Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

একটি মোবাইল যখন সম্পর্কের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায়।

 

ভূমিকা

২১শ শতাব্দীকে আমরা ডিজিটাল যুগ বলি। মোবাইল ফোন এখন শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি আমাদের ব্যক্তিগত সহচর, আমাদের বিনোদনের উৎস, আমাদের অফিস, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পরিচয়ের অংশ। কিন্তু যে যন্ত্র মানুষকে কাছাকাছি আনার জন্য তৈরি হয়েছিল, সেটাই কি আজ মানুষের মধ্যে অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করছে? দাম্পত্য সম্পর্ক, প্রেমের সম্পর্ক, পিতা-মাতা ও সন্তান সম্পর্ক—সব ক্ষেত্রেই মোবাইল কখনও কখনও এক নীরব তৃতীয় পক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


মোবাইল ফোনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব

  • পরিসংখ্যান: ২০২৪ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপ অনুসারে, একজন গড় মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৩-৫ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে। কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে এটি ৭ ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়।
  • সামাজিক বাস্তবতা: আগে পরিবারের সবাই একসাথে গল্প করত, খেলাধুলা করত, সিনেমা দেখত। এখন প্রত্যেকে নিজের স্ক্রিনে ডুবে থাকে।
  • যোগাযোগের নতুন রূপ: মোবাইল ফোনে WhatsApp, Messenger, Instagram, ইত্যাদি থাকায় যোগাযোগ অনেক বেড়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগত সংলাপ (face-to-face communication) কমেছে।

সম্পর্কের মাঝে দেওয়াল: সমস্যার মূল

১. অতিরিক্ত ব্যবহার (Overuse)

যখন একজন সঙ্গী সারাক্ষণ মোবাইলে ব্যস্ত থাকে—গেম খেলে, সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করে, ভিডিও দেখে—অন্যজন নিজেকে উপেক্ষিত মনে করে।

২. মোবাইল আসক্তি (Nomophobia)

গবেষণা বলছে, যারা মোবাইল ছাড়া থাকতে পারে না, তাদের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং সম্পর্কের জটিলতা বেড়ে যায়।

৩. বিশ্বাসের সংকট

মোবাইলে ব্যক্তিগত চ্যাট, কল লিস্ট, সোশ্যাল মিডিয়া ফ্রেন্ড লিস্ট নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্ক ভেঙে দেয়।

৪. প্রেমের উষ্ণতা হারিয়ে যাওয়া

দাম্পত্য সম্পর্কে শারীরিক ও মানসিক ঘনিষ্ঠতা কমে যায়। একে বলে “ফোন ফ্যাটিগ”—যেখানে সঙ্গীরা একসাথে থাকলেও মানসিকভাবে দূরে থাকে।


মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ

  • ডোপামিন এফেক্ট: সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক, কমেন্ট আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন ক্ষরণ বাড়ায়, যা এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে। ফলে সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলার চেয়ে ফোন দেখা বেশি আকর্ষণীয় লাগে।
  • অ্যাটাচমেন্ট থিওরি: সম্পর্কের নিরাপত্তা বোধ নষ্ট হলে মানুষ সঙ্গীর বদলে ফোনে আশ্রয় খোঁজে।
  • ফোমো (FOMO): ফোন না দেখলে কিছু মিস হয়ে যাবে—এই ভয় মানুষকে সারাক্ষণ ফোনের দিকে টেনে নেয়।

বাস্তব উদাহরণ

উদাহরণ ১:

সুদীপ ও মেঘলা বিবাহিত দম্পতি। অফিস থেকে ফিরে দুজনেই ক্লান্ত। একসময় তারা একসাথে গল্প করত, হাঁটতে যেত। এখন দুজনেই সোফায় বসে ফোনে ডুবে থাকে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কথা বলা কমে যায়, ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে।

উদাহরণ ২:

একটি পরিবারে খাওয়ার টেবিলে প্রত্যেকে ফোন ব্যবহার করছে। বাবা সংবাদ পড়ছে, মা অনলাইন শপিং করছে, ছেলে গেম খেলছে। ফলে পরিবারে একসাথে সময় কাটানোর ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।


সমাজে প্রভাব

  • বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধি: বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে যে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ও বিচ্ছেদের মামলা বেড়েছে।
  • শিশুদের উপর প্রভাব: যখন পিতা-মাতা ফোনে বেশি সময় দেয়, শিশুরা অবহেলিত বোধ করে। তাদের আবেগিক বিকাশে প্রভাব পড়ে।
  • বন্ধুত্ব ও সামাজিক সম্পর্ক ক্ষীণ হওয়া: অফলাইন সামাজিক মেলামেশা কমে যাচ্ছে।

সম্ভাব্য সমাধান

১. ডিজিটাল ডিটক্স: প্রতিদিন অন্তত ১-২ ঘণ্টা মোবাইল ছাড়া সময় কাটানো।
২. ফোন-মুক্ত সময়: খাওয়ার সময়, শোবার সময়, বা পরিবার একসাথে থাকলে ফোন দূরে রাখা।
৩. ওপেন কমিউনিকেশন: সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা যে অতিরিক্ত ফোন ব্যবহার তাকে কষ্ট দিচ্ছে।
৪. রিয়েল-টাইম এক্টিভিটি: একসাথে হাঁটা, রান্না করা, ভ্রমণ করা—যাতে একে অপরের সান্নিধ্যে সময় কাটানো যায়।
৫. মাইন্ডফুলনেস: সচেতনভাবে ফোন ব্যবহার করা এবং সময়সীমা নির্ধারণ করা।


প্রযুক্তি বনাম মানবিক সম্পর্ক

প্রযুক্তি খারাপ নয়—এটি আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু প্রযুক্তিকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ না করি, তাহলে এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। মোবাইল ফোনকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে এটি সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়, বিনাশ নয়।


উপসংহার

মোবাইল ফোন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু সম্পর্ককে জটিলও করেছে। এই অদৃশ্য দেওয়াল ভাঙার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদেরই ঠিক করতে হবে, আমরা কি চাই—ডিজিটাল জগতে হারিয়ে যাওয়া, নাকি বাস্তব জীবনের ভালোবাসা ও সম্পর্ককে ফিরিয়ে আনা।

প্রযুক্তি ব্যবহার হবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে, সম্পর্কের ক্ষতি না করে বরং সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার জন্য।


এই প্রবন্ধটি সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এক বাস্তব সমস্যার বিশ্লেষণ।

 

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

একটি পরিবারে নারীর ভূমিকা।।

ভূমিকা

মানবসমাজের ইতিহাসে পরিবার একটি মৌলিক একক। পরিবার গড়ে ওঠে ভালোবাসা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। আর এই পরিবারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে, একে সুসংহত ও সমৃদ্ধ রাখতে নারীর ভূমিকা অপরিসীম।

নারী শুধু মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রী হিসেবে পরিচিত নন, বরং তিনি একজন সংরক্ষক, সৃষ্টিশীল চিন্তক, সংস্কৃতির ধারক ও মানসিক শক্তির উৎস। ভারতীয় সমাজসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে নারী পরিবারকে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকেও ধরে রাখেন।


১. পরিবারে নারীর ঐতিহাসিক ভূমিকা

১.১ প্রাচীন সমাজে নারী

ভারতীয় সভ্যতায় নারীকে গৃহদেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

  • বেদের যুগে নারী ছিলেন শিক্ষিত, দর্শন ও শাস্ত্রচর্চায় পারদর্শী।
  • গার্হস্থ্য জীবনে তিনি ছিলেন পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু – অন্নপূর্ণার প্রতীক।

১.২ মধ্যযুগে অবস্থার পরিবর্তন

মধ্যযুগে নানা সামাজিক কারণে নারী কিছুটা গৃহবন্দি হয়ে পড়েন।

  • পর্দা প্রথা, বাল্যবিবাহ, শিক্ষার অভাব – এসব কারণে নারীর স্বাধীনতা সীমিত ছিল।
  • তবু তিনি পরিবারের মূল ভরসা ছিলেন – রান্না, সন্তান লালনপালন, গৃহস্থালি সামলানো সবই তাঁর হাতে।

১.৩ আধুনিক যুগে পরিবর্তন

শিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের ফলে আধুনিক কালে নারীর ভূমিকা বহুমাত্রিক হয়েছে।

  • আজ তিনি কর্মজীবী, শিক্ষিত, আর্থিকভাবে স্বনির্ভর।
  • পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে।

২. পরিবারে নারীর মানসিক ভূমিকা

২.১ আবেগীয় ভারসাম্য রক্ষা

নারী প্রায়শই পরিবারের মানসিক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেন।

  • সন্তানদের মানসিক বিকাশ, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক, আত্মীয়তার জাল – সব কিছুতে তাঁর কূটনৈতিক ভূমিকা থাকে।
  • পারিবারিক দ্বন্দ্ব মেটাতে তিনি মধ্যস্থতাকারী।

২.২ ভালোবাসা ও সহানুভূতি

নারীর স্নেহ পরিবারকে একত্রে রাখে।

  • মায়ের ভালোবাসা শিশুর চরিত্র গঠনের ভিত্তি।
  • স্ত্রী হিসেবে তিনি স্বামীকে মানসিক সমর্থন দেন।

৩. পরিবারে নারীর সামাজিক ভূমিকা

৩.১ মূল্যবোধের সংরক্ষণ

নারী প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নৈতিকতা ও সংস্কৃতির শিক্ষা দেন।

  • তিনি সন্তানদের মধ্যে শৃঙ্খলা, সহমর্মিতা, মানবিকতা গড়ে তোলেন।
  • পারিবারিক ঐতিহ্য ও উৎসবের ধারক।

৩.২ সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা

পরিবারের সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় নারীর অবদান বড়।

  • আত্মীয়, প্রতিবেশী, পাড়া-প্রতিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন।
  • সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিয়ে পরিবারের সম্মান বাড়ান।

৪. অর্থনৈতিক ভূমিকা

৪.১ গৃহস্থালি পরিচালনা

নারী সংসারের আর্থিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ।

  • সংসারের খরচ, সঞ্চয়, বাজেট – সব কিছু তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন।
  • অনেক ক্ষেত্রেই সংসারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তিনি।

৪.২ কর্মজীবী নারী

আজ অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে সফল।

  • চাকরি বা ব্যবসার মাধ্যমে পরিবারে আর্থিক অবদান রাখেন।
  • দ্বিগুণ দায়িত্ব সামলে পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যান।

৫. সন্তান লালনপালনে নারীর ভূমিকা

৫.১ প্রথম শিক্ষক

মা শিশুর প্রথম গুরু।

  • ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ সবকিছু তিনি শেখান।
  • সন্তানের মনোবিজ্ঞান বোঝেন ও তার বিকাশে সাহায্য করেন।

৫.২ শিক্ষার পরিবেশ

নারী বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করেন।

  • তিনি সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, পড়াশোনায় সাহায্য করা, স্বপ্ন দেখাতে উৎসাহ দেন।

৬. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভারসাম্য

পরিবারে নারীর ভূমিকা শুধু মায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

  • তিনি স্বামীর সঙ্গী, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক।
  • সংসারের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখা – সংসারের স্থিতিশীলতার মূল।

৭. আধুনিক চ্যালেঞ্জ

৭.১ দ্বৈত ভূমিকা

কর্মজীবী নারীদের জন্য পরিবার ও অফিসের ভারসাম্য রাখা কঠিন।

  • মানসিক চাপ ও সময়ের অভাব দেখা দেয়।

৭.২ সামাজিক বাঁধাধরা ধারণা

আজও অনেক স্থানে নারীকে শুধুমাত্র গৃহিণীর ভূমিকায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাওয়া হয়।

৭.৩ মানসিক স্বাস্থ্য

পারিবারিক দায়িত্ব, সন্তান, কর্মজীবন সামলে নারীর মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে।


৮. সমাধান ও অগ্রযাত্রা

৮.১ শিক্ষা ও সচেতনতা

নারীর শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।

  • শিক্ষিত নারী পরিবারের মান উন্নত করেন।

৮.২ পুরুষের সহায়তা

পরিবারে পুরুষকেও সমান দায়িত্ব নিতে হবে।

  • গৃহকর্ম ও সন্তান পালনে অংশগ্রহণ জরুরি।

৮.৩ মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

নারীর জন্য কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বাড়ানো উচিত।


উপসংহার

নারী পরিবারে মেরুদণ্ডের মতো। তিনি শুধু একজন মা বা স্ত্রী নন, বরং একজন শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, মনোবিদ, সামাজিক কর্মী ও ভবিষ্যত প্রজন্মের গড়নশিল্পী

আজকের দিনে যখন নারী ক্রমশ শিক্ষিত ও স্বনির্ভর হচ্ছেন, তখন সমাজেরও উচিত তাঁকে সমান মর্যাদা ও সহযোগিতা দেওয়া। পরিবারে নারীকে সম্মান দিলে পরিবার হয় শান্তিপূর্ণ, সুখী ও সমৃদ্ধ। আর সেই পরিবারই তৈরি করে একটি সুস্থ সমাজ ও শক্তিশালী দেশ।

 

Share This
Categories
কবিতা

তোমার চোখে প্রেমের নদী।

তোমার চোখে দেখি আমি অদ্ভুত এক নদী,
সেখানে ঢেউ উঠে শুধু আমার নাম খোদাই করে।
নীরব আকাশে হঠাৎ ঝরে তারার দল,
তোমার স্পর্শে যেন চাঁদ ডাকে রাতভর।

তোমার হাসি আমার হৃদয়ের একমাত্র গান,
যেন বসন্তের হাওয়া ছুঁয়ে যায় প্রাণ।
তোমার নীরবতা আমার কাছে অমূল্য রতন,
যেন পূর্ণিমার রাতে ভিজে থাকা বন।

তুমি আছো বলেই জীবন এত রঙিন,
তুমি ছাড়া আমি যেন অসমাপ্ত দিন।
প্রতিটি ভোরে সূর্যের আলোয় করি প্রতিজ্ঞা —
ভালোবাসব তোমায় যতদিন থাকবে প্রজ্ঞা।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

বর্তমান যুব সম্প্রদায়ের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব।

ভূমিকা

একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া মানবজীবনের অন্যতম প্রধান অংশে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টিকটক, এক্স (টুইটার) এবং নানা রকম প্ল্যাটফর্ম এখন আর শুধু বিনোদনের জায়গা নয়, বরং আমাদের চিন্তা, যোগাযোগ, তথ্য গ্রহণ, এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শ গঠনের ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে যুব সমাজ, অর্থাৎ ১৫ থেকে ৩০ বছরের মানুষরা, সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় ব্যবহারকারী।

কিন্তু এই ব্যবহার কতটা সুফল দিচ্ছে, আর কতটা কুফল বয়ে আনছে? এই প্রশ্ন আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।


১. সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান ও যুব সমাজ

গত এক দশকে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকে তীব্রভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

  • ভারতে ২০২৫ সালের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান।
  • ভারতের মোট ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৬৫% এর বয়স ৩০-এর নিচে।

যুব সমাজ তথ্য, বিনোদন, শিক্ষা, সম্পর্ক, ক্যারিয়ার — সব কিছুই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগ্রহ করছে। ফলে তাদের জীবনযাপন, মূল্যবোধ ও মানসিকতা আগের প্রজন্মের তুলনায় ভিন্ন।


২. ইতিবাচক প্রভাব

২.১ যোগাযোগ ও সংযোগ

  • পরিবার, বন্ধু, সহপাঠী ও বিদেশে থাকা পরিচিতদের সাথে সহজ যোগাযোগ।
  • দূরত্ব ও সময়ের সীমাবদ্ধতা অনেকটাই কমে গেছে।

২.২ তথ্যপ্রাপ্তি ও শিক্ষা

  • ইউটিউব ও এডুকেশনাল ব্লগ/পেজ থেকে নানা রকম শিক্ষামূলক কন্টেন্ট পাওয়া যায়।
  • প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, অনলাইন কোর্স, নতুন দক্ষতা শেখা – সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সহজ হয়েছে।

২.৩ ক্যারিয়ার ও ব্যবসায়িক সুযোগ

  • অনেক যুবক/যুবতী সোশ্যাল মিডিয়াকে পেশা বানিয়েছে – যেমন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইনফ্লুয়েন্সার, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার।
  • ছোট ব্যবসা ও স্টার্টআপের জন্য ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম এখন গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম।

২.৪ সামাজিক সচেতনতা

  • যুব সমাজ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সোচ্চার।
  • জলবায়ু পরিবর্তন, নারী অধিকার, পরিবেশ রক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা – এসব বিষয়ে অনলাইন ক্যাম্পেইন শক্তিশালী আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।

৩. নেতিবাচক প্রভাব

৩.১ আসক্তি

  • প্রতিদিন গড়ে ৩-৪ ঘণ্টা সময় কাটে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
  • অতিরিক্ত ব্যবহার ডোপামিন আসক্তি তৈরি করে, যা মস্তিষ্ককে তাত্ক্ষণিক আনন্দের উপর নির্ভরশীল করে তোলে।

৩.২ মনোযোগে ব্যাঘাত

  • ক্রমাগত নোটিফিকেশন, স্ক্রল করার অভ্যাস মনোযোগ ভেঙে দেয়।
  • পড়াশোনা ও প্রোডাক্টিভিটির ক্ষতি হয়।

৩.৩ মানসিক স্বাস্থ্য

  • FOMO (Fear of Missing Out) – অন্যদের জীবনের ঝলমলে ছবি দেখে নিজেকে পিছিয়ে পড়া মনে হয়।
  • হতাশা, উদ্বেগ, একাকিত্ব বেড়ে যায়।
  • সাইবার বুলিং ও অনলাইন হ্যারাসমেন্টের শিকার হয় অনেক তরুণ।

৩.৪ ভুয়ো খবর ও বিভ্রান্তি

  • সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ভুয়ো খবর ছড়ায়।
  • যুব সমাজ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

৩.৫ বাস্তব সম্পর্কের ক্ষয়

  • মুখোমুখি কথোপকথন কমে যাচ্ছে।
  • পরিবারে সময় দেওয়া কমছে।

৪. যুব সমাজের আচরণে পরিবর্তন

সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে যুবকদের জীবনে নিম্নলিখিত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে —

  • ভাষা ও যোগাযোগ: ইমোজি, শর্টকাট, মিম – নতুন এক ভাষা তৈরি হয়েছে।
  • সেলফ ইমেজ: লাইক ও ফলোয়ার সংখ্যা আত্মসম্মানকে প্রভাবিত করছে।
  • তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টির অভ্যাস: দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বদলে দ্রুত ফলাফলের দিকে ঝোঁক বাড়ছে।

৫. মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মপরিচয়

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার —

  • ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটি বাড়ায়।
  • ঘুমের সমস্যা তৈরি করে।
  • আত্মপরিচয় সংকট (Identity Crisis) তৈরি করে — কারণ অনেকে ভার্চুয়াল দুনিয়ার আদর্শ জীবনকে বাস্তব মনে করে।

৬. সমাধান ও করণীয়

৬.১ ডিজিটাল ডিটক্স

  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার।
  • “নোটিফিকেশন অফ” করে রাখা।

৬.২ সচেতন ব্যবহার

  • কোন তথ্য শেয়ার বা বিশ্বাস করার আগে যাচাই করা।
  • ইতিবাচক ও শিক্ষামূলক কন্টেন্টে সময় ব্যয় করা।

৬.৩ বাস্তব সম্পর্কের গুরুত্ব

  • পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো।
  • অফলাইন হবি বা খেলাধুলায় অংশগ্রহণ।

৬.৪ নীতিনির্ধারক ও শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা

  • স্কুলে ডিজিটাল লিটারেসি শিক্ষা।
  • সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর উপর কঠোর নিয়ম, যাতে ভুয়ো খবর ও হেট স্পিচ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৭. ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ

সোশ্যাল মিডিয়া পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বরং এর সঠিক ব্যবহার শিখতে হবে।

  • ভবিষ্যতে AI ভিত্তিক কন্টেন্ট ফিল্টার ব্যবহার বাড়বে।
  • মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে আরও প্রচার হবে।
  • যুব সমাজ যদি সোশ্যাল মিডিয়াকে কেবল বিনোদনের জন্য নয়, শিক্ষার ও উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তবে এটি আশীর্বাদ হতে পারে।

উপসংহার

সোশ্যাল মিডিয়া আজকের যুব সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি একদিকে যেমন তথ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সংযোগ এনে দিচ্ছে, অন্যদিকে আসক্তি, মানসিক চাপ, বিভ্রান্তি ও একাকিত্বও বাড়াচ্ছে।

তাই প্রয়োজন সচেতনতা ও ভারসাম্য

  • যুব সমাজকে ডিজিটাল মিডিয়ার সুফল গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য ও বাস্তব সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
  • পরিবার, শিক্ষক ও সরকারকে একসাথে কাজ করতে হবে যাতে সোশ্যাল মিডিয়া এক শক্তিশালী উন্নয়নমূলক মাধ্যম হয়ে ওঠে, ধ্বংসাত্মক নয়।
Share This
Categories
গল্প

অন্ধকারে লুকানো সত্য (রহস্য গল্প)।

(একটি পূর্ণাঙ্গ রহস্য গল্প)

১. প্রথম সতর্কবার্তা

পার্থ মুখার্জি কলকাতার এক পুরোনো বাড়িতে একা থাকে। বাড়িটা তার ঠাকুরদার সময়ের, প্রায় একশো বছরের পুরোনো। সেদিন সকালে ডাকবাক্স খুলতেই সে দেখতে পেল একটি হলুদ খামের চিঠি। খামের উপর কাঁপা হাতের লেখা —
“আজ রাত বারোটার আগে বাড়ির ঘড়ি থামিয়ে দিও। না হলে বিপদ আসবে।”

চিঠি পড়ে পার্থর শরীরে কাঁটা দিল। কে লিখল এই চিঠি? কেন লিখল? সে জানে তার বাড়ির দোতলায় ঝোলানো ঘড়িটা অনেক বছর ধরে বন্ধ।

দিনভর তার মাথায় এই রহস্য ঘুরপাক খেতে লাগল। সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির ভিতর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। পার্থ বারবার সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ছে।

২. অদ্ভুত শব্দ

রাত বাড়তে থাকল। ঠিক ১১টা নাগাদ হঠাৎ দোতলার দিক থেকে টিক-টিক শব্দ শোনা গেল।
পার্থ থমকে দাঁড়াল।
— “অসম্ভব! ওই ঘড়ি তো নষ্ট…”

টর্চ হাতে নিয়ে দোতলায় উঠতেই তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করেছে।

ঘড়ির কাচের ভেতরে তার নিজের মুখ দেখল, কিন্তু মনে হল আরেকটি ছায়া দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। টর্চের আলো ফেলতেই ছায়া মিলিয়ে গেল।

৩. দেয়ালের পেছনের ঘর

ঠিক তখনই দেয়ালের পেছন থেকে ফাঁপা শব্দ এল। পার্থ টর্চ দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে দেয়ালের একটা অংশ ঠুকল। হঠাৎ একটা গোপন দরজা খুলে গেল। ভেতরে ছোট্ট একটা ঘর, ধুলো জমে আছে, কিন্তু সেখানে রাখা একটি টেবিলের উপর পুরোনো ডায়েরি আর কিছু দলিল।

ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা —
“আমি এই বাড়ির আগের মালিক অমরেশ মুখার্জি। আমাকে আমার আপন ভাই খুন করেছে এই বাড়ির সম্পত্তির জন্য। আমার দেহ এই ঘরের মেঝের তলায় লুকানো আছে। আমার আত্মা মুক্তি চাই।”

পার্থর গলা শুকিয়ে গেল। সে সাথে সাথে পুলিশের খবর দিল।

৪. তদন্ত শুরু

পরের দিন সকালেই ইন্সপেক্টর সুদীপ সরকার এলেন। অভিজ্ঞ অফিসার, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
— “আপনি বলছেন ঘড়ি নিজে থেকে চলতে শুরু করেছে?”
পার্থ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ স্যার, আর এই ডায়েরিটা পেয়েছি।”

দলিল আর ডায়েরি দেখে সুদীপ গম্ভীর হলেন।
— “আমরা ঘরের মেঝে খুঁড়ব। যদি হাড়গোড় পাওয়া যায় তবে এটা খুনের মামলা।”

মেঝে খুঁড়তেই সত্যিই একটি কঙ্কাল পাওয়া গেল। বাড়ি হইচই পড়ে গেল। খবর ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায়।

৫. অতিপ্রাকৃত ইঙ্গিত

সেই রাতে পার্থ আবার সেই ছায়া দেখল। এবার ছায়াটি তাকে হাতের ইশারায় অন্য ঘরের দিকে ডাকল। পার্থ ভয় পেলেও সাহস করে গেল। সেখানে একটি ছোট কাঠের বাক্স পেল। বাক্সের ভিতরে পুরোনো নথি আর একটি রুপোর চেইন।

পরদিন ইন্সপেক্টরকে বাক্সটি দেখানো হল। নথির মধ্যে ছিল বাড়ির পুরোনো দলিল, যেখানে দেখা গেল অমরেশ মুখার্জির মৃত্যুর পর সম্পত্তি বেআইনি ভাবে তার ভাই অর্জুন মুখার্জির নামে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সুদীপ বললেন,
— “এখন স্পষ্ট, অর্জুন খুন করেছে। কিন্তু সে তো বহু বছর আগে মারা গেছে। খুনের পেছনে আর কেউ ছিল কি?”

৬. নতুন সন্দেহভাজন

তদন্তে জানা গেল অর্জুনের নাতি রাজীব মুখার্জি সম্প্রতি বাড়ির দখল নিতে চেয়েছিল। পার্থর কাছে চিঠি লিখে বাড়ি ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিল।

পার্থ মনে পড়ল— সেই চিঠির হাতের লেখা! চিঠি আর রাজীবের পুরোনো স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখতেই বোঝা গেল দুটোই এক।

সুদীপ পুলিশ টিম নিয়ে রাজীবকে গ্রেপ্তার করল। রাজীব স্বীকার করল যে সে জানত তার দাদু অমরেশকে খুন করেছে। সে এই সত্যিটা চিরতরে গোপন রাখতে চেয়েছিল, তাই পার্থকে ভয় দেখাতে চিঠি লিখেছিল।

৭. চূড়ান্ত মুখোমুখি

রাজীবকে নিয়ে বাড়িতে পুনর্নির্মাণ চলছিল। ঠিক তখনই ঘড়ি আবার বাজতে শুরু করল। হঠাৎ জানলা বন্ধ হয়ে গেল, ঘর অন্ধকার। সবাই দেখল এক ফ্যাকাশে ছায়ামূর্তি রাজীবের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজীব চিৎকার করে উঠল,
— “আমার দোষ নেই! আমি খুন করিনি!”

ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটায় থেমে গেল। যেন আত্মা শান্তি পেল।

৮. ন্যায়বিচার

রাজীবকে আদালতে তোলা হল। ডায়েরি, দলিল আর পার্থর সাক্ষ্য মিলে মামলায় প্রমাণ হল অমরেশকে খুন করেছিল অর্জুন। আদালত পার্থর নামে বাড়ির সম্পত্তির অধিকার ফিরিয়ে দিল।

ইন্সপেক্টর সুদীপ পার্থকে বললেন,
— “আপনি কেবল বাড়ির মালিক নন, আপনি ইতিহাসের সাক্ষী। আপনি যদি সাহস না করতেন, অমরেশ মুখার্জির আত্মা আজও শান্তি পেত না।”

৯. সমাপ্তি

রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝলমল করছে। পার্থ দোতলায় দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ি থেমে আছে, কিন্তু বাড়ি আর অদ্ভুত নয়। যেন শান্তি ফিরে এসেছে।

পার্থ ভাবল,
— “এই বাড়ি শুধু আমার নয়। এখানে এক ইতিহাস আছে, এক রক্তাক্ত অতীত আছে। এখন আমি সেই অতীতের রক্ষক।”

সে টেবিলে ডায়েরিটা রাখল, যেন ভবিষ্যতের জন্য প্রমাণ হয়ে থাকে। বাইরে হাওয়ায় যেন একটুখানি ধন্যবাদসূচক ফিসফিসানি শুনল।

 

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

তুংনাথের পথে – এক অবিস্মরণীয় যাত্রা।

১. যাত্রার শুরু

সকালবেলায় কলকাতার হাওড়া স্টেশন।
প্ল্যাটফর্ম ভরতি মানুষের কোলাহল, গরম চা আর খবরের কাগজের গন্ধ—যেন এক বিশেষ ভ্রমণের ডাক।
আমরা চারজন বন্ধু—আমি, অর্ক, স্নিগ্ধা আর রোহন—নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়িয়ে আছি।
আজ থেকে শুরু হচ্ছে আমাদের বহু প্রতীক্ষিত উত্তরাখণ্ড ভ্রমণ।

গন্তব্য—তুংনাথ
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু শিবমন্দির। পাহাড়ের কোলে বসে থাকা এক দেবালয়, যার পথও এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।


২. প্রথম গন্তব্য – হরিদ্বার ও ঋষিকেশ

ট্রেনে রাত কাটিয়ে সকালে পৌঁছলাম হরিদ্বারে।
সকালবেলার গঙ্গার ঘাট যেন স্বর্গীয় দৃশ্য—হালকা কুয়াশা, ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের গন্ধ।
আমরা সকলে মিলে গঙ্গাজলে হাত ডুবিয়ে প্রণাম করলাম। মনে হল, ভ্রমণের শুরুতেই আশীর্বাদ পেয়ে গেলাম।

তারপর ছোট্ট বাসযাত্রা করে পৌঁছলাম ঋষিকেশ।
লক্ষ্মণ ঝুলা পার হওয়ার সময় গঙ্গার গর্জন কানে আসছিল।
স্নিগ্ধা ছবি তুলতে ব্যস্ত, অর্ক বলল—
— “দেখো না, আমরা যেন অন্য দুনিয়ায় এসে পড়েছি!”

ঋষিকেশের নিরিবিলি ক্যাফেতে বসে গরম কফি খেলাম। পাহাড়ি বাতাসে ক্লান্তি উড়ে গেল।


৩. চন্দ্রশিলা ট্রেকের সূচনা

পরদিন সকালে আমরা গাড়িতে করে পৌঁছলাম চোপতা।
এখান থেকেই শুরু হবে তুংনাথ ট্রেক।
চোপতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে মনে হয়, প্রকৃতি এখানে নিজের হাতে ছবি এঁকেছে—
সবুজ তৃণভূমি, বরফে ঢাকা দূরের শৃঙ্গ, আর পাখিদের গান।

ট্রেক শুরু করতেই প্রথমেই বোঝা গেল—এটা সহজ হবে না।
রাস্তা ঢালু, শ্বাস নিতে কষ্ট, কিন্তু দৃশ্য এত সুন্দর যে কষ্ট ভুলে যাচ্ছিলাম।
পথে দেখা পেলাম পাহাড়ি গ্রামের ছোট্ট বাচ্চাদের। তাদের হাসি যেন পাহাড়ের ঝর্ণার মতো স্বচ্ছ।


৪. তুংনাথ মন্দিরে পৌঁছানো

প্রায় তিন ঘণ্টার চড়াই পেরিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম তুংনাথ মন্দিরে।
এখানে দাঁড়িয়ে মনে হল—মেঘের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি।
নীচে সবুজ উপত্যকা, উপরে নীল আকাশ আর চারপাশে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ।

মন্দির ছোট্ট, কিন্তু শান্তির অনুভূতি অসীম।
মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, ঠান্ডা হাওয়া, আর পাহাড়ের নীরবতা—সব মিলে মনে হল যেন শিব স্বয়ং এখানে বিরাজমান।

আমরা চারজনই মন্দিরের সিঁড়িতে বসে চা খেলাম।
ক্লান্ত শরীরের মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি ফিরে এল।
এমন মুহূর্তে মনে হয়—এই কষ্টটাই তো আসল আনন্দের মূল্য।


৫. চন্দ্রশিলার শীর্ষে

মন্দির থেকে আরও এক ঘণ্টার ট্রেক করে আমরা পৌঁছলাম চন্দ্রশিলার শীর্ষে।
সেখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ—নন্দাদেবী, ত্রিশূল, চৌখাম্বা, কেদারনাথের শৃঙ্গ—সব একসঙ্গে দেখা যায়।

রোহন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম—
— “কি ভাবছিস?”
সে হেসে বলল—
— “মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন আজ।”

আমি মনে মনে ভাবলাম, এ সত্যিই এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায়।


৬. ফেরার পথে অনুভূতি

নামার সময় সূর্যাস্ত হচ্ছিল।
আকাশে কমলা-গোলাপি রঙের মেলা বসেছে।
মনে হচ্ছিল পাহাড় আমাদের বিদায় জানাচ্ছে।

চোপতায় ফিরে আমরা আগুন জ্বালিয়ে বসে গান গাইলাম, গল্প করলাম।
সেই রাতের তারা ভরা আকাশ আজও আমার মনে সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি হয়ে আছে।


গল্পের সারমর্ম

তুংনাথ ভ্রমণ আমাদের শিখিয়েছে—
জীবনের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় তখনই, যখন কষ্টকে জয় করে এগিয়ে যেতে পারো।
পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছিল নতুন এক অনুভূতি।

এই ভ্রমণ কেবল একটি ট্রেক ছিল না—এটা ছিল এক আত্মঅন্বেষণ।
আজও যখন চোখ বন্ধ করি, মনে হয় আমি সেই তুংনাথের সিঁড়িতে বসে আছি, আর দূরে নীল আকাশে ভেসে যাচ্ছে মেঘের দল।

 

Share This
Categories
গল্প

শেষ ট্রেনের অপেক্ষা।

১. শুরুটা – এক ট্রেনস্টেশনের গল্প

রাত তখন প্রায় দশটা। শহরের শেষ ট্রেন ধরার জন্য ভিড় কমতে শুরু করেছে। হাওয়া ঠান্ডা, রেললাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ধরনের বিষণ্ণ নীরবতা।
স্টেশনের বেঞ্চে বসে আছেন অনির্বাণ—চোখের সামনে কুয়াশা, হাতে এক কাপ চা। মনটা তার আজ বড় খারাপ। অফিসে আবারও প্রোমোশনটা পায়নি, তার ওপরে আজ ছিল বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। দিনভর ব্যস্ততার ভিড়ে মন খারাপটাকে চাপা দিতে পেরেছিল, কিন্তু এই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে এসে হঠাৎ যেন সবটাই আবার মনে পড়ল।

ঠিক তখনই, পাশের বেঞ্চে বসে পড়ল এক মেয়ের ছায়া।
গায়ে হালকা নীল শাল, হাতে মোবাইল। চুলগুলো খোলা, যেন বাতাসে খেলা করছে। মেয়েটির চোখেমুখে একটা অদ্ভুত শান্তি, অথচ চাহনিতে ছিল গভীর কষ্ট।

অনির্বাণ খানিক তাকিয়ে আবার নিজের চায়ের দিকে মন দিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটিই কথা শুরু করল—
— “মাফ করবেন, শেষ ট্রেনটা ক’টায় আসে জানেন?”

অনির্বাণ একটু চমকে তাকাল।
— “দশটা পঞ্চাশে। তবে আজ ট্রেন লেট হবে শুনলাম।”

মেয়েটি হেসে মাথা নাড়ল।
— “আচ্ছা, ধন্যবাদ।”

এতটুকুই পরিচয়। কিন্তু অনির্বাণের মনে হল, সে মেয়েটির মুখের হাসিটা আবার দেখতে চায়।


২. পরিচয় – কথার সূত্রপাত

ট্রেন লেট হওয়ার কারণে, তারা ধীরে ধীরে কথায় জড়িয়ে গেল।
মেয়েটির নাম ইশানি। সে পাশের শহরে স্কুলশিক্ষিকা। আজ এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল, ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।

অনির্বাণ জানাল, সে এক আইটি কোম্পানিতে কাজ করে, অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে এখানে ট্রেনের অপেক্ষা করছে।

কথার পর কথায় তারা দু’জনের জীবন খুলে গেল যেন—
ইশানি জানাল, সে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার জন্য একাই থেকে এসেছে। বাবা-মা গ্রামে থাকেন। তার জীবনটা সোজাসাপ্টা, কিন্তু কখনও কখনও একাকিত্ব খুব কষ্ট দেয়।
অনির্বাণ বলল, তার মা অনেক বছর আগে মারা গেছেন, বাবার সঙ্গেই বড় হয়েছে। বাবাই তার জীবনের অনুপ্রেরণা ছিলেন।

দুজনেই অনুভব করল—কোনো এক অদ্ভুত মিল আছে তাদের মধ্যে।
যেন দুজনেই একই রকম শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে।


৩. বন্ধুত্ব – অজানা টান

ট্রেন এল, দুজনেই পাশাপাশি বগিতে উঠল।
স্টেশনে পৌঁছে তারা নম্বর বিনিময় করল না। কিন্তু দুজনেরই মনে হল—এটাই কি শেষ দেখা?

কিন্তু ভাগ্যও যেন চুপিচুপি হেসে ছিল।
কয়েকদিন পর অনির্বাণ আবার স্টেশনে ইশানিকে দেখতে পেল।
সেই থেকে তাদের পরিচয় গভীর হতে থাকল। ফোন নম্বরও বিনিময় হল, কখনও একসঙ্গে চা খেল, কখনও বইয়ের দোকানে গেল।

ধীরে ধীরে তারা একে অপরের জীবনের গল্পে ঢুকে গেল।
অনির্বাণের ক্লান্ত সন্ধ্যাগুলোতে ইশানির ফোন যেন আলো হয়ে এল।
ইশানির একাকী রাতগুলোতে অনির্বাণের মেসেজ তাকে হাসিয়ে তুলল।


৪. ভালোবাসা – অব্যক্ত অনুভূতি

এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টি পড়ছে ঝরঝর করে।
স্টেশনের ছাদে দাঁড়িয়ে দুজনে ভিজে ভিজে গল্প করছে।
হঠাৎ ইশানি বলল—
— “তুমি কি কখনও কাউকে খুব মিস করো? এমন মিস, যা বুকের ভেতরটা ভারী করে দেয়?”

অনির্বাণ চুপ করে রইল।
তার মনে পড়ল তার বাবা-মা, তার একাকী ঘর।
কিন্তু আজ যেন মনে হল, এই মেয়েটির জন্যও এমন একটা মিস সে বোধ করছে।

— “হ্যাঁ,” ধীরে ধীরে বলল অনির্বাণ।
— “আর সেই মিসটা আজ তোমাকে দেখেই হচ্ছে।”

ইশানি অবাক হয়ে তাকাল, তারপর হেসে ফেলল।
কিন্তু চোখের কোণে ছোট্ট একটা অশ্রুবিন্দু চিকচিক করল।

সেই রাতে বাড়ি ফিরে ইশানি ডায়েরিতে লিখল—
“হয়তো এটাই প্রেম।”


৫. বাঁক – জীবনের পরীক্ষা

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।
হঠাৎ একদিন ইশানির বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ইশানিকে গ্রামে ফিরে যেতে হল। সে আর শহরে ফিরল না।

অনির্বাণ ফোন করত, কিন্তু ইশানি খুব কম উত্তর দিত।
দুজনের দূরত্ব যেন বাড়তে থাকল।

মাস কেটে গেল।
একদিন হঠাৎ খবর এল—ইশানির বিয়ে ঠিক হয়েছে।

সেদিন রাতে অনির্বাণ স্টেশনে বসে কেঁদে ফেলল।
যে প্ল্যাটফর্মে তাদের প্রথম দেখা, আজ সেইখানেই তার মনে হল সবকিছু ফাঁকা।


৬. সমাপ্তি – শেষ ট্রেনের অপেক্ষা

দিন যায়। ইশানির বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে।
অনির্বাণ চেষ্টা করেও দেখা করতে যায়নি।

বিয়ের আগের রাতে হঠাৎ অনির্বাণ ট্রেনস্টেশনে গেল।
এবারও রাত দশটা বেজে গেছে।
কিন্তু আজও সে মনে মনে চাইল—যেন একবার ইশানিকে দেখতে পায়।

ঠিক তখনই, প্ল্যাটফর্মের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ইশানিকে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
চোখে জল, কিন্তু মুখে এক আশ্চর্য হাসি।

— “আমার বিয়ে হচ্ছে ঠিকই,” বলল ইশানি।
— “কিন্তু জানো, আমি আজ এখানে এসেছি শুধু তোমাকে একবার দেখতে।
তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি।”

অনির্বাণ কিছু বলল না।
শুধু বলল—
— “তুমি সুখে থেকো।”

ট্রেন এল।
ইশানি উঠে গেল বগিতে।
অনির্বাণ তাকিয়ে রইল।
শেষ ট্রেন চলে গেল।

কিন্তু অনির্বাণ জানল—তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা, যদিও হারিয়ে গেল, তবুও তাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিয়ে গেল।


গল্পের সারমর্ম

ভালোবাসা সবসময় পেতে হয় না।
কখনও কখনও ভালোবাসা মানে কেবল সেই মানুষটির সুখের প্রার্থনা করা, দূর থেকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়া।
অনির্বাণের কাছে ইশানি রয়ে গেল সেই শেষ ট্রেনের মতো—যে ট্রেন হয়তো আর কখনও ধরা যাবে না, কিন্তু যার হুইসেল চিরকাল তার মনে বাজতে থাকবে।

 

Share This