্ণুপুর ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।
  • বাউল গান, লোকনৃত্য, নাটক ও কবিগানের আসর বসে।

🛍️ হস্তশিল্প ও মেলা

পুজোর সময়ে বিষ্ণুপুরে বসে হস্তশিল্পের মেলা।

  • বালুচরি শাড়ি, ডোকরা শিল্প, টেরাকোটা ঘর সাজানোর সামগ্রী – সবই পাওয়া যায়।
  • স্থানীয় বাজারে পিঠে-পায়েস, মাটির খেলনা ও মিষ্টির দোকান ভিড়ে ঠাসা থাকে।

🌳 প্রকৃতির কোলে শান্ত পরিবেশ

বিষ্ণুপুর শহরের চারপাশে সবুজ ক্ষেত, পুকুর আর ছোট ছোট গ্রাম। পূজোর দিনে এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্যান্ডেল হপিং করে ক্লান্ত হলে প্রকৃতির কোলে বসে আরাম করা যায়।


🛣️ কিভাবে পৌঁছাবেন

  • ট্রেন: হাওড়া থেকে বিষ্ণুপুরে সরাসরি ট্রেন পাওয়া যায় (রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস, অরন্যক এক্সপ্রেস ইত্যাদি)।
  • রাস্তায়: কলকাতা থেকে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টার ড্রাইভ।

🍲 খাওয়া-দাওয়া

পুজোর সময় বিষ্ণুপুরে খাওয়ার বিশেষ আয়োজন থাকে।

  • ছানা দিয়ে তৈরি মিষ্টি যেমন মকড়চুরি, গোপালভোগ – খুব বিখ্যাত।
  • হোটেল ও ঢাবায় ভাত-ডাল-সিদ্ধ, মাছের ঝোল ও মাটন কষার স্বাদ অন্যরকম লাগে।

উপসংহার–

বিষ্ণুপুরে দুর্গাপুজো মানেই একসাথে ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি আর উৎসবের আনন্দ। টেরাকোটা মন্দিরের সৌন্দর্য আর রাজবাড়ির পুজোর ঐতিহ্য মিলিয়ে বিষ্ণুপুর হয়ে ওঠে এক অনন্য গন্তব্য। যারা পুজোর সময় শান্ত কিন্তু ঐতিহ্যমণ্ডিত ভ্রমণ চান, তাদের জন্য বিষ্ণুপুর হতে পারে এক অসাধারণ পছন্দ।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও বিশ্বকর্মা পূজা : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।

আমাদের মূল্যবান মনুষ্য জীবনে উৎসবমুখর ভারতবর্ষে, ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে দেবশিল্পী ভগবান বিশ্বকর্মা পূজা হয়। এই বছর 17 সেপ্টেম্বর, 2025-এ (বাংলা ৩১ভাদ্র বুধবার ১৪৩২) বিশ্বকর্মা পূজা পড়েছে। দেবশিল্পী ভগবান বিশ্বকর্মা, দেবতাদের ঐশ্বরিক স্থপতি এবং প্রকৌশলী হিসাবে পরিচিত, পুরাণে তাঁর অতুলনীয় কারুকাজ এবং দক্ষতার জন্য সম্মানিত। এই উৎসবটি কর্মক্ষেত্র এবং কারখানাগুলিতে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, যেখানে জীবিকা এবং সাফল্যের উপকরণ হিসাবে হাতিয়ার এবং যন্ত্রপাতি পূজা করা হয়। সত্য সনাতন ধর্মে স্থাপত্য দেবতা বিশ্বকর্মার সন্তুষ্টি লাভের আশায় এই পূজা করা হয়। তাকে স্বয়ম্ভু এবং বিশ্বের স্রষ্টা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের বিশ্বকর্মা পূজা বা বিশ্বকর্মা জয়ন্তী হচ্ছে একটি ধর্মীয় উৎসব।

তিনি ভগবান কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা শহরটি ও পাণ্ডবদের মায়া সভা নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কা নগরী, রামায়ণে উল্লিখিত ব্রহ্মার পুষ্পক রথ, দেবতাদের বিভিন্ন গমনাগমনের জন্য বিভিন্ন বাহন, দেবপুরী এবং বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিব এর ত্রিশূল, কুবের এর অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকের শক্তি সহ দেবতাদের জন্য বহু কল্পিত অস্ত্রের স্রষ্টা। তিনি এই বিশ্বের সব কর্মের সম্পাদক। তিনি সব ধরনের শিল্পের প্রকাশক। শিল্পবিদ্যায় বিশ্বকর্মার রয়েছে একচ্ছত্র অধিকার। তিনি নিজেই চতুঃষষ্টিকলা, স্থাপত্যবেদ এবং উপবেদ এর প্রকাশক। কথিত আছে, পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথমূর্তিও তিনিই নির্মাণ করেন। তাকে স্বর্গীয় সূত্রধরও বলা হয়।

বিশ্বকর্মা পূজা শুধুমাত্র কারুশিল্প এবং দক্ষতাই উদযাপন করে না বরং শ্রমিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা ও বন্ধুত্বের ধারনাও জাগিয়ে তোলে। এটি দৈনন্দিন জীবনে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং কঠোর পরিশ্রমের গুরুত্ব তুলে ধরে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে, কাজের সঙ্গে জড়িত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের পূজা করা হয়। তিনি সৃষ্টিশক্তির দেবতা এবং পরম সত্যের প্রতিরূপ। ঋগ্বেদ অনুযায়ী, তিনি সময়ের সূত্রপাতের আগে থেকেই অস্তিত্বমান ছিলেন। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে, কাজের সাথে জড়িত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ও পূজা করা হয়।
বিশ্বকর্মা পূজা ভারত জুড়ে অত্যন্ত উত্সাহের সাথে পালিত হয়। উন্নত ভবিষ্যৎ, নিরাপদ কাজের পরিস্থিতি এবং নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোপরি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে, বিভিন্ন ধরনের পেশার মানুষ এদিন বিশ্বকর্মার পুজো করেন। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি তিথিকে ‘কন্যা সংক্রান্তি’ বলা হয়। পুরাণ মতে এই তিথিতেই বিশ্বকর্মার জন্ম হয়। আমাদের হিন্দু ধর্মে সব দেব -দেবীর পুজোর তিথি স্থির হয় চন্দ্রের গতি প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে। বিশ্বকর্মা পুজোর তিথি স্থির হয় সূর্যের গতির উপর নির্ভর করে।

সেইসাথে আজ ভাদু উৎসব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলার লৌকিক উৎসব হল ভাদু উৎসব। আজ নাগদেবী মা মনসার পূজা ও অনেক জায়গায়। দেবশিল্পী ভগবান বিশ্বকর্মার নাগদেবী মা মনসার শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক, এই প্রার্থনা করি…!
স্বামী আত্মভোলানন্দ *পরিব্রাজক*

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

বিদেশ ভ্রমণ : প্রস্তুতি, অভিজ্ঞতা ও প্রেরণা।

✈️ ভূমিকা: কেন বিদেশ ভ্রমণ?

মানুষের মন স্বভাবতই অজানাকে জানতে চায়। নিজের দেশ ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যাওয়া শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং শেখার জন্য, নতুন সংস্কৃতি জানার জন্য, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার জন্য। বিদেশ ভ্রমণ আমাদের মনকে নতুন করে সাজায়, জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শেখায়।


🧳 অধ্যায় ১: বিদেশ ভ্রমণের মানসিক প্রস্তুতি

বিদেশ যাওয়ার আগে প্রথমেই মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়।

  • ভাষার বাধা কাটানোর মানসিকতা
  • সংস্কৃতির পার্থক্যকে সম্মান করার অভ্যাস
  • নতুন মানুষের সাথে মিশতে শেখা
  • অচেনা জায়গায় খাপ খাওয়ানোর সাহস

অনেকেই প্রথমবার বিদেশ গেলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বিমানবন্দর, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস—সবই নতুন অভিজ্ঞতা। মানসিক প্রস্তুতি নিলে ভ্রমণ অনেক সহজ হয়।


🛂 অধ্যায় ২: পাসপোর্ট ও ভিসা প্রক্রিয়া

বিদেশ ভ্রমণের প্রথম ধাপ হলো বৈধ পাসপোর্ট থাকা।

  • পাসপোর্ট: ভারতের পাসপোর্ট আবেদন এখন সহজ। অনলাইনে ফর্ম পূরণ, ডকুমেন্ট যাচাই, পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং কিছুদিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায়।
  • ভিসা: গন্তব্য দেশের উপর নির্ভর করে ভিসার ধরন আলাদা হয়।
    • পর্যটক ভিসা
    • স্টুডেন্ট ভিসা
    • ব্যবসায়িক ভিসা
    • অন-অ্যারাইভাল ভিসা (যেমন থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ)
    • ভিসা-ফ্রি দেশ (যেমন নেপাল, ভুটান – ভারতীয়দের জন্য)

💰 অধ্যায় ৩: বাজেট ও আর্থিক পরিকল্পনা

বিদেশ ভ্রমণের খরচ প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় –

  1. ফ্লাইট টিকিট – আগেভাগে বুকিং করলে খরচ কম হয়।
  2. আবাসন – হোটেল, হোস্টেল, এয়ারবিএনবি – বাজেট অনুসারে বেছে নেওয়া যায়।
  3. খাবার ও যাতায়াত – স্থানীয় স্ট্রিট ফুড, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করলে খরচ বাঁচে।

ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স করাও বুদ্ধিমানের কাজ। হঠাৎ অসুস্থতা বা লাগেজ হারালে এটি কাজে লাগে।


🗺️ অধ্যায় ৪: জনপ্রিয় গন্তব্য ও তাদের বিশেষত্ব

১. ইউরোপ

  • প্যারিস – আইফেল টাওয়ার, লুভর মিউজিয়াম
  • সুইজারল্যান্ড – পাহাড়, ট্রেন ভ্রমণ
  • ইতালি – রোমের কলোসিয়াম, ভেনিসের খাল

২. এশিয়া

  • সিঙ্গাপুর – আধুনিক শহর, সেন্তোসা
  • থাইল্যান্ড – সমুদ্র সৈকত, রাতের বাজার
  • জাপান – টোকিও, কিয়োটো, চেরি ব্লসম

৩. আমেরিকা

  • নিউইয়র্ক – টাইমস স্কোয়ার, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি
  • ক্যালিফোর্নিয়া – ডিজনিল্যান্ড, সিলিকন ভ্যালি
  • লাতিন আমেরিকা – মাচু পিচু, ব্রাজিলের রিও

৪. আফ্রিকা

  • মিশর – পিরামিড, নীল নদের ক্রুজ
  • কেনিয়া – সাফারি, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

📱 অধ্যায় ৫: ভাষা ও যোগাযোগ

বিদেশে গেলে অনেক সময় ভাষার সমস্যায় পড়তে হয়।

  • গুগল ট্রান্সলেট, অফলাইন ডিকশনারি কাজে লাগে
  • কিছু সাধারণ বাক্য শিখে রাখা ভালো
  • শরীরী ভাষা অনেক সাহায্য করে

🍲 অধ্যায় ৬: বিদেশি খাবারের অভিজ্ঞতা

প্রতিটি দেশের খাবারের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

  • ইতালিতে পাস্তা, পিৎজা
  • জাপানে সুশি
  • থাইল্যান্ডে টম ইয়াম স্যুপ
  • ফ্রান্সে ক্রোসঁ ও ওয়াইন

তবে নিজের দেশের খাবার মিস করলে ভারতীয় রেস্টুরেন্টও খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় সব বড় শহরে।


🛡️ অধ্যায় ৭: নিরাপত্তা ও ভ্রমণ শিষ্টাচার

  • পাসপোর্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের ফটোকপি রাখুন
  • স্থানীয় আইন-কানুন মেনে চলুন
  • রাতে নির্জন জায়গায় একা ঘুরবেন না
  • স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন

📸 অধ্যায় ৮: স্মৃতি ধরে রাখা

বিদেশ ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আনন্দ স্মৃতি ধরে রাখা।

  • ছবি ও ভিডিও তুলুন
  • ট্রাভেল ডায়েরি লিখুন
  • স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলুন
  • ছোটখাটো সুভেনির সংগ্রহ করুন

🌏 অধ্যায় ৯: ভ্রমণের প্রভাব ও শিক্ষা

বিদেশ ভ্রমণ আমাদের মনের পরিধি প্রসারিত করে।

  • সহনশীলতা বাড়ায়
  • নতুন বন্ধু তৈরি হয়
  • দৃষ্টিভঙ্গি বড় হয়
  • আত্মবিশ্বাস বাড়ে

🏠 অধ্যায় ১০: ফিরে এসে অভিজ্ঞতা শেয়ার

দেশে ফিরে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণের গল্প শেয়ার করুন। ছবি দেখান, নতুন সংস্কৃতি সম্পর্কে বলুন। অনেক সময় এই অভিজ্ঞতা অন্যদেরও ভ্রমণে উৎসাহিত করে।


✨ উপসংহার

বিদেশ ভ্রমণ কেবল বিলাসিতা নয়, এটি একধরনের শিক্ষা। পৃথিবীর নানান মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, ইতিহাস দেখতে পারা জীবনের বড় সৌভাগ্য। ভ্রমণ শেষে মানুষ আরও বিনম্র, আরও কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে।


 

Share This
Categories
উপন্যাস

অপেক্ষার ছায়া।

অধ্যায় ১: প্রথম দেখা

কলকাতার গরমে হাঁপিয়ে ওঠা এক দুপুর। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় ভিড় জমজমাট।
অরণ্য দাঁড়িয়ে পুরনো বই ঘাঁটছে। হঠাৎ করেই পাশ থেকে এক মেয়ে এসে ধাক্কা দিল।

“সরি!” – মেয়েটি লজ্জায় বলল।
অরণ্য তাকিয়ে দেখল, সাদামাটা সালোয়ার-কামিজ পরা এক মেয়ে, চুল এলোমেলো।

“কিছু হয়নি,” অরণ্য মৃদু হাসল।
এটাই তাদের প্রথম পরিচয়। মেয়েটির নাম ছিল মেঘলা


অধ্যায় ২: বন্ধুত্বের শুরু

পরিচয় বাড়ল। অরণ্য জানল মেঘলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে।
দুজনের বইয়ের রুচি এক। রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, সেলিঞ্জার—সবই তাদের আলোচনার বিষয়।

ধীরে ধীরে তারা নিয়মিত দেখা করতে শুরু করল।
কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে একসাথে কফি খাওয়া, গঙ্গার ধারে হাঁটা, বইয়ের দোকানে একসাথে ঘুরে বেড়ানো—সবই নতুন স্বাদ এনে দিল অরণ্যের জীবনে।


অধ্যায় ৩: প্রেমের জন্ম

একদিন গঙ্গার ধারে বসে মেঘলা হঠাৎ বলল—
“তুমি জানো অরণ্য, আমি কখনও কাউকে এতটা বিশ্বাস করিনি।”
অরণ্য অবাক হয়ে তাকাল।

সেদিন হাওয়ার ঝাপটায় মেঘলার চুল মুখে এসে পড়ল।
অরণ্য ধীরে হাত বাড়িয়ে সেটা সরিয়ে দিল।
তাদের চোখে চোখ পড়তেই অরণ্যের বুক ধড়ফড় করে উঠল।

সেই দিন থেকেই তাদের প্রেমের গল্প শুরু হল।


অধ্যায় ৪: ভবিষ্যতের স্বপ্ন

অরণ্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মেঘলা স্বপ্ন দেখত বিদেশে উচ্চশিক্ষার।
তারা প্রায়ই ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলত।

“যদি আমি বাইরে চলে যাই?” – মেঘলা একদিন জিজ্ঞেস করল।
অরণ্য বলল—
“তাহলেও আমি থাকব। তুমি পড়াশোনা শেষ করে ফিরবে, তারপর আমরা সংসার গড়ব।”


অধ্যায় ৫: দূরত্বের শুরু

মেঘলা বিদেশে পড়তে চলে গেল।
প্রথম কয়েক মাস তারা নিয়মিত ফোনে কথা বলত, ভিডিও কল করত।

কিন্তু ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে এল।
টাইম জোনের পার্থক্য, ব্যস্ততা, নতুন জীবন—সব মিলে মেঘলা কম সময় দিতে লাগল।

অরণ্য কষ্ট পেত, কিন্তু কিছু বলত না।


অধ্যায় ৬: ভুল বোঝাবুঝি

একদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় অরণ্য দেখল মেঘলা তার এক সহপাঠীর সাথে ছবি দিয়েছে।
ছবিতে তারা হাসছে।

অরণ্যের বুকের ভেতর রাগ জমল।
সে মেঘলাকে মেসেজ করল—
“তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ?”

মেঘলা উত্তর দিল না।
কয়েকদিনের নীরবতার পর সে লিখল—
“অরণ্য, আমাদের মধ্যে দূরত্ব এত বেড়ে গেছে যে আমি আর টিকিয়ে রাখতে পারছি না।”


অধ্যায় ৭: ভাঙনের রাত

অরণ্য সেই রাতে ঘুমোতে পারেনি।
মেঘলার শেষ মেসেজটা বারবার পড়তে পড়তে চোখে জল এসে গেল।

সকালে উঠে সে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিল।
ফোন, মেসেঞ্জার, মেইল—সব জায়গা থেকে মেঘলাকে ব্লক করল।


অধ্যায় ৮: সময়ের নির্মমতা

বছর গড়িয়ে গেল।
অরণ্য চাকরি পেল, জীবনে কিছুটা স্থিরতা এল।
কিন্তু মেঘলার স্মৃতি তাকে ছাড়ল না।

রাতের বেলা একা বসে গান শুনলে মনে হত মেঘলা ঠিক পাশেই বসে আছে।


অধ্যায় ৯: অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ

একদিন এক সাহিত্য সভায় অরণ্য মেঘলাকে হঠাৎ দেখল।
সে দেশে ফিরেছে। চুলে সামান্য সাদা, মুখে পরিণত ভাব।

তাদের চোখে চোখ পড়ল।
দুজনেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।


অধ্যায় ১০: মুখোমুখি

অরণ্য ধীরে মেঘলার কাছে গেল।
“কেমন আছো?”—তার গলায় কাঁপন।

মেঘলা হেসে বলল—
“ভালো। অনেক কিছু শিখেছি। তোমাকে না পেয়ে শিখেছি, কীভাবে একা বাঁচতে হয়।”

অরণ্য বলল—
“আমি এখনও ভুলতে পারিনি।”

মেঘলা চুপ করে রইল। তারপর বলল—
“কিন্তু অরণ্য, আমরা দুজনেই বদলে গেছি। সেই দিনগুলো ফিরে আসবে না।”


অধ্যায় ১১: শেষ সিদ্ধান্ত

অরণ্য বাড়ি ফিরে সারারাত জানালার পাশে বসে রইল।
ভোরের আলোয় মনে হল—
মেঘলাকে ছেড়ে দেওয়াটাই হয়তো ভালো।

সে ডায়েরিতে লিখল—
“প্রেম শেষ হয়নি, শুধু রূপ বদলেছে। মেঘলা থাকবে, কিন্তু স্মৃতির মতো।”


অধ্যায় ১২: মুক্তি

অরণ্য মেঘলাকে একটি শেষ মেসেজ পাঠাল—
“ধন্যবাদ আমার জীবনে এসে আমাকে ভালোবাসার মানে শেখানোর জন্য। তোমার সুখী হওয়া ছাড়া আমার আর কিছু চাই না।”

মেঘলা উত্তর দিল না।
কিন্তু অরণ্যের মনে হল, বুকের ভার হালকা হয়ে গেছে।


সমাপ্তি

অরণ্য জানল—প্রেম মানেই সবসময় একসাথে থাকা নয়।
কখনও কখনও ছেড়ে দেওয়াই সত্যিকারের ভালোবাসা।

সে হেসে উঠল।
বছরের পর বছর যে যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে বেড়াত, আজ যেন মুক্তির স্বাদ দিল।

 

Share This
Categories
অনুগল্প

অনু গল্প : শেষ দেখা।

ট্রেনের হুইসেল বাজলেই যেন চমকে উঠল রিয়া। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সে দেখল, ভিড়ের ভেতর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে অর্ণব।
“রিয়া!” – হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে।
রিয়া তাকিয়ে রইল – তার চোখে জল।

“তুমি যাচ্ছ?”
রিয়া চুপ। শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল।

অর্ণবের চোখে হাজার কথা জমে ছিল, কিন্তু সময়ের অভাব ছিল আরও বড়। ট্রেন তখন ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলেছে।
হঠাৎ অর্ণব রিয়ার হাত ধরে বলল,
“যদি কখনো ফিরে আসো… আমি এখানেই থাকব।”

ট্রেন চলে গেল।
রিয়া জানালায় দাঁড়িয়ে দেখল অর্ণব ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে।
তার ঠোঁট নড়ে উঠল –
“হয়তো একদিন…”

Share This
Categories
গল্প

শেষ চিঠির অপেক্ষা।

একটি দীর্ঘ, আবেগঘন ও রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প লিখছি। গল্পে থাকবে সম্পর্কের গভীরতা, আবেগ, দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝি, বিচ্ছেদ এবং পুনর্মিলনের স্বাদ—যাতে এটি পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে রাখে।


❤️ “শেষ চিঠির অপেক্ষা”

(একটি ৫০০০ শব্দের ভালোবাসার গল্প)


অধ্যায় ১: প্রথম দেখা

শীতের এক বিকেল। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের ভিড় জমজমাট রাস্তা।
অর্পিতা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে ফিরছিল। বইয়ের গন্ধ, গলির চায়ের দোকান, আর পাশের বইয়ের দোকানের ডাকাডাকি—সব মিলে এক অন্যরকম পরিবেশ।

হঠাৎ করেই এক ধাক্কা। তার হাত থেকে বইগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল।
“সরি, আমি দেখিনি!”—একটা কণ্ঠস্বর।

অর্পিতা তাকিয়ে দেখল, লম্বা, হাসিখুশি এক যুবক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে সোয়েটার।
সে তাড়াতাড়ি বইগুলো তুলে দিয়ে বলল—
“আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। আমি সমীর।”

অর্পিতা কিছুটা রেগে ছিল, কিন্তু ছেলেটির আন্তরিক হাসি দেখে রাগ গলে গেল।

সেদিনের দেখা যেন তাদের জীবনের গল্পের প্রথম পৃষ্ঠা।


অধ্যায় ২: বন্ধুত্বের শুরু

সমীর ও অর্পিতার দেখা হতে লাগল বারবার। কখনও কলেজ স্ট্রিটে, কখনও কফি হাউসে।
তাদের আলোচনার বিষয় বই, সিনেমা, সঙ্গীত, স্বপ্ন।

একদিন সমীর হেসে বলল—
“তুমি জানো, তুমি একদম সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়িকা মতো।”
অর্পিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হল। তারা একসাথে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করল—ছোট্ট একটা বাড়ি, অনেক বই, রবিবার সকালে একসাথে চা খাওয়া।


অধ্যায় ৩: প্রেমের প্রথম স্বাদ

ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে গঙ্গার ধারে তারা দুজনে হাঁটছিল।
হাওয়া ঠাণ্ডা, সূর্যাস্তের আলো গঙ্গার জলে লেগে সোনালি রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

সমীর হঠাৎ অর্পিতার হাত ধরল।
“অর্পিতা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

অর্পিতার চোখে জল চলে এলো।
“আমিও সমীর। আমি অনেকদিন ধরে বলতে চেয়েছিলাম।”

সেই মুহূর্তে মনে হল, পৃথিবী থমকে গেছে। শুধু তারা দুজন, আর চারপাশে গঙ্গার ঢেউ।


অধ্যায় ৪: জীবনের বাস্তবতা

কিন্তু ভালোবাসা যত সুন্দর, জীবনের বাস্তবতা তত কঠিন।
সমীর মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অর্পিতার বাবা-মা চায় সে বিদেশে উচ্চশিক্ষা করুক।

অর্পিতা দ্বিধায় পড়ল—
সে কি প্রেম বেছে নেবে, নাকি স্বপ্ন?
সে কি সমীরকে অপেক্ষা করাবে, নাকি একসাথে ভবিষ্যত গড়বে?


অধ্যায় ৫: দূরত্বের সূচনা

অর্পিতা বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
এয়ারপোর্টে বিদায়ের সময় সমীর চিঠি দিয়ে বলল—
“যখন একা লাগবে, পড়বে। আমি অপেক্ষা করব।”

অর্পিতা কান্না আটকাতে পারল না।
বিমানের জানালা দিয়ে সমীরকে ছোট হতে হতে হারিয়ে যেতে দেখল।


অধ্যায় ৬: অপেক্ষার দিনগুলো

সমীর প্রতিদিন অর্পিতাকে চিঠি লিখত।
প্রথম কয়েক মাস অর্পিতা নিয়মিত উত্তর দিত।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তর কমতে লাগল।

অর্পিতা নতুন শহর, নতুন জীবন, নতুন বন্ধুদের মাঝে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সমীর একা শহরে তার চিঠির অপেক্ষা করত।


অধ্যায় ৭: ভুল বোঝাবুঝি

একদিন সমীর শুনল অর্পিতা একজন সহপাঠীর সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছে।
তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধল।

সে একটি রাগী চিঠি লিখে ফেলল—
“তুমি যদি আমাকে ভুলে গিয়ে থাকো, তাহলে বলো। আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।”

অর্পিতা চিঠি পেয়ে কষ্ট পেল।
সে কিছুদিন চুপ করে রইল। এই নীরবতা তাদের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিল।


অধ্যায় ৮: বিচ্ছেদ

অবশেষে অর্পিতা লিখল—
“সমীর, হয়তো আমাদের সময় শেষ। আমি এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। তুমি তোমার জীবনে এগিয়ে যাও।”

সমীর ভেঙে পড়ল। তার পৃথিবী যেন থেমে গেল।
সে লেখা বন্ধ করে দিল।


অধ্যায় ৯: সময়ের নিরাময়

বছর কেটে গেল।
সমীর চাকরি পেল, শহর বদলাল।
অর্পিতা বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরল।

একদিন কলেজ স্ট্রিটের সেই পুরোনো বইয়ের দোকানে তারা হঠাৎ মুখোমুখি হল।
চোখে চোখ পড়তেই যেন পুরোনো সব স্মৃতি ফিরে এল।


অধ্যায় ১০: শেষ চিঠির অপেক্ষা

অর্পিতা ধীরে ধীরে বলল—
“সমীর, আমি তোমার লেখা চিঠিগুলো সব রেখেছি।”
সমীর তাকাল—”তাহলে তুমি কখনও আমাকে ভুলোনি?”
অর্পিতা চোখের জল মুছল—
“না সমীর। আমি শুধু সময় চেয়েছিলাম। আজ আমি প্রস্তুত। তুমি কি এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছ?”

সমীর মুচকি হাসল—
“আমি আজও সেই শেষ চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম।”

তারা আবার একসাথে হাঁটল।
গঙ্গার ধারে সূর্যাস্তের আলোতে যেন তাদের প্রেম আবার নতুন করে জন্ম নিল।


সমাপ্তি

গল্পটি আমাদের শেখায়—ভালোবাসা সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকতে পারে, যদি দুজনেই একে অপরকে সময় দেয় এবং অপেক্ষা করতে জানে।

 

Share This