আমরা জানি, নাটক সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গ । নাটক জীবনেরই সুদৃশ্য রূপায়ণ । যাকে বলে নাটক জীবনের দর্পন । মঞ্চে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাহায্যে মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা যখন সংলাপের আশ্রয়ে দর্শকের সামনে উপস্থিত করা হয়, তখন নাটক । “নাটক” শব্দটির মধ্যে রয়েছে সত্যের ইঙ্গিত । নট, নাট্য, নাটক এই তিনটি শব্দের মূল হলো নট । আর নট্ অর্থ হলো নড়াচড়া করা, অঙ্গচালনা করা, ইত্যাদি । নাটক বলতে আমরা বুঝি এমন একটা ফলিত শিল্পকলা, যা অভিনয়-মঞ্চসজ্জা-রূপসজ্জা—ধ্বনি-প্রেক্ষাপট-দর্শক দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত । নাটকের ইংরেজি প্রতিশব্দ “Drama“র মধ্যেই একই সত্য আমরা খুঁজে পাই । “Drama” শব্দের মূলে রয়েছে গ্রীক শব্দ Dracin, যার অর্থ “to-do“ অর্থাৎ কিছু করা । তাই নাটককে জীবনের দর্পন বলা হয় ।
( ২ )
বাংলা নাটকের উদ্ভব দুইশত বছরেরও পূর্বে । পাশ্চাত্য রঙ্গমঞ্চের অনুকরণে বাংলা রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হওয়ার ফলেই বাংলা নাটক বিদেশী নাটকের মৌলধর্মাবলম্বন করেই আত্মপ্রকাশ । সংস্কৃত ও ইংরেজি নাটকের অনুবাদের মধ্য দিয়েই বাংলা নাটকের সূচনা । তাই বাংলা নাটকের আবির্ভাবের সময়কাল তিনটে । ১৭৯৫ থেকে ১৮৭২ পর্যন্ত “আদি যুগ”, ১৮৭৩ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত “মধ্যযুগ” এবং ১৯০০ থেকে “আধুনিক যুগ” । যতটুকু জানা যায়, ১৭৯৫ সালের ২৭শে নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল নামক একটি বাংলা অনুবাদ — প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চস্থ হয় (কলকাতা ডোমতলায়) । আবার কোথাও জানা যায়, বাংলা নাটক প্রথম মঞ্চে অভিনীত হয় ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে । এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, “শর্মিষ্ঠা”কে (১৮৫৯) প্রথম সার্থক ও আধুনিক নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় , যার রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত । পরবর্তীকালের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটকের নাম এখানে দেওয়া হলো । যেমন রামনারায়ণ তর্করত্নের “কুলীনকুলসর্বস্ব”, মধুসূদন দত্তের “কৃষ্ণকুমারী” ও “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো”, দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পন”, গিরিশ চন্দ্র ঘোষের “প্রফুল্ল”, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের “সাহাজাহান”, ইত্যাদি ।
বাংলা সাহিত্যে বাংলা “নাটক”এর উদ্ভব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । জীবনকে প্রত্যক্ষ দেখতে, জানতে, বুঝতে নাটকের বিকল্প নেই । নাটক মানুষের জীবন নিয়ে রচিত । তাই সমাজের জীবনের নানা সমস্যা ও সংকটের শিল্পীত রূপ নাটকে প্রতিফলিত হচ্ছে । বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হচ্ছে বাংলা নাটক । গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ সাহিত্যের এইসব বিচিত্র শাখার মধ্যে নাটক এখন জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম । নাটক হচ্ছে একইসঙ্গে দেখার ও শোনার বিষয় ।
( ৩ )
এবার দেখা যাক, আগেকারদিনে নাটকের উৎপত্তি কীভাবে ঘটলো । নাটক শব্দ একটি গ্রীক শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ “কাজ” বা “কাজ” যা “I do” থেকে নেওয়া । নাটকের সাথে যুক্ত দুটি মুখোশ কমেডি এবং ট্রাজেডির মধ্যে প্রচলিত জেনেরিক বিভাজনের প্রতিনিধিত্ব করে । যাই হোক পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার হলেন প্রাচীন গ্রীকরা । প্রাচীন গ্রীকদের জন্য নাট্য রচনার সাথে জড়িত ছিল পোয়েসিস, অর্থাৎ নির্মিত কাজ (poesis — the act of making) । খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে অ্যারিস্টটল নাটকের উপাদানগুলি বিবেচনা করেছিলেন — প্লট (mythos), চরিত্র (ethos), চিন্তা (dianoia i.e. thought), ডিকশন (lexis), সঙ্গীত (melodia ), ইত্যাদি । চরিত্র পছন্দ এবং কর্মধারা নির্ধারিত হয় ট্রাজেডি যেটা হলো মাইমেসিস – একটি কাজের অনুকরণ যা গুরুতর (Tragedy is mimesis – “the imitation of an action that is serious.) অ্যারিস্টটল স্থান-কাল-পাত্রের সুসম ঐক্যের কথা বলেছেন ।
এবার আসছি নাটকের উপাদান বলতে আমরা কী বুঝি ? আগেই বলি — বিষয় ও পরিণতির দিক থেকে নাটক দুই প্রকার – বিয়োগান্তক নাটক (Tragedy) এবং মিলনান্তক নাটক (Comedy) । উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম মূল ভাবনা, প্লট, চরিত্র, সংলাপ, দৃশ্য ও সঙ্গীত । অন্যদিকে নাটকের শ্রেণী বিভাগ যেমন — ভাব সংবেদনা রীতি অনুসারে (ট্রাজেডি, কমেডি,), বিষয়বস্তুর উৎসরীতি অনুসারে (পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, পারিবারিক), বৈশিষ্ট্য অনুসারে (গীতিনাট্য বা অপেরা, নৃত্যনাট্য ), আয়তন অনুসারে (মহানাটক, নাটক), গঠনরীতি অনুসারে (ক্লাসিক্যাল, রোমান্টিক), রচনারীতি অনুসারে (পদ্যনাটক, গদ্যনাটক), ইত্যাদি ।
( ৪ )
পরিশেষে বলা যায়, বাংলা নাটক এখন অনেক বেশী জনপ্রিয় । যদিও দর্শকদের রুচির পরিবর্তনের সাথে সাথে নাট্য ভাবনার, নাটকের প্লটের পরিবর্তন ঘটছে এবং সমান তালে দর্শকও বাড়ছে । ইদানীং আঞ্চলিক ভাষার নাটকের কদর বাড়ছে । সম্পূর্ণ মহিলাদের নিয়ে নাট্য গ্রুপ “সেঁজুতি” ভাল কাজ করছে, যার প্রভাব সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ছে । সুতরাং বাংলা সংস্কৃতিতে বাংলা নাটকের কদর দিন দিন বাড়বে বই কমবে না । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত) ।
 
		 
								 
						 
						