Categories
গল্প প্রবন্ধ

নিত্যানন্দ এয়োদশী কেন এত মহিমাময় ? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

বঙ্গদেশের বেশিরভাগ রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের দু’পাশে আমরা দু’বাহু উর্দ্ধে প্রসারিত করা নিতাই-গৌরের মূর্তি দেখতে পাই । প্রায় সকলেই জানি গৌর  অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব। কিন্তু নিতাই  বলতে বুঝি গৌরের দাদা বা ভাই স্থানীয় কোন বিশেষজন। কারণ, প্রচলিত প্রবাদ বাক্য প্রায় সকলেরই জানা– “নিতাই-গৌর দুই ভাই , হল এক ঠাঁই।”  যদি প্রশ্ন করা হয় , আচ্ছা তাঁদের মধ্যে গৌর কে আর কোনজনই বা নিতাই। তাহলে কয়জন যে সঠিক উত্তর দিতে পারব সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ।বলবো হয়ত, দু’জনেই তো একই রকম দেখতে,তাই ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক । হ্যাঁ ,খুবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এ কারণে যে, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর এই প্রায় পাঁচশো বত্রিশ বছরের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যত চর্চা হয়েছে তার সিকি ভাগও নিতাই বা নিত্যানন্দকে নিয়ে হয়নি । যত গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে রচিত হয়েছে , পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বিশেষ চরিত্র নিয়ে এত গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। অথচ, যে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে এত লেখালিখি, যাঁর ভক্তি আন্দোলন সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে দূর মহাদেশে প্রভাব ফেলেছে—-সেই তিনি নিজমুখে শ্রীরাঘব পণ্ডিতের কাছে স্বীকার করেছেন , “এই নিত্যানন্দ যেই করায় আমারে।সেই করি আমি এই বলিল তোমারে।।”(চৈ.ভা.অন্ত্য,৫) নিত্যানন্দ যদি না থাকতেন তাহলে শ্রীচৈতন্যদেবকে জগত জানতে পারতো না। ভক্তি আন্দোলন হতই না । যখন মন্দিরে নিত্যানন্দ বিগ্রহ স্থান পেয়েছেন, পূজা পাচ্ছেন ,তখন তাঁর পূজিত হওয়ার কি কারণ হতে পারে সে সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ওঠাটা খুব যুক্তিসংগত। তবে তা কিন্তু অনেকাংশে হয়নি বললেই চলে। কারণ সেই একটাই—তাঁর সম্পর্কে আলোচনা কম। অথচ ,এই নিত্যানন্দই ছিলেন মধ্যযুগের বঙ্গদেশে সংঘটিত ধর্মবিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারী। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব প্রদর্শিত প্রেমভক্তি-ধারার ভগীরথ । মধ্যযুগীয় মানবমুক্তির অগ্রদূত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের  অভিন্ন আত্মা নিত্যানন্দ । চৈতন্যদেব ও  নিত্যানন্দের যৌথ সংকল্প ও প্রয়াসের সার্থক প্রতিচ্ছবি হল প্রেমভক্তি আন্দোলন। চৈতন্যের ইচ্ছার রূপকার হলেন নিত্যানন্দ।যা নিমাই চেয়েছেন, নিতাই  করেছেন তা বাস্তব। নিমাই নামপ্রেম  এনেছেন আর অকাতরে তা বিলিয়েছেন নিতাই।নিমাই-নিতাইয়ের লোকহিতৈষণা ব্রতেই  নবযুগের সূচনা সম্ভব হয়েছে । ভারতবর্ষের প্রথম সাম্যবাদী সমাজ স্থাপিত হয়েছে নিত্যানন্দরই পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতায় । ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গণ সংগঠন গড়ে উঠেছিল নিত্যানন্দেরই নেতৃত্বে। চন্দ্র প্রকাশ হতে যেমন , সূর্যের আলো লাগে , ঠিক তেমন গৌরচন্দ্র প্রকাশ হত না যদি না নিতাই সূর্য থাকতো । আর , একথা অত্যুক্তি বা অতিকথন ও অতিরঞ্জন নয় । কেন? তা আমরা আজ এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আলোচনা করার চেষ্টা  করবো।  ৩রা ফেব্রুয়ারি, মাঘী শুক্ল ত্রয়োদশী তিথিতে নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর। এই সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে আজও যে তিনি কতখানি প্রাসঙ্গিক তা জানবো ।

ইতিহাসের খাতে নিতাই-নিমাই দুটি হৃদয়ধারা গঙ্গা-যমুনার মত পারস্পরিক সৌহার্দ্য ,ভ্রাতৃত্ব ,সাহচর্য্যকে  সম্বল করে নিরবধি বয়ে গেছে নির্দন্ধ, নিঃস্বার্থ ভাবে ।একে অপরের প্রতি কী সুগভীর টান,ভালোবাসা,অন্তরঙ্গতা — যা ইতিহাসে বিরল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, “মুঞি নিত্যানন্দের দাস— একথা প্রতিদিন মুখে যে একবার বলে,আমি তার হয়ে যাই।” আবার, নিত্যানন্দ বলেছেন, “ যে দিনান্তে অন্তত একবার ‘হা গৌরাঙ্গ’ বলে ,আমি তার দাস হয়ে যাই।” নিতাই-নিমাই দু’জনারই জীবনের এক লক্ষ্য, এক অভীপ্সা— পতিত উদ্ধার করা ,দীন-দুঃখী- দরিদ্র-দুর্বলদের মুখে হাসি ফোটানো।

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল অদ্ভুত জনাকর্ষিণী ,লোকমোহিনী শক্তি। মানুষের মন যে কী ভাবে মমতাভরা ব্যবহার দিয়ে জয় করা যায়, তা যেমন তিনি জানতেন ,তেমনি নিজ ব্যক্তিত্বগুণে সংগঠন কার্য্য পরিচালন পদ্ধতিও তাঁর অজানা ছিল না ।আর ,সে কারণেই তাঁরই অনুপ্রেরণায় শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তনকে গণসঙ্গীতের রূপ দিয়ে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  নিত্যানন্দ নদীয়াতে আসার আগে পর্যন্ত কীর্তন ঘরের মধ্যে করা হত।নিত্যানন্দ পরামর্শ দিয়ে কীর্তনকে খোলা আকাশের নীচে পথে বের করে আনালেন ।আকাশে বাতাসে হিল্লোল তোলা কীর্তনের ভাব,আবেগ,ধ্বনি,সুর ,অনুরণন ক্রমে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করলো। সর্বস্তরের মানুষ সমবেতভাবে গলা মেলানোয় তা সংকীর্তনের রূপ নিল।  গণবিপ্লবের মাধ্যম  হয়ে উঠল ধীরে ধীরে এই সংকীর্তনরূপ গণসংগীত।  সকল শ্রেণীর মানুষ শামিল হতে থাকলেন সেই সংকীর্তনরত  গণজোয়ারে। ভেদ-ভাবের ভাবনা ভুলতে থাকলো মানুষ। জাতের বিচার করে নয় , ভক্তির গভীরতায় একে অপরকে প্রণাম করতো। ফলে দেখা গেল ব্রাহ্মণ হয়েও চন্ডাল ভক্তের পদধূলি নিয়ে মাথায় দিচ্ছে নিজে। অসাম্য দূর হল।অনাথ-আতুর-অবহেলিতরা সমাজে  হৃত সম্মান ফিরে পেতে থাকলেন। নিত্যানন্দ দেখালেন ধর্ম কখনো বিদ্বেষ তৈরি করে না , তৈরী করি আমরাই।ধর্ম তো আশ্রয় দেয় , ধারণ করে আমাদের। মানুষের সাথে মানুষের সম্মিলন করায়  ধর্ম।  এভাবেই সেদিন থেকে রক্ষণশীল সমাজের স্মার্ত-বিধি-বিড়ম্বনার অবসান সূচীত হয়েছিল। জাতিভেদের অবসান হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম সকলকে ধারণ করে সার্বজনীন মানব ধর্মে পরিণত হয়েছিল। “বৈষ্ণবের জাতি বুদ্ধি যেই জন করে। কোটি জন্ম অধম যোনিতে ডুবি মরে”।(চৈ.ভা.)

তবে পথে-ঘাটে এমন  সংকীর্তনের ফলও হয়েছিল মারাত্মক । কাজীর আদেশে পেয়াদারা কীর্তনের  বাদ্যযন্ত্রগুলো মাটিতে আছাড় দিয়ে ভাঙ্গতে থাকলো । সংকীর্তনকারীদের প্রহার করতে থাকলো। গৌরাঙ্গ সিদ্ধান্ত নিলেন কাজীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে নামবেন ।হাতে মশাল নিয়ে কীর্তন করতে করতে কাজীর বাসভবন ঘেরাও করা হল।  সেই ঘেরাও মিছিলের  নেতৃত্বে ছিলেন নিতাই। অস্ত্র একটাই—সংকীর্তন। নিজের ভুল বুঝে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন ভীত কাজী। তিনি গৌরাঙ্গের চরণে আত্মসমর্পণ করলেন ।এই আন্দোলনই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম অহিংস আন্দোলন। ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘History of Bengali Literature’ গ্রন্থে একথাই  লিখেছেন— “It was perhaps the first act of civil disobedience in the history of India.” এখনও পর্যন্ত নগর সঙ্কীর্তন করার সময় যে ‘খোন্তা’ ব্যবহার করা হয় , তা আসলে কাজীর থেকে আদায় করা কীর্তনের গেটপাস, যা সঙ্কীর্তন প্রচার-প্রসারের উদ্যোগে সেদিন নিত্যানন্দের জয়কে সূচীত করে।  সুবিশাল দেহী, অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্বানুভাবানন্দে বিভোর নিত্যানন্দ নবদ্বীপের ঘরে ঘরে পথে পথে নামপ্রেম বিতরণ করতে মত্ত সিংহের মত বিচরণ করেছেন। “নিত্যানন্দ মত্ত সিংহ সর্ব নদীয়ায় । ঘরে ঘরে বুলে প্রভু অনন্ত লীলায়”।(চৈ.ভা.মধ্য,২৪)

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল এক সুন্দর ক্ষমাশীল সর্বংসহ মানসিকতা। ঠিক সেকারণেই , নবদ্বীপে যখন দুর্বৃত্ত জগাই-মাধাই মদের কলসীর প্রহার করে কপাল ফাটিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করেন, তখনও নিত্যানন্দ নির্বিকার। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে , অথচ তাও যে রক্ত ঝরালো, চাইছেন তার উদ্ধার। এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু সমগ্র বিশ্বের ধর্মের ইতিহাসে বিরল। মহাপ্রভু, তাঁর প্রাণের নিতাইয়ের অমন করুণ পরিণতি দেখে‌ ক্রোধে আত্মহারা হয়েছেন সেসময়। কিন্তু, নিত্যানন্দ সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছেন জগাই-মাধাইকে । এমন অহিংস নীতির গুণেই জগাই-মাধাইয়ের মত নৃশংস , অত্যাচারী , কুখ্যাত মানুষের মন পরিবর্তিত হয়েছিল। সেদিন থেকে মানবিকতার মন্ত্র পেয়ে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নিত্যানন্দের আদেশে তাঁরা গঙ্গার ঘাটে আগত স্নানার্থীদের সেবার কাজে নিজেদের বাকী জীবন নিয়োজিত করেছিলেন।  কাটোয়ায় ‘জগাই-মাধাইয়ৈর ঘাট’ আজও সেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । সদা আনন্দে থাকা  নিত্যানন্দ এমন ক্রোধহীন,  অহংকারহীন ছিলেন বলেই পদকর্তা লোচন দাস ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অক্রোধ পরমানন্দ নিত্যানন্দ রায় । অভিমান শূন্য নিতাই নগরে বেড়ায়।।”

নিত্যানন্দ ছিলেন অদোষদর্শী , কখনো কারও দোষ দেখতেন না। সকলেই তাঁর কাছে বড় আপনারজন।  সর্বদা বালখিল্যভাবে তিনি মত্ত থাকতেন।  বালকের ন্যায় মুখে খলখল হাসি আর শ্রীনয়নে যেন আনন্দধারা বয়ে যেত। তাঁকে যে দেখত তার মনও আনন্দে ঝংকৃত হয়ে উঠতো। আর কেউ যদি চৈতন্যের ভক্ত হতেন তবে তো কথাই নেই । গৌরাঙ্গের নাম নিলেই তিনি নিজেকে তার চরণে বিকিয়ে দিতেন।  তাইতো কেবল বলতেন, “আমাকে কিনিয়া লহ বল গৌরহরি”।

মহাপ্রভু চেয়েছিলেন একটি সার্বজনীন মানবধর্ম প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে। জাতের দলাদলি, কৌলিন্যাচারের করাল থাবা  মুক্ত হোক মানুষের জীবন । যথাযোগ্য সম্মান পাক প্রতিটি মানবিক চেতনা । উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, সম্মানীয়-হীন সকলে সকলকে গ্রহণ করুক সমানভাবে , বিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে।  কিন্তু ,এ কাজে তাঁকে চরম বাধা প্রাপ্ত হতে হয়েছিল যতটা না  মুসলমানদের থেকে , তার থেকে অনেক বেশী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে । তিনি চিন্তা করে দেখলেন, সন্ন্যাসী সকলের পূজ্য হন, এখন তিনি যদি নিজে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তবে উন্নাসিক ব্রাহ্মণদের থেকে সম্মান, প্রণাম ,অধীনতা আদায়ের মাধ্যমে সমাজের অসাম্য দূর করার প্রচেষ্টায় আরো একধাপ অগ্রসর হওয়া সহজ হবে। তিনি তাই সংসারের নিরাপদ, সুখময় জীবন বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসের কঠোর জীবন সংগ্রামের পথ অবলম্বন করেছিলেন । আর , মূলতঃ নিত্যানন্দই তাঁকে সম্মতি জানিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্তে।  পরিণামে ফলও  পাওয়া গিয়েছিল হিসেবমতই। মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে জননী ও যুবাস্ত্রীকে ত্যাগ করে, নবদ্বীপের নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিতের গৌরবময় জীবনকে তুচ্ছ করে নিমাইয়ের  আকস্মিক সন্ন্যাস গ্রহণ সকলকে স্তম্ভিত করলো। অতি বড় পাষাণ হৃদয়ও গলিত হল, নরম হল।

এই মহাপ্রভুই যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর পাগলের মত বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রাঢ়দেশ দিয়ে ছুটছেন; তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কোন হুঁশ নেই তাঁর। তখন নিত্যানন্দের চতুরতাতেই তাঁকে শান্তিপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
“দেখি সব ভক্তগণ করে অনুতাপ।
গৌরাঙ্গ গোলক যায় কি হবে রে বাপ।।
তবে নিত্যানন্দ প্রভু বলে বীর দাপে।
রাখিব চৈতন্য আমি আপন প্রতাপে।।”
(লোচন দাসের চৈতন্য মঙ্গল,মধ্য, ১৪)

তাই তো সুবিখ্যাত ‘অমিয় নিমাই চরিত’গ্রন্থে শ্রীশিশির কুমার ঘোষ এপ্রসঙ্গে নিত্যানন্দের অবদান স্মরণ করে লিখেছেন ,”শ্রীনিত্যানন্দের কথা কি বলিব?  প্রভু নিতাই!  তোমাকে কি ধন্যবাদ দিব? আহা! ধন্যবাদ তো অনেককেই দিয়া  থাকি,  হৃদয়ে কি তোমার পাদপদ্মে প্রণাম করিব? তাহাও তো সকলে করিয়া থাকে। অতএব, হে নিত্যানন্দ! হে বিশ্বরূপের অভিন্ন কলেবর,হে জীবের বন্ধু! আমি তোমার ধার শুধিতে পারিলাম না, তোমার নিকট চিরঋণী রহিলাম।”

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব বুঝেছিলেন যে তেজস্বী ,আত্মবিশ্বাসী, অটুট ব্যক্তিত্বের অধিকারী উদ্যমী নিত্যানন্দই এমন একজন ব্যক্তিত্ব , যাঁকে  সেসময়ের সমাজের ভীষণ প্রয়োজন। জাত-পাত বিভেদের  বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের ক্ষুদ্র মানসিকতাকে , সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করতে চাই নিত্যানন্দের মতো বৃহদ্ মানবিকচেতনা সম্পন্ন একজন সংগঠকের। জনমানসচেতনার উদ্বোধন ঘটাতে একজন সুদক্ষ নেতার যা যা গুণ, সর্বংসহ উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তরে মানবপ্রেম থাকা প্রয়োজন — তা সব  নিত্যানন্দের মধ্যেই নিহিত আছে।  শ্রীগৌরাঙ্গ দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন যে ,নিত্যানন্দের হৃদয়ে সকল জাতের মানুষের প্রতি  যে সাম্যভাব আছে সেই ভাব, সেই নীতিকে যদি সমাজে প্রকাশিত করে দেওয়া যায় ,প্রবাহিত করে দেওয়া যায় তবে সমাজে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়ে যাবে। আর তাই তিনি যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করে পুরীতে বাস করছেন তখন এক বছর আদেশ করলেন নিত্যানন্দকে—-

“মূর্খ নীচজড়ান্ধাখ্যা যে চ পাতকিনোপরে।
তানেব সর্বথা সর্বান কুরু প্রেমাধিকারিণঃ।।”
(মুরারি গুপ্তের কড়চা-৪/২১/১০)

—-“নিত্যানন্দ তুমি এভাবে আর রথযাত্রায় প্রতিবছর এসো না। তুমিও যদি সন্ন্যাসী-মুনীদের মত করে সব ভুলে কেবল ধর্মাচরণ পালনে ব্যস্ত থাকো, তবে সমাজকে কে চালনা করবে ! সমাজের দুঃখী-দরিদ্র ,আর্ত-আতুরদের দুরাবস্থা কে ঘোচাবে!  না, না,, তোমাকে যে আরও বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে হবে ।”

নিজের গণসমেত অর্থাৎ অনুগত জনাদের নিয়ে ফিরে এসেছিলেন নিত্যানন্দ । পুরী থেকে ফেরার পথে যখন  পানিহাটিতে  শ্রীরাঘব পন্ডিতের ভবনে উঠলেন , তখন সেখানে গঙ্গাতীরে এক মহোৎসবের আয়োজন করালেন হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের জমিদার পুত্র  রঘুনাথ দাসের  ব্যয়ভারে। সেই উৎসবে একসঙ্গে  ৩৬জাতির মানুষকে  এক পংক্তিতে (লাইনে) বসিয়ে ভোজন করালেন । পানিহাটীকে কেন্দ্র করেই নিত্যানন্দ তাঁর সমাজসংস্কারক অভিযান শুরু করলেন। সেখানেই  নিত্যানন্দ তাঁর পার্ষদদের মধ্য থেকে উপযুক্ত বারোজনকে নির্ধারণ করলেন। শ্রীঅভিরাম , সুন্দরানন্দ , ধনঞ্জয়, গৌরীদাস, কমলাকর পিপ্পলাই, উদ্ধারণ দত্ত, মহেশ পণ্ডিত, পুরুষোত্তম দাস, নাগর পুরুষোত্তম, পরমেশ্বর দাস, কালা কৃষ্ণদাস ও শ্রীধর পণ্ডিত—–  এঁদেরকে গৌড়মন্ডলের এক একটি নির্দিষ্টস্থানে নামপ্রেম প্রচারের দায়িত্ব দিলেন। আদেশ দিলেন উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র কোন বাছবিচার না করে প্রত্যেককে  কাছে টেনে নিতে।  নিত্যানন্দের নির্দেশে সেই বারোজন সেনানী আজীবন সেই কর্মই করে গেছেন।  ফলে সমাজে এক মানববন্ধন তথা প্রেমমন্ডল তৈরি হয়েছিল। ধর্মবিভেদ ভুলে ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ নীতিতে মানুষ মানুষকে  তথা মানবাত্মাকে সম্মান করতে শিখেছিলো।

নিত্যানন্দ অনুভব করেছিলেন যে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের অর্থাৎ জল-অচল হিন্দু, বৌদ্ধ সহজিয়া , নেড়া-নেড়ী সম্প্রদায়ের সেই বিশাল সংখ্যক মানুষকে যদি সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায় তবে হিন্দুসমাজ বলবতী হবে।  এই ভাবনা থেকেই তিনি সস্নেহে পূর্ববঙ্গের জল-অচল মানুষদের কৃষ্ণনাম প্রদান করে মূল হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন । বহিষ্কৃত সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়কেও সেসময় হিন্দু সমাজভুক্ত করেছিলেন তিনি। তারফলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণীয়তা আরো বেড়ে গিয়েছিল।শ্রীগৌরাঙ্গের আদর্শ–“কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার”— এই পন্থাকে অবলম্বন করে নিত্যানন্দ তাঁর পতিত উদ্ধারণ লীলা অব্যাহত রাখলেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বহারাদের নেতা, বঙ্গদেশের প্রথম সাম্যবাদী নেতা। তাঁর আবেদন ছিল অত্যন্ত জোরালো ও প্রভাবময়।

নিত্যানন্দ ছিলেন চরম বাস্তববাদী নেতা।  তাইতো তিনি বলেছিলেন, “কাঠিন্য কীর্তন কলিযুগ ধর্ম নয়”( জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল–উত্তরখন্ড)। আরও বলেছিলেন, “কূলবধূ নাচাইমু কীর্তনানন্দে”(ঐ)।  পুরুষদের মত নারী জাতিরও যে অধিকার আছে কীর্তনে অংশগ্রহণ করার,সেখানে নৃত্য করার—একথা প্রথম শোনা যায় নিত্যানন্দের নির্ভয় কন্ঠেই । তখন থেকেই পর্দানশীন বঙ্গবধূর বহির্জগৎ তৈরি হতে থাকে। অন্দরমহলের অন্তরায় ভেদ করে নারীরা সর্বসমক্ষে আসতে আরম্ভ করে। আর তারই চরম দৃষ্টান্ত হল  নিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী জাহ্নবাদেবী। জাহ্নবাদেবী হয়েছিলেন সমুদয় বৈষ্ণবকুলের আচার্যানী, জননেত্রী। সমগ্র গৌরমন্ডলে পরিভ্রমণ করে, বিগ্রহ স্থাপন করে , মহোৎসব করে বৈষ্ণবদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন তিনি।

সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতিমূর্তি নিত্যানন্দে  শৈব ,শাক্ত ,বৈষ্ণব—এই ত্রিধারার মেলবন্ধন দেখতে পাই আমরা। কারণ, তাঁর মস্তকে থাকতো শাক্ত সম্প্রদায়ের ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র , সঙ্গে রাখতেন শৈব সম্প্রদায়ের নীলকন্ঠ মহাদেব ; আর ,কণ্ঠে ধারণ করতেন বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিভূ  অনন্তদেব শিলা ।  তাঁর মত হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব ছিল এমন বেপরোয়া আচরণ।  আবার , যে যুগে জাত বাঁচাতে ব্রাহ্মণরা অন্য জাতের জলটুকুও গ্রহণ করতেন না , সেযুগে  নিত্যানন্দ ছিলেন একেবারে ছুঁৎমার্গহীন।দিনের পর দিন বৈশ্য সম্প্রদায়ের উদ্ধারণ দত্তের  রন্ধন করা দ্রব্য  আহার করেছেন । প্রথম জীবনের সুদীর্ঘ কুড়িটা বছর ভারতবর্ষের নানা স্থানে পরিব্রাজক হয়ে ঘোরার ফলেই হয়তো বা ভারতমাতার উদার মানবিক ভাবটি আত্মস্থ হয়েছিল তাঁর।

নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর পরও তাঁর আদর্শ ও তিনি বড় বেশীরকম প্রাসঙ্গিক। তবে, গৌর আদর্শের সার্থক রূপকার নিত্যানন্দের সাংগঠনিকশক্তি ও উদার-ভাবনা সম্পর্কে গবেষণা সেই অর্থে হয় কী! বর্তমানের এই দাঙ্গা-হানাহানি, অভিযোগ-অশান্তির আবহে ভীষণ প্রয়োজন বৃহৎ আদর্শের , সাম্য মনোভাবের। মানবদরদী নিত্যানন্দ চরিত্রের আলোচনা, গবেষণা— তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

টুকাই : রাণু সরকার।

পতিত বস্তু পথ থেকে তুলে তুলে জড়ো করে বস্তায় নানান জায়গা থেকে, কখনো ডাস্টবিন ঘেঁটে।
ছোটবেলা থেকে বঞ্চিত মাবাবার ভালোবাসা থেকে। এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা মা বাবার সাথেই কুড়িয়ে বেরায় জঞ্জাল।
এই আবর্জনা কুড়িয়ে বিক্রি করে যা টাকা পায় কোনরকমে পেট চলে, ওদের ঘর নেই, রাস্তার ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।
মেয়েদের সমস্যা বেশিরভাগ,অন্ধকার নেমে আসলেই ভয়ে ভয়ে রাত কাটে- কখন কি অঘটন ঘটিয়ে দেয় হিংস্রের দল। একদিন এক ঝুপড়ির দুহিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র জন্তু, মনে হয় তার খাদ্যের অনটন দেখা দিয়েছিল, আসলে বিনামূল্যে গায়ের জোরে খাবার মেলে যে ঝুপড়িতে। সেই দুহিতা কিছুদিনের মধ্যেই হয় অন্তঃসত্ত্বা, আর কি করা ওদের সাথে তো কেউ নেই ঘৃণার চোখে দেখি তাই অস্বাভাবিক ভাবেই হলো গর্ভমোচন। এরাতো টুকাই- তাই না?ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো কিছুদিন লালনপালনও করলো। কি জানি কে চুরিও করে নিলো শিশুটিকে সন্তান হারা মা এখন পাগল।কে করবে ওর চিকিৎসা?

পাশের এক ঝুপড়ির টুকাই সব দেখে ভয় পেলো – ওরকম যদি ওর হয়।
এই টুকাই একটু বুদ্ধিমতী ছিলো তাই সে একদিন জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবহৃত আবরক কিনে রাখলো তার আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এক ওষুধের দোকান থেকে-দোকানী টুকাইয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে-ভাবতে থাকে যে কি করবে-হয়তো পরে ভাবনার উত্তর ঠিক খুঁজে পেয়েছে।
কোন হিংস্র আসলে অনিচ্ছাকৃত এই অস্ত্রটি হাতে তুলে দিয়ে বলবে, এই নে– আমার অস্ত্র দিয়ে আমাকে খুন কর—

ভাবা যায় না সচরাচর এইরকম ঘটেই চলছে- এই টুকাই দের কথা ভাবি না, নিজেকে নিয়েই থাকি ব্যস্ত।

Share This
Categories
গল্প

পরিবর্তন : দিলীপ রায়।

তপা পরীক্ষার মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরল । অভিভাবকের স্বাক্ষর করিয়ে পরের দিন অবশ্যই জমা দিতে হবে । পরেরদিন মার্কশীট জমা দেওয়ার শেষ দিন । তপা মায়ের কাছে গিয়ে মার্কশীট দেখিয়ে বলল, কীভাবে বাবার স্বাক্ষর নেওয়া যায় ? বাবা মার্কশীট দেখলে আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে ।
নম্বরের যা বহর, তাতে তুই কোন্‌ মুখে বাবার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর চাইবি !
তপার বাবা পশুপতি খাঁ । পূর্বস্থলি স্টেশনের কাছে সোনাঝরা গ্রামে তাঁর মুদিখানার দোকান । দোকানে অনেক ধার-বাকী । খরিদ্দারের কাছ থেকে ধারের টাকা আদায় হচ্ছে না । চাইতে গেলে সকলের মুখে এককথা, “মাঠের ধান উঠুক, ধারের সমস্ত টাকা শোধ করে দেবো ।“ পশুপতির আবার ধার দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ । অথচ ধার না দিলে খরিদ্দার ধরে রাখা কষ্ট । সদলবলে গাজি মিয়ার মুদির দোকানে হত্যে দেবে । তাতে আখেরে তাঁর লোকসান ।
তখন সন্ধ্যা আঁটটা ! খরিদ্দারের আনাগোনা নেই বললেই চলে । তাই ভাবল পশুপতি, এবার দোকান বন্ধ করা যাক । মন-মেজাজ তাঁর ভাল নেই । কিছুক্ষণ আগে খাতা খুলে পশুপতির মাথায় হাত ! প্রায় আঠারো হাজার টাকা ধার । এইটুকু দোকানে এতগুলি টাকা ধার ! লোকে ধার খেয়ে শোধ করার নাম করছে না । অথচ অনেকগুলি টাকা । সংসারে অনেক খরচ । অভাব অনটনের বহর বেড়েই চলেছে । তাঁর বৌটা তেমনি ! একটু রেখে ঢেকে খরচা বাঁচিয়ে সংসার চালাবে সেদিকে তাঁর নজর নেই । শুধু বায়নাক্কা । এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে । দেখা যাবে আজ গৃহের আসবাবপত্র কেনা, কাল দেখা যাবে ঘরের থালা বাসন কেনা ! আজকাল আবার অনলাইনে কেনাকাটা শিখেছে । কেনার শেষ নেই । তাঁর বৌয়ের খরচার হাত ষোলোআনা । এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে পৌঁছালো পশুপতি খাঁ ।
গামছা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁর বৌ বলল, “হাত মুখ ধুয়ে এসো চা বানিয়ে দিচ্ছি । ঐদিকে খাবার রেডি । যখন বলবে তখনই রাতের খাবার দিয়ে দেবো ।“
পশুপতি বৌয়ের দিকে কট্মট করে তাকিয়ে বৌকে ঝাঁঝালো সুরে বলল, “কষ্ট করে আর চা বানাতে হবে না । ক্ষিদে পেয়েছে, সুতরাং একটু পরে রাতের খাবার খেতে দিলেই চলবে । যতোসব আদিখ্যেতা !”
পশুপতি হাত মুখ ধুতে যাবে এমন সময় তপা কাচুমাচু হয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো । মেয়েকে দেখে মুখ ভেঙ্‌চি দিয়ে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “সাঝ-সন্ধ্যাবেলায় তোমার আবার কী দরকার ?”
“বাবা, আমার স্কুলের মার্কশীটে তোমার স্বাক্ষর চাই”, তপা আমতা আমতা করে বাবাকে বলল ।
মার্কশিট নিয়ে ঐরকম হতচ্ছাড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? নিশ্চয়ই পরীক্ষায় ডাহা ফেল ! দেখি তো মার্কশীট, বলেই পশুপতি মেয়ের হাত থেকে টান দিয়ে মার্কশীট নিজের হাতে নিলো ।
এক ঝলক মার্কশীটের নম্বর দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো পশুপতি । তারপর রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে কষে মেয়ের গালে এক চড় । চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে তপা ঘরের মেঝেতে সটান্‌ পড়ে গেল । যন্ত্রণায় তপা কাঁদছে । তপার মা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলতে গেলে পশুপতি এক ধ্মকে বৌকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো । আর কট্মট করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “তোমার লায় পেয়ে মেয়েটা উচ্ছন্নে গেছে” ।
তপা কাঁদছে ।
পশুপতি মার্কশীট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলো ।
“বাবা, মার্কশীট আগামীকাল স্কুলে জমা দিতে হবে”, ভীত ও ত্রস্ত অবস্থায় তপা বাবাকে বলল ।
আগে নাচ বন্ধ করো তারপর স্বাক্ষর । নাচ বন্ধ না করলে আমি আর স্বাক্ষর করবো না । ধাই ধাই করে এখানে সেখানে নেচে বেড়ানো । যার জন্য ১০০ নম্বরের মধ্যে অঙ্কে ২৫ নম্বর । ইংরেজিতে ২২ নম্বর । আহারে ! নম্বরের কী ছিরি !
তারপর আবার মেয়ের উপরে রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে নাচের সরঞ্জাম দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসে মেয়েকে ধমকিয়ে বলল, “আবার কখনও নাচে তোকে দেখেছি, তাহলে তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারবো । তোর মা এসেও বাচাঁতে পারবে না । বলেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গজরাতে গজরাতে খাওয়ার ঘরে ঢুকলো ।“
( ২ )
পরের দিন রাজ্যস্তরে নাচের প্রতিযোগিতা । কলকাতার নজরুল মঞ্চে । স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতা ছুটলো নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে । এই ঘটনা একমাত্র তপার মা জানে । কেননা একমাত্র মা তপাকে নাচে ভীষণ উৎসাহ দেয় । সত্যি কথা বলতে, তপার পড়াশুনা ভাল লাগে না । পড়তে বসলেই পড়া থেকে উঠে নাচের অনুশীলন । নাচের অনুশীলনে তার পরিশ্রম নেই, বরং ভীষণ স্বচ্ছন্দ । কিন্তু তার বাবা উল্টো, পড়াশুনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না । অথচ তপার নাচই জীবন । নাচটা তার রক্তে । মনপ্রাণ দিয়ে নাচ শেখে । লুকিয়ে লুকিয়ে নাচের ক্লাস করে । নাচে ভীষণ দক্ষ । মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলকাতার নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিলো তপা । তার সঙ্গে রয়েছে সহপাঠী অনুপম । তপাকে নাচের ব্যাপারে সবরকম সহযোগিতা করে অনুপম ।
বিশাল বড় হল । রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম । প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন অথবা দুইজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে । টান টান উত্তেজনা । বিচারকের আসনে স্বনামধন্য পাঁচজন । সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হল বেলা ১১টায় । বিচারকেরা নাচের নিয়মাবলী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । বিচারকদের নির্দেশমতো প্রতিযোগীদের একটা মাত্র নৃত্য পরিবেশন । শুরু হল নৃত্যানুষ্ঠান ।
তপার পালা ঠিক বেলা দুটোর সময় । তাকে কত্থকের উপর নৃত্য পরিবেশনের জন্য বিচারকমণ্ডলী নির্দেশ দিলেন । তপার নৃত্যের তাল,ছন্দ ও লয় অতীব সুন্দর । তালে তালে এত সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করলো তপা, যার জন্য হলের সমস্ত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূতো । প্রচণ্ড হাততালি । বিচারকগণ পুনরায় তপাকে নির্দেশ দিলেন আধুনিক লোকগীতির সঙ্গে আরও একটি নৃত্য পরিবেশন করতে । তপাও তেমনি ! নৃত্যের তাল সম্পর্কে তপার প্রচণ্ড দখল । এটা তার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা । মন খুলে মনের আনন্দে নৃত্য পরিবেশন করলো তপা । নৃত্যে তার অফুরন্ত আনন্দ । অনুপম অবাক ! অনুপম লক্ষ করল, তপার নাচের পরিবেশনের সময় তার সাথে সাথে অর্ধেকের বেশি শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলেন । অনুপম আরও লক্ষ করল, মাননীয় বিচারকেরা একে অপরের প্রতি হাসিমুখে তাকালেন ।
তারপর দুজনে ছুটলো হাওড়া স্টেশন । ট্রেন ধরতে । পূর্বস্থলি স্টেশনে যখন পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ৭টা । অনুপমের সঙ্গে তপা বাড়ি ফিরছে । তপা ভাবছে এই সময়ে বাড়িতে বাবা নেই, সুতরাং বাবার বকা বা তাঁর হাতে মার খাওয়া থেকে মুক্তি । কিন্তু গাঁয়ের ভাওয়াল মাস্টার মশাই অনুপমের সঙ্গে তপার বাড়ি ফেরা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন । সরাসরি পশুপতির দোকানে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ ! শেষে কিনা আপনার মেয়ে একটা আদিবাসী ছেলের সাথে মিশছে ? ভর সন্ধেবেলায় আপনার মেয়ে কিনা নীচু জাতের আদিবাসী ছেলেটার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ! স্কুলের ড্রেস পরা । পিঠে স্কুলের বইয়ের ব্যাগ । নির্ঘাত স্কুল থেকে আলো-আধারি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ।“ কথাগুলি বলে ভাওয়াল মাস্টার অন্যত্র ছুটলেন ।
পশুপতি রাগে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য । দোকান খোলা রেখেই ছুটলো বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছেই চিৎকার, “তপা কোথায় ?”
স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে ।
তপা বাথরুম থেকে বের হতেই হাতের বেতের লাঠি দিয়ে তপার পিঠে বেদম মার ! তপার মা থামাতে গেলে তাকেও ঐ বেতের লাঠি দিয়ে চপেটাঘাত । মেয়েকে শাসিয়ে পশুপতি বলল, “নাচ বন্ধ । এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা । এর বাইরে কোথাও দেখতে পেলে তোর ঠ্যাং খোড়া করে দেবো । স্ত্রীর দিকে ক্রূদ্ধভাবে শাসিয়ে বলল, “মেয়েকে না সামলাতে পারলে আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দেবো ।“
তারপর হন্‌হন্‌ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো পশুপতি ।
মা ও মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে তপা কেদেই যাচ্ছে । কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না ! কলকাতায় ছোটাছুটিতে সারাদিনের ধকলের পর বাবার হাতের বেদম প্রহারে তপা যতো না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে বাবার হাতে মা নিগৃহীত হওয়ার জন্য !
( ৩ )
তারপর, নাচের প্রতিযোগিতার ফলাফল । সেটা ঘোষণা হবে কলকাতায় শনিবারদিন । বাড়ি থেকে কীভাবে বের হবে সেই চিন্তায় তপা অস্থির ।
মা মেয়েকে বলল, কাল অর্থাৎ শনিবার তুই ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবি । সঙ্গে অনুপম যাবে ।
“তুমি যাবে না মা ? তুমি আমার সঙ্গে চলো মা”, বায়না ধরলো তপা ।
যাওয়ার ইচ্ছা আমার ষোলোআনা, কিন্তু তোর বদরাগী বাবাকে নিয়ে ভয় ?
তপা মনকে শক্ত করে মাকে বলল, “আমার নাচে কোনো পুরস্কার পেলে আমি বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবো না । বাবার জন্য তোমার যেমনি অশান্তি তেমনি আমার ভীতি । দরকার হলে থানায় নালিশ জানাবো । বাবার অভব্যতার একটা বিহীত হওয়া দরকার, নতুবা বাবা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে” ।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা শান্তভাবে তপাকে বলল, “বাবাকে নিয়ে ওসব আজেবাজে কথা বলতে নেই মা । তোর নাচের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো পুরস্কার পেলে তোর বাবার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর মনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য । আমার কথাটা মিলিয়ে নিস ।“
পরের দিন মা ও মেয়ে দুইজনেই পশুপতি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরলো । কলকাতায় রাজ ভবনের প্রেস কর্ণার হলে ফলাফল ঘোষণা । মাননীয় রাজ্যপাল বিজেতাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন । পুরো অনুষ্ঠান টিভিতে লাইফ দেখানো হবে । তপা ও মা এবং অনুপম রাজভবনে গিয়ে আসন নিয়ে বসে পড়লো । অনুপমকে রাজভবনে ঢোকার গেটে সিকিউরিটি ধরেছিল । কিন্তু তপা অনুপমকে তার জেঠতুতো দাদা বানিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করল । যার ফলে অনুপম ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলো ।
এবার নাম ঘোষণার পালা ।
তপা ভীষণ টেনশনে আনচান । কোনো পুরস্কার না পেলে আজ তার বাবার কাছে রক্ষে নেই । বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে তাড়িয়ে দেবে । পুরস্কারের ব্যাপারে তপা যেটা বুঝেছে সেটা হচ্ছে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছাড়া আরও জেলা ভিত্তিক একটি করে পুরস্কার । জেলা ভিত্তিক দশ জনের পুরস্কার । পুরস্কারে নগদ ৫০,০০০/- টাকা এবং মানপত্র । প্রথম পুরস্কার ৫ লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৩ লাখ এবং তৃতীয় পুরস্কার ২ লাখ টাকা এবং সঙ্গে মানপত্র ।
নাম ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠে এলেন মাননীয় ঘোষকঃ-
হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ । রাজ্যের মন্ত্রী ও উচ্চ পদাধীকারি আধিকারিকগণ । নাম ঘোষণা করলেন —- প্রথম, পূর্বস্থলির তপতি বেরা ।
তারপর হাততালি । প্রচুর হাততালি । ঘোষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “তপতিকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি ।“
মঞ্চে তপতির ওঠবার পর ঘোষক তাঁর হাতের মাইকটি তপতির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলো ।“
এদিকে ভাওয়াল মাস্টার পশুপতিকে আবার খবর দিয়ে বলল, “টিভিতে তোমার মেয়েকে দেখাচ্ছে । এখন টিভি খুললেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে ।“
সঙ্গে সঙ্গে পাশের দোকানে টিভির সম্মুখে এসে পশুপতি অবাক ! তাঁর মেয়ে প্রেস, মিডিয়া্‌ ও অনেক শ্রোতামণ্ডলির সামনে নির্দ্বিধায় বলছে, “নৃত্য শিক্ষায় আমার অনুপ্রেরণা আমার মা । মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতে আমার নৃত্য শিক্ষার বাস্তবায়ন ।“
পশুপতির চোখ ছলছল । সে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলো, ফিরে এলে মেয়েকে আর বকবে না । মেয়ে যেটা চায় সেটাই করবে । মেয়ের ক্যারিয়ারে কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । সে এখন পরিষ্কার বুঝেছে, “যার যেদিকে ঝোঁক তাকে সেদিকেই এগিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় ।“ রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো পশুপতি ।
( ৪ )
তারপর স্কুল, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সকলে তপার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । নাচের প্রতিযোগিতায় তপা রাজ্যে প্রথম হওয়ায় সকলেই গর্বিত ।
পশুপতি কাচুমাচু হয়ে মেয়ের কাছে নত হয়ে ছলছল চোখে বলল, “মা আমাকে ক্ষমা করিস্‌ ।“
তপা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ।
———০———

Share This
Categories
গল্প নারী কথা

অন্য দুর্গা : ডঃ অশোকা রায়।

হালকা চপল ছন্দে শরত এসেছে গ্রীষ্মের প্রখরতার আতংক আর বর্ষার বিষণ্ন বিধুরতা মুছে দিয়ে. প্রসন্ন হাসি গাছের পাতার সবুজ রিবনে, মেঘ- রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলায়, কাশবনের হিন্দোলে. প্রকৃতি জুড়ে মা দুর্গার আগমনী গান… “য়া চন্ডী মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী… ” শরতের পূর্নতায় আপামর মানুষ মেতে ওঠে ঢাকের তালে উৎসবের বন্যায়. কিন্তু পুজোর আনন্দ – আয়োজন কি সবার জন্য? না, ব্যতিক্রম আছে বই কি. নানা রকম কারণে সেই ব্যতিক্রম. আমার আজকের লেখা সেই রকম একটা ব্যতিক্রম নিয়ে.
এ এক অন্য দুর্গার কথা।
কলকাতার খুব কাছেই উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজেন্দ্রপুর. এই রাজেন্দ্রপুরেরই একটা গ্রামের নাম সুন্দর গ্রাম. বিদ্যেধরী নদীর তীরে অবস্থিত এই সবুজ ঘেরা গ্রাম সার্থক নামা. এই গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার বলতে দাসপরিবার. অর্থের প্রতুলতা তো রয়েছেই, বংশ লতিকার গরিমাও কম নয়. স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে দাসপরিবারের প্রতিপত্তি বেশি. অবশ্য আজকের সুন্দর গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন নির্বাহের মান মোটামুটি ভালো. কলকাতা বা অন্যত্র কর্মের সুবাদে শুধু মাত্র ক্ষেত- খামার আর হাল-বলদের ওপর তাদের ভরণপোষণ নির্ভর করে না. শিক্ষার ছোঁয়ায় তাদের জীবনের মানে বদলে গেছে. তারা শিখেছে স্বচ্ছলভাবে স্বচ্ছন্দে বাঁচার উপায়. তাই আজ সুন্দর গ্রামের প্রকৃতি না পাল্টালেও, মানুষজনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে. বিদ্যেধরীর জলে ভেসে এসেছে শহরের ছোঁয়াচ. তাই সুন্দর গ্রামে আজকাল দু-চারটে বারোয়ারি পুজো হয়, আলোর কম্পিটিশনও চলে,.. তবুও দাসবাড়ির পুজোর আকর্ষণ অম্লান. স্হানীয় লোকজনের ধারণা, ষষ্ঠীর বোধনের সাথে সাথে মা দুর্গার জীবন্ত অধিষ্টান হয় দাসবাড়ির পুজোর দালানে. সামনের মাঠে সামিয়ানার তলায় তাই নানা বয়েসের পুরুষ – নারীর ভিড়. সারাদিন ধরে চলে পুজোর কাজকর্ম, আড্ডা গুলতানি আর রান্নার তদারকি. সারা গ্রামের মানুষের পাত পড়ে চারদিন এই দাসবাড়ির অন্দরের গোলঘরে.
আজ অষ্টমী. পুষ্পান্জলি শুরু হয় নি এখনো. যে যার নিজের রুচিতে সাজগোজ করে পুজোমন্ডপে জমিয়ে বসেছে. মেয়ে- বৌরা পুরোহিত কে পুজোর কাজে হাত লাগিয়েছে. বয়স্ক মহিলারা উপদেশ – নির্দেশ দিতে ব্যস্ত. বয়স্ক পুরুষদের ব্যস্ততা একাল- সেকাল নিয়ে আলাপ আলোচনায়. আর কম বয়সী পুরুষরা কেউ বাইরের কাজে, কেউ ভেতরের কাজের হিসাবে দৌড়াদৌড়ি করছে.
দাসবাড়ির দেউড়ির নহবতে বাজছে সানাই…. রাত পুইয়েছে এক শারদ প্রাতে. মন্ডপ আলো করে মা হাসছেন. মায়ের অঙ্গাভরণে আলোর রোশনাই. রোশনাই অল্পবয়সী মেয়েদের চোখে- মুখে. আজ বিকেলে কে কি পরবে…. তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা. কেউ বালুচরী, কেউ সিল্ক কেউ আবার চান্দেরী. সব কটা কলকাতার বিখ্যাত দোকানের. একজন বলে, “তোরা বাবা পোশাকের প্ল্যান কর, আমি বাবার সাথে যাব সন্ধ্যা- রাতে কলকাতা. মেট্রো চেপে ঠাকুর দেখব সারা রাত.
বাবা বলছে আমিনিয়ায় বিরিয়ানি খাওয়াবে.” অন্য একটি মেয়ে বলে, “কলকাতায় তো বেজায় ভিড় হবে, সামাল দিতে পারবি তো নিজেকে? ” গরবিনী বলে ঔদ্ধত্য নিয়ে , ” কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে?”
অন্যরা উত্তপ্ত আবহাওয়ায় জল ঢালে…..” কাল সকালে প্যান্ডেলে আসবি তো? ” এই একটা আন্তরিক প্রশ্নে ওঁ শান্তি. কে আর অপ্রীতিকর পরিবেশ চায় পুজোর দিনে?কিন্তু অশান্তি তো একটা ঘটলই পুজোর দিনে, তাও আবার পুজোর অষ্টমীর সকালে. আচ্ছা বয়েস, অর্থ আর পারিবারিক দম্ভ মানুষ কে কতটা নিষ্ঠুর করতে পারে?
দাসবাড়ির সামিয়ানার তলায় এককোণে এক মেয়ে, পরণে আধো ময়লা শাড়ি,হাতার কাছে বেশ খানিকটা ছেঁড়া ব্লাউজ, উস্কোখুস্কো চুলে একমনে কোঁচড়ে রাখা শিউলি ফুল তুলে মালা গেঁথে চলেছে. বয়েস? আন্দাজ ষোল – সতেরো তো হবেই. কালই তো ওর মা সদু ওর বাবা বাদল কে বলছিল রাতে, ” মেয়েডারে এট্টা শাড়ি কিনে দ্যাও না. সনাতন ব্যাপারী কাল আসবে মঞ্জু মার শাড়ি খান দিতে. দুগ্গার একখানও আস্ত শাড়ি নেই.” বাদল বলে, সাধ কি হয় না দুগ্গোর মা? কিন্তু শোলার কাজ করে মাকে ডাকের সাজ পরানো যায়, মেয়েডারে সাজানো যায় না. ” কিন্তু অতবড়ো মেয়ে, ওরকম ভাবে ঘুরে ফিরে. শেয়াল – কুকুরের তো অভাব নাই কুনখানে”
বাদল কোন জবাব দেয় না. অক্ষম বাপের জবাব দেবার কি আর থাকতে পারে? দুর্গা ঘুমোয় নি. বাপের কথা শুনে কষ্ট পায় না. মা দুর্গার ওপর তার দারুণ ভরসা. সে বিশ্বাস করে মা দুর্গার কৃপায় একদিন তাদের অবস্থা সে ফেরাবে. বাবা – মা কে সুখে রাখবে. কিন্তু কি ভাবে? তার হদিস মা দুর্গা এখনও দেয় নি. দুগ্গা গ্রামের অবৈতনিক বিদ্যালয় যায় আসে. আর স্বপ্ন দেখে মা দুর্গা তাকে অনেক লেখা পড়া শিখিয়ে বড়ো চাকরি পাইয়ে দেবে. তাদের সুদিন আসবে.
দুগ্গার মালা গাঁথা শেষ. পুরুতমশাইরে ডাক দেয়, “ও দাদু শিউলির মালাটারে মা দুগ্গার গলায় দ্যাও না দুলিয়ে গো. বড়ো যতনে গেঁথেছি. পুরুত কিছু বলার আগেই দাসগিন্নি নথ নাড়িয়ে বলে,” কি আপদ! দূর হ এখান থেকে. নোংরা বাসী কাপড়. এখনি ছোঁয়া – নেপা হয়ে যাবে. ঐ মালাটাকে দোলাব মায়ের গলায়. মা অপবিত্র হয়ে যাবে না? ” ” না গো ঠাকুমা নেয়ে- ধুয়ে ফুল কুড়িয়েছি. আমাদের উঠোনে শিউলি গাছ ভরে ফুল ফুটেছে. অনেক ফুল পড়েছিল গাছের তলায়. পরিষ্কার করে নিকোয় মা রোজ. “” তুই মিথ্যে কথা বলছিস. নেয়েছিস তো তোর চুল উস্কোখুস্কো কেন? ” দুগ্গা নীচু স্বরে বলে,” ঘরে নারকেল তেল বাড়ন্ত. চিরুনী গেছে ভেঙে. বাবা আনলি তবে চুল আঁচড়াবো মা- বেটি মিলে. ” পুরুত দাসগিন্নির দিকে তাকায় সন্মতির আশায় , ” মা দেব পরিয়ে মালাটা? ” দাসগিন্নির গম্ভীর নির্দেশ আসে,” পুরুত মশাই আপনি নিজের কাজ করুন.” তারপর হাঁক দেন, ” এই কে আছিস কাছে – পিঠে….. দুগ্গারে বার করে দে. ” দুগ্গা বলে,” আমারে কারোরি বার করতি হবে না গো ঠাকুমা. দুগ্গা এমনি চলে যাচ্ছে. তবে মা দুগ্গারে বলি যাচ্ছে সে, আমার হাত থিকি মালা তোমারে একদিন নিতি হবে, যদি তুমি হও আমারো মা. “
দুগ্গা ছুটে দাসবাড়ির চৌহদ্দি পার হয়েছে. পুজোর দালানের বাইরের চত্বরের এককোণে পড়ে আছে ওর গাঁথা শিউলির মালা. শরতের আকাশের হালকা ভাঙা মেঘ জমাট বাঁধে.অসময়ের বৃষ্টির ঝরঝর শব্দে দুগ্গার গাঁথা শিউলির মালার কান্না মিশে যায়. শরতের শুভ্রতা ম্লান হয় মানুষের মনের কালিমায়.
এ গল্পটা এখানেই শেষ হলে হতে পারতো, কিন্তু তা তো হলো না. কারণ জীবন প্রবাহ সব সময় নিয়ম মেনে চলে না. আর মা দুর্গার ইচ্ছেও নয় সেটা. মা দুর্গা চাননি সবকিছু নিয়ম মেনে স্বাভাবিক ভাবে হোক. পাঁচ বছর আগে দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন দাসবাড়িতে অপমানিত হওয়ার পর আর দুগ্গাকে দেখা যায় নি, তার মা- বাবা কেও নয়. গরীবের থাকা না থাকাতে গ্রামের বাসিন্দাদের সে ভাবে মাথা ব্যাথা হয় নি. তবুও সন্দেহ আর জল্পনা- কল্পনা শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু দানা বাঁধার আগেই থেমে গেছে. এই গতির যুগে মানুষ ছুটছে নিজের ধান্দায়. গ্রামের মানুষজনও এর বাইরে নয়. অতশত দুগ্গার ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়, যাদের দুগ্রাস ভাতের সংস্হান নেই ? প্রায়ই তো ওদের তেল নুন চাল ধার দিতে হত ফেরত পাওয়ার আশা না করে. দাসগিন্নীর ভাষায় ‘আপদ বালাই গেছে, ভালো হয়েছে.’
বছর পাঁচ বাদে আজ আবার হিমের পরশ বুলিয়ে শরত এসেছে. নিয়ম মতো মা দুর্গাও এসেছেন. দাসবাড়িতে ঢাকের কাঠি পড়েছে. শুরু হয়েছে প্রতি বছরের মতো দুর্গা পুজোর আয়োজন. সেদিনের মতো আজো অষ্টমী. সমস্ত পরিবেশ এক. কিছু লোকজনের মুখের পরিবর্তন হয়েছে. গ্রামের কোন কোন মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে, অন্য কোন মেয়ে বিয়ে হয়ে ঘর- বসত করতে এসেছে এই গ্রামে. অবশ্য পুরুত একই রয়েছে, একই রয়েছে দাসগিন্নী. তবে বয়েসের ভার কিছু ছাপ ফেলেছে তাদের চেহারায়, তাদের চলন- বলনে. নয়তো এই সব ছোটো খাটো পরিবর্তন ছাড়া দাসবাড়িতে পুজোর চিত্রপট একই. মা দুর্গাও একই ভাবে বিরাজমানা. পুরোহিত পুষ্পান্জলির মন্ত্র পড়ছেন নিষ্টাভরে..
“আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে.ধনং দেহি পুত্রান দেহি, সর্ব্ব কামাংশ্চ দেহি মে” জমায়েতের মধ্যে শুদ্ধভাবে পুনরুচ্চারণের প্রচেষ্টা. ভক্তির নেই খামতি.
পুষ্পান্জলির পর্ব শেষ. সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এক সালংকারা নারী
অলক্তরঞ্জিত খালি চরণে সে এগিয়ে আসছে গজেন্দ্রগামিনী ছন্দে. পিছনে চারদাসীর হাতে পুজোর সম্ভার. দাসবাড়ির দুর্গা প্রতিমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেই সুন্দর রমনী. সমবেত সকলের চোখে সমীহের সাথে কৌতূহল… কে এই নারী? নিশ্চয়ই কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ… নারী মহলে ফিসফিস. একবার ফিরে তাকায় সালংকারা সুন্দরী. চিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে. মুহূর্তে মেলায়. দাসীর হাত থেকে লাল ভেলভেটের বাক্স নেয় একটা. ক্লিপ খোলে . সোনার শিউলির লম্বা মালা. এগিয়ে দেয়, পুরুতের দিকে ” দাদু পরিয়ে দাও এ মালা মা দুর্গার গলায়.” পুরুত শিউরেছে, এ যে বেশ কয়েক বছর আগে এক মেয়ের আকুতি! তবে কি… মুখটা তো চেনা – চেনা, তবে অনেক পরিবর্তন. পুরুত আজও চেয়েছে, দাসগিন্নীর পানে.. ” পরাবো মা?” দাসগিন্নী বিগলিত, ” নিশ্চয়ই পরাবেন ঠাকুর মশাই. মায়ের জন্য আনা জিনিস ফেরাই কি করে? ” নারী তখন করজোড়ে চোখ বন্ধ করে মা দুর্গাকে মনে মনে বলে, ” পাঁচ বছর আগে তুমি আমার গাঁথা শিউলির মালা পরো নি, যে মালায় যৌবন ছুঁই ছুঁই এক পবিত্র মেয়ের অকৃত্রিম ভক্তি ছিল. আর আজ এই দুর্গা বারবধু. তার দেয়া সোনার শিউলির মালা তুমি কি মনে কর অপবিত্র, অশুচি? তাহলে আজো এ মালা পরো না তুমি. চোখ খুলে নারী দেখে পুরুতদাদুর পরানো মালা গলায় মা যেন হাসছেন আর বলছেন,” দুগ্গা আজ তোর দিন. তুই এদের জানিয়ে দে, আমার পুজোয় পবিত্র – অপবিত্র বলে কিছু হয় না. আমার পুজোয় সকলের সাদর অংশ গ্রহণ আমার কামনা. এই দিনের অপেক্ষায় আমি ছিলাম.
দাসগিন্নী জিজ্ঞেস করেছেন, ” তুমি কে মা?” সেদিনের দুগ্গা সদম্ভে জানিয়েছে, ” আমি বাদল শোলাকারের মেয়ে দুগ্গা.” তবে সে আমার পূর্বাশ্রমের পরিচয়. আজ আমি বিজুরী- বাঈ. বনেদী বাঈজী. মুজরো করি নিজের বাড়িতে. ডাক পেলে লক্ষ্নৌ পাটনাও যাই. ঠিকানা কলকাতার বৌ বাজারের সোনা পট্টি . এই জিনিস গুলো দিয়ে গেলাম. পুজোর কাজে লাগিও. বেশ্যা বাড়ির মাটি তো মায়ের কাঠামো তৈরির কাজে লাগে.
আর জেনো মানুষ মানুষই হয়. পবিত্রতা – অপবিত্রতা দেহে নয়, মনে জন্মায়. দৃপ্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে যায় দুগ্গা সকলের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে. এ এক অন্য দূর্গা.

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

দুর্গার দুর্গতি : ডঃ অশোকা রায়।

করোনার ক্যারিশমা সত্যি সত্যি দেখার মতো। দেবী দুর্গারও বুক বাপের বাড়িতে এসে দুরুদুরু।অথচ বাপের বাড়ির লোভ জয় করা দুরুহ। মা দুর্গা ও বোধহয় অতটা জিতেন্দ্রিয় নন। বছরান্তে একবারো বাপের বাড়ি পা দেবেন না,তা কি করে হয়? কথায় বলে মেয়েদের কাছে বাপের বাড়ির মাটিটুকু বড়ো মিষ্টি। স্বামী বুঝিয়েছেন,’ এই আশ্বিনে যেওনা বাপের বাড়ি। গতবার গিয়ে তো দেখেছ, খাতির যত্ন পাওনি। আর পাবে কোথা থেকে বলো তো দুর্গা রানী? করোনা নামে
অতি মহামারী পৃথিবী কে ছারখার করে দিয়েছে। তারপর তোমার বাপের বাড়ি,তা সে পূব বা পশ্চিম বাংলা- যাইহোক না কেনো,কেউ তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদের মতো ধনী নয়।ফলে করোনার করুণায় তোমার বাপের বাড়ির বাসিন্দাদের হাঁড়ির হাল। নন্দী তো সেদিন ঘুরে এসে বললো, তাবড় তাবড় ভালো চাকরি করা লোকেরা বাড়িতে বসে মাছি তাড়াচ্ছে আর টিপে টিপে সামান্য সঞ্চয় থেকে খরচা করছে,প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া টিউব থেকে পেস্ট বার করার মতো।না শেভ করা দাড়ি নিয়ে অনেক পুরুষ এখন ঘরের মধ্যে বিষাদের ঘরে নিজেদের বন্দী করেছে। বেল্ড বা ক্ষুর- শেভিং ক্রিমের পয়সা যতটা বাঁচে। যাদের অফিস বা রোজগার নামক বস্তু টি কোনক্রমে টিঁকে আছে, তাদেরও সদাই ভয়, এই বুঝি রিটেনশনের নোটিশ দ্বিধা থরো থরো হাতে কেউ গুঁজে দিল। মালিক পক্ষের মানবিকতা আছে, কিন্তু কি করবে তারা? করোনার কাছে নতজানু হয়েও বিশেষ সুরাহা হয়নি।নিজেদেরই পেট ভরে না, শংকরকে ডাকবে কি করে? সুতরাং অন্ততঃ ফিফটি পারসেন্ট ছাঁটাই তো বটে, ইফ নট মোর,নয়তো পুরোপুরি তালা বন্ধ। বাড়ির গিন্নীদের কাছে বিউটি পার্লার যাওয়া পূর্ব জন্মের স্মৃতির মতো। বরং দু ফোঁটা তেলে জলের ছিটে দিয়ে রাঁধতে নাজেহাল। লোকাল ট্রেন তো বিধিবদ্ধ ভাবে চলল না। স্টাফ স্পেশ্যাল নাম কা ওয়াস্তে। আপামর পাবলিকের ভিড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা ব্যবস্থা। মুখে মাস্ক কি এহেন ব্যবস্হার মুশকিল আসান হতে পারে? তার ওপর উপনির্বাচনে প্রচারের ঠ্যালা।যেও না গিন্নী, অসুবিধায় পড়বে। গিন্নী নাছোড়, ” বছরে তো একবার বাপের বাড়ি যেতে দাও। বাদবাকি সময় তো তুমি,তোমার ছেলেমেয়ে আর তোমার হাঁড়িহেঁশেল নিয়ে পড়ে থাকি। আমার কি আমোদের সুযোগ টুকুও থাকবে না? এক নম্বর মেল-শভিনিস্ট কোথাকার।”কি যে হবে মা দুর্গার কে জানে! আর জানার ইচ্ছে আছে নাকি ভদ্র মহিলার? সেই আসতেই হবে ঝড়- জল উপেক্ষা করে কোভিড এর যুগে। এতোটাই অবুঝ যে বুঝতে পারে না, দুর্গা এসেছে বলে হাজার হাজার না হোক, অন্ততঃ শখানেক লোক ছুটে আসবে আদিখ্যেতা করতে। কোভিডের সংক্রমণ হার বাড়বে। সামাল দিতে সরকারের প্রাণান্তকর অবস্হা। পুলিশ ব্যতিব্যস্ত। আর কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এলে আবার প্রাণ নিয়ে টানাটানি।ডাক্তার দের নাওয়া- খাওয়া মাথায়। কোভিডের গুঁতো তো মা দুর্গা কে সইতে হয় না। তাঁর মাথাব্যথা হবে কেন? চীন যতদূর মনে হয় তাঁর এক্তিয়ারভুক্ত নয়। শুনেছি তো চীনে ওয়াংশাং বলে এক দেবতা আছে, সে না কি সাহিত্যের দেবতা; আর ফুসি স্বর্গলোকের দেবতা, নুইও মর্ত্য লোকের দেবতা।
আর ওয়েল বিয়িং এর দেবী সকলের মঙ্গলের দিকটা দেখে। আর ইয়াং লং ড্রাগন বৃষ্টির দেবতা। তবে সব সেরা দেবতা হচ্ছে Tian. তা দুর্গার সাথে এদের কোন প্যাক্ট হয়েছে কি না জানা নেই।তবে দুর্গা আসছে কোন সাহসে? বলি মরণের ভয় ডর কি নেই?তার ওপর বায়না, দুর্গা আর তার পরিবার মাস্ক পড়ে কিছুতেই আসবেন না।সৌন্দর্য নষ্ট হবে যে! কোভিড বিধিতে পড়ে গেলে ফাইন হবে , সে চিন্তাও নেই! মর্ত্যে আসবে, অথচ মর্ত্যের আইন মানব না… এ তো বেশ গা জোয়ারী ব্যবস্থা। অথচ দুর্গার মুখে যত বোলচালই হোক না কেনো, করোনার ভয়ে তিনিও কিন্তু কাঁটা।পুজো উদ্যোক্তারা কেউ কেউ দুর্গা আর তার পরিবারের মুখে মাস্ক পরিয়ে দিলে,
” মা দুর্গা রাতের স্বপ্নে উদ্যোক্তাদের ওপরে প্রথম হম্বিতম্বি করেন,” এক্ষুনি হাটা তোদের এই মুখোশ, আমার আর ছেলেমেয়েদের প্রাণ যায় যায়। অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছে। এখানকার ডাক্তার গুলো ভীতুর ডিম এক একটা। পিপিই কিট পড়ে জবরজং সাজা ডাক্তার সব। নিজের সেফটি দেখতে ব্যস্ত। অথচ পকেটে টাকা বোঝাই করা চাই। তাই কত বুদ্ধি। হাসপাতালের ডিউটি শেষ হলো তো, শুরু হলো প্রাইভেট কনসালটেন্সি।ভিডিও কলিং এ দেদার রোজগার।বুদ্ধুরাম ডাক্তার দের পড়াশোনার বহর তো জানা আছে! আর অভিজ্ঞতা? না বলতেই হবে এবার, ধনবান হলে একরকম কসরত। আর ধনবান না হলে ভিডিও কলে বা ফোনে যা হোক নিদান দিয়ে ছেড়ে দাও।অন লাইনে পেমেন্ট এলেই হলো। টিকি পাকড়াও করে কোন পাকড়াশী? তার তো এখনও জন্মই হয়নি। চীনের উহান দোষী নিশ্চয়ই। এর একটা বিহিত করতে হবে বলে তোদের বাবা ঐ কল্কে সেবী শিব সকল দেবতা দের নিয়ে মিটিং ডাকছে। শুধু ডেট ফিক্সিং বাকি। আমি এখান থেকে ডেটা নিয়ে যাই… তখনই ডেটটা জানিয়ে দেব তোদের। কত রূপে কত অসুর আর দৈত্যদের বধ করলাম! আর তোদের বিরক্ত করে মারছে যে করোনাসুর, তাকে মারা তো আমার বাঁ হাতের খেলা রে। তবে একটা ভ্যাকসিন আর সিরিঞ্জ আমার চাই। খোঁজে আছি। পেলেই করোনাসুর কে এমন ফুটিয়ে দেব বুকে সিরিঞ্জ, জিভ বার করে অক্কা পাবে। বিভিন্ন দেশের সাথেও যোগাযোগ রাখছি, যদি কেউ মোটা সিরিঞ্জ আর ওষুধ দেয়। তাহলে মর্ত্যের খেলা মর্ত্যেই মিটিয়ে যাব। আমি এর মধ্যে না পারলে লক্ষী আর সরস্বতী তো পরপর আসবে। ওদের হাতেই না হয় করোনাসুর বধ হবে। মায়ের কাজ মেয়ে করবে, তাতে লজ্জা কি? শুধু ভয় পাচ্ছি এখন এখানে লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকের যদি কিছু হয়, কি হবে? একটা ডাক্তারও ফিজিক্যালি
চেক- আপ করবে না।ভিডিও কলিং এ কি রোগী দেখা যায় রে? নাড়ি টিপব না, জিভ দেখব না নিজের চোখে? সব কি ক্যামেরার এক্সপোজার দিলেই হয়ে যায়?ওদের বাপ আমায় মোবাইলেই তুলোধুনো করবে, ফেরারও তর সইবে না। বলবে, “পরপর দুই বছর শূন্য মন্ডপে বসে ধান ভানার কি দরকার? সরাসরি শিবের গাজন তো কৈলাশে বসেই গাওয়া যায়। আমি নিজের গাজন ভালো করে শুনতে পাই, তা’ও আবার তোমার মুখে। মনে পুলক হয়। মর্ত্যে তুমি যা কর, তা ঠিক মতো দেখতে পাই না, শুনতেও পাই না। একেবারে বেপরোয়া হয়ে বাপের বাড়ির আদর খাও। চোখ আর কান দুটো অর্গানই আজকাল বড়ো জ্বালাচ্ছে।” দুর্গা বলেন, এবার থেকে তোরা আমাকে আনার সময় ঘোড়া- মুখো অশ্বিনী কুমার দুজনকে আনার ব্যবস্থা করবি। অশ্বিনীকুমাররা যমজ দুই ভাই। কপালদোষে ঘোড়া মুখো। সূর্য আর তার বৌ সংজ্ঞার কি যে শখ জাগল, ঘোড়া রূপে মিলিত হল। জন্ম হলো ঘোড়া মুখো অশ্বিনীকুমার দের।মা হয়ে তোদের সাথে এসব আলোচনা করা উচিত নয়,বুঝি। তবুও দুশ্চিন্তায় কি মাথার ঠিক থাকে?ওদের কথা তোদের জেনে রাখা ভালো। পরের বার এ্যাপ্রোচ করতে সুবিধা হবে। তোরা তো দেখছি সকলেই ষোল ঊর্ধ্বে।সুতরাং আমার পাপ হবে না অশ্বিনী কুমার দের জন্ম রহস্য খোলসা করে তোদের বলার জন্য । ষোলো পেরোলেই ছেলে -মেয়ে মায়ের বন্ধু।জানিস,অশ্বিনীরা তো আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস। সরোর শরীরটা চিরকাল তেমন শক্তপোক্ত নয়। লক্ষীর ইদানীং দেখছি এনার্জি লেভেল কম। এনসিওর খাওয়াচ্ছি দুবেলা, কিছুতেই কিছু হবার নয়। কেমন করে কেৎরে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ না। কেতোর আবার সামনের মাসে আর্চারি কম্পিটিশন আছে। এখানে আবার আসবে তো সেই কার্তিক মাসেই, তাই ডেট এ্যাডজাস্ট করার জন্য আমাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছে। এ্যাপ্রুড হয়ে যাবে মনে হয়। কর্তৃপক্ষ তো জানে পঞ্জিকার ডেটের নট নড়ন- চড়ন।গনশার দেহটাই ওমনি ঢ্যাপসা। বলতে গেলে ও বিকলাঙ্গ মানুষ। মানুষের দেহে হাতির মাথা। তার ওপর পেটটাও অস্বাভাবিক বড়ো ।হাঁসফাঁস করছে।এখানে এতো বৃষ্টি হচ্ছে,অথচ গুমশুনি ভাব গেল না।দু- দুটো মাস্ক স্পেশাল অর্ডার দিয়ে করিয়েছিস , গনশার তো সর্দি হয়ে গেছে। বারবার ন্যাপকিন চাইছে।করোনা হলে সামলাবে কি করে?আসার জন্য এখন আমার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সোয়ামীর কথা না শুনলে এমনই হয়। তা যাক গে এসব কথা। করোনা হলে দেখা যাবে। তোরা মানুষরা কত কষ্ট পাচ্ছিস, আমার তো এখানে থাকার মেয়াদ কুল্লে পাঁচদিন। তোদের ভোলে বাবা ঠিক পার করিয়ে দেবে। জয় ভোলানাথ।

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

সিঙ্গল মাদার : ডঃ অশোকা রায়।

বহুদিন বাদে তোমাকে দেখলাম. ট্যাংগুলার পার্কের মোড়ে আদি ঢাকেশ্বরীতে. মায়ের জন্যে একটা কালো পাড় গরদের শাড়ি কিনতে এসেছিলাম একবারে শেষ মুহূর্তে. আজ দুর্গা পুজোর ষষ্ঠী.
মায়ের শাড়িটা শেষ মুহূর্তে কেনার কারণ মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবহেলা নয়. মা ছিল বেলভিউতে. বেলুন সার্জারি হয়েছে হার্টের. ভালো আছে এখন. কিন্তু নিজের মা হাসপাতালে, তাই পুজোশপিং অন্যান্য দের জন্য করলেও আমার মা নার্সিংহোম থেকে ছাড়া না পাওয়া অবধি মা আর নিজের জন্যে কোন কিছু কিনবো না বলে রেজ‌োলিউশন নিয়েছিলাম. মা কে কাল বাড়ি নিয়ে এসেছি. মায়ের একমাত্র সন্তান ‌আমি. সুতরাং এসব ঝামেলা আমাকেই পোয়াতে হয়. বাবা আর শ্বশুর মারা গেছেন আমার বিয়ের আগে. ‌আর আমার স্বামী তার উজ্জ্বল
কেরিয়ার গড়তে পাড়ি দিয়েছে সাগর পাড়ে. শ্বাশুড়ির দায়িত্ব আমার ঘাড়ে নিয়েছি স্বেচ্ছায় সানন্দে. অবশ্য মায়ের মতো আমার শ্বাশুড়িকে নিয়ে ছুটতে হয় না যখন তখন ডাক্তারের চেম্বারে.তবে সপ্তাহে একদিন যেতে হয় শ্বাশুড়ির সংগে সিনেমা হলে. স্মার্ট শ্বাশুড়ি আমার. কি হিন্দি, কি বাংলা কি ইংরেজী সব সিনেমা কোথায় চলছে, টাইম কি, সব মুখস্থ. আমার দায়িত্ব অন লাইনে টিকিট বুকিং আর ওঁনাকে সংগ দেয়া, সে আমার ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক. হাজার অন্য কাজ থাকুক. ‌অদ্রিজাকে বলিনি, আমার শ্বাশুড়ির মেজাজের সংগে আমার অল্পবিস্তর পরিচয় আছে. অদ্রিজা আমার শ্বাশুড়ির ছাত্রী. আমার সংগে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে. ‌আমার শ্বাশুড়ি অমনোমত হলে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন না আমাকে. অথচ আমি যে তাঁর মেয়ে হয়ে এসেছি এই বাড়িতে.. এই প্রতিশ্রুতির খেলাপ তাঁর কোনও দিন হয়নি. আমি তাঁর মেয়ের মতো নই.. সত্যিই মেয়ে. মা- মেয়ের মধ্যে রাগারাগি তো স্বাভাবিক জিনিস সম্পর্কের সুস্বাস্হ্যের লক্ষ‌ণ. আমার শ্বাশুড়ি বলেছিলেন, বেয়ান বাড়ি ফিরলে তোমাদের সাথেই আমার শাড়ি কিনো. তবে শ্বাশুড়ির বিনীত আবদার তার ছাত্রী অদ্রিজার বুটিকের পার্টিকুলার ডিজাইনের ঢাকাই শাড়ি. আজ সকালে অদ্রিজাকে ফোন করেছিলাম, শাড়িটা রেডি
আছে কিনা. অদ্রিজা বলেছে, বাপস্ রে বাপ্ ম্যাডামের অর্ডার সবার আগে তৈরি করে রেখেছি. নাহলে কি ‌আর রক্ষে আছে. জানো বৌদি ম্যাডাম সম্পর্কে আমাদের আগের সেই সম্ভ্রম আর ভালোবাসার মিলিজুলি ‌আবেগ আজো বজায় আছে. আমাদের ব্যাচের গেট-টুগেদারে ঘুরে ফিরে ম্যাডামের প্রসঙ্গ উঠবেই উঠবে.
টেলিফোনের মধ্যে হেসে উঠি আমি, “মা তো খুব ভালো মানুষ.মাইডিয়ার বলে যাকে, তবে ভয় পেতে কেন? অদ্রিজাও হাসে,” শুধু ভয় তো বলিনি. ভালোবাসার কথাও বলেছি. ক্লাসে ডায়াসে ভয়াবহ.
পড়া না করে ক্লাসে ঢোকা, পড়াবার সময় অন্যমনস্ক হলে কঠিন কঠোর. অথচ ক্লাসের বাইরে এক সংবেদনশীল বন্ধু. এমন মানুষ কে না ভালোবেসে পারা যায়?” কি আর বলি, শুধু বললাম “মায়ের শাড়িটা রেডি করে রেখো. সন্ধ্যের দিকে একসময় কালেক্ট করে নেবো.
ঢাকেশ্বরীতে ঢোকার আগে শ্বাশুড়ি – মায়ের শাড়িটা অদ্রিজার বুটিকের থেকে কালেক্ট করেছি. তারপর ঢাকেশ্বরীতে ঢুকেছি. মা আর আমার দুটো পছন্দ সই শাড়ি কিনেছি. মায়েরটা অবশ্যই কালো পাড় গরদ. মা বৈধব্যের সব নিয়মকানুন মানেন. আঁশ খান না. একাদশী করেন. কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি – মা সেসবের ধারপাশ দিয়ে যান না. নাঃ আমার রাগ হয় না. আজকের জগতের নিয়মই তো হচ্ছে আপ রুচি খানা. আপ রুচি পড়না. তাই আমি আমার মা বা শ্বাশুড়ি- মায়ের এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যাই না. ওদের ওদের মতো থাকতে দিই. তবে দুই বেয়ানের খুব ভাব. প্রতিদিন দেখা না হলেও রোজ টেলিফোনে কথা হয়. আর কি আশ্চর্য দুজনেই ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করতে ভালোবাসে.
যাক গে এখন আমি সেদিনের ঘটনায় আসি. ‌এক্কেবারে প্রথমে এমন একজনের কথা বলেছি, যার সংগে আজ অনেকদিন বাদে আমার দেখা. সে সুজন, আমার প্রাক বিবাহিত জীবনে আমার হার্ট -থ্রব. বিয়ে নিশ্চয়ই করেছে.
শাড়ির বিলের পেমেন্ট করেছে আমি লক্ষ্য করেছি. তখন সংকোচে কথা বলতে পারি নি. কাঁচের দরজা ঠেলে যখনই বেরোচ্ছি, তখনই দুজনের চোখাচুখি. সুজন স্বাভাবিক. জিজ্ঞেস করেছে কেমন আছি আমি. মৃদু হাসি আমার,.. “ভালো.” রাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব স্মৃতির রোমন্থন, তারপর সুজনের অনুরোধে তার অডিতে চেপে ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য পাঁচতারা হোটেলে পদার্পণ… নিশির ডাকে চলেছি আমি. সুজনের নির্দেশে কি ওয়েটার আমার সফট ডিঙ্কসের গ্লাসে হার্ড ডিঙ্কস সার্ভ করেছে? আগের পীরিতির লোক, তার ওপর নিজের স্বামী স্বপনের দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি সামাজিক অনুশাসনের ব্যাকরণ ভুলেছি. সুজনের পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েক পেগ খাওয়া হয়ে গেছে. চেতনা লুপ্ত. জ্ঞান ফিরে পেয়েছি চারশো – বিশ নাম্বার স্যুটের অবিন্যস্ত বিছানায়. গায়ে চাদর টানা রয়েছে. দেহে পোশাকের অনুপস্থিতি বলে দিয়েছে আমাকে আমার বর্তমানের স্ট্যাটাস. পাশে আমার কেনা কালকের সব প্যাকেট. ওয়াশরুমে গিয়ে স্নান করে পোশাক পরে নিয়েছি. ঘড়ি তে ‌আটটা বাজতে পনেরো . রিসেপশন থেকে ফোন করে জানিয়েছে, চেক আউট টাইম ডট আটটা. পেমেন্ট করা আছে. আমি প্যাকেট গুলো নিয়ে বেরিয়ে এসেছি হোটেল থেকে. ট্যাক্সি নিয়ে বলেছি জেনেক্সভ্যালি. ড্রাইভার ট্যাক্সি ছুটিয়েছে. এখনও ঠিকমতো অফিস- টাইম আরম্ভ হয়নি. নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক আগে পৌঁছেছি বাড়িতে. শ্বাশুড়ি রেগে ‌আগুন, তেলে বেগুন. হিসহিসে স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, “রাত কাটালে কোথায়? বেয়ানের বাড়িতে যাওনি শুনলাম. ” আমি ‌আনুপূর্বিক সব ঘটনা বলে গেলাম. নিরাসক্ত মুখে শুনে গেলেন. চেয়ার থেকে উঠে ল্যান্ড ফোনের কাছে. মাকে বললেন সব. ওপ্রান্তের উত্তর শোনা গেল না. মেয়ের কুকীর্তিতে একটা মায়ের বলার কি বা থাকে! শ্বাশুড়ি ফোন কানে নিয়েই বিশাল হুঙ্কার ছাড়েন…” এই বাড়ির বাইরে যাও.” হুঙ্কারের রেশ মেলায়নি. শ্বাশুড়িমা আমার সপাটে আছড়ে পড়েছেন মাটিতে.ডাক্তারকে খবর দিয়েছি. এসে শ্বাশুড়িকে পরীক্ষা করে বলেছেন চার ঘন্টা বাদে এসে ডেথ-সার্টিফিকেট লিখবেন. ম্যাসিভ্ হার্ট এ্যাটাক্. চেম্বারে অনেক পেশেন্ট অপেক্ষা করছে. নিয়মবিধি অনুযায়ী চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া যাবে না.পুরনো কাজের লোক শ্বাশুড়ির ছেলে ও অন্যান্য দের খবর দিয়েছে. স্বামী স্বপন আসছে বলে জানিয়েছে. সময় যাতায়াতের জন্য যেটুকু লাগবে. বডি পিস-হেভেনে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি. বাড়ির মধ্যে ঢুকিনি. এমন কি টয়লেটেও যাই নি. মনে হচ্ছে শরীরের প্রাকৃতিক ক্রিয়া – কর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে. মাসী শ্বাশুড়িকে বলেছি, শ্বাশুড়ির জন্যে কেনা নতুন ঢাকাই পড়িয়ে দিতে. মনে মনে বলেছি “ওটা তো তোমার ছেলের পয়সায় কেনা. পড়তে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই. কেমন তরো সংবেদনশীল মানুষ তুমি তোমার মেয়েকে ক্ষমা করতে পারলে না! “তোমার ছাত্রীরা তোমাকে ঠিক মতো চেনে না. একটা ফোন করেছি আমি যে এন. জি. ও র সংগে যুক্ত সেখানকার প্রেসিডেন্ট জলিদি কে. থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে. মেয়েদের সেলাই শেখাই সেখানে. বস্তীর মেয়েদের পড়াশোনার উইং খুললে তার দায়িত্ব নেব. এখনকার ‌থেকে মাইনেও বেড়ে যাবে. যথাসময়ে মেয়ের জন্ম দিয়েছি আমি. নাম রেখেছি অগ্নিহোত্রী. কামনার অগ্নি থেকে ওর জন্ম. স্হির করেছি এমন দৃঢ় ও চৌখশ ভাবে গড়ে তুলবো ওকে, তখন ওকে ডাকবে সবাই আগুনে পাখি বলে, যে সমাজের সব জন্জাল সাফ করে,… হবে মহীয়সী এক নারী. স্বপন বা সুজন আসে নি আর কোন দিন. আমার নিজের মা বেঁচে আছে কোনক্রমে. কিন্তু আমার মুখ দেখে না. আমি সিঙ্গল – মাদার.


Share This
Categories
গল্প

মৃত্যঞ্জয় : ডঃ অশোকা রায়।

কফির আড্ডায় আজ সবাই আছে নেই মৃত্যুঞ্জয়।
অবসরের পর আমরা সবাই কলকাতায়, দেশ- বিদেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে।
কর্মজীবন আমাদের সাত বন্ধুর জোড়টা আলগা করেছিল। তবে চোখের দেখা না থাকলেও প্রাণের বাঁধন বজায় রেখেছিল ইন্টারনেট। সুতরাং বন্ধুত্বে ভাঁটা সেভাবে পড়ে নি। স্কাইপ বা ভিডিও কলে আমরা পরস্পরের মেদ-বাহুল্য ঘটার ঘটনা যেমন জানতে পারতাম, তা,অপরাধী বন্ধুর পক্ষ থেকে লোকানোর যতোই চেষ্টা করা হোক না কেন, আবার কারো ওজন দ্রুত কমলে সেটাও জানা থাকতো । জ্ঞান বরিষণের হাত থেকে রেহাই পেতে তার কাজের অজুহাতে ভিডিও ক্যামেরার সামনে থেকে পালানোর কথা বাকিদের কাছে অজানা থাকতো না। সকলের নাড়িনক্ষত্র আমাদের প্রত্যেকের কাছে খোলা খাতার মতোই ছিল। কথাটা যে কতটা ভুল ছিল তা’ বুঝেছি অবসরের পর। তবে সে বোঝা অলৌকিকভাবে।
অবসরের পর আমরা সবাই দেশের মাটিতে। মৃত্যঞ্জয় রয়েছে মেক্সিকোতে। ওর বিদেশিনী বৌয়ের চাকরি আর কয়েক মাস আছে। মৃত্যুঞ্জয় আর তার বৌ লিসা ঠিক করেছে ভারতে ফিরবে। আর তো কয়েক মাস। তারপর সপ্তরত্নের সভা সস্ত্রীক জমজমাট। বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভা হার মেনে যাবে। আমাদের স্ত্রীরা যমের মুখে ছাই দিয়ে বহাল তবিয়তে বর্তমান। সুতরাং দুরন্ত মৃত্যুঞ্জয় ঘরে ফিরলে আমরা সাত দু-গুণে চোদ্দো। নবরত্ন সভাকে হাসিহুল্লোড়ের রেটিং এ পিছে রাখতেই পারি।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আলিপুরের এক কফি-বারিস্তায় আমাদের নতুন আড্ডা। আগের আড্ডা কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস আমরা ছেলে-ছোকরা আর কিছু ইন্টেলেকচুয়াল লোকজন কে ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য কোনকালেই আমরা যথাযথ ইন্টেলেকচুয়াল ছিলাম না। তবে ইন্টেলেকচুয়ালের ভান করাটা প্যাশন এবং ফ্যাশন ছিল। তাই ব্রাত্য হওয়ার ভয়ে কফি হাউসের কাঠের সিঁড়ি ভাঙ্গতাম।
এখন সেই ফ্যাশনের মোহ নেই, প্যাশন উধাও। বয়স বেড়েছে। আমরা সবাই দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। এতোটা পথ উজিয়ে যাওয়ার এনথু একেবারে লেস।
তাই কফিহাউস ছেড়ে আলিপুরের কফি-বারিস্তায় আমাদের আড্ডা। রোজ নয়, সপ্তাহে দুদিন। আড্ডার অত সময় আমাদের মধ্যে তিনজনের নেই। আমার ছেলের চাকরি খোদ কলকাতার বুকে। একে নিজের বৌয়ের ফরমায়েশ, তার ওপর বৌমার চিকণ গলায় আবদারের সুরে বলা তার নিজস্ব জিনিসের ফর্দ। কায়দা করে জুড়ে দেয় প্রশংসা, ” বাবা তোমার বাজার করার ফরম্যাট টা সুন্দর। তোমার ছেলে কে কেন শেখাও নি? কিছু আনতে বললে আগেভাগে ফরমান জারি করে, ওসব কোথায় পাওয়া যায় জানি না। বাবা কে বলো। ” অগত্যা বাজারে দরকারী অ- দরকারী কাজে আমার কাটে পাক্কা দু ঘন্টা। তারপর কিছু অবসর। চারটে বাজতে না
বাজতেই দুটো ক্ষুদে দস্যির আগমন। পার্ক আর ইনডোর গেমস। কিন্তু সেটা আমার রিলাক্সেশন। আসলের চেয়ে সুদ বেশি। বাদবাকি দুজনের ঐ একই অবস্থা। একটু ঊনিশ-বিশ।
হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। সেদিন আড্ডা তুঙ্গে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পাওয়া নিয়ে। চলে এসেছে অমর্ত্য সেনের প্রসঙ্গ। কফির পেয়ালায় আলোচনার তুফান। হঠাৎ আমাদের টেবিলের সামনে মৃত্যুঞ্জয়। সেই দীর্ঘ দেহ। ঠোঁটে মুচকি হাসি। আমরা ছ’ জন হতবাক। সায়ক বলে, “তোর তো ফিরতে কয়েক মাস বাকি! ” মৃত্যুঞ্জয় বলে,” আগে ফিরতে মন চাইছিল বড়ো। কেন তোরা খুশি হসনি? ” নবারুণ, উদয়, অমিত, কৌশিক সমস্বরে বলে, ” তুই ভাবলি কি করে এ কথা। আমরা বলে অপেক্ষা করে আছি, কবে আসবি তুই “? মৃত্যঞ্জয় এবার আমার দিকে চায়, ” কি করে প্রদীপ, এমন করে চেয়ে আছিস যে। এক কাপ কফি তো বল। আর কাজুবাদামও অর্ডার কর। ” আমরা ভালো করে জানি মৃত্যঞ্জয়ের পছন্দ। আগে বলতো, কফির সাথে কাজু হোয়াটস এ্যা ফ্যান্টাস্টিক কম্বিনেশন”! একটু পজ দিয়ে বলতো, “খেতে খেতে আমি ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় চলে যাই। “
আমি কফি- কাজুর অর্ডার দিই।
ওগুলো আসার আগে মৃত্যুঞ্জয় বন্ধুদের সাথে মেক্সিকোর গল্পে মেতেছে। আমার মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। সকালের ফোনটা কি ফেক ফোন? ঐরকম বদমাইশি কেউ কারও সাথে করে! ভেবছিলাম, বন্ধু দের একটু পরে জানাব, কেউ একজন মেক্সিকো থেকে জানিয়েছে, “মৃত্যঞ্জয় ভৌমিক ইজ নো মোর। ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক”। আর এখন মৃত্যুঞ্জয় আমার সামনে বসে কলকাতার কফি-বারিস্তায় কাজু খাচ্ছে! ভাগ্যিস খবরটা বন্ধু দের আগে দিই নি। লেগপুলিং কে আমার বড়োই ভয়। ভেবেছিলাম বাড়ি ফেরার আগে দেব। আজ দুপুরে ভাত খাইনি ফোন রিসিভ করে মন খারাপ।
ভাবনার মধ্যে আমার ফোন টা বাজছে। ফোন বার করে দেখি, কলার লিসা। “হ্যালো”. ” প্রদীপ, মৃত্যুঞ্জয় চলে গেছে। ফিউরানাল শেষ হলো। ইন্ডিয়ায় ফেরার জন্য ফিউরিয়াস হয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝিনি। বোঝাতাম আর তো কয়েক মাস। মুখে কিছু বলত না। কিন্তু রেস্টলেস হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।
আমার ইল- লাক। আমি চাকরি ছাড়ছি। সময়ের টি
কাজ সময়ে করা উচিত,এ শিক্ষা আমার ইগনোর করা উচিত ছিল। বড়োই লেটে বুঝলাম। মৃত্যঞ্জয়ের ইচ্ছামত বাদবাকি জীবন ইন্ডিয়ায় কাটাব। বাট মৃত্যুঞ্জয় থাকবে না, সাথে। তুমি আমার একটা এ্যাকোমোডেশন এ্যারেঞ্জ করে দিও প্লিজ। ” লিসা জানে, আমি মৃত্যঞ্জয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এটুকু সাহায্য সে চাইতেই পারে। আশ্চর্যজনক কিছু নয় সেটা। আমি ফোন টা ইদানীং কানে কম শুনি বলে সবসময় স্পিকারে দিই। বন্ধু রা আমার ফোনে লিসার প্রায় এক তরফা কথা শুনেছে। মৃত্যঞ্জয়ের চেয়ারের দিকে তাকিয়েছে। চেয়ার খালি। কফির কাপ শেষ।
কাজুবাদামের প্লেট খালি।
জীবন থেকে চলে গিয়েও মৃত্যুঞ্জয়ের ইচ্ছা হয়েছিল বন্ধুদের সাথে অন্ততঃ একবার আড্ডা মারার। মৃত্যু কে জয় করে মৃত্যুঞ্জয় তার ইচ্ছাপূরণ করেছে।
সর্বস্বত্ব লেখিকা কর্তৃক।সংরক্ষিত।
19/10/2019

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জাতিস্মর : ডঃ অশোকা রায়।

কি নিয়ে লিখব ভাবছিলাম বেশ কিছু ক্ষণ ধরে। কিছুই মাথায় আসছিল না।
মাথাটা একেবারে ব্ল্যাংক। হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। আমার ঘরের ঠিক জানলার নীচে একটা ঝোপ আছে, অনেক ক্ষণ ধরে সেখান থেকে ব্যাঙের ঘ্যানঘ্যানানি ডাক ভেসে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম বৃষ্টি আসবে। অপেক্ষায় থাকলাম বৃষ্টির। বৃষ্টি আমার আশা পূরণ করলো। ঝমঝমানি শব্দ করে নামলো বৃষ্টি। প্রথমে জানলা বন্ধ করিনি, যদি বৃষ্টি দেখে মাথায় গল্পের প্লট আসে, তবে সুমনের পোর্টালে আজ একটা আবার গল্প দিতে পারবো, এই ধান্দা নিয়ে। জগতটাই তো ধান্ধাবাজিতে চলছে, তবে আমিই বা এব্যাপারে পেছিয়ে থাকি কেন? লোকে তো তখন আমার কপালে “ব্যাক ডেটেড” শব্দটা দেগে দেবে। কি একটা হিন্দি সিনেমায় দেখেছিলাম নায়কের হাতে উল্কি কেটে ” আমার বাবা চোর” লিখে দেয়া হয়েছিল। সে নিয়ে তো সিনেমাটা একেবারে ক্লাইমেক্সে পৌঁছে গিয়েছিল। বক্স অফিসও হিট। সিনেমার নামটা ভালোই মনে আছে। কিন্তু বলে তর্ক সৃষ্টি করতে চাই না। এত চিন্তামগ্ন ছিলাম যে, বৃষ্টির ছাঁট আমার পাঞ্জাবিটা ভিজিয়ে দিয়েছে কখন বুঝতেই পারিনি। সুতরাং জানলা বন্ধ করে দিতে যাই। আর তখনি আকাশের গায়ে জোর বিদ্যুৎ ঝলকানি। তা’ দেখে আমার মাথায় গল্পের প্লট এসে যায়। জানলা বন্ধ করে আমি টেবিলের সামনে চেয়ারে বসি। কলম তুলে নিই, লেখনী এগিয়ে চলে পাতার পর পাতা। কল্পনার গরু ‌আমার একবারে মগডালে।
সমীরণ খুব ভালো বন্ধু আমার সেই স্কুল জীবন থেকে। ওদের বাড়িতে আমি যেতাম প্রায়ই। খুব ছোট যখন লুডো বা ক্যারাম খেলতে। শৈশবে সমীরণ খুব বেশি না হলেও আমাদের বাড়িতে আসত‌। কিন্তু সে ইনডোর গেমেই ইন্টারেস্ট দ‌েখাতো, আউটডোর গেমে নয়। আমি সমীরণ দুজনেই বড়ো হয়েছি। সমীরণ ঘরের কোণে বই মুখে দিয়ে বসে থেকেছে। আমি গেলে বেশ বড়ো অবস্থাতেও আমার সাথে সাপলুডো খেলেছে। আমি ব্যঙ্গ করে বলেছি চল্ আমরা সাপলুডোই খেলি। বড়োদের বিজ্ঞাপন কিন্তু আমি যে এঁচ‌োড়ে পাকা। সরল সমীরণ আক্ষরিক অর্থেই কথাটা নিয়েছে। ইনার মিনিংটা বোঝে নি, বা বোঝার ক্ষমতা তার ছিল না। এই সময় আমাদের বয়েস চোদ্দ বছর। সমীরণকে কতবার মাঠে খেলার কথা বলেছি। মোটা চশমার কাঁচের আড়ালে ঢাকা সমীরণের চোখ দুটো এক লহমার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পরক্ষণেই ম্রিয়মাণ গলায় জবাব দিয়েছে “না রে, মা বাবা বকবে” রহস্যটা উদ্ধারের ইচ্ছে থাকলেও তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। আমি ফুটবল, ক্রিকেট সব খেলাতেই বেশ দড় ছিলাম। ফুটবলে সেন্টার ফরোয়ার্ড প্লেয়ার হিসেবে আমার তখন পাড়া, পাশাপাশি বেপাড়ায় বেশ সুনাম। তার থেকেও বড়ো কথা আমি তখন অনুর্দ্ধ ঊন্নিশ-এ সি. এ. বির টুর্নামেন্ট খেলছি। নামযশ কিছু কিছু ছড়িয়েছে। কাগজে আমার ক্যালিবারের প্রশংসা করে রিভিউ বেরোচ্ছে। তবু তার মধ্যেও সমীরণের বাড়ি যাই। দুজনের চরিত্রগত প্রকৃতির বিশাল ডিফারেন্স। তবুও সমীরণের আকর্ষণ আমার কাছে অপ্রতিরোধ্য। কারণটা তখন বুঝতে পারি নি। বুঝেছি অনেক পরে।
ইতি মধ্যে আরো কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমি বেঙ্গল ক্রিকেট দলের অপরিহার্য সদস্য। টেস্ট দলে আমার অন্তর্ভুক্তি আলোচনার স্তরে আছে। আমার এ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন হায়ার সেকেন্ডারির স্তর পেরিয়ে থমকে গেছে। দরকার কি? এ. জি বেঙ্গলে ঢুকে গেছি। সমীরণের সংগে সম্পর্ক ত্যাগ করিনি। আমার চাকরি পাওয়া উপলক্ষ্যে “রেড চিলি” তে তাকে ডিনার খাইয়েছি। সমীরণ তখন এম. এ তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বি. এড পড়ছে আর চাকরি পাওয়ার জন্য জুতোর শুকতলা ক্ষয়িয়ে ফেলছে। আমি ভেবেছি ওর চাকরির জন্যে কোন মুরুব্বিকে ধরব‌ো। এখন আমার পরিচিতির সার্কেল হাইফাই। দরকার হয়নি , আমি তখন টেস্ট খেলছি ব্যাঙ্গালোরে। রাত আটটায় আমার মোবাইলে ফোন “অর্ক আমি একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি। ভাগ্যিস বি. এড টা কমপ্লিট করেছিলাম।” আমি শ্রী অর্ক রায় সমীরণকে অভিনন্দন জানিয়েছি। রাতে ঘুম আসার আগে রবি ঠাকুরের গানটা মনে পড়েছে, “প্রান ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে ম‌োরে আরো আরো আরো দাও প্রান। তব ভুবনে, তব ভবনে মোরে আরো আরো আরো দাও স্হান। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নয় অর্ক সমীরণকে এই গানটা ডেডিকেট করে। এ এক আশ্চর্য টান!
দুবছর বাদে সমীরণের সংগে আমার চাক্ষুষ সাক্ষাৎ। চুপিচুপি এসেছি ওর বাড়ি। তখন ক্রিকেটে আমার নাম দেশ-বিদেশের ক্রীড়ামোদীদের কাছে খুব আদরনীয় এক নাম। সিকিউরিটি নিইনি, ড্রাইভারও নয়। আজ এসেছি আমি সমীরণ‌ের মা-বাবার একসাথে মৃত্যুর খবর পেয়ে। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাঙালির কাছে পুরী রথ দেখা কলা বেচার মতো… জগন্নাথ ও সমুদ্র দর্শন একত্রে। ফিরতি পথে বাস উল্টেছে। জখম অল্প বেশি সকলে। শুধু সমীরণ‌ের মা-বাবার নাম নিহতের তালিকায়। সমীরণ কে ফোন করে বডি আইডেন্টিফিকেশন করতে বলা হয়েছে কটক থানা থেকে। কটকেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। সমীরণ থানায় গেছে। নিজে শিওর হয়েছে ও পুলিশ কে জানিয়েছে বডি তার মা-বাবার। কটকের শ্মশানে পাশাপাশি দুটো চুল্লিতে সমীরণের জীবনের দুই প্রিয় মানুষের নশ্বর দ‌েহ ভস্মীভূত হয়েছে সমীরণকে খুব একলা করে দিয়ে। সমীরণ বিয়ে করেনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। তার থেকে বলা ভালো মা-বাবার সংগে বৌয়ের অবনিবনা হবার ভয়ে। বিয়ে আমিও করিনি। বহু সেলিব্রিটি নায়িকা, ফ্যাশন জগতের মেয়েদের সংগে বা বড়ো বিজনেস ম্যানদের মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি করেছি একটা সীমারেখা বজায় রেখে। তবু এ নিয়ে ইয়েলো জার্নালিজম হয়েছে। ক্রেডিটে আমার অনেক স্ক্যান্ডাল জমা পড়েছে। কেয়ার করিনি। সেলিব্রিটিদের কাছে এগুলো মুকুটে গোঁজা কৃতিত্বের অনুষঙ্গের এক, একটা পালক বিশেষ। সুতরাং বিয়েতে আমারও অনীহা।
বর্ষার বৃষ্টি অঝোরে পড়ছে সারাদিন ধরে। থামা-কমার নামগন্ধ নেই। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আমি আজ এসেছি সমীরণের বাড়িতে। মব এ্যারেস্টেড্ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সমীরণের অঙ্গে কাছা। খাপছাড়া ভাবে সে আমায় আজ কিছু কথা বলে, যা জুড়ে আমি সমীরণের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু আভাস পাই । নিজের মতো সাজিয়ে নিয়ে সমীরণের বলতে চাওয়া কথা গুলো আমি আপনাদের বলছি। মা-বাবা দুজনকেই একসাথে হারানো সমীরণকে আপনারা দোষ দেবেন না। ওর মানসিক স্হিতি এ‌খন খুব নড়বড়ে। আমি সমীরণের বকলমে যা বলবো, তাতে অসংগতি বা অগোছালো ভাব থাকবে না। কারণ আমি সমীরণের বন্ধু মাত্র। তার মা-বাবা যাওয়াতে দুঃখ পেয়েছি খুবই কিন্তু সমীরণের মতো ভেঙ্গে পড়িনি। সমীরণের মা-বাবা আমার পাড়ার কাকু-কাকীমা, মা-বাবা তো নয়।
সমীরণ ফিরে গিয়েছিল আমাদের সেই ছেলেবেলায়। বলেছে, আমার মনে আছে কিনা, যে সে খেলতে যেত না মাঠে আমার হাজার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও। খুব মনে আছে আমার। ভীষণ রাগ লাগতো আমার মানে শ্রীমান অর্ক রায়ের, সে কথাটাও ভুলিনি। তা’ সত্ত্বেও সমীরণের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণের কথা ভুলিনি। যেচে যেচে ওদের বাড়ি যেতাম। মনে পড়ে আমি গেলে সমীরণের মা কেমন ভাবে স্নেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন আমার দিকে। থালা ভর্তি খাবার এনে এক থালা থেকে খাইয়ে দিতেন আমাদের দুজনকে। আমাদের তখন নিজের হাতে খাওয়ার সুযোগ কই? ততক্ষণে হয়তো সমীরণের পুট পড়লে আমার পাকা ঘুঁটি কেঁচে যাবে। নয়তো সমীরণের ছক্কা আর দুই পড়লে শেষ ঘুঁটি ঘরে উঠে যাবে। সমীরণ জিতে যাবে। দারুণ টেনশনের মুহূর্ত। আর তাছাড়া সমীরণের মায়ের হাতে খেতে আমার ভালো লাগতো। সমীরণ আর আমি গল্প করছি, নিজের হাতে খেতে কোন বাধা নেই। তবুও কাকীমার কাছে আবদার করেছি, খাইয়ে দেয়ার জন্যে। কাকীমার চোখে জল। মানে বুঝতে পারি নি কেন? কারণও জিজ্ঞেস করা হয় নি। ভেবেছি আনন্দাশ্রু। কাকীমা খুব নরম-সরম। আমার মায়ের মতো স্ট্রিক্ট ছিলেন না। সমীরণের বাবা সবসময় বাড়ি থাকতেন না। আমি যখন সমীরণদের বাড়ি যেতাম অফিস থেকে ফেরার সময় তখনও কাকুর হতো না। কিন্তু ছুটির দিন আমাদের দুজনকে পাশে বসিয়ে দেশ-বিদেশের নানা গল্প বলতেন। কি আকর্ষণীয় বলার ভঙ্গি! আমরা দুই বন্ধু গালে হাত দিয়ে শুনতাম। আমার বাবা মস্ত অফিসার। অফিসের পর মিটিং, ক্লাব – পার্টি। রবিবারও তিনি ব্যস্ত। নিজের ছেলেকে দেবার মতো সময় তার রবিবারের সিডিউলেও থাকতে নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সমীরণের বাড়ির আকর্ষণ আমার কাছে অপ্রতিরোধ্য। আজ সমীরণের কাছে জানতে পারলাম, সে জাতিস্মর। পূর্ব জন্মের কথা তার জ্ঞান হওয়া অবধি মনে আছে। আর এই কথা লোকজানাজানি যাতে নাহয়, তার জন্যেই কাকু-কাকীমা সমীরণকে বেরোতে দিতেন না। বিস্ময়কর বটে সমীরণের কথাটা। বিশ্বাস – অবিশ্বাসের দোলায় দুলি আমি। সমীরণ বুঝতে পারে আমি ওর গল্পটা ঠিক মতো হজম করতে পারছি না। জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারে, ” বৃষ্টির তোড়টা একটু কমেছে। রাত অনেক। রাস্তাও শুনশান। তোকে ঘিরে ধরার লোকজন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে। যাবি নাকি আমার সংগে একটা জায়গায়?” সমীরণ ভুল বলেনি রাজি হয়ে যাই। সমীরণ ড্রয়ারে রাখা চাবির গোছা তুলে হাতে নেয়। কাছাধারীর পকেট কোথায়? আমি পকেট হাতড়িয়ে গাড়ির চাবি বার করে নিই।
নিশুতি রাত চিরে গাড়ি এগিয়ে চলে। চালক আমি, পথ নির্দেশক সমীরণ। পথটা মনে হয় আমাদের ডায়মন্ড হারবারের দিকে নিয়ে চলেছে। আবার বৃষ্টি় তোড়ে এসেছে। ওয়াইপার চলছে। তবু দৃশ্যমানতায় অসুবিধা হচ্ছে। আমরা চুপচাপ। তবুও আমি দু-একটা কথা বলতে গিয়েছিলাম। অদ্ভুত গলায় সমীরণ বলেছে চুপচাপ সাবধানে গাড়ি চালা, এ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। আমি সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, মুখের রেখা গুলো কেমন অচেনা। তবুও বলি, “ডেস্টিনেশনটা কিন্তু এখনো জানাস নি।” ছোট্ট উত্তর এসেছে, ” ডায়মন্ড হারবারের দেউলা স্টেশন। গ্রামের নাম দিশাগড়।” দিশেহারা আমি বলি, ” রাস্তা চিনি না।” সমীরণ বলে, “ডিরেকশন দেয়ার দায়িত্ব আমার।” আমি আর কিছু বলি না। চুপচাপ স্টিয়ারিং এর নিয়ন্ত্রণ করি।
সমীরণের নির্দেশক্রমে দেউলা স্টেশনে পৌঁছে গ্রামের পথ ধরেছি। রাস্তা একদম ভালো নয়. বৃষ্টি থেমেছে। তবে সারা রাস্তা কাদায়-কাদা। বৃষ্টি থামা আকাশে কাস্তে চাঁদের উঁকি ঝুঁকি। নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ। অন্ধকারে জোনাকের আলোর মিটিমিটি ফোকাস , ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক.. আমার নেশা ধরায়। অথচ সমীরণের বাড়ি আসবো বলে দামী মদে অভ্যস্ত আমার পেটে আজ একফোঁটা এ্যালকোহল নেই। আমার নেশা চটকে দেয় সমীরণ… ” অর্ক গাড়ি থামা। এসে গেছি আমরা আমাদের বাড়িতে। যন্ত্র – গাড়ি যান্ত্রিক আওয়াজ করে থেমে যায়। গাড়ি থেকে নেমে দেখি জীর্ণ বাড়ি। রঙ-পলেস্তারা অনেকদিন পড়ে নি। তবুও একেবারে বসবাসের অযোগ্য নয়। সমীরণ কখন যে একটা চার ব্যাটারির টর্চ সংগে নিয়েছিল, খেয়াল করিনি। টর্চের জোরালো আলোয় অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা বাড়ির সদর-দরজার সামনে। আগে হয়ত এই পথের ধারে কেয়ারী করা বাগান ছিল, হয়তো ছিল না। নিছক আমার কল্পনা। তবে এখন যে এই জায়গায় আগাছা থরে থরে গজিয়ে রয়েছে, সেটা বাস্তব। সমীরণকে কিছু জিজ্ঞেস করবে, ইচ্ছে করছে না। সে যেন এখন একটা ভূতগ্রস্ত জীব। সমীরণ চাবির গোছা থেকে সঠিক চাবি বেছে নিয়ে ঢোকায় তালার গর্তে। তালা খুলে যায়। ওরা ভেতরে ঢোকে। বাড়ির মেঝে মার্বেলের ঝাঁট-মোছ না পড়ার দরুন ধূলিকণায় মলিন। নীচের সব ঘর বন্ধ. সমীরণ সেদিকে যায় না। বিশাল মার্বেলের সিঁড়ির ধাপ গুলো পেরোতে থাকে সে। পেছনে নিশি পাওয়া মানুষের মতো আমি তাকে অনুসরণ করি.
দোতলার ঘরের তালা খোলা হয়। আমি আর সমীরণ ঘরের মধ্যে। আমি দেখি জমিদার বা ভীষণ অবস্থাপন্ন দের বিশাল শয়ন- কক্ষ। মেহগিনী কাঠের পালঙ্ক। বার্মা টিকের নানা ফার্নিচার, বেলজিয়াম কাঁচের আয়না বসানো আলমারি। ঘরের মাঝে একটা গোল শ্বেত-শুভ্র টেবিল। চারপাশে লালটুকটুকে ভেলভেটের চেয়ার। একপাশের দেওয়াল আলমারিতে কাঁচের পুতুল, আরেকটা দিকের দেয়াল- আলমারিতে দেশ বিদেশের নানা বই। আমি যেন সাপুড়ের বীণ শোনা মন্ত্রমুগ্ধ এক সাপ। নিজের অজান্তেই মন আমার হেলছে দুলছে. দেয়ালে টাঙানো বিদেশী ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার চোখ আটকায় একটা সাদা-কালো ছবিতে. একি, এ তো সমীরণের মা-বাবার ছবি। এতো বড়ো ছবি, তা’ও চোখে পড়েনি। ফোটোগ্রাফ থেকে গোড়ের ঝুঁইের মালা ঝুলছে। এই ঘরে ঢুকে আমি পুরোনো ভ্যাপসা ঘরের গন্ধ পাই নি। উল্টে একটা ভালো গন্ধ পাচ্ছিলাম। মনে মনে তখন আমি ধরে নিয়েছি, এটা সমীরণদের বাড়ি। সংগে সংগে প্রশ্ন জেগেছে মনে,যাদের এতো ভালো অবস্থা,.. কলকাতায় তারা কেন অতো সাধারণ ভাবে থাকতো? এখন আমরা বড়ো হয়ে গেছি। একথা ছোট বেলার জিগরি – দোস্তকেও জিজ্ঞেস করা যায় না। কিছু ভাবতে পারে। ছোটবেলায় অনেক কিছু বলা যায়, অনেক কিছু করা যায়। পরিনত বয়েসে সম্পর্কের সমীকরণ সরলপথে হাঁটে না। তাই শুধু জিজ্ঞেস করি সমীরণকে , ” কাকু-কাকীমার ফোটোগ্রাফে মালাটা কোথা থেকে এলো রে? ” সমীরণের উদাস উত্তর, “জানি না”। অবাক হই, সমীরণ কোন মালা যে আনেনি আমি শিওর। সমীরণ নিয়ে যায় পরবর্তী ঘরে। ঘরের ফার্নিচার গুলো বলে, এটা কোন বাচ্চার ঘর। সুন্দর খাটের বিছানায় দুজনের পাশাপাশি শোওয়ার সরন্জাম বলে, একজন নয়, দুজন বাচ্চার ঘর। বইপত্র, খেলনার সংগে ঘরের এককোণে দাঁড়ানো ক্রিকেট ব্যাট রয়েছে। একটা ফুটবল খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আমার পায়ে ধাক্কা মারে। সমীরণ আমাকে দেখে যাচ্ছে। আমি ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি পড়ার টেবিলে রাখা আরো একটা ফটোগ্রাফ….. সমীরণ আর আমার। সমবয়সী দুটো ছেলের ছবি। জিজ্ঞাসু আমার চোখে এমন কিছু ছিল, যার উত্তর দিতে সমীরণ বাধ্য হয়েছিল।

সমীরণ জানিয়ে ছিল সমীরণ, কাকু, কাকীমা তিনজনেই পূর্ব স্মৃতি নিয়ে জন্মেছিল। বাদ ছিলাম খালি আমি। অথচ একই পাড়ায় আমার জন্ম। পূর্বজন্মের দুই যমজ ভাই এই জন্মে সমবয়সী দুই বন্ধু। আমি সমীরণের কথা বিশ্বাস করেছি। আমার মনে পড়েছে কাকীমার মাতৃ-স্নেহ, কাকুর পিতৃসুলভ আচরণ। ছেলের বন্ধু কে অনেকেই ছেলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু কাকু-কাকীমার ভালোবাসায় অরিজিনাল কিছু ছিল, ছিল রক্তের টান। আর সমীরণের সংগে তো শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, আত্মার সম্পর্ক একই বৃন্তে ফোটা দুটি কুসুমের মতো। সমীরণকে বলি,” চল, এবার আমরা এগোই.”
আবার আমি চালক। পথ চিনে গেছি, সব কিছু জেনে গেছি। সমীরণের নির্দেশক বা কথকের ভূমিকা শেষ। সমীরণ চুপচাপ। আমার মনে দিশের গড়,… আমার পূর্ব জীবন, পূর্ব জীবনের বাড়ি তোলপাড় তুলেছে। আমি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। গাড়ি উল্টেছে নয়ানজুলিতে। আশেপাশের লোকজন আমায় কষ্ট করে বার করেছে গাড়ি থেকে। আমার কিচ্ছু হয়নি। একটুও কাটেনি-ছড়েনি পর্যন্ত। আশ্চর্যের বিষয়, সমীরণ নেই। জমায়েত জনতা বলেছে আর কেউ ছিল না গাড়িতে। তাদের চোখের সামনেই তো ঘটনাটা ঘটেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করি সমীরণ নয়ানজুলির ধারে দাঁড়িয়ে বলছে, ” অর্ক, আমিও আর বেঁচে নেই রে। দেড় বছর আগে ডেঙ্গি আমায় নিয়ে গেছে। শুধু তোকে প্রকৃত ঘটনা জানাব বলে প্রতীক্ষা করছিলাম তোর দেশে ফেরার। ফিরে যা অর্ক, তোর নিজস্ব জগতে। অতীতের মাঝে বাসের কষ্ট আমরা তিনজন জানি। তবে তোর আমাদের প্রতি আকর্ষনের কারণটা তোর জানা দরকার ছিল। চলি রে। সমীরণ মিলিয়ে যায়। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অন্য কেউ সমীরণকে দেখে নি, আমাদের কথোপকথন শোনে নি। গাড়ি স্টার্ট করি। সেদিন নিরাপদে পৌঁছে যাই আমার এ জন্মের আস্তানায়।
আমি কাছাধারণ করেছি আমার এ জন্মের মা-বাবা জীবিত থাকা সত্ত্বেও। প্রশ্নের বাণ ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এসেছে। আমার এ জন্মের মা কেঁদেছে। বাবা মুখ গম্ভীর করে ঘুরেছে। সমীরণের কাছ থেকে আমার পূর্বজন্মের পরিচয় পাওয়ার ঠিক দশদিনের মাথায় ঘটাপটা করে আমার পূর্বজন্মের তিন আত্মজনের শ্রাদ্ধাদি কার্য করেছি। নিমন্ত্রিতদের কৌতুহল সেদিন নিবারণ করেছি,… “আমার পূর্বজন্মের শেষ ঋণ চোকাচ্ছি।”
সমীরণ তোর শেষ কথা রাখতে পারিনি। ডুপ্লিকেট চাবি করিয়ে যখনই দেশে থাকি দিশেরগড়ের বাড়িতে যাই অতীতের সংগে কথা কই। জানি না তোরা শুনতে পাস কিনা, নাকি তোদের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে?

Share This
Categories
গল্প

পরিবর্তন : দিলীপ রায়।

             তপা পরীক্ষার মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরল । অভিভাবকের স্বাক্ষর করিয়ে পরের দিন অবশ্যই জমা দিতে হবে । পরেরদিন মার্কশীট জমা দেওয়ার শেষ দিন । তপা মায়ের কাছে গিয়ে মার্কশীট দেখিয়ে বলল, কীভাবে বাবার স্বাক্ষর নেওয়া যায় ?  বাবা মার্কশীট দেখলে আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে । 
      নম্বরের যা  বহর, তাতে তুই কোন্‌ মুখে  বাবার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর চাইবি !            
     তপার বাবা পশুপতি খাঁ । পূর্বস্থলি স্টেশনের কাছে সোনাঝরা গ্রামে তাঁর মুদিখানার দোকান । দোকানে অনেক ধার-বাকী । খরিদ্দারের কাছ থেকে ধারের  টাকা আদায় হচ্ছে না । চাইতে গেলে সকলের মুখে এককথা, “মাঠের ধান উঠুক, ধারের সমস্ত টাকা শোধ করে দেবো ।“  পশুপতির আবার ধার দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ । অথচ ধার না দিলে খরিদ্দার ধরে রাখা কষ্ট । সদলবলে গাজি মিয়ার মুদির দোকানে হত্যে দেবে । তাতে আখেরে তাঁর লোকসান । 
      তখন সন্ধ্যা আঁটটা ! খরিদ্দারের আনাগোনা নেই বললেই চলে । তাই ভাবল পশুপতি, এবার দোকান বন্ধ করা যাক । মন-মেজাজ তাঁর ভাল নেই । কিছুক্ষণ আগে খাতা খুলে পশুপতির মাথায় হাত ! প্রায় আঠারো হাজার টাকা  ধার  । এইটুকু দোকানে এতগুলি  টাকা ধার ! লোকে ধার খেয়ে শোধ করার নাম করছে না । অথচ অনেকগুলি টাকা । সংসারে অনেক খরচ । অভাব  অনটনের বহর বেড়েই চলেছে । তাঁর বৌটা তেমনি ! একটু রেখে ঢেকে খরচা বাঁচিয়ে সংসার চালাবে সেদিকে তাঁর নজর নেই । শুধু বায়নাক্কা । এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে । দেখা যাবে  আজ গৃহের আসবাবপত্র কেনা, কাল দেখা যাবে ঘরের থালা বাসন কেনা ! আজকাল আবার অনলাইনে কেনাকাটা শিখেছে ।  কেনার শেষ নেই । তাঁর বৌয়ের খরচার হাত ষোলোআনা ।  এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে পৌঁছালো পশুপতি খাঁ ।
       গামছা হাতে  ধরিয়ে দিয়ে তাঁর বৌ বলল, “হাত মুখ ধুয়ে এসো চা বানিয়ে দিচ্ছি । ঐদিকে খাবার রেডি । যখন বলবে তখনই রাতের খাবার দিয়ে দেবো ।“  
       পশুপতি বৌয়ের  দিকে কট্মট করে  তাকিয়ে বৌকে ঝাঁঝালো সুরে বলল, “কষ্ট করে  আর  চা বানাতে হবে না । ক্ষিদে পেয়েছে, সুতরাং একটু পরে রাতের খাবার খেতে দিলেই চলবে । যতোসব আদিখ্যেতা  !”  
       পশুপতি হাত মুখ ধুতে যাবে এমন সময় তপা কাচুমাচু হয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো । মেয়েকে দেখে মুখ ভেঙ্‌চি দিয়ে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “সাঝ-সন্ধ্যাবেলায় তোমার আবার কী  দরকার ?” 
  “বাবা,  আমার স্কুলের  মার্কশীটে তোমার স্বাক্ষর চাই”, তপা আমতা আমতা করে বাবাকে  বলল ।
     মার্কশিট নিয়ে ঐরকম হতচ্ছাড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? নিশ্চয়ই পরীক্ষায়  ডাহা ফেল ! দেখি তো মার্কশীট, বলেই  পশুপতি মেয়ের হাত থেকে টান দিয়ে মার্কশীট  নিজের হাতে  নিলো ।
      এক ঝলক মার্কশীটের নম্বর দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো পশুপতি । তারপর রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে কষে মেয়ের গালে এক চড়  । চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে তপা ঘরের মেঝেতে সটান্‌ পড়ে গেল  । যন্ত্রণায় তপা কাঁদছে । তপার মা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলতে গেলে পশুপতি এক ধ্মকে বৌকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো । আর কট্মট করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “তোমার লায় পেয়ে মেয়েটা উচ্ছন্নে গেছে”  । 
   তপা কাঁদছে ।
   পশুপতি মার্কশীট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলো ।
  “বাবা, মার্কশীট আগামীকাল স্কুলে জমা দিতে হবে”,  ভীত ও ত্রস্ত অবস্থায় তপা  বাবাকে বলল ।
   আগে নাচ বন্ধ করো তারপর স্বাক্ষর । নাচ বন্ধ না করলে আমি আর স্বাক্ষর করবো না । ধাই ধাই করে এখানে সেখানে নেচে বেড়ানো । যার জন্য ১০০ নম্বরের মধ্যে  অঙ্কে ২৫ নম্বর । ইংরেজিতে  ২২ নম্বর ।  আহারে ! নম্বরের কী ছিরি ! 
    তারপর আবার মেয়ের উপরে  রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে নাচের সরঞ্জাম দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসে মেয়েকে ধমকিয়ে বলল, “আবার কখনও নাচে তোকে দেখেছি, তাহলে তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারবো । তোর মা এসেও বাচাঁতে পারবে না । বলেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা  হয়ে গজরাতে গজরাতে খাওয়ার ঘরে ঢুকলো ।“ 
                                                  ( ২ ) 
    পরের দিন রাজ্যস্তরে নাচের প্রতিযোগিতা । কলকাতার নজরুল মঞ্চে । স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতা ছুটলো নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে । এই ঘটনা একমাত্র তপার মা জানে । কেননা একমাত্র মা তপাকে নাচে ভীষণ উৎসাহ দেয় । সত্যি কথা বলতে, তপার পড়াশুনা ভাল লাগে না । পড়তে বসলেই পড়া থেকে উঠে নাচের অনুশীলন । নাচের অনুশীলনে তার পরিশ্রম নেই, বরং ভীষণ স্বচ্ছন্দ ।  কিন্তু তার বাবা উল্টো, পড়াশুনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না । অথচ তপার নাচই জীবন । নাচটা তার রক্তে ।  মনপ্রাণ দিয়ে নাচ শেখে । লুকিয়ে লুকিয়ে  নাচের ক্লাস করে । নাচে ভীষণ দক্ষ ।  মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে  কলকাতার  নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিলো তপা । তার সঙ্গে রয়েছে সহপাঠী অনুপম । তপাকে নাচের ব্যাপারে সবরকম সহযোগিতা করে অনুপম ।
   বিশাল বড় হল । রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম । প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন অথবা দুইজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে । টান টান উত্তেজনা ।  বিচারকের আসনে স্বনামধন্য  পাঁচজন । সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হল বেলা ১১টায়  ।  বিচারকেরা নাচের নিয়মাবলী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । বিচারকদের নির্দেশমতো প্রতিযোগীদের একটা মাত্র  নৃত্য পরিবেশন ।  শুরু হল নৃত্যানুষ্ঠান । 
      তপার পালা ঠিক বেলা দুটোর সময় । তাকে কত্থকের উপর নৃত্য পরিবেশনের জন্য বিচারকমণ্ডলী নির্দেশ দিলেন । তপার নৃত্যের তাল,ছন্দ ও লয় অতীব সুন্দর ।  তালে তালে এত সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করলো তপা, যার জন্য হলের সমস্ত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূতো । প্রচণ্ড হাততালি । বিচারকগণ পুনরায় তপাকে নির্দেশ দিলেন আধুনিক লোকগীতির সঙ্গে আরও একটি নৃত্য পরিবেশন করতে । তপাও তেমনি ! নৃত্যের তাল সম্পর্কে  তপার প্রচণ্ড দখল । এটা তার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা  ।   মন খুলে মনের আনন্দে নৃত্য পরিবেশন করলো তপা । নৃত্যে তার অফুরন্ত  আনন্দ ।  অনুপম অবাক ! অনুপম লক্ষ করল, তপার নাচের পরিবেশনের সময় তার সাথে সাথে অর্ধেকের বেশি শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলেন । অনুপম আরও লক্ষ করল, মাননীয় বিচারকেরা একে অপরের প্রতি হাসিমুখে তাকালেন ।
    তারপর দুজনে ছুটলো হাওড়া স্টেশন । ট্রেন ধরতে । পূর্বস্থলি স্টেশনে যখন পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ৭টা । অনুপমের সঙ্গে তপা বাড়ি ফিরছে । তপা ভাবছে এই সময়ে বাড়িতে বাবা নেই, সুতরাং বাবার বকা বা তাঁর হাতে মার খাওয়া থেকে মুক্তি । কিন্তু গাঁয়ের ভাওয়াল মাস্টার মশাই অনুপমের সঙ্গে তপার বাড়ি ফেরা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন । সরাসরি  পশুপতির দোকানে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ ! শেষে কিনা আপনার মেয়ে একটা আদিবাসী ছেলের সাথে মিশছে ? ভর সন্ধেবেলায় আপনার মেয়ে কিনা নীচু জাতের আদিবাসী ছেলেটার হাত ধরে  রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ! স্কুলের ড্রেস পরা । পিঠে স্কুলের বইয়ের ব্যাগ । নির্ঘাত স্কুল থেকে আলো-আধারি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ।“  কথাগুলি বলে ভাওয়াল মাস্টার অন্যত্র ছুটলেন ।                                        
      পশুপতি রাগে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য । দোকান খোলা রেখেই ছুটলো বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছেই  চিৎকার, “তপা কোথায় ?” 
   স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ  ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে ।
    তপা বাথরুম থেকে বের হতেই হাতের বেতের লাঠি দিয়ে তপার পিঠে বেদম মার ! তপার মা থামাতে গেলে তাকেও ঐ বেতের লাঠি দিয়ে চপেটাঘাত । মেয়েকে শাসিয়ে  পশুপতি বলল, “নাচ বন্ধ । এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা । এর বাইরে কোথাও দেখতে পেলে তোর ঠ্যাং খোড়া করে দেবো । স্ত্রীর দিকে ক্রূদ্ধভাবে  শাসিয়ে বলল, “মেয়েকে না সামলাতে পারলে আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব  পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে  দেবো ।“  
   তারপর  হন্‌হন্‌ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে  গেলো পশুপতি । 
    মা ও মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে তপা কেদেই যাচ্ছে । কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না ! কলকাতায় ছোটাছুটিতে সারাদিনের ধকলের পর বাবার হাতের বেদম প্রহারে তপা যতো না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে বাবার হাতে  মা  নিগৃহীত  হওয়ার জন্য !   
                                   ( ৩ ) 
    তারপর, নাচের প্রতিযোগিতার ফলাফল । সেটা ঘোষণা হবে কলকাতায় শনিবারদিন । বাড়ি থেকে কীভাবে বের হবে সেই চিন্তায় তপা অস্থির । 
 মা মেয়েকে বলল, কাল অর্থাৎ শনিবার  তুই ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবি । সঙ্গে অনুপম যাবে ।
  “তুমি যাবে না মা ? তুমি আমার সঙ্গে চলো মা”, বায়না ধরলো তপা ।
  যাওয়ার ইচ্ছা আমার ষোলোআনা, কিন্তু তোর বদরাগী বাবাকে নিয়ে ভয় ? 
    তপা  মনকে শক্ত করে মাকে বলল, “আমার নাচে  কোনো পুরস্কার পেলে আমি বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবো না । বাবার জন্য তোমার  যেমনি অশান্তি তেমনি আমার ভীতি । দরকার হলে থানায় নালিশ জানাবো । বাবার অভব্যতার একটা বিহীত হওয়া  দরকার, নতুবা বাবা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে” । 
     মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা শান্তভাবে তপাকে বলল, “বাবাকে নিয়ে ওসব আজেবাজে  কথা বলতে নেই মা । তোর নাচের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো পুরস্কার পেলে তোর বাবার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর মনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য । আমার কথাটা মিলিয়ে নিস ।“ 
     পরের দিন মা ও মেয়ে দুইজনেই পশুপতি  ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে  ট্রেন ধরলো । কলকাতায় রাজ ভবনের প্রেস কর্ণার হলে ফলাফল ঘোষণা । মাননীয় রাজ্যপাল বিজেতাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন । পুরো অনুষ্ঠান টিভিতে লাইফ দেখানো হবে । তপা ও মা এবং অনুপম রাজভবনে গিয়ে আসন নিয়ে বসে পড়লো । অনুপমকে রাজভবনে ঢোকার গেটে সিকিউরিটি ধরেছিল । কিন্তু তপা অনুপমকে তার জেঠতুতো দাদা বানিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করল । যার ফলে অনুপম  ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলো । 
   এবার নাম ঘোষণার পালা । 
    তপা ভীষণ টেনশনে আনচান । কোনো  পুরস্কার না পেলে আজ তার বাবার কাছে রক্ষে নেই । বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে তাড়িয়ে দেবে । পুরস্কারের ব্যাপারে তপা যেটা বুঝেছে সেটা হচ্ছে,  প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছাড়া আরও জেলা ভিত্তিক একটি করে পুরস্কার । জেলা ভিত্তিক দশ জনের পুরস্কার ।  পুরস্কারে নগদ ৫০,০০০/- টাকা এবং মানপত্র । প্রথম পুরস্কার ৫ লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৩ লাখ এবং তৃতীয় পুরস্কার ২ লাখ টাকা এবং সঙ্গে মানপত্র ।
     নাম ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠে এলেন মাননীয় ঘোষকঃ- 
       হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ । রাজ্যের মন্ত্রী ও উচ্চ পদাধীকারি আধিকারিকগণ  ।  নাম ঘোষণা করলেন ---- প্রথম,  পূর্বস্থলির তপতি বেরা । 
       তারপর হাততালি । প্রচুর হাততালি । ঘোষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “তপতিকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি ।“ 
    মঞ্চে তপতির ওঠবার পর ঘোষক তাঁর হাতের মাইকটি তপতির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি  শ্রোতাদের  উদ্দেশে কিছু বলো ।“ 
    এদিকে ভাওয়াল মাস্টার পশুপতিকে আবার খবর দিয়ে বলল, “টিভিতে তোমার মেয়েকে দেখাচ্ছে । এখন টিভি খুললেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে ।“  
   সঙ্গে সঙ্গে পাশের দোকানে টিভির সম্মুখে এসে পশুপতি অবাক ! তাঁর মেয়ে প্রেস, মিডিয়া্‌ ও  অনেক শ্রোতামণ্ডলির সামনে নির্দ্বিধায় বলছে, “নৃত্য শিক্ষায় আমার অনুপ্রেরণা আমার মা ।  মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতে আমার নৃত্য শিক্ষার বাস্তবায়ন ।“  
    পশুপতির চোখ ছলছল । সে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলো,  ফিরে এলে মেয়েকে  আর বকবে না । মেয়ে যেটা চায় সেটাই করবে । মেয়ের ক্যারিয়ারে   কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । সে এখন পরিষ্কার বুঝেছে, “যার যেদিকে ঝোঁক তাকে সেদিকেই এগিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় ।“  রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো পশুপতি । 
                                           ( ৪ ) 
     তারপর স্কুল, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সকলে তপার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।  নাচের প্রতিযোগিতায় তপা রাজ্যে প্রথম হওয়ায় সকলেই গর্বিত । 
   পশুপতি কাচুমাচু হয়ে মেয়ের কাছে নত হয়ে  ছলছল চোখে  বলল, “মা আমাকে ক্ষমা করিস্‌ ।“  
   তপা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ।
             ---------০---------
Share This