Categories
প্রবন্ধ

বরবরিকা ও শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ : ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে কৃষ্ণের পরীক্ষা — একটি বিস্ময়কর ঘটনা।।

🔶 ভূমিকা

মহাভারতের একটি অনুল্লেখিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন বরবরিকা। তিনি ছিলেন মহাবীর ভীমের পৌত্র, ঘটোৎকচের পুত্র এবং এক অতুলনীয় যোদ্ধা। তাঁর তিনটি অদ্ভুত অস্ত্রবিশিষ্ট তীক্ষ্ণ বাণ (তিনটি তীর) এবং অদম্য প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ নিতে বের হন। কিন্তু যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে তাঁকে এক বিচিত্র পরীক্ষার মুখোমুখি করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, যিনি তখন পাণ্ডবদের কৌশলী সাথী।


🔶 বরবরিকার প্রতিজ্ঞা

বরবরিকা শপথ নিয়েছিলেন, “আমি যুদ্ধে দুর্বল পক্ষের পাশে দাঁড়াবো।”
তিনি বলেছিলেন, “যে পক্ষ যুদ্ধে দুর্বল ও পরাস্ত হতে চলেছে, আমি তার সাহায্যে দাঁড়াবো, আর এভাবে একের পর এক পক্ষ বদলে বদলে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আমিই অবশিষ্ট থাকব।”

এই প্রতিজ্ঞার ভয়াবহ প্রভাব উপলব্ধি করেছিলেন কৃষ্ণ, কারণ বরবরিকার এই নিরপেক্ষ নীতিই আসলে সমগ্র যুদ্ধে বিভীষিকাময় ফল আনতে পারত।


🔶 কৃষ্ণের ছদ্মবেশে পরীক্ষা

যুদ্ধে যাওয়ার পথে বরবরিকা কুরুক্ষেত্র পেরোচ্ছিলেন। সেখানে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশে কৃষ্ণ তাঁর পথ রোধ করেন।

কৃষ্ণ (ব্রাহ্মণ রূপে) বরবরিকাকে প্রশ্ন করেন:

  • “তুমি এত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কোথায় যাচ্ছ?” বরবরিকা উত্তর দেন:
  • “আমি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ নিতে যাচ্ছি। দুর্বলপক্ষের সহায় হব।”

কৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞাসা করেন:

  • “তোমার কাছে তো মাত্র তিনটি তীর, এত বড় যুদ্ধে এই তিনটি তীর দিয়ে কী করবে?”

বরবরিকা বলেন:

  • “এই তিনটি তীর যথেষ্ট। একটিতে আমি শত্রুদের চিহ্নিত করবো, দ্বিতীয়টি সব শত্রুদের ধ্বংস করবে, আর তৃতীয়টি আমার তূণে ফিরে আসবে। কোনো শত্রু এই তীরের হাত থেকে রেহাই পাবে না।”

🔶 কৃষ্ণের বিস্ময় ও পরীক্ষা

বরবরিকার শক্তি যাচাই করতে কৃষ্ণ তাঁকে একটি পরীক্ষা নিতে বলেন।
তিনি একটি পিপল গাছ দেখিয়ে বলেন:

  • “এই গাছে অসংখ্য পাতা রয়েছে। তুমি কি সেই গাছের পাতাগুলোতে তীর চালিয়ে নির্ভুলভাবে আঘাত করতে পারো?”

বরবরিকা প্রথম তীর ছোঁড়েন — তীর গাছের সব পাতা চিহ্নিত করে দেয়।
দ্বিতীয় তীর ছোঁড়েন — তা একে একে প্রতিটি চিহ্নিত পাতা কেটে ফেলে।

কিন্তু কৃষ্ণ তখন এক পাতা নিজের পদতলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিস্ময়করভাবে, সেই দ্বিতীয় তীর এসে তাঁর পা ঘিরে ঘুরতে থাকে যাতে লুকানো পাতাটিকে কেটে ফেলা যায়।

তখনই কৃষ্ণ বুঝলেন, এই বীর যদি যুদ্ধে অংশ নেন, তবে যুদ্ধে কেবল ধ্বংসই হবে — কোন পক্ষ বেঁচে থাকবে না।


🔶 কৃষ্ণের আবেদনে বর্বরিকার আত্মবলীদান

অবশেষে কৃষ্ণ নিজ পরিচয় দেন। তিনি বরবরিকাকে বোঝান, তাঁর এই শক্তি যুদ্ধে ভারসাম্য নষ্ট করবে।
তখন কৃষ্ণ বরবরিকার কাছে বলেন:

  • “তুমি যদি সত্যিই চাও, তবে তোমার সবচেয়ে বড় দান হতে পারে — তোমার মাথা।”

বরবরিকা সম্মত হন।
তিনি বলেন, “এক মহান যুদ্ধে আমার মাথা যদি কাজে আসে, তবে এটাই হবে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগ।”

তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর মাথা দান করেন কৃষ্ণকে।
কৃষ্ণ বরবরিকের সেই মাথা যুদ্ধ চলাকালে একটি পাহাড়ের ওপর স্থাপন করেন, যাতে তিনি সম্পূর্ণ যুদ্ধ দর্শন করতে পারেন।


🔶 খাতু শ্যাম রূপে পূজা

বরবরিকা আজকের দিনে ভারতের রাজস্থানের খাতু গ্রামে “খাতু শ্যাম” নামে পূজিত হন।
বিশ্বাস করা হয়, তাঁর মাথাটি কৃষ্ণ নিজ হাতে খাতুতে স্থাপন করেন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন:

“ভবিষ্যতে তুমি আমার নামে পূজিত হবে।”


🔶 উপসংহার

বরবরিকার এই ঘটনা শুধু এক যোদ্ধার অসাধারণ শক্তিরই নয়, বরং এক আদর্শ বীরের ত্যাগ, নৈতিকতা ও ভক্তির চূড়ান্ত নিদর্শন
তিনি ছিলেন না পাণ্ডব না কৌরব — ছিলেন সত্য, ন্যায় ও ত্যাগের প্রতীক।


📜 মনে রাখার মতো উদ্ধৃতি:
“জয় খাতু শ্যাম জি কি! যাঁর ত্যাগ আজও ভক্তদের হৃদয়ে আলো জ্বেলে রাখে।”

 

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *