Categories
প্রবন্ধ বিবিধ

ছাগ বলি বিতর্কে ফের আদালতের দ্বারস্থ পশুপ্রেমীরা, তবুও ঐতিহ্য ধরে রাখছে বোল্লা কালী পুজো।

বালুরঘাট, নিজস্ব সংবাদদাতা : – প্রত্যেক বছর মত এবছরও রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার বালুরঘাটের বোল্লা এলাকায় উত্তরবঙ্গের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহি বোল্লা রক্ষাকালীর পুজো অনুষ্ঠিত এদিন শুরু হল। এই বোল্লা রক্ষাকালীর পুজো। পুজোর পাশাপাশি চারদিন মেলাও বসে। প্রতি বছর বোল্লা মায়ের পুজো ও মেলায় লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয়।মেলা উপলক্ষে বসানো হয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প । মহিলা পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়ার, সাদা পোশাকের পুলিশ, পুলিশ আধিকারিক-সহ প্রায় দেড় হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়ে থাকে এই কদিন মেলাকে ঘিরে।স্বাভাবিক ভাবেই, মন্দির কমিটি এবং জেলা প্রশাসন ও পুলিশ মেলার নিরাপত্তা-সহ আগত ভক্তদের সুবিধার্থে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে ।পাশাপাশি প্রচুর সিসি ক্যামেরার মধ্যমে এই মেলাকে মুড়ে ফেলে

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা। জেলার সদর শহর বালুরঘাট শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে বোল্লা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহ্য ও মাহাত্ম্য সমৃদ্ধ রক্ষা কালী মাতা মন্দির। যা উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বোল্লা কালী পুজো ও মন্দির। এই মাতা বোল্লা কালী মাতা বলেই সুপ্রসিদ্ধ।

রাসপূর্ণিমার পরবর্তী শুক্রবারে মায়ের বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় ও সোমবারে মায়ের বিসর্জন হয়। এই কয়েকদিন যাবত মায়ের পুজোকে ঘিরে বিশাল মেলা হয়।উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের রাস মেলার পর এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা হিসেবে বিবেচিত।দুই দিনাজপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলা ও রাজ্য, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও বহু মানুষ এই পুজো দেওয়ার পাশাপাশি মেলা দেখতে আসেন। পজোর দিন সারাদিন সারা রাত জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুন্যার্থীদের বোল্লাতে আসার জন্য বেসরকারি পরিবহন চলাচল করে থাকে।এর পাশাপাশি রেলের তরফে বালুরঘাট থেকে কলকাতাগামী ও শিলিগুড়িগামী এক্সপ্রেস ট্রেন গুলি অস্থায়ী ভাবে বোল্লার পাশ দিয়ে যাওয়া রেল লাইনে স্টপেজ দেওয়া হয়।সোমবার বিসর্জনের দিন বিশেষ করে পুজোকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় বউ মেলা।

কথিত আছে, জনৈক এক ব্যক্তি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুকুর থেকে মায়ের শিলাময় রূপটি উদ্ধার করেন ও প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পূজা শুরু করেন। এই সময়ে মাকে ‘মরকা কালী’ বলে অভিহিত করা হত। প্রতি জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় হত মায়ের বিশেষ পূজা। এরপর ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার মুরারিমোহন চৌধুরী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ঘটনাক্রমে বহু গ্রামবাসী সহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তিনি মড়কা কালী মায়ের কাছে প্রার্থনা করেন। তিনি বেকসুর খালাস পান। জ্যৈষ্ঠ মাস আসতে দেরি থাকায়; সেই সময় তিনি ধার্য করেন যে, রাস পূর্ণিমার পরবর্তী শুক্রবারে মায়ের পুজো করবেন। সেই থেকে দেবীর বাৎসরিক পুজো ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

বর্তমানে সাড়ে সাত হাত মাতৃমূর্তি পূজিত হন। কয়েক হাজার পাঁঠাবলি ও একটি মহিষ বলি হয়। প্রায় ১৪ কেজি সোনার গহনায় মায়ের প্রতিমা সজ্জিত হয়।মায়ের হাতের খড়গ থেকে পুরো শরীর পর্যন্ত সোনার গয়নায় মোড়া থাকে। পাশাপাশি বহুমুল্যের হীরের গহনাও মায়ের অংগে শোভা পায়।সোনা হীরে গহনা সব ভক্তদের দান।এছাড়াও বহু ভক্ত মানত করা ছোট ছোট কালী মূর্তিতে পূজা দেন ও বাতাসা নৈবেদ্য অর্পণ করেন। স্থানীয় মুসলিমরাও হিন্দুদের সাথে মায়ের উদ্দ্যেশ্যে পুজো দেন। বল্লভ মুখোপাধ্যায় বলে কোনো জমিদারের নাম থেকে অঞ্চলটির নাম হয় বোল্লা। বোল্লা গ্রামে অবস্থিত রক্ষা কালী মাতা ‘বোল্লা রক্ষা কালী’ বা ‘বোল্লা কালী’ নামে ভক্ত মহলে সুপ্রসিদ্ধ। আর সে থেকেই বোল্লা কালী মাতার পুজো হয়ে আসছে ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহ।

বোল্লা পুজোর অন্যতম ভোগ বাতাসা বা মিষ্টান্ন ভোগ। পুজোর কয়েক দিনে কয়েক হাজার কুইন্টাল বাতাসা বিক্রি হয়। জেলা সহ বাইরে থেকে বাতাসা বিক্রেতারা বোল্লা মেলায় পসরা সাজিয়ে বসেন।বোল্লার রক্ষাকালী মাতার পুজো উপলক্ষ্যে চলে বিশেষ কদমা ও বাতাসা লুট । বোল্লার বিখ্যাত-বাতাসা, কদমা, চিনির তৈরি বিভিন্ন পুতুল লুটের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন ভক্তরা । লুটের সময় আঘাত থেকে বাঁচতে হেলমেট দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে পুজো কমিটির সদস্যরা।
তবে বোল্লা মায়ের পুজোতে ভক্তরা মায়ের কাছে মানত করা মনের কামনা পুরন করার জন্য ছাগ বলি মানত করে থাকেন। পুজোর দিন কয়েক বছর আগেও হাজারের উপর ছাগ বলি দেওয়া হতো। কিন্তু বিগত তিন চার বছর আগে পুশুপ্রেমীরা মন্দির কমিটি ও ভক্তদের কাছে ছাগ বলি না দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। তারপরেও অনেক ভক্ত তা না মানায় পশু প্রেমীদের তরফে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করা হয়। কিন্তু তারপরেও পশু বলি বন্ধ করা যায় নি। এবারও পশুপ্রেমীরা ফের আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে।এখন দেখার এবার কি হয়।যদিও এই বিষয়ে মেলা কমিটির সদস্য গৌতম চক্রবর্তী জানান, বিষয়টি নিয়ে মন্দির কমিটিও উদ্বিগ্ন। তারা আদালতের নির্দেশ মেনেই সব করে থাকবেন।কিন্তু সব চেয়ে দরকার ভক্তদের এব্যাপারে সচেতন করা।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *