Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর মধুময় কথা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীগৌরাঙ্গের পতিত-পাবন নামের সার্থক প্রমাণ হল শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই উদ্ধার লীলা। ভক্ত শিরোমণি জগাই-মাধাইয়ের অবণীতে আবির্ভাব হয় প্রভুর ইচ্ছায় দুরাচারী, অত্যাচারী, মদ্যপ ও অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরূপে। এমন কোন পাপকর্ম জগৎ-এ ছিল না, যা, তাঁরা করতেন না। চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, গোমাংস ভক্ষণ, পরের গৃহ অগ্নিদগ্ধ করা, স্ত্রী-হত্যা, ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি সব রকম অসৎকর্মই তাঁরা অবলীলায় করতেন। তবে হ্যাঁ, উল্লেখ্য যে, বৈষ্ণব অপরাধ তাঁরা কখনও করেননি। মদ্যপ সঙ্গীদের সঙ্গ সবসময় করতেন বলে বৈষ্ণব অপরাধ করার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনদিন হয়ে উঠেছিল না।
নবদ্বীপবাসী ব্রাহ্মণ শুভানন্দ রায়। নবদ্বীপের জমিদার বলেই তাঁর দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছিল। সুমিষ্ট, সৎ ব্যবহারের জন্য পাৎসাহ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তাঁর দুই পরম-সুন্দর পুত্র—–জ্যেষ্ঠ রঘুনাথ, কনিষ্ঠ জনার্দন দাস। রঘুনাথের পুত্রের নাম জগন্নাথ আর জনার্দনের পুত্র মাধব। এই জগন্নাথ ও মাধবই ওরফে ‘জগাই-মাধাই’ বলে পরিচিত ছিলেন। নবদ্বীপের কোটাল এই দুই ভাই। যদিও জগাই-মাধাইয়ের পূর্বপুরুষরা সকলেই সদাচারী ছিলেন, কিন্তু মদ্যপ-কুসঙ্গীদের পাল্লায় পরে জগাই-মাধাইয়ের চরিত্রের অবনমন ঘটে। আর সেজন্য স্বজনদের দ্বারা তাঁরা পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। ভক্তসঙ্গ কী জিনিষ তা তাঁরা জানতেনই না। মদ্যপান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি পর্যন্ত যেতেন, কখনো বা বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন, আবার কখনো অশ্রাব্য গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যেই কিল-চড়-লাথি দিতেন। লোকে তাঁদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন সব সময়। যে পথ দিয়ে জগাই-মাধাই যেতেন। দূর থেকে দেখতে পেলে সেই পথ এড়িয়ে অন্য পথ ধরতেন ভীত পথিকেরা।
এমনই একদিন প্রচুর মদ্যপান করে রাস্তায় ধুলোয় পড়ে ‘কিলাকিলি-লাথালাথি করছিলেন জগাই-মাধাই। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশে প্রতিদিন নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের প্রতি ঘরে ঘরে গমন করে মানুষকে কৃষ্ণ বলাচ্ছেন সেসময়। সেদিন তাঁরা সম্মুখীন হলেন পথে জগাই-মাধাইয়ের। দেখলেন ওভাবে মদের নেশার বিক্ষেপে তাঁদের পশুবৎ দশা। তখন পরম করুণ নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন, “ইস্! কী করুণ দশা এদের! এমন পাতকী তো কোথাও দেখিনি। আমার প্রভু গৌরাঙ্গ পাতকীদের উদ্ধার করতেই এই কলিতে এসেছেন। যদি এদের মতো পাপীদের তিনি উদ্ধার করেন, তবেই তো তাঁর পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে, তবে তো জগৎবাসী জানবে যে আমার প্রভুর মহিমা কতখানি! যাঁর ভৃত্য বলে আমরা গর্ব বোধ করি, তিনি যে কতখানি ক্ষমতা ধরেন সে প্রমাণ পাবে মানুষ তখন। না, এদেরকে ভক্তিপথে আনতেই হবে। যাঁরা ভক্ত হয় তাঁরা অতি সহজেই নাম নেয়; কিন্তু যদি এদের মত দুরাচারীকেও নাম নেওয়ানো যায়, তবেই আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সফল হবে। না হলে তো বৃথা আষ্ফালন সব আমাদের ! না, হরিদাস, আমাদের এখন প্রথম কাজ হবে এদেরকে উদ্ধার করা। অন্য জায়গায় আমরা পরে যাব। গৌরীহরিকে এদের কথা জানাবো। হরিদাস, তোমাকে যবনরা অত্যাচার করেছিল। তুমি তো তাদেরও মঙ্গল কামনা করেছিলে। এবার এদের মঙ্গল চাও। কারণ, তোমার মত ভক্তের চাওয়া ভগবান পূরণ করবেনই। এরা উদ্ধার হবে এই পাপী জীবন থেকে তবে।”
হরিদাস বললেন, “সে কী কথা! তুমি চেয়েছো যখন তখনই তো তা পূরণ হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। তোমার ইচ্ছাই যে প্রভুর ইচ্ছা। আবার আমাকে টানছো কেন!” নিত্যানন্দ একথায় হেসে প্রেমালিঙ্গন দিলেন হরিদাসকে। তারপর একটু দূর থেকে উপদেশের সুরে জগাই-মাধাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, লহ কৃষ্ণনাম। কৃষ্ণ মাতা, কৃষ্ণ পিতা, কৃষ্ণধন প্রাণ।। তোমা সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার। হেন কৃষ্ণ ভজ, সব ছাড় অনাচার।।”
কিন্তু উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হল । জগাই এমন কথা শুনে একটু মাথা তুলে প্রথমে দেখলেন, তারপরই মহাক্রোধে “ধরতো! ধরতো!” বলে ধাওয়া করলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে। “রক্ষ কৃষ্ণ, রক্ষ কৃষ্ণ” বলে নিতাই-হরিদাস কোনক্রমে জগাইয়ের প্রহারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। সে কী অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য! গর্জন করতে করতে দুই দস্যু ধাওয়া করছেন আর সামনে প্রেমে বিহ্বল দুই মহাভক্ত হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছেন।
শ্রীবাস গৃহে ভক্ত সমেত বসে আছেন বিশ্বম্ভর। নিতাই-হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সব বললেন তাঁকে। শ্রীবাস পন্ডিত ও গঙ্গাদাস জগাই-মাধাইয়ের বংশ পরিচয় দিলেন এবং তাঁদের দুষ্কর্মের আদ্যোপান্ত বর্ণনাও দিলেন। নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু, আগে তোমায় এদেরকে উদ্ধার করতেই হবে। তারপর অন্য কথা। তোমার পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে এদের পাপমোচনের দ্বারা। বিশ্ববাসী তোমার মহিমা দেখুক।” গৌরাঙ্গ হেসে বললেন, “যে মুহুর্তে তোমার দর্শন ওরা পেয়েছে, তুমি চেয়েছো ওদের উদ্ধার, সেই মুহূর্তেই ওদের সব পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু তুমি ওদের মঙ্গল চিন্তা করো, দেখবে অচিরেই কৃষ্ণ ওদের মঙ্গল সাধন করে দিয়েছেন। তোমার ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হবে।”
রাত্রিবেলায় একদিন নগর ভ্রমণ করে নিত্যানন্দ যাচ্ছেন পথ দিয়ে হেঁটে, এমন সময় জগাই-মাধাই তাঁর পথ অবরোধ করলেন। বললেন, “কে রে? কে তুই?” নিত্যানন্দ বললেন, “আমি অবধূত, গৌরগুণ গাই। এখন বাড়ি যাচ্ছি।” অবধূত শব্দ শোনা মাত্র মাধাই করলেন কী, পথের পাশে পড়ে থাকা এক ভাঙা কলসী উঠিয়ে নিয়ে আছাড় মারলেন নিত্যানন্দের মস্তকে। সজোরে আঘাত করায় মাথা ফেটে গেল নিতাইয়ের। আর অবিরল ধারায় রক্ত ঝরতে লাগলো। অক্রোধ পরমানন্দ, অভিমান শূন্য নিতাই গৌরস্মরণ করে নির্বিকার চিত্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর নির্লিপ্ততা দেখে মদ্যপ মাধাই আবার মারতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রক্তধারা আর নিতাইয়ের নিশ্চুপতা দেখে জগাইয়ের মন দৈবেচ্ছায় মাখনের মত গলে গেল। তিনি মাধাই কে বললেন, “না, না, আর মেরো না। ও তো অবধূত, তা আবার দেশান্তরী ! ওকে মেরে লাভ কী তোমার! এত নির্দয় হয়ো না।” এই বলে তিনি মাধাইয়ের হাত ধরে ফেললেন। এদিকে অন্যান্য পথচারীদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে এ দুঃসংবাদ দিলেন গৌরাঙ্গকে।

শোনামাত্র গৌরাঙ্গ সপরিকর ছুটতে ছুটতে এলেন সেই মুহুর্তেই। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইয়ের অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! এ কী সহ্য করা সম্ভব! প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন গৌরাঙ্গ। স্বয়ং তাঁকে প্রহার করে রক্ত ঝরিয়ে দিলেও এতখানি ক্রোধিত হতেন না, যতখানি নিতাইয়ের ক্ষেত্রে হলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি “চক্র, চক্র” বলে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান জানিয়ে নিজের হাত উপরে তুললেন। সুদর্শন চলে এলেন তাঁর হাতে। ভক্তরা সকলে প্রমাদ গুনলেন। এবার তো আর নিস্তার নেই জগাই-মাধাইয়ের! চক্র দ্বারা প্রভু তাঁদের সংহার করবেনই করবেন। কিন্তু, কলিতে এই অবতারে তো তাঁর অস্ত্র ধরার কথা নয়। তাঁর অঙ্গ-উপাঙ্গ স্বরূপ পার্ষদরাই তাঁর অস্ত্র। পার্ষদদের দ্বারা নাম-প্রেম বিতরণ করিয়ে তিনি পতিতদের উদ্ধার করবেন। তাঁর রূপ মাধুর্য্যের দ্বারা অসুরের আসুরিক স্বভাবের পরিবর্তন করবেন। তাঁকে দর্শন করেই দুরাচারীদের মন পরিবর্তিত হবে। এযুগে তো তিনি কাউকে সংহার করবেন না। বরং মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রেমভক্তিতে মনকে জারিত করবেন, ভক্ত বানাবেন অভক্তদের। মহাভাগবত হবেন তাঁরা এক-একজন সব।
নিত্যানন্দ করলেন কৌশলতা এক। তিনি মহাপ্রভুর মন ঘোরাবার চেষ্টা করলেন, বললেন- “প্রভু, দেখ, দেখ, এই যে জগাইকে দেখছো , এ আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছে। মাধাই মারতে গেলেও তাঁকে বাঁধা দিয়ে রক্ষা করেছে আমায়।” একথা শুনেই গৌরাঙ্গের মনসংযোগ চক্রের প্রতি থেকে সরলো। বললেন- “তাই নাকি! তুমি আমার নিতাইকে রক্ষা করেছো জগাই ! প্রভু তোমার অনেক মঙ্গল করুক। নিত্যানন্দকে বাঁচিয়ে তুমি আমায় কিনে নিলে আজ।” এই বলেই তিনি জগাইকে জড়িয়ে ধরলেন। জগাইকে রেখে পাছে মাধাইকে মারেন, তাই নিত্যানন্দ বলে চললেন- প্রভু, এই দু’জনার শরীরই আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি। তুমি তো এযুগে প্রতিজ্ঞা করেছো যে অস্ত্র না ধরেও জীবতারণ করবে। তবে কেন তার ব্যাতিক্রম করবে! এই দুইজনকেই তুমি কৃপা কর।”
এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেমালিঙ্গন দেওয়ায় প্রেমভার বইতে না পেরে জগাই মূর্ছিত হয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ বললেন- “ওঠো জগাই। তোমার যা বর লাগে, তুমি চেয়ে নাও আজ। আমি আজ সত্য সত্যই তোমায় প্রেমভক্তি প্রদান করলাম। আমার দেহ থেকেও নিত্যানন্দের দেহ বড় আমার কাছে জেনো। তুমি তাঁকে রক্ষা করেছো যখন, শ্রীকৃষ্ণ তোমায় অনেক কৃপা করবেন এই আমি বললাম।” জগাই দেখলেন গৌরহরি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রেমানন্দে করজোড়ে তখন প্রাণের আকুতিভরা প্রণাম জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গকে জগাই। তাঁর নয়নের জল সর্বাঙ্গ বয়ে নীচে পড়ছে। তিনি আবার জ্ঞান হারালেন। তখন গৌরহরি নিজের শ্রীচরণখানি তাঁর বক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। যাঁর অভয়পদ স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর জীবন, সেই পদ হৃদয়ে ধরে জগাই সদৈন্যে তখন কেঁদেই চলেছেন। সেই দুরাচারী জগাই কই আর! ইনি যে এখন মহাভক্ত এক। জগাইয়ের ওপর গৌরহরির এমন করুণা দেখে উপস্থিত ভক্তবৃন্দরা হরিধ্বনি দিতে থাকলেন উচ্চৈঃস্বরে। আকাশ ভেদ করে সে দিব্যধ্বনি যেন গোলকে পৌঁছে যাচ্ছিল।

এতক্ষণ ধরে এতসবের সাক্ষী মৌন মাধাই। তাঁর ভাবান্তর ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী জগাই এমন কৃপা পেয় গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্ধার হয়ে গেল, অথচ, তিনি তিমিরেই পড়ে রইলেন !—– একথা ভেবে মাধাই তখন পাগলপ্রায় হয়ে গৌরাঙ্গের পাদপদ্মে পড়ে গেলেন ছিন্নমূল বৃক্ষের মত। তাঁর দুর্বুদ্ধির বিনাশ হয়ে গেছে। তিনিও এখন দুষ্কর্ম ছেড়ে জগাইয়ের মত ভক্ত হতে চান। তাই বিনয় বচনে বললেন- “আমরা দুই ভাই জগাই-মাধাই সর্বক্ষণ একসাথে থাকি। একই কুকর্ম করি, তবে কেন একজনকে কৃপা করে অন্যজনকে বঞ্চিত করবে প্রভু? আমাকেও উদ্ধার কর। ক্ষমা করে দাও আমায়। অনুগ্রহ করে আমাকেও তোমার নাম-গান প্রচারে সামিল কর। আমার মত দুর্জনকে তুমি উদ্ধার না করলে, আর কী গতি হবে আমার! কৃপা কর দয়াময়। কৃপা কর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “না, তোমার ত্রাণ কোনমতে হবে না। তুমি নিত্যানন্দের দেহে আঘাত করেছো।” মাধাই—-“প্রভু, তোমার অন্যান্য অবতারে কত অসুর তো তোমায় বাণেতে বিদ্ধ করেছে। তুমি তো তাঁদের সকলকেই উদ্ধার করেছো। তোমার অভয়পদে স্থান দিয়েছো। তবে আমার বেলায় কেন তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করবে তোমার! গৌরাঙ্গ, “তুমি তো আমায় নির্য্যাতন করোনি। করেছো আমার প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইকে। যদি আমায় করতে, তাহলে ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিতাম। কিন্তু, আমার দেহের থেকেও নিত্যানন্দের দেহ যে অনেক প্রিয় , অনেক বড় আমার কাছে। তাঁকে দুঃখ দিয়ে আমার কৃপা কোনমতেই পাবে না আমার থেকে।” মাধাই, “প্রভু, তুমি তো সর্ব রোগহর বৈদ্য চূড়ামণি। তবে আমার এই কঠিন রোগ কেমন করে দূর হবে বলো! বলে দাও কী করলে আমার পরিত্রাণ হবে এ ঘৃণ্য অপরাধের থেকে। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।” তখন গৌরসুন্দর বললেন- “যদি নিজের পাপমোচন করতে চাও, তবে যাঁর চরণে অপরাধ হয়েছে, তাঁর শরণ নাও। নিতাইয়ের অপরাধী তুমি, তাই নিতাইয়ের কাছেই তোমার ক্ষমাভিক্ষা করতে হবে। সে যতক্ষণ না কৃপা করবে, তোমার প্রেমভক্তি ততক্ষণ বাদ।”
মাধাই নিত্যানন্দের শ্রীচরণে পড়লেন। যে পদ দেব ঋষিগণ প্রার্থনা করেন, রেবতী যে পদযুগলকে সেবা করেন সেই পদে মাথা কুটতে থাকলেন মাধাই। গৌরহরি বললেন, “নিতাই তুমি ওকে ক্ষমা না করলে যে ও উদ্ধার হবে না ! তোমার কৃপা বিনা তো কেউ প্রেমভিক্ষা পায় না। তাই, এবার দেখো তুমি ওকে কী করবে!” নিত্যানন্দ হেসে বললেন, “আমার জীবনে যদি কিছু সুকৃতী থেকে থাকে, আমি তার সমস্তটা আজ মাধাইকে দান করলাম।” এই বলে মাধাইকে নিজের চরণ থেকে তুলে কৃপালিঙ্গন দিলেন তিনি। মাধাইয়ের শরীরে নিজ শক্তি সঞ্চার করে দিলেন। সকল বন্ধনের বিমোচন হয়ে গেল মাধাইয়ের। মহাভাগবত হলেন মাধাই সে মুহুর্তেই। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই-মাধাই, তোমাদের কোটি জন্মের সব পাপের ভার আমার হল। আর কিন্তু নতুন কোন পাপ কার্য করো না, আজ থেকে। তোমাদের পূর্বের কর্মের সবদায় আমার হল।“ জগাই-মাধাই সমস্বরে বলে উঠলেন- “না, না, বাবা, আর নয়। আমরা আর কোনদিন, কোন কুকর্ম করবো না। এমনকী করার কথা ভাববোও না।” গৌরাঙ্গ, “বেশ, তবে তোমাদের দেহ আমার অবতার হবে। তোমাদের দুজনার মুখ দ্বারা আহার হবে আমার।” এমন কৃপাশীর্বাদ পেয়ে দু’ভাই বাহ্য হারালেন। গৌরাঙ্গ তাঁর পরিকরদের বললেন, “এদের দুজনকে আমার ঘরে নিয়ে চল। ব্রহ্মার দুর্লভ যে ধন, আজ সেই ধন আমি এদেরকে দেব। সকলের থেকে উত্তম বানাবো। এদেরকে স্পর্শ করলে গঙ্গাস্নানের সমান ফল প্রাপ্ত হওয়া যাবে এমন পূণ্যবান ভক্ত বানাবো এদের।”
জগাই-মাধাই দু-ভাইকে নিয়ে গেলেন ভক্তরা প্রভুর ঘরে। তাঁদের দুজনকে ঘিরে সংকীর্তন শুরু হল। কীর্তনের রোল শ্রবণ করে প্রেমানন্দে উঠে বসে দু’বাহু তুলে অপার নৃত্য করতে থাকলেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দেহে বাহ্যস্মৃতি লোপ পেল। প্রেমে বিভোর দুই তনু তখন ঢলঢল, গড়গড়। অশ্রুনীরে সর্বাঙ্গ সিক্ত। সাত্ত্বিকভাবের প্রকাশ দেহে। দৈন্য, স্তুতি করে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের সেই দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়। তাঁদের দৈন্য দেখে বুক ফাটে এমন দশা তখন ভক্তদের। গৌরাঙ্গ বললেন, “আজ থেকে এরা আর মদ্যপ হবে না। এরা আমার সেবক। সকলে প্রাণঢেলে আশীর্বাদ কর এদেরকে যেন জন্মে-জন্মে আমায় না ভোলে আর। কারোর চরণে যদি কিছু অপরাধ থেকে থাকে এদের, তাহলে তোমরা নিজগুণে সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিও। কৃপা কর সকলে জগাই-মাধাইকে।” তখন দু’ভাই জগাই-মাধাই চোখের জলে ভেসে সকলের চরণ ধরে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকলেন । সকলে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাঁদেরকে আপন করে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেদিন থেকে তাঁরা অনুগত সেবক হলেন গৌর-নিতাইয়ের। এরপর সকলে মিলে কীর্তন করতে করতে গঙ্গাস্নান করতে গেলেন। অনেক জলকেলি হল। জগাই-মাধাইয়ের সব পাপ নিজে ধারণ করে নিলেন প্রভু। প্রমাণ দিতে ‘কালিয়া-আকার’ ধারণ করেছিলেন সেদিন। স্নান সেরে তীরে উঠে, নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ প্রভুদ্বয় আপন আপন কন্ঠের মালা জগাই-মাধাইকে পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে মহাভাগবত হলেন দু-ভাই জগাই ও মাধাই।
“মহাপ্রভু দুঁহে করিয়া আলিঙ্গন।
বোলে আজি হৈতে মোর সেবক দুইজন।। নিতাই আলিঙ্গিয়া দুঁহে বলয়ে বচন।
প্রিয় শিষ্য হৈলে মোর তোমরা দুইজন।। জগাই মাধাই হৈলা ভক্ত অতিশয়।
দুই প্রভুর দুই শাখা মধ্যে গণনা যে হয়।।”
(প্রেমবিলাস, ২১)

“এতেক যতেক কৈল এই দুইজনে।
করিলাম আমি ঘুচাইলাম আপনে।।
ইহা জানি এ দুইয়ে সকল বৈষ্ণব।
দেখিয়া অভেদ দৃষ্ট্যে যেন তুমি সব।।
শুন এই আজ্ঞা মোর যে হও আমার।
এ দুইয়ে শ্রদ্ধা করি যে দিব আহার।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যত মধু আছে।
সে হয় কৃষ্ণের মুখে দিলে প্রেমরসে।।
এ দুইরে বট মাত্র দিবে যেই জন।
তার সে কৃষ্ণের মুখে মধু সমর্পণ।।
এ দুই জনেরে যে করিবে উপহাস।
এ দুইর অপরাধে তার সর্বনাশ।।
তবে গলার মালা দোঁহার গলে দিল।
প্রভু কৃপা পাই দোঁহে প্রেমেতে ভাসিল।।”
(চৈ.ভা-১৩)
পরম প্রেমিক, মহাভক্ত জগাই-মাধাই দু’ভাই এখন দিবানিশি কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে আঁখি নীরে ভাসেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে এসে তাঁরা দুই লক্ষ নাম নেন। কৃষ্ণ বলে নিরবধি হা-হুতাশ করেন। কৃষ্ণময় জগৎ এখন তাঁদের। কিন্তু, এত সবের সঙ্গে নিজেদের অতীতের কীর্তিকলাপের কথা ভেবে ধিক্কার দেন নিজেদেরকেই তাঁরা। নিজেদের জীবহিংসার কথা ভেবে মরমে মরে যায়। ভূমিতে পড়ে আকুলি-বিকুলি করেন অনুশোচনায়। পতিত পাবন গৌরসুন্দর কত দয়াময় আর নিত্যানন্দ এত করুণাময়(!), তাঁদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন এত অবলীলায়, এত কৃপা করলেন!—–এসব ভেবে কেঁদে আকুল হন তাঁরা। বিহ্বল হয়ে যান প্রভুদের কৃপালীলার কথা ভেবে। কখনো কৃষ্ণপ্রেমানন্দে, কখনো নিজেদের কর্মের কথা ভেবে প্রায়ই আহার করেন না। তখন নিতাই-গৌরসুন্দর অনেক বুঝিয়ে আহার তুলে দেন মুখে তাঁদের।
মাধাই আরও বেশী অনুশোচনায় ভোগেন জগাইয়ের থেকে। তিনি নিতাইকে প্রহার করেছেন, রক্ত বের করে দিয়েছেন মাথা থেকে; কত না পাপীষ্ঠ তিনি! —-একথা ভেবে বক্ষ ভাসান নয়ন জলে। যদিও নিতাই তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও একদিন দন্তে তৃণ ধরে আবার নিত্যানন্দের চরণে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন তিনি। চোখের জলে নিত্যানন্দের চরণ ধুয়ে দিলেন, স্তব করলেন কত না। সন্তুষ্ট নিত্যানন্দ বুকে টেনে নিলেন তাঁর প্রিয় মাধাইকে। বললেন- “মাধাই, তুমি এখনো এতদিন পরেও কেন এমন করো। শোক পরিহার কর। তুমি তো এখন আমার দাস। তোমার শরীর এখন আমার সম্পদ। তুমি এভাবে দৈন্যক্রন্দন করে আমাকে কেন কষ্ট দাও। শিশুপুত্র যদি পিতাকে মারে, পিতার কী কিছু যায় আসে তাতে! পুত্রের অপরাধ দেখে না পিতা। তেমন তুমিও তখন অজ্ঞানী ছিলে শিশুপুত্রের ন্যায়। তোমার কোন অপরাধ আমি দেখিনি। তার ওপর আমার প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ তোমায় আপন করেছেন। যাকে তিনি কৃপা করেন, সে আমার জন্মে জন্মে প্রিয়পাত্র হয়। আর যে জন তাঁকে লঙ্ঘন করে আমায় পূজা দেয়, সেই মূঢ় কখনো আমার কৃপার প্রাপ্ত হয় না, প্রিয়পাত্র হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তোমায় তিনি কৃপা করেছেন যখন, তখন তুমি আমার যে কত প্রিয় হয়েছো, তা আমি বোঝাতে পারবো না।” এইবলে নিত্যানন্দ মাধাইকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। তখন মাধাইয়ের অন্তর শান্ত হলেন। মাধাই বললেন, কিন্তু, প্রভু আমার যে অনেকের কাছে অনেক অপরাধ জমা আছে। তার কি হবে? আমি তো তাদের সকলকে চিনিও না। ভুলে গেছি কারা তারা। কি করে তাদের কাছে আমি ক্ষমা চাইবো? আমি বহু বহু পাপ করেছি এতদিন ধরে। কি করে সেই অপরাধবোধ যাবে আমার?”
তখন নিত্যানন্দ বললেন, বেশ, তবে এক কাজ করো। তুমি প্রতিদিন গঙ্গারঘাটে গিয়ে মার্জন করবে ঘাঁট। যারা স্নান করতে আসবে তাদের যতটা সম্ভব সেবা করবে। তারা স্নান করে উঠলে তাদের প্রণাম জানিয়ে ক্ষমা চাইবে। প্রসন্ন হয়ে তারা তোমায় আশীর্বাদ করবে কল্যাণ হোক বলে, তাতেই তোমার পাপস্খলন হবে, অপরাধবোধ চলে যাবে। হৃদয় প্রশান্ত হবে। এই আকুলতা দূর হবে।
নিত্যানন্দের দেখানো পথেই এখন জগাই-মাধাই আচরণ করেন। সকলের চরণ ধরে প্রার্থনা করেন- “জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যত পাপ করেছি আপনার প্রতি, ক্ষমা চাইছি সবের জন্য। আপনি ক্ষমা করুন এই জীবাধমকে, এই পতিতকে। এ নরাধম ভিক্ষা মার্জনা চাইছে আপনার থেকে।” তাঁদের ক্রন্দন দেখে আর অনুরোধ শুনে ঘাটে আগত স্নানার্থীদের চোখেও জল এসে যেত। তাঁরাও নয়নাশ্রু ফেলে ক্ষমা করে দিতেন। আবেগে তাঁদের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যেত জগাই-মাধাইয়ের বিনয় দেখে।
প্রেমিক সুজন জগাই-মাধাই কঠোর থেকে কঠোরতম ভজনে মগ্ন হলেন। ব্রহ্মচারী বলে তাঁরা খ্যাত হলেন। তাঁরা কোদাল চালিয়ে মাটি কেটে গঙ্গার ঘাট বানালেন। এখনও সে স্থান দর্শন হয়। ‘মাধাইয়ের ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ সে ঘাট, নিত্যানন্দের করুণাগুণে তাঁরা চৈতন্যচরণ পেয়েছেন। গৌরাঙ্গের পতিত পাবন লীলার মহাপ্রমাণ হলেন তাঁরা। নিতাইয়ের কৃপাপাত্র এই দুই ভাগ্যবান ভ্রাতারা আসলে শ্রীনারায়ণের ধাম বৈকুন্ঠের দুই দ্বারপাল ‘জয়’ ও ‘বিজয়’। সনকাদি মুনির অভিশাপে দুর্বৃত্ত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরণীতে। “বৈকুন্ঠে দ্বারপালৌ যৌ জয়াদ্য বিজয়ান্তকৌ। তাবাদ্য জাতৌ স্বেচ্ছাতঃ শ্রীজগন্নাথ-মাধবৌ।” (গৌ.গ.দি.-১১৫)
নিত্যানন্দ চেয়েছিলেন প্রাকৃত মদ্যপান করে যেমন অস্পৃশ্যরা উন্মত্ত হয়, তেমন মদ্যপ জগাই-মাধাই প্রেমভক্তিসুধা পান করে পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হোক, কীর্তন করুক, নৃত্য করুক আবেশে, ভজন পরায়ণ হোক,সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হোক গৌরকৃপাপাত্র হবার——সে ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রকৃত অর্থেই। মহা ভাগবত, ভজনানন্দী হয়েই সারাটা জীবন কাটালেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দর্শনেই মানব পাপমুক্ত হত, কৃপা প্রাপ্ত হত।
ওহে প্রেমিকসুজন দুই ভ্রাতা ‘শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই’ , কৃপা করুন যাতে নিরবধি নিতাইচরণ চিন্তা করতে পারি, চৈতন্য কৃপার যোগ্য পাত্রী যেন হতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণে অনন্ত অর্বুদ কোটি প্রণাম এ জীবাধমার।
—– (সংকলিত), গ্রন্থ — ‘মহাপ্রভুর মধুময় কথা’, লেখিকা–রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক,

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

এক বিতর্কিত-বিগ্রহ কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

উত্তর ভারত থেকে পুরী যাওয়ার পথে প্রধান সড়কের ধারেই বিষ্ণুপুর অবস্থিত।ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে এখানে মন্দিরের সংখ্যা ছিল ৩৬০টি।ফলে পুরী যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা এখানে আসতেন আর দেববিগ্রহের পূজা দিয়ে দক্ষিণা-প্রণামীও দিতেন। স্বভাবতঃই মন্দির গুলো থেকে আয় হত প্রচুর।বিষ্ণুপুরের আয়ের এক অন্যতম উৎস ছিল মন্দির। আর, দেববিগ্রহদের মধ্যে সবথেকে বেশী আকর্ষনীয় বিগ্রহ ছিল   শ্রীমদনমোহনদেব। মদনমোহন মন্দিরের  আয় ছিল বিষ্ণুপুরের সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এ তথ্য পাওয়া যায় ১৭৮৯সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা একটি চিঠিতে। চিঠিটি লিখেছিলেন  বীরভূমের সেইসময়ের কালেক্টর জী. কীটিংসয়ে’র এ্যাসিস্ট্যান্ট অন ডেপুটেশন–  এ. হেসিলরীজ। সেসময় বিষ্ণুপুরে অর্থাভাব চলছিল আর মদনমোহনদেব কলকাতার বাগবাজারে ছিলেন। হেসিলরীজ লিখেছিলেন–‘এই বিগ্রহকে যদি বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় , তবেই  সেখানকার সম্পদবৃদ্ধির সম্ভবনা আছে।’  অতএব, মদনমোহনদেবের নাম প্রাচীন বিষ্ণুপুরের অর্থনৈতিক  ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। আবার,  এক দেববিগ্রহকে নিয়ে রাজপরিবারে মামলা , বন্ধকী, ডিক্রী— এ ঘটনা ইতিহাসে আর নেই। তাই মদনমোহন বিগ্রহ বিষ্ণুপুরের রাজপ্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক দলিল স্বরূপ। বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে(?)—তাঁর বর্তমান অবস্থানকে কেন্দ্র করে বিতর্ক বা ধোঁয়াশা এখনও পর্যন্ত  মেটেনি বললেই চলে। সেইসাথে তাঁর নানান অবিশ্বাস্য অলৌকিক লীলা— সমস্তটা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় শ্রীমদনমোহনদেবের কাহিনী ভীষণ আকর্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর। আসুন, মদনমোহনকে নিয়ে ইতিহাসের সেই টানা-পোড়েন দৃশ্য একটু দেখার চেষ্টা করি।
ষোড়শ শতকে  বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের ৪৯তম রাজা ছিলেন বীর হাম্বীর বা হাম্বীর মল্ল । ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজত্ব শুরু করেন।তাঁর অধীনে ডাকাত বাহিনী থাকতো।পথচারীরা বিষ্ণুপুরের জঙ্গল পার করতে গেলেই এই সব ডাকাতরা দস্যুতা করে সব ছিনিয়ে নিত। তারপর সব সম্পদ বীর হাম্বীরকে দিয়ে দিত ।বদলে এদের ভরণপোষণের  ভার রাজা বহন করতেন। সেসময় এই ডাকাতদের জন্য পথচারীদের পক্ষে বনবিষ্ণুপুর পেরোনো রীতিমত ত্রাসের ব্যাপার ছিল।
“ঐছে দুষ্ট রাজা নাই ভারতভূমিতে ।
কেহ না পারয়ে এ পাপীরে দন্ড দিতে।।”
(ভক্তিরত্নাকর,৭/৭১)
বৃন্দাবন থেকে শ্রীরূপ-সনাতন,কবিরাজ গোস্বামী ও অন্যান্য গোস্বামীদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে গৌড় দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন শ্রীনিবাস , নরোত্তম ও শ্যামানন্দ প্রভু। উদ্দেশ্য গৌড়দেশে ভক্তি গ্রন্থ প্রচার করবেন। সকল গ্রন্থ পেটিকায়(বাক্স বা সিন্দুক) ভরে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ;সাথে দুজন পাহারাদারও রয়েছে।  জঙ্গলপথে বিষ্ণুপুরের ডাকাতদের নজরে পড়লো গো-শকট  আর তাতে যত্ন করে রাখা  পেটিকা। তারা পিছু নিল। রাতের বেলায় বিশ্রাম নিতে গাড়ি থামিয়ে যখন সকলে ঘুমোচ্ছে তখন  পেটিকা ডাকাতি করে পালিয়ে গেল ডাকাতরা। জমা দিল রাজকোষাগারে।পরদিন সকালে ডাকাতির দ্রব্য দেখতে রাজা এলেন।পেটিকা খোলা হল। সে কি !সোনা, রূপা, হীরে , জহরত কিছুই তো নেই ভেতরে। কেবল পুঁথি আর পুঁথি!  কিন্তু সোনা-রূপো না থাকলেও যা ছিল তা সোনার থেকেও মহিমায় অমূল্য রতন। রাধা-কৃষ্ণতত্ত্ব ,ভক্তিতত্ত্ব ,ভক্তিসিদ্ধান্ত সমৃদ্ধ মহাজন লিখিত গ্রন্থগুলো স্পর্শ  করা মাত্র লেখনীর দিব্য প্রভাবে যেন পরিবর্তিত হয়ে গেল দস্যুরাজা বীর হাম্বীরের হৃদয় ।
এদিকে সকালে শ্রীনিবাস আচার্যদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।সংবাদ গেল বৃন্দাবনে। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে লেখা মহাগ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’র পান্ডুলিপিও ছিল পেটিকায়। লেখক অশীতিপর বৃদ্ধ শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন যে তিনি জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করলেন । বিষ্ণুপুরে অনেক অন্বেষণ করেও যখন গ্রন্থপেটিকা পাওয়া গেল না তখন শ্রীনিবাস হতাশ শ্যামানন্দ ঠাকুর ও নরোত্তম ঠাকুরকে‌ তাঁদের নিজেদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন আর নিজে রয়ে গেলেন বিষ্ণুপুরে । মনে মনে ভাবলেন এক না একদিন কোন না কোনভাবে গ্রন্থের সুলুক সন্ধান তিনি পাবেনই পাবেন ।
দশ দিন কেটে গেল , অনেক অনুসন্ধান করেও কোন কিনারা করতে পারলেন না শ্রীনিবাস।  একটি গাছের তলায় ক্লান্ত,শ্রান্ত  হয়ে মলিন মনে বসে আছেন আর দুঃশ্চিন্তা করছেন। এমন সময় কৃষ্ণবল্লভ নামে এক ব্রাক্ষ্মণ কিশোর হাজির হল সেখানে। তার সঙ্গে আলাপ করে কথা প্রসঙ্গে বনবিষ্ণুপুরের রাজার আচরণ জানতে পারলেন শ্রীনিবাস। রাজা  রাতে দস্যুবৃত্তি করান আর দিনের বেলায় রাজসভায় শাস্ত্র আলোচনা করান — একথা জেনেই সেই কিশোরকে  তিনি বললেন, ” আমায় একদিন নিয়ে যেতে পারবে সেই সভায়?” কিশোর সানন্দে রাজী হয়ে মাথা নাড়ল। শ্রীনিবাস এলেন রাজসভায় শাস্ত্র ব্যাখ্যা শুনতে। ব্যাস চক্রবর্তী পুরাণ ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছিলেন।মনে মনে শ্রীনিবাস যা ভেবেছিলেন তাই হল। পন্ডিত এর ব্যাখ্যায় ভুল ছিল। শ্রীনিবাস ভুল ধরলেন  ।রাজা বীর হাম্বীর বলে বসলেন , “এত যখন সাহস দেখালেন , তাহলে এবার আপনিই ব্যাখ্যা করুন। শুনি সকলে।”  শ্রীনিবাস এটাই চাইছিলেন ,কারণ ,তিনি জানতেন কোনভাবে যদি রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে পারেন তবে রাজার হস্তক্ষেপে  গ্রন্থপেটিকা প্রাপ্তিতে সুবিধা হতে পারে। হলও তাই ।তিনি ভ্রমর গীতা শ্রবণ করালেন। তাঁর প্রেমভক্তি সমন্বিত অসাধারণ শাস্ত্র ব্যাখ্যায় , নিখুঁত বিশ্লেষণে সভায় উপস্থিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্রত্যেকের চোখে জল এল আবেগে, ভক্তিতে ।খুশি হয়ে পুরষ্কার ঘোষণা করতে চাইলেন রাজা, বললেন, ” আপনার যা চাই আমি তাই দেব , আর এবার থেকে আপনাকে  রোজ ভাগবত প্রবচন করতে হবে সভায়।” শ্রীনিবাস বললেন,” রাজামশাই আমার কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। আপনি যদি পারেন আমার অপহৃত  ধনের প্রাপ্তিতে একটু সাহায্য করুন ।” এই বলে সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাজা  বললেন ,”আপনি আসুন আমার সঙ্গে।” রাজকোষাগারে নিয়ে গেলেন  তাঁকে। বিস্মিত শ্রীনিবাস দেখলেন, যে গ্রন্থপেটিকার জন্য তিনি এতো অনুসন্ধান চালিয়ে চলেছেন হন্যে হয়ে,  তা সব রাজার কাছেই গচ্ছিত রয়েছে।  শ্রীনিবাস আচার্যকে গ্রন্থপেটিকা ফিরিয়ে  তো দিলেনই রাজা ,পরবর্তীতে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন তাঁর থেকে। বীর হাম্বীরের পত্নীর নাম  ‘সুলক্ষণা’  ও পুত্রের  নাম ছিল ‘ধাড়ীহাম্বীর’ ।পরম বৈষ্ণব হলেন সপরিবারে তাঁরা। বীর হাম্বীরের  সময় থেকেই বংশপরম্পরায় মল্ল রাজারা  বৈষ্ণব ভক্ত হলেন । তার আগে তো তাঁরা শাক্ত ছিলেন।বিষ্ণুপুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী  মৃন্ময়ীর যে মন্দির আমরা দেখতে পাই তা   ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজা জগৎমল্লই  নির্মাণ করে  দিয়েছিলেন ।  বীর হাম্বীর সমস্ত অসাধু কর্ম ত্যাগ করলেন । তিনি শ্রীকালাচাঁদ বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠা করালেন শ্রীনিবাস আচার্যের দ্বারা।
“হৈল বীর হাম্বীরের পরম উল্লাস।
শ্রীকালাচাঁদের সেবা করিলা প্রকাশ।।
রাজা বীর হাম্বিরের রাণী সুলক্ষণা।
আচার্য্য প্রভুরে কত করিলা প্রার্থনা।।
আচার্য্য প্রসন্ন হইয়া দীক্ষামন্ত্র দিলা।
পাইয়া যুগল মন্ত্র রাণী হর্ষ হৈলা।।”
(ভক্তিরত্নাকর, ৯/২৭০)
পরবর্তীতে রাজা বীর হাম্বীর বৈষ্ণব ধর্মের একজন পরম পৃষ্ঠপোষক হলেন। তিনি কালাচাঁদকে নিয়ে অপূর্ব পদ রচনা করেন, যেগুলি পদকল্পতরু’তে স্থান পেয়েছে। যখন নিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী শ্রীমতী জাহ্নবা ঠাকুরাণী বৃন্দাবনে কাম্যবনের গোপীনাথের জন্য রাধিকা মূর্তি নির্মাণ করিয়ে গৌড়দেশ থেকে বৃন্দাবনে পাঠান ,তখন সেই বিগ্রহের জন্য মূল্যবান অলংকার সামগ্রী, বস্ত্র, বাসনপত্র ও যাবতীয় উপঢৌকন সব এই বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বীরই  প্রদান করেছিলেন। বৃন্দাবনের আচার্য শ্রীল জীব গোস্বামীজী প্রসন্ন হয়ে তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন ‘চৈতন্য দাস’ ।
“শ্রীজীব গোস্বামী হইলা প্রসন্ন তোমারে ।
শ্রীচৈতন্য দাস নাম থুইল তোমার ।।”
( ভক্তিরত্নাকর, ৯,২০৫)
এই  বীর হাম্বীর রাজা একবার বৃষভানুপুরের বনে পথ হারিয়ে  ক্লান্ত ,অবসন্ন হয়ে সন্ধ্যাবেলায়  উপস্থিত হলেন এক কুটীরে। সে কুটীরে সাধনা করতেন এক তান্ত্রিক। তান্ত্রিকের কাছে পূজিত হতেন অপূর্ব দর্শন শ্রীমদনমোহন বিগ্রহ। বিগ্রহের   রূপমাধুরী দর্শন করা মাত্র রাজার  ইচ্ছা হলো সে বিগ্রহ নিজের কাছে রাখার । তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তান্ত্রিক ওই বিগ্রহ কোথায় পেয়েছেন। তান্ত্রিক জানালেন যে  ,বনবিষ্ণুপুরের বিল থেকে এক জেলেনীর জালে উঠেছিলেন বিগ্রহ । জেলেনী নিজে পূজার্চনার কিছু জানতেন না বলে তান্ত্রিককে সেটি দিয়ে দিয়েছিলেন পূজা করার জন্য।
বৃষভানুপুর থেকে কোন উপায়ে বীর হাম্বীর  সে বিগ্রহ রাজপ্রাসাদে উঠিয়ে আনলেন ।  এদিকে বিগ্রহ-হারা  তান্ত্রিক  লোক মারফৎ জানতে পারলেন যে, মদনমোহন রাজার কাছে আছে। তিনি বিগ্রহ ফেরত চাইতে রাজদরবারে আসলেন। কিন্তু, রাজা বললেন, “তোমার যত ধন সম্পত্তি  লাগে নিয়ে যাও,  ওই বিগ্রহ আমাকে দিয়ে দাও তুমি।” তান্ত্রিক রাজী  নন। তাঁর অন্য কিছু নয় , বিগ্রহই  লাগবে। কয়েকদিন পর ফেরৎ দেবেন এই বলে শেষে রাজা সময় চাইলেন। এক নকল বিগ্রহ গড়ালেন আর তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে বললেন তান্ত্রিককে।কিন্তু বিগ্রহকে বুকে লাগিয়ে তাঁর অঙ্গগন্ধ নিতেই তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন যে, সেই বিগ্রহ তাঁর নয়, নকল বিগ্রহ সেটি।  তিনি নিজের বিগ্রহ চাইলেন। রাজা বললেন, নিতে হলে ওই বিগ্রহই নিতে হবে, ওটিই আসল । শেষে অশ্রুপাত করতে করতে তান্ত্রিক বললেন ,”আজ আপনার দিন ভালো যাচ্ছে তাই আমায় এমন করে ফেরাতে পারলেন। একদিন এমন আসবে যখন আপনাদেরও এই বিগ্রহের জন্য কাঁদতে হবে, বলে গেলাম আমি।”
“মল্ল রাজাদের সময় ভালো হইতে সদয় ।
সময় গেলে কবে তারে দেখ কাঁদিতে হয়।।”
(মদনমোহন বন্দনা, অভয়পদ মল্লিক)
মদনমোহন রয়ে গেলেন রাজার কাছে। ভালোই থাকেন। ভক্ত রাজা  যত্ন করেন ,মন প্রাণ ঢেলে সেবার ব্যবস্থা করেছেন। রাজপুরোহিত  ধরণী মহাপাত্রকে   নিযুক্ত করলেন সেবার্চনার জন্য। মদনমোহনের জন্য  রাসমঞ্চ  নির্মাণ করিয়ে দিলেন । সেটা তখন ১৬০০খ্রিষ্টাব্দ।রাসমঞ্চের বিশাল বেদী।বেদীর ওপর মঞ্চ, চূড়া ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। চূড়ার শৈলী পিরামিডের মত।  ৩৫ফুট উঁচু ও ৮০ফুট চওড়া টেরাকোটার কারুকার্যে খোদিত এই অসামান্য রাসমঞ্চ পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। মূলতঃ বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার স্থাপত্য  বীর হাম্বীরের আমল থেকেই প্রসার লাভ করে । তাঁর অপর এক কীর্তি হল দলমাদল কামান স্থাপন।এই কামানও অতীব আশ্চর্য  দর্শণীয় বস্তু। কারণ, মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথর গলানো ,লোহা দিয়ে তৈরী  ২৯৬মণ ওজনের এই কামানে এখনো একবিন্দুও মরচে ধরেনি। কামানের নাম সম্ভবতঃ প্রথমে ছিল দোলমর্দন ( মর্দন অর্থাৎ দলন, শত্রু পীড়ন)  ।কালের অপভ্রংশে নাম হয় দলমাদল। তবে জনশ্রুতি বলে যে ,বীর হাম্বীর দল ও মাদল নামে দুটি কামান বসিয়েছিলেন। মাদল কামনটি বর্তমানে লালবাঁধে  জলের মধ্যে পড়ে আছে ,দেখতে পাওয়া যায় না। আর ,  যে কামানটি দেখা যায় সেটি হল  ‘দল’ কামান। যদিও সম্প্রতি কালে লালবাঁধ সংস্কার হলেও কোন কামান কিন্তু সেখানে দেখা যায় নি। এখন, এত বছরে জলকাদায় মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে কিনা সেটাই বা কে বলতে পারে। বিষ্ণুপুর মিউজিয়ামের  তত্ত্বাবধায়ক ঐতিহাসিক শ্রী তুষার সরকার জানালেন যে, ট্রেজারি বিল্ডিং-এ একটি কামান ছিল এতদিন ধরে , বর্তমানে বিষ্ণুপুর প্রশাসনিক ভবনের সামনে সেটি স্থাপন করা হয়েছে। এই কামানটির কোন ইতিহাস জানা যায় না । এই কামানটি ‘মাদল’ কামান হলেও হতে পারতো। কিন্তু, এটি আকারে অন্য কামানটির থেকে এতটাই ছোট যে সেটিও নিশ্চিত রূপে বলা সম্ভব নয়। অতএব, আলাদা করে মাদল কামান ছিল কিনা তা প্রশ্নবোধক।এই দলমাদল কামানের সঙ্গে মদনমোহনের এক অবিশ্বাস্য অলৌকিক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বীরহাম্বীর। বীর হাম্বীরের পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে  রাজা হন  ধাড়ী হাম্বীর, রঘুনাথ মল্লদেব,বীর সিংহদেবের পর দুর্জন সিংহদেব। এই রাজা দুর্জন সিংহদেব মদনমোহনদেবের জন্য  নির্মাণ করে দেন মন্দির। বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার   শ্রেষ্ঠ মন্দির এটিই। দৈর্ঘ্য ১২.২মিটার ও প্রস্থ ১০.৭মিটার।  মন্দিরের টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকার্যময় খিলান, দেওয়াল আজও বিস্ময়ান্বিত করে  দেশ-বিদেশের পর্যটক ও গবেষকদের। Archeological Survey of India (Kolkata circle)মন্দিরের বাইরে প্রশস্তিতে লিখেছে –‘এই মন্দিরটি ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ তৈরি করেন। বাংলা চালার ছাদে একটি শিখর বিশিষ্ট ইটের একরত্ন মন্দিরগুলির মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ। মন্দির দেওয়ালের পোড়ামাটির অলঙ্করণও দেখার মত।’
প্রসঙ্গত, বীর হাম্বীরের পৌত্র রঘুনাথ মল্লদেবের  সময়  মল্লরাজারা মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে ‘সিংহ’ উপাধি পেয়েছিলেন।আর তাই, রঘুনাথের  পরবর্তী রাজাদের নামের পরে মল্লের পরিবর্তে ‘সিংহদেব’ যুক্ত হয়।

দুর্জন সিংহের পর দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহদেব , আর তারপর গোপাল সিংহদেব রাজা হন। গোপাল সিংহ ছিলেন কট্টর বৈষ্ণব। বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক রাজ্যবাসীকে সন্ধ্যেবেলায় হরি নামের মালা জপ করার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।এমনকি প্রজারা ঠিকঠাক মালা জপ করছে  কিনা ,তা পরীক্ষার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করেছিলেন।  এদিকে বর্ধমানের বর্গী রাজা ভাস্কর রাও আক্রমণ চালাবার প্রস্তুতি শুরু করে দেন বৈষ্ণবরাজা গোপাল সিংহের নিরীহতার সুযোগ নিয়ে।
একদিন আচমকাই মধ্যরাতে মারাঠা বর্গীরা অতর্কিত হামলা করল বিষ্ণুপুরের ওপর। খবর আগে থাকতেই পেয়েছিলেন গোপাল সিংহ ।কিন্তু মদনমোহনের চরণে একান্ত শরণাগত ,আত্মনিবেদিত রাজা একটুও বিচলিত হলেন না‌। তিনি রাজ্যবাসীদের আদেশ দিলেন সকলে যেন সারা রাত ধরে হরিনাম করতে থাকে। কোন অস্ত্র কেউ ধরল না । প্রত্যেক সৈনিক পর্যন্ত হরিনাম নিতে থাকলেন আর রাজার নিজের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ , সারা রাত ধরে রাজ্যবাসী কামানের  গোলাবর্ষণের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শুনলেন। অনেকে তো ভয়ে মূর্ছিত হলেন কামানের ভীষণ শব্দে। পরে দেখা গেল যে  ৫২ হাজার বর্গী সেনার একজনও আর নেই । তাহলে গোলা বর্ষণ করল কে? কামান চালাল কে?
সকালে পুরোহিত গর্ভগৃহের দ্বার খুলে দেখেন বিগ্রহের  সারা গায়ে বারুদের দাগ আর পোড়া বারুদের গন্ধে ভরে মন্দির। এদিকে এক গোয়ালা এসে ধরলো রাজাকে ;নিবেদন করলো, ” রাজামশাই ,আপনার ছেলে দই খাওয়ার টাকা শোধ করুন ।সে বলেছে আপনার থেকে চেয়ে নিতে।” রাজা বললেন–“আমার ছেলে আবার কখন দই খেল, তা আবার তোমার থেকে?”  গোয়ালা বললো–‘আপনারই ছেলে তো! সিপাহির বেশ পরা, সারা গায়ে-মুখে কালি ঝুলি মাখা ।বারুদপোড়া গন্ধ কী তাঁর শরীর থেকে! নাম বলল বোধহয় মদনমোহন।” রাজার মূর্ছা যাবার উপক্রম হল শুনতেই।বললেন , “গোয়ালা তোমার যে কত সৌভাগ্য কী বলবো। তুমি সাক্ষাৎ বিষ্ণুপুরের ভগবানকে দর্শন করেছ আজ। তাঁকে দই খাইয়েছ! তুমি ধন্য।” আনন্দের আতিশয্যে পাগলপ্রায় দশা  তখন গোয়ালার।  ভগবানকে দেখেছে সে —- এ সৌভাগ্যের কথা  কাকে বলবে, কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ দেখা গেল তার দইয়ের হাঁড়িগুলো চকচক করে উঠলো , সোনার হয়ে গেল।রাজা গোপাল সিংহ আর ঠিক থাকতে পারলেন না ।তাঁর মদনমোহনের এতসব অলৌকিক কীর্তিকলাপ দেখে তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে গেলেন। আসলে, যাঁর চরণে সব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা , দায় তো সব, তাঁর ওপরই বর্তায় তখন ।তাই মদনমোহন নিজেই কামাল দেগে বর্গী তাড়িয়েছেন সারারাত ধরে। আর তখনই নাকি  যুদ্ধ শেষে মাদল কামানটি  জলে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
” লালবাঁধে দল-মাদল  দুটি কামান ছিল।
তার মধ্যে ৮০মণ বারুদ ভরিল।।
দুইটি কামান প্রভু লইলো দুই বগলে।
দুই হাতে দু-কামানে দিল পলতে জ্বেলে।।
এক কোপে বহু বর্গী  হইল নিধন‌।
কামানের শব্দে মূর্চ্ছা  গেল বহুজন।।”
(মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য, গাইড বুক)

ভক্তের বিপদের সময় ভগবান যে বিপদভঞ্জন হন, সে প্রমাণ দিলেন মদনমোহন। আর , তা জানাবার জন্যই মদনমোহন করেছিলেন দই খেয়ে পয়সা না দেবার লীলা। সেই গোয়ালার নাম ছিলো গোপাম মূরতি।
এখন, সময়টা ১৭৪৮ সাল। বিষ্ণুপুরের রাজসিংহাসনে রাজা গোপাল সিংহদেবের পর রাজা  চৈতন্য সিংহদেব বসেছেন। তিনিও ভক্তিমান  রাজা । এদিকে রাজপরিবারের অপর  সদস্য দামোদর সিংহদেব  সিংহাসন দখল করার  জন্য মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে হাত মেলালেন ।নবাব সাহায্য করলেন ।বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন বাঁকুড়া ।কিন্তু ,লক্ষ্য পূরণ হলো না। জিততে পারলেন না ।  এরপর নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ১৭৫৬ সালে  পলাশীর যুদ্ধে হেরে প্রাণ হারান  ইংরেজদের হাতে। তিনিই ছিলেন   বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব।  সেসময় বাংলার প্রত্যেকটি রাজ্য ইংরেজের করদ্ রাজ্যে পরিণত হল। অর্থাৎ , রাজাদের সকলকেই ইংরেজদেরকে  খাজনা বা কর  দিতে হত। সামন্তরা ইংরেজের তোষামোদকারী  জমিদারে পরিণত হয়েছেন। আবার ইংরেজদের ছত্রছায়ায় সেসময়  উত্থান ঘটলো আরেক  নতুন গোষ্ঠীর….. তাঁরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ।

হাওড়া জেলার কোন্নগরে  বাস করতেন শ্রী সীতারাম মিত্র মহাশয়।  বর্গীদের প্রচণ্ড উৎপাত ,অত্যাচার মাঝেমধ্যেই হয় সেখানে । তাই সেখান থেকে মিত্র মহাশয়  চলে এলেন সুতানটি গ্রামে বা এখনকার কলকাতার বাগবাজারে । এখানে তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য। রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা।ফলে বর্গীদের উৎপাত ছিল না বললেই চলে । সীতারাম মিত্রের পুত্র  শ্রী গোকুলচন্দ্র মিত্রের ছিল লবণের ব্যবসা। বড় ব্যবসায়ী তিনি ,সেইসাথে অত্যন্ত দয়ালুও ছিলেন । তাঁর আমলে প্রত্যেকদিন হাজার জন অনাথ-আতুড় খাবার পেত। ব্যবসার সূত্রে গোকুল মিত্র কোন ভাবে পরিচিত ছিলেন রাজা চৈতন্য সিংহের সঙ্গে‌। চৈতন্য সিংহদেবের আমন্ত্রণে তিনি বেশ কয়েকবার বিষ্ণুপুর এসেছিলেন। যেবার তিনি  প্রথম দর্শন করেন মদনমোহনদেবকে , সেবারই দর্শন মাত্র মদনমোহনের প্রতি এক অপার্থিব টান অনুভব করেন। মন যেন চাইতে থাকল  মদনমোহনের সান্নিধ্য, তাঁকে সেবা করার সৌভাগ্য। হয়তো বা সে কারণেই গোকুল মিত্র একাধিকবার বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন ।
এক সময় চৈতন্য সিংহদেবের কিছু অর্থাভাব হয় ।গোকুলচন্দ্র বাড়িয়ে দেন  চৈতন্য সিংহদেবের দিকে সাহায্যের হাত। তিনি তিন লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন চৈতন্য সিংহকে‌। তবে গোকুল মিত্র শর্ত একটা রাখলেন যে যতদিন না টাকা ফেরৎ দিতে পারবেন চৈতন্য সিংহ ,ততদিন মদনমোহনদেবকে তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখতে হবে। অর্থাৎ কিনা বন্ধক রাখতে হবে । আসলে সেই যে মিত্র মহাশয়ের  মন বিকিয়ে গেছে  মদনমোহনের পদপঙ্কজে ,এখন এসুযোগে তিনি  নিজের কাছে মদনমোহনকে রেখে দিতে চান ,প্রাণভরে সেবা করতে চান কিছুদিন । আবার,ভক্তবৎসল ভগবান তো প্রেমের কাঙ্গাল চিরকালই। তাঁরও মন হয়েছিল  গোকুল মিত্রের প্রেমসেবা গ্রহণ করে তাঁকে সুখী করতে। ভক্ত যেমন  ভগবানকে সুখ দিতে চায় , ভগবানও তো তেমন তাঁর ভক্তকে সুখী দেখতে ভালোবাসেন। তাই হয়তো বা এমন পরিস্থিতি তৈরী হল।মন  একবিন্দুও না চাইলেও ভাগ্যের পরিহাসে চৈতন্য সিংহদেবকে  বাধ্য হয়ে কুলদেবতা মদনমোহনকে বন্ধক রাখতে হল গোকুল মিত্রের কাছে। রাজা আকুল হয়ে অশ্রু বিসর্জন করছেন দেখে ,  মদনমোহনদেব  সান্ত্বনার পরশ  দিলেন তাঁর প্রিয় চৈতন্য সিংহকে । তিনি পূর্ণ সায় জানালেন  তাঁকে বন্ধক রাখার জন্য।তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে  বন্ধক হয়ে গেলেন বাগবাজারে মদনমোহনদেব ।বাগবাজারে গোকুলধামের মন্দিরের ফলকে লেখা ১৭৬১ সালে শ্রীমদনমোহন জীউ স্থাপিত হয়েছেন। সম্ভবত, ঐ বছরেই বিষ্ণুপুর থেকে এখানে মদনমোহনদেবকে আনা হয়েছিল।
এদিকে এসময় থেকে মল্লরাজাদের সম্পদ ক্ষয় হতে শুরু করে দেয়, পতনের সূচনা হয় রাজত্বের।অভয়পদ মল্লিকের লেখা ‘History of Bishnupur Raj’-এ পাওয়া যায়– ‘ Thus  according to Babu Balindra Nath Singha of Indus , a scion of immediate cause of the decay and downfall were :–1) The Mahratta raids,
2) The famine of 1770,
3) The imposition of crusing land Tax by the     British Government and
4) Family dissensions
He also enumerated some indirect causes such as 5) the adoption of the Vaishnavas and 6) its corollary the construction of costly temples etc.অর্থাৎ, বর্গী বা  মারাঠাদের ক্রমাগত হানা, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ, ব্রিটিশদের খাজনা আদায়, রাজবংশের অন্দরে কোন্দল, বৈষ্ণব ধর্মমত গ্রহণ করায় রাজার আচরণে নীরিহতা আর মন্দির নির্মাণে বহুব্যায় —- এসব কারণের দরুণ মল্ল রাজত্ব ক্ষয় এবং পতনের দিকে যেতে থাকে।
সেসময়  বর্গীরা যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে যেত সেখানকার সব শস্য তছনছ করে দিয়ে , ধানক্ষেত পুড়িয়ে দিয়ে প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে যেত নগর-গ্রাম।  ওদিকে চৈতন্য সিংহদেব আর দামোদর সিংহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল,যুদ্ধ।আবার দুর্ভিক্ষের সময়  অনাহারে ক্লীষ্ট প্রজাদের বাঁচাতে ধর্মপ্রাণ চৈতন্য সিংহদেব দু’হাতে শস্য ,সম্পদ বিলোতে থাকেন। ফলে রাজকোষাগার আকস্মিক ভাবে প্রায় খালি হয়ে যায়। ইংরেজদের কাছে খাজনা বাকী পড়তে থাকে। রাজ্য নিলামে ওঠার পরিস্থিতি তৈরী হয়।এই ভীষণ সংকট কালে অর্থ জোগাড় করে  মদনমোহন বিগ্রহ ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে চৈতন্য সিংহদেবের পক্ষে।

বাগবাজারে গোকুল মিত্র  প্রাণঢালা সেবাপূজা করেন বিগ্রহের।  আদরে-সোহাগে সুখেই আছেন মদনমোহন। গোকুলের বাল্যবিধবা কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়া নিজের পতিরূপে ভজনা করেন মদনমোহনকে।আর মদনমোহনও তাঁর প্রেমে বাঁধা পড়লেন ।একদিন রাত্রে লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে মদনমোহন নিজের চূড়া, বাঁশী খুলে রেখে গেলেন শয্যায় । পরদিন প্রভাতে পুজারীজী মদনমোহনের চূড়া -বাঁশী খুঁজে পাচ্ছেন না। চারদিকে খোঁজ খোঁজ রব। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে লক্ষ্মীপ্রিয়া দেখেন তাঁর শয্যায় তাঁর মাথার বালিশের ওপরে রাখা ওগুলো । এ লীলা দ্বারা মদনমোহন যেন বার্তা দিলেন যে তিনিও লক্ষ্মীপ্রিয়াকে নিজের পত্নীরূপে দেখেন , আর তাই রাত্রে শয়ণে যান লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে।
আর একবার তো ভগবান নিজে সেবক ভৃত্য সেজে তাঁর ভক্তের সেবা করলেন ।গোকুল মিত্র  ভৃত্য মদনাকে ডেকে তামাক সাজিয়ে দিতে বললেন ।ঘটনাক্রমে মদনা সে সময় বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। আর গোকুল মিত্রের তামাক সেবনের সময় পেরিয়ে যেতে থাকলো। মদনমোহন করলেন কী, নিজে তামাক সাজিয়ে নিয়ে এসে গড়গড়ার নল এগিয়ে দিলেন গোকুল মিত্রের কাছে। গোকুল মিত্র মনের সুখে তামাক টানলেন। পরে মন্দিরের পূজারী দেখলেন মদনমোহন বিগ্রহের হাতে তামাক ও টীকার দাগ। আশ্চর্য হয়ে জানাতে গেলেন মিত্র মহাশয়কে। গোকুল মিত্র নিজে ছুটে এলেন সত্য কিনা পরীক্ষা করতে। সত্যিই তো! পরক্ষণেই মনে পড়লো তিনি তো তামাক দিতে বলেছিলেন ভৃত্য মদনা কে। খোঁজ নিয়ে জানলেন , মদনা তো তখন ভবনে ছিলেনই না, বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে , সে তামাক কে সেজে এনেছিল আর কেনই বা ঠাকুরের হাতে অমন দাগ।মিত্র মহাশয় আদেশ দিলেন , আর কেউ যেন ভবনে তামাক সেবন না করে এবার থেকে।ভগবানকে ভৃত্য হতে হয়েছে যে কারণের জন্য, সেই কারণটাই তিনি নির্মূল করে দিতে চাইলেন।এভাবে  একের পর এক মধুর লীলা করতে থাকলেন মদনমোহনদেব বাগবাজারে গোকুল ভবনে।

এরপর একদিন চৈতন্য সিংহদেব এলেন তাঁর প্রাণের  বিগ্রহ ফেরৎ নিতে।  তখন সম্ভবত ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ । তিনি পরিবারের সকলের অলংকারের বদলে  টাকা জোগাড় করে বিগ্রহ নিতে এলেন। এদিকে গোকুল মিত্র এতদিনে ভীষণ ভাবে  মদনমোহনের প্রেমে পড়ে গেছেন। বিগ্রহ ছাড়া থাকতে পারবেন না তিনি। তাই ,তিনি টাকার বদলে বিগ্রহ দান করে দিতে  অনেক অনুরোধ-উপরোধ করলেন রাজাকে। কিন্তু, রাজী নন রাজা। শেষে গোকুল  ,ছলে-বলে-কৌশলে বিগ্রহ পাবার জন্য   ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হেস্টিংস সাহেবের কাছে চৈতন্য সিংহের বিরুদ্ধে সময়মত টাকা ফেরৎ না দেবার নালিশ জানিয়ে আরও অনেক টাকা দাবী করে বিগ্রহের নামে  ডিক্রী আদায় করলেন । অত  টাকা দিতে  অসমর্থ রাজা । আলিপুর  আদালতের একতরফা রায় গেল গোকুল মিত্রের দিকে। ব্যাস,  ডিক্রী হয়ে গেলেন বিগ্রহ । তবে থেকে গোকুল মিত্রের বরাবরের সম্পদ হলেন মদনমোহনদেব। তখন মদনমোহনদেব  রাজাকে আশ্বাস  দেন যে প্রতিদিন আরতি ও ভোগের সময় তিনি বিষ্ণুপুরে প্রকট থাকবেন। প্রথম বিষ্ণুপুরের ইতিহাস লেখক শ্রী  ফকির নারায়ণ কর্মকার  তাঁর ‘বিষ্ণুপুরের অমরকাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন , ‘ তাই নিজের ভাগ্যকে নিজে ধিক্কার দিয়ে সেই অপকৌশলের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁর প্রাণের ঠাকুরকে কলকাতার বাগবাজারে রেখে আসতে বাধ্য হন তিনি। শেষ হয়ে যায় চৈতন্য সিংহদেবের সব আশা ভরসা।বিবাদ বিসম্বাদের মধ্যেই তিনি যে মদনমহনকে ওখানে রেখে এসেছিলেন সেই কথাই সত্য।’  শ্রীমতী বন্দনা বিশ্বাস তাঁর ‘কথা ও কাহিনীতে বিষ্ণুপুর ‘- বইয়ে লিখেছেন—‘বিগ্রহ ফেরতের ব্যাপারে গোকুল মিত্র মোটা টাকা দাবী করলে রাজা অপারগ হন—ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, অবশেষে আদালতে গোকুল মিত্রের এক তরফা ডিক্রীলাভ হয়। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় ৬০জন রাজা বিষ্ণুপুরে রাজত্ব করেছেন, কিন্তু এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি কখনো।’ ‘সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী’-তেও  বলা হয়েছে মামলায় জিতেছিলেন গোকুল আর তাই আসল মদনমোহনদেব তাঁর কাছে থেকে যায় কোর্টের আদেশে ডিক্রি হয়ে। “বিচার মতে রাজার ঠাকুর গোকুল ডঙ্কা মেরে নিলা।” আবার এই জীবনী বইয়ে  বলা হয়েছে যে, গোকুল মিত্রই নাকি পূর্ব জন্মে ছিলেন সেই দইওয়ালা,যিনি সিপাহী মদনমোহনকে দই খাইয়েছিলেন। মদনমোহন যখন দইয়ের হাঁড়ি সোনার করে দিয়েছিলেন তখন দইওয়ালা বলেছিলেন, সেসবে তিনি ভুলবেন না, মরণকালে তাঁর মদনমোহনের অভয়চরণ প্রাপ্তি চাই।

“রাজা বলে ভয় নাই জমি দিব আমি।
কোনখানে খেলেন দৈ দেখাও দেখি তুমি।।
বকুলতলায় দৈ খেলেন গোয়ালা দেখাইলো।
গোয়ালার হাড়ি যত সোনা হয়ে গেল।
পায়ে ধরে গোয়ালা কান্দিতে লাগিল।
ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন দেখিতে পাইল।।
গোয়ালা বলে ভুলাও কি হে মদনমোহন ।
মরণকালে দিও প্রভু অভয়চরণ।।”

তবে কোন কোন বইয়ে কিন্তু গোকুল মিত্রের জিতে যাবার কথা লেখা নেই। হেরে যাবার কথা লেখা আছে।মদনমোহন বিগ্রহ  বাগবাজারে রয়েছেন এ কথা  বিষ্ণুপুরবাসীরা অনেকেই মানতে নারাজ। বিষ্ণুপুরে পাঁচালীর আকারে লেখা যেসব ভ্রমণ গাইড পুস্তিকা গুলো বিক্রী হয় , সেগুলোতে ঘটনা অন্য রকম লেখা।’মদনমোহন মাহাত্ম্য’ বইতে লেখা চৈতন্য সিংহ যখন তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে  কুলদেবতা মদনমোহনকে বাগবাজার থেকে আবার  বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনতে যান, তখন গোকুল মিত্র  বিগ্রহ ছাড়তে নারাজ। তিনি মিথ্যা দলিল দেখিয়ে জানালেন যে, মদনমোহন তো রাজা বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁর কাছে আগেই ।  রাজা মনের দুঃখে চোখের জল ফেলে ফিরে যাচ্ছিলেন , সেসময় তাঁকে স্বয়ং মদনমোহন আদেশ দেন ,”হতাশ না হয়ে বরং আলিপুর কোর্টে গোকুল মিত্রের বিরুদ্ধে মামলা করো। তোমার হয়ে আমি পাগড়ী পরা উকিল সেজে সওয়াল-জবাব করবো।”  মদনমোহনের পরামর্শ মতো রাজা আপিল করলেন আদালতে ।বিচারের দিন মদনমোহন এসে দাঁড়ালেন উকিলের বেশে ।ম্যাজিস্ট্রেট নাম জিজ্ঞাসা করলে উকিল বলেন যে , তাঁর নাম মদন আর বিষ্ণুপুরের রাজার অধীনে তিনি বেতনভুক কর্মচারী। উকিল মদনের ক্ষুরধার প্রশ্নের সামনে অপ্রস্তুত , অপারগ গোকুল মিত্র হেরে গেলেন। কোর্ট আদেশ দিল বিগ্রহ ফিরিয়ে দিতে ।
গোকুল মিত্র একই রকম দেখতে একটি নকল বিগ্রহ তুলে দিলেন রাজার হাতে। চিনতে না পেরে নকল বিগ্রহ নিয়েই ফিরলেন রাজা। কিন্তু নদীর ধার থেকে এক বালক জোরে হেঁকে বলে যে , ” রাজা , তুমি তো নকল বিগ্রহ নিয়ে ফিরে যাচ্ছো।” সে বালক নাকি  স্বয়ং মদনমোহনই ছিলেন। রাজার টনক নড়লো। আসল মদনমোহন ফেরত নিতে আবার এলেন বাগবাজার।অভিযোগ জানালেন । গোকুল মিত্র বললেন,” আপনি বরং এক কাজ করুন। পাশাপাশি তিনটি বিগ্রহ রাখা হবে। চিনে নিয়ে আপনারটি আপনি নিয়ে যান।  আমার কোন আপত্তি নেই ,সবেতেই রাজী।” তিনটিই এক রকম দেখতে।’মদনমোহন মাহাত্ম্য কথা’-য় বলা হয়েছে এসময় মদনমোহনই নাকি  উপদেশ করেন, “যে বিগ্রহের বামাঙ্গ ভিজে থাকবে ও নাকের ওপর সাদা মাছি বসে থাকবে সেটি আমি ।” ঘটলও তাই। রাজা আসল বিগ্রহকে তুলে নিলেন। মদনমোহনদেব  ফিরে এলেন বিষ্ণুপুর। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে সেবাপূজা শুরু হল মদনমোহনের আবার‌। বিষ্ণুপুরের মত অনুযায়ী, যখন মদনমোহন চলে আসেন কলকাতা ছেড়ে, তখন তিনি গোকুল মিত্রকে  কথা দিয়েছিলেন এই বলে ,”ওহে গোকুল,  তুমি কেঁদো না। প্রতিবছর অন্নকূট উৎসবের সময় আমি তোমার কাছে বারো দন্ড থাকবো কথা দিচ্ছি ।”
কুলদেবতাকে কেন্দ্র করে বিষ্ণুপুরে মহোৎসাহে শুরু হল দোলযাত্রা, ঝুলন উৎসব ,রাসউৎসব ইত্যাদি।বিষ্ণুপুর পূর্ণ হল হর্ষে-আনন্দে।  ১৮০২খ্রিষ্টাব্দে চৈতন্য সিংহদেবের মৃত্যু হয় ।  তার আগের বছর অর্থাৎ ১৮০১-এ তিনি পৌত্র মাধব সিংহকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন।বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা তথা  মল্লরাজাদের রাজপুরোহিত বংশের বিশিষ্টজন শ্রী মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র জানালেন, বিতর্ক এড়াতে অনেক লেখকই আসল ঘটনা না জেনে , অনুমান ভিত্তিক লিখেছেন। ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। তিনি বলেন , তাঁদের পূর্বপুরুষরা বলতেন যে আসল মদনমোহন বিষ্ণুপুরে ফেরৎ আসেন। বিষ্ণুপুরেই নাকি  বিরাজ করছেন তিনি। (এ প্রবন্ধ লেখায়  অনেক তথ্য ও  ছবি দিয়ে সাহায্য করেছেন  মৃত্যুঞ্জয় মহাশয়। )

বাগবাজারে গোকুল মিত্র  মদনমোহনদেবের পাশে রাধিকার এবং ললিতা-বিশাখার বিগ্রহদের স্থাপন করলেন রাস উৎসবের সময় । সেরাত্রে আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার  জীবনাবসান হল। বলা হয় যে , শ্রীরাধা বিগ্রহের মধ্যেই নাকি গোকুল মিত্রের কন্যার আত্মা বিরাজিত রয়েছে।
মদনমোহনদেবের  জন্য বড় মন্দির ,  রাসমঞ্চ,ঝুলনমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন গোকুল মিত্র।  সমস্ত সম্পত্তি তিনি  তাঁর জামাই শ্রীমদনমোহনদেবের নামে করে দিয়েছেন ,যাতে তাঁর অবর্তমানে মদনমোহনের সেবা পূজায় কোন বিঘ্ন না ঘটে। এখনও পর্যন্ত উত্তর কলকাতা চিৎপুর রোডে রাজবল্লভ পাড়ায় গোকুল মিত্র লেনে মদনমোহন তলা নামে সুপ্রসিদ্ধ মদনমোহন মন্দির এলাকা ।গোকুলধাম নামে বিখ্যাত সেই সুবিশাল মন্দির। রাজবল্লভ পাড়ার মোড়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী বাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ডানদিকে মন্দির পরে ।মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেই বাঁ দিকে বিশাল চওড়া শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে  দোতলায় উঠে যেতে হয়। সেটি দর্শনার্থীদের ব্যবহারের জন্য সিঁড়ি। উপরে দোতালাতে অবস্থান করেন শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব। আর যদি সিঁড়িতে  না উঠে প্রবেশদ্বার দিয়ে সোজা এগিয়ে আসা হয় , তবে নাটমন্দির চোখে পড়ে। এখানে মদনমোহনদেবের জন্য নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। এই  চত্বরেই প্রতিদিন আগে অনাথ-আতুরদের প্রসাদ ভোজন করানো হত।নাটমন্দিরকে ঘিরে আঙ্গিনার ওপারে তিনদিকে ঠাকুর বাড়ীর দালান।একদিকে ভোগের রন্ধনশালা ,আর একদিকে মন্দিরের অফিসঘর ,এসব । আর নাটমন্দিরের ডানদিকটার পুরোটা জুড়ে বিশাল  ঝুলনমন্দির। মার্বেল বাঁধানো ঝুলন মঞ্চ।  মঞ্চের মধ্যে  দোলনা সিংহাসন।ঝুলনের সময় এখানেই ঝুলন উৎসব হয় বড় করে।
উপরে  দোতলায় মদনমোহনদেবের রাজত্ব । সিঁড়ি দিয়ে উঠেই  ডানদিকে দরবার হল তাঁর। দরবার হলের শেষপ্রান্তে সিংহাসনে শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন বিরাজ করছেন । সাথে আছেন ললিতা-বিশাখা সখীর বিগ্রহ, শালগ্রাম শিলা আর ছোট্ট গোপালসোনা। নিরাপত্তার কারণে  ব্যবধান দেওয়া লোহার গ্রিলের । সব মন্দিরে যেখানে বিগ্রহ অবস্থান করেন সেখানে সামনেই ভোগ লাগানো হয় , মদনমোহনের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয় । তাঁর ভোগের ঘর আলাদা, বিশ্রামের ঘরও আলাদা।ভোগের সময় সিংহাসন থেকে নেমে যান ভোগমন্দিরে। সেখানে ভোজন করে আসেন বিশ্রাম কক্ষে। বারান্দা পার করে বিশ্রাম ঘর। বিশ্রাম করার পর এখানেই তাঁকে শৃঙ্গার করানো হয় ।নতুন সাজে সজ্জিত  হলে আবার প্রবেশ করেন দরবার হলে। সিংহাসনে আরোহন করেন এরপর।আর, তিনি কখনও ফেরৎ যাত্রা করেন না অর্থাৎ একমুখী হয়ে গমন করেন সবসময়,একই পথে উল্টো দিকে হাঁটেন  না।
দোতালায় অপরদিকে  ভাঁড়ার-ঘর(স্টোর রুম)। এত বড়  ভাঁড়ার ঘর সমগ্র কলকাতায় আর নাকি নেই। তারপাশে অতিথিদের  থাকার ঘর । এরপরে আবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামা। সেই সিঁড়ি দিয়ে মদনমোহন নামেন ঝুলনের সময় , রাসের সময়।  মন্দির থেকে  বেড়িয়ে বাঁ দিকে আরো একটু এগিয়ে গেলেই রাস্তার ওপরে পাকা রাসমঞ্চ তৈরী আছে। ।রাসের সময় উৎসব হয় । বিগ্রহদের নিয়ে যাওয়া হয় তখন সেখানে। এছাড়া  সারা বছরই উৎসব হয় গোকুলধামে। বড় করে পালিত হয়  অন্নকূট উৎসব। অন্নকূটে নীচে একতলায় ভক্তরা কাপড় পেতে ধরেন আর ওপরের দোতলার বারান্দা থেকে মদনমোহনদেবের অমৃতপ্রসাদ ফেলা হয় ।ভক্তরা আকুলতাসহ হুড়োহুড়ি করে সংগ্রহ করেন প্রতিটি কণা প্রসাদের।
বর্তমানে বাগবাজারে মদনমোহনদেবের পালাদার সেবাইত হলেন শ্রী মাধবমিত্র। ১৫ই এপ্রিল ,২০১৯ থেকে ১৩ই এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত মদনমোহনের সেবার ভার তাঁর। আর , বিগ্রহ অর্চন-বন্দন-পূজার ভার শ্রী সুব্রত পূজারী মহাশয়ের ওপর। তিনি হলেন ধরণী মহাপাত্রের সপ্তম অধস্তন পুরুষ। মল্লরাজারা ‘পূজারী’ উপাধি দিয়েছিলেন তাঁদের।  পূজারী মহাশয়  জানালেন , যখন মদনমোহন বাগবাজারে চলে আসেন, তখন তাঁর পূর্বপুরুষরাও  বিষ্ণুপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন মদনমোহনদেবের সেবা করবেন বলে। সেই প্রথম দিন থেকে তাঁদের বংশের পূজারীরাই মদনমোহনদেবের পূজার্চনার দায়িত্বে। মদনমোহনই নাকি স্বয়ং গোকুল  মিত্র কে আদেশ দিয়েছিলেন কেবল এই বংশের হাতেই তিনি পূজা নেবেন। ফকির নারায়ণের লেখাতেও একই কথা পেলাম–‘ মিত্র মহাশয়ের প্রতি স্বপ্নাদেশ হয়। স্বপ্নে  মদনমোহন তাঁকে বলেন ,”আমার সেবাইত, পুরোহিত ব্যতীত অপরের হাতে সেবা-পূজা নিয়ে আমার তৃপ্তি হয় না ।তাদের অভাবে আমি উপবাসী আছি। আমার স্বপ্নাদেশের কথা রাজাকে জানিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আয়‌। নইলে এইরকম উপবাসী অবস্থাতেই আমাকে দিন কাটাতে হবে।”…. সবকিছু শুনে রাজা কাঁদতে থাকেন। দ্বিরুক্তি করেন না ।সেবাইত, পুরোহিতকে পাঠিয়ে দেন তাঁদের সঙ্গে‌।’
সুব্রত পূজারী মহাশয় জানালেন, বাগবাজারের বিগ্রহই আসল মদনমোহন। তিনটি বিগ্রহের অবশিষ্ট বিগ্রহটি বর্তমানে তাঁদের ব়ংশে রয়েছেন। এখনও নানান অলৌকিক লীলা করেন মদনমোহন। দিনে-দুপুরে-রাত্রে মদনমোহনের  চলার নূপুরের ধ্বনি শোনা যায় , হঠাৎ  ম-ম করে ওঠে তাঁর অঙ্গগন্ধ  নির্জন বারান্দায়।
শ্রীমদনমোহনের অলৌকিক লীলা নিয়ে প্রচুর বই প্রকাশ হয়েছে । সেগুলির কোন কোনটি বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা বা বিষ্ণুপুর রাজবংশের ঘনিষ্ঠ কবিরা লিখেছেন , আবার কোনটা রচনা করেছেন গোকুল মিত্রের দিকের কবিরা। তাই সেসব লেখাতে পক্ষপাতিত্বের একটা ব্যাপার  লক্ষ্য করা যায় । মূল বিগ্রহ যে প্রকৃত কোথায় অবস্থিত, বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে এটা নিয়ে একটা চোরা দ্বন্দ এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে।বিষ্ণুপুর থেকে বলা হয় মদনমোহনদেব বিরাজ করছেন বিষ্ণুপুরেই। আর,বাগবাজার থেকে বলা হয় মূলবিগ্রহ রয়েছেন বাগবাজারে। তবে হ্যাঁ , বর্তমানে মদনমোহন যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, তিনি যে দল-মাদল কামান দেগেছেন আর গোকুল মিত্রের কাছে তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে বন্ধক ছিলেন এ কথা কিন্তু সত্য—–প্রতিটি গ্রন্থেই স্বীকৃত হয়েছে । ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’গ্রন্থে ড. সুকুমার সেন লিখেছেন –“অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় দেবদেবী ,ব্যক্তি বা ঘটনা বিশেষ ও দৈব-দুর্বিপাক লইয়া ছড়া গান রচিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি আমাদের হস্তগত হইবার পূর্বেই লুপ্ত হইয়াগিয়াছে ।…..একাধিক কবি রচিত মদনমোহন বন্দনা  পাওয়া গিয়াছে। ইহার বর্ণনীয় বিষয় হইতেছে  মদনমোহন কর্তৃক দল-মাদল কামান দাগিয়া বিষ্ণুপুর হইতে বর্গী বিতরণ এবং চৈতন্য সিংহ কর্তৃক কলিকাতায় গোকুল মিত্রের  নিকট মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখা।”
মদনমোহন সর্বদা তাঁর ভক্তের সঙ্গে থেকেছেন সেবক রূপে, ভৃত্য রূপে, বন্ধু রূপে ।তা সে বিষ্ণুপুরের ভক্তিমান রাজা গোপাল সিংহ ,চৈতন্য সিংহই হন বা বাগবাজারের ধনাঢ্য ,দানবীর ,ভক্তমহাজন গোকুল মিত্রই হন না কেন। ভগবান যে তাঁর ভক্তের পরম সুহৃদ, পরম বান্ধব, পরম হিতৈষীজন এই সত্য সংস্থাপিত হয়েছে বারে বারে ,নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ মদনমোহনদেবের নানান অলৌকিক লীলায়।
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলতেন , কিছু চাইতে হলে তিন জনার কাছে চাইতে হয়–দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী, খড়দহের শ্যামসুন্দর আর বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের কাছে।
মদনমোহনদেবের অলৌকিক কাহিনী শুনে, তাঁর মনোলোভা চিতচোর সৌন্দর্যের কথা জেনে এখনও পর্যন্ত ভক্তরা তাঁকে দর্শন করতে ছুটে যান কলকাতার বাগবাজারে আর  বিষ্ণুপুরের মন্দিরে। আসল বিগ্রহ যেখানেই থাকুন না কেন , উভয় স্থানে গিয়েই ভক্তরা অনুভব করতে পারেন শ্রীশ্রীমদনমোহনদেবের উপস্থিতির  আবেশ ও  তাঁর লীলার দিব্য অনুভূতি। আসলে, ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ভগবান যে সকল স্থানেই প্রকট হতে একান্ত ভাবে ভালোবাসেন….. তাঁর অবস্থিতি তো সর্বস্থানে!
জয় শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব।

সমাপ্ত

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

শান্তিপুরের শ্রীশ্যামসুন্দরের অলৌকিক লীলামাধুরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

আহা ! শান্তিপুরের আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির শ্রীশ্যামসুন্দরের যেমন চিত্তাকর্ষক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য তেমনই তাঁর অপূর্ব সব লীলা । পুত্র যেমন পিতার কাছে আবদার করে, বায়না করে তেমনভাবেই শ্যামসুন্দর নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ রূপে করেছেন এটা-সেটার দাবি। কখনো শ্রীআনন্দকিশোর গোস্বামীর কাছে কখনও বা শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের কাছে। প্রসঙ্গতঃ জানাই , আনন্দকিশোর গোস্বামী ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের পিতাপ্রভু ।

অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র শ্রীদেবকীনন্দন ছিলেন আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরজীউ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হন স্বয়ং অদ্বৈত, তাঁর পুত্র বলরাম এবং পৌত্র দেবকীনন্দন— তিনজনের দ্বারা মিলিত ভাবে। দেবকীনন্দন নির্দেশিত নিয়ম মেনেই এখনও সেবাপূজা চলে। বিশ্ববিশ্রুত সিদ্ধ মহাপুরুষ ,প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই বংশেই জন্মগ্রহণ করেন‌ বলে এই বাটীকে ‘বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাটী’-ও বলা হয়।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখনও ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করেননি। মনে-প্রাণে তিনি ভীষণ ভাবে ব্রাহ্মধর্মে বুঁদ হয়ে আছেন । কলকাতাতে থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার চালাচ্ছেন জোরকদমে । মাঝে মধ্যে শান্তিপুরে যান । আর যখনই শান্তিপুরে যান তখনই শ্যামসুন্দর তাঁর সম্মুখে প্রকট হন। প্রেমচাহিদার যেন শেষ নেই বিজয়কৃষ্ণের কাছে শ্যামসুন্দরের । ওদিকে ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণ নীতিগতভাবে মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী থাকলেও , কোন অজ্ঞাত কারণে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ , টান অনুভব করেন শ্যামসুন্দরের প্রতি। আর , তাই শ্যামসুন্দরের আবদারও মিটিয়ে চলেন একের পর এক।

একবার নটখট্ শ্যামসুন্দর বললেন , “শোন বিজয় ! আমার দেখ না বাঁশি নেই ! একটা বাঁশী বানিয়ে দে না !” এমন ভাবে শ্যামসুন্দর বললেন, যে বুকে গিয়ে বাজলো বিজয়কৃষ্ণের সে কথা । তিনি বাংলাদেশের ঢাকাতে অর্ডার দিয়ে খুব সুন্দর একটি বাঁশি প্রস্তুত করিয়ে দিলেন। বাঁশি পেয়ে বড় আনন্দ পেলেন বিগ্রহ শ্যাম।

আবার একবার শ্যামসুন্দর বললেন , “বাঁশী তো দিলি , এবার চূড়াটাও গড়িয়ে দে। বাঁশি-চূড়া না থাকলে কী সাজ সম্পূর্ণ হয়, বল !” শ্যামসুন্দরের বলার ঢঙে হেসে ফেললেন বিজয়কৃষ্ণ । মনটা কোমল হয়ে গেল যেন । স্নেহব্যথা পেলেন চিনচিনে এক । তিনি পরদিনই ঢাকায় সংবাদ পাঠিয়ে চূড়ার অর্ডার দিলেন । বেশকিছুদিন পর ঢাকা থেকে এল চূড়া । বাঁশি আর চূড়ার সাজে শ্যামসুন্দরের সুন্দর সাজ এমন সুন্দর হল যে নয়ন ফেরানো যায় না । কিন্তু, না , শ্যামসুন্দরের মনের ইচ্ছা অন্য । তিনি বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ নিয়ে হাজির । অনুযোগের সুরে বললেন , “চূড়া তো দিলি , ভালো হয়েছে। কিন্তু , আমার মনোমতো হয়নি।” বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “কেন , কি রকম হলে তোমার মনোমতো হবে শুনি !” শ্যামসুন্দর বায়নার মত করে বললেন , “আমার সোনার চূড়া চাই। রূপার চূড়া নেব না ।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন অবাক হয়ে, “সে কী কথা ! আমি সোনার চূড়া কোথায় পাবো ! অত টাকা আছে নাকি আমার !কোথায় পাব টাকা !” শ্যামসুন্দর বললেন, “রাঙ্গা ঠাকুরাণীর অনেক টাকা আছে, জানিস তো ! তুই আমার নাম করে বল , দেখবি টাকা দেবে ।”

রাঙ্গা ঠাকুরাণী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাকিমা ছিলেন । তাঁকে বিজয়কৃষ্ণ সব জানালেন । তিনি শুনেই আনন্দে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না । শ্যামসুন্দরের মুখে তাঁর নাম ! শ্যামসুন্দর নিজে যেচে তাঁর থেকে সেবা নিতে চেয়েছেন । এমন সৌভাগ্যও তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো, আহা ! পুলকিত , রোমাঞ্চিত হলেন তিনি । অতি শীঘ্র টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বিজয়কৃষ্ণকে । সে টাকা থেকে রূপোর চূড়ায় সোনার পাত বসিয়ে সোনার চূড়া বানানো হল। অপূর্ব দর্শন রূপোর বাঁশি আর সোনার চূড়ায় সেজে শ্যামসুন্দরের যে মনোহারী, মনাকর্ষক , মুগ্ধকর সাজ হল তা ভাষায় বর্ণনার অতীত । তিনি নিজেও অনুধাবন করলেন যে , এরূপ দেখলে বিজয়কৃষ্ণও তাঁর প্রেমে পরে যাবেন । তাইতো বিজয়কৃষ্ণের কাছে এবার বললেন, “হ্যাঁ রে, দিলি তো চূড়া-বাঁশী । এবার একটু দেখবি না আমায় এসব পরে কেমন লাগছে ! যা, মন্দিরে যা, দেখ আমায়।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “বা-রে ! আমি না ব্রাহ্ম! মন্দির-টন্দিরে আমায় যেতে নেই জানো না ! ওসব দেখতে নেই।”

শ্যামসুন্দর—”তাতে কী ! ব্রাহ্ম না হয় হলিই। দেখতে দোষ কী । আর ব্রাহ্ম তো তুই আমার ইচ্ছেতেই হয়েছিস । আমিই বানিয়েছি ব্রাহ্ম তোকে।”

শ্যামসুন্দরের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ চুপ করে রইলেন । পরে একসময় মন্দিরে গিয়ে দর্শন করে এলেন শ্যামসুন্দরকে। সত্যিই শ্যামসুন্দরের সৌন্দর্য দর্শনে মন যেন কেমন করে উঠল তাঁর।বোধহয় ইচ্ছে হল একবারটি নিজের কোলে করার, বক্ষে ধরে নেওয়ার ; শ্যামসুন্দরের ওই রাতুল চরণে মস্তক স্পর্শ করাতে ইচ্ছে হল আত্মনিবেদনের ভাব নিয়ে।

ঠিক এমনই ঘটনা আবারও একদিন হল। বিজয়কৃষ্ণের মনে হল যেন কেউ নূপুর পরে হাঁটছে। তিনি বেরিয়ে এলেন । নূপুরের ধ্বনি যেদিকে, সেদিকে এগিয়ে গেলেন। মনে তাঁর দোলা দিয়েছে, এ ধ্বনি শ্যামসুন্দরের চরণের নূপুরের না তো ! কারণ, মাঝেমধ্যেই তিনি শ্যামসুন্দরের নিক্কণের ধ্বনি পান। তাঁর পিতা-মাতা বা পরিবারের অনেকেই পান । শ্যামসুন্দর নিজের উপস্থিতি জানান দেন এভাবে। তাই আজ বিজয়কৃষ্ণ নূপুরের ধ্বনি শুনেই কোন যেন অমোঘ টানে চলে গেলেন শ্যামসুন্দরকে দেখবেন বলে বা ধরবেন বলেই হয়তো বা ।

হ্যাঁ , শ্যামসুন্দরও আজ যেন বিজয়কৃষ্ণের জন্যই রূপের ফাঁদ পেতেছেন । বিজয়কৃষ্ণ দেখলেন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে শ্যামসুন্দর । দুষ্টুমির ঝলক তাঁর আখির প্রান্তে । তাঁর রূপ দেখে বিজয়কৃষ্ণ ক্ষণিকের জন্য বিহবল হয়ে গেলেন। আর অন্তর্যামীর দেরী হল না অন্তর পড়তে বিজয়কৃষ্ণের । বিদ্যুতের ঝলকের থেকেও তাঁর অনুধাবন ক্ষমতা অতি তীব্র, অতি দ্রুত যে। তখন শ্যামসুন্দরের মনের ভাবখানা এমন যে কেমন ফাঁদ পেতেছি আমি, দেখলি তো ! কেমন ধরা পড়লি সে ফাঁদে, বল ! আর সেকারণেই ছিল দুষ্টুমির ঝলক নট্‌খট্‌ নওলকিশোর শ্যামসুন্দরের নয়নের কোনায়। কন্ঠে তিনি দুষ্টুমির সুর করে বললেন, “ বল তো , এবার আমায় কেমন দেখছিস ?” স্বগোতক্তির ন্যায় বিজয়কৃষ্ণের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “অতি সুন্দর তুমি।” পরক্ষণেই বিজয়কৃষ্ণের একটা কথা মনে এল, তিনি বলে ফেললেন তা আপনমনে —-”আচ্ছা, একটা কথা বলো তো ! আমায় দর্শন দিয়ে এত কৃপা করার ইচ্ছে যখন তোমার , তাহলে কেন এমন করে ব্রাহ্ম করলে আমায়?”

শ্যামসুন্দর আকর্ণ-বিস্তৃত মধুময় হাসি হেসে বললেন, “জানিস, অলংকার ভেঙ্গে আবার গড়ালে আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয় তা।” বিজয়কৃষ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন এ উত্তর পেয়ে । শ্যামসুন্দরও অন্তর্ধান করলেন সেই মুহূর্তেই , আসল কাজ করা হয়ে গেছে এই মন নিয়ে।

শ্যামসুন্দর নিজের প্রিয় পাত্র বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগও করতেন । একবার পূজারী ভোগের সময় জল দিতে ভুলে গেলেন। শ্যামসুন্দর বাচ্চা ছেলেদের মতো এসে বিজয়কৃষ্ণকে বললেন, “দেখ বিজয়, তোদের পূজারী কেমন ! মধ্যাহ্নভোগে পারস করেছে আর জল দিতে ভুলে গেছে । বলতো খেতে বসে জল না দিলে হয় !” তখন বিজয়কৃষ্ণ পূজারীকে খানিকটা তিরস্কার করেই ঘটনা জানালেন সব। আর যেন এমন ভুল না হয় সাবধান করলেন।

আবার অন্য একটা দিনের কথাও জানাই । মন্দিরে চুরি করল এক চোর । শ্রীরাধারাণীর মুকুটটি বড় ভালো লাগায় হয়তো বা লোভ সামলাতে না পেরে সেটি নিয়ে গেল। তবে পরে নিজের ভুল বুঝে অনুতাপানলে জ্বলে ফেরত দিতে চাইলো । কিন্তু, আর তো উপায় নেই গর্ভমন্দিরে ঢুকে রাধারাণীর মস্তকে মুকুট পরিয়ে দেবার । ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে । তাই করলো কী , মুকুটটি মন্দির চত্বরেই একটু আড়াল করা স্থানে ফেলে গেল। মুকুটের খোঁজ চলছে এদিকে । পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই । তখন শ্যামসুন্দরের শ্রীরাধিকা বিজয়কৃষ্ণের কাছে প্রকাশিত হলেন । সে সময় আসনে বসে ধ্যান করছেন বিজয়কৃষ্ণ। শ্রীরাধিকা মুকুটের অবস্থান বলে দিলেন । বিজয়কৃষ্ণ তা সকলকে জানালেন। সত্যিই সে স্থানে পাওয়া গেল মুকুট।

ভক্তিপূর্ণ প্রণাম পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করি এহেনো সুন্দরের সুন্দর শ্যামসুন্দর বিগ্রহকে ও যাঁর সঙ্গে তিনি এমন মধুময় লীলা করেছেন সেই শ্রদ্ধেয় প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

নিত্যানন্দ এয়োদশী কেন এত মহিমাময় ? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

বঙ্গদেশের বেশিরভাগ রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের দু’পাশে আমরা দু’বাহু উর্দ্ধে প্রসারিত করা নিতাই-গৌরের মূর্তি দেখতে পাই । প্রায় সকলেই জানি গৌর  অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব। কিন্তু নিতাই  বলতে বুঝি গৌরের দাদা বা ভাই স্থানীয় কোন বিশেষজন। কারণ, প্রচলিত প্রবাদ বাক্য প্রায় সকলেরই জানা– “নিতাই-গৌর দুই ভাই , হল এক ঠাঁই।”  যদি প্রশ্ন করা হয় , আচ্ছা তাঁদের মধ্যে গৌর কে আর কোনজনই বা নিতাই। তাহলে কয়জন যে সঠিক উত্তর দিতে পারব সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ।বলবো হয়ত, দু’জনেই তো একই রকম দেখতে,তাই ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক । হ্যাঁ ,খুবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এ কারণে যে, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর এই প্রায় পাঁচশো বত্রিশ বছরের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যত চর্চা হয়েছে তার সিকি ভাগও নিতাই বা নিত্যানন্দকে নিয়ে হয়নি । যত গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে রচিত হয়েছে , পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বিশেষ চরিত্র নিয়ে এত গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। অথচ, যে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে এত লেখালিখি, যাঁর ভক্তি আন্দোলন সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে দূর মহাদেশে প্রভাব ফেলেছে—-সেই তিনি নিজমুখে শ্রীরাঘব পণ্ডিতের কাছে স্বীকার করেছেন , “এই নিত্যানন্দ যেই করায় আমারে।সেই করি আমি এই বলিল তোমারে।।”(চৈ.ভা.অন্ত্য,৫) নিত্যানন্দ যদি না থাকতেন তাহলে শ্রীচৈতন্যদেবকে জগত জানতে পারতো না। ভক্তি আন্দোলন হতই না । যখন মন্দিরে নিত্যানন্দ বিগ্রহ স্থান পেয়েছেন, পূজা পাচ্ছেন ,তখন তাঁর পূজিত হওয়ার কি কারণ হতে পারে সে সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ওঠাটা খুব যুক্তিসংগত। তবে তা কিন্তু অনেকাংশে হয়নি বললেই চলে। কারণ সেই একটাই—তাঁর সম্পর্কে আলোচনা কম। অথচ ,এই নিত্যানন্দই ছিলেন মধ্যযুগের বঙ্গদেশে সংঘটিত ধর্মবিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারী। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব প্রদর্শিত প্রেমভক্তি-ধারার ভগীরথ । মধ্যযুগীয় মানবমুক্তির অগ্রদূত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের  অভিন্ন আত্মা নিত্যানন্দ । চৈতন্যদেব ও  নিত্যানন্দের যৌথ সংকল্প ও প্রয়াসের সার্থক প্রতিচ্ছবি হল প্রেমভক্তি আন্দোলন। চৈতন্যের ইচ্ছার রূপকার হলেন নিত্যানন্দ।যা নিমাই চেয়েছেন, নিতাই  করেছেন তা বাস্তব। নিমাই নামপ্রেম  এনেছেন আর অকাতরে তা বিলিয়েছেন নিতাই।নিমাই-নিতাইয়ের লোকহিতৈষণা ব্রতেই  নবযুগের সূচনা সম্ভব হয়েছে । ভারতবর্ষের প্রথম সাম্যবাদী সমাজ স্থাপিত হয়েছে নিত্যানন্দরই পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতায় । ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গণ সংগঠন গড়ে উঠেছিল নিত্যানন্দেরই নেতৃত্বে। চন্দ্র প্রকাশ হতে যেমন , সূর্যের আলো লাগে , ঠিক তেমন গৌরচন্দ্র প্রকাশ হত না যদি না নিতাই সূর্য থাকতো । আর , একথা অত্যুক্তি বা অতিকথন ও অতিরঞ্জন নয় । কেন? তা আমরা আজ এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আলোচনা করার চেষ্টা  করবো।  ৩রা ফেব্রুয়ারি, মাঘী শুক্ল ত্রয়োদশী তিথিতে নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর। এই সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে আজও যে তিনি কতখানি প্রাসঙ্গিক তা জানবো ।

ইতিহাসের খাতে নিতাই-নিমাই দুটি হৃদয়ধারা গঙ্গা-যমুনার মত পারস্পরিক সৌহার্দ্য ,ভ্রাতৃত্ব ,সাহচর্য্যকে  সম্বল করে নিরবধি বয়ে গেছে নির্দন্ধ, নিঃস্বার্থ ভাবে ।একে অপরের প্রতি কী সুগভীর টান,ভালোবাসা,অন্তরঙ্গতা — যা ইতিহাসে বিরল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, “মুঞি নিত্যানন্দের দাস— একথা প্রতিদিন মুখে যে একবার বলে,আমি তার হয়ে যাই।” আবার, নিত্যানন্দ বলেছেন, “ যে দিনান্তে অন্তত একবার ‘হা গৌরাঙ্গ’ বলে ,আমি তার দাস হয়ে যাই।” নিতাই-নিমাই দু’জনারই জীবনের এক লক্ষ্য, এক অভীপ্সা— পতিত উদ্ধার করা ,দীন-দুঃখী- দরিদ্র-দুর্বলদের মুখে হাসি ফোটানো।

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল অদ্ভুত জনাকর্ষিণী ,লোকমোহিনী শক্তি। মানুষের মন যে কী ভাবে মমতাভরা ব্যবহার দিয়ে জয় করা যায়, তা যেমন তিনি জানতেন ,তেমনি নিজ ব্যক্তিত্বগুণে সংগঠন কার্য্য পরিচালন পদ্ধতিও তাঁর অজানা ছিল না ।আর ,সে কারণেই তাঁরই অনুপ্রেরণায় শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তনকে গণসঙ্গীতের রূপ দিয়ে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  নিত্যানন্দ নদীয়াতে আসার আগে পর্যন্ত কীর্তন ঘরের মধ্যে করা হত।নিত্যানন্দ পরামর্শ দিয়ে কীর্তনকে খোলা আকাশের নীচে পথে বের করে আনালেন ।আকাশে বাতাসে হিল্লোল তোলা কীর্তনের ভাব,আবেগ,ধ্বনি,সুর ,অনুরণন ক্রমে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করলো। সর্বস্তরের মানুষ সমবেতভাবে গলা মেলানোয় তা সংকীর্তনের রূপ নিল।  গণবিপ্লবের মাধ্যম  হয়ে উঠল ধীরে ধীরে এই সংকীর্তনরূপ গণসংগীত।  সকল শ্রেণীর মানুষ শামিল হতে থাকলেন সেই সংকীর্তনরত  গণজোয়ারে। ভেদ-ভাবের ভাবনা ভুলতে থাকলো মানুষ। জাতের বিচার করে নয় , ভক্তির গভীরতায় একে অপরকে প্রণাম করতো। ফলে দেখা গেল ব্রাহ্মণ হয়েও চন্ডাল ভক্তের পদধূলি নিয়ে মাথায় দিচ্ছে নিজে। অসাম্য দূর হল।অনাথ-আতুর-অবহেলিতরা সমাজে  হৃত সম্মান ফিরে পেতে থাকলেন। নিত্যানন্দ দেখালেন ধর্ম কখনো বিদ্বেষ তৈরি করে না , তৈরী করি আমরাই।ধর্ম তো আশ্রয় দেয় , ধারণ করে আমাদের। মানুষের সাথে মানুষের সম্মিলন করায়  ধর্ম।  এভাবেই সেদিন থেকে রক্ষণশীল সমাজের স্মার্ত-বিধি-বিড়ম্বনার অবসান সূচীত হয়েছিল। জাতিভেদের অবসান হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম সকলকে ধারণ করে সার্বজনীন মানব ধর্মে পরিণত হয়েছিল। “বৈষ্ণবের জাতি বুদ্ধি যেই জন করে। কোটি জন্ম অধম যোনিতে ডুবি মরে”।(চৈ.ভা.)

তবে পথে-ঘাটে এমন  সংকীর্তনের ফলও হয়েছিল মারাত্মক । কাজীর আদেশে পেয়াদারা কীর্তনের  বাদ্যযন্ত্রগুলো মাটিতে আছাড় দিয়ে ভাঙ্গতে থাকলো । সংকীর্তনকারীদের প্রহার করতে থাকলো। গৌরাঙ্গ সিদ্ধান্ত নিলেন কাজীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে নামবেন ।হাতে মশাল নিয়ে কীর্তন করতে করতে কাজীর বাসভবন ঘেরাও করা হল।  সেই ঘেরাও মিছিলের  নেতৃত্বে ছিলেন নিতাই। অস্ত্র একটাই—সংকীর্তন। নিজের ভুল বুঝে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন ভীত কাজী। তিনি গৌরাঙ্গের চরণে আত্মসমর্পণ করলেন ।এই আন্দোলনই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম অহিংস আন্দোলন। ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘History of Bengali Literature’ গ্রন্থে একথাই  লিখেছেন— “It was perhaps the first act of civil disobedience in the history of India.” এখনও পর্যন্ত নগর সঙ্কীর্তন করার সময় যে ‘খোন্তা’ ব্যবহার করা হয় , তা আসলে কাজীর থেকে আদায় করা কীর্তনের গেটপাস, যা সঙ্কীর্তন প্রচার-প্রসারের উদ্যোগে সেদিন নিত্যানন্দের জয়কে সূচীত করে।  সুবিশাল দেহী, অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্বানুভাবানন্দে বিভোর নিত্যানন্দ নবদ্বীপের ঘরে ঘরে পথে পথে নামপ্রেম বিতরণ করতে মত্ত সিংহের মত বিচরণ করেছেন। “নিত্যানন্দ মত্ত সিংহ সর্ব নদীয়ায় । ঘরে ঘরে বুলে প্রভু অনন্ত লীলায়”।(চৈ.ভা.মধ্য,২৪)

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল এক সুন্দর ক্ষমাশীল সর্বংসহ মানসিকতা। ঠিক সেকারণেই , নবদ্বীপে যখন দুর্বৃত্ত জগাই-মাধাই মদের কলসীর প্রহার করে কপাল ফাটিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করেন, তখনও নিত্যানন্দ নির্বিকার। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে , অথচ তাও যে রক্ত ঝরালো, চাইছেন তার উদ্ধার। এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু সমগ্র বিশ্বের ধর্মের ইতিহাসে বিরল। মহাপ্রভু, তাঁর প্রাণের নিতাইয়ের অমন করুণ পরিণতি দেখে‌ ক্রোধে আত্মহারা হয়েছেন সেসময়। কিন্তু, নিত্যানন্দ সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছেন জগাই-মাধাইকে । এমন অহিংস নীতির গুণেই জগাই-মাধাইয়ের মত নৃশংস , অত্যাচারী , কুখ্যাত মানুষের মন পরিবর্তিত হয়েছিল। সেদিন থেকে মানবিকতার মন্ত্র পেয়ে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নিত্যানন্দের আদেশে তাঁরা গঙ্গার ঘাটে আগত স্নানার্থীদের সেবার কাজে নিজেদের বাকী জীবন নিয়োজিত করেছিলেন।  কাটোয়ায় ‘জগাই-মাধাইয়ৈর ঘাট’ আজও সেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । সদা আনন্দে থাকা  নিত্যানন্দ এমন ক্রোধহীন,  অহংকারহীন ছিলেন বলেই পদকর্তা লোচন দাস ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অক্রোধ পরমানন্দ নিত্যানন্দ রায় । অভিমান শূন্য নিতাই নগরে বেড়ায়।।”

নিত্যানন্দ ছিলেন অদোষদর্শী , কখনো কারও দোষ দেখতেন না। সকলেই তাঁর কাছে বড় আপনারজন।  সর্বদা বালখিল্যভাবে তিনি মত্ত থাকতেন।  বালকের ন্যায় মুখে খলখল হাসি আর শ্রীনয়নে যেন আনন্দধারা বয়ে যেত। তাঁকে যে দেখত তার মনও আনন্দে ঝংকৃত হয়ে উঠতো। আর কেউ যদি চৈতন্যের ভক্ত হতেন তবে তো কথাই নেই । গৌরাঙ্গের নাম নিলেই তিনি নিজেকে তার চরণে বিকিয়ে দিতেন।  তাইতো কেবল বলতেন, “আমাকে কিনিয়া লহ বল গৌরহরি”।

মহাপ্রভু চেয়েছিলেন একটি সার্বজনীন মানবধর্ম প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে। জাতের দলাদলি, কৌলিন্যাচারের করাল থাবা  মুক্ত হোক মানুষের জীবন । যথাযোগ্য সম্মান পাক প্রতিটি মানবিক চেতনা । উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, সম্মানীয়-হীন সকলে সকলকে গ্রহণ করুক সমানভাবে , বিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে।  কিন্তু ,এ কাজে তাঁকে চরম বাধা প্রাপ্ত হতে হয়েছিল যতটা না  মুসলমানদের থেকে , তার থেকে অনেক বেশী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে । তিনি চিন্তা করে দেখলেন, সন্ন্যাসী সকলের পূজ্য হন, এখন তিনি যদি নিজে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তবে উন্নাসিক ব্রাহ্মণদের থেকে সম্মান, প্রণাম ,অধীনতা আদায়ের মাধ্যমে সমাজের অসাম্য দূর করার প্রচেষ্টায় আরো একধাপ অগ্রসর হওয়া সহজ হবে। তিনি তাই সংসারের নিরাপদ, সুখময় জীবন বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসের কঠোর জীবন সংগ্রামের পথ অবলম্বন করেছিলেন । আর , মূলতঃ নিত্যানন্দই তাঁকে সম্মতি জানিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্তে।  পরিণামে ফলও  পাওয়া গিয়েছিল হিসেবমতই। মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে জননী ও যুবাস্ত্রীকে ত্যাগ করে, নবদ্বীপের নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিতের গৌরবময় জীবনকে তুচ্ছ করে নিমাইয়ের  আকস্মিক সন্ন্যাস গ্রহণ সকলকে স্তম্ভিত করলো। অতি বড় পাষাণ হৃদয়ও গলিত হল, নরম হল।

এই মহাপ্রভুই যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর পাগলের মত বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রাঢ়দেশ দিয়ে ছুটছেন; তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কোন হুঁশ নেই তাঁর। তখন নিত্যানন্দের চতুরতাতেই তাঁকে শান্তিপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
“দেখি সব ভক্তগণ করে অনুতাপ।
গৌরাঙ্গ গোলক যায় কি হবে রে বাপ।।
তবে নিত্যানন্দ প্রভু বলে বীর দাপে।
রাখিব চৈতন্য আমি আপন প্রতাপে।।”
(লোচন দাসের চৈতন্য মঙ্গল,মধ্য, ১৪)

তাই তো সুবিখ্যাত ‘অমিয় নিমাই চরিত’গ্রন্থে শ্রীশিশির কুমার ঘোষ এপ্রসঙ্গে নিত্যানন্দের অবদান স্মরণ করে লিখেছেন ,”শ্রীনিত্যানন্দের কথা কি বলিব?  প্রভু নিতাই!  তোমাকে কি ধন্যবাদ দিব? আহা! ধন্যবাদ তো অনেককেই দিয়া  থাকি,  হৃদয়ে কি তোমার পাদপদ্মে প্রণাম করিব? তাহাও তো সকলে করিয়া থাকে। অতএব, হে নিত্যানন্দ! হে বিশ্বরূপের অভিন্ন কলেবর,হে জীবের বন্ধু! আমি তোমার ধার শুধিতে পারিলাম না, তোমার নিকট চিরঋণী রহিলাম।”

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব বুঝেছিলেন যে তেজস্বী ,আত্মবিশ্বাসী, অটুট ব্যক্তিত্বের অধিকারী উদ্যমী নিত্যানন্দই এমন একজন ব্যক্তিত্ব , যাঁকে  সেসময়ের সমাজের ভীষণ প্রয়োজন। জাত-পাত বিভেদের  বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের ক্ষুদ্র মানসিকতাকে , সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করতে চাই নিত্যানন্দের মতো বৃহদ্ মানবিকচেতনা সম্পন্ন একজন সংগঠকের। জনমানসচেতনার উদ্বোধন ঘটাতে একজন সুদক্ষ নেতার যা যা গুণ, সর্বংসহ উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তরে মানবপ্রেম থাকা প্রয়োজন — তা সব  নিত্যানন্দের মধ্যেই নিহিত আছে।  শ্রীগৌরাঙ্গ দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন যে ,নিত্যানন্দের হৃদয়ে সকল জাতের মানুষের প্রতি  যে সাম্যভাব আছে সেই ভাব, সেই নীতিকে যদি সমাজে প্রকাশিত করে দেওয়া যায় ,প্রবাহিত করে দেওয়া যায় তবে সমাজে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়ে যাবে। আর তাই তিনি যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করে পুরীতে বাস করছেন তখন এক বছর আদেশ করলেন নিত্যানন্দকে—-

“মূর্খ নীচজড়ান্ধাখ্যা যে চ পাতকিনোপরে।
তানেব সর্বথা সর্বান কুরু প্রেমাধিকারিণঃ।।”
(মুরারি গুপ্তের কড়চা-৪/২১/১০)

—-“নিত্যানন্দ তুমি এভাবে আর রথযাত্রায় প্রতিবছর এসো না। তুমিও যদি সন্ন্যাসী-মুনীদের মত করে সব ভুলে কেবল ধর্মাচরণ পালনে ব্যস্ত থাকো, তবে সমাজকে কে চালনা করবে ! সমাজের দুঃখী-দরিদ্র ,আর্ত-আতুরদের দুরাবস্থা কে ঘোচাবে!  না, না,, তোমাকে যে আরও বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে হবে ।”

নিজের গণসমেত অর্থাৎ অনুগত জনাদের নিয়ে ফিরে এসেছিলেন নিত্যানন্দ । পুরী থেকে ফেরার পথে যখন  পানিহাটিতে  শ্রীরাঘব পন্ডিতের ভবনে উঠলেন , তখন সেখানে গঙ্গাতীরে এক মহোৎসবের আয়োজন করালেন হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের জমিদার পুত্র  রঘুনাথ দাসের  ব্যয়ভারে। সেই উৎসবে একসঙ্গে  ৩৬জাতির মানুষকে  এক পংক্তিতে (লাইনে) বসিয়ে ভোজন করালেন । পানিহাটীকে কেন্দ্র করেই নিত্যানন্দ তাঁর সমাজসংস্কারক অভিযান শুরু করলেন। সেখানেই  নিত্যানন্দ তাঁর পার্ষদদের মধ্য থেকে উপযুক্ত বারোজনকে নির্ধারণ করলেন। শ্রীঅভিরাম , সুন্দরানন্দ , ধনঞ্জয়, গৌরীদাস, কমলাকর পিপ্পলাই, উদ্ধারণ দত্ত, মহেশ পণ্ডিত, পুরুষোত্তম দাস, নাগর পুরুষোত্তম, পরমেশ্বর দাস, কালা কৃষ্ণদাস ও শ্রীধর পণ্ডিত—–  এঁদেরকে গৌড়মন্ডলের এক একটি নির্দিষ্টস্থানে নামপ্রেম প্রচারের দায়িত্ব দিলেন। আদেশ দিলেন উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র কোন বাছবিচার না করে প্রত্যেককে  কাছে টেনে নিতে।  নিত্যানন্দের নির্দেশে সেই বারোজন সেনানী আজীবন সেই কর্মই করে গেছেন।  ফলে সমাজে এক মানববন্ধন তথা প্রেমমন্ডল তৈরি হয়েছিল। ধর্মবিভেদ ভুলে ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ নীতিতে মানুষ মানুষকে  তথা মানবাত্মাকে সম্মান করতে শিখেছিলো।

নিত্যানন্দ অনুভব করেছিলেন যে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের অর্থাৎ জল-অচল হিন্দু, বৌদ্ধ সহজিয়া , নেড়া-নেড়ী সম্প্রদায়ের সেই বিশাল সংখ্যক মানুষকে যদি সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায় তবে হিন্দুসমাজ বলবতী হবে।  এই ভাবনা থেকেই তিনি সস্নেহে পূর্ববঙ্গের জল-অচল মানুষদের কৃষ্ণনাম প্রদান করে মূল হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন । বহিষ্কৃত সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়কেও সেসময় হিন্দু সমাজভুক্ত করেছিলেন তিনি। তারফলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণীয়তা আরো বেড়ে গিয়েছিল।শ্রীগৌরাঙ্গের আদর্শ–“কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার”— এই পন্থাকে অবলম্বন করে নিত্যানন্দ তাঁর পতিত উদ্ধারণ লীলা অব্যাহত রাখলেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বহারাদের নেতা, বঙ্গদেশের প্রথম সাম্যবাদী নেতা। তাঁর আবেদন ছিল অত্যন্ত জোরালো ও প্রভাবময়।

নিত্যানন্দ ছিলেন চরম বাস্তববাদী নেতা।  তাইতো তিনি বলেছিলেন, “কাঠিন্য কীর্তন কলিযুগ ধর্ম নয়”( জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল–উত্তরখন্ড)। আরও বলেছিলেন, “কূলবধূ নাচাইমু কীর্তনানন্দে”(ঐ)।  পুরুষদের মত নারী জাতিরও যে অধিকার আছে কীর্তনে অংশগ্রহণ করার,সেখানে নৃত্য করার—একথা প্রথম শোনা যায় নিত্যানন্দের নির্ভয় কন্ঠেই । তখন থেকেই পর্দানশীন বঙ্গবধূর বহির্জগৎ তৈরি হতে থাকে। অন্দরমহলের অন্তরায় ভেদ করে নারীরা সর্বসমক্ষে আসতে আরম্ভ করে। আর তারই চরম দৃষ্টান্ত হল  নিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী জাহ্নবাদেবী। জাহ্নবাদেবী হয়েছিলেন সমুদয় বৈষ্ণবকুলের আচার্যানী, জননেত্রী। সমগ্র গৌরমন্ডলে পরিভ্রমণ করে, বিগ্রহ স্থাপন করে , মহোৎসব করে বৈষ্ণবদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন তিনি।

সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতিমূর্তি নিত্যানন্দে  শৈব ,শাক্ত ,বৈষ্ণব—এই ত্রিধারার মেলবন্ধন দেখতে পাই আমরা। কারণ, তাঁর মস্তকে থাকতো শাক্ত সম্প্রদায়ের ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র , সঙ্গে রাখতেন শৈব সম্প্রদায়ের নীলকন্ঠ মহাদেব ; আর ,কণ্ঠে ধারণ করতেন বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিভূ  অনন্তদেব শিলা ।  তাঁর মত হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব ছিল এমন বেপরোয়া আচরণ।  আবার , যে যুগে জাত বাঁচাতে ব্রাহ্মণরা অন্য জাতের জলটুকুও গ্রহণ করতেন না , সেযুগে  নিত্যানন্দ ছিলেন একেবারে ছুঁৎমার্গহীন।দিনের পর দিন বৈশ্য সম্প্রদায়ের উদ্ধারণ দত্তের  রন্ধন করা দ্রব্য  আহার করেছেন । প্রথম জীবনের সুদীর্ঘ কুড়িটা বছর ভারতবর্ষের নানা স্থানে পরিব্রাজক হয়ে ঘোরার ফলেই হয়তো বা ভারতমাতার উদার মানবিক ভাবটি আত্মস্থ হয়েছিল তাঁর।

নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর পরও তাঁর আদর্শ ও তিনি বড় বেশীরকম প্রাসঙ্গিক। তবে, গৌর আদর্শের সার্থক রূপকার নিত্যানন্দের সাংগঠনিকশক্তি ও উদার-ভাবনা সম্পর্কে গবেষণা সেই অর্থে হয় কী! বর্তমানের এই দাঙ্গা-হানাহানি, অভিযোগ-অশান্তির আবহে ভীষণ প্রয়োজন বৃহৎ আদর্শের , সাম্য মনোভাবের। মানবদরদী নিত্যানন্দ চরিত্রের আলোচনা, গবেষণা— তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

টুকাই : রাণু সরকার।

পতিত বস্তু পথ থেকে তুলে তুলে জড়ো করে বস্তায় নানান জায়গা থেকে, কখনো ডাস্টবিন ঘেঁটে।
ছোটবেলা থেকে বঞ্চিত মাবাবার ভালোবাসা থেকে। এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা মা বাবার সাথেই কুড়িয়ে বেরায় জঞ্জাল।
এই আবর্জনা কুড়িয়ে বিক্রি করে যা টাকা পায় কোনরকমে পেট চলে, ওদের ঘর নেই, রাস্তার ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।
মেয়েদের সমস্যা বেশিরভাগ,অন্ধকার নেমে আসলেই ভয়ে ভয়ে রাত কাটে- কখন কি অঘটন ঘটিয়ে দেয় হিংস্রের দল। একদিন এক ঝুপড়ির দুহিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র জন্তু, মনে হয় তার খাদ্যের অনটন দেখা দিয়েছিল, আসলে বিনামূল্যে গায়ের জোরে খাবার মেলে যে ঝুপড়িতে। সেই দুহিতা কিছুদিনের মধ্যেই হয় অন্তঃসত্ত্বা, আর কি করা ওদের সাথে তো কেউ নেই ঘৃণার চোখে দেখি তাই অস্বাভাবিক ভাবেই হলো গর্ভমোচন। এরাতো টুকাই- তাই না?ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো কিছুদিন লালনপালনও করলো। কি জানি কে চুরিও করে নিলো শিশুটিকে সন্তান হারা মা এখন পাগল।কে করবে ওর চিকিৎসা?

পাশের এক ঝুপড়ির টুকাই সব দেখে ভয় পেলো – ওরকম যদি ওর হয়।
এই টুকাই একটু বুদ্ধিমতী ছিলো তাই সে একদিন জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবহৃত আবরক কিনে রাখলো তার আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এক ওষুধের দোকান থেকে-দোকানী টুকাইয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে-ভাবতে থাকে যে কি করবে-হয়তো পরে ভাবনার উত্তর ঠিক খুঁজে পেয়েছে।
কোন হিংস্র আসলে অনিচ্ছাকৃত এই অস্ত্রটি হাতে তুলে দিয়ে বলবে, এই নে– আমার অস্ত্র দিয়ে আমাকে খুন কর—

ভাবা যায় না সচরাচর এইরকম ঘটেই চলছে- এই টুকাই দের কথা ভাবি না, নিজেকে নিয়েই থাকি ব্যস্ত।

Share This
Categories
গল্প

পরিবর্তন : দিলীপ রায়।

তপা পরীক্ষার মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরল । অভিভাবকের স্বাক্ষর করিয়ে পরের দিন অবশ্যই জমা দিতে হবে । পরেরদিন মার্কশীট জমা দেওয়ার শেষ দিন । তপা মায়ের কাছে গিয়ে মার্কশীট দেখিয়ে বলল, কীভাবে বাবার স্বাক্ষর নেওয়া যায় ? বাবা মার্কশীট দেখলে আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে ।
নম্বরের যা বহর, তাতে তুই কোন্‌ মুখে বাবার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর চাইবি !
তপার বাবা পশুপতি খাঁ । পূর্বস্থলি স্টেশনের কাছে সোনাঝরা গ্রামে তাঁর মুদিখানার দোকান । দোকানে অনেক ধার-বাকী । খরিদ্দারের কাছ থেকে ধারের টাকা আদায় হচ্ছে না । চাইতে গেলে সকলের মুখে এককথা, “মাঠের ধান উঠুক, ধারের সমস্ত টাকা শোধ করে দেবো ।“ পশুপতির আবার ধার দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ । অথচ ধার না দিলে খরিদ্দার ধরে রাখা কষ্ট । সদলবলে গাজি মিয়ার মুদির দোকানে হত্যে দেবে । তাতে আখেরে তাঁর লোকসান ।
তখন সন্ধ্যা আঁটটা ! খরিদ্দারের আনাগোনা নেই বললেই চলে । তাই ভাবল পশুপতি, এবার দোকান বন্ধ করা যাক । মন-মেজাজ তাঁর ভাল নেই । কিছুক্ষণ আগে খাতা খুলে পশুপতির মাথায় হাত ! প্রায় আঠারো হাজার টাকা ধার । এইটুকু দোকানে এতগুলি টাকা ধার ! লোকে ধার খেয়ে শোধ করার নাম করছে না । অথচ অনেকগুলি টাকা । সংসারে অনেক খরচ । অভাব অনটনের বহর বেড়েই চলেছে । তাঁর বৌটা তেমনি ! একটু রেখে ঢেকে খরচা বাঁচিয়ে সংসার চালাবে সেদিকে তাঁর নজর নেই । শুধু বায়নাক্কা । এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে । দেখা যাবে আজ গৃহের আসবাবপত্র কেনা, কাল দেখা যাবে ঘরের থালা বাসন কেনা ! আজকাল আবার অনলাইনে কেনাকাটা শিখেছে । কেনার শেষ নেই । তাঁর বৌয়ের খরচার হাত ষোলোআনা । এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে পৌঁছালো পশুপতি খাঁ ।
গামছা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁর বৌ বলল, “হাত মুখ ধুয়ে এসো চা বানিয়ে দিচ্ছি । ঐদিকে খাবার রেডি । যখন বলবে তখনই রাতের খাবার দিয়ে দেবো ।“
পশুপতি বৌয়ের দিকে কট্মট করে তাকিয়ে বৌকে ঝাঁঝালো সুরে বলল, “কষ্ট করে আর চা বানাতে হবে না । ক্ষিদে পেয়েছে, সুতরাং একটু পরে রাতের খাবার খেতে দিলেই চলবে । যতোসব আদিখ্যেতা !”
পশুপতি হাত মুখ ধুতে যাবে এমন সময় তপা কাচুমাচু হয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো । মেয়েকে দেখে মুখ ভেঙ্‌চি দিয়ে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “সাঝ-সন্ধ্যাবেলায় তোমার আবার কী দরকার ?”
“বাবা, আমার স্কুলের মার্কশীটে তোমার স্বাক্ষর চাই”, তপা আমতা আমতা করে বাবাকে বলল ।
মার্কশিট নিয়ে ঐরকম হতচ্ছাড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? নিশ্চয়ই পরীক্ষায় ডাহা ফেল ! দেখি তো মার্কশীট, বলেই পশুপতি মেয়ের হাত থেকে টান দিয়ে মার্কশীট নিজের হাতে নিলো ।
এক ঝলক মার্কশীটের নম্বর দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো পশুপতি । তারপর রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে কষে মেয়ের গালে এক চড় । চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে তপা ঘরের মেঝেতে সটান্‌ পড়ে গেল । যন্ত্রণায় তপা কাঁদছে । তপার মা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলতে গেলে পশুপতি এক ধ্মকে বৌকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো । আর কট্মট করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “তোমার লায় পেয়ে মেয়েটা উচ্ছন্নে গেছে” ।
তপা কাঁদছে ।
পশুপতি মার্কশীট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলো ।
“বাবা, মার্কশীট আগামীকাল স্কুলে জমা দিতে হবে”, ভীত ও ত্রস্ত অবস্থায় তপা বাবাকে বলল ।
আগে নাচ বন্ধ করো তারপর স্বাক্ষর । নাচ বন্ধ না করলে আমি আর স্বাক্ষর করবো না । ধাই ধাই করে এখানে সেখানে নেচে বেড়ানো । যার জন্য ১০০ নম্বরের মধ্যে অঙ্কে ২৫ নম্বর । ইংরেজিতে ২২ নম্বর । আহারে ! নম্বরের কী ছিরি !
তারপর আবার মেয়ের উপরে রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে নাচের সরঞ্জাম দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসে মেয়েকে ধমকিয়ে বলল, “আবার কখনও নাচে তোকে দেখেছি, তাহলে তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারবো । তোর মা এসেও বাচাঁতে পারবে না । বলেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গজরাতে গজরাতে খাওয়ার ঘরে ঢুকলো ।“
( ২ )
পরের দিন রাজ্যস্তরে নাচের প্রতিযোগিতা । কলকাতার নজরুল মঞ্চে । স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতা ছুটলো নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে । এই ঘটনা একমাত্র তপার মা জানে । কেননা একমাত্র মা তপাকে নাচে ভীষণ উৎসাহ দেয় । সত্যি কথা বলতে, তপার পড়াশুনা ভাল লাগে না । পড়তে বসলেই পড়া থেকে উঠে নাচের অনুশীলন । নাচের অনুশীলনে তার পরিশ্রম নেই, বরং ভীষণ স্বচ্ছন্দ । কিন্তু তার বাবা উল্টো, পড়াশুনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না । অথচ তপার নাচই জীবন । নাচটা তার রক্তে । মনপ্রাণ দিয়ে নাচ শেখে । লুকিয়ে লুকিয়ে নাচের ক্লাস করে । নাচে ভীষণ দক্ষ । মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলকাতার নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিলো তপা । তার সঙ্গে রয়েছে সহপাঠী অনুপম । তপাকে নাচের ব্যাপারে সবরকম সহযোগিতা করে অনুপম ।
বিশাল বড় হল । রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম । প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন অথবা দুইজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে । টান টান উত্তেজনা । বিচারকের আসনে স্বনামধন্য পাঁচজন । সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হল বেলা ১১টায় । বিচারকেরা নাচের নিয়মাবলী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । বিচারকদের নির্দেশমতো প্রতিযোগীদের একটা মাত্র নৃত্য পরিবেশন । শুরু হল নৃত্যানুষ্ঠান ।
তপার পালা ঠিক বেলা দুটোর সময় । তাকে কত্থকের উপর নৃত্য পরিবেশনের জন্য বিচারকমণ্ডলী নির্দেশ দিলেন । তপার নৃত্যের তাল,ছন্দ ও লয় অতীব সুন্দর । তালে তালে এত সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করলো তপা, যার জন্য হলের সমস্ত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূতো । প্রচণ্ড হাততালি । বিচারকগণ পুনরায় তপাকে নির্দেশ দিলেন আধুনিক লোকগীতির সঙ্গে আরও একটি নৃত্য পরিবেশন করতে । তপাও তেমনি ! নৃত্যের তাল সম্পর্কে তপার প্রচণ্ড দখল । এটা তার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা । মন খুলে মনের আনন্দে নৃত্য পরিবেশন করলো তপা । নৃত্যে তার অফুরন্ত আনন্দ । অনুপম অবাক ! অনুপম লক্ষ করল, তপার নাচের পরিবেশনের সময় তার সাথে সাথে অর্ধেকের বেশি শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলেন । অনুপম আরও লক্ষ করল, মাননীয় বিচারকেরা একে অপরের প্রতি হাসিমুখে তাকালেন ।
তারপর দুজনে ছুটলো হাওড়া স্টেশন । ট্রেন ধরতে । পূর্বস্থলি স্টেশনে যখন পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ৭টা । অনুপমের সঙ্গে তপা বাড়ি ফিরছে । তপা ভাবছে এই সময়ে বাড়িতে বাবা নেই, সুতরাং বাবার বকা বা তাঁর হাতে মার খাওয়া থেকে মুক্তি । কিন্তু গাঁয়ের ভাওয়াল মাস্টার মশাই অনুপমের সঙ্গে তপার বাড়ি ফেরা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন । সরাসরি পশুপতির দোকানে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ ! শেষে কিনা আপনার মেয়ে একটা আদিবাসী ছেলের সাথে মিশছে ? ভর সন্ধেবেলায় আপনার মেয়ে কিনা নীচু জাতের আদিবাসী ছেলেটার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ! স্কুলের ড্রেস পরা । পিঠে স্কুলের বইয়ের ব্যাগ । নির্ঘাত স্কুল থেকে আলো-আধারি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ।“ কথাগুলি বলে ভাওয়াল মাস্টার অন্যত্র ছুটলেন ।
পশুপতি রাগে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য । দোকান খোলা রেখেই ছুটলো বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছেই চিৎকার, “তপা কোথায় ?”
স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে ।
তপা বাথরুম থেকে বের হতেই হাতের বেতের লাঠি দিয়ে তপার পিঠে বেদম মার ! তপার মা থামাতে গেলে তাকেও ঐ বেতের লাঠি দিয়ে চপেটাঘাত । মেয়েকে শাসিয়ে পশুপতি বলল, “নাচ বন্ধ । এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা । এর বাইরে কোথাও দেখতে পেলে তোর ঠ্যাং খোড়া করে দেবো । স্ত্রীর দিকে ক্রূদ্ধভাবে শাসিয়ে বলল, “মেয়েকে না সামলাতে পারলে আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দেবো ।“
তারপর হন্‌হন্‌ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো পশুপতি ।
মা ও মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে তপা কেদেই যাচ্ছে । কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না ! কলকাতায় ছোটাছুটিতে সারাদিনের ধকলের পর বাবার হাতের বেদম প্রহারে তপা যতো না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে বাবার হাতে মা নিগৃহীত হওয়ার জন্য !
( ৩ )
তারপর, নাচের প্রতিযোগিতার ফলাফল । সেটা ঘোষণা হবে কলকাতায় শনিবারদিন । বাড়ি থেকে কীভাবে বের হবে সেই চিন্তায় তপা অস্থির ।
মা মেয়েকে বলল, কাল অর্থাৎ শনিবার তুই ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবি । সঙ্গে অনুপম যাবে ।
“তুমি যাবে না মা ? তুমি আমার সঙ্গে চলো মা”, বায়না ধরলো তপা ।
যাওয়ার ইচ্ছা আমার ষোলোআনা, কিন্তু তোর বদরাগী বাবাকে নিয়ে ভয় ?
তপা মনকে শক্ত করে মাকে বলল, “আমার নাচে কোনো পুরস্কার পেলে আমি বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবো না । বাবার জন্য তোমার যেমনি অশান্তি তেমনি আমার ভীতি । দরকার হলে থানায় নালিশ জানাবো । বাবার অভব্যতার একটা বিহীত হওয়া দরকার, নতুবা বাবা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে” ।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা শান্তভাবে তপাকে বলল, “বাবাকে নিয়ে ওসব আজেবাজে কথা বলতে নেই মা । তোর নাচের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো পুরস্কার পেলে তোর বাবার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর মনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য । আমার কথাটা মিলিয়ে নিস ।“
পরের দিন মা ও মেয়ে দুইজনেই পশুপতি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরলো । কলকাতায় রাজ ভবনের প্রেস কর্ণার হলে ফলাফল ঘোষণা । মাননীয় রাজ্যপাল বিজেতাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন । পুরো অনুষ্ঠান টিভিতে লাইফ দেখানো হবে । তপা ও মা এবং অনুপম রাজভবনে গিয়ে আসন নিয়ে বসে পড়লো । অনুপমকে রাজভবনে ঢোকার গেটে সিকিউরিটি ধরেছিল । কিন্তু তপা অনুপমকে তার জেঠতুতো দাদা বানিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করল । যার ফলে অনুপম ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলো ।
এবার নাম ঘোষণার পালা ।
তপা ভীষণ টেনশনে আনচান । কোনো পুরস্কার না পেলে আজ তার বাবার কাছে রক্ষে নেই । বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে তাড়িয়ে দেবে । পুরস্কারের ব্যাপারে তপা যেটা বুঝেছে সেটা হচ্ছে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছাড়া আরও জেলা ভিত্তিক একটি করে পুরস্কার । জেলা ভিত্তিক দশ জনের পুরস্কার । পুরস্কারে নগদ ৫০,০০০/- টাকা এবং মানপত্র । প্রথম পুরস্কার ৫ লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৩ লাখ এবং তৃতীয় পুরস্কার ২ লাখ টাকা এবং সঙ্গে মানপত্র ।
নাম ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠে এলেন মাননীয় ঘোষকঃ-
হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ । রাজ্যের মন্ত্রী ও উচ্চ পদাধীকারি আধিকারিকগণ । নাম ঘোষণা করলেন —- প্রথম, পূর্বস্থলির তপতি বেরা ।
তারপর হাততালি । প্রচুর হাততালি । ঘোষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “তপতিকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি ।“
মঞ্চে তপতির ওঠবার পর ঘোষক তাঁর হাতের মাইকটি তপতির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলো ।“
এদিকে ভাওয়াল মাস্টার পশুপতিকে আবার খবর দিয়ে বলল, “টিভিতে তোমার মেয়েকে দেখাচ্ছে । এখন টিভি খুললেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে ।“
সঙ্গে সঙ্গে পাশের দোকানে টিভির সম্মুখে এসে পশুপতি অবাক ! তাঁর মেয়ে প্রেস, মিডিয়া্‌ ও অনেক শ্রোতামণ্ডলির সামনে নির্দ্বিধায় বলছে, “নৃত্য শিক্ষায় আমার অনুপ্রেরণা আমার মা । মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতে আমার নৃত্য শিক্ষার বাস্তবায়ন ।“
পশুপতির চোখ ছলছল । সে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলো, ফিরে এলে মেয়েকে আর বকবে না । মেয়ে যেটা চায় সেটাই করবে । মেয়ের ক্যারিয়ারে কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । সে এখন পরিষ্কার বুঝেছে, “যার যেদিকে ঝোঁক তাকে সেদিকেই এগিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় ।“ রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো পশুপতি ।
( ৪ )
তারপর স্কুল, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সকলে তপার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । নাচের প্রতিযোগিতায় তপা রাজ্যে প্রথম হওয়ায় সকলেই গর্বিত ।
পশুপতি কাচুমাচু হয়ে মেয়ের কাছে নত হয়ে ছলছল চোখে বলল, “মা আমাকে ক্ষমা করিস্‌ ।“
তপা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ।
———০———

Share This
Categories
গল্প নারী কথা

অন্য দুর্গা : ডঃ অশোকা রায়।

হালকা চপল ছন্দে শরত এসেছে গ্রীষ্মের প্রখরতার আতংক আর বর্ষার বিষণ্ন বিধুরতা মুছে দিয়ে. প্রসন্ন হাসি গাছের পাতার সবুজ রিবনে, মেঘ- রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলায়, কাশবনের হিন্দোলে. প্রকৃতি জুড়ে মা দুর্গার আগমনী গান… “য়া চন্ডী মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী… ” শরতের পূর্নতায় আপামর মানুষ মেতে ওঠে ঢাকের তালে উৎসবের বন্যায়. কিন্তু পুজোর আনন্দ – আয়োজন কি সবার জন্য? না, ব্যতিক্রম আছে বই কি. নানা রকম কারণে সেই ব্যতিক্রম. আমার আজকের লেখা সেই রকম একটা ব্যতিক্রম নিয়ে.
এ এক অন্য দুর্গার কথা।
কলকাতার খুব কাছেই উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজেন্দ্রপুর. এই রাজেন্দ্রপুরেরই একটা গ্রামের নাম সুন্দর গ্রাম. বিদ্যেধরী নদীর তীরে অবস্থিত এই সবুজ ঘেরা গ্রাম সার্থক নামা. এই গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার বলতে দাসপরিবার. অর্থের প্রতুলতা তো রয়েছেই, বংশ লতিকার গরিমাও কম নয়. স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে দাসপরিবারের প্রতিপত্তি বেশি. অবশ্য আজকের সুন্দর গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন নির্বাহের মান মোটামুটি ভালো. কলকাতা বা অন্যত্র কর্মের সুবাদে শুধু মাত্র ক্ষেত- খামার আর হাল-বলদের ওপর তাদের ভরণপোষণ নির্ভর করে না. শিক্ষার ছোঁয়ায় তাদের জীবনের মানে বদলে গেছে. তারা শিখেছে স্বচ্ছলভাবে স্বচ্ছন্দে বাঁচার উপায়. তাই আজ সুন্দর গ্রামের প্রকৃতি না পাল্টালেও, মানুষজনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে. বিদ্যেধরীর জলে ভেসে এসেছে শহরের ছোঁয়াচ. তাই সুন্দর গ্রামে আজকাল দু-চারটে বারোয়ারি পুজো হয়, আলোর কম্পিটিশনও চলে,.. তবুও দাসবাড়ির পুজোর আকর্ষণ অম্লান. স্হানীয় লোকজনের ধারণা, ষষ্ঠীর বোধনের সাথে সাথে মা দুর্গার জীবন্ত অধিষ্টান হয় দাসবাড়ির পুজোর দালানে. সামনের মাঠে সামিয়ানার তলায় তাই নানা বয়েসের পুরুষ – নারীর ভিড়. সারাদিন ধরে চলে পুজোর কাজকর্ম, আড্ডা গুলতানি আর রান্নার তদারকি. সারা গ্রামের মানুষের পাত পড়ে চারদিন এই দাসবাড়ির অন্দরের গোলঘরে.
আজ অষ্টমী. পুষ্পান্জলি শুরু হয় নি এখনো. যে যার নিজের রুচিতে সাজগোজ করে পুজোমন্ডপে জমিয়ে বসেছে. মেয়ে- বৌরা পুরোহিত কে পুজোর কাজে হাত লাগিয়েছে. বয়স্ক মহিলারা উপদেশ – নির্দেশ দিতে ব্যস্ত. বয়স্ক পুরুষদের ব্যস্ততা একাল- সেকাল নিয়ে আলাপ আলোচনায়. আর কম বয়সী পুরুষরা কেউ বাইরের কাজে, কেউ ভেতরের কাজের হিসাবে দৌড়াদৌড়ি করছে.
দাসবাড়ির দেউড়ির নহবতে বাজছে সানাই…. রাত পুইয়েছে এক শারদ প্রাতে. মন্ডপ আলো করে মা হাসছেন. মায়ের অঙ্গাভরণে আলোর রোশনাই. রোশনাই অল্পবয়সী মেয়েদের চোখে- মুখে. আজ বিকেলে কে কি পরবে…. তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা. কেউ বালুচরী, কেউ সিল্ক কেউ আবার চান্দেরী. সব কটা কলকাতার বিখ্যাত দোকানের. একজন বলে, “তোরা বাবা পোশাকের প্ল্যান কর, আমি বাবার সাথে যাব সন্ধ্যা- রাতে কলকাতা. মেট্রো চেপে ঠাকুর দেখব সারা রাত.
বাবা বলছে আমিনিয়ায় বিরিয়ানি খাওয়াবে.” অন্য একটি মেয়ে বলে, “কলকাতায় তো বেজায় ভিড় হবে, সামাল দিতে পারবি তো নিজেকে? ” গরবিনী বলে ঔদ্ধত্য নিয়ে , ” কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে?”
অন্যরা উত্তপ্ত আবহাওয়ায় জল ঢালে…..” কাল সকালে প্যান্ডেলে আসবি তো? ” এই একটা আন্তরিক প্রশ্নে ওঁ শান্তি. কে আর অপ্রীতিকর পরিবেশ চায় পুজোর দিনে?কিন্তু অশান্তি তো একটা ঘটলই পুজোর দিনে, তাও আবার পুজোর অষ্টমীর সকালে. আচ্ছা বয়েস, অর্থ আর পারিবারিক দম্ভ মানুষ কে কতটা নিষ্ঠুর করতে পারে?
দাসবাড়ির সামিয়ানার তলায় এককোণে এক মেয়ে, পরণে আধো ময়লা শাড়ি,হাতার কাছে বেশ খানিকটা ছেঁড়া ব্লাউজ, উস্কোখুস্কো চুলে একমনে কোঁচড়ে রাখা শিউলি ফুল তুলে মালা গেঁথে চলেছে. বয়েস? আন্দাজ ষোল – সতেরো তো হবেই. কালই তো ওর মা সদু ওর বাবা বাদল কে বলছিল রাতে, ” মেয়েডারে এট্টা শাড়ি কিনে দ্যাও না. সনাতন ব্যাপারী কাল আসবে মঞ্জু মার শাড়ি খান দিতে. দুগ্গার একখানও আস্ত শাড়ি নেই.” বাদল বলে, সাধ কি হয় না দুগ্গোর মা? কিন্তু শোলার কাজ করে মাকে ডাকের সাজ পরানো যায়, মেয়েডারে সাজানো যায় না. ” কিন্তু অতবড়ো মেয়ে, ওরকম ভাবে ঘুরে ফিরে. শেয়াল – কুকুরের তো অভাব নাই কুনখানে”
বাদল কোন জবাব দেয় না. অক্ষম বাপের জবাব দেবার কি আর থাকতে পারে? দুর্গা ঘুমোয় নি. বাপের কথা শুনে কষ্ট পায় না. মা দুর্গার ওপর তার দারুণ ভরসা. সে বিশ্বাস করে মা দুর্গার কৃপায় একদিন তাদের অবস্থা সে ফেরাবে. বাবা – মা কে সুখে রাখবে. কিন্তু কি ভাবে? তার হদিস মা দুর্গা এখনও দেয় নি. দুগ্গা গ্রামের অবৈতনিক বিদ্যালয় যায় আসে. আর স্বপ্ন দেখে মা দুর্গা তাকে অনেক লেখা পড়া শিখিয়ে বড়ো চাকরি পাইয়ে দেবে. তাদের সুদিন আসবে.
দুগ্গার মালা গাঁথা শেষ. পুরুতমশাইরে ডাক দেয়, “ও দাদু শিউলির মালাটারে মা দুগ্গার গলায় দ্যাও না দুলিয়ে গো. বড়ো যতনে গেঁথেছি. পুরুত কিছু বলার আগেই দাসগিন্নি নথ নাড়িয়ে বলে,” কি আপদ! দূর হ এখান থেকে. নোংরা বাসী কাপড়. এখনি ছোঁয়া – নেপা হয়ে যাবে. ঐ মালাটাকে দোলাব মায়ের গলায়. মা অপবিত্র হয়ে যাবে না? ” ” না গো ঠাকুমা নেয়ে- ধুয়ে ফুল কুড়িয়েছি. আমাদের উঠোনে শিউলি গাছ ভরে ফুল ফুটেছে. অনেক ফুল পড়েছিল গাছের তলায়. পরিষ্কার করে নিকোয় মা রোজ. “” তুই মিথ্যে কথা বলছিস. নেয়েছিস তো তোর চুল উস্কোখুস্কো কেন? ” দুগ্গা নীচু স্বরে বলে,” ঘরে নারকেল তেল বাড়ন্ত. চিরুনী গেছে ভেঙে. বাবা আনলি তবে চুল আঁচড়াবো মা- বেটি মিলে. ” পুরুত দাসগিন্নির দিকে তাকায় সন্মতির আশায় , ” মা দেব পরিয়ে মালাটা? ” দাসগিন্নির গম্ভীর নির্দেশ আসে,” পুরুত মশাই আপনি নিজের কাজ করুন.” তারপর হাঁক দেন, ” এই কে আছিস কাছে – পিঠে….. দুগ্গারে বার করে দে. ” দুগ্গা বলে,” আমারে কারোরি বার করতি হবে না গো ঠাকুমা. দুগ্গা এমনি চলে যাচ্ছে. তবে মা দুগ্গারে বলি যাচ্ছে সে, আমার হাত থিকি মালা তোমারে একদিন নিতি হবে, যদি তুমি হও আমারো মা. “
দুগ্গা ছুটে দাসবাড়ির চৌহদ্দি পার হয়েছে. পুজোর দালানের বাইরের চত্বরের এককোণে পড়ে আছে ওর গাঁথা শিউলির মালা. শরতের আকাশের হালকা ভাঙা মেঘ জমাট বাঁধে.অসময়ের বৃষ্টির ঝরঝর শব্দে দুগ্গার গাঁথা শিউলির মালার কান্না মিশে যায়. শরতের শুভ্রতা ম্লান হয় মানুষের মনের কালিমায়.
এ গল্পটা এখানেই শেষ হলে হতে পারতো, কিন্তু তা তো হলো না. কারণ জীবন প্রবাহ সব সময় নিয়ম মেনে চলে না. আর মা দুর্গার ইচ্ছেও নয় সেটা. মা দুর্গা চাননি সবকিছু নিয়ম মেনে স্বাভাবিক ভাবে হোক. পাঁচ বছর আগে দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন দাসবাড়িতে অপমানিত হওয়ার পর আর দুগ্গাকে দেখা যায় নি, তার মা- বাবা কেও নয়. গরীবের থাকা না থাকাতে গ্রামের বাসিন্দাদের সে ভাবে মাথা ব্যাথা হয় নি. তবুও সন্দেহ আর জল্পনা- কল্পনা শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু দানা বাঁধার আগেই থেমে গেছে. এই গতির যুগে মানুষ ছুটছে নিজের ধান্দায়. গ্রামের মানুষজনও এর বাইরে নয়. অতশত দুগ্গার ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়, যাদের দুগ্রাস ভাতের সংস্হান নেই ? প্রায়ই তো ওদের তেল নুন চাল ধার দিতে হত ফেরত পাওয়ার আশা না করে. দাসগিন্নীর ভাষায় ‘আপদ বালাই গেছে, ভালো হয়েছে.’
বছর পাঁচ বাদে আজ আবার হিমের পরশ বুলিয়ে শরত এসেছে. নিয়ম মতো মা দুর্গাও এসেছেন. দাসবাড়িতে ঢাকের কাঠি পড়েছে. শুরু হয়েছে প্রতি বছরের মতো দুর্গা পুজোর আয়োজন. সেদিনের মতো আজো অষ্টমী. সমস্ত পরিবেশ এক. কিছু লোকজনের মুখের পরিবর্তন হয়েছে. গ্রামের কোন কোন মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে, অন্য কোন মেয়ে বিয়ে হয়ে ঘর- বসত করতে এসেছে এই গ্রামে. অবশ্য পুরুত একই রয়েছে, একই রয়েছে দাসগিন্নী. তবে বয়েসের ভার কিছু ছাপ ফেলেছে তাদের চেহারায়, তাদের চলন- বলনে. নয়তো এই সব ছোটো খাটো পরিবর্তন ছাড়া দাসবাড়িতে পুজোর চিত্রপট একই. মা দুর্গাও একই ভাবে বিরাজমানা. পুরোহিত পুষ্পান্জলির মন্ত্র পড়ছেন নিষ্টাভরে..
“আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে.ধনং দেহি পুত্রান দেহি, সর্ব্ব কামাংশ্চ দেহি মে” জমায়েতের মধ্যে শুদ্ধভাবে পুনরুচ্চারণের প্রচেষ্টা. ভক্তির নেই খামতি.
পুষ্পান্জলির পর্ব শেষ. সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এক সালংকারা নারী
অলক্তরঞ্জিত খালি চরণে সে এগিয়ে আসছে গজেন্দ্রগামিনী ছন্দে. পিছনে চারদাসীর হাতে পুজোর সম্ভার. দাসবাড়ির দুর্গা প্রতিমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেই সুন্দর রমনী. সমবেত সকলের চোখে সমীহের সাথে কৌতূহল… কে এই নারী? নিশ্চয়ই কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ… নারী মহলে ফিসফিস. একবার ফিরে তাকায় সালংকারা সুন্দরী. চিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে. মুহূর্তে মেলায়. দাসীর হাত থেকে লাল ভেলভেটের বাক্স নেয় একটা. ক্লিপ খোলে . সোনার শিউলির লম্বা মালা. এগিয়ে দেয়, পুরুতের দিকে ” দাদু পরিয়ে দাও এ মালা মা দুর্গার গলায়.” পুরুত শিউরেছে, এ যে বেশ কয়েক বছর আগে এক মেয়ের আকুতি! তবে কি… মুখটা তো চেনা – চেনা, তবে অনেক পরিবর্তন. পুরুত আজও চেয়েছে, দাসগিন্নীর পানে.. ” পরাবো মা?” দাসগিন্নী বিগলিত, ” নিশ্চয়ই পরাবেন ঠাকুর মশাই. মায়ের জন্য আনা জিনিস ফেরাই কি করে? ” নারী তখন করজোড়ে চোখ বন্ধ করে মা দুর্গাকে মনে মনে বলে, ” পাঁচ বছর আগে তুমি আমার গাঁথা শিউলির মালা পরো নি, যে মালায় যৌবন ছুঁই ছুঁই এক পবিত্র মেয়ের অকৃত্রিম ভক্তি ছিল. আর আজ এই দুর্গা বারবধু. তার দেয়া সোনার শিউলির মালা তুমি কি মনে কর অপবিত্র, অশুচি? তাহলে আজো এ মালা পরো না তুমি. চোখ খুলে নারী দেখে পুরুতদাদুর পরানো মালা গলায় মা যেন হাসছেন আর বলছেন,” দুগ্গা আজ তোর দিন. তুই এদের জানিয়ে দে, আমার পুজোয় পবিত্র – অপবিত্র বলে কিছু হয় না. আমার পুজোয় সকলের সাদর অংশ গ্রহণ আমার কামনা. এই দিনের অপেক্ষায় আমি ছিলাম.
দাসগিন্নী জিজ্ঞেস করেছেন, ” তুমি কে মা?” সেদিনের দুগ্গা সদম্ভে জানিয়েছে, ” আমি বাদল শোলাকারের মেয়ে দুগ্গা.” তবে সে আমার পূর্বাশ্রমের পরিচয়. আজ আমি বিজুরী- বাঈ. বনেদী বাঈজী. মুজরো করি নিজের বাড়িতে. ডাক পেলে লক্ষ্নৌ পাটনাও যাই. ঠিকানা কলকাতার বৌ বাজারের সোনা পট্টি . এই জিনিস গুলো দিয়ে গেলাম. পুজোর কাজে লাগিও. বেশ্যা বাড়ির মাটি তো মায়ের কাঠামো তৈরির কাজে লাগে.
আর জেনো মানুষ মানুষই হয়. পবিত্রতা – অপবিত্রতা দেহে নয়, মনে জন্মায়. দৃপ্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে যায় দুগ্গা সকলের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে. এ এক অন্য দূর্গা.

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

দুর্গার দুর্গতি : ডঃ অশোকা রায়।

করোনার ক্যারিশমা সত্যি সত্যি দেখার মতো। দেবী দুর্গারও বুক বাপের বাড়িতে এসে দুরুদুরু।অথচ বাপের বাড়ির লোভ জয় করা দুরুহ। মা দুর্গা ও বোধহয় অতটা জিতেন্দ্রিয় নন। বছরান্তে একবারো বাপের বাড়ি পা দেবেন না,তা কি করে হয়? কথায় বলে মেয়েদের কাছে বাপের বাড়ির মাটিটুকু বড়ো মিষ্টি। স্বামী বুঝিয়েছেন,’ এই আশ্বিনে যেওনা বাপের বাড়ি। গতবার গিয়ে তো দেখেছ, খাতির যত্ন পাওনি। আর পাবে কোথা থেকে বলো তো দুর্গা রানী? করোনা নামে
অতি মহামারী পৃথিবী কে ছারখার করে দিয়েছে। তারপর তোমার বাপের বাড়ি,তা সে পূব বা পশ্চিম বাংলা- যাইহোক না কেনো,কেউ তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদের মতো ধনী নয়।ফলে করোনার করুণায় তোমার বাপের বাড়ির বাসিন্দাদের হাঁড়ির হাল। নন্দী তো সেদিন ঘুরে এসে বললো, তাবড় তাবড় ভালো চাকরি করা লোকেরা বাড়িতে বসে মাছি তাড়াচ্ছে আর টিপে টিপে সামান্য সঞ্চয় থেকে খরচা করছে,প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া টিউব থেকে পেস্ট বার করার মতো।না শেভ করা দাড়ি নিয়ে অনেক পুরুষ এখন ঘরের মধ্যে বিষাদের ঘরে নিজেদের বন্দী করেছে। বেল্ড বা ক্ষুর- শেভিং ক্রিমের পয়সা যতটা বাঁচে। যাদের অফিস বা রোজগার নামক বস্তু টি কোনক্রমে টিঁকে আছে, তাদেরও সদাই ভয়, এই বুঝি রিটেনশনের নোটিশ দ্বিধা থরো থরো হাতে কেউ গুঁজে দিল। মালিক পক্ষের মানবিকতা আছে, কিন্তু কি করবে তারা? করোনার কাছে নতজানু হয়েও বিশেষ সুরাহা হয়নি।নিজেদেরই পেট ভরে না, শংকরকে ডাকবে কি করে? সুতরাং অন্ততঃ ফিফটি পারসেন্ট ছাঁটাই তো বটে, ইফ নট মোর,নয়তো পুরোপুরি তালা বন্ধ। বাড়ির গিন্নীদের কাছে বিউটি পার্লার যাওয়া পূর্ব জন্মের স্মৃতির মতো। বরং দু ফোঁটা তেলে জলের ছিটে দিয়ে রাঁধতে নাজেহাল। লোকাল ট্রেন তো বিধিবদ্ধ ভাবে চলল না। স্টাফ স্পেশ্যাল নাম কা ওয়াস্তে। আপামর পাবলিকের ভিড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা ব্যবস্থা। মুখে মাস্ক কি এহেন ব্যবস্হার মুশকিল আসান হতে পারে? তার ওপর উপনির্বাচনে প্রচারের ঠ্যালা।যেও না গিন্নী, অসুবিধায় পড়বে। গিন্নী নাছোড়, ” বছরে তো একবার বাপের বাড়ি যেতে দাও। বাদবাকি সময় তো তুমি,তোমার ছেলেমেয়ে আর তোমার হাঁড়িহেঁশেল নিয়ে পড়ে থাকি। আমার কি আমোদের সুযোগ টুকুও থাকবে না? এক নম্বর মেল-শভিনিস্ট কোথাকার।”কি যে হবে মা দুর্গার কে জানে! আর জানার ইচ্ছে আছে নাকি ভদ্র মহিলার? সেই আসতেই হবে ঝড়- জল উপেক্ষা করে কোভিড এর যুগে। এতোটাই অবুঝ যে বুঝতে পারে না, দুর্গা এসেছে বলে হাজার হাজার না হোক, অন্ততঃ শখানেক লোক ছুটে আসবে আদিখ্যেতা করতে। কোভিডের সংক্রমণ হার বাড়বে। সামাল দিতে সরকারের প্রাণান্তকর অবস্হা। পুলিশ ব্যতিব্যস্ত। আর কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এলে আবার প্রাণ নিয়ে টানাটানি।ডাক্তার দের নাওয়া- খাওয়া মাথায়। কোভিডের গুঁতো তো মা দুর্গা কে সইতে হয় না। তাঁর মাথাব্যথা হবে কেন? চীন যতদূর মনে হয় তাঁর এক্তিয়ারভুক্ত নয়। শুনেছি তো চীনে ওয়াংশাং বলে এক দেবতা আছে, সে না কি সাহিত্যের দেবতা; আর ফুসি স্বর্গলোকের দেবতা, নুইও মর্ত্য লোকের দেবতা।
আর ওয়েল বিয়িং এর দেবী সকলের মঙ্গলের দিকটা দেখে। আর ইয়াং লং ড্রাগন বৃষ্টির দেবতা। তবে সব সেরা দেবতা হচ্ছে Tian. তা দুর্গার সাথে এদের কোন প্যাক্ট হয়েছে কি না জানা নেই।তবে দুর্গা আসছে কোন সাহসে? বলি মরণের ভয় ডর কি নেই?তার ওপর বায়না, দুর্গা আর তার পরিবার মাস্ক পড়ে কিছুতেই আসবেন না।সৌন্দর্য নষ্ট হবে যে! কোভিড বিধিতে পড়ে গেলে ফাইন হবে , সে চিন্তাও নেই! মর্ত্যে আসবে, অথচ মর্ত্যের আইন মানব না… এ তো বেশ গা জোয়ারী ব্যবস্থা। অথচ দুর্গার মুখে যত বোলচালই হোক না কেনো, করোনার ভয়ে তিনিও কিন্তু কাঁটা।পুজো উদ্যোক্তারা কেউ কেউ দুর্গা আর তার পরিবারের মুখে মাস্ক পরিয়ে দিলে,
” মা দুর্গা রাতের স্বপ্নে উদ্যোক্তাদের ওপরে প্রথম হম্বিতম্বি করেন,” এক্ষুনি হাটা তোদের এই মুখোশ, আমার আর ছেলেমেয়েদের প্রাণ যায় যায়। অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছে। এখানকার ডাক্তার গুলো ভীতুর ডিম এক একটা। পিপিই কিট পড়ে জবরজং সাজা ডাক্তার সব। নিজের সেফটি দেখতে ব্যস্ত। অথচ পকেটে টাকা বোঝাই করা চাই। তাই কত বুদ্ধি। হাসপাতালের ডিউটি শেষ হলো তো, শুরু হলো প্রাইভেট কনসালটেন্সি।ভিডিও কলিং এ দেদার রোজগার।বুদ্ধুরাম ডাক্তার দের পড়াশোনার বহর তো জানা আছে! আর অভিজ্ঞতা? না বলতেই হবে এবার, ধনবান হলে একরকম কসরত। আর ধনবান না হলে ভিডিও কলে বা ফোনে যা হোক নিদান দিয়ে ছেড়ে দাও।অন লাইনে পেমেন্ট এলেই হলো। টিকি পাকড়াও করে কোন পাকড়াশী? তার তো এখনও জন্মই হয়নি। চীনের উহান দোষী নিশ্চয়ই। এর একটা বিহিত করতে হবে বলে তোদের বাবা ঐ কল্কে সেবী শিব সকল দেবতা দের নিয়ে মিটিং ডাকছে। শুধু ডেট ফিক্সিং বাকি। আমি এখান থেকে ডেটা নিয়ে যাই… তখনই ডেটটা জানিয়ে দেব তোদের। কত রূপে কত অসুর আর দৈত্যদের বধ করলাম! আর তোদের বিরক্ত করে মারছে যে করোনাসুর, তাকে মারা তো আমার বাঁ হাতের খেলা রে। তবে একটা ভ্যাকসিন আর সিরিঞ্জ আমার চাই। খোঁজে আছি। পেলেই করোনাসুর কে এমন ফুটিয়ে দেব বুকে সিরিঞ্জ, জিভ বার করে অক্কা পাবে। বিভিন্ন দেশের সাথেও যোগাযোগ রাখছি, যদি কেউ মোটা সিরিঞ্জ আর ওষুধ দেয়। তাহলে মর্ত্যের খেলা মর্ত্যেই মিটিয়ে যাব। আমি এর মধ্যে না পারলে লক্ষী আর সরস্বতী তো পরপর আসবে। ওদের হাতেই না হয় করোনাসুর বধ হবে। মায়ের কাজ মেয়ে করবে, তাতে লজ্জা কি? শুধু ভয় পাচ্ছি এখন এখানে লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকের যদি কিছু হয়, কি হবে? একটা ডাক্তারও ফিজিক্যালি
চেক- আপ করবে না।ভিডিও কলিং এ কি রোগী দেখা যায় রে? নাড়ি টিপব না, জিভ দেখব না নিজের চোখে? সব কি ক্যামেরার এক্সপোজার দিলেই হয়ে যায়?ওদের বাপ আমায় মোবাইলেই তুলোধুনো করবে, ফেরারও তর সইবে না। বলবে, “পরপর দুই বছর শূন্য মন্ডপে বসে ধান ভানার কি দরকার? সরাসরি শিবের গাজন তো কৈলাশে বসেই গাওয়া যায়। আমি নিজের গাজন ভালো করে শুনতে পাই, তা’ও আবার তোমার মুখে। মনে পুলক হয়। মর্ত্যে তুমি যা কর, তা ঠিক মতো দেখতে পাই না, শুনতেও পাই না। একেবারে বেপরোয়া হয়ে বাপের বাড়ির আদর খাও। চোখ আর কান দুটো অর্গানই আজকাল বড়ো জ্বালাচ্ছে।” দুর্গা বলেন, এবার থেকে তোরা আমাকে আনার সময় ঘোড়া- মুখো অশ্বিনী কুমার দুজনকে আনার ব্যবস্থা করবি। অশ্বিনীকুমাররা যমজ দুই ভাই। কপালদোষে ঘোড়া মুখো। সূর্য আর তার বৌ সংজ্ঞার কি যে শখ জাগল, ঘোড়া রূপে মিলিত হল। জন্ম হলো ঘোড়া মুখো অশ্বিনীকুমার দের।মা হয়ে তোদের সাথে এসব আলোচনা করা উচিত নয়,বুঝি। তবুও দুশ্চিন্তায় কি মাথার ঠিক থাকে?ওদের কথা তোদের জেনে রাখা ভালো। পরের বার এ্যাপ্রোচ করতে সুবিধা হবে। তোরা তো দেখছি সকলেই ষোল ঊর্ধ্বে।সুতরাং আমার পাপ হবে না অশ্বিনী কুমার দের জন্ম রহস্য খোলসা করে তোদের বলার জন্য । ষোলো পেরোলেই ছেলে -মেয়ে মায়ের বন্ধু।জানিস,অশ্বিনীরা তো আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস। সরোর শরীরটা চিরকাল তেমন শক্তপোক্ত নয়। লক্ষীর ইদানীং দেখছি এনার্জি লেভেল কম। এনসিওর খাওয়াচ্ছি দুবেলা, কিছুতেই কিছু হবার নয়। কেমন করে কেৎরে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ না। কেতোর আবার সামনের মাসে আর্চারি কম্পিটিশন আছে। এখানে আবার আসবে তো সেই কার্তিক মাসেই, তাই ডেট এ্যাডজাস্ট করার জন্য আমাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছে। এ্যাপ্রুড হয়ে যাবে মনে হয়। কর্তৃপক্ষ তো জানে পঞ্জিকার ডেটের নট নড়ন- চড়ন।গনশার দেহটাই ওমনি ঢ্যাপসা। বলতে গেলে ও বিকলাঙ্গ মানুষ। মানুষের দেহে হাতির মাথা। তার ওপর পেটটাও অস্বাভাবিক বড়ো ।হাঁসফাঁস করছে।এখানে এতো বৃষ্টি হচ্ছে,অথচ গুমশুনি ভাব গেল না।দু- দুটো মাস্ক স্পেশাল অর্ডার দিয়ে করিয়েছিস , গনশার তো সর্দি হয়ে গেছে। বারবার ন্যাপকিন চাইছে।করোনা হলে সামলাবে কি করে?আসার জন্য এখন আমার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সোয়ামীর কথা না শুনলে এমনই হয়। তা যাক গে এসব কথা। করোনা হলে দেখা যাবে। তোরা মানুষরা কত কষ্ট পাচ্ছিস, আমার তো এখানে থাকার মেয়াদ কুল্লে পাঁচদিন। তোদের ভোলে বাবা ঠিক পার করিয়ে দেবে। জয় ভোলানাথ।

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

সিঙ্গল মাদার : ডঃ অশোকা রায়।

বহুদিন বাদে তোমাকে দেখলাম. ট্যাংগুলার পার্কের মোড়ে আদি ঢাকেশ্বরীতে. মায়ের জন্যে একটা কালো পাড় গরদের শাড়ি কিনতে এসেছিলাম একবারে শেষ মুহূর্তে. আজ দুর্গা পুজোর ষষ্ঠী.
মায়ের শাড়িটা শেষ মুহূর্তে কেনার কারণ মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবহেলা নয়. মা ছিল বেলভিউতে. বেলুন সার্জারি হয়েছে হার্টের. ভালো আছে এখন. কিন্তু নিজের মা হাসপাতালে, তাই পুজোশপিং অন্যান্য দের জন্য করলেও আমার মা নার্সিংহোম থেকে ছাড়া না পাওয়া অবধি মা আর নিজের জন্যে কোন কিছু কিনবো না বলে রেজ‌োলিউশন নিয়েছিলাম. মা কে কাল বাড়ি নিয়ে এসেছি. মায়ের একমাত্র সন্তান ‌আমি. সুতরাং এসব ঝামেলা আমাকেই পোয়াতে হয়. বাবা আর শ্বশুর মারা গেছেন আমার বিয়ের আগে. ‌আর আমার স্বামী তার উজ্জ্বল
কেরিয়ার গড়তে পাড়ি দিয়েছে সাগর পাড়ে. শ্বাশুড়ির দায়িত্ব আমার ঘাড়ে নিয়েছি স্বেচ্ছায় সানন্দে. অবশ্য মায়ের মতো আমার শ্বাশুড়িকে নিয়ে ছুটতে হয় না যখন তখন ডাক্তারের চেম্বারে.তবে সপ্তাহে একদিন যেতে হয় শ্বাশুড়ির সংগে সিনেমা হলে. স্মার্ট শ্বাশুড়ি আমার. কি হিন্দি, কি বাংলা কি ইংরেজী সব সিনেমা কোথায় চলছে, টাইম কি, সব মুখস্থ. আমার দায়িত্ব অন লাইনে টিকিট বুকিং আর ওঁনাকে সংগ দেয়া, সে আমার ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক. হাজার অন্য কাজ থাকুক. ‌অদ্রিজাকে বলিনি, আমার শ্বাশুড়ির মেজাজের সংগে আমার অল্পবিস্তর পরিচয় আছে. অদ্রিজা আমার শ্বাশুড়ির ছাত্রী. আমার সংগে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে. ‌আমার শ্বাশুড়ি অমনোমত হলে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন না আমাকে. অথচ আমি যে তাঁর মেয়ে হয়ে এসেছি এই বাড়িতে.. এই প্রতিশ্রুতির খেলাপ তাঁর কোনও দিন হয়নি. আমি তাঁর মেয়ের মতো নই.. সত্যিই মেয়ে. মা- মেয়ের মধ্যে রাগারাগি তো স্বাভাবিক জিনিস সম্পর্কের সুস্বাস্হ্যের লক্ষ‌ণ. আমার শ্বাশুড়ি বলেছিলেন, বেয়ান বাড়ি ফিরলে তোমাদের সাথেই আমার শাড়ি কিনো. তবে শ্বাশুড়ির বিনীত আবদার তার ছাত্রী অদ্রিজার বুটিকের পার্টিকুলার ডিজাইনের ঢাকাই শাড়ি. আজ সকালে অদ্রিজাকে ফোন করেছিলাম, শাড়িটা রেডি
আছে কিনা. অদ্রিজা বলেছে, বাপস্ রে বাপ্ ম্যাডামের অর্ডার সবার আগে তৈরি করে রেখেছি. নাহলে কি ‌আর রক্ষে আছে. জানো বৌদি ম্যাডাম সম্পর্কে আমাদের আগের সেই সম্ভ্রম আর ভালোবাসার মিলিজুলি ‌আবেগ আজো বজায় আছে. আমাদের ব্যাচের গেট-টুগেদারে ঘুরে ফিরে ম্যাডামের প্রসঙ্গ উঠবেই উঠবে.
টেলিফোনের মধ্যে হেসে উঠি আমি, “মা তো খুব ভালো মানুষ.মাইডিয়ার বলে যাকে, তবে ভয় পেতে কেন? অদ্রিজাও হাসে,” শুধু ভয় তো বলিনি. ভালোবাসার কথাও বলেছি. ক্লাসে ডায়াসে ভয়াবহ.
পড়া না করে ক্লাসে ঢোকা, পড়াবার সময় অন্যমনস্ক হলে কঠিন কঠোর. অথচ ক্লাসের বাইরে এক সংবেদনশীল বন্ধু. এমন মানুষ কে না ভালোবেসে পারা যায়?” কি আর বলি, শুধু বললাম “মায়ের শাড়িটা রেডি করে রেখো. সন্ধ্যের দিকে একসময় কালেক্ট করে নেবো.
ঢাকেশ্বরীতে ঢোকার আগে শ্বাশুড়ি – মায়ের শাড়িটা অদ্রিজার বুটিকের থেকে কালেক্ট করেছি. তারপর ঢাকেশ্বরীতে ঢুকেছি. মা আর আমার দুটো পছন্দ সই শাড়ি কিনেছি. মায়েরটা অবশ্যই কালো পাড় গরদ. মা বৈধব্যের সব নিয়মকানুন মানেন. আঁশ খান না. একাদশী করেন. কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি – মা সেসবের ধারপাশ দিয়ে যান না. নাঃ আমার রাগ হয় না. আজকের জগতের নিয়মই তো হচ্ছে আপ রুচি খানা. আপ রুচি পড়না. তাই আমি আমার মা বা শ্বাশুড়ি- মায়ের এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যাই না. ওদের ওদের মতো থাকতে দিই. তবে দুই বেয়ানের খুব ভাব. প্রতিদিন দেখা না হলেও রোজ টেলিফোনে কথা হয়. আর কি আশ্চর্য দুজনেই ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করতে ভালোবাসে.
যাক গে এখন আমি সেদিনের ঘটনায় আসি. ‌এক্কেবারে প্রথমে এমন একজনের কথা বলেছি, যার সংগে আজ অনেকদিন বাদে আমার দেখা. সে সুজন, আমার প্রাক বিবাহিত জীবনে আমার হার্ট -থ্রব. বিয়ে নিশ্চয়ই করেছে.
শাড়ির বিলের পেমেন্ট করেছে আমি লক্ষ্য করেছি. তখন সংকোচে কথা বলতে পারি নি. কাঁচের দরজা ঠেলে যখনই বেরোচ্ছি, তখনই দুজনের চোখাচুখি. সুজন স্বাভাবিক. জিজ্ঞেস করেছে কেমন আছি আমি. মৃদু হাসি আমার,.. “ভালো.” রাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব স্মৃতির রোমন্থন, তারপর সুজনের অনুরোধে তার অডিতে চেপে ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য পাঁচতারা হোটেলে পদার্পণ… নিশির ডাকে চলেছি আমি. সুজনের নির্দেশে কি ওয়েটার আমার সফট ডিঙ্কসের গ্লাসে হার্ড ডিঙ্কস সার্ভ করেছে? আগের পীরিতির লোক, তার ওপর নিজের স্বামী স্বপনের দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি সামাজিক অনুশাসনের ব্যাকরণ ভুলেছি. সুজনের পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েক পেগ খাওয়া হয়ে গেছে. চেতনা লুপ্ত. জ্ঞান ফিরে পেয়েছি চারশো – বিশ নাম্বার স্যুটের অবিন্যস্ত বিছানায়. গায়ে চাদর টানা রয়েছে. দেহে পোশাকের অনুপস্থিতি বলে দিয়েছে আমাকে আমার বর্তমানের স্ট্যাটাস. পাশে আমার কেনা কালকের সব প্যাকেট. ওয়াশরুমে গিয়ে স্নান করে পোশাক পরে নিয়েছি. ঘড়ি তে ‌আটটা বাজতে পনেরো . রিসেপশন থেকে ফোন করে জানিয়েছে, চেক আউট টাইম ডট আটটা. পেমেন্ট করা আছে. আমি প্যাকেট গুলো নিয়ে বেরিয়ে এসেছি হোটেল থেকে. ট্যাক্সি নিয়ে বলেছি জেনেক্সভ্যালি. ড্রাইভার ট্যাক্সি ছুটিয়েছে. এখনও ঠিকমতো অফিস- টাইম আরম্ভ হয়নি. নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক আগে পৌঁছেছি বাড়িতে. শ্বাশুড়ি রেগে ‌আগুন, তেলে বেগুন. হিসহিসে স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, “রাত কাটালে কোথায়? বেয়ানের বাড়িতে যাওনি শুনলাম. ” আমি ‌আনুপূর্বিক সব ঘটনা বলে গেলাম. নিরাসক্ত মুখে শুনে গেলেন. চেয়ার থেকে উঠে ল্যান্ড ফোনের কাছে. মাকে বললেন সব. ওপ্রান্তের উত্তর শোনা গেল না. মেয়ের কুকীর্তিতে একটা মায়ের বলার কি বা থাকে! শ্বাশুড়ি ফোন কানে নিয়েই বিশাল হুঙ্কার ছাড়েন…” এই বাড়ির বাইরে যাও.” হুঙ্কারের রেশ মেলায়নি. শ্বাশুড়িমা আমার সপাটে আছড়ে পড়েছেন মাটিতে.ডাক্তারকে খবর দিয়েছি. এসে শ্বাশুড়িকে পরীক্ষা করে বলেছেন চার ঘন্টা বাদে এসে ডেথ-সার্টিফিকেট লিখবেন. ম্যাসিভ্ হার্ট এ্যাটাক্. চেম্বারে অনেক পেশেন্ট অপেক্ষা করছে. নিয়মবিধি অনুযায়ী চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া যাবে না.পুরনো কাজের লোক শ্বাশুড়ির ছেলে ও অন্যান্য দের খবর দিয়েছে. স্বামী স্বপন আসছে বলে জানিয়েছে. সময় যাতায়াতের জন্য যেটুকু লাগবে. বডি পিস-হেভেনে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি. বাড়ির মধ্যে ঢুকিনি. এমন কি টয়লেটেও যাই নি. মনে হচ্ছে শরীরের প্রাকৃতিক ক্রিয়া – কর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে. মাসী শ্বাশুড়িকে বলেছি, শ্বাশুড়ির জন্যে কেনা নতুন ঢাকাই পড়িয়ে দিতে. মনে মনে বলেছি “ওটা তো তোমার ছেলের পয়সায় কেনা. পড়তে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই. কেমন তরো সংবেদনশীল মানুষ তুমি তোমার মেয়েকে ক্ষমা করতে পারলে না! “তোমার ছাত্রীরা তোমাকে ঠিক মতো চেনে না. একটা ফোন করেছি আমি যে এন. জি. ও র সংগে যুক্ত সেখানকার প্রেসিডেন্ট জলিদি কে. থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে. মেয়েদের সেলাই শেখাই সেখানে. বস্তীর মেয়েদের পড়াশোনার উইং খুললে তার দায়িত্ব নেব. এখনকার ‌থেকে মাইনেও বেড়ে যাবে. যথাসময়ে মেয়ের জন্ম দিয়েছি আমি. নাম রেখেছি অগ্নিহোত্রী. কামনার অগ্নি থেকে ওর জন্ম. স্হির করেছি এমন দৃঢ় ও চৌখশ ভাবে গড়ে তুলবো ওকে, তখন ওকে ডাকবে সবাই আগুনে পাখি বলে, যে সমাজের সব জন্জাল সাফ করে,… হবে মহীয়সী এক নারী. স্বপন বা সুজন আসে নি আর কোন দিন. আমার নিজের মা বেঁচে আছে কোনক্রমে. কিন্তু আমার মুখ দেখে না. আমি সিঙ্গল – মাদার.


Share This
Categories
গল্প

মৃত্যঞ্জয় : ডঃ অশোকা রায়।

কফির আড্ডায় আজ সবাই আছে নেই মৃত্যুঞ্জয়।
অবসরের পর আমরা সবাই কলকাতায়, দেশ- বিদেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে।
কর্মজীবন আমাদের সাত বন্ধুর জোড়টা আলগা করেছিল। তবে চোখের দেখা না থাকলেও প্রাণের বাঁধন বজায় রেখেছিল ইন্টারনেট। সুতরাং বন্ধুত্বে ভাঁটা সেভাবে পড়ে নি। স্কাইপ বা ভিডিও কলে আমরা পরস্পরের মেদ-বাহুল্য ঘটার ঘটনা যেমন জানতে পারতাম, তা,অপরাধী বন্ধুর পক্ষ থেকে লোকানোর যতোই চেষ্টা করা হোক না কেন, আবার কারো ওজন দ্রুত কমলে সেটাও জানা থাকতো । জ্ঞান বরিষণের হাত থেকে রেহাই পেতে তার কাজের অজুহাতে ভিডিও ক্যামেরার সামনে থেকে পালানোর কথা বাকিদের কাছে অজানা থাকতো না। সকলের নাড়িনক্ষত্র আমাদের প্রত্যেকের কাছে খোলা খাতার মতোই ছিল। কথাটা যে কতটা ভুল ছিল তা’ বুঝেছি অবসরের পর। তবে সে বোঝা অলৌকিকভাবে।
অবসরের পর আমরা সবাই দেশের মাটিতে। মৃত্যঞ্জয় রয়েছে মেক্সিকোতে। ওর বিদেশিনী বৌয়ের চাকরি আর কয়েক মাস আছে। মৃত্যুঞ্জয় আর তার বৌ লিসা ঠিক করেছে ভারতে ফিরবে। আর তো কয়েক মাস। তারপর সপ্তরত্নের সভা সস্ত্রীক জমজমাট। বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভা হার মেনে যাবে। আমাদের স্ত্রীরা যমের মুখে ছাই দিয়ে বহাল তবিয়তে বর্তমান। সুতরাং দুরন্ত মৃত্যুঞ্জয় ঘরে ফিরলে আমরা সাত দু-গুণে চোদ্দো। নবরত্ন সভাকে হাসিহুল্লোড়ের রেটিং এ পিছে রাখতেই পারি।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আলিপুরের এক কফি-বারিস্তায় আমাদের নতুন আড্ডা। আগের আড্ডা কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস আমরা ছেলে-ছোকরা আর কিছু ইন্টেলেকচুয়াল লোকজন কে ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য কোনকালেই আমরা যথাযথ ইন্টেলেকচুয়াল ছিলাম না। তবে ইন্টেলেকচুয়ালের ভান করাটা প্যাশন এবং ফ্যাশন ছিল। তাই ব্রাত্য হওয়ার ভয়ে কফি হাউসের কাঠের সিঁড়ি ভাঙ্গতাম।
এখন সেই ফ্যাশনের মোহ নেই, প্যাশন উধাও। বয়স বেড়েছে। আমরা সবাই দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। এতোটা পথ উজিয়ে যাওয়ার এনথু একেবারে লেস।
তাই কফিহাউস ছেড়ে আলিপুরের কফি-বারিস্তায় আমাদের আড্ডা। রোজ নয়, সপ্তাহে দুদিন। আড্ডার অত সময় আমাদের মধ্যে তিনজনের নেই। আমার ছেলের চাকরি খোদ কলকাতার বুকে। একে নিজের বৌয়ের ফরমায়েশ, তার ওপর বৌমার চিকণ গলায় আবদারের সুরে বলা তার নিজস্ব জিনিসের ফর্দ। কায়দা করে জুড়ে দেয় প্রশংসা, ” বাবা তোমার বাজার করার ফরম্যাট টা সুন্দর। তোমার ছেলে কে কেন শেখাও নি? কিছু আনতে বললে আগেভাগে ফরমান জারি করে, ওসব কোথায় পাওয়া যায় জানি না। বাবা কে বলো। ” অগত্যা বাজারে দরকারী অ- দরকারী কাজে আমার কাটে পাক্কা দু ঘন্টা। তারপর কিছু অবসর। চারটে বাজতে না
বাজতেই দুটো ক্ষুদে দস্যির আগমন। পার্ক আর ইনডোর গেমস। কিন্তু সেটা আমার রিলাক্সেশন। আসলের চেয়ে সুদ বেশি। বাদবাকি দুজনের ঐ একই অবস্থা। একটু ঊনিশ-বিশ।
হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। সেদিন আড্ডা তুঙ্গে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পাওয়া নিয়ে। চলে এসেছে অমর্ত্য সেনের প্রসঙ্গ। কফির পেয়ালায় আলোচনার তুফান। হঠাৎ আমাদের টেবিলের সামনে মৃত্যুঞ্জয়। সেই দীর্ঘ দেহ। ঠোঁটে মুচকি হাসি। আমরা ছ’ জন হতবাক। সায়ক বলে, “তোর তো ফিরতে কয়েক মাস বাকি! ” মৃত্যুঞ্জয় বলে,” আগে ফিরতে মন চাইছিল বড়ো। কেন তোরা খুশি হসনি? ” নবারুণ, উদয়, অমিত, কৌশিক সমস্বরে বলে, ” তুই ভাবলি কি করে এ কথা। আমরা বলে অপেক্ষা করে আছি, কবে আসবি তুই “? মৃত্যঞ্জয় এবার আমার দিকে চায়, ” কি করে প্রদীপ, এমন করে চেয়ে আছিস যে। এক কাপ কফি তো বল। আর কাজুবাদামও অর্ডার কর। ” আমরা ভালো করে জানি মৃত্যঞ্জয়ের পছন্দ। আগে বলতো, কফির সাথে কাজু হোয়াটস এ্যা ফ্যান্টাস্টিক কম্বিনেশন”! একটু পজ দিয়ে বলতো, “খেতে খেতে আমি ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় চলে যাই। “
আমি কফি- কাজুর অর্ডার দিই।
ওগুলো আসার আগে মৃত্যুঞ্জয় বন্ধুদের সাথে মেক্সিকোর গল্পে মেতেছে। আমার মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। সকালের ফোনটা কি ফেক ফোন? ঐরকম বদমাইশি কেউ কারও সাথে করে! ভেবছিলাম, বন্ধু দের একটু পরে জানাব, কেউ একজন মেক্সিকো থেকে জানিয়েছে, “মৃত্যঞ্জয় ভৌমিক ইজ নো মোর। ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক”। আর এখন মৃত্যুঞ্জয় আমার সামনে বসে কলকাতার কফি-বারিস্তায় কাজু খাচ্ছে! ভাগ্যিস খবরটা বন্ধু দের আগে দিই নি। লেগপুলিং কে আমার বড়োই ভয়। ভেবেছিলাম বাড়ি ফেরার আগে দেব। আজ দুপুরে ভাত খাইনি ফোন রিসিভ করে মন খারাপ।
ভাবনার মধ্যে আমার ফোন টা বাজছে। ফোন বার করে দেখি, কলার লিসা। “হ্যালো”. ” প্রদীপ, মৃত্যুঞ্জয় চলে গেছে। ফিউরানাল শেষ হলো। ইন্ডিয়ায় ফেরার জন্য ফিউরিয়াস হয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝিনি। বোঝাতাম আর তো কয়েক মাস। মুখে কিছু বলত না। কিন্তু রেস্টলেস হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।
আমার ইল- লাক। আমি চাকরি ছাড়ছি। সময়ের টি
কাজ সময়ে করা উচিত,এ শিক্ষা আমার ইগনোর করা উচিত ছিল। বড়োই লেটে বুঝলাম। মৃত্যঞ্জয়ের ইচ্ছামত বাদবাকি জীবন ইন্ডিয়ায় কাটাব। বাট মৃত্যুঞ্জয় থাকবে না, সাথে। তুমি আমার একটা এ্যাকোমোডেশন এ্যারেঞ্জ করে দিও প্লিজ। ” লিসা জানে, আমি মৃত্যঞ্জয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এটুকু সাহায্য সে চাইতেই পারে। আশ্চর্যজনক কিছু নয় সেটা। আমি ফোন টা ইদানীং কানে কম শুনি বলে সবসময় স্পিকারে দিই। বন্ধু রা আমার ফোনে লিসার প্রায় এক তরফা কথা শুনেছে। মৃত্যঞ্জয়ের চেয়ারের দিকে তাকিয়েছে। চেয়ার খালি। কফির কাপ শেষ।
কাজুবাদামের প্লেট খালি।
জীবন থেকে চলে গিয়েও মৃত্যুঞ্জয়ের ইচ্ছা হয়েছিল বন্ধুদের সাথে অন্ততঃ একবার আড্ডা মারার। মৃত্যু কে জয় করে মৃত্যুঞ্জয় তার ইচ্ছাপূরণ করেছে।
সর্বস্বত্ব লেখিকা কর্তৃক।সংরক্ষিত।
19/10/2019

Share This