ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসংখ্য নারী তাঁদের জীবন, স্বপ্ন, পরিবার ও নিরাপত্তা বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের অনেকের নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকলেও, অনেকের অবদান অজানা রয়ে গেছে। বিজয়া সেন তেমনই একজন সংগ্রামী, যিনি বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত নাম। তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক কর্মকাণ্ড, নারীর অধিকার রক্ষায় অবদান এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ড তাঁকে স্বাধীনতার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
বিজয়া সেন ১৯১০ সালের দিকে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) এক সাংস্কৃতিক ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক এবং মা ছিলেন গৃহবধূ হলেও সাহিত্য ও সংগীতপ্রেমী। ছোটবেলা থেকেই বিজয়ার মনে দেশপ্রেমের বীজ রোপিত হয়েছিল, কারণ তাঁর পরিবার ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবাপন্ন ছিল এবং বাড়িতে প্রায়ই স্বদেশী নেতাদের আলোচনা হত।
শিক্ষাজীবনে বিজয়া ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন, যা তখন নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান ছিল। এখানেই তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ শুরু করেন।
রাজনৈতিক প্রেরণা
১৯২৮ সালের সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলন এবং লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় বিজয়া গভীরভাবে প্রভাবিত হন। বেথুন কলেজে পড়াকালীন তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ছাত্র সংঘের সভায় অংশ নিতে শুরু করেন।
তবে কেবল কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না থেকে, তিনি বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর এবং বঙ্গীয় যুব সংঘ-এর সঙ্গেও গোপনে যুক্ত হন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল একদিকে গান্ধীবাদের অহিংস প্রতিরোধ, অন্যদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি—পরিস্থিতি অনুযায়ী কোন পথ গ্রহণ করা হবে, তা তিনি বাস্তবতার ভিত্তিতে বিবেচনা করতেন।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ড
বিজয়া সেন কলকাতা ও চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের সংবাদ ও অস্ত্র সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর সময় তিনি সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষার জন্য মহিলা কুরিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলেন।
তিনি একাধিকবার বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছেন, পুলিশের চোখ এড়িয়ে অস্ত্র পরিবহন করেছেন, এবং নারীর পরিচয়ের আড়ালে গোপন বার্তা বহন করেছেন। তাঁর সাহসিকতার কারণে তাঁকে সমসাময়িকরা “বেঙ্গল’স ব্রেভহার্ট” বলে ডাকতেন।
কারাবাস ও নির্যাতন
১৯৩২ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, অবৈধ অস্ত্র রাখা এবং বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য হওয়া। কারাগারে বিজয়া সেনকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
কারাগারে থেকেও তিনি অন্য বন্দিনী নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন। তিনি কারাগারে গান্ধীজীর বই পড়াতেন, নারীদের সংগঠিত করতেন এবং ব্রিটিশ শাসনের অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজসেবা
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বিজয়া সেন সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেননি, তবে সামাজিক কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেন। তিনি কলকাতায় বস্তিবাসী শিশুদের জন্য একটি বিনামূল্যের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং নারীদের স্বনির্ভর করতে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন।
তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে একাধিক প্রচারাভিযান চালান এবং একাধিক নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছে স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়—সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা।
ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ
বিজয়া সেনের ব্যক্তিত্ব ছিল দৃঢ়, স্নেহশীল এবং ন্যায়পরায়ণ। তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করতেন। তাঁর জীবনদর্শন ছিল—
“স্বাধীনতা কেবল মাটির নয়, মন ও মনের স্বপ্নেরও স্বাধীনতা।”
সমসাময়িকদের প্রশংসা
বিজয়া সেনের জীবদ্দশায় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর অবদান স্বীকার করেছেন। প্রখ্যাত বিপ্লবী অনন্ত সিং একবার বলেছিলেন—
“বিজয়া আমাদের জন্য শুধু অস্ত্র বহন করতেন না, সাহসও বহন করতেন।”
উত্তরাধিকার
আজকের দিনে বিজয়া সেনের নাম ইতিহাসের মূলধারায় খুব বেশি উচ্চারিত হয় না, কিন্তু তাঁর জীবন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। তাঁর কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, স্বাধীনতার আন্দোলনে নারী কেবল সহযাত্রী নয়, বরং নেতা ও পথপ্রদর্শকও হতে পারে।
উপসংহার
বিজয়া সেনের জীবন কাহিনী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। তিনি ছিলেন সাহসী, আদর্শবাদী, এবং মানবিক চেতনার প্রতীক। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কেবল শাসক বদল নয়, সমাজ বদল জরুরি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীর অবদান নিয়ে যখনই কথা হবে, বিজয়া সেনের নাম সেখানে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে।