Categories
প্রবন্ধ

আর্ন্তজাতিক আর্কাইভস দিবস কি, কেন পালিত হয় জানুন।

আজ আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস (আইসিএ) এর উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছরের ৯ জুন দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ দিবসের মূল লক্ষ্য, সাধারণ মানুষ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। জাতীয় আর্কাইভসে জমা থাকে দেশের সব সরকারি সংস্থা, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির ঐতিহাসিক তথ্যের রেকর্ড বা নথি। এগুলোকে বলা যায় জাতির স্মৃতির আকর। একটি দেশ বা জাতির অস্তিত্বের বেড়ে ওঠার বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করে জাতীয় আর্কাইভস।
আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস। ১৯৪৮ সালের ৯ জুন ইউনেস্কোর অঙ্গ সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস (আইসিএ) এর যাত্রা শুরু হয়। আইসিএ’র উদ্যোগেই ২০০৮ সাল থেকে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আর্কাইভ দিবস।

মূলত ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি আর প্রশাসনের নীতিনির্ধারকদের সামনে আর্কাইভসের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্যই এ দিবসের সূচনা করে আইসিএ।
, ‘আর্কাইভস সিদ্ধান্ত, কাজ ও স্মৃতিকে ধারণ করে। আর্কাইভস একটি অনন্য ও অপ্রতিকল্পনীয় ঐতিহ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহমান থাকে। আর্কাইভস তার মূল্যবোধ ও মান সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আর্কাইভস তথ্যের বিশ্বাসযোগ্য উৎস, যা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ভিত্তি নির্মাণ করে। এটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্মৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। আর্কাইভসে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত রাখার মাধ্যমে মানবসমাজ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে, গণতন্ত্রকে সচল রাখে, নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা করে এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে।’

উদ্দেশ্য—–

আর্কাইভস হলো ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন সরকারি ও বেসরকারি নথিপত্র, দলিলাদি, পুরনো বিরল পুস্তকাদি, পান্ডুলিপি ইত্যাদির সংগ্রহশালা। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা, শিক্ষা ও গবেষণা, রেফারেন্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাতীয় আরকাইভসের গুরুত্ব অপরিসীম। সম্ভবত প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় আর্কাইভ জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্ভব হয় এবং মধ্যযুগেও এগুলির অস্তিত্ব বজায় থাকে। গ্রিক ‘আর্কিয়ন’ শব্দ থেকে আর্কাইভস এর উদ্ভব, যা দ্বারা বোঝায় কোনো দফতরের আয়ত্তাধীন কর্মপ্রণালী। আর্কিয়ন এসেছে ‘আর্ক’ শব্দ থেকে যা দ্বারা আবার প্রারম্ভ, উদ্ভব, সর্বময় কর্তৃত্ব, সাম্রাজ্য, ম্যাজিস্ট্রেসি, দফতর ইত্যাদি বোঝায়। ল্যাতিন ‘আর্কিভিয়াম’ এসেছে গ্রিক আর্কিয়ন শব্দ থেকে, আর ল্যাতিন থেকে এসেছে ফরাসি ল্যা-আর্কাইভ। বিভিন্ন বস্তুর সন্নিবেশ বোঝাতে ফরাসি থেকে ইংরেজি ‘আর্কাইভ’ শব্দটির উৎপত্তি। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান আর্কাইভসকে সজ্ঞায়িত করেছে এমন একটা স্থান হিসেবে যেখানে সংরক্ষণের নিমিত্ত সরকারি নথিপত্র বা ঐতিহাসিক দলিলাদি সংগৃহীত হয়। টি.আর. শ্যালেনবার্গ আর্কাইভস-এর আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, যে কোনো সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেই সকল নথিপত্র যেগুলি কোনো গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত হিসেবে প্রয়োগের উদ্দেশ্যে স্থায়ী সংরক্ষণের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করে সেভাবে কোনো সংগ্রহশালায় রক্ষিত হয়েছে বা রক্ষণের জন্য বাছাই করা হয়েছে। আর্কাইভ এখন একটা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণাগার; একটা জাতির স্মৃতিময় তথ্যের ভান্ডার।

আরকাইভসের গুরুত্ব—

আরকাইভসের গুরুত্ব তুলে ধরতে ১৯৪৮ সালের এ দিনে ইউনেস্কোর অঙ্গ সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস (আইসিএ) যাত্রা শুরু করে। ২০০৪ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বিশ্বব্যাপী আর্কিভিস্টদের বা নথিরক্ষকদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে দুই হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। সম্মেলন শেষে তাঁরা একটি সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁরা জাতিপুঞ্জকে (ইউনাইটেড নেশন্স) অনুরোধ করবেন যেন বিশ্বব্যাপী একটি দিবস ‘আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশ তাদের দেশে ‘জাতীয় আর্কাইভস’ বা জাতীয় দলিলপত্র দিবস পালন করছে। দিবসটি পালন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে আর্কাইভস বা দলিলপত্র সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং একই সঙ্গে দেশের নীতিনির্ধারকদের আর্কাইভসের গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করানো। ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি আর প্রশাসনের নীতিনির্ধারকদের সামনে আর্কাইভসের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্যই এ দিবসের সূচনা করে আইসিএ। মূলত ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস (আইসিএ) এর উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছরের ৯ জুন দিবসটি পালিত হচ্ছে।

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

আজ ৮ জুন, বিশ্ব মহাসাগর দিবস, জানুন দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব।

বিশ্ব মহাসাগর দিবস হল একটি আন্তর্জাতিক দিন যা প্রতি বছর ৮ জুন অনুষ্ঠিত হয়।  ধারণাটি মূলত ১৯৯২ সালে কানাডার ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান ডেভেলপমেন্ট (ICOD) এবং ওশান ইনস্টিটিউট অফ কানাডা (OIC) আর্থ সামিটে – ইউএন কনফারেন্স অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (UNCED) ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে প্রস্তাব করেছিল।  মহাসাগর প্রকল্পটি ২০০২ সালে বিশ্ব মহাসাগর দিবসের বিশ্বব্যাপী সমন্বয় শুরু করে৷ “বিশ্ব মহাসাগর দিবস” আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল৷ আন্তর্জাতিক দিবসটি বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) বাস্তবায়নকে সমর্থন করে এবং সুরক্ষায় জনস্বার্থকে উৎসাহিত করে৷  সমুদ্র এবং এর সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা।

 

বিশ্ব মহাসাগর দিবস মানুষকে সমুদ্রের গুরুত্ব এবং দৈনন্দিন জীবনে তারা যে প্রধান ভূমিকা পালন করে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য স্মরণ করা হয়। জাতিসংঘের মতে, দিবসটি সমুদ্রের উপর মানুষের ক্রিয়াকলাপের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রের প্রজাতির জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য। এছাড়াও, বিশ্বব্যাপী সমুদ্র এবং সম্পদের টেকসইতাকে উন্নীত করার জন্য সমুদ্র এবং এর সম্পদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি সমুদ্র থেকে মানবজাতির উৎসারিত বিভিন্ন সম্পদ, সেইসাথে সমুদ্র যে বিভিন্ন হুমকির সম্মুখীন হয় তা তুলে ধরার উদ্দেশ্য।

 

গোটা বিশ্বে সমুদ্র ও উপকূলবর্তী এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত আজ বিপন্ন প্রায়। অথচ পৃথিবীতে মানব জাতির টিকে থাকার অন্যতম চাবিকাঠি হল সাগর। খাদ্য, ওষুধসহ বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের একটি বড় অংশ আসে মহাসাগর থেকে। তাছাড়া মহাসাগরগুলো বায়ুমণ্ডলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে আছে। কিন্তু মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি জলবায়ুর বৈরী থাবায় মহাসাগরগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে এর জীববৈচিত্র্য।

 

আমাদের অক্সিজেনের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা হলো সাগর-মহাসাগর। পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয় এসব সাগর-মহাসাগরকে। সমুদ্রের এই অবদান, আবেদন, প্রয়োজনীয়তা আর উপকারিতাকে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বের সবার সামনে তুলে ধরতে প্রতি বছর ৮ জুন পালন করা হয় বিশ্ব সমুদ্র দিবস।দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো, সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জোয়ার পরিবর্তনে স্পন্দন হারাচ্ছে সমুদ্র’  -২০২৩।

 

ইতিহাস—

 ১৯৮৭-১৯৯২

Brundtland Commission (এছাড়াও বিশ্ব কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামে পরিচিত) ১৯৮৭ Brundtland রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় সমুদ্র সেক্টরে একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বরের অভাব রয়েছে।
১৯৯২ সালে প্রথম বিশ্ব মহাসাগর দিবসে, উদ্দেশ্যগুলি ছিল সমুদ্রকে আন্তঃসরকারি এবং এনজিও আলোচনা এবং নীতির কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাপী সমুদ্র এবং উপকূলীয় নির্বাচনী এলাকার কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করা।

 

২০০২-২০০৮

 

বিশ্বব্যাপী সমন্বিত প্রচেষ্টাগুলি The Ocean Project এবং World Ocean Network সহযোগীতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এবং ইভেন্টের সংখ্যা কয়েক ডজন।  এই সময়ের মধ্যে, www.WorldOceanDay.org চালু হয়েছে, সাগরের প্রোফাইল বাড়াতে এবং আমাদের নীল গ্রহের জন্য যুক্ত হওয়ার এবং একটি পার্থক্য করার সুযোগ দেওয়ার সুযোগের প্রচারে সহায়তা করতে।  ওয়েবসাইটটি ইভেন্ট সংগঠকদের তাদের সম্প্রদায়গুলিতে সাহায্য করার উপায়গুলি প্রদান করে এবং শিক্ষামূলক এবং কার্যকরী সংস্থান, ধারণা এবং সরঞ্জামগুলির প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সম্পৃক্ততা তৈরি করে, সর্বদা প্রত্যেকের জন্য তারা যে কোনও উপায়ে বিশ্ব মহাসাগর দিবস উদযাপন করতে ব্যবহার করার জন্য বিনামূল্যে।  ২০০৪ সালে, The Ocean Project এবং World Ocean Network চালু করেছে “আমাদের মহাসাগর গ্রহের জন্য একটি পার্থক্য করতে সাহায্য করুন!”  ৮ জুনকে বিশ্ব মহাসাগর দিবস হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের কাছে একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করার জন্য অনলাইন এবং ব্যক্তিগত উভয় সুযোগের সাথে।  ডিসেম্বর ২০০৮ সালে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি ঘোষণা পাস করে।

 

বার্ষিক থিম—

 

জাতিসংঘ দিবসটির জন্য নিম্নলিখিত বার্ষিক থিমগুলি বেছে নিয়েছে:

২০০৯: “আমাদের মহাসাগর, আমাদের দায়িত্ব”

২০১০: “আমাদের মহাসাগর: সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ”

২০১১: “আমাদের মহাসাগর: সবুজ আমাদের ভবিষ্যত”

২০১২: “UNCLOS @ 30” — United Nations Convention on the Law of the Sea (UNCLOS)

২০১৩: “মহাসাগর এবং মানুষ”

২০১৪: “সমুদ্রের স্থায়িত্ব: আসুন একসাথে নিশ্চিত করি যে মহাসাগরগুলি ভবিষ্যতে আমাদের টিকিয়ে রাখতে পারে”

২০১৫: “স্বাস্থ্যকর মহাসাগর, স্বাস্থ্যকর গ্রহ”

২০১৬: “স্বাস্থ্যকর মহাসাগর, স্বাস্থ্যকর গ্রহ ⁠- একটি টেকসই গ্রহের জন্য ভ্রমণ: হোকুলে’র আগমন”

২০১৭: “আমাদের মহাসাগর, আমাদের ভবিষ্যত”

২০১৮: “আমাদের মহাসাগর পরিষ্কার করুন!”

২০১৯: “লিঙ্গ এবং মহাসাগর”

২০২০: “টেকসই মহাসাগরের জন্য উদ্ভাবন”

২০২১: “The Ocean: Life & Livelihoods”

২০২২: “পুনরুজ্জীবন: মহাসাগরের জন্য যৌথ কর্ম”

২০২৩: “প্ল্যানেট ওয়াসেন: জোয়ার পরিবর্তন হচ্ছে।

 

বিশ্বের খাদ্য ও ওষুধের অন্যতম ভাণ্ডার এই মহাসাগর। ফলে যেভাবেই হোক রক্ষা করতেই হবে সমুদ্রকে। পৃথিবীর মোট ৭০ শতাংশেরও বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে মহাসাগর। পৃথিবীর প্রায় ৯৪ শতাংশ প্রাণী প্রজাতি বাস করে সমুদ্রের নীচে!মহাসাগরগুলি পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে। কারণ সমুদ্রের নীচে থাকা সামুদ্রিক প্রজাতিই এই অক্সিজেন উৎপাদন করে।

 

তাই বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষার কাজে মহাসাগরের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে মহাসাগরের তুলনা নেই। আন্তর্জাতিক মহাসাগর দিবসে যাতে আমরা মহাসাগরের গুরুত্ব আরো বেশি করে উপলব্ধি করতে পারি সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার একটি বিশেষ দিন।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

 

 

 

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস কেন পালিত হয় এবং পালনের গুরুত্ব, জানুন।

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে খাদ্য। সেই খাদ্যকে গুরুত্ব দিতেই ৭ জুনকে বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়  যাতে খাদ্যজনিত ঝুঁকি প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা এবং মানব স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।এই বছরের বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবস ২০২৩-এর থিম হল “খাদ্য মান জীবন বাঁচায়।”  বেশির ভাগ মানুষই তাদের খাদ্য নিরাপদ কিনা তা জানার জন্য ভোগ্য সামগ্রীর প্যাকেজিংয়ের তথ্যের উপর নির্ভর করে। এই খাদ্য নিরাপত্তা মানগুলি কৃষক এবং যারা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ করে তাদের গাইড করে।  সংযোজন, দূষক, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ এবং পশুচিকিত্সা ওষুধের পরিমাণ যা আমাদের দ্বারা নিরাপদে সেবন করা যায়, পরিমাপ করা, প্যাকেজিং এবং পরিবহন করা যায়, সেগুলিও এই মানগুলির অধীনে নির্ধারিত হয়৷ পুষ্টি এবং অ্যালার্জেনের লেবেলগুলি গ্রাহকদের একটি জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে৷

WHO প্রতি বছরের বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবসের থিম ঘোষণা করে বিশ্বব্যাপী অংশগ্রহণকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সংগঠিত প্রচারাভিযান চালু করেছে। নিরাপদ খাদ্য সুস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্যারান্টারগুলির মধ্যে একটি।  অনিরাপদ খাবার অনেক রোগের কারণ এবং অন্যান্য খারাপ স্বাস্থ্যের অবস্থার জন্য অবদান রাখে, যেমন প্রতিবন্ধী বৃদ্ধি এবং বিকাশ, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি, অসংক্রামক বা সংক্রামক রোগ এবং মানসিক অসুস্থতা।  বিশ্বব্যাপী, প্রতি দশজনের মধ্যে একজন খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়।  ক্যাম্পেইনটি বেশিরভাগ খাদ্যবাহিত রোগ প্রতিরোধ করার জন্য একটি টেকসই পদ্ধতিতে উন্নত স্বাস্থ্য সরবরাহ করার জন্য খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।  খাদ্য ব্যবস্থার নীতি-নির্ধারক, অনুশীলনকারী এবং বিনিয়োগকারীদের স্বাস্থ্যের ফলাফলের উন্নতির জন্য নিরাপদ খাদ্যের টেকসই উৎপাদন এবং ব্যবহার বাড়ানোর জন্য তাদের কার্যক্রম পুনর্বিন্যাস করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবস এর ইতিহাস–

 

কোডেক্স অ্যালিমেন্টারিয়াস কমিশন (সিএসি), যা এফএও/ডব্লিউএইচও ফুড স্ট্যান্ডার্ড প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করে, ২০১৬ সালে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবস উদযাপনের একটি প্রস্তাবকে সমর্থন করে। এক বছর পরে, জুলাই মাসে, খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সম্মেলন।  এর ৪০ তম অধিবেশন ডব্লিউএইচও দ্বারা সমর্থিত একটি রেজোলিউশন গ্রহণ করে ধারণাটিকে সমর্থন করেছে।
অবশেষে, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ তারিখে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তার রেজোলিউশন ৭৩/২৫০ দ্বারা বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবস প্রতিষ্ঠা করে।  আরও, বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্যজনিত অসুস্থতা প্রতিরোধ এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সর্বাত্মক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবসের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিতে এবং তুলে ধরার জন্য 3 আগস্ট, ২০২০ তারিখে WHA73.5 রেজুলেশন পাস করে।  খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা জোরদার করা।

 

বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবস এর তাৎপর্য—

 

আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি খাদ্যে কীটনাশক, রাসায়নিক এবং সংযোজন বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করেছে যা নিয়ন্ত্রিত না হলে ভোক্তাদের ক্ষতি করবে।  পানি দূষণও একটি বড় সমস্যা।  বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবস নিশ্চিত করে যে সমস্ত ভোক্তাদের জন্য সর্বোত্তম স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে খাদ্যের মান মেনে চলা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতিবছর মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রাণ হারায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।
পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কমে গেছে জীববৈচিত্র্য। অর্থাৎ, ফসলের জন্য উপকারী কীটপতঙ্গ কমে গেছে, বেড়েছে কিছু ক্ষতিকর পতঙ্গ। যার ফলে ব্যবহৃত হচ্ছে পতঙ্গনাশক ও রাসায়নিক সার। তাই প্রতি বছর খাদ্যজনিত সমস্যায় প্রায় ৬ কোটি মানুষ অসুস্থতায় ভোগেন। তাই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতরকণ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খাদ্যজনিত অসুস্থতা সাধারণত সংক্রামক ও বিষাক্ত পদার্থের কারণে হয়ে থাকে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী ও নানা রাসায়নিক পদার্থের কারণে খাদ্য অনিরাপদ হয়ে পড়ে। আর, এই অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে রোগ জীবাণু ও দূষিত পদার্থ, যা অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।

পরিবেশ দূষণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জমির মাটি ও ফসল। একই সাথে দূষিত পদার্থ প্রবেশ করছে শস্যের মাঝে।   পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কমে গেছে জীববৈচিত্র্য। অর্থাৎ, ফসলের জন্য উপকারী কীটপতঙ্গ কমে গেছে, বেড়েছে কিছু ক্ষতিকর পতঙ্গ। যার ফলে ব্যবহৃত হচ্ছে পতঙ্গনাশক ও রাসায়নিক সার। যা পরোক্ষ ভাবে আমাদের ই শরীরে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের শরীরে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হচ্ছে না।

 

তাই মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনিরাপদ খাদ্য সৃষ্টি করে নানা রকম রোগ-বালাই ও দুর্বল দেহ। যেমন, শিশুর দুর্বল বা অক্ষম হয়ে বেড়ে ওঠা, পুষ্টির অভাব, সংক্রামক কিংবা অসংক্রামক রোগের সৃষ্টি এবং মানসিক অসুস্থতা।

তাই প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে ৭ই জুন পৃথিবীব্যাপী দিবসটি পালন করা হচ্ছে। খাদ্যজনিত রোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ, চিহ্নিতকরণ, প্রতিরোধ ও তার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এই দিনটি আয়োজিত হয়।

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

লাবণ্যপ্রভা দত্ত : ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিকন্যা।

সূচনা—

ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলনে কত বীর সন্তান যে শহীদ হয়েছেন তার হিসেব মেলা ভার। স্বাধীনতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বহু নারী এই সংগ্রামে সমান ভাবে আহুতি দিয়েছিলেন নিজেদের। ভলোকরে  ইতিহাস ফিরে দেখলে তার খোঁজ পাওয়া যাবে। চিরস্মরণীয় মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকায় রয়েছেন মাতঙ্গিনী হাজরা, বীণা দাস, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়দ্দেদার, শন্তি ঘোষ, কমলা দেবী আরো কতো নাম। অনেকের নাম আবার অনেকেই জানেনা। তেমনি এক নমস্য বিপ্লবী বীরাঙ্গনা নারী ছিলেন
লাবণ্যপ্রভা দত্ত (১৮৮৮ ― ৬ জুন, ১৯৭১)। যিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিকন্যা। তাঁর সেই বিরত্বের কাহিনী আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

জন্ম ও পরিবার—-

লাবণ্যপ্রভা দত্ত ১৮৮৮ সালে বহরমপুরে পিতার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পিতৃভূমি ছিল মুর্শিদাবাদ এর বহরমপুরে। তার পিতার নাম হেমচন্দ্র রায় ও মাতার নাম কুসুমকুমারী দেবী। স্বামীর নাম ছিল যতীন্দ্রনাথ দত্ত। ৯ বছর বয়সে খুলনার যতীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বিবাহ হয়। অগ্ৰজ সুরেন্দ্রনাথ রায়ের কাছে রাজনৈতিক কর্মে অনুপ্রেরণা পান। ১৯০৬ খ্ৰী. স্বদেশী যুগে তিনি স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করতেন এবং স্বদেশী ছেলেদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। ২৩ বছর বয়সে বিধবা হয়ে বহুদিন পুরী ও নবদ্বীপে কাটান। ১৯২৯ খ্রী. লাহোর জেলে যতীন দাসের মৃত্যুর ঘটনায় আবার তিনি দেশসেবার কাজে এগিয়ে আসেন।

সংগ্রামী জীবন—-

জমিদার বাড়ির মেয়ে ছিলেন তিনি, বিভিন্ন অন্যায় দেখে ছোট থেকে প্রতিবাদী হয়েছেন। তার বড় ভাই সুরেন্দ্রনাথ রায়ের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হন। স্বদেশী কাজে যুক্ত ছেলেদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। তিনি নিজের স্বামীকে প্রভাবিত করেছিলেন স্বদেশীভাবাপন্ন করতে। ১৯৩০ খ্রী. তিনি ও তাঁর কন্যা শোভারানী দেশসেবা ও জনসেবার আদর্শ নিয়ে ‘আনন্দমঠ’ নামে এক সংস্থা প্ৰতিষ্ঠা করেন এবং দেশসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৩৩ সালে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠন করেন। তিনি দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেসের সেক্রেটারি ও চব্বিশ-পরগনার কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলন এর কাজ করার সময় তিনি গ্রেপ্তার হন ও তিনমাস জেল খাটেন।

১৪ দিন অনশন —-

১৯৩২ খ্রী. আইন অমান্য আন্দোলনে তাঁর ১৮ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। প্রেসিডেন্সী জেলের ভিতর ফিমেল ওয়ার্ডে বিধবাদের নিজেদের রান্না করে খাবার অধিকার পাবার জন্য ঐ জেলে ১৪ দিন অনশন করে সফল হন। দক্ষিণ কলিকাতা কংগ্রেসের সেক্রেটারী, চব্বিশ পরগনা কংগ্রেস কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বিপিসিসি-র মহিলা সাব-কমিটির সেক্রেটারী (১৯৩৯), বিপিসিসি’র সভানেত্রী (১৯৪০ – ১৯৪৫) ছিলেন।

মৃত্যু—

মহান এই স্বাধীনতা সংগ্রামী ১৯৭১ সালে ৬ জুন প্রয়াত হন।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

“বিশ্ব পরিবেশ দিবস” সম্পর্কে দুটি কথা : কলমেঃ দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

“আজ বাঁচাও সবুজ, জাগাও সবুজ,
ঘোচাও হিংসার রেশ
মনের সবুজ বাঁচলে তবেই
বাঁচবে এ পরিবেশ ।“

বিশ্ব পরিবেশ দিবসের তাৎপর্য হলো, দিবসটি বিশ্বের বা একটি নির্দিষ্ট দেশের সম্মুখীন পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করতে পালন করা ।
প্রথমেই আমরা জেনে নিই, পরিবেশ কাকে বলে । উদ্ভিদ, মানুষ যে পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করে এবং যে দৃশ্য ও অদৃশ্য উপাদান মানুষের জীবন জীবিকার উপর প্রভাব বিস্তার করে — সম্মিলিতভাবে তাকে পরিবেশ বলে ।
মানুষের চারিদিকে যে প্রাকৃতিক ও মানবিক স্পর্শ রয়েছে যাদের ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব নয়, সেসব বিষয়গুলিকে একত্রিতভাবে বলা হয় পরিবেশ ।
সোজা কথা – আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই আমাদের পরিবেশ । অর্থাৎ মাটি, জল, বায়ু, গাছপালা, জীবজন্তু, ইত্যাদি আমাদের পরিবেশ । পরিবেশ সম্পর্কে মাসটন বেটস্‌ বলেছেন, “পরিবেশ হলো সেসব বাহ্যিক অবস্থার সমষ্টি যা জীবনের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে ।“
এবার দিবসটির ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া যাক । ১৯৬৮ সালের ২০শে মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার । চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাঁদের গভীর উদ্বেগের কথা । সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলচ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয় । পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্য রাষ্ট্রগুলীর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালে ৫ থেকে ১৫ জুন জাতিসংঘের মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায় । ১৯৭৪ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ই জুনকে জাতিসংঘ “পরবেশ দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে । বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস । প্রতি বছর ৫ জুন ‘পরিবেশ’ দূষণের হাত থেকে এ বিশ্বকে বাঁচানোর অঙ্গীকার নিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে । বিশ্ব পরিবেশ দিবস প্রতি বছর ৫ই জুন বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ আর জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে পালিত দিবস ।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিকমতো বজায় রেখে মানুষ যাতে এই পৃথিবীর বুকে অন্যান্য সমস্ত জীবের সাথে একাত্ম হয়ে এক সুন্দর পরিবেশে বেঁচে থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল উদ্দেশ্য ।
এবার আসছি পরিবেশবিদরা কী বলছেন ? বিভিন্ন পরিবেশবিদরা বলছেন, পর্যাপ্ত গাছের অভাবে জলের বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেছে, এর ফলে এখানে মাইক্রোক্লাইমেট তথা আশেপাশের এলাকা থেকে ভিন্ন জলবায়ু পরিস্থিতি বিরাজ করছে । গাছ না লাগালে আগামী ২০বছর পর এখানে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিতে পারে ।
অনেক পরিবেশবিদরা বলছেন, গাছ মূলত ‘বাষ্পমোচন ও ঘনীভবন’ — এই দুটি প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি আনতে সাহায্য করে । গাছ তার শোষিত জলের ১০ শতাংশ সালোকসংশ্লেষণে ব্যবহার করে । আর বাকী ৯০ শতাংশই প্রকৃতিতে বাষ্পমোচন করে দেয় । এতে বাতাসে ভাসমান জলীয়কণার পরিমান বাড়ে, যা বৃষ্টির প্রধান উপাদান । বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এখন গাছও কম, তাই বৃষ্টি কম ।
“দূষণ মুক্ত সবুজ পৃথিবী গড়তে
গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান ।“
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারলাম না । জানেন কি, এক টাকাও খরচ না করে দেশের স্বচ্ছতম নদীর তকমা পেয়েছে মেঘালয়ের এক পাহাড়ি নদী । শুধুমাত্র স্থানীয় মানুষের সচেতনতার ফল । মেঘালয়ের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড় জেলায় অবস্থিত ছোট্টো পরিচ্ছন্ন এবং তকতকে শহর ডাউকি । ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ডাউকি কিন্তু দেশের আর পাঁচটা সীমান্তের মতো সবসময় উত্তপ্ত থাকে না । পরিবেশ যেন সর্বদাই মনোরম। যদিও সেনা টহল সবসময় । ডাউকির কাছেই অবস্থিত এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং । ডাউকির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল উমঙ্গট নদী ।
অথচ গঙ্গা দূষণ রোধে ও পরিবেশ রক্ষায় না জানি ভারত সরকার কত হাজার কোটি টাকা খরচ করে যাচ্ছে ! অথচ ফল কী হচ্ছে, আজও মানুষেরা অজানা !
এবছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম – প্লাস্টিক-দূষণ মোকাবিলার পথ সন্ধান করা । ২০২৩ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো “প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে সামিল হই সকলে ।“ দিবসের স্লোগান নির্ধারন হয়েছে, “সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ ।“ দেশের সুশীল নাগরিক সমাজও পরিবেশ দিবসের স্লোগানের সাথে সামিল হন, আবেদন রইলো । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
——-০———–

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

গোদাবরী তটে শ্রীমন্ মহাপ্রভু রায় রামানন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন, “দুঃখ মধ্যে কোন্ দুঃখ হয় গুরুতর ?’ রায় রামানন্দ তদুত্তরে বলেছিলেন— “কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর।।” নিরন্তর ভক্তসঙ্গে ভজনের যে পরিপাটী লাভ করা যায় তা যে কোন একজন সাধকের ঈপ্সিত লক্ষ্য। একজন পথচারী যখন দুর্গম বনপথ দিয়ে একা গমন না করে অনেকের সঙ্গে আলাপচারিতা, কথোপকথন বা হাস্য পরিহাসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন, তখন তাঁর দস্যুভয় বা হিংস্র পশু আক্রমণের বিপদের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায়। তেমনই, সাধক যদি নিত্য উপযুক্ত ভক্তসঙ্গ করেন তখন সংসারের দস্যুতুল্য, পশুতুল্য কামনা-বাসনা, বিষয়-বাসনা বা কোন প্রকার ভজন অহংকার তাঁর মনে অযথা উপদ্রব হয়ে তাঁকে সাধন-পথভ্রষ্ট করতে পারে না। তাইতো শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় বলেছেন— “করহ ভকত সঙ্গ, প্রেমকথা রসরঙ্গ, তবে হয় বিপদ বিনাশ।” ভক্তসঙ্গ করার দরুণ ভক্তে-ভক্তে হয় বন্ধুত্ব। এ বন্ধুত্ব আমাদের প্রাকৃত জগতের বন্ধুত্ব নয়। দিব্য অপ্রাকৃত বন্ধুত্ব হল তা। প্রাকৃত বন্ধুত্ব নশ্বর, ক্ষণিক। তা স্বার্থ সম্বন্ধের সুক্ষ্ম আবেশ মিশ্রিত হলেও হতে পারে। কিন্তু দুই ভক্তের ভিতর ভক্তিকে কেন্দ্র করে যে বন্ধুত্ব, তা নিত্য, সত্য, স্বার্থগন্ধহীন। কারণ, এই বন্ধুত্বে কৃষ্ণেতর বস্তুতে কোন কৌতূহল থাকে না। এই বন্ধুত্বের একমাত্র লক্ষ্য পরস্পরের নিকট হতে কৃষ্ণপ্রেমরস আস্বাদন, নিরন্তর একে অপরের সঙ্গে কৃষ্ণকথা আলাপন ও একত্রে নাম-সংকীৰ্ত্তন রূপ আনন্দ সমুদ্রে অবগাহন। কৃষ্ণ মাধুর্য আস্বাদনের লোভে এক ভক্ত যখন অপর ভক্তের সঙ্গ-সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে, তখন অচিরেই অমলিন, নিষ্পাপ, অপ্রাকৃত বন্ধুত্বের রূপ পায় তাদের উভয়ের অন্তরের টান। এরূপ বন্ধুত্ব সাধনের পরিপুষ্টি আনে। আর তাই সাধক এমন বন্ধুত্ব সঙ্গ প্রত্যাশা করে। তাই তো রামানন্দ রায় যখন মহাপ্রভুকে দশদিন গোদাবরী তীরে বাস করে তাঁকে সঙ্গ দিতে অনুরোধ করেন, তখন মহাপ্রভু বলেন— “দশদিনের কা কথা যাবৎ আমি জীব। তাবৎ তোমার সঙ্গ ছাড়িতে নারিব।। নীলাচলে তুমি আমি থাকিব এক সঙ্গে। সুখে গোঙাইৰ কাল কৃষ্ণকথা রঙ্গে।।” (চৈ. চ. / মধ্য/ ৮ম পরিঃ)।

কৃষ্ণকথা তো এ জগতে শুদ্ধকথা সার। সে অমৃত যতই পান করা যায় ততই তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায় আরও পানের। অদ্ভূত, অলৌকিক, অবিশ্বাস্য প্রভাব কৃষ্ণকথামৃতের। ভক্তমনকে জড়ীয় প্রপঞ্চের ভাবনা থেকে অপসারিত করে আনন্দলোকের মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত করে। পার্থিব লোক হতে হৃদয়কে উৎপাটিত করে কৃষ্ণলোকে রোপণ করে, যেখানে মাধুর্য্য-লাবণ্য বলতে যা , সব কিছুই কৃষ্ণকেন্দ্রিক। আর যা কৃষ্ণকেন্দ্রিক তা মায়াগন্ধহীন, কামকলুষমুক্ত। “কৃষ্ণ সূৰ্য্য সম মায়া হয় অন্ধকার। যাঁহা কৃষ্ণ তাঁহা নাহি মায়া অধিকার।। (চৈ. চ./মধ্য/২২পরিঃ)। তা সদানন্দময়, চিদানন্দময়। কৃষ্ণকথা শুরু হলে তা ভক্তমনকে এমন বিবশ করে যে, “সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়” –তাও ভক্ত টের পায় না। এ কথার আবেশে ভক্ত কখনো হাসে কখনো কাঁদে, কখনো গায় আবার কখনো আনন্দের আতিশয্যে নৃত্যও করে ফেলে। ঠিক যেমন মহাপ্রভু আর রামানন্দ রায় টের পান নি। “এইমত দুইজনে কৃষ্ণকথা রসে। নৃত্য-গীত-রোদন হৈল রাত্রি শেষে।।” (চৈ .চ/মধ্য/৮ম পরিঃ)। তাইতো, এমন দিব্য আনন্দদানকারী বন্ধুত্বে যখন বিচ্ছেদ আসে তখন ভক্তের কাছে তা এক অপূরণীয় বিরাট ক্ষতি।
যখন ঠাকুর হরিদাস মহাপ্রভুকে জানান যে, তিনি এবার মৃত্যুবরণ করতে চান, যাতে মহাপ্রভুর অপ্রকটলীলার বেদনা তাঁকে সহ্য করতে না হয়। তখন মহাপ্রভু বলেন তিনিও ঠাকুর হরিদাসের মতো ভক্তসঙ্গের বিরহ বহন করতে কষ্ট পাবেন। “কিন্তু আমার যা কিছু সুখ সব তোমা লঞা। তোমা যোগ্য নহে, যাবে আমারে ছাড়িয়া।।” (চৈ. চ./ অন্ত্য/১২ পরিঃ)। কৃষ্ণভক্ত-বন্ধুর বিরহবেদনার জ্বালার উপশম হয় না সহজে। সেই দুঃখানুভূতির কোন তুলনা হয় না কোন কিছুর সাথে। সে অভাবের কোন পূরণ হয় না। এমনটা তো হয়েছিল শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর ক্ষেত্রেও। তাঁর এবং শ্রীল রূপগোস্বামীর ভিতর ছিল এমনই অপ্রাকৃত কৃষ্ণপ্রেমময় বন্ধুত্ব। মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর যখন তিনি বৃন্দাবনে এসেছিলেন তখন তাঁর মনে মনে সংকল্প ছিল যে, বৃন্দাবনের লীলাস্থলী দর্শন করার পর গিরিরাজ গোবর্দ্ধন হতে ভৃগুপাতে জীবন বিসর্জন দেবেন। কারণ, তাছাড়া অন্য কোন উপায়ে মহাপ্রভুর কৃপা সঙ্গহীনতার মনোবেদনা নাশের পথ ছিল না তাঁর। কিন্তু ব্রজেতে আগমন করে যখন তিনি শ্রীরূপ-সনাতনের সান্নিধ্যে শ্রীব্রজধাম, গিরিরাজ শ্রীগোবর্ধন এবং শ্রীরাধাকুণ্ড দর্শন করলেন তখন তাঁর অন্তরের গৌরসুন্দর-বিরহের কিছুটা লাঘব হয়েছিল, উপশম হয়েছিল। তিনি শ্রীরাধাকুণ্ডের আশ্রয়তটে ভজনে নিমগ্ন হয়েছিলেন। শান্তি পেয়েছিলেন। অথচ, এই ব্রজধাম, এই গেবর্দ্ধন ,এই রাধাকুণ্ডই তাঁর কাছে ভয়াশ্রয়া, ভয়াল, অসহ্য মনে হয়েছিল শ্রীরূপ গোস্বামীর অপ্রকট হবার পর। তাঁর বিরহবেদনায় তিনি লিখেছিলেন—“শূন্যায়তে মহাগোষ্ঠং গিরীন্দ্রোহজগরায়তে। ব্যাঘ্রতুণ্ডায়তে কুণ্ডং জীবাতু রহিতস্য মে।।” অর্থাৎ, শ্রীরূপ গোস্বামীপাদের বিরহে জীবন ধারণের উপায় স্বরূপ এই মহাগোষ্ঠভূমি আমার নিকট শূণ্য-শূণ্য প্রতিভাত হচ্ছে। শ্রীগোবর্দ্ধন যেন অজগরের ন্যায়। শ্রীরাধাকুণ্ড যেন ব্যাঘ্রের ন্যায় মুখব্যাদান করে বসে আছে, মনে হচ্ছে। মহাবিরহে চরম বিচ্ছেদে মর্মাহত হয়ে, অধীর হয়ে খেদ করে বলেছেন- “গৌরাঙ্গচন্দ্রমিহ রূপযুগং ন পশ্যান হা বেদনাঃ কহি সহে স্ফুটরে ললাটে।”—হায়! শ্রীগৌরাঙ্গচন্দ্র ও শ্রীরূপ-সনাতনকে না দেখে আর কত বিরহ সহ্য করবো ! ওরে ললাট, তুই শতধা বিদীর্ণ হয়ে যা!

ঠিক এমনই বন্ধুপ্রীতি ছিল ঠাকুর নরোত্তম এবং শ্রীনিবাস আচার্য্য ঠাকুরের শিষ্য শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের ভিতর। রামচন্দ্র কবিরাজ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীচিরঞ্জীব সেনের পুত্র। পদকর্তা শ্রীগোবিন্দ কবিরাজের জ্যেষ্ঠ সহোদরও। তিনি মহাপণ্ডিত মহাকবি ছিলেন। আর মহাভক্ত তো বটেই। তাঁর সঙ্গে ঠাকুর মহাশয়ের বন্ধুপ্রীতি সম্পর্কে ‘ভক্তিরত্নাকরে’ ঠাকুর নরহরি চক্রবর্তী লিখেছেন— “রামচন্দ্র নরোত্তম দোঁহার যে রীত। আগে জানাইব এথা কহি সে কিঞ্চিৎ।। তনু মন প্রাণ নাম একই দোঁহার। কবিরাজ নরোত্তম নাম-এ প্রচার।। নরোত্তম কবিরাজ কহে সৰ্ব্বজন। কথাদ্বয় মাত্র যৈছে নর-নারায়ণ।। রামচন্দ্র নরোত্তম বিদিত জগতে। হৈল যুগল নাম সবে সুখ দিতে।।”
নরোত্তম-কবিরাজের তনু-মন-প্রাণ অভিন্নতার একটি চিত্তহারী লীলা আছে। রামচন্দ্র কবিরাজ তখন খেতুরীতে ঠাকুর মহাশয়ের সান্নিধ্যে অবস্থনারত। তাঁর পত্নী রত্নমালাদেবী রামচন্দ্রকে একাধিকবার পত্রমারফত অনুরোধ করেন যে একটি বার অন্ততঃ দর্শনদান করে ধন্য করেন তিনি রত্নমালাদেবীকে। কিন্তু সংসারত্যাগী রামচন্দ্র কবিরাজের মন একটিবারের জন্যও সে অনুরোধে উচাটন হয়নি। তিনি নরোত্তম সঙ্গ ছাড়তে নারাজ। পরিশেষে রত্নমালাদেবী পত্র মারফত অনুরোধ করলেন ঠাকুর মহাশয়কে যাতে তিনি অন্ততঃ একটি বারের জন্য রামচন্দ্র কবিরাজকে গৃহে প্রেরণ করেন বুঝিয়ে। নরোত্তম ঠাকুর কবিরাজ মহাশয়কে বললেন—তিনি যেন সে দিনই দুপুরে প্রসাদ পেয়ে কুমারনগরে নিজের গৃহে যান আর পরদিন প্রভাতে ফিরে আসেন। বললেন , “আমার শপথ ইহা না করিহ অন্যথা। না করিলে, মনে আমি পাব বড় ব্যথা।।’ (গৌরভক্তামৃতলহরী-৮ম খণ্ড, শ্রীকিশোরী দাস বাবাজী)
রামন্দ্র কবিরাজ বেজায় দুর্বিপাকে পড়লেন। বন্ধু নরোত্তমের শপথ অন্যথা করতে পারবেন না আবার সংসারের মোহভরা ঘেরাটোপে এক মুহুর্তের জন্যও যেতে চান না নরোত্তম সঙ্গ ছেড়ে। চিত্ত বড় ব্যাকুল হল। শেষে, “কান্দিতে কান্দিতে প্রেমে করয়ে গমন। খেতুরি পানে একদৃষ্টে করি নিরীক্ষণ।।” (ঐ)। পত্নী সম্ভাষণে গেলেন কবিরাজ মহাশয় বান্ধবের শপথ রক্ষা করতে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে কুমারগ্রাম ত্যাগ করে যখন খেতুরীতে প্রত্যাগমন করলেন তখন প্রভাত। পূজারী আরতি করছেন শ্রীমন্দিরে। তিনি একাধারে রাখা মার্জনী (ঝাড়ু)টি তুলে নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গন মার্জন করতে লাগলেন। কবিরাজ মহাশয় আড় চোক্ষে ঠাকুর মহাশয়কে দর্শন করে… নিজেকেই নিজে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন, ‘হায়। আমি কী অধম চিত্তের অধিকারী। এখানকার এমন দিব্য সুখ আমার ভালো লাগলো না। আমি বহু সময় হেলায় নষ্ট করে এলাম কাল। ধিক্ আমায় ধিক্‌।’—এই প্রলাপ করেই তিনি নিজের পৃষ্ঠে নিজেই মার্জনী দ্বারা প্রহার করতে লাগলেন। অবিলম্বে নরোত্তম ঠাকুর তাঁকে বিরত করতে তাঁর হস্ত ধরে ফেললেন। বললেন, ‘আহা। করো কী, করো কী রামচন্দ্র! আমার যে বড় ব্যথা লাগলো। আর এমন কর্ম কোরো না। দেখতো কী করলে আমার অবস্থা।”—এই বলে নিজের পৃষ্ঠখানি রামচন্দ্রের সম্মুখে ধরলেন। আর রামচন্দ্র কবিরাজ দেখলেন তাঁর বান্ধব নরোত্তমের পৃষ্ঠ ফুলে গিয়েছে প্রহারে। নিজের পৃষ্ঠের প্রতিটি আঘাত নরোত্তম ঠাকুরের পৃষ্ঠে পড়েছে। সকল বেদনা তাঁর বান্ধব নিজের শরীরে ধারণ করেছেন। তখন উভয়ের ক্রন্দন আর থামে না। এমন বন্ধুপ্রীতি যে ইহজগতের ঘটনা নয়। ভাবের আবেশে ভাববিহ্বল তনু-মন-প্রাণ একাত্ম হয়ে ভূমিতে গড়াগড়ি করে বিস্তর ক্রন্দন করলেন। “দোঁহে গলাগলি কান্দে ভূমি গড়ি যায়। দুইজনে হেন প্রীতি জানে গোরারায়।।” (ঐ)।
{ ‘শ্রীগুরুকৃপার দান’ গ্রন্থে, শ্রীপাদ রামদাস বাবাজী মহাশয়ের শ্রীমুখ নিঃসৃত ‘শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের সূচক কীৰ্ত্তনে বলা হয়েছে— “শ্রীআচার্য্য প্রিয়তম নরোত্তম প্রাণ যেন / রামচন্দ্র কবিরাজ সেই। … গুরুবাক্যে নিষ্ঠা তাঁর (রামচন্দ্র-র) ত্রিভুবনে পরচার/ এই বাক্য হয় সুপ্রমাণ…. যদি গুরুপদে হয় রতি তুলনা নাহিক কতি/ শুনহ সে অপূৰ্ব্ব কথন/ একদিন শ্রীআচার্য্য /আদেশিলেন রামচন্দ্রে/ রামচন্দ্র একবার যাও/সম্ভাষণ করে এস/বিবাহিতা পত্নীসনে সম্ভাষণ করে এস./…… অপূর্ব রহস্য কথা…../ সারা নিশি করলেন আলাপন …. শ্রীগুরু-গৌর লীলা প্রসঙ্গ সারা নিশি করলেন আলাপন… নিশি পরভাত হল…. শ্রীগুরুসেবার সময় হয়েছে। চলিলেন ত্বরা করে……/ শ্রীযাজিগ্রামের পথে এসে মনে হল/ প্রভু আজ্ঞা করেছিলেন…./পুনঃরায় ফিরে গেলেন/সম্ভাষণ করলেন/রামচন্দ্রের পুরুষ অভিমান নাই / সেই স্বভাবে রামচন্দ্র করিলেন আলিঙ্গন/লাগিল রামচন্দ্র ললাটে/প্রিয়ার সিঁথির সিন্দুর লাগিল রামচন্দ্র ললাটে/ উপনীত যাজিগ্রামে/তখন নরোত্তম করছিলেন আঙ্গিনা মার্জ্জন/জিজ্ঞাসেন রামচন্দ্রে/ কোথা গিয়েছিলে বা এখন বা যাও কোথা / পত্নী সম্ভাষণে গিয়েছিলাম/ এখন যাই শ্রীগুরুসেবায় /(তখন) নরোত্তম আঘাত করলেন রোষভরে/রামচন্দ্রের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করলেন রোষভরে/ সম্মার্জ্জনী লয়ে করে আঘাত করলে রোষভরে/…. আবার মধ্যাহ্নে নরোত্তমের সেবা/ করিতেছিলেন তৈল মৰ্দ্দন/শ্রীনিবাস আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে করিতেছিলেন তৈল মৰ্দ্দন/অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে মার্জ্জনীর আঘাত অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/মনে মনে ভাবলেন /কার অঙ্গে আঘাত করেছি/ এ তো নয় রামচন্দ্রের দেহ/নরোত্তম ব্যাকুল হলেন/অপরাধ স্খালন লাগি/ নরোত্তম করলেন মনে/এ হাত পোড়াব আগুনে নরোত্তম করলেন মনে … সে ভাব বুঝে আচার্য্য বলেন মনে মনে……এ দেশে বিচার নাই বাপ রে বাপ। দিনে মারে ঝাঁটার বাড়ী রাত্রে পোড়ায় হাত।।/কি সুমধুর লীলা রে/বালাই লয়ে মরে যাই/শ্রীগুরুসেবার আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র/ শ্রীগুরুপদে আত্ম-সমর্পণের আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র/বিকালে তাঁর পদতলে সর্ব্বোত্তমা গতি মিলে……}

এমনই হরিহর আত্মা ছিলেন নরোত্তম-কবিরাজ। যখন শ্রীনিবাস আচার্য্য শিষ্য রামচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনে গমন করলেন তখন ঠাকুর নরোত্তমের বিপ্রলম্ভ ভাব অর্থাৎ বিরহ ভাব আর চক্ষে দেখা যেত না। তিনি তাঁর প্রেমস্থলী নামক ভজন স্থানে ভূমিতে পড়ে অহর্নিশি বুকফাটা রোদন করতেন। বিশ্বে তাঁর মতো বন্ধুবিরহীকে সান্ত্বনাদানের কোন বস্তু বা ভাষা ছিল না। সব শূণ্য তাঁর কাছে তখন। বিরহালনে দগ্ধ হৃদয় হয়ে কী মর্মবিদরী পয়ার লিখলেন—’রামচন্দ্র কবিরাজ সেই সঙ্গে মোর কাজ /তাঁর সঙ্গ বিনা সব শূণ্য। যদি হয় জন্ম পুনঃ তাঁর সঙ্গ হয় যেন /তবে হয় নরোত্তম ধন্য।। (প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা-১১৮)। এখানে ‘সেই সঙ্গে মোর কাজ’ বলতে রামচন্দ্র কবিরাজের মতো ভক্তবন্ধুর সঙ্গপ্রসঙ্গে তিনি যে ভগবৎমাধুরী ও কৃষ্ণপ্রেমরস আস্বাদন করতেন তার কথা বলেছেন। আবার নিজের প্রেমভক্তির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে, ভক্তির অতৃপ্তি স্বভাববশতঃ যারপরনাই দৈন্য ভরে ভেবেছেন হয়তো তাঁকে আবার জন্ম নিতে হবে। আর তখন যদি রামচন্দ্র কবিরাজের মতো ভক্তের সঙ্গ পান তখনই তাঁর জীবন ধন্য হবে। তাঁর পুনঃ প্রার্থনাতেও তাঁকে লিখতে দেখা যায় “রামচন্দ্র সঙ্গ মাগে নরোত্তম দাস।” এ হেন অন্তরে সুহৃদ, পরমপ্রেমিক রামচন্দ্র। কবিরাজের মতো বান্ধব-বিরহে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর তাই লিখেছেন—— “তাঁর সঙ্গ বিনা সব শূণ্য ।’ তাইতো —- “কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর” ।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

অবনী মুখোপাধ্যায় : ভারতীয় উপমহাদেশের একজন সাম্যবাদী, বিপ্লবী।

সূচনা—-

ভারতীয় উপমহাদেশের একজন সাম্যবাদী, বিপ্লবী অবনী মুখোপাধ্যায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯২০ সালে ১৭ অক্টোবর তাসখন্ডে ৮ জন সদস্যকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা হলো কমিউনিস্ট পার্টি যার অন্যতম সদস্য অবনীনাথ ও তার পত্নী রোজা ফিটিংগফ। অবনীনাথ মুখোপাধ্যায় অল্প বয়েসেই প্রবীন কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব সখারাম গনেশ দেউস্করের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। অবনীর পিতা রাজনীতি থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। দূরে পাঠাতে তাকে আমেদাবাদের টেক্সটাইল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট এ পড়তে পাঠান। ১৯১৪ সালে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মহান বিপ্লবী বাঘা যতীনের। অবনীনাথ তারই পরামর্শে চাকরি নিয়ে জাপান যাত্রা করেন জাপানে ও অন্যান্য এশীয় দেশের সশস্ত্র বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে।

 

জন্ম—

অবনীনাথ মুখোপাধ্যায় মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর শহরে ৩ জুন ১৮৯১ জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস বাংলাদেশের খুলনায়র বাবুলিয়া গ্রামে। পিতার নাম ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। স্কুলের পাঠ শেষে তিনি কলকাতায় উইভিং টেকনোলজি শেখেন।

 

ব্যক্তিগত জীবন —-

 

তিনি বিয়ে করেন ১৯২০ সালে।  বলশেভিক তরুণী রোজা ফিটিংগফের সাথে তার বিবাহ হয় ১৯২০ সালে। কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও গবেষক চিন্মোহন সেহানবীশের সাথে মস্কোয় রোজার সাক্ষাত হয়। জানা যায় অবনীর পুত্র গোরা ঐতিহাসিক স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে শহীদ হন ১৯৪০ সালে। মেয়ে মায়া ছিলেন যক্ষারোগ বিশেষজ্ঞা।

 

কর্ম জীবন—

 

ছাত্রাবস্থায় কলকাতাতেই তিনি গণেশ দেউস্কর ও বিপিন পালের দ্বারা প্রভাবিত হন। উইভিং শেখার পর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলের অ্যাসিস্ট্যান্ট উইভিং মাস্টার হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষার জন্য জাপান ও জার্মানি যান। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে দেশে ফিরে অ্যান্ডু ইউল কোম্পানিতে চাকরি নেন ও কিছুকাল পরে বৃন্দাবনের প্রেম মহাবিদ্যালয়ে উপাধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন।

 

বৈপ্লবিক জীবন—

কুখ্যাত কার্লাইল ফতোয়া জারি করে ব্রিটিশ সরকার ছাত্র আন্দোলন নিষিদ্ধ করলে ১৯০৫ সালে তার বিরুদ্ধে কিশোর অবনী একটি জনসভায় যোগ দেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে শাস্তি প্রদান করলে তিনি স্কুল থেকে পালিয়ে জামালপুরের রেল শ্রমিক ধর্মঘটে সামিল হন। অল্প বয়েসেই সান্নিধ্য পেয়েছিলেন প্রবীণ জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব সখারাম গনেশ দেউস্করের। অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়, গদর বিপ্লবী ভগবান সিং ও রাসবিহারী অস্থায়ী বিপ্লব কমিটি গঠন করেন। জার্মান দূতের সাথে দেখা করে ফেরার পথে বিপ্লবীদের নাম ঠিকানাসহ নোটবই নিয়ে ধরা পড়েন পেনাং পুলিশের হাতে অবনীনাথ। ১৯১৭ সালে সিঙ্গাপুরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়। কয়েকজন জার্মান যুদ্ধবন্দীর সাথে অবনীনাথ দু:সাহসীক ভাবে পলায়ন করেন। সেখান থেকে সুমাত্রায় এক রবার বাগিচায় কাজ নেন ও গোপনে যোগাযোগ করেন ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতে সেখানেই তিনি রুশ বিপ্লবের কথা জানতে পারেন ও কমিউনিজমে আকৃষ্ট হন। পরে জাল ছাড়পত্রের সাহায্যে শাহির ছদ্মনামে অবনীনাথ এরপর চলে যান হল্যান্ড ও জার্মানি।

 

হিন্দুস্থান শ্রমিক ও কৃষক পার্টির প্রতিষ্ঠা—

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্বেও ১৯২২ এর শেষে তিনি ভারতে ফেরেন।  ভারত ত্যাগের পূর্বে মাদ্রাজে হিন্দুস্থান শ্রমিক ও কৃষক পার্টির প্রতিষ্ঠা করে যান ১৯২৪ এর ২রা মার্চ।

 

 গবেষনা ও রচনা—

মস্কোতে এম এন রায়ের সাথে মিলিতভাবে ‘ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’ বইটি রচনা করেন। মোপলা বিদ্রোহ সম্বন্ধে অবনী একটি পুস্তিকা লেখেন যা লেনিনের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে পাওয়া গেছে। এছাড়া ১৯২৩ সালে তিনি ‘গরীবের কথা’ একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

 

সম্মাননা—-

১৯৮৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অবনী মুখোপাধ্যায়কে মরণোত্তর সন্মানে পুনর্বাসিত করেন

 

 

মৃত্যু—-

তাঁর মৃত্যু রহস্যাবৃত। সন্দেহ করা হয় বুখারিনের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল এই অভিযোগে রাশিয়ান গোয়েন্দা দপ্তরের নির্দেশে তার মৃত্যুদণ্ড হয়।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

পানিহাটির চিঁড়া-দধি মহোৎসবের প্রচলনে শ্রীল রামদাস বাবাজী মহাশয়ের অবদান : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

এই বৎসর পানিহাটির প্রসিদ্ধ চিঁড়া-দধি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ২রা জুন। বৈষ্ণব ইতিহাসের পরম ঐতিহ্যবাহী ‘দণ্ডোমহোৎসব’-কে স্মরণ করতে এ উৎসবের প্রচলনে বরানগর পাঠবাড়ির রামদাস বাবাজী মহাশয়ের অবদান অনস্বীকার্য। কি ভাবে ?

আসুন জেনে নেওয়া যাক , সেই মহোৎসবের আকর্ষণীয় ইতিহাস আর সেই ইতিহাস শ্রদ্ধা-স্মরণে রামদাস বাবাজী মহাশয়ের প্রচেষ্টার কথা।

নবদ্বীপ সমাজবাড়ির বড়বাবা তথা শ্রীল রাধারমণচরণ দাসদেব তাঁর প্রিয় শিষ্য বরানগর পাঠবাড়ির রামদাস বাবাজীকে আদেশ দিয়েছিলেন নতুন মঠ-মন্দির স্থাপন নয়, বরং লুপ্ত বৈষ্ণব তীর্থগুলি উদ্ধার করার দিকে বেশী মনোনিবেশ করতে হবে। অর্থাৎ, যে যে স্থানে আমাদের অন্তরের আপনার জন শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ-গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এবং তাঁদের পার্ষদরা লীলা করেছেন সেই সকল মহিমান্বিত স্থানগুলির প্রাচীন ইতিহাসকে লোকমননে স্মরণ করিয়ে দেওয়া , লোকচক্ষুর সম্মুখে আনা তথা কালের গর্ভে লুপ্তিকরণ হতে উদ্ধার করা।

আর , একজন যোগ্য শিষ্যের মতই রামদাস বাবাজী মহারাজ আজীবন সেই আদেশকে শিরোধার্য করে লুপ্ত বৈষ্ণব তীর্থ উদ্ধারে এবং জনমনন থেকে হারিয়ে যাওয়া লীলাগুলির ইতিহাস পুনঃ জাগরণে সদা সচেষ্ট থেকেছেন।

বর্তমান পানিহাটির গঙ্গাপাড়ে দণ্ডমহোৎসব তলায় প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে আমরা যে ‘চিড়াদধি মহোৎসব’ উপলক্ষে প্রায় চার-পাঁচ লক্ষ ভক্তসমাগম দেখি, তার হোতা কিন্তু রামদাস বাবাজী মহারাজ-ই। পরম দয়াল শ্রীনিত্যানন্দের এক ঐতিহাসিক লীলা যা প্রায় পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল(১৫১৭খ্রিষ্টাব্দে) পানিহাটির শ্রীরাঘব ভবনের অদূরে এই গঙ্গাতীরে—সেই লীলার কথা কেবল গ্রন্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু, সেই লীলাকে স্মরণ করে আবারও একবার সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে প্রণত হওয়া, অশ্রুভেজা আঁখিতে ভক্তপ্রাণ হৃদয়ে ভাববিহ্বল হওয়া—-এসবের অগ্রপথিক রামদাস বাবাজী মহারাজ। তিনি বেশ কয়েকজন অনুগত ভক্তজনাদের সাথে করে প্রতি বছর এই তিথিতে উপস্থিত হতেন পানিহাটিতে । তারপর চৈতন্য ভাগবত ,চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ থেকে পয়ার গেয়ে , তাতে আখর দিয়ে কীর্তন করে লীলা স্মরণ করতেন আর অশ্রুবন্যার প্লাবন আনতেন দণ্ডোমহোৎসব তলায় সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত সুপ্রাচীন বটবৃক্ষমূলে। প্রায় একশো বছর পূর্বে বাবাজী মহারাজ এমন সেবা শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে প্রতি বৎসর পালিত হওয়া সেই প্রথা আজকের সুবৃহৎ চিঁড়াদধি মেলার রূপ নেয়। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে বিগত দু’বছর ভক্তসমাগম বন্ধ ছিল । তবে, শ্রীপাঠবাড়ি আশ্রম থেকে প্রাণের আয়োজন অব্যাহত ছিল । বাবাজী মহারাজ চিত্রপটে গমন করেছেন সেস্থানে আর তাঁদের সংকীর্তনের ধারাও অক্ষুণ্ন ছিল । এবছর ভক্তদের আনন্দের অবধি নেই। করোনা যদিও পুরোপুরি যায়নি , কখন আবার রক্তচক্ষু নিয়ে দৃষ্টি দেবে ঠিক নেই , তবু প্রকোপ যখন কম , তখন উৎসবে ভক্তির আনন্দের অংশীদার তো হতেই হয় !

আসুন এবার দণ্ডমহোৎসবের ইতিহাস কী জানা যাক।

দণ্ড অর্থাৎ শাস্তি। শাস্তি যখন মহৎ কারণে হয় ,মহা লাভ ঘটায় ,তখন তাতে মহোৎসব করাই যায় ,এটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ,কেন শাস্তি ?

১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দে যখন পুরীধাম থেকে সন্ন্যাসী মহাপ্রভু গৌড়ে আসেন ,তখন পানিহাটির এই ঘাটে নেমে রাঘব পণ্ডিতের ভবনে ওঠেন। আবার ১৫১৭খ্রীষ্টাব্দে মহাপ্রভুর নির্দেশে নিত্যানন্দ যখন পুরীধাম থেকে বঙ্গে চলে আসেন , তখন তিনিও এই রাঘব পণ্ডিতের কাছেই ওঠেন তাঁর সকল পার্ষদদের নিয়ে। আর ,মূলতঃ নিত্যানন্দের এই আসাতেই পানিহাটির মহোৎসবের ইতিহাস লুকিয়ে আছে।
হুগলী জেলার সেসময় সমৃদ্ধপূর্ণ গ্রাম সপ্তগ্রাম। এখানকার জমিদার হিরণ্য দাস আর গোবর্দ্ধন দাস–দুই ভাই। তাঁদের একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেন রঘুনাথ দাস। রঘুনাথের হৃদয়ে ছিল তীব্র গৌরপ্রীতি । তাঁর মন সংসারে নেই। সংসার ত্যাগ করে শ্রীক্ষেত্রে গৌরাঙ্গের কাছে চলে যাবেন বলে , তিনি কতবার কত প্রচেষ্টা করেছেন।‌কিন্তু ,বাবা-জ্যাঠার প্রখর নজরদারিতে প্রতিবারই অসফল হয়েছেন। একদিন শুনলেন গৌরাঙ্গের একান্ত নিজজন নিত্যানন্দ আসছেন পানিহাটিতে। অনেক অনুনয় বিনয় করে বাবা-জ্যাঠাকে রাজী করিয়ে দর্শন করতে এলেন নিত্যানন্দকে।
নিত্যানন্দ গঙ্গাতীরে বটগাছের তলায় পিণ্ডার ওপর বসে আছেন। চারপাশে তাঁকে ঘিরে প্রায় হাজার ভক্ত দাঁড়িয়ে ,বসে। নিত্যানন্দের প্রতিপত্তি দেখে রঘুনাথ বিস্মিত। তিনি দণ্ডবৎ প্রণাম জানালেন।জমিদার পুত্রকে দেখিয়ে একজন পরিচয় দিলেন নিত্যানন্দের কাছে। নিত্যানন্দ বললেন, ” আয় ,আয় ,চোরা। এদিকে আয় । ওহ্,তুমি আমায় না বলে গৌরকে পেতে চেয়েছিলে ! তুমি জানো না ,আমি না দিলে গৌরকে পাওয়া যায় না ! গৌরাঙ্গ আমার সম্পদ। না জানিয়ে সম্পদ নিলে চুরি করা হয়। তুমি চুরি করতে চেয়েছ।তাই, তোমায় আজ দণ্ড দেব।” রঘুনাথ বললেন, ” দণ্ড পেয়ে যদি গৌরচরণ পাওয়া যায় ,তবে তাতেই আমি রাজি। দণ্ড দিয়ে আমায় গৌরাঙ্গকে দিন। বলুন ,কী শাস্তি আমার । আমি মাথা পেতে নেব, যে কোন প্রকার শাস্তি।” নিত্যানন্দ বললেন,”এখানে মহোৎসব হবে ।সকলকে চিড়ে, দই , ফল আহার করাবে তুমি। সকল খরচ তোমায় বহন করতে হবে মহোৎসবের।” মহাখুশি রঘুনাথ আয়োজন করলেন সবকিছুর।
সেই মহোৎসবে জাতপাতের সকল বিভেদ ভুলে একসাথে ছত্রিশ জাতির প্রায় হাজারজন মানুষ বসে প্রসাদ পেলেন,যা আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে এক অসম্ভব, অভাবনীয় ,অবাস্তব ব্যাপার ছিল । নিত্যানন্দের মানবমুখী , সাম্যবাদী নীতির এ এক দারুণ দৃষ্টান্ত। সারাদিন মহাসংকীর্তন ধ্বনিতে আকাশে বাতাসে মহামিলনের মহাকল্লোল উঠল। জাতিদ্বন্ধ ভুলে মানুষ আবেগের অশ্রুতে ভেসে একে অপরকে কোলাকুলি করলেন । চারিদিকে সৌভ্রাতৃত্বের সৌরভ। পদকর্তা বিস্মিত হয়ে তাইতো লিখলেন –“ব্রাক্ষ্মণে চণ্ডালে করে কোলাকুলি ,কবে বা ছিল এ রঙ্গ।”
নিত্যানন্দ অনেক কৃপা করলেন রঘুনাথকে। তিনি তাঁকে কাছে ডেকে তাঁর মাথায় নিজের চরণ স্পর্শ করিয়ে বললেন, “আজ তুমি যে পুলিন ভোজন করালে তাতে চৈতন্য মহাপ্রভু বড় প্রীত হয়েছেন তোমার প্রতি। তোমায় কৃপা করতেই তাঁর আগমন হয়েছিল এখানে। তিনি কৃপা করে চিঁড়া-দধি ভোজন করেছেন। কীর্তনে নৃত্য দর্শন করে রাত্রে প্রসাদ ভক্ষণও করেছেন। নিজে এসে তোমায় উদ্ধার করে গেছেন গৌরহরি। তোমার যত বিঘ্ন সবের বিনাশ হয়ে গেছে। তোমায় তিনি অন্তরঙ্গ ভক্ত করে নিজের কাছে রাখবেন। স্বরূপ দামোদরের কাছে তোমায় সমর্পণ করবেন। নিশ্চিন্তে থেকো, তুমি খুব শীঘ্রই তাঁর চরণ পাবে।”

এরপরই রঘুনাথের সংসারের বন্ধন মোচন হয়। তিনি শ্রীক্ষেত্রে মহাপ্রভুর কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন। মহাপ্রভু রঘুনাথকে কাছে টেনে নিলেন‌।
এই ঘটনা এই সত্যই প্রতিস্থাপিত করে যে ,গৌরাঙ্গের কৃপা নিতাইমূলা। অর্থাৎ, নিত্যানন্দ কৃপা না করলে মহাপ্রভু কৃপা করেন না। তাই সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিতাই কৃপা পাবার জন্য ,নিজেদের সকল অপরাধের মোচন করার জন্য ভক্তরা আজও চিঁড়ে-দই নিবেদন করেন নিতাই-নিমাই-এর কাছে। আজও এই তিথিতে সেখানে সপার্ষদ নিতাই-নিমাই প্রকট হন সেদিনের মত করে।
এই তিথিতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডমহোৎসব তলায় শুরু হয়ে যায় কমপক্ষে একশোটি ছাউনিতে কীর্তন । বরানগর পাঠবাড়ি আশ্রম, ভারত সেবা সঙ্ঘ, গৌড়ীয় মঠ, ইসকন,ভবা পাগলা সম্প্রদায় ,সদগুরু সম্প্রদায় ইত্যাদি নানা সংগঠন তাদের নিজের নিজের সুন্দর করে সাজানো আশ্রমমন্দির ছাউনিতে কীর্তন ,ভোগরাগ সম্পন্ন করেন। আর ,এদিনের ভোগে অবধারিত ভাবে যা নিবেদিত হয় তা হল চিড়ে,দই , মিষ্টি আর ফল। অন্নের সাথে অন্যান্য সুস্বাদু ব্যজ্ঞন কিন্তু নিবেদিত হয় না।

বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া যে দুই ভাই নিতাই-নিমাই বিরাজ করছেন , তাঁদেরকে অন্তরের আঙিনায় আবার একবার প্রেমাভিষেক করাবার জন্য এই বিশেষ দিনে ভক্তদের যাবতীয় প্রচেষ্টা তাই দেখা যায়।

অন্তর ভরে প্রণাম জানাই সপার্ষদ নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে। প্রণাম জানাই রামদাস বাবাজী মহারাজকে। আপনাদের কৃপায় এ অধমার সকল অপরাধের মোচন হোক । ভক্তসেবায় যেন এ জীবন উৎসর্গ করতে পারি—এ প্রার্থনা জানালাম।

——-সেবা অভিলাষিণী
ভক্তকৃপা প্রার্থিনী
জীবাধমা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক‌।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

গুরুতত্ত্বে-র গূঢ় রহস্য : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীমন্ মহাপ্রভু রায় রামানন্দের কাছে জানতে চেয়েছিলেন — “বিদ্যার মধ্যে কোন্ বিদ্যা জীবের হয় সার ?” বিদ্যা শব্দটি “বিদ্‌’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘জানা’। আর সার অর্থে শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ তিনি জানতে চাইলেন কী বা কাকে জানা শ্রেষ্ঠ? তখন ‘রায় কহে, ভক্তি বিনা বিদ্যা নাহি আর। ভক্তি বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ।” ভক্তিকে জানাই সর্বোত্তম বিদ্যা। ভক্তি কি? ভক্তি অর্থাৎ ভজনা। অতএব, ভগবানকে ভজনা করতে জানাই হল শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। এ পৃথিবীতে যে কোন ধরণের শিক্ষার জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। এমনকি যা আমরা প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে বা অনুভবের দ্বারা শিখি তাও এ সংসারে কারো না কারো প্রেরণা বা অবদান। তাহলে জাগতিক বিদ্যা শিক্ষা করতে যখন শিক্ষকের প্রয়োজন তখন ভক্তিবিদ্যা বা পরাবিদ্যার মতো গম্ভীর বিষয়কে জানার জন্য, শেখার জন্যও একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। এই শিক্ষকই হলেন ‘গুরু’। গুরু শব্দটি ‘গুড়’ ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘রক্ষা করা’। যিনি সংসার মহাদাবাগ্নি থেকে রক্ষা করেন তিনিই গুরু। ‘গু’অর্থ ‘অন্ধকার’, ‘রু’ অর্থ ‘দূর করা’। যিনি অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে দেন তিনিই গুরু। গুরু অর্থে ‘হিতকারী’। গুরু অর্থে ‘উপদেষ্টা’। কথিত আছে— “এক অক্ষর শিখায় যে, জন্মে জন্মে গুরু সে।” আবার গুরু অর্থ ভারীও হয়। অতএব এই যে, ‘গুরুতত্ত্ব’ তা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, গূঢ়, ও রহস্যময় বিষয়ও।

আমাদের জীবনে গুরুর প্রয়োজন কতটা? গুরু বিনা কি গতি নেই? ভগবানকে মন থেকে ডাকলে, ভক্তি করলেই তো চলে, তার জন্য আবার গুরুর কি দরকার—এ প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনেই। তাহলে সেই উত্তর স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকেই আমরা শুনি। তিনি বলেছেন – ভবসমুদ্র পাড় করতে মানব- শরীর হল এক সুদৃঢ় নৌকা। যা প্রাপ্ত হওয়া দুর্লভ। সেই দুর্লভ বস্তু সুলভ হয়ে যখন কেউ মনুষ্য যোনিতে জন্মগ্রহণ করে; গুরু-কে তার জীবন সমুদ্র পথের কাণ্ডারী নিযুক্ত করে; তখন শুধুমাত্র স্মরণ করা মাত্রই আমি অনুকুল বায়ু হয়ে তাকে লক্ষ্যপথে নিয়ে যাই। আর যে তা করে না, সে নিজের আত্মহননের পথ প্রশস্ত করে। তার অধঃপতনের জন্য সে নিজেই দায়ী হয়।’ (শ্রীমদ্ ভা.-১১/১০/১৭)।

অতএব ভগবানের কথা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ভবসমুদ্র পার করতে গুরুর চরণাশ্রয় করলেই ভগবান ভক্তের উদ্ধারের জন্য নিজের হাতখানা বাড়িয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে, শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলেন বালক ‘ধ্রুব’ মহারাজ। তপঃকর্মের শেষ সীমায় পৌঁছালেও বালক ধ্রুব-কে দর্শন দিতে পারছিলেন না শ্রীনারায়ণ। তখন শ্রীভগবানের আদেশে নারদ মুনি ধ্রুবকে দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্রে দীক্ষা দান করলেন। দীক্ষিত হাবর পর ধ্রুব শ্রীনারায়ণের সাক্ষাৎ দর্শনের কৃপালাভ করলেন। তাই গুরুর যে কী গুরুত্ব তা সহজেই অনুমেয়। কলিযুগ পাবনাবতার শ্রীমন্ মহাপ্রভু নিজে পরতত্ত্বের শেষ সীমা হয়েও শ্রীঈশ্বরপুরীপাদের কাছে দীক্ষা নিয়ে গুরুকরণ করে দেখিয়েছেন গুরুর প্রয়োজনীয়তা। দীক্ষা কি? জীব গোস্বামীপাদ তাঁর ‘ভক্তিসন্দর্ভ’ গ্রন্থে বলেছেন—‘যা থেকে দিব্যজ্ঞান লাভ হয় ও পাপসমূহ সম্যকরূপে নষ্ট হয় তাই দীক্ষা।’ (২৮৩ অনুঃ)। এখন এই দিব্যজ্ঞান হাটে-বাজারে বিকোবার বস্তু নয় যে গিয়ে ক্রয় করবো । বা, গ্রন্থ পড়ে জ্ঞানার্জনের দ্বারাও শুধু লাভ হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে একমাত্র উপায়—‘শ্রীগুরুদেব’। শ্রীগুরুদেব ভিন্ন অন্য কেউ দীক্ষাদান করতে পারেন না। বা ঘুরিয়ে বললে, যিনি দীক্ষা দান করেন তিনিই শ্রীগুরুদেব। “অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকায়। চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।” অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে দীক্ষা নামক দিব্যজ্ঞানের অঞ্জনশলাকা দ্বারা যিনি জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন করেন, তিনিই শ্রীগুরুদেব, তাঁকে প্রণাম করি।

শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ তাঁর ‘শ্রীভক্তিরসামৃত সিন্ধু’ গ্রন্থে যে চৌষট্টি প্রকার ভজন অঙ্গের নির্দেশ করেছেন তার প্রারম্ভেই ভক্তি মন্দিরে প্রবেশের দ্বারস্বরূপ তিনটি বিশেষ অঙ্গের কথা লিখেছেন—১) গুরুপদাশ্রয়, ২) শ্রীকৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে ভাগবত ধর্ম শিক্ষা, ও ৩) বিশ্বাসের সঙ্গে শ্রীগুরুসেবা। শ্রীগুরুপদাশ্রয় বলতে দীক্ষাগ্রহণের পূর্বে কিছুকাল শ্রীগুরুদেবের কাছে বাস করে তাঁর আনুগত্যে থেকে নিষ্কপট সেবা পরিচর্যা দ্বারা গুরুদেবকে প্রসন্ন করা-কে বোঝানো হয়েছে। এর ফলে গুরু ও শিষ্য একে অপরকে অনুধাবন করতে পারেন। শিষ্য দীক্ষাগ্রহণের যোগ্যতা ও ভজনযোগ্যতা লাভ করে। আবার শিষ্যের সেবার আন্তরিকতা দেখে গুরুদেবের চিত্ত করুণার্দ্র হয়ে ওঠে। আর তার ফলে করুণা বিগলিত ও সন্তুষ্ট শ্রীগুরুদেবের কাছ থেকে পাওয়া দীক্ষামন্ত্র পরম পুরুষার্থ ও সৌভাগ্যজনক হয় শিষ্যের কাছে। এ প্রসঙ্গে ঠাকুর নরোত্তমের দৃষ্টান্ত প্রাতঃস্মরণীয় আমাদের কাছে। শ্রীল লোকনাথ গোস্বামী সংকল্প করেছিলেন যে তিনি জীবনে কোন শিষ্য গ্রহণ করবেন না। আর ঠাকুর নরোত্তম তাঁকেই মনে মনে গুরুরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। তাই তাঁর থেকে দীক্ষাগ্রহণ করাটাই ছিল নরোত্তম ঠাকুরের অভীষ্ট। তিনি প্রতিদিন লোকনাথ প্রভুর প্রাতঃকৃত্য করার স্থানটি সূর্যোদয়ের আগেই মার্জন করে পরিস্কার করে রাখতেন। আর তারপর “বৈষ্ণবের দেহ প্রাকৃত কভু নয়। অপ্রাকৃত দেহ ভক্তের চিদানন্দময় ।।” এই জ্ঞানে লোকনাথ প্রভুর বিষ্ঠাকেও অপ্রাকৃত বস্তু হিসেবে মেনে সেই বিষ্ঠালাগানো সম্মার্জনীটি (ঝাঁটাটি) নিজের বুকে চেপে ধরে ‘হা গুরুদেব’ বলে ক্রন্দন করতেন। এদিকে লোকনাথ গোস্বামী মনে মনে সংকুচিত হন, এই ভেবে যে— কোন ব্রজবাসী এমন সেবা করে প্রতিদিন তার জন্য ! এতে যে তার পাপ হচ্ছে !

দীর্ঘ এক বৎসর পর বহু চেষ্টা করে লোকনাথ গোস্বামী একদিন হাতে-নাতে ধরলেন নরোত্তম ঠাকুরকে, অমন হীনসেবা দানের সময়। বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন নরোত্তম ঠাকুরের গুরুভক্তি দেখে। সেই দিনই নিজের সংকল্প ত্যাগ করে দীক্ষা দিলেন নরোত্তম ঠাকুরকে।

“গুরুকৃপা হি কেবলম্”—গুরুকৃপাই শিষ্যকে নিতাই-গৌর-গোবিন্দের প্রতি একনিষ্ঠ প্রেমসেবায় ব্রতী করেন। শ্রীললিতা সখী মাতা ঠাকুরাণী বলেছেন— “শ্রীগুরুকৃপাই সাধনভক্তি, ভাবভক্তি ও প্রেমভক্তির মূল।” তাই গুরুসেবা দ্বারা গুরুপ্রসন্নতা অর্জন করা একান্তরূপে বাঞ্ছনীয় এবং চরম ও পরম কর্তব্য শিষ্যের কাছে। গুরুসেবা দুই প্রকার—১) পরিচর্যারূপ সেবা ও ২) প্রসঙ্গরূপ সেবা। শ্রীগুরুদেবকে জলপ্রসাদ বা ভোজ্যপ্রসাদ নিবেদন, স্নানাদির জন্য জল আহরণ, তাঁর শ্রীঅঙ্গমার্জন, বস্ত্রধৌতাদি, অথবা অসুস্থ থাকাকালীন পথ্যাদি দান, শ্রীঅঙ্গের সেবা ইত্যাদি হল পরিচর্যারূপ সেবা তাঁর। আর, ভাগবতী কথা পাঠ করে , কৃষ্ণনামগান কীৰ্ত্তন করে শ্রবণ করানো—- ইত্যাদি হল প্রসঙ্গরূপ সেবা। শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী যখন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন তখন শ্রীঈশ্বরপুরী তাঁর কতই না সেবা করেছেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে পাই—“ঈশ্বরপুরী গোসাঞি করে শ্রীপাদ সেবন। স্বহস্তে করেন মল-মূত্ৰাদি মার্জন।।’ অতএব নিষ্ঠসহ পরিচর্যারূপ সেবা করেছেন। আবার “কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণলীলা শুনায় অনুক্ষণ।” কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণকথা শ্রবণ করিয়ে প্রসঙ্গরূপ সেবাও করেছেন। সেবায় সন্তুষ্ট গুরু শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী আশীর্বাদ করলেন শিষ্য ঈশ্বরপুরীকে “তোমার হোক কৃষ্ণের প্রসাদ।” সেই আশীর্বাদের গুণেই প্রেমের সাগর হলেন তিনি আর পরিণামে স্বয়ং ভগবান শ্রীমন্ মহাপ্রভুকে শিষ্যরূপে পেলেন। অতএব, দীক্ষাগ্রহণান্তে শ্রীগুরুসেবার বিশেষ প্রয়োজন। সেবা দ্বারা সাধকের সকল অনর্থ নষ্ট হয়ে যায়। সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্তশুদ্ধির উপায় ‘শ্রীগুরুদেব’। সকল অভাব পূরণের উপায় ‘শ্রীগুরুদেব’। সিদ্ধ জগন্নাথ দাস বাবার শিষ্য তথা শ্রীঅঙ্গসেবক বিহারীজী গুরুচরণ-ছাড়া-না হবার আদর্শ। জগন্নাথ দাস বাবা বলেছিলেন— “হ্যাঁ রে বিহারী ! তুই আমায় চাস, নাকি টাকা চাস? ভেবে বল। ভাবছি তোকে একগাড়ী টাকা পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করে যাব আমার মৃত্যুর পরে।” বিহারী হাসতে হাসতে বললেন- “বাবা। তোমার আবার টাকা কই গো ! থাকো তো লোকের দয়া করে তৈরী করে দেওয়া কুটীরে, আর ভিক্ষা করে আনা চালে ঠাকুরের প্রসাদান্ন পাও। তুমি কোথায় টাকা পাবে, বল?” সিদ্ধ বাবা বললেন, “আমায় কয়েকদিন পরই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিতে আসবেন। তখন আমি বলবো তাঁকে— বিহারী তো আমার অনেক সেবা করেছে, ওকে এক গাড়ী টাকা পাইয়ে দাও। গৌরাঙ্গ প্রভু তোর টাকার ব্যবস্থা করে দেবেন।” এইবার বিহারী সঙ্গে সঙ্গে বললেন- “না, না বাবা ! টাকা আমার চাই না, আমার শুধু তোমার শ্রীচরণ চাই।” তৃপ্ত হয়ে বাবা তখন আশীর্বাদ করে বললেন, “বেশ। তোর কোনদিন কোন অভাব হবে না। তুই শুধু শ্রীনাম করে যাস, বাকী সব শ্রীনামের প্রভাবে ঠিক হয়ে যাবে।” এই ঘটনার চারদিন পরই সিদ্ধ বাবা দেহ রাখলেন। তিনি ১৪০ বৎসর ধরাধামে ছিলেন। তাঁর নিত্যলীলায় গমনের পর বিহারীই তাঁর যাবতীয় ক্রিয়া-কর্ম করলেন। সুতরাং, শ্রীগুরুচরণ প্রাপ্তিই একমাত্র লক্ষ্য হয় যথার্থ সাধকের।

“দাস বংশী কহে, ভজিলে ভজন নহে, গুরকৃপা ভজনের মূল।” শ্রীগুরুস্বরূপের চিন্তনই হল ধ্যানের মূল, পূজার মূল শ্রীগুরুচরণ পূজা, মন্ত্রের মূল শ্রীগুরুবাক্য আর ভক্তির মূল হল শ্রীগুরুভক্তি। যার প্রতি গুরুদেব তুষ্ট হন, স্বয়ং শ্রীহরিও তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। কৃষ্ণ অপ্রসন্ন হলে গুরুদেব তাঁর ভজন দ্বারা কৃষ্ণের মন ফেরাতে পারেন সেই শিষ্যের প্রতি। কিন্তু গুরু অসন্তুষ্ট হলে, কৃষ্ণ গুরুকে প্রসন্ন করতে কোন চেষ্টা করেন না। তাই তো বলা হয়েছে, “কৃষ্ণ রুষ্ট হলে গুরু রাখিবারে পারে। গুরু রুষ্ট হলে কৃষ্ণ রাখিবারে নারে।।’
তাহলে এমন মহিমাময় গুরুদেবকে কী ভগবৎস্বরূপ জ্ঞান করে গঙ্গাজল-তুলসী দিয়ে পূজা করা উচিৎ? কারণ বলা হয়েছে— “গুরু কৃষ্ণরূপ হন শাস্ত্রের প্রমাণে । গুরুরূপে কৃপা করেন শিষ্যগণে।।” তবে তার উত্তর হল, গুরু কেবল শিষ্যের কাছে আরাধ্যস্বরূপ, সমগ্র জগৎ-এর কাছে নন। তিনি শিষ্যের কাছে প্রিয়তমাংশে ও পূজাতমাংশে কৃষ্ণের সাথে অভিন্ন কিন্তু স্বরূপাংশে ভিন্ন। অর্থাৎ শিষ্যের কাছে গুরুদেব কৃষ্ণের মতই প্রিয় ও পূজনীয়, কিন্তু ভগবানের ষড়শ্বৈর্যশালী যে স্বরূপ তা গুরুতে নেই। গুরুর ভিতর সাধক-ভক্ত ভবন প্রকাশিত হয়। তিনি নিজেকে একজন সাধক ভিন্ন অন্য কিছু ভাবেন না। তাই তাঁর শ্রীচরণে তুলসী-গঙ্গাজল নিবেদন করে কৃষ্ণজ্ঞানে পূজা করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন। এ প্রসঙ্গে, উৎকলে ‘বড়বাবাজী’ নামে খ্যাত শ্রীরাধারমণচরণদাস বাবা অপূর্ব সিদ্ধান্ত করে গেছেন।
একবার শ্রীগুরুপূর্ণিমায় পুরীর ঝাঁজপিটা মঠে উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে সংশয় দেখা দেয় যে, শ্রীগুরুদেব কে কী পৃথক দ্রব্য দিয়ে পূজা করা উচিৎ নাকি প্রসাদী দ্রব্যে পূজা করা সঙ্গত? কারণ শাস্ত্রে গুরু-কৃষ্ণের অভিন্নতার প্রমাণ আছে বিস্তর। তাই সর্বাগ্রে গুরুপূজা করা উচিৎ। এমনকি কোথাও বলাও নেই যে কৃষ্ণের প্রসাদী দ্রব্যে তাঁকে ভোগ লাগানো বা পূজা করা বিধেয়। তাহলে উপায়? তখন বড়বাবাজী মহাশয় বললেন— “শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রদর্শিত উপাসনা প্রণালীর নাম রাগানুগা পন্থা। এই উপাসনার মূল ভিত্তিই ‘আনুগত্য’ অর্থাৎ গুরুর অনুগত হয়ে ভজন। এমন গুরুকে সাক্ষাৎ ভগবদ্‌-বুদ্ধিতে পূজা করলে উনি যতটা সুখী হন তার থেকে বেশী সুখ পান অনুগত ভাবের আরাধনায়। অর্থাৎ কৃষ্ণের প্রাসদী থালায় তাঁকে বরণ করলে। কারণ তিনি তো নিজেও সাধক। আর তাই শিষ্যের কাছে ‘সকল ছাড়িয়া আজ্ঞা বলবান’ অর্থাৎ গুরুর আজ্ঞানুসারে কর্ম করাই শিষ্যের কর্ত্তব্য । সেবার অর্থ তো সুখ দেওয়া। আমি হয়তো সাক্ষাৎ কৃষ্ণ ভেবে গুরুকে সেবা-পূজা করলাম অনেক কিন্তু তাতে তিনি সুখী হলেন না। তাহলে সেই সেবা করে আমি নিজেও সুখলাভ করতে পারবো কী? শাস্ত্রে প্রমাণ ও যুক্তি যাই থাক শিষ্যের কাছে গুরু আজ্ঞাই সর্বথা পালনীয়। তাই গুরুসেবা করে গুরুকে সুখ দিতে কৃষ্ণের মালা, প্রসাদে গুরুপূজা করাটাই বিধেয়, সমুচিত।”

শ্রীপাদ রামদাস বাবাজী মহাশয় বলেছেন যে— “শ্রীগুরু পাদপদ্মই হলেন শেষ প্রাপ্তি। নিতাই-গৌর বা অন্য যা কিছুর সেবা সকলই তাঁর (গুরুদেবের) সুখের জন্য। শ্রীগুরদেবকে সুখ দিতে হলে তিনি যা পেলে সুখ পাবেন তাই দিতে হবে। সেবা মানে নিজে সুখ পাওয়া নয়। সেব্যকে সুখ দিয়ে, তাঁরই সুখে নিজে সুখ পাওয়া। এ সুখ পাওয়া নিজের সুখ পাওয়ার চেয়ে কোটিগুণ বেশি …. সেবকের তো ওই ভজন-সাধন, সর্বদা শ্রীগুরুদেবের সুখের পানে ও মুখের পানে চেয়ে থাকা।”

শ্রীরাধারমণদেবের অশেষ কৃপাস্নাত সবিশেষ গুরুগতপ্রাণ শিষ্য শ্রীশীতলচরণ দাস বাবাজী মহাশয় সিদ্ধ মহাত্মা ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে সাক্ষাৎকালে একবার প্রশ্ন করেছিলেন—‘ঈশ্বর দর্শন করতে শ্রীগুরুর কৃপালাভ কতটা অপরিহার্য?’ ত্রৈলঙ্গ স্বামীজী হিন্দীতে যে উত্তর দিয়েছিলেন তার বাংলা অনুবাদ করলে হয়— “জগতে শ্রীগুরু হতে আর কোন বস্তুই বড় অর্থাৎ গুরু নয়। শ্রীগুরু ব্যতীত আর সকলই লঘু। জপ-তপ-আরাধনা, পুত্র-পরিবার- সংসার—-এ সবই শ্রীগুরুচরণলাভের চেয়ে বড় নয়। সাধারণভাবে শ্রীগুরুদেব দুইভাবে পাওয়া যায়—দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু। আবার বিশেষভাবে গুরুকে তিনভাবে দর্শনলাভ হয়—জগৎগুরু, দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু। চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রাদি যে শক্তির ইঙ্গিতে নিরন্তর আপন কার্য সমাধা করে চলেছে নিয়মের গণ্ডীতে থেকে—– সে শক্তিকে জগদগুরু বলা যায়।
যখন কোন শক্তি জীবের হৃদয়ে জগদ্‌গুরুকে জানবার বা বোঝার জন্য প্রেরণা জাগিয়ে জগৎগুরুর পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তখন সেই শক্তিকে দীক্ষাগুরুর শক্তি বলা হয়। এই বিশ্বচরাচর হচ্ছে জগদ্গুরুর মায়াজাল। ব্রহ্মাণ্ডের পরমানু থেকে ব্রহ্মা পর্যন্ত পশুপাথী, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতা, গ্রহনক্ষত্র প্রভৃতি মনুষ্য ও মনুষ্যেতর জীবজগত থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করার প্রয়োজন পরে। যার কাছ হতে সেই শিক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে পাওয়া যায়, তখন তাঁকে বা সেই শক্তিকে শিক্ষাগুরুর শক্তির প্রভাব বলা যায়। জগদ্গুরুকে জানতে শিক্ষাগুরুর প্রয়োজন অপরিহার্য।”

অতএব, ‘গুরুকৃপা হি মূলম্’ গুরুকৃপাই মূল, গুরুকৃপাই একমাত্র সহায়, একমাত্র অবলম্বন । শ্রীগুরুদেব নির্দেশিত পথে নববিধা ভক্তি (শ্রবণ, কীৰ্ত্তন, স্মরণাদি …) যাজন করে আমরা নিতাই-গৌর-গোবিন্দের প্রেমসেবা করার যোগ্যতা অর্জন করবো। ভজনরাজ্যে প্রবেশ করিয়ে দেন ভক্ত-কে তাঁর গুরুদেব আপন ভজনানুভূতির শিক্ষা ও সকরুণ কৃপা দ্বারা। গুরুকৃপাতেই ভজনপথ হয় সুসংহত, শাস্ত্রানুযায়ী সঠিক ও প্রেমপূর্ণ।

কলিযুগে আমাদের জগদ্গুরু হলেন পতিত উদ্ধারণ শ্রীমন্ নিত্যানন্দ প্রভু। তাইতো শ্রীরামদাস বাবাজী মহাশয় বলেছেন , “যত দেখ শ্রীগুরুরূপ, নিত্যানন্দ প্রকাশ-স্বরূপ।… দেখে গুরু স্বরূপ নানা, যেন ভিনু ভিনু মনে করো – না ! অনুকূলে বা প্রতিকূলে নিতাই অনন্ত গুরুরূপে।…নিতাই যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যে যেমন তার কাছে তেমন।…যেদিন শ্রীগুরুরূপে হাত ধরেছে, সেদিন সাধন শেষ হয়েছে। গুরুরূপে দেছে পদছায়া, শেষ হয়েছে সব চাওয়া পাওয়া । …. কাজ কি অন্য উপাসনা, আমার কাজ তাঁর পদে বিকানা।”

তাই একান্ত নিবেদন, শ্রীগুরুতত্ত্বের’র মতো গূঢ় গম্ভীর গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব নিয়ে লেখার চেষ্টা আমার মত ভজনহীনা, অধমার ধৃষ্টতা—বই আর কিছু নয়। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো! “বিধি কী এ সাধ পূরাবে আমার।” সাধ্যের বাইরে গিয়ে সাধপূরণ করার আস্ফালন শুধু। সকল গুরুজন তথা গুণীজন, সাধু-গুরু-বৈষ্ণবের কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থিনী, এ হেন ধৃষ্টতার জন্য। আর সেই সাথে সকলের শ্রীচরণে অনন্তকোটি প্রণাম নিবেদন করে আশীর্বাদ ভিক্ষা করি যেন গুরু-গোবিন্দের চরণারবিন্দে সেবা করাই জন্মজন্মান্তরের একমাত্র অভীষ্ট হয় আমার।

জয় শ্রীগুরুদেব। জয় শ্রীশ্রীনিতাই। জয় শ্রীশ্রীগৌরসুন্দর ।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪-তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ । তিনি বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পশ্চিম বর্ধ্মান জেলা) আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর ডাক নাম “দুখু মিয়া” । তাঁর জীবনকে আমরা চারটি ভাগে ভাগ করতে পারিঃ- প্রাথমিক জীবন ১৮৯৯ — ১৯১৭, সৈনিক জীবন ১৯১৭ – ১৯২০, সাহিত্য জীবন ১৯২০ – ১৯৪২ ও অসুস্থতা জীবন ১৯৪২ – ১৯৭৬ ।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয় । স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াজ্জিন (নমাজের সময় হলে অংশ নেওয়ার জন্য আজান দেন) হিসেবেও কাজ করেছিলেন । কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন । ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন । সেই সময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন । তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন । জেলে বন্দী অবস্থায় লেখেন “রাজবন্দীর জবানবন্দী” । নজরুল প্রায় ৩০০০গান রচনা করেন । অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেছেন তিনি নিজে, সেগুলি নজরুল গীতি নামে পরিচিত ।
কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন বাঙালি কবি এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি । তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রেখে গেছেন । তিনি বাংলা সাহিত্যে, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব । ভারত ও বাংলাদেশ — দুই দেশে তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত । তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হতো । তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের ও দাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ । বিশেষভাবে উল্লেখ থাকে যে, বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম । কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, সাম্য, আর বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন আজীবন । যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনে ও কাজে বিদ্রোহী কবি । তিনি প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং শেকল ভাঙ্গার গানের মতো কবিতা । “অগ্নিবীণা” হাতে তাঁর প্রবেশ, “ধূমকেতুর” মতো তাঁর প্রকাশ । বাংলা কবিতায় নজরুলের আবির্ভাব একেবারেই উল্কার মতো । কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা জুটিয়েছে । বাংলা কাব্যে একটি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন । সেটা হচ্ছে গজল । শ্যামাসঙ্গীত ও ভক্তিগীতিও রচনা করেন । সংগীত বিশিষ্টজনদের মতে রবীন্দ্রনাথ – পরবর্তি নজরুলের গান অনেকটাই ভিন্ন ধরনের নির্মাণ । অধিকাংশ গান সুর প্রধান । বৈচিত্রপূর্ণ সুরের লহরী কাব্যকথাকে তরঙ্গায়িত করে এগিয়ে নিয়ে যায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন — “ছন্দ ও সরস্বতির বরপুত্র” হিসাবে ।
যদিও উল্লেখিত তবুও বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা । তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন । তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল । তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক । রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নজরুল চেয়েছিলেন । কিন্তু তিনি মনে করতেন এর পথে প্রধান বাধা সাম্প্রদায়িক সংঘাত । সেইজন্য তিনি “দুর্গম গিরি কান্তার মরু” গানে বলেছিলেন —
“হিন্দু না ওরা মুসলমান ওই জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন ?
কাণ্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার ।“
তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে । তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস ।
দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়েছিলেন । তাই তাঁর বিখ্যাত কবিতা “বল বীর / বল উন্নত মম শীর” । অনেকেই বলেন “বিদ্রোহী” কবিতা তাঁকে অমর করে রেখেছে ।
১৯৭২ সালের ২৪শে মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন । রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন । কবির বাকী জীবন বাংলাদেশেই কাটে ।
পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে “জাতীয় কবি”র মর্যাদা দেওয়া হয় । তাঁর রচিত “চল চল চল ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল” বাংলাদেশের রণসংঙ্গীত হিসাবে গৃহীত ।
১৯৭৬ সালের ২৯শে আগষ্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবির জীবনাবসান ঘটে । কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় । এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ।
পরিশেষে এটাই বলার, ৭৭ বছর তিনি বেঁচেছিলেন এবং এই ৭৭ বছর ছিল তাঁর সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস । কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মদিনে তাঁকে জানাই শতকোটি প্রণাম । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
———–০———

Share This